সূরা আল-বাকারা
আয়াত সংখ্যা: ২৮৬, রুকু সংখ্যা: ৪০
সূরা আল-বাকারা অর্থ “গরু”। এটি কুরআনের দ্বিতীয় সূরা এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সূরা। এতে মোট ২৮৬টি আয়াত রয়েছে। এই সূরাটি মাদানী সূরা — অর্থাৎ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এতে ইসলামী সমাজ, শরীয়ত, ঈমান, নামাজ, রোযা, হজ, জিহাদ, ন্যায়বিচার ও পারিবারিক বিধানসহ জীবন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ নকশা উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলের ইতিহাস, তাদের অবাধ্যতা ও শিক্ষা তুলে ধরেছেন, যাতে মুসলমানরা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সূরাটির নামকরণ হয়েছে আয়াত ৬৭–৭৩-এ উল্লিখিত "গরু জবাইয়ের ঘটনা" থেকে।
🌿 সূরা আল-বাকারা’র মূল বিষয়সমূহ:
- আল্লাহর একত্ব, নবুয়ত, আখিরাত ও হেদায়াতের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা।
- মুমিন, কাফির ও মুনাফিকদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য।
- আদম (আঃ)–এর সৃষ্টির ইতিহাস ও মানুষের খলিফা হওয়ার শিক্ষা।
- বনী ইসরাঈলের অবাধ্যতা, শিক্ষা ও আল্লাহর অনুগ্রহ।
- কাবা শরীফের পুনর্নির্মাণ ও কিবলা পরিবর্তনের ঘোষণা।
- নামাজ, রোযা, হজ, জাকাত ও কুরবানির বিধান।
- পরিবার, বিবাহ, তালাক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত আইন।
- জিহাদ, কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও ঈমানের পূর্ণতা নিয়ে আলোচনা।
🌸 সূরা আল-বাকারা’র বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
- এটি কুরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ সূরা — এতে পূর্ণ শরীয়ত, হেদায়াত ও জীবনদর্শন রয়েছে।
- নবী ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি সূরা আল-বাকারা পাঠ করে, তার ঘরে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৮০)
- আয়াতুল কুরসি (আয়াত ২৫৫) — ইসলামের সবচেয়ে মহান আয়াতগুলোর একটি, যা আল্লাহর একত্ব, শক্তি ও জ্ঞান সম্পর্কে বর্ণনা করে।
💫 বর্তমান যুগে শিক্ষা:
- যে সমাজ কুরআনের বিধান অনুযায়ী চলে, সেটিই প্রকৃত ইসলামী সমাজ।
- বনী ইসরাঈলের মতো অবাধ্যতা করলে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
- নামাজ, রোযা, হজ ও জাকাত শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সমাজের সংস্কারমূলক শক্তি।
- অর্থনৈতিক লেনদেনে সুদ, প্রতারণা ও অন্যায়ের স্থান নেই — সূরা আল-বাকারা এসব থেকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে।
🌿 শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর বিধান মানা ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর অনুসরণই মুক্তির পথ।
- আয়াতুল কুরসি, শেষ দুই আয়াত (আমানার রাসূল) নিয়মিত পড়া উচিত।
- সূরা আল-বাকারা সমাজ সংস্কার, ন্যায়বিচার ও ঈমানের পূর্ণতার শিক্ষা দেয়।
এগুলোকে "হুরুফে মুকাত্তা’আত" বলা হয়। এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহই জানেন। তবে এগুলো দ্বারা কুরআনের অলৌকিকতা এবং মহত্ব প্রকাশ করা হয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআনের প্রতিটি অক্ষরের পেছনে রহস্য রয়েছে।
২. আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মানুষ সবকিছু জানতে সক্ষম নয়।
এখানে কুরআনকে “সন্দেহহীন কিতাব” বলা হয়েছে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, সত্য ও নির্ভুল। আর এটি কেবল মুত্তাকিদের জন্যই হিদায়াত।
সূরা ফাতিহায় আমরা যে দোয়া করেছি — “আমাদেরকে সরল পথ দেখাও” — তার জবাবে আল্লাহ বললেন: “এই সেই পথের মানচিত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে এ পথ অনুসরণ করবে, সে অবশ্যই সঠিক পথে চলবে।”
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—আজকের দিনে কেউ যদি গুগল ম্যাপ ব্যবহার করতে চায়, তবে তার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়: (১) স্মার্টফোন বা কম্পিউটার, (২) ইন্টারনেট সংযোগ, (৩) অ্যাপ ওপেন করা, তারপর সার্চ করলে গন্তব্যের সঠিক দিক পাওয়া যায়। একইভাবে, কুরআন থেকে দিকনির্দেশ পেতে হলে মানুষের ভেতরে মুত্তাকির গুণাবলি থাকতে হবে। এর বিস্তারিত পরবর্তী আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন সন্দেহমুক্ত সত্য।
২. তাকওয়া ছাড়া হিদায়াত পাওয়া যায় না।
মুত্তাকিদের প্রধান গুণাবলি হলো—
১) গায়েবের প্রতি ঈমান আনা: আল্লাহ, ফেরেশতা, জান্নাত-জাহান্নাম, আখিরাত ইত্যাদি—এসব বিষয় চোখে দেখা যায় না, কিন্তু বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমন আজকের যুগে আমরা ওয়াইফাই সিগনাল বা বিদ্যুৎ দেখতে পাই না, কিন্তু এর প্রভাব অনুভব করি। একইভাবে গায়েবের প্রতি বিশ্বাস না রাখলে প্রকৃত ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয় না।
২) নামাজ কায়েম করা: কেবল পড়া নয়, বরং নিয়মিত ও যথাযথভাবে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “সে বিশ্বাস করেনি এবং নামাজ পড়েনি।” (সূরা আল-ক্বেয়ামাহ: ৩১) রাসুল ﷺ বলেছেন: “বান্দা এবং শিরক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪৯) অর্থাৎ নামাজ ছেড়ে দেওয়া মানেই কুফরের (অবিশ্বাসের) দিকে ধাবিত হওয়া, অর্থাৎ গায়েবের প্রতি বিশ্বাসকে আপনি পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাস করেননি
আজকের বাস্তবতায়ও দেখা যায়—যে পরিবারে নামাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শৃঙ্খলা ও শান্তি বেশি থাকে। নামাজ মানুষকে খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে।
৩) আল্লাহর দেওয়া রিজিক থেকে ব্যয় করা: দান-খয়রাত হলো তাকওয়ার বাস্তব নিদর্শন। যেমন সমাজে গরিব-অসহায়দের সাহায্য করা, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা—এসব মানুষের হৃদয় পরিশুদ্ধ করে এবং সম্পদে বরকত আনে। আজকের যুগে আমরা যদি আয় থেকে কিছু অংশ নিয়মিত দান করি, তবে সমাজে বৈষম্য কমে এবং দরিদ্ররাও উপকৃত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা প্রকৃত ঈমানের শর্ত।
২. নামাজ হলো ঈমানের প্রধান স্তম্ভ; তা ছাড়া ঈমান পূর্ণ হয় না।
৩. দান-খয়রাত মানুষের অন্তর পরিশুদ্ধ করে ও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
মুত্তাকিদের আরও তিনটি বৈশিষ্ট্য এখানে বর্ণিত হয়েছে—
৪) কুরআনে বিশ্বাস রাখা: শুধু বিশ্বাস করলেই হবে না, বরং তার নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: আপনি গুগল ম্যাপ ওপেন করলেন, কিন্তু সেখানে দেখানো রাস্তায় না চললে কখনোই গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। একইভাবে কুরআনে বিশ্বাস করার মানে হলো এর নির্দেশনা মেনে চলা; তাহলেই জান্নাতের গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব।
৫) পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে বিশ্বাস: তাওরাত, যাবুর, ইনজিল—এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ছিল। যদিও মানুষেরা সময়ের সাথে সাথে এগুলো পরিবর্তন করেছে, তবুও একজন মুত্তাকি মানে যে এগুলো মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছিল।
৬) আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস: আখিরাতের ওপর নিশ্চিত বিশ্বাস মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং গুনাহ থেকে বিরত রাখে। যেমন, একজন শিক্ষার্থী যদি জানে পরীক্ষার পর নম্বর দেওয়া হবে, তবে সে পড়াশোনা অবহেলা করে না। ঠিক তেমনি, আখিরাতের হিসাব-নিকাশে দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে আল্লাহর পথে দৃঢ় রাখে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. প্রকৃত ঈমানের জন্য সব আসমানি কিতাবকে মানা জরুরি।
২. কুরআনে বিশ্বাস মানে তার নির্দেশনা মেনে চলা।
৩. আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে সৎকর্মে ও তাকওয়ার পথে রাখে।
এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন—যারা পূর্বে বর্ণিত মুত্তাকির গুণাবলি ধারণ করে, তারাই প্রকৃত হিদায়াতপ্রাপ্ত। হিদায়াত মানে শুধু জ্ঞান নয়, বরং সেই জ্ঞানের আলোয় জীবন পরিচালনা করা।
আর যারা হিদায়াত পায়, তারাই প্রকৃত সফলকাম। পৃথিবীর সাফল্য অস্থায়ী—যেমন চাকরি, টাকা, নাম-যশ; কিন্তু আখিরাতের সাফল্য স্থায়ী।
উদাহরণস্বরূপ: একজন ছাত্র যদি সারা বছর ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়, নিয়ম মেনে পড়ে, তবে পরীক্ষায় সে সফল হয়। ঠিক একইভাবে মুত্তাকিরা আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষায় (জীবনের পরীক্ষা) পাশ করে আখিরাতে জান্নাত লাভ করবে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. প্রকৃত হিদায়াত কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই পাওয়া যায়।
২. মুত্তাকিদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই সফলতার পথ উন্মুক্ত থাকে।
৩. দুনিয়ার সাফল্য ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আখিরাতের সাফল্য চিরস্থায়ী।
আল্লাহ এখানে সেইসব কাফেরদের কথা বলেছেন যাদের অন্তর একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তারা সত্য দেখেও অস্বীকার করে। যেমন কেউ যদি চোখ বন্ধ করে নেয়, সূর্যের আলো থাকা সত্ত্বেও সে আলো দেখতে পাবে না। ঠিক তেমনি কাফেররা হক কথা শুনলেও তা মানে না।
এর মানে এই নয় যে দাওয়াহ দেওয়া বৃথা, বরং কিছু মানুষের অন্তর এতটাই জিদে আচ্ছন্ন থাকে যে সতর্ক করলেও তারা বদলায় না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হিদায়াত আল্লাহর হাতে, শুধু দাওয়াহ দিলেই সবার অন্তর খুলে যায় না।
২. জিদ ও অহংকার মানুষকে সত্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করে।
৩. হকের কথা শুনতে হলে বিনয়ী হৃদয় থাকা জরুরি।
যারা সত্য জেনেও বারবার অস্বীকার করে, আল্লাহ তাদের অন্তর সিলমোহর করে দেন। তখন তারা আর সত্য বুঝতে বা গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। তাদের কান সত্য শুনেও কোনো প্রভাবিত হয় না, চোখ সত্য দেখেও অন্ধের মতো হয়ে যায়।
যেমন—একটি মোবাইল ফোন বারবার ম্যালওয়্যার ইনস্টল করলে সেটি একসময় একেবারে হ্যাং হয়ে যায়, আর কাজ করে না। কাফেরদের অন্তরও ঠিক তেমন—বারবার অবাধ্যতা করতে করতে একসময় সত্য গ্রহণের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে।
এর পরিণাম হলো আখিরাতে কঠিন শাস্তি।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পাপ ও জিদে অবিচল থাকলে আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে।
২. অন্তর, কান ও চোখ সবই যদি সত্য থেকে বঞ্চিত হয়, তবে হিদায়াত লাভ অসম্ভব।
৩. নিয়মিত গুনাহ করলে হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, তাই তওবা ও আল্লাহর স্মরণ জরুরি।
এখানে মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে—যারা মুখে ঈমানের দাবি করে, কিন্তু অন্তরে কুফর লুকিয়ে রাখে। তারা সমাজে মুসলমান হিসেবে পরিচিত হয়, কিন্তু আসলে ইসলামকে দুর্বল করার জন্যই নিজেদের মুসলমান বলে প্রকাশ করে।
আজকের যুগেও আমরা দেখি, অনেকে মুখে ইসলামকে সমর্থন করে, কিন্তু কাজে-কর্মে আল্লাহর বিধান অমান্য করে। যেমন—কারও কথায় খুব সুন্দর ইসলামি ভাব, কিন্তু ব্যবসায় বা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে কোনো ইসলামি নীতি নেই।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কেবল মুখের ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
২. অন্তরের বিশ্বাস ও কর্মের মিল থাকা জরুরি।
৩. মুনাফিকি হলো দ্বিচারিতা, যা সমাজের জন্য ভয়ংকর।
মুনাফিকরা মনে করে, আল্লাহকে ও মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদেরকেই ধ্বংস করছে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তাঁর কাছে কিছুই গোপন নয়। তাদের মুনাফেকী কার্যকলাপ আসলে সাময়িকভাবে মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে, কিন্তু শেষপর্যন্ত ধরা পড়েই যাবে। দুনিয়ায় তাদের মর্যাদা নষ্ট হবে আর আখিরাতে তাদের কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না।
উদাহরণস্বরূপ: অনেকে পরীক্ষায় নকল বা চাকরিতে জাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে মনে করে কিছুদিন হয়তো টিকে যাবে, কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়ে ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলে। সম্প্রতি ভারতে এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে প্রতারণার কারণে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। মুনাফিকের অবস্থাও একই—ধোঁকা দিতে গিয়ে নিজের আখিরাতকেই ধ্বংস করে ফেলে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়া অসম্ভব।
২. মুনাফিকি আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা।
৩. ঈমান ও আমলের আন্তরিকতা ছাড়া প্রকৃত সফলতা সম্ভব নয়।
এখানে "রোগ" বলতে হৃদয়ের রোগ—অবিশ্বাস, সন্দেহ, হিংসা ও ভণ্ডামি বোঝানো হয়েছে। মুনাফিকরা দ্বিধায় ভুগতে থাকে—একদিকে মুসলমানদের সঙ্গে থাকে, অন্যদিকে কাফিরদের সঙ্গে আঁতাত করে। এর ফলে তাদের অন্তরের রোগ ক্রমশ বেড়ে যায়। আল্লাহ তাদের সঠিক পথে আসতে চাইলেও তারা মিথ্যা ও প্রতারণায় লিপ্ত থাকে, তাই তাদের শাস্তি অনিবার্য হয়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ: যেমন একজন মানুষ বারবার ডাক্তারকে মিথ্যা বলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়—ফলে রোগ আরও বেড়ে যায়। একইভাবে মুনাফিকরাও আল্লাহর হিদায়াত গ্রহণ না করে বারবার প্রতারণা করে, ফলে তাদের অন্তরের রোগ বাড়তেই থাকে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হৃদয়ের রোগ (অবিশ্বাস, হিংসা, মিথ্যা) মানুষকে ধ্বংস করে।
২. পাপ করলে অন্তরের অন্ধকার আরও বাড়ে।
৩. মিথ্যা ও প্রতারণা শেষপর্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির দিকে নিয়ে যায়।
মুনাফিকরা নিজেদের কাজকে কখনোই মন্দ মনে করত না। যখন তাদেরকে বলা হতো, তোমরা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না—তখন তারা উল্টো বলতো, “আমরা তো আসলে শান্তি স্থাপন করছি।” কিন্তু তাদের কথিত শান্তি ছিল আসলে ধ্বংসাত্মক। সত্যকে গোপন করা, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে আঁতাত করা—সবই ছিল তাদের ফাসাদের কাজ।
উদাহরণস্বরূপ: আজকের যুগে অনেকেই অন্যায়, দুর্নীতি, বা নাস্তিক্যবাদ ছড়িয়ে বলে—“আমরা সমাজকে মুক্ত করছি”, “আমরা সংস্কার করছি।” অথচ তাদের এসব কাজ সমাজে বিভ্রান্তি, অশান্তি ও ধ্বংস ডেকে আনে। যেমন মাদক ব্যবসায়ী বলে, “আমরা তো শুধু ব্যবসা করছি”—কিন্তু আসলে সে সমাজে নষ্টামি ছড়াচ্ছে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মন্দ কাজকে ভালো সাজানো মুনাফিকদের স্বভাব।
২. সত্যিকার শান্তি ও সংস্কার আসে আল্লাহর আইন মানার মাধ্যমে।
৩. মিথ্যা সংস্কারের নামে যারা ফাসাদ ছড়ায়, তারা সমাজ ধ্বংসের কারণ হয়।
পূর্ববর্তী আয়াতে মুনাফিকরা বলেছিল: “আমরা তো সংস্কারক।” কিন্তু আল্লাহ এখানে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন—আসলে তারাই প্রকৃত ফাসাদকারী। তারা দ্বিচারিতা, মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে দুর্বল করত। অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছিল।
উদাহরণস্বরূপ: একজন ডাক্তার যদি মিথ্যা ওষুধ দিয়ে রোগীকে বলে—“এটা তোমাকে ভালো করবে”, তাহলে আসলে সে রোগীকে মারাত্মক ক্ষতি করছে। রোগী হয়তো বুঝতেও পারছে না। একইভাবে মুনাফিকরা ভেবেছিল তারা শান্তি ও উন্নতি করছে, অথচ তাদের কাজই সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ যা বলেন, সেটাই চূড়ান্ত সত্য; মানুষের দাবি মিথ্যা হতে পারে।
২. ফাসাদ সৃষ্টিকারীরা অনেক সময় নিজেদের কাজকে “ভালো” ভেবে ধ্বংস ডেকে আনে।
৩. মুনাফিকির স্বভাব হলো—নিজেদের দোষ কখনো তারা স্বীকার করে না।
মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো—তারা প্রকৃত ঈমানদারদেরকে ‘মূর্খ’ বলে উপহাস করত। তারা মনে করত, যারা সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করে, আল্লাহর পথে কষ্ট সহ্য করে—তারা নাকি অজ্ঞ। অথচ আল্লাহ ঘোষণা করলেন, আসল মূর্খ তারাই, যারা সত্যকে অস্বীকার করে সাময়িক দুনিয়ার লোভে ভেসে যায়।
উদাহরণস্বরূপ: আজকের যুগেও যারা নামাজ, হিজাব বা ইসলামী জীবনযাপন করে তাদের অনেক সময় বলা হয় “পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ”, “অজ্ঞ” বা “ব্যাকডেটেড।” অথচ প্রকৃত অজ্ঞতা হলো আল্লাহর আইন না মানা এবং আখিরাতকে ভুলে যাওয়া। যেমন কেউ যদি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাদিন গেম খেলে, সাময়িক আনন্দ পাবে বটে, কিন্তু শেষমেশ ফেল করবে—এটাই আসল মূর্খতা। ঠিক তেমনি যারা ঈমানকে উপহাস করে, তারা আসল ক্ষতিগ্রস্ত।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ঈমানদারদের উপহাস করা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য।
২. দুনিয়ার সামান্য লাভের জন্য আখিরাতকে ভুলে যাওয়া আসল বোকামি।
৩. প্রকৃত জ্ঞান হলো আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস।
মুনাফিকদের দ্বিমুখী চরিত্র এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুমিনদের সামনে তারা ঈমানদার সেজে থাকে, যাতে মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য থাকে। কিন্তু নিজেদের নেতাদের ও অবিশ্বাসী সাথীদের সাথে একান্তে হলে বলে—“আমরা তো আসলে তোমাদের সঙ্গেই আছি, মুসলমানদেরকে শুধু ঠকাচ্ছি।” এভাবে তারা দ্বিমুখী নীতি মেনে চলত—এক পা ইসলামে, আরেক পা কুফরে।
উদাহরণস্বরূপ: আজকের যুগে এমন অনেকেই আছে যারা মসজিদে গিয়ে মুসলমান সেজে নামাজ পড়ে, কিন্তু পরক্ষণেই অন্যদের সাথে গিয়ে ইসলামকে ব্যঙ্গ করে বা হারাম কাজে লিপ্ত হয়। আবার যেমন কেউ অফিসে বসের সামনে চাটুকারিতা করে বলে “স্যার, আমি শুধু আপনার কথাই মানি”—কিন্তু পেছনে গিয়ে বলে “আমি তো শুধু মজা করছি”—এটাই ভণ্ডামির উদাহরণ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. দ্বিমুখী চরিত্র মুনাফিকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
২. আল্লাহ ও মুমিনদের সাথে প্রতারণা আসলে আত্মপ্রতারণা।
৩. সত্যিকার ঈমানদার কখনো উপহাস বা ভণ্ডামি করে না।
মুনাফিকরা মুমিনদেরকে উপহাস করে। কিন্তু প্রকৃত উপহাস তাদের সাথেই হচ্ছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের ভ্রষ্টতায় ছেড়ে দেন, ফলে তারা অন্ধভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।
উদাহরণস্বরূপ: যেমন একজন ছাত্র শিক্ষককে ঠকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু শেষে নিজেই ফেল করে—আসলে সেই ঠকানোর ফল সে-ই ভোগ করে। একইভাবে মুনাফিকদের প্রতারণা আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য রাখে না, বরং তা তাদের ক্ষতির কারণ হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুমিনদের উপহাস করা আসলে নিজের ক্ষতি ডেকে আনা।
২. বিভ্রান্তিতে চলতে থাকলে আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
এখানে মুনাফিকদের কাজকে ব্যবসার সাথে তুলনা করা হয়েছে। তারা হিদায়াতকে ছেড়ে গোমরাহী বেছে নিয়েছে, অথচ এর কোনো লাভ নেই।
উদাহরণস্বরূপ: কেউ যদি আসল হীরার পরিবর্তে নকল পাথর কিনে, সাময়িকভাবে খুশি হলেও আসল সময়ে তার ক্ষতি হবে। মুনাফিকরাও দুনিয়ার সামান্য লাভের জন্য আখিরাতের হিদায়াত হারিয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হিদায়াতের পরিবর্তে ভ্রষ্টতা গ্রহণ করা সবচেয়ে বড় ক্ষতি।
২. প্রকৃত লাভ হলো আখিরাতের সাফল্য, দুনিয়ার প্রতারণা নয়।
মুনাফিকদের উদাহরণ এখানে দেওয়া হয়েছে। তারা সাময়িকভাবে আলোর কাছে আসে, কিন্তু পরে নিজেদের মিথ্যার কারণে আবার অন্ধকারে ডুবে যায়।
উদাহরণস্বরূপ: একজন মানুষ পরীক্ষার জন্য লাইট জ্বালাল, কিন্তু বই না পড়ে ঘুমিয়ে পড়ল—ফলে আলো কোনো কাজে এল না। একইভাবে মুনাফিকরা ঈমানের আলো পেলেও, তা কাজে লাগায়নি।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হিদায়াতের আলোকে উপেক্ষা করলে মানুষ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
২. ঈমান শুধু মুখের কথা নয়, আমলেও প্রতিফলিত হতে হবে।
এখানে বলা হয়েছে, মুনাফিকরা সত্য শুনতে চায় না (বধির), সত্য বলতে চায় না (মূক), এবং সত্য দেখতে চায় না (অন্ধ)। ফলে তারা সঠিক পথে ফিরে আসে না।
উদাহরণস্বরূপ: যেমন কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখে, বই বন্ধ করে দেয়, চোখ বন্ধ করে ঘুমায়—তাহলে তাকে কিছু শোনানো বা শেখানো সম্ভব নয়। মুনাফিকদের অবস্থাও তেমন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সত্য শুনতে, বলতে ও মানতে না চাইলে হিদায়াত পাওয়া যায় না।
২. অন্তরের অন্ধত্ব শারীরিক অন্ধত্বের চেয়ে ভয়ানক।
এখানে আরেকটি উপমা দেওয়া হলো। যেমন ঝড়-বৃষ্টিতে বজ্র ও বিদ্যুৎ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে, মুনাফিকরাও তেমন আতঙ্কিত হয় সত্যের ধাক্কায়। তারা কানে আঙ্গুল দিয়ে সত্যকে অস্বীকার করে, অথচ আল্লাহর হাত থেকে পালাতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ: যেমন একজন অপরাধী পুলিশের ভয় পেয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে—কিন্তু পুলিশ তো পুরো শহর ঘিরে ফেলতে পারে। তেমনি মুনাফিকরা সত্যকে এড়িয়ে যেতে চায়, অথচ আল্লাহর কবল থেকে পালানোর উপায় নেই।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সত্যকে এড়িয়ে চলা সমস্যার সমাধান নয়।
২. আল্লাহর কবল থেকে কেউ পালাতে পারবে না।
মুনাফিকরা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। যখন তাদের কোনো লাভ হয়, তখন কিছুটা ঈমানের পথে চলে, কিন্তু বিপদ এলে থেমে যায়। আল্লাহ চাইলে তাদের কান-চোখই কেড়ে নিতে পারেন, কিন্তু তিনি অবকাশ দেন, যাতে তারা সত্য বুঝতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ: যেমন কোনো ছাত্র আলো জ্বলে থাকলে পড়ে, কিন্তু আলো নিভলেই আর কিছু করতে পারে না। তার পড়াশোনার আসল আগ্রহ নেই। মুনাফিকের অবস্থাও তাই—সুবিধা হলে ঈমানের দাবি করে, বিপদ এলে থেমে যায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুনাফিকরা সবসময় দ্বিধায় ভোগে।
২. আল্লাহর শক্তি অসীম, তিনি চাইলে যেকোনো কিছু কেড়ে নিতে পারেন।
৩. সত্যিকার ঈমান স্থায়ী হয়, সুবিধাভিত্তিক নয়।
এখানে আল্লাহ সমস্ত মানবজাতিকে আহ্বান করছেন। উদ্দেশ্য হলো, শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, অন্য কেউ নয়। তাকওয়া অর্জনের একমাত্র পথ হলো—আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য।
উদাহরণ: যেমন একজন ছাত্র শিক্ষককে মান্য করলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, কিন্তু যদি সে অবাধ্য হয় তবে ব্যর্থ হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহর আনুগত্য মানুষকে আখিরাতে সফল করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদ মেনে ইবাদত করতে হবে।
২. তাকওয়া হলো মানবজীবনের মূল লক্ষ্য।
আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ উল্লেখ করছেন—পৃথিবী, আকাশ, বৃষ্টি, ফসল। এগুলো প্রমাণ করে যে ইবাদতের যোগ্য কেবল তিনিই। শরিক করা সবচেয়ে বড় অন্যায়।
উদাহরণ: যেমন বিদ্যুৎ দিয়ে সব কিছু চলে, কিন্তু মানুষ যদি পাখা বা বাল্বকে বিদ্যুতের সমান মনে করে তবে সে ভুল করবে। তেমনি আল্লাহর সৃষ্টির কোনো কিছুকেই আল্লাহর সমান ধরা যাবে না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহর দয়া মানুষের জীবনধারণের মূল ভিত্তি।
২. শিরক মানবজাতির সবচেয়ে বড় অপরাধ।
কুরআনের চ্যালেঞ্জ এখানে বর্ণিত হয়েছে। যদি কেউ সন্দেহ করে, তবে সে যেন একই রকম একটি সূরা বানিয়ে আনে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—কেউ তা করতে পারেনি।
উদাহরণ: যেমন আজকের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু কুরআনের মতো নিখুঁত দিকনির্দেশনা, ভাষাশৈলী ও প্রভাব কেউ তৈরি করতে পারবে না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআনের অলৌকিকত্ব চিরন্তন।
২. সত্যকে অস্বীকার করা কেবল জিদ্দি মনোভাব।
এখানে আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন—কেউই কুরআনের সমকক্ষ কিছু আনতে পারবে না। আর যারা অস্বীকার করবে তাদের পরিণতি হবে জাহান্নাম।
উদাহরণ: যেমন একটি আদালতের রায় কেউ অস্বীকার করলে শাস্তি ভোগ করতে হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহর আদালতের আইন কেউ অস্বীকার করলে তার শাস্তি হলো আগুন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআনের সত্যতা চিরস্থায়ী।
২. জাহান্নাম কাফিরদের জন্য প্রস্তুত।
আল্লাহ মুমিনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন। সেখানে ফলমূল, নদী, সঙ্গিনী সবই থাকবে পরিশুদ্ধ ও চিরস্থায়ী।
উদাহরণ: যেমন দুনিয়ায় মানুষ সুন্দর বাগান দেখে আনন্দিত হয়, কিন্তু সেই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। জান্নাতের বাগান চিরন্তন হবে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ঈমান ও আমল একসাথে হলে জান্নাত লাভ হয়।
২. জান্নাতের নেয়ামত দুনিয়ার তুলনায় বহু গুণ উত্তম।
আল্লাহ তাঁর কিতাবে ছোট-বড় যেকোনো উদাহরণ ব্যবহার করেন, যেন মানুষ বুঝতে পারে। মুমিনরা এসব থেকে শিক্ষা নেয়, আর কাফিররা ঠাট্টা করে।
উদাহরণ: যেমন শিক্ষক কোনো জটিল বিষয় বোঝাতে ছোট্ট উদাহরণ দেন—যেমন একটি পিঁপড়ার পরিশ্রম। ছাত্ররা বুঝে নেয়, কিন্তু অলসরা বলে ‘এতে কী শেখার আছে?’
