তাওহীদের সংজ্ঞা
তাওহীদ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “وَحَّدَ” (ওয়াহ্হাদা) থেকে, যার অর্থ এক করা। ইসলামী পরিভাষায় তাওহীদ মানে আল্লাহ্ তাআলাকে তাঁর রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যাহ ও আসমা ও সিফাত-এ এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে স্বীকার করা।
আল্লাহ বলেন: “তোমার রব একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি দয়াময়, পরম করুণাময়।” (সূরা আল-বাকারা ২:১৬৩)
তাওহীদের তিনটি বিভাগ
🌸১️ তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ (প্রভুত্বে একত্ব)
তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ অর্থ — আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, মালিক, রিজিকদাতা, জীবনের দাতা ও মৃত্যুর নিয়ন্তা। তিনিই এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তা পরিচালনা করছেন। তাঁর আদেশ ছাড়া একটি পাতা পর্যন্ত পড়ে না। পৃথিবীতে যে সুখ, দুঃখ, জীবিকা, মৃত্যু, বৃষ্টি — সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।
কুরআনের ঘোষণা:
“আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা, এবং তিনি সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক।”
(সূরা আয-যুমার ৩৯:৬২)
অর্থাৎ, কোনো মানুষ, নবী, ফেরেশতা বা পীর-আওলিয়া— কেউই নিজ ক্ষমতায় কিছু করতে সক্ষম নয়। তারা কেবল আল্লাহর আদেশ ও অনুমতি অনুযায়ী কাজ করতে পারে। তাই যেকোনো উপকার বা ক্ষতির বিশ্বাস শুধু আল্লাহর প্রতি রাখা ইমানের দাবি।
আরও বলেন আল্লাহ:
“বলুন, তোমাদের জন্য কে রিজিক দেয় আকাশ থেকে ও জমিন থেকে?
কে শ্রবণ ও দর্শনশক্তির অধিকারী করে দেয়?
কে মৃত থেকে জীবিত এবং জীবিত থেকে মৃত বের করে আনে?
তারা বলবে, আল্লাহ। তাহলে কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?”
(সূরা ইউনুস ১০:৩১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, এমনকি মুশরিকরাও স্বীকার করত যে আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালনাকারী, কিন্তু তারা ইবাদতে অন্যদের শরীক করত। তাই কেবল আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করাই যথেষ্ট নয়— বরং তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী ইবাদত ও আনুগত্য করতে হবে।
নবী মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর কাছে এইভাবে দো‘আ করতেন — “হে আল্লাহ! সবকিছুই তোমার হাতে, তুমি যাকে চাও দাও, যাকে চাও বঞ্চিত করো।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান — হাদীস নং 4790 [Darussalam]; Hadith Foundation: 1761)
- আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা — কোনো শরীক নেই।
- রিজিক, জীবন-মৃত্যু, উপকার-কষ্ট — সব তাঁর হাতে।
- সৃষ্টিতে বা পরিচালনায় কাউকে শরীক করা শির্ক।
- সঠিক রুবুবিয়্যাহের বিশ্বাস মানুষকে প্রকৃত তাওহীদের দিকে পরিচালিত করে।
🌸২️ তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ (ইবাদতে একত্ব)
তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ অর্থ — ইবাদতের সমস্ত কাজ একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা। অর্থাৎ, নামাজ, দো‘আ, রোযা, কুরবানি, মান্নত, ভয়, আশা, তাওয়াক্কুল, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা — এসব কেবল আল্লাহরই জন্য হবে। অন্য কারো জন্য ইবাদতের কোনো অংশ করলে তা শির্ক (অংশীদার স্থাপন) হিসেবে গণ্য হয়।
কুরআনে আল্লাহ বলেন: “আমি মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।” (সূরা আয-যারিয়াত ৫১:৫৬)
এই আয়াত স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহর ইবাদত করা। তাঁরই দাসত্ব করা এবং অন্য কারো ইবাদত না করা — এটাই তাওহীদের মূল দাবি।
সুতরাং কেউ যদি দো‘আ করে পীর-আওলিয়ার নামে, মান্নত দেয় কোনো মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে, কুরবানি করে কারো কবরের পাশে — তাহলে সে ইবাদতের অংশ অন্য কারো প্রতি করেছে, যা শির্কে আকবর বা বড় শির্ক।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “দো‘আ ইবাদতের মর্ম।” (সুনান আত-তিরমিযী, কিতাবুদ দা‘ওয়াত — হাদীস নং 2969 [Darussalam]; Hadith Foundation: 3371)