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহর প্রতিটি উদাহরণের গভীর তাৎপর্য রয়েছে।
২. হিদায়াত পেতে হলে অন্তরে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা থাকতে হবে।
ফাসিকদের বৈশিষ্ট্য হলো—অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করা।
উদাহরণ: যেমন কোনো কর্মচারী অফিসে যোগ দেওয়ার সময় চুক্তি করে—সততার সাথে কাজ করবে। কিন্তু পরে সে প্রতারণা করে, সম্পর্ক নষ্ট করে এবং অফিসের ক্ষতি করে। শেষ পর্যন্ত সে চাকরি হারায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ মারাত্মক গুনাহ।
২. আত্মীয়তা ছিন্ন করা আখিরাত ও দুনিয়ার ক্ষতি ডেকে আনে।
আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতার স্পষ্ট প্রমাণ হলো—জীবন ও মৃত্যু। মানুষ কিছুই ছিল না, আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন, মৃত্যু দেবেন, আবার পুনরুত্থান করবেন।
উদাহরণ: যেমন একজন কৃষক মাটির ভেতর বীজ রাখে, তারপর তা মৃত মাটি থেকে প্রাণ পায়, আবার শুকিয়ে যায়, পরে আবার নতুন বীজ থেকে জীবিত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
২. আখিরাতে প্রত্যাবর্তন অনিবার্য।
আল্লাহ মানুষের কল্যাণে পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এরপর আসমানকে সুবিন্যস্ত করে সাত আসমান বানিয়েছেন। তিনি সবকিছুই জানেন।
উদাহরণ: যেমন একটি বিশাল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পুরো সিস্টেম তৈরি করে, কিন্তু তার প্রতিটি কোডের খুঁটিনাটি সে জানে। ঠিক তেমনি আল্লাহ মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিস জানেন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পৃথিবীর সব নিয়ামত মানুষকে আল্লাহ দিয়েছেন।
২. আল্লাহ সর্বজ্ঞ—তাঁর জ্ঞান থেকে কিছুই গোপন নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি (খলীফা) বানানোর ঘোষণা দেন। ফেরেশতারা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল—মানুষ রক্তপাত ও অন্যায় করবে, তাহলে কেন তাকে প্রতিনিধি বানানো হচ্ছে? আল্লাহ জবাব দেন, "আমি জানি যা তোমরা জানো না।"
এখানে বোঝা যায়, মানুষকে শুধু পরীক্ষা ও দায়িত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও মানুষ ভুল করবে, অন্যায় করবে, তবে তাদের মধ্য থেকে নবী-রাসূল, সৎকর্মশীল ও আল্লাহর বন্ধু বের হবে—যা ফেরেশতারা আগে থেকে জানত না।
উদাহরণ: যেমন কোনো শিক্ষক জানেন, ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যর্থ হবে, আবার কেউ হবে মেধাবী ও সফল। তবুও তিনি পুরো ক্লাসকে সুযোগ দেন। তেমনি আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন—যদিও কেউ অন্যায় করবে, তবুও অনেকে সৎপথে চলবে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষকে আল্লাহ পৃথিবীতে দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন।
২. ফেরেশতারা শুধু একটি দিক দেখেছিল (রক্তপাত), কিন্তু আল্লাহ সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।
৩. আমাদের কর্তব্য হলো অন্যায় থেকে দূরে থেকে খলীফার দায়িত্ব পালন করা।
৪. আল্লাহর হিকমত বা প্রজ্ঞা আমরা সবসময় বুঝতে নাও পারি, তবুও তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক।
আল্লাহ তাআলা আদম (আঃ)-কে সমস্ত বস্তুর নাম ও জ্ঞান শিখিয়ে তাঁর বিশেষ মর্যাদা প্রদর্শন করেন। ফেরেশতাদের সামনে প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তাদের বলেন—যদি তোমরা মনে করো মানুষ সৃষ্টি করা অনুচিত, তবে বলো এদের নাম।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষকে জ্ঞান দান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুগ্রহ।
২. জ্ঞানই মানুষকে ফেরেশতাদের ওপরে মর্যাদাশীল করেছে।
ফেরেশতারা তাদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেয়। তারা জানে না, আল্লাহ যা শিখিয়েছেন শুধু তাই জানে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়—সর্বজ্ঞ কেবল আল্লাহ, তাঁর জ্ঞান ও হিকমত সীমাহীন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জ্ঞানের মূল উৎস আল্লাহ।
২. বান্দার কর্তব্য হলো বিনয়ী হয়ে নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা।
৩. আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।
আল্লাহ আদম (আঃ)-কে নির্দেশ দিলেন ফেরেশতাদের সামনে নামগুলো বলতে। এতে আদম (আঃ)-এর জ্ঞান প্রমাণিত হলো এবং ফেরেশতাদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেল। এরপর আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তিনি অদৃশ্য ও গোপন সবকিছু জানেন—ফেরেশতাদের কথাও এবং ইবলিসের অন্তরের গোপন অহংকারও।
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ মর্যাদা।
২. আল্লাহ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব জানেন।
৩. মানুষকে জ্ঞান দিয়ে আল্লাহ বিশেষ দায়িত্বশীল বানিয়েছেন।
৪. আল্লাহর জ্ঞানের সামনে কারও জ্ঞান কিছুই নয়।
এ আয়াতে কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে যখন আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.) সৃষ্টি করে তাকে সম্মানিত অবস্থায় স্থাপন করলেন ও ফেরেশতাদের আদেশ করলেন আদমের কাছে সিজদা করতে।বারবার ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে সিজদা ইবাদতের রূপ ছিল না বরং এটা আদমকে সম্মান প্রদর্শনের আদেশ—তবে ইবলীস তা অগ্রাহ্য করে গর্ব ও অবাধ্যের কারণে অমান্য করল। তার এই অমান্যবাদিতাবশত সে ঈমানহীনতায় পড়ে গেল।
মূল পয়েন্টগুলো:
- কর্তৃপক্ষের আদেশে অনুগততা: ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশ মেনে চলল—এতে অনুগততার গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়।
- ইবলীসের গর্ব: ইবলীস মমতা, গর্ব ও আত্মগৌরবের কারণে অবাধ্য হয়—এটি শয়তানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- অন্তর্মুখী শিক্ষা: ক্ষমতা বা জ্ঞানের ভিত্তিতে গৌরব করা বিপজ্জনক; নীরব বিনয় ও আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলাই উত্তম।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত থেকে আমরা শিখি যে আল্লাহর নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে তা বিশ্বাস ও রূহানীহীনতার দিকে নিয়ে যায়; অন্যদিকে, আত্মবিদ্বেষ ও গর্ব ত্যাগ করলে সৎ পথ ধরে চলা সম্ভব।
উদাহরণ:
যদি একজন লোক তার পজিশন বা ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে অন্যকে তুচ্ছ মনে করে, তাহলে সে ইবলীসের মন্ত্রে প্রলুব্ধ হতে পারে—অর্থাৎ গর্ব তাকে ভুলের দিকে ঠেলে দেয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর আদেশে বিনয় ও আনুগত্য বজায় রাখা।
- গৌরব ও রওয়া থেকে সতর্ক থাকা।
- ইবলি-সদৃশ আচরণ চিনে নিয়ে ট্রান্সফরমেশন করা: ক্ষমতাবান হওয়া মানেই শুধুই দায়িত্ববোধ।
এ আয়াতে আল্লাহ আদম (আ.) এবং হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে বসবাসের অনুমতি দেন এবং সব ধরনের নিয়ামত ভোগ করার স্বাধীনতা দেন। কিন্তু একটি গাছের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেন—যাতে তাদের আনুগত্য পরীক্ষা করা হয়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নির্দেশ মানা হচ্ছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার অংশ।
- মানুষকে স্বাধীনতা দেওয়া হলেও সীমা আছে; সীমা অতিক্রম করলেই অন্যায় হয়।
- শয়তান মানুষের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রলুব্ধ করে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষকে সব ধরনের নিয়ামত দেওয়া হলেও পরীক্ষার জন্য কিছু বিষয় নিষিদ্ধ রাখা হয়। এটাই দুনিয়ার জীবনেও সত্য—সব কিছু হালাল নয়, কিছু হারাম থেকে বিরত থাকতে হবে।
উদাহরণ:
যেমন একজন কর্মচারীকে তার প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য সুবিধা দেওয়া হয়, কিন্তু কিছু নিয়ম ভাঙলে চাকরি হারাতে পারে। তেমনি, আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের মাঝে কিছু সীমারেখা আছে যা অমান্য করলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর দেয়া নিয়ামতগুলো ভোগ করার সময় কৃতজ্ঞ থাকা জরুরি।
- পরীক্ষার অংশ হিসেবে কিছু নিষেধ মেনে চলতে হয়।
- আনুগত্যই সফলতার মূল চাবিকাঠি।
- আল্লাহর সীমারেখা ভাঙলে মানুষ জালেম হয়ে যায়।
এ আয়াতে বলা হয়েছে, শয়তান আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে ধোঁকা দিয়ে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করায় প্রলুব্ধ করে। ফলে তারা জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামতে বাধ্য হন। এটি মানবজাতির জন্য একটি শিক্ষা যে শয়তান সর্বদা মানুষকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে।
মূল শিক্ষা:
- শয়তান মানুষকে প্রতারণা করে ভুল করায়।
- মানুষকে পৃথিবীতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে।
- মানুষ ও শয়তানের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক চিরস্থায়ী।
- পৃথিবী হলো মানুষের জন্য অস্থায়ী আবাস।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানুষের প্রকৃত আবাস জান্নাত, কিন্তু পৃথিবী হলো একটি পরীক্ষার স্থান। এখানে মানুষকে সীমিত সময়ের জন্য থাকতে হবে এবং সঠিক পথ অবলম্বন করলে জান্নাতে ফিরে যেতে পারবে।
উদাহরণ:
যেমন একজন পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখা হয়—সময় শেষে তাকে বের হতে হয়। পৃথিবীর জীবনও তেমনি একটি পরীক্ষা, এর পরেই চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণ হবে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
- পৃথিবীর জীবন অস্থায়ী, আখিরাতের জীবনই স্থায়ী।
- মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলতে হবে।
- মানুষের আসল গন্তব্য জান্নাত, তাই তা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন যে, আদম (আ.) যখন ভুল করলেন তখন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে কিছু দো‘আ ও শব্দ শিখলেন। এগুলো দ্বারা তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করলেন। আল্লাহর অন্যতম গুণ হলো তিনি বান্দার তওবা গ্রহণ করেন।
মূল শিক্ষা:
- মানুষ ভুল করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন।
- আল্লাহর দয়া অসীম; তিনি বান্দাকে হতাশ করেন না।
- তওবা মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষ যদি ভুল করে তাওবা না করে, তবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আন্তরিকভাবে তওবা করলে আল্লাহ তাঁর রহমতে ক্ষমা করে দেন। এ আয়াত মানুষকে আশা জোগায় যে, আল্লাহ সর্বদা ক্ষমাশীল।
উদাহরণ:
যেমন একটি শিশু ভুল করে ফেললে যদি সে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চায়, তবে দয়ালু বাবা-মা তাকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে এর চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- ভুল হলে হতাশ না হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
- তওবা আল্লাহর রহমত পাওয়ার একটি মাধ্যম।
- আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়ালু।
- শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচতে হলে সবসময় তওবায় ফিরে আসতে হবে।
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন, মানুষকে পৃথিবীতে নামানো হলো, তবে তাদের জন্য দিকনির্দেশনা (কুরআন, নবী, ওহি) প্রেরণ করা হবে। যে কেউ আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণ করবে, তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি থাকবে। ভয় ও দুঃখ থেকে মুক্তিই হলো প্রকৃত মুক্তি।
মূল শিক্ষা:
- মানুষ পৃথিবীতে পরীক্ষা দিতে এসেছে।
- আল্লাহ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন—যারা তা মানবে তারাই সফল।
- ভয় ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথ হলো আল্লাহর হেদায়াত।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
আল্লাহ মানুষের জন্য কুরআন ও রাসূল পাঠিয়েছেন হিদায়াত হিসেবে। এটি অনুসরণ করলে দুনিয়া ও আখিরাতের ভয় ও দুঃখ দূর হয়। তাই এই আয়াত মুসলমানদের জন্য আশার আলো।
উদাহরণ:
যেমন একজন ভ্রমণকারীকে সঠিক মানচিত্র দেওয়া হলে সে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, তেমনি আল্লাহর হেদায়াত মানুষের জন্য নিরাপদ পথ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- পৃথিবী হলো পরীক্ষার জায়গা, জান্নাত হলো গন্তব্য।
- আল্লাহর পাঠানো হেদায়াতই নিরাপদ পথ।
- ভয় ও দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ জরুরি।
- আল্লাহ মানুষকে কখনো দিশাহীন রাখেন না।
এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট জানাচ্ছেন, যারা কুরআনের আয়াত অস্বীকার করবে এবং অবাধ্যতা করবে, তাদের পরিণাম হলো জাহান্নাম। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকবে। এটি পূর্বের আয়াতের বিপরীতে সতর্কবার্তা।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর আয়াত অস্বীকারকারীরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
- ইমান ও হেদায়াত গ্রহণকারীদের জন্য মুক্তি, আর অস্বীকারকারীদের জন্য শাস্তি।
- কুফর ও মিথ্যাচার মানুষের চরম ক্ষতির কারণ।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এ আয়াত মানুষকে সতর্ক করছে যে, আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করা বা অবহেলা করা আখিরাতে চিরস্থায়ী শাস্তির কারণ হবে। তাই হেদায়াত গ্রহণই একমাত্র নিরাপদ পথ।
উদাহরণ:
যেমন আইন ভঙ্গকারীর জন্য কারাগার নির্ধারিত থাকে, তেমনি আল্লাহর আইন অস্বীকারকারীদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কুফর ও অবাধ্যতা মানুষের চরম সর্বনাশের কারণ।
- আল্লাহর আয়াতকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে হবে।
- জাহান্নাম হলো অবিশ্বাসীদের স্থায়ী ঠিকানা।
- মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহর হেদায়াত ধরে রাখা।
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলকে তাঁর দেওয়া নিয়ামত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন— যেমন মিসর থেকে মুক্তি, আকাশ থেকে মান্না-সালওয়া প্রদান, নবী-রাসূল প্রেরণ ইত্যাদি। তিনি তাদেরকে আহ্বান করছেন যেন তারা আল্লাহর সঙ্গে করা অঙ্গীকার পূর্ণ করে। যদি তারা তা করে, আল্লাহও তাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নিয়ামত ভুলে গেলে কৃতঘ্নতা তৈরি হয়।
- আল্লাহর সাথে করা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
- আল্লাহর ভয় মানুষকে সঠিক পথে রাখে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এ আয়াত মুসলমানদের জন্যও শিক্ষা যে, আমরা যেন আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত স্মরণ রাখি, তাঁর সঙ্গে করা অঙ্গীকার (ইবাদত, আনুগত্য) পালন করি। এর বিনিময়ে আল্লাহ আখিরাতে জান্নাত দান করবেন।
উদাহরণ:
যেমন একজন শিক্ষক ছাত্রকে সাহায্য করে, আর ছাত্রের দায়িত্ব হলো সেই সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিয়ম মেনে চলা। তেমনি আল্লাহ অসংখ্য নিয়ামত দেন, আর বান্দার কর্তব্য তা স্মরণ রাখা ও কৃতজ্ঞ থাকা।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর নিয়ামত সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত।
- প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা বড় গোনাহ।
- শুধু আল্লাহকেই ভয় করতে হবে।
- আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে তিনি বান্দাকে উত্তম প্রতিদান দেন।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তারা কুরআনে ঈমান আনে, কারণ এটি তাওরাত ও পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা নিশ্চিত করে। কিন্তু তারা নিজেদের জেদ ও স্বার্থপরতার কারণে সত্য অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ সতর্ক করলেন যে, দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের জন্য আল্লাহর আয়াত বিক্রি করো না।
মূল শিক্ষা:
- কুরআনে ঈমান আনা পূর্ববর্তী সব কিতাবের সত্যতার প্রমাণ।
- প্রথম অবিশ্বাসী হওয়া বড় গোনাহ।
- আল্লাহর আয়াত বিক্রি মানে সত্য গোপন করে দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিল করা।
- তাকওয়া ছাড়া মুক্তি নেই।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত মুসলমানদের সতর্ক করে দেয় যেন আমরা দুনিয়ার স্বার্থে কুরআনের শিক্ষা বিকৃত না করি এবং সত্যের পথে দৃঢ় থাকি। সত্য গোপন করে সামান্য লাভ নেওয়া আখিরাতে বড় ক্ষতির কারণ হবে।
উদাহরণ:
যেমন একজন বিচারক যদি টাকার বিনিময়ে ন্যায় গোপন করে, তবে সে মানুষের আস্থা হারায় এবং আল্লাহর কাছে গুনাহগার হয়। তেমনি আল্লাহর আয়াত গোপন করা বা বিক্রি করাও গুরুতর অপরাধ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কুরআনে ঈমান আনা ঈমানের শর্ত।
- সত্যকে গোপন বা অস্বীকার করা মহাগুনাহ।
- আল্লাহর আয়াত বিক্রি করা মানে সামান্য স্বার্থে সত্য ত্যাগ করা।
- তাকওয়া অবলম্বন করা মুমিনের প্রধান কর্তব্য।
এ আয়াতে বনী ইসরাঈলকে সতর্ক করা হয়েছে— তারা যেন সত্য ও মিথ্যা গুলিয়ে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে। তারা জেনে-বুঝে সত্য (রাসূল ﷺ ও কুরআন) গোপন করতো। আল্লাহ তাদেরকে নিষেধ করলেন এ কাজ থেকে।
মূল শিক্ষা:
- সত্য ও মিথ্যা এক করা সবচেয়ে বড় অন্যায়।
- সত্য গোপন করা জেনে-বুঝে প্রতারণার সমান।
- আল্লাহর আয়াত মানুষকে পরিষ্কারভাবে জানানো উচিত।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
সত্য গোপন করা সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করে। মানুষ ভুল পথে চলে যায়। তাই আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন সত্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে।
উদাহরণ:
যেমন একজন ডাক্তার যদি রোগীর আসল রিপোর্ট গোপন করে ভুল তথ্য দেয়, তবে রোগী বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তেমনি সত্য গোপন করলে মানুষ আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্যকে মিথ্যার সাথে মেশানো গুরুতর গোনাহ।
- জেনে শুনে সত্য গোপন করা অপরাধ।
- মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচাতে সত্য প্রচার করা জরুরি।
- আল্লাহর আয়াত স্পষ্টভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো ঈমানের দায়িত্ব।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে নির্দেশ দিচ্ছেন— তারা যেন নামাজ কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, এবং মুসলিম জামাতে অংশগ্রহণ করে ইবাদত করে। এটি তাদের দ্বীনের মূল দায়িত্ব ছিল।
মূল শিক্ষা:
- সালাত ও যাকাত ইসলামের মৌলিক ইবাদত।
- ইবাদতে একতা ও জামাতে শামিল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
- ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিকভাবে পালনীয়।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
নামাজ ও যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক এবং সমাজের সাথে সম্পর্ক উভয়ই দৃঢ় হয়। জামাতে নামাজ পড়া মুসলিমদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বকে শক্তিশালী করে।
উদাহরণ:
যেমন একটি দল একসাথে কাজ করলে শক্তি বৃদ্ধি পায়, তেমনি মুসলমানরা একসাথে জামাতে নামাজ পড়লে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য তৈরি হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- নামাজ প্রতিষ্ঠা করা মুমিনের প্রথম কর্তব্য।
- যাকাত দানের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়।
- জামাতে অংশগ্রহণ মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে।
- ইবাদত ব্যক্তিগত ও সামাজিক— দুই দায়িত্বই বহন করে।
আল্লাহ এখানে বনী ইসরাঈলের পণ্ডিতদের (এবং পরোক্ষভাবে সকল মানুষকে) সম্বোধন করছেন, যারা অন্যকে **সৎ কাজের** নির্দেশ দিত কিন্তু নিজেরা তা থেকে বিরত থাকত। বিশেষত, তারা তাওরাত পাঠ করত, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমনের সুসংবাদ ছিল, কিন্তু তারা নিজেরা তাঁর ওপর ঈমান আনেনি। এই আয়াতে তাদের **জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও মূর্খতা** এবং **কাজের সাথে কথার অমিল**-এর জন্য তিরস্কার করা হয়েছে।
মূল শিক্ষা:
- প্রচারকের জন্য যা প্রচার করে, তা আগে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক।
- জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আমল না করা বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক।
- নিজের ভুলের প্রতি সচেতন হওয়া এবং তা সংশোধন করা জরুরি।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
একজন মানুষের কথা তখনই প্রভাব ফেলে যখন তার **কর্মে তার কথার প্রতিফলন** থাকে। যে ব্যক্তি নিজেই আমল করে না, সে যখন অন্যকে সৎ কাজের দিকে ডাকে, তখন তার দাওয়াত মূল্যহীন হয়ে যায় এবং সে আল্লাহর কাছে তিরস্কৃত হয়।
এ বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন:-
- হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল?, - তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।(সূরা আছ-ছফ:২-৩)
শিক্ষণীয় বিষয়:
- জ্ঞান অর্জন করে তা আমলে পরিণত করা প্রথম দায়িত্ব।
- অন্যকে উপদেশ দেওয়ার আগে নিজের জীবন পর্যালোচনা করা উচিত।
- কোরআন ও কিতাব পাঠের উদ্দেশ্য শুধু জানা নয়, বরং মানা।
- মুনাফেকী আচরণ পরিহার করে আন্তরিকতার সাথে ইবাদত ও দাওয়াত করা।
আল্লাহ এই আয়াতে মুমিনদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন তাদের দুনিয়াবী ও আখিরাতের সকল সমস্যা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য **ধৈর্য (সবর)** ও **নামাজের (সালাত)** মাধ্যমে তাঁর কাছে সাহায্য চায়। সবর বলতে সাধারণভাবে বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা, পাপ থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকাকে বোঝায়। তবে এই কাজগুলো কেবল সেইসব মানুষের জন্য সহজ, যারা **বিনয়ী (খাশিয়ীন)** এবং আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে।
মূল শিক্ষা:
- সকল প্রকার সাহায্য একমাত্র আল্লাহর নিকট চাওয়া উচিত।
- বিপদাপদে ও প্রয়োজনে ধৈর্য ও নামাজ হলো মুমিনের প্রধান হাতিয়ার।
- আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য বিনয়ী মনোভাব অপরিহার্য।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
জীবনে সমস্যা আসা অনিবার্য। সবর হলো সেই মানসিক শক্তি যা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষকে অবিচল রাখে। আর সালাত হলো আল্লাহর সাথে সরাসরি সংযোগের মাধ্যম, যা অন্তরকে প্রশান্তি দেয় এবং আত্মাকে শক্তিশালী করে। বিনয়ী ব্যক্তিরাই কেবল এই দুই ইবাদতের প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারে।
উদাহরণ:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোনো কঠিন বা চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় পড়লে তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন (আবু দাউদ-১৩১৯)। এটি ছিল তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার এবং মানসিক শক্তি অর্জনের সর্বোত্তম উপায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- ধৈর্য হলো ইমানের অর্ধেক।
- সালাত হলো মুমিনের জন্য মি’রাজ (আল্লাহর নৈকট্য লাভের সিঁড়ি)।
- নামাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা (খুশু) বজায় রাখা আল্লাহর কাছে প্রিয়।
- আল্লাহর প্রতি বিনয়ী হওয়াই সফলতা ও প্রশান্তির মূল চাবিকাঠি।
এই আয়াতে আগের আয়াত (৪৫)-এ উল্লিখিত বিনয়ী (খাশিয়ীন) ব্যক্তিগণের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এখানে 'ইয়াযুন্নূনা' (يَظُنُّونَ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ সাধারণত 'ধারণা করা' হলেও, কোরআনের পরিভাষায় এই প্রেক্ষাপটে এটি নিশ্চিত বিশ্বাস বা দৃঢ় প্রত্যয় বোঝায়। অর্থাৎ, বিনয়ী তারাই, যারা এই দু'টি মৌলিক বিষয়ে অবিচল বিশ্বাস রাখে:
- **আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ:** তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কিয়ামতের দিন তাদের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াতে হবে।
- **তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন:** তারা বিশ্বাস করে যে জীবনের সমাপ্তিতে তাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকেই।
মূল শিক্ষা:
- পরকালে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার বিশ্বাসই হলো সকল সৎকর্মের মূল ভিত্তি।
- **আখিরাতের নিশ্চিত বিশ্বাস** মানুষকে ধৈর্য ও সালাতে শক্তি যোগায়।
- বিনয় (খুশু) কেবল বাহ্যিক নয়, বরং এটি হৃদয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ের ফল।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
যে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে তাকে একদিন তার রবের সামনে তার সকল কাজের হিসাব দিতে হবে, সে ব্যক্তি কখনো পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না এবং তার ইবাদতে একাগ্রতা আসে। এই **বিশ্বাসই পরকালের ভীতি ও আশা** সৃষ্টি করে।
উদাহরণ:
যে ছাত্র জানে যে তাকে পরীক্ষার হলে শিক্ষকের সামনে দাঁড়াতে হবে, সে অবশ্যই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তেমনি, মুমিন ব্যক্তি আখিরাতের নিশ্চিত সাক্ষাতের কারণে দুনিয়ার জীবনে সৎকর্মের প্রস্তুতি নেয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- **ইয়াকীন** (দৃঢ় বিশ্বাস) হলো ইবাদতের প্রাণ।
- আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার কথা স্মরণ করা মানুষকে দুনিয়ার মোহ থেকে বাঁচায়।
- সালাতে খুশু (একাগ্রতা) অর্জনের জন্য এই আয়াতের অর্থ অনুধাবন করা সহায়ক।
- আখিরাতের চিন্তা মুমিনের জীবনকে নিয়মানুবর্তী ও ফলপ্রসূ করে তোলে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **বনী ইসরাঈল**কে তাদের প্রতি তাঁর পূর্বের অসংখ্য নিয়ামত ও বিশেষ মর্যাদা স্মরণ করতে বলছেন। এই নিয়ামতগুলোর মধ্যে ছিল: রাসূল, কিতাব (তাওরাত), ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি, মান্না ও সালওয়া খাদ্য লাভ, এবং **তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব** দান করা। এই স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল— তারা যেন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, তাঁর আনুগত্য করে এবং সর্বশেষ রাসূল (মুহাম্মদ সাঃ)-এর উপর ঈমান আনে। উল্লেখ্য, এই শ্রেষ্ঠত্ব ছিল **নির্দিষ্ট কালের জন্য** এবং উম্মতে মুহাম্মাদীর আগমনের পর সেই শ্রেষ্ঠত্ব এই উম্মতের দিকে স্থানান্তরিত হয়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নিয়ামতসমূহ সর্বদা স্মরণ করা এবং তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক।
- বিশেষ মর্যাদা লাভ করলে তার মর্যাদা ও হক রক্ষা করা অপরিহার্য।
- শ্রেষ্ঠত্ব একটি শর্তসাপেক্ষ বিষয়— তা কেবল সৎকর্ম ও আনুগত্যের মাধ্যমেই বজায় থাকে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করা মানুষকে অহংকার থেকে দূরে রাখে এবং তাঁকে ভুলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি বনী ইসরাঈলকে তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে এবং তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একটি নির্দেশ।
উদাহরণ:
যেমন একজন ছাত্রকে তার শিক্ষক স্মরণ করিয়ে দেন, কীভাবে সে একসময় খারাপ অবস্থায় ছিল, আর এখন শিক্ষকের সাহায্যে সে সফল হয়েছে। তেমনি আল্লাহও তাঁর অনুগ্রহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যাতে তারা সৎপথে ফিরে আসে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সদা-সর্বদা আল্লাহর **শুকরিয়া** আদায় করা মুমিনের কর্তব্য।
- নিয়ামতপ্রাপ্ত জাতিদের কর্তব্য হলো সেই নিয়ামত ধরে রাখার জন্য আল্লাহর আনুগত্য করা।
- অতীতে পাওয়া মর্যাদা বা সাফল্য ধরে রাখার জন্য বর্তমানের কর্ম গুরুত্বপূর্ণ।
- আল্লাহর অনুগ্রহের কথা ভুলে গেলে মানুষ **অকৃতজ্ঞ** ও **অবাধ্য** হয়ে যায়।
এটি কিয়ামতের দিন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী, যেখানে আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে (এবং সকল মানুষকে) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, সেদিন চারটি বিষয় কোনো কাজে আসবে না:
- **কেউ কারো সামান্য উপকার করতে পারবে না:** প্রতিটি মানুষ কেবল নিজের কর্মফল নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
- **শাফাআত (সুপারিশ) গৃহীত হবে না:** কেবল আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে মনোনীত ব্যক্তির সুপারিশই কার্যকর হবে। এখানে সেই ভুল ধারণা দূর করা হয়েছে যে, আত্মীয় বা প্রভাবশালী কেউ বিনা অনুমতিতে সুপারিশ করে দেবে।
- **ক্ষতিপূরণ (মুক্তিপণ/ফিদিয়া) নেওয়া হবে না:** দুনিয়ার ধন-সম্পদ বা কোনো বিনিময় দিয়ে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
- **কোনো সাহায্যকারী পাওয়া যাবে না:** আল্লাহর সাহায্য ছাড়া অন্য কেউ এসে বাঁচাবে না।
মূল শিক্ষা:
- আখিরাতে একমাত্র নিজের আমল ছাড়া আর কিছুই মুক্তির কারণ হবে না।
- দুনিয়ার সম্পর্ক, প্রভাব বা সম্পদ কিয়ামতে কোনো কাজে আসবে না।
- আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) অবলম্বন করাই হলো সেই দিনের জন্য প্রকৃত প্রস্তুতি।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াতটি সকল প্রকার ভুল ধারণা (যেমন: আমরা অমুক নবীর বংশধর, তাই মুক্তি পেয়ে যাব; বা আমাদের পূর্বপুরুষরা সুপারিশ করবে) থেকে মুসলিমদেরকে সাবধান করে দেয়। মুক্তি কেবল **আল্লাহর দয়া এবং সৎকর্মের** উপর নির্ভরশীল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- ব্যক্তিগতভাবে সৎকর্ম করা অপরিহার্য।
- আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচতে দুনিয়াতে তাকওয়া অবলম্বন করা উচিত।
- মুক্তি লাভের জন্য কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে, অন্য কারো ক্ষমতার উপর নয়।
- সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ।
এই আয়াতে বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ্ তাদের ইতিহাসের এক **সবচেয়ে কঠিন সময়** এবং সেই দুঃসময় থেকে **মুক্তি লাভের নিয়ামত** স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। ফেরাউন ও তার লোকেরা বনী ইসরাঈলদের ওপর অত্যন্ত **নির্মম অত্যাচার** করত, যার প্রধান দিক ছিল— নবজাতক **পুত্র সন্তানদের হত্যা** করা (মুসা আঃ এর জন্মের আগে বা পরে) এবং **নারীদেরকে জীবিত রাখা** (সেবা ও দাসত্বের জন্য)। আল্লাহ বলছেন যে, এই পরিস্থিতি (কঠিন শাস্তি ও মুক্তি উভয়ই) ছিল **তাদের রবের পক্ষ থেকে এক মহা পরীক্ষা (বালাউন আযীম)**। এই স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, তারা যেন তাদের **বিশাল অতীত নিয়ামত** স্মরণ করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় এবং নবীর আনুগত্যে ফিরে আসে।
মূল শিক্ষা:
- বিপদাপদ ও কঠিন পরিস্থিতি আল্লাহর পক্ষ থেকে **পরীক্ষা** স্বরূপ আসে।
- আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তি লাভও একটি **বিরাট নিয়ামত** যা কৃতজ্ঞতা দাবি করে।
- জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট থেকে উদ্ধারের স্মৃতি ভুলে যাওয়া চরম অকৃতজ্ঞতা।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষ যেন মনে না করে যে তাদের ক্ষমতা বা কৌশলে তারা বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে। বরং আল্লাহর রহমত ও ইচ্ছাতেই তারা মুক্তি পেয়েছিল। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, চরম কষ্টের সময়ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখা উচিত, কারণ তিনিই একমাত্র রক্ষাকারী।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কঠিনতম পরিস্থিতিতেও আল্লাহর রহমতের আশা ত্যাগ করা উচিত নয়।
- দুঃখ-কষ্ট, নিপীড়ন ও বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য পরীক্ষা।
- মুক্তি লাভের পর আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
- নিপীড়িত অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা এবং মুক্তি পাওয়ার পর কৃতজ্ঞ হওয়া, উভয়ই আল্লাহর ইবাদত।
এটি বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর একটি বিশাল অলৌকিক নিয়ামত-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা তাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল।
- **সমুদ্র বিভক্ত:** মুসা (আঃ)-এর লাঠির আঘাতে আল্লাহ্ সমুদ্রকে বিভক্ত করে বনী ইসরাঈলের জন্য শুকনো পথ তৈরি করে দেন।
- **বনী ইসরাঈলদের মুক্তি:** তারা সেই পথ ধরে সমুদ্র পার হয়ে নিরাপদে মুক্তি লাভ করে।
- **ফেরাউনের দলের নিমজ্জন:** যখন ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী সেই বিভক্ত পথে প্রবেশ করে, তখন আল্লাহ্ সমুদ্রকে আবার এক করে দেন এবং তারা সবাই বনী ইসরাঈলের চোখের সামনেই ডুবে মারা যায়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর ক্ষমতা অসীম, তিনি যেকোনো অসম্ভব কাজ সহজে করে দিতে পারেন।
- মুজিযা (অলৌকিক ঘটনা) আল্লাহর অস্তিত্ব ও রাসূলদের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
- আল্লাহ্ তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে চরম বিপদ থেকেও রক্ষা করেন এবং অবাধ্যদেরকে ধ্বংস করে দেন।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই ঘটনা বনী ইসরাঈলের মুক্তির চূড়ান্ত মুহূর্ত ছিল। এটি ছিল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের দাবির সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নিজের চোখের সামনে এমন অলৌকিক মুক্তি দেখার পরও আল্লাহর অবাধ্য হওয়া চরম অকৃতজ্ঞতার শামিল।
উদাহরণ:
যখন কোনো ব্যক্তি নিশ্চিত মৃত্যু বা ধ্বংসের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পায়, তখন তার উচিত জীবনের বাকি সময় আল্লাহর প্রতি পূর্ণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এই ঘটনা বনী ইসরাঈলের জন্য ঠিক তেমনই ছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর প্রতিদান ও শাস্তির বিধান খুবই বাস্তব।
- অবিচারী শাসক ও জাতিরা আল্লাহর শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারে না।
- বিপদের সময় আল্লাহর সাহায্য আসে ধৈর্য ও আনুগত্যের পরে।
- আল্লাহর নিয়ামত ভুলে গিয়ে বিদ্রোহ করা আত্ম-ধ্বংস ডেকে আনে।
আল্লাহ এখানে বনী ইসরাঈলের প্রতি আরেকটি গুরুতর অন্যায় কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। মূসা (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ এবং ৪০ রাতের জন্য ইবাদতে রত থাকার জন্য তুর পর্বতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে তারা বাছুরের মূর্তি তৈরি করে তার পূজা শুরু করে দেয়। তারা এই মূর্তিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে আল্লাহ্র সাথে **শিরক** করে ফেলে, যা ছিল চরম **অবিচার (যুলম)**। মাত্র কিছুদিন আগে ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর অসংখ্য মুজিজা দেখার পরও তাদের এই কাজ ছিল তাদের দুর্বল ইমান ও ওয়াদা ভঙ্গের চরম নিদর্শন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর অনুগ্রহের পর সামান্যতম সুযোগে **শিরক** করা চরম অকৃতজ্ঞতা।
- শরীয়তের প্রধানের (রাসূলের) অনুপস্থিতিতে দ্বীনের পথে অবিচল থাকা অত্যাবশ্যক।
- শিরক এবং ওয়াদা ভঙ্গ হলো মানবজাতির প্রতি সবচেয়ে বড় যুলম (অবিচার)।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, মানুষের মন কত দ্রুত সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে এবং নশ্বর বস্তু বা ক্ষমতা কীভাবে আল্লাহর ইবাদত থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়। এটি মুসলিমদেরকে **শিরক ও মূর্তিপূজা** থেকে সর্বদা সতর্ক থাকতে এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে শেখায়।
উদাহরণ:
যেমন একটি শিশু, যাকে তার পিতা কিছুক্ষণের জন্য ঘরে একা রেখে গেছেন এবং নিষেধ করেছেন যেন সে নিষিদ্ধ বস্তুটি স্পর্শ না করে, কিন্তু পিতার অবর্তমানে শিশুটি সেটিই করে ফেলে। তেমনি বনী ইসরাঈল মূসা আঃ এর অনুপস্থিতির সুযোগে মূর্তিপূজা করে চরম অন্যায় করেছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর প্রতি আমাদের ওয়াদা সর্বদা রক্ষা করতে হবে।
- আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ) হলো ইমানের মূল ভিত্তি, যার সাথে কোনো আপস নেই।
- পরীক্ষার সময়, বিশেষত যখন নেতৃত্ব অনুপস্থিত থাকে, তখন ধৈর্য ও ইমান ধরে রাখা উচিত।
- শিরককারী নিজের আত্মার প্রতি এবং আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বড় অত্যাচারী (যালিম)।
পূর্ববর্তী আয়াতে (৫১) বনী ইসরাঈলের গো-বাছুর পূজা করে **শিরক** করার গুরুতর অন্যায় কাজের কথা উল্লেখ করার পর, এই আয়াতে আল্লাহ্ তাদের প্রতি তাঁর অসীম করুণা ও ক্ষমার কথা ঘোষণা করেছেন। এত বড় পাপ করার পরও আল্লাহ তাদেরকে অবিলম্বে শাস্তি দেননি, বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন (যা পরবর্তীতে তাওবা ও নির্দেশ পালনের মাধ্যমে হয়েছিল)। এই ক্ষমা করার উদ্দেশ্য ছিল— যাতে তারা আল্লাহর নেয়ামত ও দয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং এর ফলস্বরূপ কৃতজ্ঞতা (শুকরিয়া) প্রকাশ করে তাঁর আনুগত্যের পথে ফিরে আসে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা তাঁর ক্রোধের উপর প্রাধান্য লাভ করে।
- পাপের পর আল্লাহর ক্ষমা লাভ করলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক।
- আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা করেন, যাতে তারা সঠিক পথে ফিরে আসে এবং শুকরিয়া আদায় করে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াতটি আল্লাহর আফু' (ক্ষমা) নামক গুণের প্রকাশ ঘটায়। এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বারবার সুযোগ দেন— যাতে তারা নিজেদের ভুল শুধরে নেয়। গুরুতর অন্যায় করার পরও শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করা হলো তাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত, যার ফলে তাদের উচিত আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মকভাবে কৃতজ্ঞ হওয়া।
উদাহরণ:
যেমন একজন পিতা তার অবাধ্য সন্তানকে গুরুতর ভুলের পরেও শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দেন, এই আশায় যে সন্তানটি তার ভুল বুঝতে পেরে ভবিষ্যতে ভালো হবে। তেমনি আল্লাহও বনী ইসরাঈলকে ক্ষমা করেছিলেন, যাতে তারা কৃতজ্ঞ হয়ে তাঁর আনুগত্য করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- গুনাহ (পাপ) করার পর তাড়াতাড়ি তাওবা করা আবশ্যক।
- আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা একটি বিরাট নিয়ামত, যার জন্য শুকরিয়া আদায় করতে হয়।
- ক্ষমা পাওয়ার পর অতীতের ভুলের কথা ভুলে না গিয়ে ঈমান ও আমলকে শক্তিশালী করা উচিত।
- আল্লাহর ক্ষমা মানুষকে নৈরাশ্য থেকে মুক্তি দিয়ে আশাবাদী করে তোলে।
পূর্বের আয়াতে (৫২) গো-বাছুর পূজার পাপ ক্ষমা করার কথা বলার পর, এই আয়াতে আল্লাহ্ বনী ইসরাঈলকে দ্বিতীয় একটি বিরাট নিয়ামত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন— মূসা (আঃ)-কে তাওরাত (কিতাব) এবং ফুরকান দান করা।
- **কিতাব (তাওরাত):** এটি ছিল তাদের জন্য জীবনবিধান।
- **ফুরকান (পার্থক্যকারী):** এর অর্থ হলো সেই সকল জ্ঞান, বোধ ও নিদর্শন (যেমন মুজিযা) যা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ্ কিতাব ও শরীয়ত নাযিল করেন মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য।
- আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত কিতাব হলো সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করার মানদণ্ড।
- আল্লাহর অনুগ্রহ (ক্ষমা ও হিদায়াত) লাভের পর সঠিক পথে চলার জন্য প্রয়াস চালানো আবশ্যক।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াতটি সকল মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঐশী নির্দেশনা (যেমন কুরআন) হলো অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার একমাত্র উপায়। তাওরাত বনী ইসরাঈলের জন্য এমন নির্দেশনা ছিল, যা থাকা সত্ত্বেও তারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল। এটি বর্তমান উম্মাহর জন্য সতর্কবার্তা যে, কুরআন থাকা সত্ত্বেও যেন তারা পথভ্রষ্ট না হয়।
উদাহরণ:
যেমন একটি গাড়ি যখন সঠিক পথে চলার জন্য দিকনির্দেশনা মানচিত্র পায়, তখন সে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। কিতাব ও ফুরকান হলো মুমিনদের জন্য এমন দিকনির্দেশনা।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ও উপলব্ধির মাধ্যমে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখা।
- শুধু কিতাব পাঠ নয়, এর নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা আবশ্যক।
- হিদায়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এক নেয়ামত, যার সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন।
- রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত কুরআনও আমাদের জন্য কিতাব ও ফুরকান।
এ আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে তাদের বড় গোনাহের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তারা গো-বাছুর পূজা করে নিজেদের উপর জুলুম করেছিল। আল্লাহ তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন তাওবা করে নিজেদের শাস্তি নিজেরাই কার্যকর করে (অর্থাৎ সত্যিকার অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের ভেতরের গোনাহ দূর করে, এমনকি কেউ কেউকে শারীরিকভাবে হত্যা করার নির্দেশও ছিল)। এ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষা, তবে এর মাধ্যমে তাদের তাওবা কবুল হয়।
মূল শিক্ষা:
- গুনাহ করে মানুষ আসলে নিজের উপরই জুলুম করে।
- আল্লাহর কাছে আন্তরিক তাওবা করলে তিনি ক্ষমা করে দেন।
- কখনও তাওবার শর্ত হিসেবে কঠিন পরীক্ষা আসতে পারে।
- আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা অসীম।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, বড় গোনাহ করলেও আল্লাহর কাছে আন্তরিক তাওবা করলে ক্ষমা পাওয়া যায়। তবে তাওবা শুধু মুখের কথা নয়, বরং সত্যিকার কর্ম ও অনুতাপের মাধ্যমে হতে হবে।
উদাহরণ:
যেমন একটি মানুষ বড় অপরাধ করলে শাস্তি ভোগ করে এবং পরে নতুন জীবন শুরু করে, তেমনি আন্তরিক তাওবা একজন বান্দাকে পূর্বের গোনাহ থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন দেয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- গোনাহ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
- তাওবা করার সুযোগ যতদিন আছে, তা গ্রহণ করা জরুরি।
- কঠিন পরীক্ষা তাওবার আন্তরিকতার প্রমাণ হতে পারে।
- আল্লাহ তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু— তাই হতাশ হওয়া যাবে না।
বনী ইসরাঈলরা তাদের চরম জেদ ও উদ্ধত আচরণের কারণে মূসা (আঃ)-কে বলেছিল— তারা আল্লাহকে প্রকাশ্যে না দেখা পর্যন্ত ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের এ ধৃষ্টতার জন্য বজ্রাঘাত দ্বারা আঘাত করেছিলেন। এটি ছিল তাদের জন্য কঠোর শাস্তি ও সতর্কবার্তা।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখা সম্ভব নয়, এটি মানুষের সীমার বাইরে।
- অতিরিক্ত জেদ ও শর্তারোপ আল্লাহর গজব ডেকে আনে।
- নবীর নির্দেশ অমান্য করা বড় অপরাধ।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত মানুষকে সতর্ক করে দেয় যেন তারা ঈমান আনার ব্যাপারে অবাঞ্ছিত শর্তারোপ না করে। ঈমান হলো গায়েবের উপর বিশ্বাস— চোখে দেখে প্রমাণ চাওয়ার বিষয় নয়।
উদাহরণ:
যেমন একজন ছাত্র যদি শিক্ষকের প্রতিটি কথায় প্রমাণ দাবি করে এবং কোনো আস্থা না রাখে, তবে সে কখনো শিক্ষকের কাছ থেকে উপকার পাবে না। তেমনি আল্লাহ ও রাসূলের বিষয়ে অতিরিক্ত শর্ত ঈমানের বিরুদ্ধে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- ঈমান আনার জন্য অদৃশ্যের উপর বিশ্বাস আবশ্যক।
- আল্লাহকে দেখা দুনিয়াতে সম্ভব নয়।
- নবীর প্রতি জেদ ও অবাধ্যতা গজবের কারণ হয়।
- ঈমান মানে বিনা শর্তে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ।
আগের আয়াতে বলা হয়েছিল যে, বনী ইসরাঈলরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে চাওয়ায় বজ্রাঘাতে মারা যায়। এরপর আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত করে পুনরায় জীবিত করেন, যাতে তারা এই মহান অনুগ্রহ উপলব্ধি করে এবং কৃতজ্ঞ হয়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ মৃত্যুর পর জীবন দান করতে সক্ষম।
- জীবন পাওয়া একটি মহান নিয়ামত, যার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
- শাস্তির পরও আল্লাহর রহমত তার বান্দাদেরকে আচ্ছাদিত করে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত মানুষের সামনে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন তুলে ধরে। তিনি যেমন মৃত্যু দেন, তেমনি পুনর্জীবিত করতেও সক্ষম। এটি আখিরাতে পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান দৃঢ় করার শিক্ষা দেয়।
উদাহরণ:
যেমন একটি শুকনো জমিনে বৃষ্টি নেমে গাছপালা আবার জীবিত হয়, তেমনি মানুষকেও আল্লাহ মৃত্যুর পর আবার জীবিত করতে সক্ষম।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
- আল্লাহ চাইলে মৃত্যুর পরও আবার জীবন দিতে পারেন।
- প্রত্যেক নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া আবশ্যক।
- আখিরাতের জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা ঈমানের অংশ।
যখন বনী ইসরাঈল মরুভূমিতে পথ হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল, তখন আল্লাহ তাদের জন্য মেঘের ছায়া দান করেন এবং আকাশ থেকে মান্না (এক ধরনের মিষ্টি খাদ্য) ও সালওয়া (এক প্রকার পাখি/কোয়েল জাতীয় খাদ্য) নাযিল করেন। কিন্তু তারা আল্লাহর এ নিয়ামতের কদর না করে অবাধ্যতা অব্যাহত রেখেছিল।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ কঠিন সময়ে তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষ নিয়ামত দান করেন।
- মান্না ও সালওয়া ছিল বনী ইসরাঈলের জন্য অলৌকিক রিযিক।
- আল্লাহর নিয়ামতের অবহেলা করা নিজের উপরই জুলুম করা।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ অসংখ্য নিয়ামত দান করেন। কিন্তু মানুষ কৃতজ্ঞ না হয়ে অবাধ্য হলে তা তাদের নিজেদের ক্ষতির কারণ হয়।
উদাহরণ:
যেমন কেউ পানির কদর না করলে তৃষ্ণায় কষ্ট পায়, তেমনি আল্লাহর নিয়ামতের কদর না করলে মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কষ্টের সময়ে আল্লাহ বিশেষ নিয়ামত দান করেন।
- রিযিকের ক্ষেত্রে হালাল ও পবিত্র অংশ থেকে খাওয়ার নির্দেশ রয়েছে।
- আল্লাহকে অবাধ্য করা মানে নিজের উপর জুলুম করা।
- নিয়ামতের কদর করলে তা বৃদ্ধি পায়, অকৃতজ্ঞ হলে তা নষ্ট হয়।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে নির্দেশ দেন— এক নগরে প্রবেশ করতে, বিনম্রভাবে (সিজদাকারী হয়ে) প্রবেশ করতে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। বিনিময়ে আল্লাহ তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করার অঙ্গীকার করেছিলেন এবং সৎকর্মশীলদের জন্য বাড়তি প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি বিনয়ী হওয়া অপরিহার্য।
- ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ পাপসমূহ ক্ষমা করেন।
- সৎকর্মশীলরা সর্বদা অতিরিক্ত প্রতিদান লাভ করেন।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষ যখন আল্লাহর অনুগ্রহ পায়, তখন অহংকার না করে বিনম্র হওয়া উচিত। কারণ, ক্ষমা ও অতিরিক্ত অনুগ্রহ কেবল আল্লাহরই পক্ষ থেকে আসে।
উদাহরণ:
যেমন শিক্ষক শুধু ভুল মাফ করেন না, বরং ভালো ছাত্রদের অতিরিক্ত পুরস্কার দেন। তেমনি আল্লাহও পাপ ক্ষমা করে সৎকর্মশীলদের জন্য বাড়তি পুরস্কার দেন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- নিয়ামতপ্রাপ্তির পর কৃতজ্ঞতা ও বিনয় প্রদর্শন করা উচিত।
- আল্লাহর কাছে সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
- সৎকর্ম আল্লাহর কাছে অতিরিক্ত পুরস্কারের কারণ।
- অহংকার নয়, বিনয়ী হওয়াই আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে আদেশ দিয়েছিলেন— নগরে বিনম্রভাবে প্রবেশ করতে এবং "হিট্তাহ" (ক্ষমা করো) শব্দটি বলতে। কিন্তু তারা বিদ্রূপ করে সেই শব্দকে পরিবর্তন করে অন্য কথা বলল। তাদের এই অবাধ্যতা ও বিদ্রূপের কারণে আল্লাহ আকাশ থেকে শাস্তি নাযিল করলেন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নির্দেশকে বিকৃত বা অবমাননা করা বড় অপরাধ।
- অবাধ্যতার ফলাফল হলো আল্লাহর শাস্তি।
- বান্দার দায়িত্ব হলো নির্দেশ যথাযথভাবে মানা, বিদ্রূপ করা নয়।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এ আয়াত সতর্ক করে দেয় যে, আল্লাহর বাণী নিয়ে ছলনা বা বিদ্রূপ করলে এর পরিণতি কঠিন শাস্তি। শুধু কথা নয়, নিখাঁদ আনুগত্যই কাম্য।
উদাহরণ:
যেমন ডাক্তার ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দিলে রোগী যদি তা উপহাস করে পরিবর্তন করে নেয়, তবে সুস্থতার বদলে সে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেমনি আল্লাহর নির্দেশ পরিবর্তন করলে শাস্তি অবধারিত।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর নির্দেশ হুবহু মানা আবশ্যক।
- ধর্ম নিয়ে বিদ্রূপ ও বিকৃতি মারাত্মক অপরাধ।
- অবাধ্যতার ফল সর্বদা শাস্তি।
- সততা ও আনুগত্যের মাধ্যমেই মুক্তি।
মরুভূমিতে পানি সংকট দেখা দিলে বনী ইসরাঈল মূসা (আঃ)-এর কাছে পানির আবেদন করে। আল্লাহ মূসাকে নির্দেশ দিলেন লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত করতে। তখন পাথর থেকে অলৌকিকভাবে বারোটি ঝরনা বের হয়েছিল, যাতে বনী ইসরাঈলের বারো গোত্র আলাদা আলাদা পানির উৎস পায়। এভাবে আল্লাহ তাদের জীবনধারণের জন্য অনন্য নিয়ামত দান করেছিলেন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ সংকটকালেও বান্দাকে জীবনোপকরণ দান করেন।
- প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ সুবিচার করেন (যেমন আলাদা পানির উৎস)।
- নিয়ামত পাওয়ার পর আল্লাহর অবাধ্যতা বা ফাসাদ সৃষ্টি করা উচিত নয়।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এ আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহ চাইলেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেন। একই সঙ্গে শিক্ষা দেয় যে, নিয়ামত পাওয়ার পর কৃতজ্ঞ থাকা ও ফাসাদ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
উদাহরণ:
যেমন একটি পরিবারে প্রত্যেক সদস্যকে আলাদা আলাদা প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার দিলে তারা শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। তেমনি আল্লাহ প্রতিটি গোত্রকে তাদের প্রয়োজনীয় ঝরনা প্রদান করেছিলেন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর উপর আস্থা রাখলে তিনি অনন্য উপায়ে সাহায্য করেন।
- প্রত্যেক সম্প্রদায়কে আল্লাহ সুবিচার করেন।
- নিয়ামত পেয়ে অকৃতজ্ঞ হওয়া বা ফাসাদ সৃষ্টি করা মারাত্মক অপরাধ।
- মানবজাতির কল্যাণের জন্য আল্লাহর নির্দেশ মানাই মুক্তির পথ।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে মান্না ও সালওয়ার মতো মহামূল্যবান খাবার দান করেছিলেন। কিন্তু তারা সে নিয়ামতের কদর না করে শাক-সবজি, শসা, মসুর ও পেঁয়াজ চাইতে থাকে। এতে তাদের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। তাদের এই কৃতঘ্নতা ও অপরাধের কারণে তাদের উপর লাঞ্ছনা, দারিদ্র্য ও আল্লাহর গযব নাযিল হয়েছিল।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের কদর করা অপরিহার্য।
- সর্বোত্তম জিনিসকে ফেলে নিকৃষ্ট জিনিস কামনা করা কৃতঘ্নতার নিদর্শন।
- অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনের পরিণতি হলো আল্লাহর গযব।
- নবী হত্যার মতো অপরাধ আল্লাহর গযব ডেকে আনে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষ প্রায়শই আল্লাহর দেওয়া উত্তম নিয়ামতের কদর না করে ক্ষুদ্র জিনিসের প্রতি আসক্ত হয়। এটি অকৃতজ্ঞতার পরিচয় এবং আল্লাহর শাস্তি ডেকে আনে।
উদাহরণ:
যেমন কেউ সোনা হাতে পেয়ে তা ছেড়ে লোহা নিতে চায়, এটি তার মূর্খতা ও অকৃতজ্ঞতার প্রমাণ। তেমনি বনী ইসরাঈলও উত্তম নিয়ামতের বিনিময়ে তুচ্ছ জিনিস চাইছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের কদর করা উচিত।
- কৃতঘ্নতা ও অবাধ্যতা মানুষকে ধ্বংস করে।
- আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করা মারাত্মক অপরাধ।
- নবীদের প্রতি অন্যায় আচরণ গযব ডেকে আনে।
এই আয়াতটি ইসলামের সর্বজনীন দাওয়াতকে তুলে ধরে। এখানে বলা হয়েছে— শুধু নামধারী মুসলিম হওয়া নয়, বরং প্রকৃত ঈমান, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং সৎকর্মই মুক্তির মূল শর্ত। পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যেও যে কেউ এই শর্তগুলো পূরণ করেছে, আল্লাহ তার পুরস্কার নিশ্চিত করেছেন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর প্রতি ঈমান, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং সৎকর্ম— মুক্তির তিন মূল স্তম্ভ।
- ধর্মের নাম নয়, আসল হলো ঈমান ও আমল।
- যারা এই শর্ত পূরণ করবে, তাদের জন্য কোনো ভয় বা দুঃখ নেই।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
এ আয়াত মুসলিমদের শিক্ষা দেয় যে, কেবল পরিচয়ের উপর নির্ভর না করে প্রকৃত ঈমান ও সৎকর্মে মনোযোগী হতে হবে। পূর্ববর্তী উম্মতের কাহিনিতে আমাদের জন্য সতর্কবার্তা।
উদাহরণ:
যেমন পরীক্ষায় শুধু ছাত্রের নাম নয়, তার উত্তরপত্রই সফলতার মাপকাঠি। তেমনি আল্লাহর দরবারে শুধু পরিচয় নয়, বরং ঈমান ও আমলই মুক্তির ভিত্তি।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান অপরিহার্য।
- সৎকর্ম ছাড়া ঈমান পূর্ণ হয় না।
- পূর্ববর্তী উম্মতের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
- মুক্তির জন্য শুধু পরিচয় নয়, ঈমান ও সৎকর্মই আসল।
বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ তাওরাত দিয়েছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে তারা এর বিধান মেনে চলবে। কিন্তু তারা অবহেলা করলে, আল্লাহ তূর পাহাড় তাদের উপর উঠিয়ে ধরেন যেন তারা আল্লাহর আদেশ মানতে বাধ্য হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল— তারা যেন কিতাবের নির্দেশ দৃঢ়ভাবে মানে এবং তাকওয়াবান হয়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর কিতাব দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা ঈমানের শর্ত।
- আল্লাহ অবাধ্যতাকে কখনো হালকা করে দেখেন না।
- তাকওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহর কিতাব মেনে চলা আবশ্যক।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
কিতাব মেনে চলা ছাড়া তাকওয়া ও মুক্তি সম্ভব নয়। এ আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয়— দ্বীন পালনে উদাসীনতা আল্লাহর গযব ডেকে আনে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা উচিত।
- তাকওয়া অর্জনের জন্য কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলা জরুরি।
- অবাধ্যতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
- বান্দাকে সর্বদা আল্লাহর আদেশের প্রতি আন্তরিক থাকতে হবে।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে কিতাব ও অঙ্গীকারের নিয়ামত দিলেন, পাহাড় তুলে সতর্কও করলেন। তবুও তারা অবাধ্য হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের কারণে তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেননি। না হলে তারা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কেউ ধ্বংস থেকে রক্ষা পায় না।
- অবাধ্যতা মানুষকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়।
- আল্লাহ দয়া না করলে বান্দার কোন মুক্তি নেই।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষের অবাধ্যতা অনেক সময় ধ্বংস ডেকে আনে। কিন্তু আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার কারণে মানুষ আবারও বেঁচে যায়। এ আয়াত মানুষকে আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
উদাহরণ:
যেমন কোনো অপরাধীকে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা থাকলেও রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করলে সে বেঁচে যায়। তেমনি আল্লাহর অনুগ্রহেই বান্দা ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত ছাড়া মুক্তি নেই।
- অবাধ্যতার কারণে ক্ষতি নিশ্চিত, যদি না আল্লাহ দয়া করেন।
- আল্লাহর দয়া পাওয়ার জন্য তাঁর আনুগত্য করা জরুরি।
- কৃতজ্ঞ না হলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বনী ইসরাঈলকে শনিবার (সাবাথ দিবস) ইবাদতের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। সেদিন শিকার করা তাদের জন্য হারাম ছিল। কিন্তু তারা চতুরতার আশ্রয় নিয়ে শনিবারে মাছ ফাঁদে আটকাত, তারপর রবিবারে সেগুলো ধরে খেত। এভাবে তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছিল। এর ফলস্বরূপ, আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি হিসেবে বানরে রূপান্তরিত করেছিলেন।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারীরা কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হয়।
- নিষিদ্ধ কাজকে কৌশলে বৈধ করার চেষ্টা মহাপাপ।
- সাবাথের ঘটনা বর্তমান উম্মাহর জন্য একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা।
আল্লাহ শনিবারে সীমালঙ্ঘনকারীদের বানরে রূপান্তরিত করে এক ভয়াবহ শাস্তি দিলেন। কিন্তু এই শাস্তি শুধু তাদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের মানুষের জন্য একটি শিক্ষা ও সতর্কবার্তা তৈরি করা হলো। মুত্তাকীরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেবে এবং আল্লাহর বিধান ভঙ্গ করার ধৃষ্টতা করবে না।
মূল শিক্ষা:
- অতীতের শাস্তির ঘটনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উপদেশস্বরূপ।
- আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করলে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে।
- মুত্তাকীরা অতীতের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সংশোধন করে।
বর্তমানের উদাহরণ:
- যেমন রাষ্ট্রে যখন কোনো বড় দুর্নীতিবাজ বা অপরাধীকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়, তখন শুধু সে-ই নয়, অন্যরাও শিক্ষা নেয় এবং ভয় পায়।
- অথবা ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার কারণে কোনো চালকের বড় অঙ্কের জরিমানা হলে, অন্য চালকেরাও সতর্ক হয়— "এভাবে করলে আমাকেও জরিমানা গুনতে হবে।"
- তেমনি আল্লাহর বিধান অমান্যকারীদের উপর নাযিল হওয়া শাস্তি ইতিহাসে এক শিক্ষা, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম আল্লাহকে ভয় করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- অতীতের শাস্তির ঘটনা শুধু ইতিহাস নয়, বরং আমাদের জন্য জীবন্ত শিক্ষা।
- আল্লাহর বিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা সর্বনাশ ডেকে আনে।
- যে আল্লাহকে ভয় করে, সে-ই সত্যিকার অর্থে সাফল্য অর্জন করে।
- বর্তমান যুগের মানুষকেও অতীতের শিক্ষা স্মরণ করে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বনী ইসরাঈল এক হত্যার ঘটনার সত্য উদ্ঘাটনের জন্য আল্লাহর কাছে সমাধান চাইলে, আল্লাহ তাদেরকে একটি গাভী জবাই করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা আজ্ঞাবহ হওয়ার বদলে মূসা (আঃ)-এর সাথে বিতর্ক শুরু করে এবং তাঁকে উপহাস করার অভিযোগ করে। মূসা (আঃ) স্পষ্ট করে দেন— আল্লাহর আদেশকে উপহাস করা অজ্ঞতা ও গোমরাহির কাজ।
বর্তমানের উদাহরণ:
- যেমন ডাক্তার যখন রোগীর জন্য ওষুধ দেন, রোগী যদি বলে — “আপনি কি আমাকে ঠাট্টা করছেন?” তবে সে নিজের ক্ষতিই করবে।
- তেমনি আল্লাহর হুকুমকে হালকাভাবে নেওয়া বা ঠাট্টা করা মানুষের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর নির্দেশকে কখনো হালকাভাবে নেওয়া বা উপহাস করা চলবে না।
- অজ্ঞতা মানুষের মধ্যে আল্লাহর আদেশের প্রতি উপহাসের প্রবণতা সৃষ্টি করে।
- নবী-রাসূলগণ সবসময় আল্লাহর পক্ষ থেকে হক্ব আদেশ দেন— এতে সন্দেহ বা বিদ্রূপের অবকাশ নেই।
- বিশ্বাসীর কর্তব্য হলো বিনা দ্বিধায় আল্লাহর হুকুম মেনে নেওয়া।
বনী ইসরাঈলকে একটি গরু কোরবানি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সরাসরি পালন না করে বারবার অযথা প্রশ্ন করছিল। এখানে মূসা (আঃ) জানালেন যে, গরুটি না অতি বুড়ি, না অতি ছোট, বরং মধ্যবয়সী হতে হবে। মূল উদ্দেশ্য ছিল — বিনা প্রশ্নে আল্লাহর নির্দেশ মানা। অথচ তারা নির্দেশের চেয়ে বেশি বিতর্ক করছিল।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন, কারো শিক্ষক বা অভিভাবক কোনো কাজ করতে বলেন। সহজভাবে কাজটি সম্পন্ন করার বদলে যদি সে বারবার অযথা প্রশ্ন করে, বা দেরি করতে থাকে, তবে সে কাজও জটিল হয়ে যায় এবং সময়ও নষ্ট হয়। আল্লাহর নির্দেশের ক্ষেত্রেও তাই — বেশি তর্ক করলে সহজ কাজ কঠিন হয়ে যায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে দেরি বা অতিরিক্ত প্রশ্ন করা উচিত নয়।
- সহজ কাজকে জটিল করা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।
- আজ্ঞাপালন দ্রুত করা আল্লাহর সন্তুষ্টি আনে।
বনী ইসরাঈল আবারও প্রশ্ন তুলল, এবার গরুর রং নিয়ে। আল্লাহ জানালেন যে, এটি এমন একটি উজ্জ্বল হলুদ রঙের গরু হবে, যা দেখলে মানুষের চোখ আনন্দিত হয়। এটি ছিল তাদের বাড়তি প্রশ্নের উত্তর, অথচ প্রয়োজন ছিল না — কারণ নির্দেশ শুধু "একটি গরু কোরবানি করো"। তারা নিজেই তাদের কাজ কঠিন করে তুলেছিল।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন, কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে একটি কাজের জন্য সহজ নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু কেউ বারবার বাড়তি শর্ত বা ব্যাখ্যা চাইতে থাকে। ফলে কাজটি সহজ থেকে জটিল হয়ে যায় এবং সময়ক্ষেপণ ঘটে। আল্লাহর নির্দেশ পালনেও অযথা শর্ত খোঁজা একই রকম সমস্যা সৃষ্টি করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- অতিরিক্ত কৌতূহল ও তর্ক অনেক সময় কাজকে জটিল করে তোলে।
- আল্লাহর আদেশ মানার ক্ষেত্রে সরলতা ও দ্রুততা গুরুত্বপূর্ণ।
- দুনিয়ার সৌন্দর্য (যেমন দৃষ্টিনন্দন জিনিস) আল্লাহর নিদর্শন, তবে সেটি মূল উদ্দেশ্য নয়।
বনী ইসরাঈল আবারও জটিল প্রশ্ন তুলল— এবার তারা বলল, বিভিন্ন গরু দেখতে একই রকম, তাই তারা সঠিক গরুটি বুঝতে পারছে না। অথচ তারা নিজেরাই এই জটিলতা তৈরি করেছিল বারবার প্রশ্ন করার মাধ্যমে। তবে তারা একটি ভালো কথা বলেছিল— "ইনশাআল্লাহ আমরা সঠিকটা খুঁজে পাব।"
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন, কোনো সহজ কাজ করতে বলা হলে কেউ বারবার অজুহাত তুলে বলে— “অনেক অপশন আছে, আমরা কোনটা বেছে নেব বুঝতে পারছি না।” অথচ সে যদি শুরুতেই নির্দেশ মেনে নিত, তবে কাজ এত জটিল হতো না। একইভাবে, আল্লাহর নির্দেশ মানতে দেরি করলে মানুষ নিজেই নিজের জন্য কষ্ট বাড়ায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে দেরি না করে দ্রুত কাজ করা উচিত।
- বারবার প্রশ্ন ও অজুহাত মানুষের জন্য কষ্ট ডেকে আনে।
- “ইনশাআল্লাহ” বলা একটি উত্তম অভ্যাস, তবে তা কাজ ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়, বরং আন্তরিকতার সাথে মানা উচিত।
এটি গরু কোরবানির ঘটনার শেষ অংশ। বনী ইসরাঈল বারবার প্রশ্ন করে গরুর শর্তকে **অত্যন্ত কঠিন** করে ফেলেছিল। এই শেষ শর্তে আল্লাহ্ নির্দিষ্ট করে দিলেন যে, গরুটি হতে হবে:
- **কাজ না করা:** জমি চাষ বা পানি সেচের কাজে কখনও ব্যবহৃত হয়নি (অর্থাৎ মূল্যবান ও অলস)।
- **নিখুঁত ও দাগমুক্ত:** সম্পূর্ণ সুস্থ, কোনো রং-এর ভিন্নতা বা খুঁত নেই।
আধুনিক উদাহরণ:
একজন শিক্ষক যখন ছাত্রকে একটি সহজ অ্যাসাইনমেন্ট দেন, আর ছাত্রটি বারবার প্রশ্ন করে তা এমন জটিল করে ফেলে যে, শেষে সেই কাজটিই করা তার জন্য অসম্ভব বা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহর নির্দেশ পালনে গড়িমসি করলে তার পরিণতিও এমন কঠিন হয়।
শিক্ষণীয় বিষয় :
- আল্লাহর নির্দেশ পালনে **তাড়াহুড়ো ও দ্রুততা** কাম্য, অহেতুক প্রশ্ন করা উচিত নয়।
- অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন **ইবাদতের পথ** কঠিন করে তোলে।
- কোনো কাজ করতে গিয়ে গড়িমসি বা অনিচ্ছা প্রকাশ করা **মুনাফেকির** লক্ষণ।
এটি সেই ঘটনার শুরু, যার সমাধানের জন্য আল্লাহ্ গো-বাছুর জবাইয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বনী ইসরাঈল গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধনী ব্যক্তি নিহত হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর তারা **একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে** প্রকৃত খুনিকে আড়াল করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করলেন যে, তারা যা কিছু **গোপন** করছে, তিনি তা **প্রকাশ করে দেবেন**। এই আয়াতটি আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার উপর জোর দেয়; যেখানে মানুষ মন্দ কাজ করে তা আড়াল করতে চাইলেও, আল্লাহ ঠিকই তা প্রকাশ করে দেন।
মূল শিক্ষা:
- হত্যা একটি গুরুতর পাপ এবং তার সত্য লুকানো আরও বড় অপরাধ।
- আল্লাহর জ্ঞান সর্বত্র পরিব্যাপ্ত; তাঁর কাছে কোনো কিছু গোপন করা সম্ভব নয়।
- নিজের অন্যায়কে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া মুনাফেকী আচরণ।
আধুনিক উদাহরণ:
আধুনিক যুগে ফরেনসিক বা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে যেমন অনেক পুরোনো গোপন অপরাধ প্রকাশ হয়ে যায়, তেমনি আল্লাহ্ও অলৌকিক উপায়ে সেই সময়ের গোপন হত্যাকাণ্ড প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মানুষকে প্রমাণ করা হয় যে, মানুষ যতই চালাকি করুক না কেন, **সত্যকে আড়াল করা যায় না**।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- মানুষের উচিত সর্বদা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যায় গোপন না করা।
- আমরা যা গোপন করি, আখিরাতে তা আল্লাহর সামনে উন্মোচিত হবে— এই বিশ্বাসে সৎ থাকা।
- আল্লাহর বিধান বা অলৌকিক ক্ষমতা মানুষের সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ্ বনী ইসরাঈলের গো-বাছুর সংক্রান্ত দীর্ঘ প্রশ্নের সমাপ্তি ঘটিয়ে **অলৌকিক সমাধান** দান করলেন। গরু জবাই করার পর আল্লাহ নির্দেশ দিলেন— সেই গরুর **যেকোনো একটি অংশ** (যেমন একটি গোশত খণ্ড বা হাড়) দিয়ে নিহত ব্যক্তির মৃতদেহকে আঘাত করতে।
- নির্দেশ পালনের সাথে সাথেই **মৃত লোকটি আল্লাহর ইচ্ছায় জীবিত হয়ে ওঠে**।
- জীবিত হয়ে সে **প্রকৃত খুনির নাম** প্রকাশ করে আবার মৃত্যুবরণ করে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর ক্ষমতার সামনে জাগতিক নিয়ম-কানুন তুচ্ছ। তিনি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম।
- অলৌকিক নিদর্শনগুলি মূলত **পরকালের সত্যতা** (পুনরুত্থান) প্রমাণের জন্য দেখানো হয়।
- দীর্ঘ গড়িমসি সত্ত্বেও, আল্লাহর নির্দেশের মধ্যেই সমস্যার **চূড়ান্ত সমাধান** নিহিত থাকে।
আধুনিক উদাহরণ:
এই ঘটনাকে এমন একটি জটিল সমস্যা সমাধানের সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে সবাই যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর, অপ্রত্যাশিত ও সহজ একটি সমাধান আসে যা **প্রকৃতির বাইরে**। এই অলৌকিক সমাধান বিশ্বাসীদের মনে আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি দৃঢ়তা আনে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কিয়ামতের দিন পুনরুত্থান সম্ভব এবং বাস্তব।
- আল্লাহর দেওয়া জ্ঞান ও নিদর্শনের মাধ্যমে জীবনের সত্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করা উচিত।
- সব ধরনের সন্দেহের ঊর্ধ্বে আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
এই আয়াতটি আগের অলৌকিক ঘটনার (মৃতকে জীবিত করা) **প্রভাবহীনতা** দেখে বনী ইসরাঈলের **হৃদয়ের কঠিনতা** নিয়ে মন্তব্য করেছে। আল্লাহ বলছেন, এত বড় মুজিযা (নিদর্শন) দেখার পরেও তাদের হৃদয় **পাথরের মতো** কঠিন হয়ে গেছে— এমনকি কিছু ক্ষেত্রে **তার চেয়েও বেশি কঠিন**। **পাথরের তিনটি অবস্থা:** আল্লাহ্ তুলনা করে দেখিয়েছেন যে, পাথরেরও সংবেদনশীলতা আছে:
- যে পাথর থেকে নদী প্রবাহিত হয় (যার দ্বারা জীবন দান হয়)।
- যা ফেটে গিয়ে পানি বের হয় (নম্রতার প্রাথমিক প্রকাশ)।
- যা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ে (আল্লাহর প্রতি বিনয় ও শ্রদ্ধার চূড়ান্ত প্রকাশ)।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নিদর্শন দেখার পরও হৃদয় কঠিন হয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় **আধ্যাত্মিক রোগ**।
- পাথরের মতো জড় বস্তুরও আল্লাহর প্রতি বিনয় থাকতে পারে, যা মানুষের জন্য শিক্ষণীয়।
- **তাকওয়া** (আল্লাহর ভয়) মানুষকে কঠিনতা থেকে রক্ষা করে।
আধুনিক উদাহরণ:
আজকের যুগে যখন কেউ অসংখ্য **প্রমাণ, উপদেশ ও নিদর্শন** দেখার পরেও কোনোভাবেই সত্য গ্রহণ করে না, তখন তাদের অবস্থা এই কঠিন হৃদয়ের মানুষের মতো। তারা জেনে বুঝেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর আয়াত ও উপদেশ শুনে হৃদয়কে **নম্র** করার চেষ্টা করতে হবে।
- দুনিয়ার প্রতি অতি আসক্তি এবং অহংকার হৃদয়ের কঠিনতার প্রধান কারণ।
- সদা মনে রাখতে হবে, আল্লাহ আমাদের প্রতিটি কাজ দেখছেন এবং সবকিছুর বিচার হবে।
পূর্বের আয়াতে বনী ইসরাঈলের হৃদয়ের কঠিনতা নিয়ে বলার পর, এই আয়াতে **রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাহাবীদের** উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, এই ধরনের লোকদের থেকে **ঈমান আশা করা উচিত নয়**। তাদের পূর্বপুরুষদের (ইয়াহুদী আলেমদের) একটি চরিত্রগত ত্রুটি ছিল— তারা:
- **আল্লাহর কালাম শুনত** (তাওরাতের আয়াত);
- তা **ভালোভাবে বুঝত** (তাদের কাছে কোনো সন্দেহ ছিল না);
- তবুও **জেনে-বুঝে তা বিকৃত করত** (হয় শব্দের পরিবর্তন করত, না হয় অর্থের অপব্যাখ্যা করত)।
মূল শিক্ষা:
- ধর্মীয় নির্দেশনা **জেনে-বুঝে বিকৃত করা** সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধ।
- যাদের অন্তর কঠিন এবং সত্যকে লুকানোর অভ্যাস আছে, তাদের ঈমান প্রত্যাশা করা **অবাস্তব**।
- দ্বীনের সঠিক জ্ঞান থাকার পরেও তা অস্বীকার বা বিকৃত করার ফল খুবই ভয়াবহ।
আধুনিক উদাহরণ:
একজন ব্যক্তি কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সত্য সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হওয়ার পরও যখন **ব্যক্তিগত স্বার্থের** জন্য সেই সত্যকে জনসাধারণের কাছে ঘুরিয়ে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করে, তখন তার আচরণ এই আয়াতের বর্ণিত চরিত্রের অনুরূপ হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কুরআন ও সুন্নাহর বাণীকে তার **আসল অর্থে** বুঝতে হবে এবং কোনো বিকৃতি থেকে বিরত থাকতে হবে।
- সত্য জানা সত্ত্বেও তা গোপন করা বা পরিবর্তন করা একজন আলেমের জন্য অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
- মুমিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং পথভ্রষ্টদের ঈমানের আশায় নিজেদের সময় নষ্ট না করা।
এই আয়াতে আল্লাহ্ **ইয়াহুদী মুনাফিকদের দ্বিচারিতা** এবং তাদের মধ্যেকার **অভ্যন্তরীণ বিতর্কের** চিত্র তুলে ধরেছেন। তারা দু'রকম আচরণ করত:
- **মুমিনদের সামনে:** তারা আন্তরিকতার ভান করে বলত যে, তারা বিশ্বাসী বা ইসলাম গ্রহণ করেছে।
- **নিভৃতে নিজেদের মধ্যে:** তারা যখন একা হত, তখন একদল অন্য দলকে তিরস্কার করত।
মূল শিক্ষা:
- দ্বিচারিতা (মুনাফিকী) সত্যকে লুকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কখনোই সফল হয় না।
- সত্যের জ্ঞান (যা আল্লাহ প্রকাশ করেছেন) গোপন করার চেষ্টা মূলত **নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদেরই যুক্তি** তৈরি করা।
- আল্লাহর বাণী মানুষের **বিবেককে** প্রশ্ন করে: "তোমরা কি তবে বুঝতে পারো না?"