এই হাদীসের অর্থ হলো — দো‘আ করা মানেই আল্লাহর ইবাদত করা। তাই যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে (যেমন — “হে পীর সাহেব, আমার বিপদ দূর করুন”), তাহলে সে ইবাদতে অন্যকে শরীক করল। এটি তাওহীদের পরিপন্থী এবং ঈমান নষ্টকারী কাজ।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন — “যে ব্যক্তি বলে, আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারি, সে তাওহীদের দাবিদার নয়।” (আল-ফিকহুল আকবর)
তাই মুসলমানের ইমানের মূল ভিত্তি হলো — ইবাদতের সবকিছু কেবল আল্লাহর জন্য করা, এবং ইবাদতে কাউকে শরীক না করা। এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত না হলে অন্য কোনো আমল আল্লাহর কাছে কবুল হয় না।
- ইবাদতের প্রতিটি কাজ (দো‘আ, সিজদা, তাওয়াক্কুল, রিজিক চাওয়া) কেবল আল্লাহর জন্য।
- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা শির্ক।
- কুরআন-হাদীস অনুযায়ী ইবাদত করলে তাওহীদ পরিপূর্ণ হয়।
- তাওহীদুল উলুহিয়্যাহই ইমানের আসল চাবিকাঠি।
🌸৩️ তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণে একত্ব)
তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত অর্থ — আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে একত্ব ঘোষণা করা। অর্থাৎ, আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহর নাম ও গুণগুলো কুরআন ও সহীহ হাদীসে যেভাবে এসেছে, সেভাবেই সেগুলোকে স্বীকার করতে হবে; না বিকৃতি করতে হবে, না অস্বীকার করতে হবে, আর না সেগুলোকে কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনা করা যাবে।
কুরআনে আল্লাহ বলেন: “তাঁর সমতুল্য কেউ নেই, এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা আশ-শূরা ৪২:১১)
এই আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন — তাঁর কোনো সাদৃশ্য বা তুলনা নেই। তিনি যেমন শুনেন, তেমন কোনো সৃষ্টির শ্রবণ নয়; তিনি যেমন দেখেন, তেমন কোনো সৃষ্টির দৃষ্টি নয়। তাঁর গুণগুলো আল্লাহরই উপযুক্ত মর্যাদায় সীমাবদ্ধ।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন — তাঁকে তাঁর সুন্দর নামগুলো দিয়েই ডাকতে হবে। যেমন — আর-রহমান (পরম দয়ালু), আর-রহিম (পরম করুণাময়), আল-গফুর (ক্ষমাশীল), আল-কবির (মহান)। কোনো নাম বা গুণ আমরা নিজে থেকে তৈরি করতে পারব না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম রয়েছে; যে ব্যক্তি সেগুলো মুখস্থ করে এবং তার অর্থে বিশ্বাস রাখে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাওহীদ — হাদীস নং 2736 [Darussalam]; Hadith Foundation: 6444)
অর্থাৎ, আল্লাহর নাম শুধু মুখস্থ করার জন্য নয়, বরং তাঁর গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস রেখে জীবনে তা প্রতিফলিত করাই আসল উদ্দেশ্য। যেমন — আল্লাহ “আর-রহমান” মানে আমরা অন্যদের প্রতি দয়া করি; আল্লাহ “আল-আদল” (ন্যায়বিচারক) — তাই আমরাও ন্যায়বিচার করি।
আহলে সুন্নাতুল জামাআহ বিশ্বাস করেন — আল্লাহর গুণাবলিতে না বিকৃতি করা যাবে, না অস্বীকার করা যাবে, আর না মানবগুণের সাথে তুলনা করা যাবে। আমরা কেবল বলি: “আমরা যেমন শুনেছি, তেমনই ঈমান এনেছি।” (শরহুস সুন্নাহ)
এই আয়াত আল্লাহর গুণের নিখুঁত সমন্বয় বোঝায় — আল্লাহ শোনেন আমাদের প্রতিটি দো‘আ, দেখেন আমাদের প্রতিটি কাজ। কিন্তু তাঁর দেখা ও শোনা মানুষের মতো নয়। এই বিশ্বাসই তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের প্রকৃত অর্থ।
- আল্লাহর সব নাম ও গুণ কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী মানতে হবে।
- তাঁর নাম ও গুণ বিকৃতি, অস্বীকার বা তুলনা করা যাবে না।
- আল্লাহর গুণাবলি যেমন শুনেছি, তেমনই বিশ্বাস করতে হবে — কেমন তা না জেনে।
- এই বিশ্বাস আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সম্মান ও ভালোবাসার প্রকাশ।