আধুনিক উদাহরণ:
এই ঘটনাকে এমন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তুলনা করা যায়, যিনি জনসমক্ষে একরকম কথা বলেন (যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য), কিন্তু নিভৃতে তার দলের মধ্যে সেই সত্য প্রকাশ করার জন্য সতর্ক করেন, কারণ সেই সত্য তার স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করা উচিত নয়, এমনকি যদি তা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিকরও হয়।
- মানুষের সামনে একরকম এবং গোপনে অন্যরকম আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- সকল মানুষের উচিত বিবেককে কাজে লাগানো এবং আল্লাহর বাণীর উদ্দেশ্য অনুধাবন করা।
এই আয়াতটি আগের আয়াত ৭৬-এর একটি সরাসরি খোলামেলা তিরস্কার ও প্রশ্ন। আয়াত ৭৬-এ ইয়াহুদী মুনাফিকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল যে, কেন তাদের কিতাবে থাকা সত্য (মুহাম্মাদ স. সম্পর্কে) মুসলিমদের কাছে প্রকাশ করা হচ্ছে, যা কিয়ামতের দিন তাদের বিপদে ফেলতে পারে। এই আয়াতে আল্লাহ্ তাদের অজ্ঞতা ও দ্বিচারিতা প্রকাশ করে বলছেন: "তারা কি এতটুকুও জানে না যে, আল্লাহ্ জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে?" এই প্রশ্নের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে:
- তারা নিজেদের কিতাবে থাকা তথ্য মুসলিমদের কাছে প্রকাশ করা নিয়ে যে গোপন ফিসফিসানি করছিল, আল্লাহ্ তা সবই জানেন।
- তাদের দ্বিমুখী আচরণ (মুসলিমদের কাছে ঈমানের ভান করা, আর গোপনে তা অস্বীকার করা) আল্লাহর কাছে গোপন নয়।
- যদি তারা ভয় পায় যে, তাদের প্রকাশ করা তথ্যের ভিত্তিতে মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করবে, তবে তারা কি ভুলে গেছে যে, **আল্লাহ্ নিজেই তো তাদের মনের সব গোপন কথা** জানেন এবং তিনিই বিচারের জন্য যথেষ্ট?
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর জ্ঞান প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছুর উপর পরিব্যাপ্ত।
- দ্বিচারিতা বা প্রতারণা আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে খোলাসা।
- আল্লাহকে ভয় না করে নিজেদের বুদ্ধি ও চতুরতার উপর ভরসা করা বোকামি।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আমাদের সব কাজ ও চিন্তা-ভাবনা আল্লাহর কাছে উন্মুক্ত— এই বিশ্বাস নিয়ে জীবন যাপন করা।
- গোপনে বা প্রকাশ্যে সব সময় সততা বজায় রাখা, কারণ কোনো কিছুই আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ্ ইয়াহুদীদের সাধারণ ও অশিক্ষিত জনগণের একটি অংশের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। পূর্বের আয়াতগুলোতে আলেম ও মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছিল, যারা জেনে-বুঝে সত্য গোপন বা বিকৃত করত। এই আয়াতে বলা হচ্ছে:
- নিরক্ষর (উম্মিয়্যূওন): এই লোকেরা লেখাপড়া জানে না, ফলে তারা তাওরাতের আসল শিক্ষা সম্পর্কেও অজ্ঞ।
- **মিথ্যা আশা (আমা-নিয়্যা): তারা তাদের আলেমদের কাছ থেকে শোনা কিছু মিথ্যা সান্ত্বনা, মনগড়া ফযিলত বা অলীক আশা ছাড়া কিতাবের মূল জ্ঞান রাখে না। যেমন— তারা ধারণা করত, ইয়াহুদী হওয়ার কারণে তাদেরকে সামান্য শাস্তি দিয়েই জান্নাতে দিয়ে দেওয়া হবে।
- **অমূলক ধারণা: তারা প্রকৃত সত্যের পরিবর্তে অন্ধ বিশ্বাস ও অনুমান (যা আলেমদের কাছ থেকে কিনে নেওয়া) এর উপর নির্ভর করে।
মূল শিক্ষা:
- ধর্মীয় বিষয়ে অন্ধ অনুসরণ মানুষকে সত্য থেকে দূরে নিয়ে যায়।
- আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে নিজস্ব জ্ঞান অর্জন করা উচিত, কেবল অন্যের কথায় নির্ভর করা উচিত নয়।
- ধর্মকে **অলীক আশা ও ধারণা** এর উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা মারাত্মক ভুল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- প্রত্যেক মুসলমানের সাধ্যমতো কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা অপরিহার্য।
- নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস যেন কোনো মিথ্যা আশার উপর বা লোকজনের মনগড়া কথার উপর ভিত্তি করে তৈরি না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
এই আয়াতে ইয়াহুদী আলেম সমাজের সেই অংশের প্রতি চরম হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, যারা অর্থ বা পার্থিব লাভের বিনিময়ে আল্লাহর কিতাবের (তাওরাতের) মূল বক্তব্য পরিবর্তন, বিকৃতি বা গোপন করত এবং সেই মিথ্যা কথাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বলে প্রচার করত। **'ওয়াইলুন' (فَوَيْلٌ)** দ্বারা **মহাধ্বংস, দুর্ভোগ বা জাহান্নামের একটি কঠিন উপত্যকাকে** বোঝানো হয়েছে। তাদের এই জঘন্য অপরাধের জন্য আল্লাহ্ তাদের **দ্বিগুণ দুর্ভোগ** ঘোষণা করেছেন: ১) **তাদের হাতের রচনার জন্য** (মিথ্যা ও বিকৃতির জন্য) এবং ২) **তাদের উপার্জনের জন্য** (যা তারা ধর্মীয় প্রতারণার মাধ্যমে লাভ করেছে)।
মূল শিক্ষা:
- ধর্মীয় বিষয়ে বিকৃতি বা মিথ্যা আরোপ একটি **মারাত্মক পাপ**, যা চিরস্থায়ী শাস্তির কারণ।
- পার্থিব স্বার্থের জন্য **ধর্মের অপব্যবহার** আল্লাহর কাছে জঘন্য অপরাধ।
মূল বার্তা:
মূল শিক্ষা:
এই আয়াতটি সেই সব লোকের ভ্রান্ত দাবি খণ্ডন করে, যারা মনে করত যে, তারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত বলে তাদের সামান্য পাপের জন্য শাস্তি হলেও তা হবে খুবই কম সময়ের জন্য। আল্লাহ এখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছেন যে, মুক্তি কোনো বংশ বা জাতিগত অধিকার নয়, বরং তা নির্ভর করে কর্মের উপর। এই আয়াতে জাহান্নামের চিরস্থায়ী অধিবাসী হওয়ার দুটি শর্ত বলা হয়েছে:
- সাইয়্যিআহ (পাপ) অর্জন: অর্থাৎ মন্দ কাজ করা।
- খতিয়াহ্ (পাপরাশি) দ্বারা পরিবেষ্টিত: এর অর্থ হলো— শিরক ও কুফরীর মতো এমন গুরুতর পাপ করা, যা মানুষকে সম্পূর্ণরূপে ঈমান থেকে বঞ্চিত** করে ফেলে এবং যার ফলে সে **কোনো নেক কাজ দ্বারা নিজেকে মুক্ত** করতে পারে না। সহজ ভাষায়, এটি হলো কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা।
মূল শিক্ষা:
- পরকালে মুক্তি বংশ বা জাতিগত পরিচয়ের উপর নির্ভর করে না।
- সব পাপ নয়, বরং শিরক ও কুফরির মতো মহাপাপের ফলে মানুষ জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে।
- মানুষ যেন শুধু নেক কাজের উপর মনোযোগ দেয় এবং আল্লাহর দয়া ছাড়া অন্য কিছুতে ভরসা না করে।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন, কোনো একটি বিখ্যাত কোম্পানির কর্মকর্তা মনে করতে পারে যে, তার পরিচয়ের জন্য সে শাস্তির ঊর্ধ্বে। কিন্তু কোম্পানি বলে দিল যে, নিয়ম ভঙ্গ করে যে কেউ চুরি করলে তাকে **চিরতরে** বরখাস্ত করা হবে, তার পদবি যাই হোক না কেন। এই আয়াত তেমনই **ঈমান ও কর্মের** চূড়ান্ত গুরুত্বকে বোঝায়।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- কোনো ভ্রান্ত আশায় নয়, বরং আল্লাহর ভয় ও সৎ কর্মের মাধ্যমেই মুক্তি লাভ সম্ভব।
- বড় ধরনের পাপ ও অন্যায় থেকে নিজেকে দূরে রাখা আবশ্যক।
- প্রতিটি মানুষের কর্মই তার পরিণাম নির্ধারণ করে।
এই আয়াতটি আগের (৮১ নম্বর) আয়াতের বিপরীত ফল বর্ণনা করে, যা মানুষকে আশা ও প্রেরণা যোগায়। আগের আয়াতে পাপীদের চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকার কথা বলা হয়েছিল, আর এই আয়াতে মুমিন ও সৎকর্মশীলদের জন্য সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। জান্নাত লাভের দুটি মূল ভিত্তি:
- ঈমান: আল্লাহর একত্ব, রাসূলগণের রিসালাত, কিতাবসমূহ এবং পরকালের প্রতি দৃঢ় ও আন্তরিক বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই হলো সকল কর্মের ভিত্তি।
- আমালুস-সালিহাত (সৎকাজ): অর্থাৎ, সেই বিশ্বাস অনুযায়ী শরীয়তসম্মত ভালো কাজ করা।
মূল শিক্ষা:
- জান্নাতের প্রবেশাধিকার নিছক কামনা-বাসনা বা বংশ পরিচয়ের উপর নয়, বরং ঈমান ও সৎকর্মের উপর নির্ভরশীল।
- ঈমান হলো মূল চাবি এবং সৎকাজ হলো সেই চাবির দাঁত; দুটিই জান্নাতের তালা খোলার জন্য আবশ্যক।
- জান্নাতের নেয়ামত এবং সেখানে চিরকাল অবস্থান আল্লাহ্ তাআলার মুমিন বান্দাদের জন্য পুরস্কার।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন, কোনো বড় পরীক্ষায় সফল হতে হলে পরীক্ষার জন্য আবেদন (ঈমান) করার পাশাপাশি ভালোভাবে পড়ালেখা (সৎকাজ) করতে হয়। শুধু আবেদন করলেই পাস করা যায় না, আবার শুধু পড়ালেখা করলেই আবেদন ছাড়া কোনো ফল পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি, ঈমান এবং সৎকর্ম অবিচ্ছেদ্য।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আমাদের ঈমানকে সবসময় দৃঢ় করতে হবে এবং তা যেন সকল কাজের ভিত্তি হয়।
- জীবনে সর্বক্ষেত্রে ছোট-বড় সকল সৎকাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
- জান্নাতের চিরস্থায়ী সাফল্যের জন্য দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আরাম ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা।
এই আয়াতটি বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর দেওয়া **আটটি মৌলিক অঙ্গীকারের** কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা মূলত **ইসলামের সার্বজনীন নীতিরই** অংশ। এটি দেখায় যে, সব আসমানী কিতাব ও নবুওয়াতের শিক্ষা একই মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আটটি প্রতিশ্রুতি/নির্দেশনা: 1. তাওহীদ: আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করবে না (মৌলিক বিশ্বাস)। 2. পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার: পরিবারে প্রথম দায়িত্ব। 3. নিকটাত্মীয়দের প্রতি সদ্ব্যবহার: সামাজিক বন্ধন রক্ষা। 4. ইয়াতীমদের প্রতি সদ্ব্যবহার: দুর্বলদের প্রতি দায়িত্ব। 5. মিসকীনদের প্রতি সদ্ব্যবহার: দরিদ্রদের সাহায্য। 6. মানুষের সাথে উত্তম কথা: সর্বসাধারণের সাথে ভালো আচরণ (সামাজিক সদাচার)। 7. সালাত কায়েম: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক (ইবাদত)। 8. যাকাত প্রদান: সম্পদের পরিশুদ্ধি ও গরীবের হক (অর্থনৈতিক দায়িত্ব)। আয়াতের শেষে আল্লাহ্ আফসোস করে বলেছেন যে, সামান্য কিছু লোক ছাড়া বাকি সবাই এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং তারা বিরুদ্ধাচরণকারী বা উপেক্ষাকারী হিসেবেই জীবন কাটিয়েছে। এই আচরণ বনী ইসরাঈলের স্বভাবজাত অবাধ্যতাকে তুলে ধরে।
মূল শিক্ষা:
- ইসলামে ইবাদত ও সামাজিক দায়িত্ব এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
- সকল মানুষের সাথে নম্র ও মিষ্টি ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এমনকি যারা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী।
- অঙ্গীকার ভঙ্গ করা একটি গুরুতর অপরাধ এবং আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করা ধ্বংসের কারণ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আমরা যেন এই আটটি মৌলিক নির্দেশনা (তাওহীদ, সালাত, যাকাত ও ৫ প্রকারের সামাজিক সদাচার) যথাযথভাবে পালন করি।
- পিতা-মাতা এবং নিকটাত্মীয়দের হককে সব সময় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
- উপদেশ বা নির্দেশ শুনে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত নয়, বরং আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা উচিত।
পূর্বের আয়াতে (৮৩) আল্লাহ ইবাদত ও সামাজিক সদাচার সম্পর্কিত অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেছিলেন। এই আয়াতটি **বনী ইসরাঈলের** কাছ থেকে নেওয়া আরও দুটি **গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও মানবিক** অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তারা প্রকাশ্যেই **স্বীকার** করেছিল। **দুটি মৌলিক অঙ্গীকার:**
- **পরস্পর রক্তপাত করবে না:** অর্থাৎ, নিজেদের মধ্যে **খুন-খারাবি বা যুদ্ধ** করবে না। ইসলামে জীবনের নিরাপত্তা একটি মৌলিক নীতি, যা বনী ইসরাঈলের প্রতিও বাধ্যতামূলক ছিল।
- **কাউকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে না:** অর্থাৎ, নিজেদের গোত্রের বা জাতির কাউকে তাদের **বাড়িঘর থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ** করবে না।
মূল শিক্ষা:
- মানব **জীবন ও বাসস্থানের নিরাপত্তা** একটি সর্বজনীন ও মৌলিক ধর্মীয় নীতি।
- একটি জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে **ঐক্য, শান্তি ও নিরাপত্তা** বজায় রাখা অত্যাবশ্যক।
- জেনে-বুঝে অঙ্গীকার করা এবং তারপর তা ভঙ্গ করা **দ্বিমুখী চরিত্র** ও অবাধ্যতার প্রমাণ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- নিজের বা অন্যের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব।
- শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক সমাজ গঠন করা ইসলামের লক্ষ্য।
- কোনো চুক্তি বা অঙ্গীকার করার আগে তা পূরণের গুরুত্ব মনে রাখতে হবে।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলের ভণ্ডামি ও দ্বিচারিতা তুলে ধরেছেন। তারা নিজেদের লোকদের হত্যা করত, ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিত, কিন্তু যখন তারা বন্দি হতো, তখন মুক্তিপণ দিয়ে তাদের উদ্ধার করত। অথচ মূল কিতাবে (তাওরাতে) সবই নিষিদ্ধ ছিল। তারা নিজেদের স্বার্থে কিতাবের কিছু মানত, আর কিছু অস্বীকার করত।
আল্লাহ ঘোষণা করলেন, এ ধরনের ভণ্ডামির শাস্তি হলো দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে কঠিনতম আজাব।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ ধর্মের সুবিধাজনক অংশ মানে, আর কঠিন অংশ অমান্য করে।
- যেমন— নামাজ পড়ে কিন্তু সুদ খায়, বা সততা শেখায় কিন্তু ব্যবসায়ে প্রতারণা করে।
- এই দ্বিচারিতা আসলে ঈমানের ক্ষতি করে এবং সমাজে ভণ্ডামির সংস্কৃতি তৈরি করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাবকে সম্পূর্ণভাবে মানতে হবে, আংশিক নয়।
- সুবিধামতো ধর্ম মানা হলো ভণ্ডামি, যা দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংস ডেকে আনে।
- আল্লাহর কাছে কিছুই গোপন নয়— তিনি প্রতিটি কাজের হিসাব নেবেন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা জোর দিয়ে বলেছেন যে — যারা **দুনিয়ার ক্ষণিক সুখ-সুবিধার বিনিময়ে সর্বোচ্চ পরীক্ষার ও অনন্ত প্রতিফলের জায়গা (আখিরাহ) বিক্রি করে** ফেলে, তাদের ভাগ্য কঠোর হবে। তারা তাদের শেষকালের বদলে সাময়িক ভূয়সী পদ, সম্পদ বা সম্মানকে প্রাধান্য দিয়েছে; ফলস্বরূপ কিয়ামতের দিনে তাদের শাস্তি **হ্রাস পাবে না** এবং তারা **কোনও সহায়তা বা রক্ষাকারী পাবে না**।
মূল ধারণা ও ব্যাখ্যা:
- “ইশতারা আল-হায়াতাদ-দুনিয়া বিল-আখিরা” — অর্থাৎ তারা দুনিয়ার সাময়িক আনন্দ ও লাভকে আখিরাহর নেকিবের চেয়ে উচ্চখ্যানে স্থাপন করেছে।
- ফল হিসেবে বলা হয়েছে — তাদের শাস্তি **কোনোভাবেই সহজ করা হবে না** (না হ্রাস পাবে) এবং তারা কাহারু দ্বারা রক্ষা বা সাহায্য** (যেমন অন্য কাহারো অবৈধ প্রভাব, ঘুষ, বা সামাজিক অবস্থান) পাবে না।
- তাফসীরে ঐতিহাসিকভাবে বলা হয়েছে—এটি তাদের প্রতি তির্যক সাবধানবাণী, যারা ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব ত্যাগ করে দুনিয়া অর্জনে লিপ্ত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- দুনিয়ার সাময়িক লাভ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আখিরাহ ত্যাগ করলে পরিণাম ভয়াবহ হবে।
- আখিরাহকে অগ্রাধিকার দিতে হবে — কর্ম, নীতিবোধ ও ঈমানই চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ করে।
- যে সমাধান বা রক্ষা কিয়ামতে কাজ করবে তা হলো সৎ ইমান ও নেক কাজ; সামাজিক বা অভিজাত অবস্থান কোনো দিন অতিরিক্ত রক্ষা দেবে না।
আধুনিক উদাহরণ (ব্যবহারিক ব্যাখ্যা):
ধরুন কেউ নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব ভুলে শুধু লোভ-লোভের জন্য অনৈতিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে—পদবি ও সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও, যদি সেই পথ আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে হয়, তবে এর শাস্তি শেষ বিচারকালে রয়েছে এবং কেউ তাকে মুক্ত করতে পারবে না। এই আয়াত এমন লোকদের কঠোর বার্তা বহন করে।
সতর্কবার্তা: আয়াতটি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে কর্ম দিয়েই চূড়ান্ত বিচার করা হবে; দুনিয়ার আদান-প্রদান জীবনের মূল্যায়ন কোনো লাভ দেবে না।
এই আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাঈলের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন— কিভাবে তিনি মূসা (আঃ)-কে কিতাব (তাওরাত) দিয়েছিলেন, তার পর বহু নবী-রাসূল পাঠিয়েছিলেন, এবং ঈসা (আঃ)-কে স্পষ্ট নিদর্শন (মুজিযা) ও রূহুল কুদুস দ্বারা সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু এর পরও বনী ইসরাঈলরা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসা নবীদের অস্বীকার করেছিলো; এমনকি তাদের মধ্যে কিছু নবীকে তারা হত্যা পর্যন্ত করেছিল।
মূল ধারণা:
- আল্লাহর পাঠানো নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা প্রতিটি উম্মতের জন্য ফরজ।
- মানুষের প্রবৃত্তির সাথে দ্বন্দ্ব হলে অধিকাংশ মানুষ সত্যকে অস্বীকার করে।
- ঐতিহাসিকভাবে বনী ইসরাঈল অনেক নবীর বিরোধিতা করেছে—এটি মুসলিম উম্মতের জন্যও সতর্কবার্তা।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাব ও নবীদের অনুসরণ করতে হবে নিজের ইচ্ছার সাথে না মিললেও।
- ঈমান হলো আনুগত্যের বিষয়, প্রবৃত্তির বিষয় নয়।
- যারা নবীদের প্রতি বিদ্রোহ করেছে, তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন—কোনো মানুষ যখন ধর্মীয় সত্য শুনে, অথচ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ইচ্ছার সাথে না মেলে, তখন সে সত্যকে অস্বীকার করে বা বিদ্রোহ করে। অথচ আল্লাহর হুকুমের সামনে **আত্মসমর্পণ** করাই প্রকৃত ঈমান।
বনী ইসরাঈলের একদল নবী-রাসূলের সত্যকে অস্বীকার করে অজুহাত দিত যে— তাদের হৃদয় যেন “ঢেকে গেছে”, তাই তারা নবীদের বাণী বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু আল্লাহ ঘোষণা করলেন—এটা তাদের অক্ষমতা নয়, বরং কুফরির কারণে **আল্লাহর অভিশাপ** তাদের হৃদয়ে পড়েছে। ফলে তারা সত্য গ্রহণে অক্ষম হয়ে গেছে এবং অল্প কয়েকজনই ঈমান এনেছে।
মূল ধারণা:
- মানুষ যখন সত্য অস্বীকার করতে চায়, তখন মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করায়।
- কুফরি ও অবাধ্যতার কারণে আল্লাহর লা‘নত নেমে আসতে পারে।
- কেবল অল্পসংখ্যক মানুষই সত্য গ্রহণ করে—এটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর দিক থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, সমস্যা হলো মানুষের জেদ ও অবাধ্যতায়।
- সত্য অস্বীকার করলে ধীরে ধীরে হৃদয় কঠিন হয়ে যায়।
- অলসতা ও জেদের কারণে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া যায়।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন কেউ যদি বলে—“আমরা বিজ্ঞানের যুগে আছি, ধর্মের কথা এখন আর মানার দরকার নেই”— এ কথাটি আসলে তার নিজের অস্বীকারের অজুহাত, বাস্তবে আল্লাহর বাণী মানতে না চাওয়াই আসল কারণ। এভাবেই তাদের হৃদয় ধীরে ধীরে সত্য গ্রহণে অক্ষম হয়ে যায়।
এ আয়াতে বনী ইসরাঈলের ভণ্ডামি প্রকাশ করা হয়েছে। তারা তাওরাত থেকে জানত যে শেষ নবী আসবেন এবং তার মাধ্যমে বিজয় কামনা করত। কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ (যার বৈশিষ্ট্য তারা চিনত) এলেন, তারা ঈর্ষা ও জেদের কারণে তাকে অস্বীকার করল। এজন্য আল্লাহ ঘোষণা করলেন—তাদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হোক।
মূল ধারণা:
- ইহুদিরা নবী ﷺ-কে চিনত, কিন্তু নিজেদের স্বার্থে অস্বীকার করেছে।
- তারা কাফিরদের বিরুদ্ধে শেষ নবীর আগমনের দোয়া করত, অথচ তিনি আসার পর অস্বীকার করেছে।
- অহংকার ও ঈর্ষা সত্য প্রত্যাখ্যানের অন্যতম বড় কারণ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্য চিনে অস্বীকার করা সবচেয়ে বড় গুনাহ।
- আল্লাহর নবীদের অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হয়।
- ঈমান আনতে হলে জেদ, স্বার্থ ও অহংকার ত্যাগ করতে হবে।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন কেউ আগে থেকেই জানে যে ইসলামই সঠিক, কুরআন আল্লাহর কিতাব, অথচ ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সমাজের ভয়ে সে সত্যকে অস্বীকার করে— তার অবস্থাই বনী ইসরাঈলের মতো, যারা চিনেও সত্য অস্বীকার করেছিল।
বনী ইসরাঈলদের ভ্রান্ত পথের নিন্দা এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে। তারা সত্যকে অস্বীকার করেছে শুধু এ কারণে যে, আল্লাহ তাঁর কিতাব ও নবুওত অন্য জাতির (আরবদের) একজনকে দিয়েছেন। তাদের হিংসা ও অহংকার এত প্রবল ছিল যে তারা আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব অস্বীকার করে ফেলল। এজন্য তারা বারবার আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়েছে— একবার তাওরাত অমান্য করার জন্য, আবার কুরআন অস্বীকার করার জন্য। এবং তাদের পরিণতি হবে লাঞ্ছনাকর আজাব।
মূল ধারণা:
- হিংসা ও অহংকার মানুষকে সত্য থেকে বঞ্চিত করে।
- আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দেন—এতে কারও আপত্তির অধিকার নেই।
- একটি গুনাহ অন্য গুনাহকে টেনে আনে, ফলে আল্লাহর ক্রোধ বারবার নেমে আসে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্যকে অস্বীকার করা হলো আত্মবিনাশ।
- ঈর্ষা ও অহংকার পরকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।
- আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ কেবল তাঁর ইচ্ছাতেই প্রদান হয়, এতে মানুষের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
আধুনিক উদাহরণ:
যেমন—কেউ যদি দেখে আল্লাহ অন্য কাউকে জ্ঞান, নেতৃত্ব বা দাওয়াতের তৌফিক দিয়েছেন, আর সে হিংসার কারণে তাকে অস্বীকার করে বা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তবে সে-ও বনী ইসরাঈলের মতো আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। ফলাফল হবে অপমানজনক পরিণতি।
বনী ইসরাঈল দাবি করত যে তারা কেবল তাদের উপর নাযিলকৃত কিতাব (তাওরাত) মানবে। কুরআনকে তারা অস্বীকার করত, যদিও কুরআন তাওরাতের সত্যতা প্রমাণ করত। আল্লাহ তাদের ভণ্ডামি প্রকাশ করলেন: তারা যদি সত্যিই ঈমানদার হতো, তবে অতীতে আল্লাহর নবীদের হত্যা করত না। তাদের দাবিই প্রমাণ করে যে, তারা ঈমানদার নয় বরং জেদি ও অহংকারী।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও কিছু মানুষ বলে: “আমরা শুধু আমাদের পূর্বপুরুষদের পথ অনুসরণ করব, নতুন কোনো শিক্ষা মানব না।”
- যেমন, কুরআনের নির্দেশ স্পষ্ট হলেও কেউ কুসংস্কার বা প্রথা আঁকড়ে ধরে।
- সত্যকে অস্বীকার করা এবং নিজের সুবিধামতো ধর্ম মানা আসলে পুরনো যুগের বনী ইসরাঈলেরই পুনরাবৃত্তি।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর সব কিতাবই সত্য, এবং কুরআন পূর্বের সব কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করে।
- আল্লাহর আদেশকে অস্বীকার করা বা খণ্ড খণ্ড করে মানা গুরুতর অপরাধ।
- সত্যকে অস্বীকার করা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, যতই তারা নিজেদেরকে মুমিন দাবি করুক।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন— মূসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে বহু মুজিযা ও স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন (যেমন: সাগর বিভক্ত হওয়া, লাঠি সাপ হওয়া, মেঘের ছায়া, মান্না-সালওয়া ইত্যাদি)। তবুও তারা মূসার অনুপস্থিতিতে গরুর বাছুরের পূজায় লিপ্ত হয়েছিল। এটি তাদের বড় ধরনের জুলুম ও কৃতঘ্নতার প্রকাশ।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও সত্যকে ছেড়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছে
- যেমন, বিজ্ঞান ও জ্ঞানের যুগেও কেউ কেউ কুসংস্কার বা মূর্তিপূজা করে।
- বা, কুরআনের হিদায়াত থাকা সত্ত্বেও কেউ অন্ধভাবে জ্যোতিষ, তাবিজ বা ভণ্ড পীরের পিছে ছুটে চলে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- মানুষের কৃতজ্ঞ না হওয়া ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আল্লাহর নিকট বড় অপরাধ।
- সুস্পষ্ট প্রমাণ ও হিদায়াতকে উপেক্ষা করা মানুষকে জুলুমকারীর দলে পরিণত করে।
- মুমিনের উচিত সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তা আঁকড়ে ধরা, অন্যথায় অতীতের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হবে।
আল্লাহ বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন— তারা তাওরাত মেনে চলবে। এমনকি তাদের ভয় দেখানোর জন্য তূর পর্বত মাথার ওপরে উত্তোলন করা হয়েছিল। তবুও তারা বলল: “আমরা শুনলাম কিন্তু মানলাম না।” তাদের অন্তরে গরুর বাছুরের পূজা এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে তারা সত্যকে উপেক্ষা করে কুফরিতে লিপ্ত ছিল। আল্লাহ তাদের ভণ্ড ঈমানকে তিরস্কার করেছেন।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজ অনেক মুসলিম মুখে বলে “আমরা আল্লাহর আদেশ মানি”, কিন্তু কাজে তা অমান্য করে।
- যেমন, নামাজের গুরুত্ব জানলেও অনেকে তা অবহেলা করে।
- বা, ইসলাম স্পষ্টভাবে সুদকে হারাম বললেও অনেকেই তা এড়িয়ে না চলে বরং সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকে।
- এটাই “শুনেছি কিন্তু মানিনি” ধরনের মানসিকতা।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- সত্য জানা সত্ত্বেও মান্য না করা বড় জুলুম ও কুফরি।
- আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে, শুধু মুখের প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়।
- অন্তরে ভ্রান্ত ভালোবাসা (যেমন দুনিয়ার মোহ, টাকা, পদ) ঢুকে গেলে মানুষ সত্যকে উপেক্ষা করে।
- মুমিনের ঈমানের প্রমাণ হলো তার আনুগত্য ও আমল, শুধু মুখের কথা নয়।
বনী ইসরাঈল দাবি করত যে, আখিরাতের জান্নাত কেবল তাদের জন্য, অন্যদের জন্য নয়। আল্লাহ তাদের এই ভ্রান্ত দাবিকে চ্যালেঞ্জ করলেন— যদি সত্যিই শুধু তাদের জন্য হয়, তবে তারা যেন মৃত্যু কামনা করে। কারণ মৃত্যু জান্নাতে প্রবেশের দরজা। কিন্তু তারা জানত যে, তাদের আমল জান্নাতের উপযুক্ত নয়, তাই তারা কখনো এ কামনা করবে না।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও কিছু গোষ্ঠী দাবি করে— “শুধু আমাদের দল/সম্প্রদায়ই মুক্তি পাবে।”
- কিন্তু আমল ও বাস্তব আচরণে তারা ইসলাম থেকে দূরে থাকে।
- যেমন, কেউ মুখে বলে সে জান্নাতি, কিন্তু সে নিয়মিত নামাজও পড়ে না।
- আল্লাহর পথে ত্যাগ ছাড়া জান্নাতের দাবি করা অর্থহীন।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- শুধু দাবি নয়, আখিরাতের সাফল্য প্রমাণ হয় আমল ও ঈমানের মাধ্যমে।
- যে সত্যিই জান্নাতপ্রত্যাশী, সে মৃত্যুকে ভয় পায় না বরং আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা করে।
- অহংকার ও মিথ্যা দাবির পরিবর্তে মুসলিমের উচিত আত্মসমালোচনা ও আমল উন্নত করা।
বনী ইসরাঈল মিথ্যা দাবি করেছিল যে জান্নাত শুধু তাদের জন্য। কিন্তু আল্লাহ ঘোষণা করলেন— তারা কখনো মৃত্যুর কামনা করবে না, কারণ তারা জানত যে তাদের কর্মই তাদের জন্য আজাবের কারণ হবে। তাদের অন্তরে কুফরি, গোনাহ ও অবাধ্যতা এমনভাবে জমা ছিল যে মৃত্যুর কথা শুনলেই ভয়ে সরে যেত।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ মুখে স্বর্গের দাবি করে, কিন্তু মৃত্যুর কথা শুনলেই ভয় পায়।
- কারণ, তারা জানে তাদের জীবন অন্যায় ও গোনাহে পূর্ণ।
- যেমন, কেউ বলে “আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন”, কিন্তু সে সুদ, ঘুষ বা হারাম আয়ে লিপ্ত থাকে।
- এমন মানুষ মৃত্যুর কামনা করবে না, কারণ অন্তরে সে জানে তার জবাবদিহি কঠিন হবে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- গোনাহভরা জীবন মানুষকে মৃত্যুভীতু করে তোলে।
- সত্যিকার ঈমানদার মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত কামনা করে।
- শুধু মুখের দাবি নয়, সৎ আমলই আখিরাতে মুক্তির আসল প্রমাণ।
বনী ইসরাঈল আখিরাতে জান্নাতের দাবি করলেও আসলে তারা দুনিয়ার জীবনকে আঁকড়ে ধরেছিল। তারা মৃত্যুকে ভয় করত এবং দীর্ঘজীবন কামনা করত— এমনকি হাজার বছরের জীবনও চাইত। কিন্তু দীর্ঘজীবন কোনোভাবেই আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা করতে পারে না। আল্লাহ তাদের সব কাজ দেখেন এবং হিসাব নেবেন।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ দুনিয়ার প্রতি এত আসক্ত যে আখিরাত ভুলে যায়।
- কেউ স্বাস্থ্য, সম্পদ বা প্রযুক্তির মাধ্যমে অমরত্বের স্বপ্ন দেখে।
- যেমন, চিকিৎসা বা বিজ্ঞান দিয়ে বার্ধক্য ঠেকানোর চেষ্টা, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য।
- আসল মুক্তি হলো আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া, দুনিয়ায় আঁকড়ে থাকা নয়।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- দীর্ঘজীবন নয়, বরং সৎ জীবনই আখিরাতে মুক্তির কারণ।
- দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে নিয়ে যায়।
- মৃত্যু ও আখিরাত অনিবার্য, তাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল জরুরি।
কিছু ইহুদি জিবরাঈল (আঃ)-এর শত্রুতা করত, কারণ তিনি কুরআন নবী মুহাম্মদ ﷺ এর উপর অবতীর্ণ করেছিলেন। তারা বলত, যদি মীকাঈল ফেরেশতা আসতেন তবে মানা যেত। কিন্তু আল্লাহ স্পষ্ট করলেন— জিবরাঈল কেবল আল্লাহর আদেশে ওহী নাযিল করেছেন। তিনি কোনো নিজস্ব সিদ্ধান্তে তা করেননি। কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রমাণ করে এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও সুসংবাদ।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও কেউ কেউ ইসলামকে অস্বীকার করে বাহানা খোঁজে— “কেন এই রাসূল? কেন এই কিতাব?”
- আসলে সত্য মানতে না চাওয়ার জন্য তারা বাহানা দেয়।
- যেমন, অনেক শিক্ষিত মানুষও বলে— “ধর্ম নয়, শুধু বিজ্ঞানই যথেষ্ট।”
- কিন্তু সত্য হলো, কুরআন আল্লাহর অনুমতিতে নাযিল হয়েছে এবং সেটাই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ পথপ্রদর্শক।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর রাসূল বা ফেরেশতার সাথে শত্রুতা করা আসলে আল্লাহর সাথেই শত্রুতা করা।
- কুরআন হিদায়াত ও সুসংবাদ, এটি প্রত্যাখ্যান করা মানে নিজের ক্ষতি করা।
- মুমিনের উচিত কুরআনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং বাহানা না খোঁজা।
ইহুদিরা জিবরাঈল (আঃ)-এর শত্রুতা করেছিল। আল্লাহ স্পষ্ট করে দিলেন— জিবরাঈল বা মীকাঈলের প্রতি শত্রুতা আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ। ফেরেশতারা কেবল আল্লাহর আদেশেই কাজ করেন। তাই যে তাদের শত্রু হবে, সে আল্লাহর শত্রু হবে, আর আল্লাহ কাফেরদের শত্রু।
আধুনিক উদাহরণ:
- কেউ কেউ ধর্মকে মানে না, কিন্তু বিজ্ঞান, ভাগ্য বা "অদৃশ্য শক্তি"-তে বিশ্বাস করে।
- আসলে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে বাহানা দিচ্ছে।
- যেমন, কেউ যদি বলে— "আমি আল্লাহকে মানি কিন্তু রাসূল ﷺ কে মানি না", তাহলে তা শত্রুতা ও অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
- বর্তমানে অনেকেই ইসলামের বিধানকে কেটে-কেটে মানতে চায়— এটা মানবো, এটা মানবো না। এটাও আল্লাহর সাথে শত্রুতা করার শামিল।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহ, ফেরেশতা, রাসূল— এদের একজনকেও অস্বীকার করা মানে কুফর।
- যারা ইসলামের কোনো অংশকে অস্বীকার করে, তারা আল্লাহর শত্রু।
- মুমিনের উচিত সবকিছু আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী মানা— অর্ধেক নয়, পূর্ণাঙ্গভাবে।
আল্লাহ এখানে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি রাসূল (সা.)-কে এমন সব প্রমাণ দিয়েছেন যা সত্য ও মিথ্যার মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে। এরপরও যারা এই নিদর্শনগুলো অস্বীকার করে, তারা ফাসিক— অর্থাৎ যারা সীমালঙ্ঘনকারী ও আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য অস্বীকার করাই আসল সমস্যা।
আধুনিক উদাহরণ:
- অনেকে প্রমাণ দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখে— কারণ সত্য মেনে চললে তাদের লাইফস্টাইল পাল্টাতে হবে।
- যেমন, কেউ কুরআন পড়ে বুঝেও বলে— "এটা সেই যুগে ঠিক ছিল, এখন আর মানায় না।"
- আসলে তারা সত্য অস্বীকার করছে জেনে শুনেই— যেটা ফাসিকদের বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহ আমাদের কাছে সত্য স্পষ্ট করেছেন— এখন আমাদের দায়িত্ব তা মেনে চলা।
- সত্যকে অস্বীকার করা মানে নিজেরই ক্ষতি ডেকে আনা।
- একজন মুমিনের উচিত প্রমাণ-based ইসলামী আদর্শকে মানা ও জীবনচর্চা করা।
এই আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাইলের একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন— তারা বারবার আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেও তা ভঙ্গ করেছে। এটি ছিল তাদের অভ্যাসগত কপটতা ও অবিশ্বাসের প্রমাণ। আল্লাহ বলেন, তাদের অধিকাংশই ঈমানদার নয়, বরং তারা সত্যকে জেনে অস্বীকার করে।
আধুনিক উদাহরণ:
- বর্তমানে অনেক মুসলিম আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতি করে— কিন্তু তা রক্ষা করে না।
- যেমন, বিপদে পড়লে বলে "বাঁচলে নামাজ শুরু করবো", কিন্তু রক্ষা পেলে আবার পুরনো জীবনে ফিরে যায়।
- এমন আচরণ ঈমানদারদের জন্য শোভনীয় নয়— এটি মুখে বিশ্বাস করা, কাজে নয়।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর সাথে করা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা মারাত্মক গুনাহ।
- একজন প্রকৃত মুমিনের উচিত কথা ও কাজে এক থাকা।
- বিগত উম্মতদের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া— যেন আমরা তাদের মত না হই।
এই আয়াতে বনী ইসরাইলের আরেকটি অবাধ্যতা তুলে ধরা হয়েছে। তারা জানত শেষ নবী (সা.) আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী তাদের কিতাবে ছিল, এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বর্ণনা তাওরাতে ছিল। তবুও তারা হিংসা ও অহংকারের কারণে তাঁকে অস্বীকার করে। তারা এমন আচরণ করল যেন কিছুই জানে না।
আধুনিক উদাহরণ:
- বর্তমানে অনেকে কুরআনের আয়াত জানে, শুনে, তবুও কাজ করে উল্টো— যেন কিছুই শোনেনি বা জানে না।
- তাদের আচরণ সেই লোকদের মতো যারা জেনে-শুনেই আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করে।
- আল্লাহর বাণীকে ‘পেছনে ফেলে দেওয়া’ মানে হলো— জীবনে তা গুরুত্ব না দেওয়া, অমান্য করা।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর কিতাব জানার পর তা অমান্য করা মারাত্মক গুনাহ।
- যারা সত্য জানে, কিন্তু মানে না— তারা জাহান্নামের কঠিন শাস্তির উপযুক্ত।
- আল্লাহর দেওয়া জ্ঞান ও নির্দেশকে জীবনের অগ্রভাগে রাখতে হবে— পিছনে নয়।
এ আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাইলের আরেকটি বড় ভুল তুলে ধরেছেন। তারা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল যে সুলায়মান (আঃ) জাদু করতেন। আল্লাহ তা অস্বীকার করে বলছেন— সুলায়মান (আঃ) কুফর করেননি, বরং শয়তানরা মানুষকে জাদু শেখাত এবং এর মাধ্যমে বিভ্রান্ত করত। হারূত ও মারূত নামে দুই ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষা হিসেবে। তারা স্পষ্টভাবে বলতেন, “আমরা পরীক্ষা মাত্র, কুফর করোনা।” কিন্তু লোকেরা তাদের কাছ থেকে শিখত এমন জিনিস, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, বিচ্ছেদ ঘটানো যেত। যদিও এগুলো আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কাজ করত না। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে— জাদু আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কার্যকর হয় না, কিন্তু তাও শিখে ক্ষতি করে নিজেরই ভবিষ্যৎ নষ্ট করছিল।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজও সমাজে অনেকে জাদু, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির ওপর ভরসা করে— অথচ তারা জানে না এসবের পরিণতি কত ভয়াবহ।
- যারা জাদু শেখে বা ব্যবহার করে— তারা জেনেশুনে কুফর করছে।
- এই আয়াতের শিক্ষা হলো— মানুষের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কোনো কিছু শেখা বা প্রয়োগ করা মারাত্মক গুনাহ।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- জাদু শেখা, করা বা বিশ্বাস করা ইসলাম বিরোধী ও কুফর।
- হারূত ও মারূতের ঘটনা প্রমাণ করে— কোনো জ্ঞান পেলেই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়; সেটি কী উদ্দেশ্যে তা বুঝা জরুরি।
- আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না— তাই মুমিনের উচিত তাওয়াক্কুল করা, জাদুতে নয়।
এ আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাইলকে বুঝাচ্ছেন যে— তারা যদি জাদু, কুফর ও শয়তানের অনুসরণ না করে ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার নির্ধারিত থাকত।
কিন্তু তারা জেনে শুনে গোমরাহির পথ বেছে নিয়েছিল। আল্লাহর দেওয়া প্রতিদানই আসল কল্যাণকর।
আধুনিক উদাহরণ:
- মানুষ প্রায়ই ক্ষণস্থায়ী লাভের জন্য মিথ্যা ও অন্যায়ের পথে যায়, অথচ দীর্ঘমেয়াদে আল্লাহর পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ।
- জাদু, কুসংস্কার বা হারাম উপায়ে লাভ অর্জন করা মানুষের ক্ষতি ডেকে আনে।
- ঈমান ও তাকওয়াই হলো প্রকৃত সাফল্যের গ্যারান্টি।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- তাকওয়া ও ঈমান ছাড়া কোনো জ্ঞান বা কর্ম কল্যাণকর নয়।
- আল্লাহর পুরস্কারই সর্বশ্রেষ্ঠ; দুনিয়ার সাময়িক লাভের কাছে সেটি ত্যাগ করা মূর্খতা।
- একজন মুমিনের উচিত দুনিয়ার লোভ ছেড়ে আখিরাতের প্রকৃত সফলতার দিকে মনোযোগী হওয়া।
বনী ইসরাইলরা নবীজি ﷺ-কে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গাত্মকভাবে “রা’ইনা” শব্দ ব্যবহার করত, যার আরবি মূল অর্থ “আমাদের খেয়াল রাখুন”, কিন্তু তাদের ভাষায় এর মধ্যে গালি ও অবমাননার অর্থও ছিল। তাই মুসলমানদের নিষেধ করা হলো এ শব্দ ব্যবহার না করতে। পরিবর্তে বলা হলো— “উনযুরনা” (আমাদের দিকে তাকাও, মনোযোগ দাও)। এতে কোনো কটূর্থা নেই, বরং সম্মানজনক ভাষা।
আধুনিক উদাহরণ:
- মুসলিমদের সবসময় শালীন ও পরিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করতে হবে।
- শব্দের ভুল প্রয়োগ অন্যকে আঘাত করতে পারে— তাই সতর্ক থাকা জরুরি।
- অমুসলিমদের কটুক্তি বা বিদ্রূপে না জড়িয়ে, সম্মানজনকভাবে উত্তর দেওয়া ইসলামের শিক্ষা।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- ভাষার অপব্যবহার ফিতনা সৃষ্টি করে— মুসলমানকে সবসময় শালীন ভাষা ব্যবহার করতে হবে।
- ইসলামে ব্যঙ্গ, উপহাস ও কটুক্তি থেকে বেঁচে থাকার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
- মুমিনের উচিত সর্বদা ভালোভাবে শোনা ও ভালোভাবে বলা।
মুশরিক ও কিতাবীদের অনেকেই চায় না মুসলমানদের কাছে হিদায়াত, ওহি বা কল্যাণ পৌঁছাক। তাদের অন্তরে ঈর্ষা, হিংসা ও শত্রুতা ছিল। কিন্তু আল্লাহ যাকে চান তাকেই রহমত দেন, তা আটকাতে কারও সাধ্য নেই।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর রহমত আল্লাহর ইচ্ছাতেই নির্ধারিত হয়।
- অন্যের হিংসা ও শত্রুতা মুমিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না।
- মুমিনের উচিত আল্লাহর রহমতের জন্যই চেষ্টা করা।
আল্লাহ চাইলে কোনো বিধান রহিত করে নতুন বিধান দেন— যা আগের চেয়ে উত্তম বা সমতুল্য হয়। এটি আল্লাহর হিকমতের অংশ। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, শরীয়তের বিধান পরিবর্তন হলে তা আল্লাহর হিকমতের কারণে হয়, মানুষের খেয়ালের কারণে নয়।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহ সর্বশক্তিমান— তাঁর হুকুম পরিবর্তন করলে তাতেই কল্যাণ রয়েছে।
- মুমিনের উচিত আল্লাহর বিধানের ওপর আস্থা রাখা।
- নাসখ (শরীয়তের বিধান পরিবর্তন) আল্লাহর ইলাহি পরিকল্পনার অংশ।
আল্লাহই আসমান-জমিনের একচ্ছত্র মালিক। তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছুই ঘটে না। তাই মুসলমানদের মনে করিয়ে দেওয়া হলো— আল্লাহ ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করা বৃথা।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহই প্রকৃত মালিক ও শাসক।
- আল্লাহ ছাড়া কারও ওপর ভরসা করলে তা ক্ষতির কারণ হবে।
- একজন মুমিনের অভিভাবক ও সাহায্যকারী শুধু আল্লাহ।
বনী ইসরাইলরা মূসা (আঃ)-এর কাছে অহেতুক ও কটূক্তিপূর্ণ প্রশ্ন করত। মুসলমানদের সতর্ক করা হলো যেন তারা রাসূল ﷺ-এর সাথে তেমনটা না করে। ঈমানের পরিবর্তে কুফর বেছে নিলে সেটা সরাসরি পথভ্রষ্টতা।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- নবীকে অযথা প্রশ্ন করে বিরক্ত করা উচিত নয়।
- ঈমান ছেড়ে কুফর গ্রহণ করা সরাসরি পথভ্রষ্টতা।
- মুমিনের উচিত রাসূল ﷺ-এর প্রতি বিনয় ও আনুগত্য প্রদর্শন।
আহলে কিতাবের অনেকেই মুসলমানদের ঈমান দেখে ঈর্ষান্বিত হত, এবং চাইত তারা যেন আবার কুফরে ফিরে যায়। মুসলমানদের বলা হলো— ধৈর্য ধরো, ক্ষমা করো এবং আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করো। আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণ সব কিছুর ওপর।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- অন্যদের হিংসার কারণে ঈমান থেকে ফিরে যাওয়া যাবে না।
- ধৈর্য ও ক্ষমাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
- আল্লাহর আদেশই চূড়ান্ত— সেটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
মুসলমানদের প্রধান আমল হলো সালাত ও যাকাত। এগুলো মুমিনের জীবন গড়ে তোলে এবং আল্লাহর নৈকট্য আনে। দুনিয়ায় যে ভালো কাজ করা হয়, তা আখিরাতে সংরক্ষিত থাকে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- সালাত ও যাকাত ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ।
- প্রত্যেক নেক কাজ আখিরাতে ফল দেবে।
- আল্লাহ সর্বদা বান্দার আমল লক্ষ্য করেন।
ইহুদি ও খ্রিস্টানরা নিজেদের দলকেই জান্নাতের একমাত্র অধিকারী বলত। আল্লাহ তাদের দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। জান্নাত কারও বংশ বা গোষ্ঠীর অধিকার নয়— বরং ঈমান ও সৎকর্মই একমাত্র শর্ত।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- জান্নাত কারও একচেটিয়া অধিকার নয়।
- আল্লাহর পথে প্রমাণ ছাড়া দাবি করা অর্থহীন।
- সত্য ঈমান ও সৎকর্মই মুক্তির নিশ্চয়তা।
জান্নাতের প্রকৃত অধিকারী তারা, যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে (ইসলাম গ্রহণ করে) এবং সৎকর্ম করে। তাদের জন্য রয়েছে নির্ভয়তা ও চিরসুখের জীবন।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণই প্রকৃত ইসলাম।
- সৎকর্মের বিনিময় আল্লাহর কাছেই নিশ্চিত।
- আল্লাহর পথে চললে কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।
ইহুদি ও খ্রিস্টানরা একে অপরকে বাতিল বলত, অথচ উভয়েরই কিতাব ছিল। তাদের এ বিরোধ প্রমাণ করে যে, তারা প্রকৃত সত্য থেকে দূরে। আল্লাহই কিয়ামতের দিনে সকলের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- ধর্মীয় বিভেদ মানুষের নিজস্ব স্বার্থ ও অজ্ঞতার ফল।
- সত্যের মাপকাঠি হলো আল্লাহর বাণী, মানুষের দাবি নয়।
- চূড়ান্ত বিচার হবে আল্লাহর হাতে, কিয়ামতের দিনে।
মসজিদ ধ্বংস করা বা নামাজে বাধা দেওয়া সবচেয়ে বড় জুলুম। যারা এ কাজ করে, তাদের দুনিয়ায় লাঞ্ছনা ও আখিরাতে আজাব নির্ধারিত।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর ঘরে বাধা দেওয়া সবচেয়ে বড় জুলুম।
- মসজিদকে آباد রাখা ঈমানদারদের কাজ।
- মসজিদের সম্মান রক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর ইবাদত কোনো নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ নয়। দিক নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য হলো আনুগত্য, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর ইবাদতের জন্য স্থান সীমাবদ্ধ নয়।
- মুমিন যেখানেই থাকুক, সেখানেই আল্লাহর ইবাদত করতে পারে।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বব্যাপী।
ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করেছিল। আল্লাহ ঘোষণা করেন— তিনি এ ধরনের অভিযোগ থেকে পবিত্র। আসমান-জমিনের সবকিছুই তাঁর অনুগত।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করা শিরক।
- আল্লাহ সব কিছুর মালিক ও স্রষ্টা।
- সৃষ্টি জগৎ তাঁর নির্দেশের অধীন।
এখানে আল্লাহর সৃষ্টিশক্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। “বদী‘উস্-সামাওয়াতি ওয়াল-আরদ”— অর্থাৎ তিনি আসমান ও জমিনকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যা আগে কখনো ছিল না। মানুষ বা জিনের মতো তিনি কারও নকল করে সৃষ্টি করেননি, বরং একেবারে নতুনভাবে সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর সৃষ্টিশক্তি এত সহজ যে তিনি কোনো কিছুকে শুধু বলেন “কুন” (হও) এবং তা মুহূর্তেই হয়ে যায়। এভাবে আল্লাহর সৃষ্টিশক্তি অসীম ও অনন্য। তিনি কারও সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করেন না।
এ আয়াত প্রমাণ করে— আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেন না। কেননা সন্তান নেওয়ার অর্থ হলো কোনো কিছুর অভাব পূরণ করা বা স্থায়িত্ব চাওয়া। অথচ আল্লাহর কোনো অভাব নেই, তিনি চিরস্থায়ী।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহ সৃষ্টিকে কিছু না থেকেও সৃষ্টি করেন।
- আল্লাহর “কুন ফাইয়াকুন” শক্তি সীমাহীন।
- আল্লাহর জন্য সন্তান বা অংশীদারের ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
এ আয়াতে মুশরিক ও কাফেরদের মানসিকতা তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলত, “কেন আল্লাহ সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলেন না?” অথবা “কোনো অলৌকিক নিদর্শন আমাদের সামনে আনা হয় না কেন?” অথচ তাদের এ দাবিগুলো ছিল অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, পূর্ববর্তী জাতিরাও একই রকম কথা বলেছিল। যেমন— বনি ইসরাইল মুসা (আঃ)-এর কাছে সরাসরি আল্লাহকে দেখতে চেয়েছিল। কুরাইশ মুশরিকরা রাসূল ﷺ -এর কাছে আসমান থেকে ফেরেশতা নামানোর দাবি তুলেছিল। কিন্তু তাদের এসব দাবি ছিল কেবল জেদ ও অবিশ্বাস থেকে, সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয়।
আল্লাহ বলেন— সত্যিকার মুমিনদের জন্য তাঁর নিদর্শনগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট। যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য অতিরিক্ত প্রমাণের দরকার নেই।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- কাফেরদের অভিযোগ শুধু অজুহাত, সত্যকে অস্বীকার করার জন্য।
- আগের জাতিরা যেমন অজুহাত দেখিয়েছে, তেমনি পরেররাও করে।
- আল্লাহর নিদর্শনগুলো স্পষ্ট— শুধু যারা বিশ্বাস করে, তারাই উপকৃত হয়।
এ আয়াতে আল্লাহ রাসূল ﷺ -এর দায়িত্ব ও অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি পাঠানো হয়েছেন দুইটি উদ্দেশ্যে— (১) ঈমানদারদের জন্য সুসংবাদবাহী হিসেবে, (২) কাফের ও অবাধ্যদের জন্য সতর্ককারী হিসেবে।
এখানে আল্লাহ নবী ﷺ -কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কারণ কাফেররা সত্য অস্বীকার করছিল, রাসূল ﷺ কষ্ট পাচ্ছিলেন। আল্লাহ বললেন— আপনার দায়িত্ব শুধু পৌঁছে দেওয়া, কে জান্নাতী হবে আর কে জাহান্নামী হবে তা আপনার ওপর নয়। জাহান্নামীদের ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞেসও করা হবে না।
অর্থাৎ দাওয়াতের কাজই আপনার মূল দায়িত্ব, মানুষের হিদায়াত বা গোমরাহি নির্ধারণ করা আল্লাহর হাতে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- রাসূল ﷺ-এর দায়িত্ব ছিল দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া, কাউকে জোর করে হিদায়াত দেওয়া নয়।
- আল্লাহ হিদায়াত যাকে চান তাকেই দেন।
- মুমিনদের জন্য দাওয়াত সুসংবাদ, আর কাফেরদের জন্য সতর্কতা।
ইহুদি ও খ্রিস্টানরা কখনো মুসলমানদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না মুসলমানরা তাদের ধর্ম ও পথ অনুসরণ করে। তাদের খুশি করার চেষ্টা বৃথা, কারণ তাদের শর্তই হলো ইসলামের সাথে আপস।
আল্লাহ ঘোষণা করেছেন— একমাত্র প্রকৃত হিদায়াত হলো তাঁর প্রদত্ত হিদায়াত (কুরআন ও ইসলাম)।
নবী ﷺ-কে সতর্ক করা হয়েছে: যদি কখনো সত্যের বদলে তাদের খেয়ালখুশি অনুসরণ করা হয়, তবে আল্লাহর সুরক্ষা হারিয়ে যাবে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- অমুসলিমদের খুশি করার জন্য ইসলামের সাথে আপস করা যাবে না।
- আসল হিদায়াত একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে আসে।
- আল্লাহ ছাড়া কাউকে অভিভাবক বা সাহায্যকারী ধরা যাবে না।
এ আয়াতে কিতাবের প্রকৃত অনুসারীদের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন— যারা কিতাব (আল্লাহর বাণী) যথাযথভাবে তিলাওয়াত করে, অর্থাৎ শুধু পড়েই না, বরং বুঝে, মানে ও আমল করে— তারাই প্রকৃত মুমিন।
যারা কিতাবকে বিকৃত করে বা কুফর করে, তারাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- কুরআন শুধু পড়াই যথেষ্ট নয়— বুঝা ও আমল করাও জরুরি।
- আল্লাহর বাণী মানলে মুক্তি, না মানলে ক্ষতি।
- প্রকৃত মুমিনরা আল্লাহর কিতাবের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য করে।
আল্লাহ বনী ইসরাইলকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর অসংখ্য নিয়ামত। তিনি তাদের মাঝে বহু নবী প্রেরণ করেছেন, তাদেরকে তাওরাত দিয়েছেন, ফিরআউনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবং মদীনা ও শাম অঞ্চলে তাদের প্রভাবশালী করেছেন।
কিন্তু তারা আল্লাহর নেয়ামত ভুলে গিয়ে অবাধ্যতা ও কুফর করেছে। তাই আল্লাহ তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন— আমার নেয়ামত ভুলে যেও না এবং কুফর করো না।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করা ঈমানের অংশ।
- যে নেয়ামত ভুলে যায়, সে অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে।
- আল্লাহ যে কাউকে সম্মানিত করতে পারেন, আবার অপমানিতও করতে পারেন।
আল্লাহ আখিরাতের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। সেদিন কারও পক্ষে অন্য কাউকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
– সুপারিশ শুধু আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সম্ভব হবে না। – কোনো ঘুষ বা বিনিময় কার্যকর হবে না। – কোনো সাহায্যকারী পাওয়া যাবে না।
এই আয়াত মানুষকে সতর্ক করে— কেবল নিজের ঈমান ও আমলই আখিরাতে কাজে দেবে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আখিরাতের দিন কারও আত্মীয়তা বা ধন-সম্পদ কাজে আসবে না।
- সেদিন শুধু ঈমান ও সৎকর্মই মুক্তির উপায়।
- শাফায়াত থাকবে, তবে তা কেবল আল্লাহর অনুমতিতে।
আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-কে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছিলেন— যেমন: আগুনে নিক্ষেপ, সন্তান কুরবানি করার নির্দেশ, নিজ পরিবারকে মরুভূমিতে রেখে আসা ইত্যাদি। তিনি সব পরীক্ষায় সফল হন।
তাই আল্লাহ তাঁকে মানবজাতির নেতা (ইমাম) ঘোষণা করেন। ইবরাহীম (আঃ) তাঁর বংশধরদের জন্যও এই মর্যাদা চান, কিন্তু আল্লাহ স্পষ্ট করেন— জালিমরা এ মর্যাদা পাবে না।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- ইবরাহীম (আঃ) সব পরীক্ষায় ধৈর্য ও আনুগত্যের পরিচয় দেন।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনো জালিমদের জন্য নয়।
- ইমামত (নেতৃত্ব) কেবল তাকওয়াবান ও ন্যায়পরায়ণদের জন্য।
আল্লাহ কা'বাঘরকে মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও ইবাদতের কেন্দ্র বানিয়েছেন। এটি মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক।
ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যেন তারা কা'বাঘরকে সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে পরিশুদ্ধ রাখেন। যাতে মুমিনরা সেখানে নিরাপদে নামাজ, তাওয়াফ ও ইবাদত করতে পারে।
"মাকামে ইবরাহীম" কে ইবাদতের স্থান করার নির্দেশও দেওয়া হয়।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- কা'বা মুসলিমদের ঐক্যের প্রতীক ও ইবাদতের কেন্দ্র।
- আল্লাহর ঘর সবসময় পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখা জরুরি।
- নামাজ, তাওয়াফ, ইতিকাফ—all are acts of devotion কেবল আল্লাহর জন্য।
ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন মক্কা নগরী নিরাপদ থাকে এবং তার মানুষরা ফল-মূল পায়। শর্ত রাখেন— যেন তারা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী হয়।
আল্লাহ বলেন— যারা কুফর করে, তাদেরকেও সাময়িক রিযিক দেব, কিন্তু আখিরাতে কঠিন শাস্তি পাবে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- মুমিনদের উচিত সমাজের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করা।
- কুফরীরা দুনিয়ায় ভোগ করলেও আখিরাতে শাস্তি পাবে।
- রিযিক আল্লাহর হাতে— তিনিই মুমিন ও কাফের উভয়কেই দেন।
ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) আল্লাহর ঘর কা'বার ভিত্তি নির্মাণ করেন। কাজ করার সময় তারা দোয়া করতেন যেন তাদের এই কাজ আল্লাহ কবুল করেন।
এ থেকে শিক্ষা— শুধু কাজ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তা কবুল হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- ইবাদত বা সৎকর্ম শেষে আল্লাহর কাছে কবুলের দোয়া করা জরুরি।
- কা'বা ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-এর হাতে নির্মিত।
- আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।
ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেন: তারা যেন মুসলিম (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী) হতে পারে, এবং তাদের বংশধরেরাও মুসলিম জাতি হিসেবে থাকে।
তারা আল্লাহর কাছে সঠিক ইবাদতের নিয়মাবলী শিখিয়ে দেওয়ার দোয়া করেন এবং তাওবা কবুল করার আবেদন জানান।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে নিজের ও সন্তানদের ঈমানের জন্য।
- ইবাদত শুধু আল্লাহর নির্দেশ মতো করলে কবুল হয়।
- আল্লাহ সর্বদা তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।
ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন— তাদের বংশধরদের মধ্যে থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন।
এই দোয়া পূর্ণ হয়েছে নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর আগমনের মাধ্যমে। তিনি মানুষের সামনে কুরআন পাঠ করেন, কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেন, এবং তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন।
এ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত রাসূলের দায়িত্ব হলো— শিক্ষা দেওয়া, শুদ্ধ করা ও পথপ্রদর্শন করা।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- নবী প্রেরণের বিষয়টি ইবরাহীম (আঃ)-এর দোয়ার ফল।
- রাসূলের দায়িত্ব শুধু বার্তা পৌঁছানো নয়, বরং মানুষকে শুদ্ধ করা।
- আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।
ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্ম হলো খাঁটি তাওহীদ ও আল্লাহর আনুগত্য। কেউ যদি এ ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে সে নিজের উপরই জুলুম করে।
আল্লাহ তাঁকে দুনিয়াতে নবুওত ও নেতৃত্ব দিয়েছেন, আর আখিরাতে তিনি সৎকর্মশীলদের দলে থাকবেন।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- ইবরাহীম (আঃ)-এর পথই প্রকৃত হিদায়াত।
- তাওহীদ থেকে সরে যাওয়া আত্মঘাতী বোকামি।
- আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েই মর্যাদা আছে।
আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-কে নির্দেশ দেন আত্মসমর্পণ করার। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন: আমি আত্মসমর্পণ করলাম। এটাই প্রকৃত ইসলামের রূপ— আল্লাহর আদেশে তৎক্ষণাৎ আনুগত্য করা।
ইবরাহীম (আঃ)-এর এই গুণই তাঁকে আল্লাহর খলিল (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) বানিয়েছে।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- ইসলাম মানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
- ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাওহীদ ও আনুগত্যের প্রকৃত প্রতীক।
- আল্লাহর নির্দেশে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেওয়া মুমিনের গুণ।
ইবরাহীম (আঃ) ও ইয়াকুব (আঃ) তাদের সন্তানদের কড়া উপদেশ দেন— আল্লাহ যে দ্বীন মনোনীত করেছেন, সেটিই আঁকড়ে ধরতে হবে। আর মৃত্যুর সময় যেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় না থাকে।
এ শিক্ষা প্রমাণ করে, ঈমান ধরে রাখার সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- মৃত্যুর সময় ঈমান নিয়ে বিদায় হওয়াই সর্বশ্রেষ্ঠ কামনা।
- পিতামাতার দায়িত্ব সন্তানদের ঈমানের وصية (উপদেশ) দেওয়া।
- ইসলাম ছাড়া আল্লাহর কাছে অন্য কোনো দ্বীন কবুলযোগ্য নয়।
আয়াতে উল্লেখ আছে ইয়াকুব (আঃ)-এর শেষ মুহূর্তের وصية। তিনি সন্তানদের জিজ্ঞেস করেন— তার পরে তারা কাকে ইবাদত করবে। সন্তানরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়, তারা এক আল্লাহকেই ইবাদত করবে।
এতে বোঝা যায়, ইবরাহীমের বংশধরদের সব নবী-রাসূল একই তাওহীদের দ্বীন প্রচার করেছেন।
শিক্ষণীয় শিক্ষা:
- সন্তানদের সামনে ঈমানের অঙ্গীকার নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
- ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক ও ইয়াকুব— সবাই একই তাওহীদ প্রচার করেছেন।
- সত্যিকার দ্বীন হলো আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রতি আনুগত্য।
আল্লাহ বলেন— পূর্ববর্তী নবী-রাসূল ও তাদের উম্মাহ নিজেদের আমলের জন্য দায়ী। পরবর্তীরা তাদের আমলের জন্য দায়ী নয়। প্রত্যেকে কেবল নিজের আমলের জন্য হিসাব দেবে।
এই আয়াত ইঙ্গিত করছে— ইসরাইলি বংশধরেরা শুধু পূর্বপুরুষদের কৃতিত্ব দাবি করে উপকৃত হতে পারবে না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- পূর্বপুরুষের আমল দিয়ে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
- প্রত্যেকেই নিজের কর্মের জন্য দায়ী।
- আল্লাহর কাছে শুধু ব্যক্তিগত আমলই মূল্যবান।
ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মের দিকে আহ্বান জানাতো, দাবি করতো — মুক্তি কেবল তাদের অনুসারীদের জন্য। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন নবী ﷺ-কে বলতে, যে সত্যিকারের পথ হলো ইবরাহীম (আঃ)-এর সরল তাওহীদের ধর্ম। তিনি কখনোই শিরক করেননি, বরং ছিলেন আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা।
উদাহরণ:
- আজও অনেক মতবাদ বা গোষ্ঠী দাবি করে— মুক্তি শুধু তাদের দলে যোগ দিলে।
- কেউ বলে, “আমাদের সংগঠনে আসো, তাহলেই সঠিক পথে থাকবে।”
- কিন্তু সত্য হলো— মুক্তির পথ হলো কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে আল্লাহর একত্ববাদে অবিচল থাকা।
- ইবরাহীম (আঃ)-এর তাওহীদের পথই সব জাতি-গোষ্ঠীর জন্য সর্বজনীন সত্য।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্যিকারের দীন হলো আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ), কোনো দল বা গোষ্ঠীর অনুসরণ নয়।
- ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্মই প্রকৃত হানিফ ও সরল পথ, যাতে শিরকের কোনো স্থান নেই।
- মুক্তি পেতে হলে শুধু লেবেল বা পরিচয় নয়, বরং তাওহীদ ও সৎকর্ম অপরিহার্য।
মুসলমানদের বিশ্বাস শুধু একটি জাতি বা কোনো নির্দিষ্ট নবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তারা বিশ্বাস করে সকল নবী-রাসূল ও তাদের প্রতি প্রেরিত কিতাবসমূহে। আল্লাহর নিকট সব নবী সমান— কারো মধ্যে পার্থক্য নেই। মুসলিম মানে— যিনি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেন।
উদাহরণ:
- আজকের দিনে অনেক ধর্ম অনুসারী নিজেদের নবী বা ধর্মকেই একমাত্র সত্য বলে দাবি করে।
- মুসলমানরা বিশ্বাস করে— ইবরাহীম, মূসা, ঈসা (আঃ) সবাই আল্লাহর প্রেরিত নবী ছিলেন।
- কুরআন আমাদের শিখিয়েছে সব নবী ও কিতাবের প্রতি বিশ্বাস রাখা, যদিও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ সময়ের সাথে বিকৃত হয়েছে।
- এতে বোঝা যায়— ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম, কেবল একটি জাতির জন্য নয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সব নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য, তাই কাউকে অস্বীকার করা যাবে না।
- মুসলিম মানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ, শুধু নামমাত্র পরিচয় নয়।
- ইসলামের দাওয়াত সর্বজনীন— সব জাতি ও সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
- ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব কেবল তাওহীদ ও আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণে।
এই আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে— সত্যিকার হিদায়াত পাওয়া যায় কেবল তখনই, যখন মানুষ মুসলমানদের মতো একই ঈমান আনে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি, তাঁর সমস্ত নবীদের প্রতি, এবং তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা বিভেদের মধ্যে থাকবে এবং আল্লাহ তাদের ব্যাপারে মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট হবেন। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন, তাই তাঁর উপর নির্ভর করাই শ্রেষ্ঠ ভরসা।
উদাহরণ:
- আজও অনেক গোষ্ঠী নিজেদের মতবাদকেই সত্য মনে করে, কিন্তু কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী ঈমান আনে না।
- যেমন কেউ কেবল কিছু নবীকে মানে, বাকিদের অস্বীকার করে— এটি বিভেদ সৃষ্টি করে।
- মুসলমানদের শিক্ষা হলো: সব নবীর প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে, কোনো পার্থক্য করা যাবে না।
- যারা সত্যকে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ নিজেই মুসলমানদের রক্ষক।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- হিদায়াত শুধু কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পূর্ণ ঈমান গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব।
- যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে, তারা বিভেদের মধ্যে পড়ে এবং পথভ্রষ্ট হয়।
- মুমিনদের ভরসা সবসময় আল্লাহর উপর হওয়া উচিত, কারণ তিনিই যথেষ্ট রক্ষক।
- ঈমান একক মানদণ্ড— কারো মতবাদ বা জাতিগত পরিচয় নয়।
“আল্লাহর রঙ” বলতে বোঝানো হয়েছে — ঈমান, ইসলামের দীক্ষা এবং তাওহীদের জীবনধারা। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা নিজেদের বিশেষ পরিচয় (দীক্ষা/বাপ্তিস্ম) নিয়ে গর্ব করত। আল্লাহ ঘোষণা দিলেন: প্রকৃত পরিচয় হলো আল্লাহর দীক্ষা, যা ইসলাম। এ দীক্ষা গ্রহণকারীর পরিচয় আল্লাহর বান্দা হিসেবে সর্বোত্তম।
উদাহরণ:
- আজও মানুষ নানা রকম পরিচয়, ট্যাগ বা গ্রুপ আইডেন্টিটি নিয়ে গর্ব করে (জাতি, দল, সম্প্রদায় ইত্যাদি)।
- কেউ গর্ব করে— “আমি ফালানা দলের লোক”, “আমি ফালানা মতবাদের।”
- কিন্তু ইসলামে সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো: “আমি আল্লাহর বান্দা।”
- আল্লাহর ‘রঙ’ মানে তাঁর নির্দেশ মানা, ইসলামকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় হলো আল্লাহর বান্দা হিসেবে আত্মপরিচয়।
- জাতিগত, রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় ক্ষণস্থায়ী; আল্লাহর দীক্ষা চিরন্তন।
- ইসলামের শিক্ষা জীবনের সব ক্ষেত্রে মেনে চলাই “আল্লাহর রঙ।”
- একজন প্রকৃত মুসলিম সবসময় আল্লাহর উপাসক ও তাঁর দাসত্বের স্বীকৃতিধারী।
ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের সাথে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করত, নিজেদেরকে আল্লাহর একমাত্র প্রিয়পাত্র মনে করত। আল্লাহ শিখিয়ে দিলেন— আল্লাহ সবার রব্ব, তিনি কেবল কোনো নির্দিষ্ট জাতির প্রভু নন। মানুষের পরিণতি তার আমলের উপর নির্ভর করবে। আর মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য হলো— তারা একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহর জন্য কাজ করে।
উদাহরণ:
- আজও অনেক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় দাবি করে— “আমরাই আল্লাহর আসল অনুসারী।”
- বাস্তবে, আল্লাহ কেবল মুসলিমদের নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক।
- আমলই আসল পরিচয়— শুধু পরিচয় বা বিতর্ক কাউকে আল্লাহর কাছে সফল করতে পারবে না।
- যেমন কেউ ইসলাম নিয়ে বিতর্কে জিতলেও যদি তার আমল ভালো না হয়, তবে আল্লাহর কাছে তার কোনো মূল্য নেই।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহ সবার রব্ব; তিনি কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর নয়।
- প্রত্যেকের আমলই তার পরিণতি নির্ধারণ করবে।
- সত্যিকারের মুসলিম হলো সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে জীবন পরিচালনা করে।
- অর্থহীন বিতর্কের পরিবর্তে আমল ও ইখলাসের উপর জোর দিতে হবে।
ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা দাবি করত যে ইবরাহীম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের বংশধররা তাদের ধর্মের অনুসারী ছিলেন। অথচ তাদের যুগে ইহুদী বা খ্রিষ্টান ধর্মের অস্তিত্বই ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, তারা ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম— আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী। এখানে দেখানো হয়েছে যে, আল্লাহর সত্যকে জেনে-বুঝে গোপন করা সবচেয়ে বড় জুলুম।
উদাহরণ:
- আজও কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসকে বিকৃত করে বা গোপন করে।
- যেমন, কোনো ব্যক্তিকে বা নেতাকে নিজেদের দলের লোক হিসেবে প্রচার করা, যদিও তিনি সে দলে কখনো ছিলেন না।
- অথবা ইসলামের শিক্ষাকে বিকৃত করে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেওয়া— এটিও আল্লাহর কাছে বড় জুলুম।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- ইতিহাস বিকৃত করা বা আল্লাহর পাঠানো সত্য গোপন করা বড় অন্যায়।
- নবীগণ ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম, কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দাবির সাথে আবদ্ধ নন।
- আমাদের উচিত সত্যকে গোপন না করে সঠিকভাবে প্রকাশ করা।
- আল্লাহ সবকিছু দেখছেন, তাই প্রতারণা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হবে।
আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন যে অতীতের নবীগণ বা পূর্ববর্তী উম্মাহরা নিজেদের আমল অনুযায়ী বিচার পাবে। তাদের কর্মের বোঝা বর্তমান প্রজন্ম বহন করবে না। প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ আমলের জন্যই দায়ী হবে। কারও বংশ, জাতি, বা পূর্বপুরুষের ভালো কাজ দিয়ে আজকের প্রজন্মের মুক্তি হবে না।
উদাহরণ:
- অনেকে ভাবে— “আমার দাদা-নানা বড় আলেম ছিলেন, তাই আমিও আল্লাহর কাছে সম্মানিত।” কিন্তু ইসলাম বংশের উপর নয়, ব্যক্তিগত আমলের উপর নির্ভর করে।
- যেমন, পরীক্ষায় কেউ ভালো করলে তার রেজাল্ট শুধু তারই হবে, অন্য কারও জন্য নয়।
- তাই নাম, পরিচয় বা পূর্বপুরুষের কৃতিত্বে ভর করে বসে থাকা উচিত নয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলের জন্য দায়ী, অন্যের সওয়াব বা গুনাহ বহন করা যাবে না।
- পূর্বপুরুষের মর্যাদায় ভর না করে নিজের আমল ঠিক করার চেষ্টা করতে হবে।
- সত্যিকারের সম্মান আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তির, যে তাকওয়া অবলম্বন করে।
মদীনায় হিজরতের পর প্রাথমিকভাবে মুসলিমরা বায়তুল মাকদিসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ত। পরে আল্লাহর নির্দেশে কিবলা পরিবর্তন করে কাবার দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন মুনাফিক ও কিছু ইহুদী ঠাট্টা করে বলত: “তাহলে আগের নামাজগুলো বাতিল হয়ে গেল?” আল্লাহ জানিয়ে দিলেন— পূর্ব-পশ্চিম সবকিছু আল্লাহর, তিনিই নির্ধারণ করেন কোন দিকে ইবাদত করতে হবে, আর প্রকৃত হিদায়াতও একমাত্র তাঁর কাছ থেকেই আসে।
আধুনিক উদাহরণ:
- আজকের যুগে অনেকেই ইসলামি বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, যেমন— কেন হিজাব, কেন যাকাত, কেন নামাজে নির্দিষ্ট নিয়ম? এগুলোও মূর্খতার উদাহরণ।
- আল্লাহর আদেশের পেছনে মানুষের বুদ্ধি সবসময় পৌঁছাবে না। মুসলিমের কাজ হলো প্রশ্ন না তুলে আনুগত্য করা।
- যেমন ট্রাফিক সিগন্যালে লাল বাতি মানা হয় নিয়মের কারণে, তেমনি আল্লাহর নিয়ম মানা হয় তাঁর হুকুমের কারণে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর বিধানকে বিদ্রূপ করা বড় গোনাহ।
- পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর, তাই দিক পরিবর্তন কোনো সমস্যা নয়, মূল উদ্দেশ্য হলো আনুগত্য।
- প্রকৃত হিদায়েত আল্লাহর কাছ থেকেই আসে, তাই সব বিষয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা জরুরি।
আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে “মধ্যপন্থী জাতি” হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ তারা চরমপন্থা বা অতিরিক্ত শিথিলতার মধ্যে নয়, বরং ন্যায় ও ভারসাম্যের পথে। মুসলিমদের দায়িত্ব হলো মানবজাতির সামনে সত্যের সাক্ষ্য বহন করা। কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা আসলে একটি পরীক্ষা ছিল— প্রকৃত মুমিন ও ভণ্ডদের পার্থক্য বোঝানোর জন্য। আল্লাহ আশ্বাস দিয়েছেন, নামাজে পূর্ববর্তী কিবলার দিকে করা ইবাদতও বৃথা যাবে না।
উদাহরণ:
- আজকের যুগে “মধ্যপন্থা” হলো ইসলামি নীতি মেনে চলা— না চরম হিংস্র, না অতিরিক্ত উদারতাবাদী।
- যেমন: কেউ ধর্মের নামে অন্যকে হত্যা করে, আবার কেউ ধর্মকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে— দুটোই ভুল। ইসলাম এর মাঝপথ।
- মুসলিম উম্মাহ আজও বিশ্বের সামনে সাক্ষ্য বহনকারী জাতি, তাই তাদের জীবন ও কর্ম ইসলামের দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- মুসলিমরা হলো মধ্যপন্থী জাতি— ভারসাম্য ও ন্যায়বিচারের পথে চলা।
- কিবলা পরিবর্তন ছিল ঈমানের পরীক্ষা— কে আল্লাহর আদেশ মানে আর কে ফেঁসে যায়।
- আল্লাহ কারও আমল বৃথা করেন না, তাই মুমিনের প্রতিটি নেক কাজের মূল্য আছে।
- রাসূল ﷺ আমাদের উপর সাক্ষী হবেন, তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করা আবশ্যক।
এই আয়াতটি কিবলা পরিবর্তনের ঘটনার প্রসঙ্গে অবস্থিত। আল্লাহ প্রত্যক্ষ করে বলছেন যে তিনি (প্রভূত দয়ায়) রাসূলের মুখের আকাশবিবর্তন লক্ষ্য করেছেন — এবং তারপর তিনি কিবলা পরিবর্তন (যার মাধ্যমে কাবা নির্ধারিত হল) ঘোষণা করেছেন। এটি একটি স্পষ্ট নির্দেশাবলী ও পরীক্ষা—যাতে পবিত্রতা ও আনুগত্য চিহ্নিত হয়।
মূল শিক্ষা:
- কিবলা পরিবর্তন একটি আল্লাহর নির্দেশ; এটি অনুমতি বা রেজা পেয়েছে যাতে মুসলিম উম্মাহ এক ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশ পায়।
- “যেখানে-ই তোমরা হও”—কথাটা নির্দেশ করে যে মুসলিমদের ইবাদত (নামাজ) স্থান-নিরপেক্ষ; কেবল মুখকে কিবলার দিকে ফিরালেই হোক।
- কিতাবপ্রাপ্ত লোকেরা (যারা তত্ত্বগতভাবে জানে) বুঝতে পারবে যে এই পরিবর্তনই বোঝায় এ সিদ্ধান্ত আল্লাহর কাছ থেকে সত্য; তবে যারা অহংকারে বা দুর্বৃত্তিতে আছে তারা অস্বীকার করে যেতে পারে।
- আল্লাহ মানুষের কর্ম ও মনোভাব থেকে অন্যমনস্ক নাই—এসব বিষয় তার ওপর রহস্যভাষ্যময় নয়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইমান ও আনুগত্যে বাহ্যিক দিকনির্দেশ (যেমন কিবলা) গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর সঙ্গে অন্তরের মিলও জরুরি।
- আল্লাহ কখনোই নির্দেশ দেন না অনর্থে; নির্দেশের পেছনে উদ্দেশ্য ও হিকমত থাকে—এগুলো বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
- মুমিনদের জন্য প্রধান শিক্ষা হলো—আদেশ মানা এবং আল্লাহর হুকুমে নম্রতা।
এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আহলে কিতাবরা (ইহুদি-খ্রিষ্টানরা) যতই নিদর্শন দেখুক, তারা মুসলিমদের কিবলার অনুসরণ করবে না। আবার মুসলিমদেরও তাদের কিবলার অনুসরণ করার অনুমতি নেই। এটি ছিল কিবলা পরিবর্তনের বড় পরীক্ষা ও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলাদা পরিচয়।
মূল শিক্ষা:
- আহলে কিতাবরা নিজেদের কিবলা নিয়ে বিভক্ত, তাই মুসলিমদের তাদের অনুসরণ করার কোনো কারণ নেই।
- কিবলা পরিবর্তন মুসলিম উম্মাহকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
- আল্লাহর হুকুমের পর মানুষের ইচ্ছার অনুসরণ করা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- মুসলিমদের পরিচয় ও ইবাদতের দিকনির্দেশ আল্লাহ নির্ধারিত করেছেন—এটি কাউকে খুশি করার জন্য বদলানো যাবে না।
- মানুষের মতামত বা সমাজের চাপের চেয়ে আল্লাহর আদেশই মুখ্য।
- আল্লাহর দেয়া জ্ঞানকে উপেক্ষা করে অন্যের খেয়ালখুশি অনুসরণ করা অন্যায় ও গুনাহ।
এই আয়াতে আল্লাহ জানাচ্ছেন যে আহলে কিতাবরা (ইহুদী-খ্রিষ্টানরা) রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ এর সত্যতা খুব ভালোভাবে জানত। তাদের কিতাব (তাওরাত ও ইনজীল) এ তাঁর বর্ণনা সুস্পষ্ট ছিল। তবুও তারা নিজেদের স্বার্থের কারণে সেই সত্য গোপন করেছে।
মূল শিক্ষা:
- আহলে কিতাবরা রাসূল ﷺ-কে চিনত নিজের সন্তানদের মতোই স্পষ্টভাবে।
- তাদের একদল জেনেশুনে সত্যকে অস্বীকার করেছে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
- সত্য জেনে গোপন করা বড় অপরাধ এবং আল্লাহর গজবের কারণ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্যকে চিনে অস্বীকার করা সবচেয়ে বড় অন্যায়—এতে আত্মপ্রবঞ্চনা হয়।
- জ্ঞান শুধু জানা নয়, তা মেনে চলা এবং প্রচার করাও দায়িত্ব।
- মুমিনদের জন্য সতর্কবার্তা—যাতে কখনো সত্যকে গোপন না করা হয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন যে, কিবলা পরিবর্তনসহ ইসলামের সব বিধান সরাসরি তাঁর পক্ষ থেকে সত্য। রাসূল ﷺ-কে এবং তাঁর অনুসারীদের বলা হয়েছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধায় না পড়তে।
মূল শিক্ষা:
- সত্য কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, মানুষের মতামত বা ইচ্ছা থেকে নয়।
- মুমিনের জন্য সন্দেহ বা দ্বিধা নয়, বরং পূর্ণ আনুগত্য জরুরি।
- আল্লাহর হুকুমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঈমানের পরিপন্থী।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- বিশ্বে অনেক মতামত ও মতবাদ থাকলেও মুসলিমদের জন্য আল্লাহর হুকুমই একমাত্র সত্য।
- কোনো মুসলিমের উচিত নয় ইসলামের বিধান নিয়ে সংশয়ে পড়া।
- সন্দেহ দূর করতে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা জরুরি।
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, কিবলার ভিন্নতা কোনো বড় বিষয় নয়; মূল বিষয় হলো নেক কাজের প্রতিযোগিতা করা। মানুষ পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সবাইকে একত্র করবেন।
মূল শিক্ষা:
- কিবলা বা বাহ্যিক দিকনির্দেশ নিয়ে বিতর্ক নয়, বরং নেক আমলে অগ্রগামী হওয়া জরুরি।
- মানুষের জন্য আসল লক্ষ্য হলো সৎকর্ম—এটাই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।
- কিয়ামতের দিন আল্লাহ সব মানুষকে সমবেত করবেন—তাঁর ক্ষমতা সীমাহীন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আমাদের মধ্যে কে কোন দিক থেকে নামাজ পড়ে তা নয়, বরং কে বেশি নেক আমল করে সেটাই আসল প্রতিযোগিতা।
- সত্কর্মে দ্রুততা দেখানো উচিত, কারণ সুযোগ সীমিত।
- আল্লাহর কাছে সবকিছুই সম্ভব—তাই তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে।
আল্লাহর পক্ষ থেকে আবারও জোর দিয়ে নির্দেশ এসেছে—যেখান থেকেই রাসূল ﷺ নামাজে দাঁড়াবেন, তিনি যেন কাবার দিকে মুখ করেন। এ পরিবর্তন আল্লাহর নির্দিষ্ট সত্য নির্দেশ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর মানুষ যা কিছু করে, আল্লাহ তা অবহেলা করেন না।
মূল শিক্ষা:
- মুসলিমদের জন্য কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়া ফরজ বিধান।
- আল্লাহর আদেশ পুনরাবৃত্তি করে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, যেন কারও মনে সন্দেহ না থাকে।
- আল্লাহ মানুষের সব কাজ অবগত আছেন, কেউ তাঁর দৃষ্টি এড়াতে পারে না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আমাদের নামাজ সর্বদা সঠিক কিবলামুখী হতে হবে।
- আল্লাহর আদেশ পালনে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
- মনে রাখতে হবে—আমাদের প্রতিটি কাজ আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য।
আল্লাহ তায়ালা আবারও জোর দিয়ে নির্দেশ দিলেন—যেখানেই মুসলিমরা থাকুক না কেন, নামাজের সময় মুখ কাবার দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এর মাধ্যমে অমুসলিমদের যুক্তি বন্ধ হয়ে যায়, যদিও অন্যায়কারীরা তবুও বিরোধ করবে। মুসলিমদের আল্লাহর ভয় করা উচিত, মানুষের ভয় নয়। কিবলা পরিবর্তন মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বড় নিয়ামত।
মূল শিক্ষা:
- কাবার দিকে মুখ করা নামাজের অপরিহার্য শর্ত।
- মুসলিমদের শক্তিশালী পরিচয় আল্লাহর আদেশ মেনে চলাতেই।
- মানুষের সমালোচনার তোয়াক্কা না করে আল্লাহর আনুগত্য করা জরুরি।
- কিবলা পরিবর্তন মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- মানুষ কী বলবে সেটির চেয়ে আল্লাহ কী বলেছেন সেটি মেনে চলাই প্রকৃত ঈমান।
- মুসলিমের জীবনে আল্লাহভীতি সর্বোচ্চ হওয়া উচিত।
- আল্লাহর বিধান মানলে তাঁর নিয়ামত পূর্ণতা লাভ করে।
এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়েছেন। নবী ﷺ-এর প্রেরণাই ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামত। তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করেন, মানুষকে আত্মশুদ্ধি করান, কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ (সুন্নাহ) শিক্ষা দেন, এবং এমন জ্ঞান দেন যা পূর্বে অজানা ছিল।
মূল শিক্ষা:
- নবী ﷺ হলেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক।
- কুরআন, সুন্নাহ ও আত্মশুদ্ধি ইসলামের মূলভিত্তি।
- আল্লাহর দেওয়া জ্ঞান মানুষকে অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- রাসূল ﷺ-এর শিক্ষা গ্রহণ করাই ঈমানের শর্ত।
- শুধু জ্ঞান নয়, আত্মশুদ্ধি করাও অপরিহার্য।
- কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়াই প্রকৃত হিদায়াত।
আল্লাহ এ আয়াতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দুটি মৌলিক দায়িত্বের কথা বলেছেন— (১) আল্লাহকে স্মরণ করা, (২) আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। যে বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহও তাকে দয়া ও রহমতের মাধ্যমে স্মরণ করেন। অকৃতজ্ঞতা করা মানে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করা।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর স্মরণে হৃদয় প্রশান্ত হয়।
- যে আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহও তাকে স্মরণ করেন।
- কৃতজ্ঞতা ঈমানের একটি মৌলিক শাখা।
- অকৃতজ্ঞতা আল্লাহর অপ্রসন্নতার কারণ।
আজকের জন্য শিক্ষা:
- যেকোনো অবস্থায় আল্লাহর জিকির করা মুমিনের কর্তব্য।
- আমাদের জীবনের প্রতিটি নিয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে।
- আল্লাহকে ভুলে গেলে মানুষ শয়তানের কবলে পড়ে যায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এ আয়াতে ঈমানদারদেরকে বিপদ, পরীক্ষা এবং দুঃসময়ের সমাধান শিখিয়ে দিচ্ছেন। বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় সহায় হলো সবর (ধৈর্য) ও সালাত (নামায)।
- সবর: ধৈর্য মানে শুধু কষ্ট সহ্য করা নয়, বরং আল্লাহর আদেশ মানা, গোনাহ থেকে বিরত থাকা এবং বিপদে হতাশ না হওয়া।
- সালাত: নামায আল্লাহর সাথে সংযোগের সর্বোত্তম মাধ্যম। এতে বান্দা তার প্রয়োজন ও দুঃখ আল্লাহর কাছে তুলে ধরে।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“বান্দা যখন সিজদায় থাকে তখনই সে তার প্রতিপালকের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। অতএব সিজদারত অবস্থায় প্রচুর দু‘আ করো।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৭০) - অন্য হাদীসে এসেছে—
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “মুমিনের জন্য ধৈর্য একটি আলোক, আর সালাত হলো নূর।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৩) - আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—যারা ধৈর্য ধরে, তিনি তাদের সাথে থাকেন। আর আল্লাহর সাথে থাকা মানেই সাহায্য, রহমত ও অন্তরের শান্তি।
মূল শিক্ষা:
- সবর ও সালাত মুমিনের জীবনের দুই প্রধান শক্তি।
- দুঃসময়ে প্রথমেই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, মানুষের কাছে নয়।
- সিজদা ও সালাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম উপায়।
- আল্লাহর সাথে থাকার চাবিকাঠি হলো ধৈর্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- কঠিন পরিস্থিতিতে অভিযোগ না করে ধৈর্য ধরতে হবে।
- প্রতিটি সমস্যার সমাধানের প্রথম ধাপ হওয়া উচিত সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।
- গোনাহ থেকে বাঁচতে ও ঈমান রক্ষার জন্যও ধৈর্যের প্রয়োজন।
- সবর ও সালাত উভয়ই মুমিনের অন্তরকে প্রশান্ত করে ও আল্লাহর রহমত আনে।
এ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা মুমিনদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, যারা আল্লাহর পথে শহীদ হন, তারা প্রকৃত মৃত নন। তাদের দেহ দুনিয়ার চোখে নিথর হয়ে গেলেও তাদের রুহ আল্লাহর কাছে সম্মানিত অবস্থায় থাকে। তারা জান্নাতে জীবিত থাকে, রিজিক পায় এবং আনন্দ উপভোগ করে।
মৃত্যুর সাধারণ অবস্থা:
আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
“প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।”সাধারণত সকল মানুষকেই দুনিয়ার জীবনের পর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। তবে এর পরবর্তী অবস্থা সবার জন্য সমান নয়—
(সূরা আলে ইমরান ৩:১৮৫)
- কাফেররা: মৃত্যুর পর অপমানজনকভাবে জীবিত থাকে, অর্থাৎ তাদের রুহ আজাব ও শাস্তি ভোগ করে।
- সাধারণ মুমিনরা: কবরের জীবনে আরামে থাকে, যেন ঘুমন্ত অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছে । কবরে মু'মিন ব্যাক্তি ঘুমাবেন (সুরা ইয়াসিন-৫২)। আর ঘুমকে একপ্রকার মৃত্যু বলা হয়েছে, (সুরা আয-যুমার-৪২)।
- শহীদগণ: আল্লাহ তাদের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। তারা সবুজ পাখির রূপে জান্নাতে বিচরণ করে, রিজিক লাভ করে এবং সুখ ভোগ করে, অর্থাৎ তারা জাগ্রত (জীবিত) অবস্থায় ঘুরে বেড়াবে,
শহীদ সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“আল্লাহর পথে নিহত শহীদরা আল্লাহর কাছে জীবিত থাকে। তারা সবুজ পাখির আকারে জান্নাতের গাছে আশ্রয় নেয় এবং জান্নাতের খাদ্য গ্রহণ করে।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮৮৭) - রাসূলুল্লাহ ﷺ আরও বলেছেনঃ
“শহীদ আল্লাহর কাছে ছয়টি বিশেষ মর্যাদা লাভ করে— (১) প্রথম রক্ত ঝরতেই তার গুনাহ ক্ষমা করা হয়, (২) জান্নাতে তার স্থান দেখানো হয়, (৩) কবরের আযাব থেকে রক্ষা করা হয়, (৪) কিয়ামতের মহাভয়ে নিরাপদ রাখা হয়, (৫) তার মাথায় ইজ্জতের মুকুট পরানো হয়, (৬) তার জন্য ৭২ জন হুরী দেওয়া হয়।”
(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস: ১৬৬৩; সহিহ)
মূল শিক্ষা:
- শহীদরা কখনোই প্রকৃত মৃত নয়, তারা আল্লাহর কাছে জীবিত।
- সাধারণ মানুষের মৃত্যু একরকম হলেও শহীদের মৃত্যু সম্পূর্ণ ভিন্ন মর্যাদার।
- আল্লাহর পথে প্রাণ বিসর্জন সর্বোচ্চ সম্মান।
- মানুষের দৃষ্টিতে যা মৃত্যু, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা আসলেই “চিরজীবন”।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- শহীদদের মর্যাদা নিয়ে কোনো সন্দেহ রাখা যাবে না, কারণ আল্লাহ তাঁদের বিশেষ জীবন দান করেছেন।
- শহীদের আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকতে হবে।
- মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সবার জন্য সমান নয়—আল্লাহর পথে শহীদদের অবস্থা সবচেয়ে উত্তম।
- এই আয়াত আমাদের ধৈর্য ও সাহস জোগায়, যেন আল্লাহর পথে কষ্ট বা ত্যাগকে কখনো বৃথা মনে না করি।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, দুনিয়ার জীবন পরীক্ষা ও কষ্ট ছাড়া পূর্ণ হবে না। মানুষকে কখনো ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ-প্রাণ-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে।
- ভয়: শত্রুর ভয়, বিপদ-সংকট বা নিরাপত্তাহীনতা।
- ক্ষুধা: অভাব-অনটন, দুর্ভিক্ষ বা দারিদ্র্য।
- সম্পদের ক্ষতি: ব্যবসা, ধন-সম্পদ বা উপার্জনে ক্ষতি।
- প্রাণের ক্ষতি: প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বা নিজেই রোগব্যাধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
- ফসল-ফলাদির ক্ষতি: জীবিকার উৎস, কৃষি বা জীবনের প্রয়োজনীয় সম্পদের ক্ষয়।
পরীক্ষা ও ধৈর্য সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“মুমিন পুরুষ ও নারীর ওপর আল্লাহ যে পরীক্ষা চালিয়ে যান— তার দেহ, সন্তান বা সম্পদে— যতক্ষণ না সে আল্লাহর সাথে গুনাহমুক্ত অবস্থায় সাক্ষাৎ করে।”
(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস: ২৩৯৯; সহিহ) - আরেক হাদীসে এসেছে—
“যার উপর আল্লাহ মঙ্গল চান, তাকে তিনি বিপদে ফেলেন (পরীক্ষা নেন)।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬৪৫)
মূল শিক্ষা:
- দুনিয়ার জীবন কষ্ট ও পরীক্ষার সমন্বয়ে গঠিত।
- ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ বা প্রাণের ক্ষতি—সবই এগুলো আল্লাহর পরীক্ষা।
- আসল সফলতা হলো এসব পরীক্ষায় ধৈর্য ধরে থাকা।
- ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহ সুসংবাদ দিয়েছেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- জীবনে দুঃখ-কষ্ট এলে হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরতে হবে।
- পরীক্ষা হলো আল্লাহর রহমতেরই অংশ, যাতে বান্দা গুনাহ থেকে পবিত্র হয়।
- বিপদের সময়ে অভিযোগ নয়, বরং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
- সবরকারীরা পৃথিবীতেও সম্মানিত এবং আখিরাতে জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করবে।
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। মুমিন যখন কোনো বিপদ, কষ্ট বা ক্ষতির সম্মুখীন হয় তখন তার মুখ থেকে বের হয়— “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।” অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর মালিকানাধীন, আর আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যও তাঁর দিকেই।
- এই দো‘আ উচ্চারণের মাধ্যমে মুমিন স্বীকার করে যে তার নিজের কিছু নেই—সবই আল্লাহর।
- বিপদ আসলে অভিযোগ নয়, বরং আল্লাহর হুকুম মানা ও ধৈর্য ধরা উচিত।
- এই বাক্য মুমিনের হৃদয়ে প্রশান্তি আনে এবং আল্লাহর রহমত লাভের কারণ হয়।
সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“যখন কোনো মুমিনের উপর কোনো বিপদ আসে এবং সে বলে— ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন, আল্লাহুম্মা আজিরনী ফি মুসীবাতি ওয়াখলুফ লি খইরান মিনহা’ (হে আল্লাহ! আমার এ বিপদে আমাকে প্রতিদান দাও এবং এর পরিবর্তে আমাকে উত্তম দাও) তখন আল্লাহ তাকে প্রতিদান দেন এবং তার জন্য উত্তম কিছু প্রদান করেন।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১৮) - আরেক হাদীসে এসেছে—
“বড় কোনো বিপদ যখন কারো ওপর আসে এবং সে ধৈর্য ধরে ‘ইন্না লিল্লাহ...’ বলে, তখন আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি তৈরি করেন, যার নাম রাখা হয়— বাইতুল হামদ (প্রশংসার ঘর)।”
(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস: ১০২১; হাসান)
মূল শিক্ষা:
- বিপদ আসলে মুমিনের প্রথম বাক্য হওয়া উচিত “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।”
- এই বাক্য কেবল দো‘আ নয়, বরং এক বিশাল ঈমানি ঘোষণা।
- সবকিছু আল্লাহর মালিকানাধীন—মুমিন তা বিশ্বাস করে।
- বিপদের সময় ধৈর্যশীলরা আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আমরা যখন কোনো ক্ষতি, বিপদ বা দুঃসংবাদ শুনি, তখনই “ইন্না লিল্লাহ...” বলা উচিত।
- এই দো‘আ শুধু মুখে নয়, অন্তরে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
- প্রতিটি বিপদ ধৈর্য নিয়ে মোকাবেলা করলে তা আখিরাতের সওয়াবের কারণ হয়।
- আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়াই জীবনের চূড়ান্ত সত্য—এ দো‘আ তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
যারা বিপদে পড়ে ধৈর্য ধারণ করে এবং বলে— “إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ”, আল্লাহ তাদের জন্য তিনটি মহান অনুগ্রহের ঘোষণা দিয়েছেন—
- সালাওয়াত (প্রশংসা / দো‘আ): আল্লাহ নিজেই ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাদের প্রশংসা করেন।
- রহমত: আল্লাহর বিশেষ দয়া তাদের উপর নাযিল হয়, যা দুনিয়ায় প্রশান্তি ও আখিরাতে জান্নাত।
- হিদায়াত: তারা সঠিক পথের দিশা পায়—যা আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত।
সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“যখন কোনো বান্দা বলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’, তখন আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দা সত্য বলল, নিশ্চয়ই সে আমার কাছ থেকেই এসেছে এবং আমার কাছেই ফিরে যাবে।”
(মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২৩৪৬৪; সহিহ) - আরেক হাদীসে এসেছে—
“ধৈর্য এমন একটি আলো, যা মুমিনকে পথ দেখায়।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৩)
মূল শিক্ষা:
- বিপদে ধৈর্য ধরলে আল্লাহর বিশেষ সালাওয়াত, রহমত ও হিদায়াত লাভ হয়।
- এগুলো আল্লাহর সবচেয়ে বড় পুরস্কার, যা দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিনকে সম্মানিত করে।
- ধৈর্য শুধু কষ্ট সহ্য করা নয়, বরং আল্লাহর উপর আস্থা রেখে কষ্ট মোকাবেলা করা।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- জীবনের প্রতিটি বিপদে আমরা “ইন্না লিল্লাহ...” বলে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহর রহমতের অধিকারী হব।
- ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশংসা ও রহমত নাযিল হয়।
- ধৈর্য হলো সঠিক হিদায়াত পাওয়ার মাধ্যম।
- মুমিনের প্রকৃত শক্তি ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।
- সফা ও মারওয়া: মক্কার কাবাঘরের নিকটবর্তী দুটি পাহাড়ি টিলা। হাজীরা হজ্ব ও উমরাহর সময় এ দুটির মাঝে সাতবার চলাফেরা করে থাকেন। একে বলা হয় সাঈ।
- জাহেলিয়াত আমলে মুশরিকরা সেখানে মূর্তি বসিয়েছিল। এ কারণে কিছু সাহাবী প্রথমে সাঈ করতে সংকোচবোধ করতেন। তখন এ আয়াত নাযিল হয় এবং জানানো হয়—এটি আল্লাহর শি‘আর, তাই সাঈ করা অপরিহার্য।
- “ফালা জুনাহা...” অর্থাৎ অপরাধ নেই, এখানে নিষেধ ভঙ্গ নয় বরং অনুমতি ও গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। পরে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর হাদীসের মাধ্যমে একে হজ্ব ও ওমরাহর অপরিহার্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সাঈ ফরজ করেছেন, তাই সাঈ কর।”
(সুনান আন-নাসায়ী, হাদিস: ২৯৭৫; সহিহ) - হযরত হাফসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত—
“আমি কখনো রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সফা-মারওয়ার সাঈ বাদ দিতে দেখিনি।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৬৪৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২৭৭)
মূল শিক্ষা:
- সফা-মারওয়া আল্লাহর প্রতীকসমূহের অংশ, এগুলো সম্মান করা ঈমানের দাবি।
- হজ্ব ও উমরাহতে সাঈ করা অপরিহার্য আমল।
- আল্লাহ নেক কাজের প্রশংসা করেন এবং বান্দার প্রতিটি আমল সম্পর্কে অবগত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আমরা যখন হজ্ব বা উমরাহ করি, তখন সম্পূর্ণ সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে।
- যে কোনো ইবাদতের মর্ম হলো আল্লাহর নির্দেশ মানা, নিজের খেয়াল নয়।
- অতিরিক্ত নেক কাজ (তাত্তাওয়া) করলে আল্লাহ তা গ্রহণ করেন এবং তার প্রতিদান বাড়িয়ে দেন।
এ আয়াতে আল্লাহ সেইসব লোকদের বিরুদ্ধে কঠোর ঘোষণা দিয়েছেন যারা—
- আল্লাহর কিতাবে নাযিলকৃত স্পষ্ট প্রমাণ, সত্য এবং হিদায়াতকে মানুষের কাছ থেকে গোপন করে।
- তাদের মূল অপরাধ হলো আল্লাহর হুকুম জানার পরও তা গোপন রাখা অথবা পরিবর্তন করা।
- আল্লাহ বলেন—তাদের উপর কেবল আল্লাহর লা‘নতই নয়, বরং ফেরেশতাগণ, নবীগণ এবং সমগ্র মানবজাতির লা‘নতও পড়ে।
সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি জ্ঞান গোপন করবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের বেড়ি দিয়ে শাস্তি দেবেন।”
(সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৬১; সহিহ) - আরেক হাদীসে এসেছে—
“তোমরা যারা উপস্থিত, তারা যারা অনুপস্থিত তাদের কাছে পৌঁছে দেবে। কেননা অনেক সময় জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তি তা থেকে বেশি উপকৃত হয়, যার কাছে জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া হয়।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৭৯)
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর বাণী ও সত্য জ্ঞান গোপন করা মহাপাপ।
- সত্য গোপনকারীরা আল্লাহর লা‘নত ও সমস্ত সৃষ্টির লা‘নতের অধিকারী।
- আল্লাহর ওহী মানুষের কাছে পরিষ্কারভাবে পৌঁছানো আলেমদের দায়িত্ব।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আমাদের উচিত কুরআন ও সহীহ হাদীসের জ্ঞান গোপন না করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
- ভুল ব্যাখ্যা বা গোপন করার পরিবর্তে স্পষ্টভাবে সত্য প্রকাশ করতে হবে।
- ধর্মীয় জ্ঞান গোপন করা বা বিকৃত করা মানুষের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি নিজের আখিরাতের জন্য ধ্বংসাত্মক।
আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী আয়াতে সত্য গোপনকারীদের উপর লা‘নত ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এই আয়াতে তিনি ব্যতিক্রম ঘোষণা করেছেন, অর্থাৎ—
- তাওবা: আন্তরিকভাবে গুনাহ থেকে ফিরে আসা।
- ইসলাহ: নিজের ভুল সংশোধন করা এবং আমলকে ঠিক করা।
- বায়ান: পূর্বে গোপন করা সত্যকে প্রকাশ করা।
যারা এই তিনটি শর্ত পূরণ করে, আল্লাহ তাদের তাওবা গ্রহণ করেন এবং রহমত নাজিল করেন। এটি আল্লাহর দয়ার এক বিশাল নিদর্শন যে, বড় গুনাহ থেকেও যদি বান্দা ফিরে আসে, তবে তিনি ক্ষমা করে দেন।
সম্পর্কিত হাদীস:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি তাওবা করে, সে এমন যেন কখনো গুনাহ করেনি।”
(সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২৫০; হাসান) - আরেক হাদীসে এসেছে—
“আল্লাহ তাআলা রাতে পাপীদের জন্য দিনের তাওবা গ্রহণ করেন, আর দিনে পাপীদের জন্য রাতের তাওবা গ্রহণ করেন, যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয়।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৫৯)
মূল শিক্ষা:
- গুনাহ করে হতাশ হওয়া যাবে না, বরং তাওবার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে।
- তাওবা শুধু মুখের কথা নয়, বরং সংশোধন (ইসলাহ) ও সত্য প্রকাশ করাও জরুরি।
- আল্লাহ সর্বদা বান্দার তাওবা গ্রহণ করেন, যদি বান্দা আন্তরিক হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- যদি কোনো ভুল করে থাকি, বিশেষ করে দ্বীনি জ্ঞান গোপন বা বিকৃত করে থাকি, তবে দ্রুত তাওবা করতে হবে।
- নিজেকে শুধরে নিতে হবে এবং সত্যকে গোপন না রেখে প্রকাশ করতে হবে।
- আল্লাহর রহমতের দরজা সবসময় খোলা, তাই কখনো হতাশ হওয়া যাবে না।
পূর্ববর্তী আয়াতে (১৬০) আল্লাহ তাআলা সত্য গোপনকারীদের জন্য তাওবার সুযোগ রেখেছিলেন, যারা নিজেদের সংশোধন করে এবং সত্য প্রকাশ করে। কিন্তু এই আয়াতে সেইসব লোকের ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে, যারা কুফরি করে (সত্যকে অস্বীকার বা গোপন করে) এবং আমৃত্যু সেই অবস্থায়ই থাকে। তাদের জন্য কোনো ক্ষমা বা তাওবার সুযোগ নেই।
- কুফরি: আল্লাহর অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব বা তাঁর প্রেরিত সত্যকে অস্বীকার করা বা গোপন করা।
- কাফির অবস্থায় মৃত্যু: তাওবা বা ঈমানের দিকে ফিরে আসার আগেই কুফরির উপর অটল থেকে মৃত্যুবরণ করা।
- লা‘নত: আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকা বা বিতাড়িত হওয়া।
এই আয়াতে তিন প্রকার সত্তার পক্ষ থেকে অভিসম্পাত (লা‘নত) ঘোষণার কথা বলা হয়েছে:
- আল্লাহর লা‘নত: তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে তাদের চিরতরে বঞ্চিত করা।
- ফেরেশতাগণের লা‘নত: ফেরেশতাগণ তাদের জন্য অভিসম্পাত ও শাস্তি প্রার্থনা করেন।
- সকল মানুষের লা‘নত: আখেরাতে সমস্ত মানুষ তাদের প্রতি ঘৃণা ও অভিসম্পাত জানাবে। কেউ কেউ এর দ্বারা মুমিনদেরকে বুঝিয়েছেন, যারা তাদের কুফরির জন্য লা‘নত করে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাওবার সুযোগ থাকলেও, কুফরির উপর অটল থাকলে সেই সুযোগ চিরতরে শেষ হয়ে যায়।
- যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়, তারা আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা ও সমস্ত সৃষ্টিকুলের অভিসম্পাতের শিকার হয়।
- এটি পূর্ববর্তী আয়াতের বিপরীতে একটি সতর্কবাণী—অর্থাৎ, যদি কেউ জীবনের শেষ মুহূর্তেও তাওবা না করে তবে তার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
মূল শিক্ষা:
- কুফরি বা সত্য গোপন করার মতো গুনাহ থেকে দ্রুত **তাওবা** করা আবশ্যক।
- এই আয়াতের মূল বার্তা হলো **ঈমানের উপর অটল থাকা** এবং কুফরি বা পাপের উপর অটল থেকে মৃত্যুবরণ না করা।
- আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকা বা লা‘নতগ্রস্ত হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক থাকা।
- আল্লাহর পথে না এসে কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্য পরকালে চিরস্থায়ী ও অসহনীয় শাস্তি নির্ধারিত।
- শাস্তি একবার শুরু হলে লাঘব বা অবকাশ— কোনোটিই পাওয়া যাবে না।
- তাই দুনিয়ার জীবনেই ঈমান এনে, সত্য গ্রহণ করে এবং সংশোধিত হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে আসা অপরিহার্য।
এই আয়াতে আল্লাহর একত্ব স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি আর-রাহমান — যিনি দুনিয়ার সব সৃষ্টির জন্য রহমতের আধার এবং আর-রাহীম — যিনি মুমিনদের জন্য আখেরাতে বিশেষ রহমত বর্ষণ করবেন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- তাওহীদ ইসলামের মূলভিত্তি।
- শির্ক থেকে বাঁচা ও একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা আবশ্যক।
- আল্লাহর রহমত সর্বজনীন এবং বিশেষভাবে মুমিনদের জন্য আরও পরিপূর্ণ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির নিদর্শনগুলোর দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসমান-জমিনের বিশালতা, দিন-রাতের আবর্তন, সমুদ্রে নৌযানের চলাচল, বৃষ্টির মাধ্যমে মৃত জমিনের পুনর্জীবন, জীবজন্তুর বিস্তার, বাতাসের দিক পরিবর্তন এবং আকাশের মেঘমালা — এসবই আল্লাহর একত্ব, ক্ষমতা ও হিকমতের স্পষ্ট প্রমাণ।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- প্রকৃতি ও বিশ্বজগতের প্রতিটি ঘটনা আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের প্রমাণ বহন করে।
- মানুষকে এসব দেখে চিন্তা ও বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে।
- আল্লাহর নিদর্শনগুলো নিয়ে চিন্তা করা ইমান বৃদ্ধির মাধ্যম।
এই আয়াতে শির্কের ভয়াবহতা ও মুমিনদের আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার উৎকৃষ্ট অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে। কাফিররা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্য বানিয়ে তাদের প্রতি আল্লাহর মতো ভালোবাসা দেখায়। অথচ মুমিনরা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় অনেক বেশি দৃঢ়। আখিরাতে যখন জালেমরা শাস্তি দেখবে তখন বুঝতে পারবে যে আসল শক্তি একমাত্র আল্লাহর হাতে এবং তাঁর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে সমকক্ষ মনে করা শির্ক এবং বড় গুনাহ।
- মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলো — তারা আল্লাহকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে।
- আল্লাহর শক্তি ও শাস্তির বাস্তবতা আখিরাতে সবাই অনুধাবন করবে।
আখিরাতে কাফির নেতারা ও যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করেছে তারা তাদের অনুসারীদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবে। অর্থাৎ, দুনিয়ায় যাদেরকে মানুষ ভরসা করেছিল, যাদের কথা মেনে চলেছিল, তারা তখন কোনো সাহায্য করবে না। শাস্তি দেখে উভয় পক্ষ পরস্পরকে দায়ী করবে এবং তাদের পারস্পরিক সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
বর্তমান উদাহরণ:
- আজকের যুগে অনেক মানুষ **রাজনৈতিক নেতা, সেলিব্রিটি, ভুয়া আলেম, ভন্ড পীর, বা ক্ষমতাবানদের অন্ধভাবে অনুসরণ** করে। আখিরাতে এরা বলবে: “আমরা দায়ী নই, তোমরাই ভুল করেছ।”
- যেমন: কেউ যদি নাস্তিক চিন্তাবিদ, ভ্রান্ত মতবাদী বা দুর্নীতিবাজ নেতাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে — কিয়ামতের দিন তারা আর অনুসারীদের চিনবেই না।
- আজকে সোশ্যাল মিডিয়াতেও মানুষ প্রভাবশালীদের অন্ধভক্ত হয়ে ভুল পথে যায়, অথচ আখিরাতে তারা অনুসারীদের কোনো উপকার করতে পারবে না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা যাচাই করে চলা জরুরি।
- নেতা বা প্রভাবশালী কেউ আখিরাতে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না।
- সঠিক নেতৃত্ব ও সত্যকে মেনে চলা ছাড়া মুক্তি নেই।
আখিরাতে অনুসারীরা অনুতপ্ত হয়ে বলবে, যদি আবার দুনিয়ায় ফেরার সুযোগ পেত তবে তারা তাদের ভ্রান্ত নেতাদের অমান্য করত এবং সম্পর্ক ছিন্ন করত। কিন্তু তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাদের আমলগুলো তাদের চোখের সামনে হাজির করা হবে — যা হবে গভীর অনুশোচনার কারণ। কিন্তু তারা জাহান্নাম থেকে কখনো মুক্তি পাবে না।
আজকের যুগের উদাহরণ:
- অনেকে আজ **রাজনীতিবিদ, সেলিব্রিটি, ভ্রান্ত মতবাদী বা ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠীকে** অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। আখিরাতে তারা বলবে: “হায়! যদি আবার সুযোগ পেতাম, তবে তাদের আর মানতাম না।”
- যেমন: কেউ ভুয়া প্রভাবশালী আলেম, ধর্মবিরোধী চিন্তাবিদ বা ভোগবাদী সংস্কৃতির দাস হয়ে জীবন কাটায় — কিয়ামতের দিন তারা শুধু আফসোস করবে, কিন্তু মুক্তি পাবে না।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- দুনিয়াতে কাকে অনুসরণ করছি তা ভালোভাবে যাচাই করতে হবে।
- কোনো মানুষ, নেতা বা প্রভাবশালী আখিরাতে সাহায্য করতে পারবে না।
- সত্যের পথে ফিরতে হলে সুযোগ শুধু দুনিয়াতেই আছে, আখিরাতে শুধু আফসোসই বাকি থাকবে।
এখানে আল্লাহ মানুষকে হালাল ও পবিত্র রিজিক ভক্ষণ করতে বলেছেন এবং শয়তানের প্ররোচনায় হারাম ও অপবিত্র জিনিসের দিকে না যেতে সতর্ক করেছেন।
আজকের উদাহরণ:
- হালাল উপার্জন ত্যাগ করে ঘুষ, সুদ বা জালিয়াতির পথে যাওয়া।
- অপবিত্র খাবার ও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা।
- ফাস্টফুড ও ক্ষতিকর জিনিসে আসক্ত হয়ে হালাল ও স্বাস্থ্যকর খাবার অবহেলা করা।
- হালাল রিজিক ভক্ষণ করা ফরয, হারাম ও অপবিত্র জিনিস থেকে বাঁচা আবশ্যক।
- শয়তান মানুষের শত্রু — তার প্ররোচনার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
শয়তানের মূল কাজ হলো মানুষকে মন্দ কাজ, অশ্লীলতা ও কুসংস্কারে লিপ্ত করা এবং আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতে প্রলুব্ধ করা।
আজকের উদাহরণ:
- অশ্লীল গান, সিনেমা ও ইন্টারনেট কন্টেন্টের দিকে আকৃষ্ট করা।
- অশ্লীল পোশাক-সংস্কৃতি প্রচলন।
- আল্লাহ ও ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত মতবাদ বা গুজব ছড়ানো।
- শয়তান কখনো ভালো কিছুর দিকে আহ্বান করে না।
- মন্দ, অশ্লীলতা ও আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞতাপূর্ণ কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ এখানে অন্ধ অনুকরণকে নিন্দা করেছেন। অনেক লোক সত্যকে অমান্য করে কেবল তাদের পূর্বপুরুষদের রীতি-নীতি অনুসরণ করে, যদিও তা ভ্রান্ত।
আজকের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ কুরআন-সুন্নাহর বদলে কুসংস্কার, লোকাচার, বাপ-দাদার প্রথা আঁকড়ে ধরে আছে।
- ধর্মীয় বিষয়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস, যেমন: কবরে সিজদা করা, তাবিজ-কবচে বিশ্বাস করা ইত্যাদি।
- শিক্ষা বা সামাজিক ক্ষেত্রে অন্ধভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অনুসরণ করা।
- অন্ধভাবে কারো অনুকরণ করা উচিত নয়; বরং সত্য যাচাই করা জরুরি।
- আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ-ই একমাত্র অনুসরণযোগ্য।
কাফিররা সত্যের আহ্বান শুনে কিন্তু তা হৃদয়ে গ্রহণ করে না। যেমন পশু রাখালের ডাক শুনে কেবল শব্দ বোঝে, কিন্তু তার অর্থ বুঝে না। এরা বধির, মূক ও অন্ধ — কারণ তারা সত্যের প্রতি নিজেদের ইচ্ছাকৃতভাবে অজ্ঞ করে রেখেছে। শিক্ষণীয় বিষয়:
- যারা সত্যের প্রতি অন্ধ, তারা জ্ঞান থাকলেও উপকৃত হয় না।
- হৃদয় যদি সঠিক পথে না থাকে, চোখ-কান কাজের হয় না।
মুমিনদের জন্য আল্লাহর বিধান হলো হালাল ও পবিত্র জিনিস খাওয়া এবং তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা। কেবল আল্লাহর ইবাদত মানে হলো তাঁর দেওয়া রিজিককে হালাল উপায়ে গ্রহণ করা।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- হালাল রিজিক খাওয়া ইবাদতের অংশ।
- আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ঈমানের মূল শর্ত।
এই আয়াতে আল্লাহ চারটি জিনিস স্পষ্টভাবে হারাম করেছেন: ১) মৃত পশু (যবাই ছাড়া মারা যাওয়া), ২) রক্ত, ৩) শূকরের মাংস, ৪) যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয় (যেমন মূর্তি, কবরে বা দেবতার নামে কোরবানি করা)। এখানে “আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ” সরাসরি **শির্ক**। শির্ক হলো — আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনায় অন্য কাউকে শরিক করা। ইসলামে শির্ক সবচেয়ে বড় গুনাহ, যা ক্ষমার অযোগ্য যদি কেউ তাওবা ছাড়া মারা যায়। আজকের যুগের শির্কের উদাহরণ:
- কোনো পীর, সাধু বা কবরের নামে পশু জবাই করা।
- ভক্তি দেখিয়ে কোনো মানুষকে বা নেতাকে উপাসনার স্তরে উন্নীত করা।
- তাবিজ-কবচ, জ্যোতিষ বা ভুয়া আধ্যাত্মিকতার নামে দোয়া-দরুদকে বাদ দিয়ে অন্যের ওপর নির্ভর করা।
- ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে মানত বা উৎসর্গ করা।
- হারাম খাবার ও শির্ক উভয়ই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- শুধু চরম বিপদের সময় অল্প পরিমাণ হারাম গ্রহণের অনুমতি আছে, কিন্তু শির্কের অনুমতি কখনো নেই।
- শির্ক থেকে দূরে থাকা ঈমানের মূল শর্ত।
এখানে ইহুদী ও নাসারাদের মতো লোকদের বর্ণনা করা হয়েছে যারা আল্লাহর কিতাবের সত্যকে গোপন করে ব্যক্তিগত স্বার্থে বিক্রি করত। এরূপ কাজকারীরা আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হবে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাব গোপন বা বিকৃত করা মহাপাপ।
- সামান্য দুনিয়ার লোভে আল্লাহর হেদায়াত বিক্রি করা মানেই আগুন খাওয়া।
যারা আল্লাহর নির্দেশ গোপন বা বিকৃত করে তারা হেদায়াতের বদলে ভ্রষ্টতা এবং ক্ষমার বদলে আযাবকে বেছে নিয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের জাহান্নামের জন্য ধিক্কার দিয়েছেন।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- সত্য গোপন করা মানে হলো হেদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহি কেনা।
- আল্লাহর আয়াত বিকৃত বা অস্বীকারকারীরা আখিরাতে ক্ষমার পরিবর্তে আযাব পাবে।
আল্লাহর কিতাব সত্য ও সঠিক পথে দিকনির্দেশক। কিন্তু যারা কিতাবের বিষয়ে মতভেদ করে ও বিভেদ সৃষ্টি করে, তারা প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে সরে যায়।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাব সর্বদা সত্য, তাতে কোনো ভ্রান্তি নেই।
- মতভেদ সৃষ্টি করা মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- আল্লাহর কিতাব মানতে হবে পুরোপুরি, আংশিকভাবে নয়।
এই আয়াতকে “আয়াতুল বির্র” বলা হয়। এখানে আল্লাহ প্রকৃত সৎকর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন। কেবল কিবলা ঘুরানো বা বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ঈমান, দান-খয়রাত, নামাজ, যাকাত, প্রতিশ্রুতি পালন এবং ধৈর্যই প্রকৃত সৎকর্ম।
মূল শিক্ষাগুলো:
- সৎকর্ম মানে হলো ঈমান + সৎ আমল — কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়।
- আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব, নবীদের প্রতি ঈমান রাখা বাধ্যতামূলক।
- সত্যিকার ভালোবাসা তখনই প্রমাণিত হয় যখন মানুষ নিজের প্রিয় সম্পদ দান করে।
- সামাজিক ন্যায়বিচার (এতিম, মিসকিন, মুসাফির, দাসমুক্তি ইত্যাদি) ইসলামি শিক্ষার অংশ।
- কষ্ট ও বিপদের সময় ধৈর্য ধারণ করা মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য।
- কেউ কেবল নামাজ পড়ে কিন্তু অন্যের হক মারে — সে পূর্ণ সৎকর্মকারী নয়।
- সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া ঈমান অসম্পূর্ণ। যেমন: এতিম/দরিদ্রের অধিকার রক্ষা।
- আজকের যুগে প্রকৃত বির্র মানে হলো — সৎভাবে উপার্জন, যাকাত দেওয়া, সমাজের দুর্বল শ্রেণির পাশে দাঁড়ানো, এবং সংকটকালে ধৈর্যধারণ।
কিসাস হলো হত্যা বা আঘাতের সমপরিমাণ প্রতিশোধ। তবে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের সুযোগও রাখা হয়েছে। এটি আল্লাহর রহমত, কারণ আগের উম্মতে শুধুই প্রতিশোধ ছিল।
উদাহরণ:
- হত্যা-আঘাতের মামলায় প্রতিশোধের সুযোগ যেমন আছে, তেমনি দিয়া (ক্ষতিপূরণ) বা ক্ষমাও অনুমোদিত।
- এতে প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার ও ক্ষমার দিকেই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
কিসাস মানে জীবন ধ্বংস নয়, বরং জীবন রক্ষা। কারণ প্রতিশোধের ভয়ে হত্যাকারীরা অপরাধ থেকে বিরত থাকে। ফলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
উদাহরণ:
- যদি হত্যার শাস্তি কঠোর হয়, তবে মানুষ হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকে।
- আজকের আইনেও মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
এ আয়াতে অসিয়তের (will/testament) বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের শুরুর সময়ে অসিয়ত করা ফরজ ছিল। পরে উত্তরাধিকার (মীরاث) সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর এর অনেকাংশ রহিত হয়েছে, তবে কিছু বিধান এখনো প্রযোজ্য।
- অসিয়ত: মৃত্যুর আগে সম্পদ থেকে কিছু অংশ নিকটাত্মীয় বা অন্যদের জন্য وصية করা বৈধ।
- মা-বাবা ও আত্মীয়: শুরুতে তাদের জন্য অসিয়ত করা হতো, পরে মীরاثের বিধান দ্বারা তা নির্ধারিত হয়ে যায়।
- মুত্তাকীদের কর্তব্য: ন্যায় ও সত্য বজায় রেখে অসিয়ত করা মুত্তাকীদের দায়িত্ব।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ মৃত্যুর আগে وصية (উইল) লিখে যায়, যাতে নিজের পরবর্তী সম্পদ বণ্টন ও দান-সদকা নির্ধারণ থাকে।
- ইসলামিক শরীয়তে উত্তরাধিকারীদের জন্য নির্ধারিত অংশ পরিবর্তন করা যাবে না, তবে অন্য আত্মীয় বা দান-সদকার জন্য وصية করা যাবে।
- এতে পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ এড়ানো যায় এবং মৃত ব্যক্তির ইচ্ছা পূর্ণ হয়।
মূল শিক্ষা:
- অসিয়ত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী শিক্ষা।
- সম্পদের বণ্টনে ন্যায় ও সুবিচার বজায় রাখতে হবে।
- মুত্তাকীরা সব সময় ভবিষ্যতের প্রস্তুতি রাখে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মৃত্যুর আগে হালালভাবে وصية লেখা উচিত।
- অসিয়তে নির্ধারিত উত্তরাধিকারীর হক ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।
- আল্লাহভীরু মানুষ সর্বদা ন্যায় ও সৎপথ অবলম্বন করে।
মৃত্যুর পর কারো উইলকে পরিবর্তন করা হারাম। এর দায়ভার শুধু পরিবর্তনকারীদের ওপর বর্তাবে।
উদাহরণ:
- অনেকে উইল লিখে গেলেও উত্তরাধিকারীরা বদলে দেয় — এটি গুনাহের কাজ।
- উইল সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিকভাবে মানা ফরজ।
যদি উইলে অন্যায় দেখা যায়, তবে তা সংশোধন করার অনুমতি আছে। এতে গুনাহ নেই, বরং এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
উদাহরণ:
- কেউ উইল লিখে কিন্তু কোনো উত্তরাধিকারীর প্রতি অবিচার করে, তখন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে।
- এতে সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ আয়াতে মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ হওয়ার ঘোষণা এসেছে। রোজা কেবল ক্ষুধার কষ্ট নয়; বরং আত্মসংযম, আল্লাহভীতি ও তাকওয়া অর্জনের জন্য ফরজ করা হয়েছে। আগের উম্মতদের ওপরও বিভিন্ন রকম রোজা ফরজ ছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- রোজা কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তাকওয়া অর্জনের মাধ্যম।
- রোজা শুধু খাদ্য-পানীয় থেকে বিরত থাকা নয়; বরং পাপ থেকে বিরত থাকা এবং নফস নিয়ন্ত্রণ করা।
- আগের উম্মতের মতো মুসলমানদের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছে — এটি আল্লাহর চিরন্তন শিক্ষা।
- রোজা মানুষের আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও আল্লাহভীতির চর্চা করায়।
- রোজা সামাজিক সমবেদনা শেখায় — ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া জাগ্রত হয়।
- রোজা মানে শুধু সারাদিন না খেয়ে থাকা নয় — বরং গিবত, মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদি থেকেও বিরত থাকা।
- যারা রোজাকে কেবল সংস্কৃতি বা স্বাস্থ্যচর্চা মনে করে, তারা মূল উদ্দেশ্য (তাকওয়া) হারিয়ে ফেলে।
- আজকের ব্যস্ত জীবনে রোজা আমাদের **আধ্যাত্মিক রিসেট** হিসেবে কাজ করে।
- প্রথমে রোজা কয়েক দিনের জন্য ফরজ করা হয়, পরে তা রমজানের সাথে নির্দিষ্ট হয়।
- অসুস্থ ও মুসাফির রোজা রেখে পরে কাযা করতে পারবে।
- প্রথমে রোজা রাখার পরিবর্তে ফিদিয়া দেওয়ার সুযোগ ছিল, পরে তা নাসিখ হয়ে যায় (বাতিল হয়), শুধু বৃদ্ধ ও স্থায়ী রোগীদের জন্য ফিদিয়া রাখার বিধান রইল।
এই আয়াতে রমজানের মাহাত্ম্য এবং রোজার ফরজ হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
- রমজান মাস: এটি ইসলামের বিশেষ মাস। এই মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, তাই রমজানকে “কুরআনের মাস” বলা হয়।
- কুরআন: কুরআন হলো মানুষের জন্য হেদায়াত, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ধারক (ফুরকান)।
- রোজা ফরজ: যারা রমজান মাস পাবে এবং সুস্থ থাকবে, তাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ।
- অসুস্থ ও মুসাফিরের ছাড়: তারা পরে কাযা করবে।
- সহজীকরণ: আল্লাহ চাইলেন দীন সহজ হোক, কষ্ট না হোক।
- ইবাদতের উদ্দেশ্য: রোজার দিন পূর্ণ করা, আল্লাহর তাকবীর বলা (ঈদুল ফিতরে তাকবীর), এবং কৃতজ্ঞ হওয়া।
- রমজান মাস কুরআনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। তাই রমজানে কুরআন বেশি বেশি পড়া ও বোঝা জরুরি।
- রোজার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন ও কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া।
- ইসলাম সহজের ধর্ম, কষ্টের নয়। অসুস্থ ও মুসাফিরদের জন্য ছাড় রয়েছে।
- ঈদের তাকবীর (আল্লাহু আকবার বলা) এই আয়াতের নির্দেশ থেকে এসেছে।
- কৃতজ্ঞতা ইসলামি জীবনের মূল ভিত্তি — রমজানের শেষে বান্দা যেন শোকর আদায় করে।
- রমজান শুধু রোজার মাস নয়, বরং কুরআন চর্চার মাস। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত রমজানে কুরআন পড়া, বোঝা ও জীবনে প্রয়োগ করা।
- যারা অসুস্থ বা সফরে থাকে তারা দীনকে কষ্টের বোঝা মনে না করে সহজভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে।
- রমজান শেষে ঈদের আনন্দ হলো কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। এটি শুধুই উৎসব নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া হেদায়াতের জন্য শোকর আদায়।
- এই আয়াতটি রোজার হুকুমের মাঝেই এসেছে, যা প্রমাণ করে রোজা ও দোয়ার মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে।
- আল্লাহ বান্দাকে খুব কাছে আছেন — তিনি দোয়া শোনেন, সাড়া দেন।
- দোয়া কবুল হওয়ার জন্য শর্ত হলো: বান্দা যেন আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয় (আদেশ মানে) এবং দৃঢ় ঈমান রাখে।
- এখানে আল্লাহ বান্দাকে আশ্বস্ত করেছেন যে তাঁর দোয়া বৃথা যায় না।
- আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্ক সরাসরি — আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে কোনো মাধ্যম প্রয়োজন নেই।
- দোয়া আল্লাহর ইবাদতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপ।
- রোজাদারের দোয়া বিশেষভাবে কবুল হয়।
- কেবল দোয়া করলেই হবে না; আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর প্রতি ঈমানও জরুরি।
- দোয়া হলো আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তি। আজকের এই ব্যস্ত জীবনে আমরা অনেক সময় সমস্যায় দিশেহারা হয়ে যাই, তখন আল্লাহর সাথে দোয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক মজবুত করা উচিত।
- রোজার সময় বিশেষভাবে দোয়া করা উচিত — ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, সমাজ ও উম্মাহর কল্যাণের জন্য।
- কেবল সমস্যায় পড়লেই নয়, বরং প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দোয়া করা ঈমানের পরিপূর্ণতার লক্ষণ।
- রমজানের রাতগুলোতে স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক রাখা বৈধ করা হলো।
- খাওয়া-দাওয়া ও বৈবাহিক সম্পর্কের সময়সীমা হলো ইফতার থেকে ফজরের সূচনা পর্যন্ত।
- স্ত্রী-স্বামী একে অপরের পরিপূর্ণ সহযোগী ও আচ্ছাদন (লিবাস) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
- ইতিকাফের সময় যৌন সম্পর্ক হারাম।
- আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করা যাবে না।
- রমজানের উদ্দেশ্য শুধু না খাওয়া নয়; বরং তাকওয়া অর্জন করা।
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ইসলাম স্বাভাবিকভাবে বৈধ করেছে, তবে সময় ও অবস্থার সীমা রেখেছে।
- ইতিকাফ হলো রমজানের শেষ দশকে একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার এক মহান আমল।
- অন্যায়ভাবে সম্পদ ভোগ মানে — চুরি, ডাকাতি, সুদ, প্রতারণা, জুয়া, ঘুষ, অন্যের হক নষ্ট করা ইত্যাদি।
- ঘুষ দিয়ে বিচারক বা শাসকের মাধ্যমে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা সবচেয়ে বড় গুনাহ।
- আল্লাহ বলেন: এটি জেনেশুনেই করা হয়, তাই এর শাস্তি গুরুতর।
- ইসলামে সম্পদ রক্ষা করা ইমানের অংশ — হালাল ও হারামের পার্থক্য করা ফরজ।
- অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
- ঘুষ শুধু ব্যক্তিগত পাপ নয়, এটি সমাজ ধ্বংসের মূল কারণ।
- একজন মুসলিমের উচিত হালাল উপার্জনে সন্তুষ্ট থাকা।
- বিচার ব্যবস্থায় অন্যায় রায় বের করতে অর্থ ব্যবহার করা হারাম।
- আজকের সমাজে দুর্নীতি, ঘুষ, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অন্যের হক খেয়ে ফেলা এই আয়াতের সরাসরি লঙ্ঘন।
- সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য ঘুষ, টেন্ডারবাজি, আদালতে ঘুষ দিয়ে অন্যায় রায় আদায় করা — এগুলো সবই এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে।
- একজন প্রকৃত মুমিন সবসময় হালাল পথে উপার্জন করবে, এবং অন্যের অধিকার নষ্ট করবে না।
- আরবরা জানতে চাইত: চাঁদ ছোট-বড় কেন হয়? উত্তরে বলা হলো: চাঁদ হলো মানুষের জন্য সময় গণনার মাধ্যম (রোজা, ঈদ, হজ, ইদ্দত ইত্যাদির সময় নির্ধারণ)।
- নেক কাজ কোনো অদ্ভুত রীতি নয়; বরং প্রকৃত নেক কাজ হলো তাকওয়া অর্জন।
- জাহেলি যুগে তারা মনে করত ইহরামের সময় ঘরে প্রবেশ করলে পিছনের দেয়াল টপকে ঢুকতে হবে। আল্লাহ এ প্রথা বাতিল করে বললেন: “দরজা দিয়ে প্রবেশ করো” — অর্থাৎ সরল ও সঠিক পথ অনুসরণ করো।
- চাঁদ দেখে ইসলামি মাস গণনা করা ফরজ — ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে চাঁদকে মূল ধরা হয়েছে।
- ইসলাম কুসংস্কার ও অদ্ভুত প্রথা বাতিল করেছে।
- প্রকৃত নেক কাজ হলো আল্লাহর ভয় (তাকওয়া), বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান নয়।
- সত্য ও সরল পথেই সফলতা নিহিত।
- রমজান, ঈদ, হজসহ সব ইসলামি ইবাদতের সময় নির্ধারণ চাঁদ দেখে করা উচিত।
- আজকের সমাজেও অনেক কুসংস্কার চালু আছে (যেমন: বাড়িতে নতুন প্রবেশের অযৌক্তিক রীতি)। ইসলাম এসব বাতিল করেছে।
- ইসলামে বাহ্যিক প্রদর্শন নয়, বরং অভ্যন্তরীণ তাকওয়া এবং আল্লাহভীতি আসল নেক কাজ।
- ইসলামে যুদ্ধ শুধুমাত্র আত্মরক্ষা ও আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য বৈধ।
- যারা মুসলিমদের আক্রমণ করবে, তাদের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি আছে।
- কোনো অবস্থাতেই সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। যেমন: শিশু, নারী, বৃদ্ধ, সাধু, কৃষক বা নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হারাম।
- সম্পদ লুট, অযথা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো, প্রতিশোধে অতিরিক্ত শত্রুতা করা সবই নিষিদ্ধ।
- মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের মক্কা থেকে বের করে দিয়েছিল; তাই মুসলিমদেরকেও তাদের বের করে দিতে বলা হয়েছে।
- “ফিতনা হত্যা অপেক্ষা কঠিন”— এখানে ফিতনা বলতে বোঝানো হয়েছে: শির্ক, মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও আল্লাহর পথে বাধা দেওয়া।
- মসজিদুল হারামের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে; সেখানে যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। তবে যদি তারা সেখানে আক্রমণ চালায়, তখন মুসলিমরা প্রতিরোধ করতে পারবে।
- এটি ইসলামে যুদ্ধের ন্যায়সঙ্গত সীমারেখা নির্ধারণ করেছে।
- ইসলামে যুদ্ধ শুধুমাত্র আত্মরক্ষামূলক, আগ্রাসনমূলক নয়।
- শত্রু যেখানে থাকবে, সেখানে মুসলিমরা প্রতিরোধ করবে।
- ফিতনা (শির্ক, ধর্মীয় নির্যাতন, আল্লাহর পথে বাধা) সবচেয়ে বড় অপরাধ।
- পবিত্র স্থানগুলোর সম্মান রক্ষা করতে হবে, তবে সেখানে আক্রমণ হলে প্রতিরোধ বৈধ।
- যুদ্ধকে ইসলাম কখনোই আগ্রাসন হিসেবে বৈধ করেনি; বরং ন্যায়বিচার রক্ষার জন্যই অনুমতি দিয়েছে।
- আজকের বিশ্বে অন্যায় নির্যাতন, ধর্মীয় স্বাধীনতায় বাধা, মুসলিম নিপীড়ন — এগুলো “ফিতনা”র অন্তর্ভুক্ত।
- সুতরাং মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হলো ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো, তবে সীমালঙ্ঘন না করা।
এটি ১৯০ ও ১৯১ সংখ্যক আয়াতের ধারাবাহিক নির্দেশের ধারায় এসেছে—যুদ্ধ ও প্রতিরোধের বিধান শেষে আল্লাহ নিশ্চিত করলেন যে যদি শত্রুরা আততায়িতা বা নির্যাতন বন্ধ করে এবং শান্তি চায়, তবে মুসলিমদেরও যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আল্লাহ ক্ষমাশীল; অতীতের দ্বেষ-শত্রুতা মুছিয়ে দিলে ক্ষমা ও পুনর্মিলন সম্ভব।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- বিরত থাকা (তারব্বু) ও শান্তি গ্রহণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
- যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য শাসন বা অধিকার নয়—বরং ফিতনার অবসান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল — প্রতিপক্ষ যদি সৎভাবে বিরত থাকে, ক্ষমা ও পুনর্মিলন সম্ভব।
- যদি কোনো সংঘাত বা বিরোধে বিরাম দেয়া হয় (আলোচনা/আত্মসমর্পণ/চুক্তি), তখন ঐ চুক্তি মেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই সঠিক।
- রাষ্ট্রদ্বন্দ্ব বা গোষ্ঠীগত হিংসা বন্ধ করলে সংশোধনের সুযোগ ও পুনর্গঠন সম্ভব।
এখানে নির্দেশ পরিষ্কার: যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো ফিতনা (শির্ক, কুরুশ কিদারী, ধর্মীয় দমন) নির্মূল করে মানুষের জন্য মুক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা—তাতে সকলেই ধর্ম অবলম্বনে স্বাধীন হয় এবং সৎ আচরণ করতে পারে। যখন ফিতনা (অর্থাৎ ধর্মীয় নিপীড়ন বা বাধা) আর থাকবে না, তখন যুদ্ধ চলবে না; কিন্তু যারা অবিচার ও দমন চালায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত থাকা বৈধ। অর্থাৎ যুদ্ধকে সীমিত, ন্যায়সঙ্গত ও উদ্দেশ্যভিত্তিক রাখা হয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয়:
- যুদ্ধের উদ্দেশ্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও ফিতনা নির্মূল—অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবতার রক্ষা।
- যুদ্ধ যখনই শর্তহীনভাবে চালানো হয়, তখন তা বৈধ হয় না; সীমাবদ্ধতা ও নৈতিকতা মেনে চলতে হবে।
- যদি প্রতিপক্ষ শান্তি চায় ও দমন বন্ধ করে, তখন শান্তি গ্রহণ ও সংঘাত বন্ধ করাই সঠিক পথ।
- শুধু প্রতিরক্ষা ও অবৈধ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিহত করা ইসলামে বৈধ।
- যদি কোনো রাষ্ট্র বা বিদ্বেষপূর্ণ গোষ্ঠী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার করে, তখন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রতিরোধ—কিন্তু সীমাবদ্ধ ও ন্যায়সংগতভাবে—বৈধ হতে পারে।
- যখন অভিযুক্ত পক্ষ নির্যাতন বিরত করে এবং মানবাধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়, তখন সংঘাত সমাধান করে পুনর্মিলন করা উচিত।
- “আশ-শাহরুল হারাম” — হারাম মাস (মহররম, রজব, যিলকদ, যিলহজ্জ) যেখানে যুদ্ধ ও রক্তপাত সাধারণত নিষিদ্ধ।
- কিন্তু যদি শত্রু হারাম মাসে মুসলিমদের আক্রমণ করে, তবে মুসলিমরাও প্রতিরোধ করতে পারবে।
- “ওাল্-হুরুমা-তু কিস্বা-ছ” — সম্মানজনক বিষয়গুলো (যেমন: হারাম মাস, মসজিদুল হারাম, কাবা) এর প্রতি সম্মানও সমানভাবে রক্ষা করতে হবে।
- আত্মরক্ষা ও প্রতিশোধ বৈধ, তবে তা সীমার বাইরে যাবে না।
- শেষে বলা হয়েছে: তাকওয়া বজায় রেখে ন্যায়বিচার করতে হবে; অতিরিক্ত প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না।
- ইসলামে প্রতিশোধ বৈধ হলেও, তা সমপরিমাণ হতে হবে — অতিরিক্ত অন্যায় করা যাবে না।
- পবিত্র মাসগুলির সম্মান রক্ষা করা ফরজ; তবে শত্রু আক্রমণ করলে আত্মরক্ষা বৈধ।
- ন্যায়বিচার ও তাকওয়া বজায় রেখে যুদ্ধ করতে হবে।
- আল্লাহ সর্বদা তাকওয়াবানদের সাথে আছেন — বিজয় তাকওয়ার ওপর নির্ভরশীল।
- আজকের সমাজে অন্যায় হলে তার ন্যায্য প্রতিরোধ করতে হবে; কিন্তু সীমালঙ্ঘন করা যাবে না।
- যে কোনো সংঘর্ষে “ন্যায়সংগত প্রতিক্রিয়া” — ইসলামের মূলনীতি।
- যুদ্ধ, রাজনীতি বা সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবশ্যই তাকওয়া বজায় রাখতে হবে, যাতে অন্যায়কারী হয়ে না দাঁড়ায়।
- আল্লাহ মুসলমানদেরকে দান-সদকা ও জিহাদের পথে ব্যয় করতে উৎসাহ দিয়েছেন।
- “ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না” — অর্থাৎ কৃপণতা বা অপব্যয় উভয়ই ধ্বংস ডেকে আনে।
- প্রতিটি কাজ এহসান (সুন্দরভাবে করা) জরুরি, কারণ আল্লাহ মু’হসিনীন (সৎকর্মশীলদের) ভালোবাসেন।
তিনি বলেন: আমরা রোম সাম্রাজ্যের এক শহরে অবস্থান করছিলাম। তখন রোমের এক বিশাল বাহিনী আমাদের মোকাবিলায় এলো এবং মুসলিমদের পক্ষ থেকেও একই রকম বা আরও বড় একটি বাহিনী এগিয়ে গেল। সেনাপতি ছিলেন ফাযালাহ ইবনু উবাইদ (রাযিঃ)।
এক মুসলিম সৈনিক শত্রুদের দিকে প্রবল আক্রমণ করেন। মুসলিমরা বলল: “সুবহানাল্লাহ! লোকটি নিজেকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেছে।” তখন আবূ আয়ুব আল-আনসারী (রাযিঃ) বললেন: “তোমরা আয়াতটির ভুল ব্যাখ্যা করছ। এ আয়াত আমাদের — আনসারদের বিষয়ে নাজিল হয়েছে।”
তিনি বলেন: ইসলাম বিজয়ী হওয়ার পর আনসারদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বলল — “আমাদের সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইসলাম এখন শক্তিশালী হয়েছে, সুতরাং চল আমরা ঘরে ফিরে সম্পদের দেখভাল করি।” তখনই আল্লাহ আয়াত নাজিল করলেন: “আল্লাহর পথে ব্যয় করো, আর নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।”
অর্থাৎ সম্পদ রক্ষায় জিহাদ ত্যাগ করাই আসল ধ্বংস। আবূ আয়ুব (রাযিঃ) আজীবন জিহাদে রত থাকলেন, এমনকি রোমে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই দাফন হন।(তিরমিজি-২৯৭২)
শিক্ষণীয় বিষয়:- আল্লাহর পথে দান করা ঈমানের প্রকাশ।
- কৃপণতা ও অপব্যয় দুটোই ধ্বংসের কারণ।
- জিহাদ বা আল্লাহর কাজে অবহেলা করাই প্রকৃত ধ্বংস।
- প্রতিটি কাজ সুন্দরভাবে ও ihsan সহকারে করতে হবে।
- আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।
এই আয়াতটি হজ ও উমরার বিধি ও শর্তাবলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে—বিশেষ করে তামাত্তু (উমরা করে সাধারণ পোশাকে ফিরে এসে হজ করা) সম্পর্কিত নিয়ম। মূল পয়েন্টগুলো নিচে দেওয়া হলোঃ
- অতিমাত্রায় সম্পূর্ণ করো (أَتِمُّوا): হজ ও উমরার ইবাদতগুলো আল্লাহর উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে করা উচিত — রূপ, নিয়ম ও নি্যমনিষ্ঠা বজায় রেখে।
- আত-ইহসার (أُحْصِرْتُمْ): যদি কোনো নিরাপত্তা-সমস্যা বা বাধা বা অন্য কারণবশত্ তুমি কাবা বা মক্কায় আটকে পড়ো, তখন যা ক্ষমতাভিত্তিক সহজলভ্য (استيسر) হাদী (বলিদ) দাও—অর্থাৎ অতিরিক্ত কঠোরতা নয়, সহজ ব্যবস্থায় সামাধান করা হবে।
- মুণ্ডন-নির্দেশ (لَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ...): হজের নির্দিষ্ট অবস্থা (Ihram) থেকে বের হওয়ার নিয়ম নির্দেশ করে—হাদী পৌঁছানো পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে মুণ্ডন/শেভ করা যাবে না।
- ফিদিয়া ব্যাখ্যা: অসুস্থ বা শারীরিক কারণে যাদের সরাসরি নুসুক করা সম্ভব নয়, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা—রোজা, দান বা নুসুক—রাহমতপূর্ণভাবে নির্ধারিত আছে।
- তমাত্তু ও হাদী: তামাত্তু' করলে (উমরা শেষে মিহর-স্বাধীন হয়ে সাধারণ পোশাকে থাকা) হজের সময়ে হাদী দান করার নির্দেশ আছে; আর যদি কেউ হাদী করতে না পারে বা খুঁজে না পায়, সে নির্ধারিত রোজা রাখবে (হজে ৩ দিন) এবং ফেরত এসে ৭ দিন—মোট ১০/১১/১২’র বিভিন্ন ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে কোরআন এখানে মোট ১০/১১/১২ হিসেবে সংখ্যা নির্দিষ্ট করেছে (এখানে কোরআন বলেছে "তুলিকা 'আশারা" — এগারোতে ইঙ্গিত ও বিস্তারিত ফিকহি ব্যাখ্যা আলেমদের আলোচ্য)।
- কোনদের জন্য এই বিধি: বিশেষত তাদের জন্য যারা যারা মসজিদের (হারাম) নিকটস্থ নয় এবং যারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন—তাদের ক্ষেত্রে সহজকৃত নিয়ম আছে।
- সতর্কবার্তা: শেষেই সতর্ক করা হয়েছে—আল্লাহকে ভয় করো এবং মনে রেখো আল্লাহ শাস্তিতে কঠোর। অর্থাৎ ইবাদত ও বিধি অবহেলা করলে তার ফল আছে।
মূল শিক্ষা:
- ইবাদত সম্পূর্ণ ও সঠিকভাবে করো—বিশেষত হজ ও উমরা, কারণ এগুলোের নির্দিষ্ট রীতিনীতি আছে।
- যদি বাধা আসে, শালীন ও দয়াশীল নিয়মে বিকল্প চালু আছে—আসলে শারী‘আত মানবিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সহজতা দিয়েছে।
- শারীরিক অসুস্থতা থাকলে ঈমানের সাথে কোরআন ও শয়ানে বিধান অনুসরণ করে ফিদিয়া গ্রহণীয়।
- আল্লাহর কাছে ভয় ও সালিকতার অনুভূতি রক্ষা করতে হবে—বিধিভঙ্গে শাস্তির আশঙ্কা স্মরণ করানো হয়েছে।
এ আয়াতে হজ্বের সময়কাল, হজের আদব এবং আল্লাহভীতি (তাকওয়া) সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মূল বিষয়গুলো হলোঃ
- হজ্ব নির্দিষ্ট মাসে: শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন—এই মাসগুলো হজের জন্য নির্ধারিত।
- হজ্বের আদব: হজের সময়ে অশ্লীল বাক্য, পাপাচার ও তর্ক-বিতর্ক করা নিষিদ্ধ। কারণ হজ ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মশুদ্ধি।
- সৎকর্ম: হজের সময় শুধু ইবাদত নয়, বরং সকল সৎকর্ম (দান, সাহায্য, দুআ) আল্লাহ জানেন ও গ্রহণ করেন।
- সর্বশ্রেষ্ঠ সামগ্রী: হজে যাওয়ার জন্য খাদ্য ও রসদ প্রয়োজন, তবে সবচেয়ে মূল্যবান রসদ হলো তাকওয়া।
- উলি-ল্আলবাব: হজ ও তাকওয়ার শিক্ষাটি বিশেষভাবে দেওয়া হয়েছে জ্ঞানী ও বোধসম্পন্নদের জন্য।
মূল শিক্ষা:
- হজের সময়ে পাপ ও ঝগড়া-ঝাঁটি থেকে বিরত থাকা জরুরি।
- হজের সফরে সৎকর্ম করা ও তাকওয়া অবলম্বন করা সবচেয়ে বড় পুঁজি।
- হজ শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ ইবাদত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- হজের নিয়ম-নীতি মেনে চলা ফরজ, কারণ এটি আল্লাহর হুকুম।
- তর্ক-বিতর্ক ও অশ্লীল কথা হজের বরকত নষ্ট করে দেয়।
- তাকওয়া ছাড়া কোনো ইবাদতই পূর্ণাঙ্গ হয় না।
এ আয়াতে হজের সময় জীবিকা অনুসন্ধান, আরাফাহ থেকে মুজদালিফায় যাত্রা এবং আল্লাহর স্মরণ করার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
- জীবিকা অনুসন্ধান: হজের মৌসুমে ব্যবসা-বাণিজ্য করা বৈধ। পূর্বে আরবরা মনে করত, হজের সময় ব্যবসা করলে পাপ হবে। আল্লাহ তা নাকচ করেছেন।
- আরাফাহ থেকে প্রত্যাবর্তন: ৯ জিলহজ্জে আরাফাহ থেকে মুজদালিফা যাওয়াই হলো হজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- মাশ‘আরুল হারাম: মুজদালিফাকে বলা হয় মাশ‘আরুল হারাম। এখানে মাগরিব ও এশার নামায একত্রে আদায় করতে হয় এবং রাতে যিকির-দু‘আ করতে হয়।
- আল্লাহর হিদায়াত: মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে—তারা আগে ছিল পথভ্রষ্ট, আল্লাহ তাদের হিদায়াত দিয়েছেন।
মূল শিক্ষা:
- হজের সময় বাণিজ্য করা বৈধ, যতক্ষণ না তা ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটায়।
- আরাফাহ ও মুজদালিফা হজের মূল রুকন—এখানে যিকির-দু‘আ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- আল্লাহর হিদায়াতের জন্য কৃতজ্ঞ হতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইবাদত ও দুনিয়ার জীবিকা—দুটোই আল্লাহর ইজাজতে বৈধভাবে একসাথে করা যায়।
- হজে প্রতিটি ধাপ আল্লাহর যিকির ও স্মরণের সাথে সম্পন্ন করতে হবে।
- অতীতের পথভ্রষ্টতা ভুলে না গিয়ে আল্লাহর দয়া স্মরণ করলে কৃতজ্ঞতা বাড়ে।
এ আয়াতটি হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিচ্ছে। আগে কুরাইশ ও তাদের অনুসারীরা নিজেদের উচ্চতর মনে করে আরাফাহতে অবস্থান করত না, বরং মুযদালিফা থেকে ফিরত।
- সবার সাথে সমান হওয়া: আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন—সব মুমিন যেন একইভাবে আরাফাহ থেকে প্রত্যাবর্তন করে। এতে ঐক্য ও সমতার শিক্ষা রয়েছে।
- ইস্তিগফার: হজের প্রতিটি রুকনের পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। কারণ ইবাদতের মাঝে ত্রুটি থাকতে পারে।
- আল্লাহর গুণ: তিনি গফূর (ক্ষমাশীল) ও রাহীম (দয়ালু)। তাই বান্দাদের উচিত নিয়মিত ইস্তিগফার করা।
মূল শিক্ষা:
- হজের সকল ধাপে মুসলিমদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।
- ইবাদতের সাথে সাথে ইস্তিগফার অপরিহার্য।
- আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য বিনম্রভাবে ফিরে আসতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- কোনো ইবাদতে অহংকারের স্থান নেই, সবাই সমান।
- হজের পরও সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
- আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার মূল চাবি হলো তওবা ও ইস্তিগফার।
এ আয়াতে হজ শেষে আল্লাহর যিকির ও দুআর শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আরবি সমাজে প্রচলিত ছিল—হজের পর তারা বাপ-দাদার বীরত্ব ও গৌরবের কথা বলত। ইসলাম তাদেরকে শিক্ষা দিল—এ সময় আল্লাহর যিকির ও দুআ করো।
- আল্লাহর যিকির: হজ শেষে কৃতজ্ঞতার সাথে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে।
- পুরনো প্রথার পরিবর্তন: পূর্বে আরবরা নিজেদের বংশগৌরব নিয়ে অহংকার করত; ইসলাম তা পরিবর্তন করে আল্লাহর যিকির ও দুআর নির্দেশ দিল।
- দুনিয়ামুখী দুআ: কারও কারও দুআ শুধু দুনিয়ার কল্যাণের জন্য হয়—তাদের আখিরাতে কোনো অংশ নেই।
মূল শিক্ষা:
- হজ শেষে আল্লাহকে প্রচুর স্মরণ করা জরুরি।
- বংশ-গৌরব নয়, বরং আল্লাহর মহিমা ও রহমত স্মরণ করতে হবে।
- যারা শুধু দুনিয়া চায়, তারা আখিরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইবাদতের পর আল্লাহকে যিকির করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অত্যাবশ্যক।
- মানুষের দুআতে দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই থাকতে হবে।
- যারা আখিরাত ভুলে যায়, তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত।
এ আয়াতে আল্লাহ বান্দাদের একটি পূর্ণাঙ্গ দুআ শিক্ষা দিয়েছেন, যেখানে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি—সবই অন্তর্ভুক্ত।
- দুনিয়ার কল্যাণ: সুস্বাস্থ্য, হালাল রিজিক, শান্তিপূর্ণ জীবন, সৎসঙ্গ, ঈমানের সাথে মৃত্যু ইত্যাদি।
- আখিরাতের কল্যাণ: জান্নাত লাভ, আল্লাহর সন্তুষ্টি, হাশরের নিরাপত্তা, কিয়ামতের দিন সহজ হিসাব।
- আগুন থেকে রক্ষা: সবচেয়ে বড় দুআ—জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপত্তা।
মূল শিক্ষা:
- মুমিনের দুআতে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই থাকতে হবে।
- শুধু দুনিয়ার জন্য দুআ করা পরিপূর্ণ দুআ নয়।
- সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা হলো জাহান্নাম, তাই এর থেকে বাঁচার দুআ সর্বদা করা উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- এই দুআ কুরআনের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ দুআ—মুমিনের মুখস্থ ও নিয়মিত পাঠ করা উচিত।
- জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনে আল্লাহর কাছে ফিরে আসতে হবে।
- ইবাদতের মাঝে, বিশেষত হজ, উমরা, নামাযের সিজদা, দুআর সময় এই দুআ পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ আয়াতটি পূর্বের দুআ (আয়াত ২০১) এর সাথে সম্পর্কিত। যারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের কল্যাণ কামনা করে, আল্লাহ তাদের জন্য এর প্রতিদান নির্ধারণ করেছেন।
- প্রাপ্য অংশ: মুমিনরা তাদের সৎকর্মের প্রতিদান দুনিয়া ও আখিরাতে পাবে।
- দ্রুত হিসাব: আল্লাহর হিসাবগ্রহণ মানুষের মতো ধীর নয়, তিনি মুহূর্তেই প্রতিটি বান্দার কর্মের হিসাব নেন।
- আল্লাহর ন্যায়বিচার: কেউ সামান্যতম সৎকর্মও হারাবে না।
মূল শিক্ষা:
- সৎকর্মের বিনিময় অবশ্যই মুমিনরা পাবে।
- আল্লাহর হিসাব নেয়া দ্রুত এবং নিখুঁত।
- দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা আল্লাহর কাছেই নির্ভরশীল।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুমিনের প্রতিটি সৎকর্ম আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ হয়।
- আল্লাহর ন্যায়বিচারে কোনো অন্যায়ের সুযোগ নেই।
- আখিরাতের হিসাব এত দ্রুত হবে যে মানুষ অবাক হয়ে যাবে।
এই আয়াতটি হজের শেষ অংশের বিধান বর্ণনা করছে, বিশেষত আয়্যামুত্-তাশরীক (যিলহজ্জের ১১, ১২, ১৩ তারিখ)।
- আয়্যামুত্-তাশরীক: হজের পর তিন দিন মিনায় অবস্থান করে আল্লাহর যিকির, তাকবীর, কুরবানির গোশত খাওয়া ও বিতরণ করার নির্দেশ আছে।
- দুই দিন বা তিন দিন: মিনায় কেউ যদি শুধু দুই দিন অবস্থান করে ফিরে আসে, গুনাহ নেই। আর তিন দিন থাকলেও গুনাহ নেই।
- শর্ত: তাকওয়া থাকতে হবে—অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করা এবং তাঁর বিধান মেনে চলা।
- শেষ সতর্কতা: মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত তাদের সবাইকে আল্লাহর কাছেই সমবেত হতে হবে।
মূল শিক্ষা:
- হজ শেষে আল্লাহর যিকির কয়েক দিন অব্যাহত রাখতে হবে।
- দুই দিন বা তিন দিন মিনায় অবস্থান করা উভয়ই বৈধ।
- সর্বত্র তাকওয়া হলো মূল বিষয়।
- কিয়ামতের দিন সবাইকে আল্লাহর সামনে সমবেত হতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইবাদত শেষে আল্লাহর যিকিরের গুরুত্ব কখনও হেলাফেলা করা যাবে না।
- হজ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তাকওয়ার প্রশিক্ষণ।
- মৃত্যুর পর সবাই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে—এ বিশ্বাস জীবনের প্রতিটি কাজে প্রভাব ফেলা উচিত।
এ আয়াতে আল্লাহ এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেন যারা মুখে মিষ্টি ও চমকপ্রদ কথা বলে, কিন্তু তাদের অন্তরে ভিন্ন কিছু থাকে। তারা আসলে ভণ্ড ও কপট।
- মিষ্টি কথা: এমন লোক দুনিয়ার সুন্দর কথা বলে মানুষকে আকর্ষণ করে।
- আল্লাহকে সাক্ষী করা: তারা আল্লাহর নাম নিয়ে শপথ করে, যেন বোঝায় তাদের অন্তর পরিষ্কার।
- প্রকৃত স্বভাব: বাস্তবে সে কঠোর বিরোধী, শত্রুতায় প্রবল এবং দ্বীন ও সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
- নিফাকের ইঙ্গিত: এ আয়াতটি মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করছে।
মূল শিক্ষা:
- কথা দ্বারা মানুষকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব, কিন্তু আল্লাহর কাছে কিছু গোপন নয়।
- মুনাফিকরা প্রায়শই আল্লাহর নাম নিয়ে শপথ করে নিজেদের সত্য প্রমাণ করতে চায়।
- বাহ্যিক সৌন্দর্য বা কথার মাধুর্যের পেছনে সবসময় সত্যতা নাও থাকতে পারে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মানুষের বাহ্যিক আচরণ দেখে নয়, বরং অন্তরের অবস্থা ও আমলের মাধ্যমে বিচার করা উচিত।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তাই ভণ্ডামি কোনো কাজে আসে না।
- মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো আন্তরিকতা ও সত্যবাদিতা।
এ আয়াতে মুনাফিকদের কুৎসিত চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা বাহ্যত সুন্দর কথা বললেও বাস্তবে সমাজে অশান্তি, ফিতনা ও ধ্বংস ডেকে আনে।
- ফিতনা সৃষ্টি: তারা আল্লাহর দ্বীন ও মানুষের মধ্যে বিভেদ ঘটায়।
- ফসল নষ্ট করা: সরাসরি কৃষিজ পণ্য ধ্বংস অথবা সমাজের কল্যাণকর কাজ নষ্ট করা বোঝানো হয়েছে।
- বংশধর ধ্বংস: মানুষ হত্যা, যুদ্ধ, অন্যায় শাসন ইত্যাদি যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- আল্লাহর অপছন্দ: আল্লাহ কোনো প্রকার ফাসাদ ও অন্যায়কে ভালোবাসেন না।
মূল শিক্ষা:
- মুনাফিকরা সমাজে ফাসাদ সৃষ্টি করে, যদিও তারা নিজেদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করে।
- আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—তিনি ফাসাদকে ঘৃণা করেন।
- ফসল, সম্পদ ও মানবসম্পদ নষ্ট করা বড় গুনাহ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সৎকর্মের নামে ফাসাদ ছড়ানো ভণ্ডামি।
- প্রকৃত মুমিন সমাজে শান্তি আনে, ধ্বংস নয়।
- মানুষ ও পরিবেশ ধ্বংস করা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয়।
এই আয়াতে সেই লোকদের স্বভাব বর্ণনা করা হয়েছে যারা উপদেশ গ্রহণ করে না। বরং তাদের মধ্যে অহংকার ও জিদ বাড়ে।
- উপদেশ প্রত্যাখ্যান: যখন তাকে বলা হয় ‘আল্লাহকে ভয় কর’, সে উপদেশ মানতে রাজি হয় না।
- অহংকার: গোনাহ করার পরও সে দম্ভে অটল থাকে।
- পরিণাম: এরূপ মানুষের শাস্তি হলো জাহান্নাম—যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট আবাস।
মূল শিক্ষা:
- মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো উপদেশ গ্রহণ করা ও আল্লাহকে ভয় করা।
- অহংকার ও জিদ মানুষকে সত্য থেকে বঞ্চিত করে।
- যারা উপদেশ মানে না, তাদের পরিণতি জাহান্নাম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর ভয় মনে রাখা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য।
- উপদেশকে অবজ্ঞা করা মারাত্মক গোনাহ।
- অহংকারই জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়।
এই আয়াতে এমন মুমিনদের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের জীবন, সম্পদ ও সবকিছু উৎসর্গ করে দেন।
- নিজেকে বিক্রি করা: আল্লাহর রাস্তায় নিজের জীবন, সময়, ধন-সম্পদ উৎসর্গ করা বোঝানো হয়েছে।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি: তাদের মূল উদ্দেশ্য দুনিয়ার স্বার্থ নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ।
- আল্লাহর দয়া: আল্লাহ তাঁর এমন বান্দাদের প্রতি অশেষ দয়াশীল, তাদের ত্যাগ কখনও বিফল হয় না।
মূল শিক্ষা:
- মুমিনের প্রকৃত লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
- আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করা সর্বোচ্চ ত্যাগ।
- আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের প্রতি অশেষ দয়ালু।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুমিনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ ও কুরবানি দিতে হবে।
- আল্লাহর জন্য করা কোনো ত্যাগ বৃথা যায় না।
- যারা আল্লাহর জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়, তারা প্রকৃত সফলকাম।
এ আয়াতে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন তারা অর্ধেক-অর্ধেকভাবে ইসলাম গ্রহণ না করে, বরং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দ্বীন মেনে চলে।
- পূর্ণরূপে ইসলাম: ইসলামের সব দিক—আক্বীদা, ইবাদত, আখলাক, লেনদেন—সবকিছুতে ইসলাম অনুসরণ করতে হবে।
- শয়তানের পদাঙ্ক: শয়তান ধাপে ধাপে মানুষকে বিভ্রান্ত করে; তার ছোট পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও মানুষ ধ্বংসে পৌঁছে যায়।
- প্রকাশ্য শত্রু: শয়তান আদম সন্তানদের প্রকাশ্য শত্রু; সে সর্বদা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরাতে চায়।
মূল শিক্ষা:
- আংশিক ইসলাম গ্রহণ করা নয়, বরং পুরোপুরি দ্বীন মানা জরুরি।
- শয়তানের ধোঁকা ও পদাঙ্ক থেকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
- মুমিনের প্রকৃত সফলতা পূর্ণরূপে ইসলাম মানার মধ্যেই।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামকে অনুসরণ করতে হবে।
- শয়তানের প্রলোভন ধাপে ধাপে মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
- মুমিনকে সর্বদা শয়তানকে শত্রু জেনে তার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
এ আয়াতে মুমিনদের সতর্ক করা হয়েছে— ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও কেউ যদি বিভ্রান্ত হয়, তবে তার দায় তার নিজের উপরই বর্তায়।
- বাই্যিনাত (সুস্পষ্ট প্রমাণ): কুরআন, হাদিস এবং রাসূল ﷺ এর শিক্ষা—যা সত্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে।
- পা পিছলে যাওয়া: সুস্পষ্ট সত্য জেনে শুনেও অবাধ্য হওয়া, গোনাহ করা বা শয়তানের ফাঁদে পড়া।
- আল্লাহর গুণ: আল্লাহ ‘আযীয (পরাক্রমশালী), তাই অবাধ্যকে শাস্তি দিতে সক্ষম। আর তিনি হাকীম (প্রজ্ঞাময়), তাই তিনি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত দেন।
মূল শিক্ষা:
- কুরআন ও হাদিস সত্যকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে।
- স্পষ্ট প্রমাণের পরও অবাধ্য হওয়া বড় গুনাহ।
- আল্লাহ ক্ষমতাবান এবং প্রজ্ঞাময়—তিনি প্রতিটি কাজ সঠিকভাবে বিচার করেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সুস্পষ্ট সত্য জানার পরও ভুল পথে গেলে তার শাস্তি অনিবার্য।
- শয়তানের প্রলোভনে পা পিছলে যেতে পারে—তাই সতর্ক থাকতে হবে।
- আল্লাহর পরাক্রম ও প্রজ্ঞা সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত।
এ আয়াতে কাফের ও অবাধ্যদের সতর্ক করা হয়েছে, যারা সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও সত্যকে অস্বীকার করে। তারা কিয়ামতের বড় বড় নিদর্শন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, অথচ তখন তওবা করা কোনো কাজে আসবে না।
- মেঘের ছায়া: কিয়ামতের দিনে আল্লাহর হুকুম আসবে, আকাশ ঢেকে যাবে।
- ফেরেশতাদের আগমন: তারা আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নের জন্য আসবে।
- কুযিয়াল-আমর: তখন বিষয় চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, আর সুযোগ থাকবে না।
- আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন: সবকিছু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে—তিনিই বিচারক।
মূল শিক্ষা:
- সত্য প্রকাশের পরও যারা অস্বীকার করে, তারা শুধু কিয়ামতের কঠিন শাস্তির অপেক্ষা করছে।
- কিয়ামতের সময় সুযোগ থাকবে না, এখনই তওবা করতে হবে।
- সমস্ত বিষয় আল্লাহর হাতে—তিনিই শেষ বিচারক।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সত্য জানার পর তা গ্রহণ করা জরুরি, বিলম্ব বিপদ ডেকে আনে।
- কিয়ামতের বড় বড় নিদর্শন আসার পর ঈমান আনা গ্রহণযোগ্য হবে না।
- সব কাজ, সিদ্ধান্ত ও পরিণতি আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে।
এ আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাঈলের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে বহু স্পষ্ট নিদর্শন, মুজিজা, ও নিয়ামত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা অকৃতজ্ঞতা করেছে, তাই কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে।
- স্পষ্ট নিদর্শন: সাগর বিভাজন, মেঘের ছায়া, মান্না ও সালওয়া প্রেরণ, মুসা (আ.)-এর লাঠি ইত্যাদি অলৌকিক নিদর্শন।
- নিয়ামত পরিবর্তন: আল্লাহর নিয়ামত কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ না করে, অবাধ্যতা ও গুনাহর মাধ্যমে তা নষ্ট করা।
- শাস্তির সতর্কতা: যারা নিয়ামতকে অকৃতজ্ঞতার মাধ্যমে বদলে দেয়, আল্লাহ তাদের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করেছেন।
মূল শিক্ষা:
- ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে—বনী ইসরাঈলের মতো অকৃতজ্ঞতা করা যাবে না।
- আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের কদর করা ফরজ।
- অকৃতজ্ঞতা ও নিয়ামতের অপব্যবহার আল্লাহর শাস্তি ডেকে আনে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর নিয়ামত পেলে কৃতজ্ঞ হওয়া অপরিহার্য।
- অতীত জাতিদের ধ্বংস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
- আল্লাহর শাস্তি কঠোর—তাঁর নিয়ামতের অবমূল্যায়ন কখনো করা উচিত নয়।
এ আয়াতে কাফের ও মুমিনদের দুনিয়া ও আখিরাতের অবস্থার পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে।
- দুনিয়ার চাকচিক্য: কাফেররা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদাকে আসল জীবন মনে করে।
- ঈমানদারদের নিয়ে উপহাস: তারা দুনিয়াতে মুমিনদের দারিদ্র্য, সরলতা বা দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠাকে উপহাস করে।
- আখিরাতের মর্যাদা: কিয়ামতের দিনে তাকওয়াবানরা মর্যাদা, সম্মান ও জান্নাত লাভ করবে, আর কাফেররা অপমানিত হবে।
- রিযিকের মালিক আল্লাহ: দুনিয়া ও আখিরাতের সব রিযিক আল্লাহই দেন, কারও কাছে এর হিসাব চাইতে হয় না।
কিছু উদাহরণ:
- মক্কার কাফেররা রাসূল ﷺ ও তাঁর সাহাবাদের উপহাস করত—তাদের দরিদ্রতা ও দুর্বলতাকে তুচ্ছ মনে করত।
- আজও অনেকে দ্বীনদার মানুষকে বলে—“দ্বীন মানলে দুনিয়ার উন্নতি হয় না।” অথচ আখিরাতে সেই তাকওয়াবানরাই মর্যাদার আসনে বসবে।
- ইতিহাসে দেখা যায়—ফিরাউন, কারুন, হামান প্রভৃতি ধন-সম্পদে গর্ব করেছিল, কিন্তু ধ্বংস হয়েছিল। আর নবী ও মুমিনরা সফল হয়েছিলেন।
মূল শিক্ষা:
- দুনিয়ার চাকচিক্যে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না।
- মুমিনকে উপহাস করা বড় গোনাহ।
- আখিরাতে তাকওয়াবানরাই মর্যাদাবান হবে।
- রিযিক আল্লাহর হাতে—তিনি যাকে চান সীমাহীনভাবে দান করেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দুনিয়ার সাময়িক চাকচিক্য আসল নয়, আখিরাতের সফলতাই আসল।
- তাকওয়াই মুমিনের প্রকৃত পুঁজি।
- ধন-সম্পদে গর্ব করা নয়, বরং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া জরুরি।
এ আয়াতে মানবজাতির প্রাচীন অবস্থা, নবীদের প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং মতভেদের কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- মানুষ এক সম্প্রদায়: আদম (আ.)-এর যুগে মানুষ এক সত্য ধর্মের উপর ছিল। পরবর্তীতে তারা বিভক্ত হয়ে যায়।
- নবীদের ভূমিকা: আল্লাহ নবীদের পাঠিয়েছেন—কিছু লোককে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য, আর কিছু লোককে সতর্ক করার জন্য।
- কিতাব নাযিল: কিতাব নাযিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করা এবং মতভেদ মিটিয়ে দেয়া।
- মতভেদের কারণ: জ্ঞান ও প্রমাণ পাওয়ার পরও হিংসা ও জিদ-এর কারণে তারা বিভক্ত হয়েছে।
- মুমিনদের হেদায়াত: আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই সত্যের দিকে হেদায়াত দেন, যাতে কাফেররা মতভেদ করেছিল।
কিছু উদাহরণ:
- বনী ইসরাঈল তাওরাত পেয়েছিল, কিন্তু হিংসা ও অহংকারের কারণে মতভেদ করেছে।
- ইসা (আ.)-এর উম্মত ইনজিল পাওয়ার পরও বিভিন্ন ফেরকা (খ্রিস্টানদের দল) বিভক্ত হয়েছে।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আল্লাহ শেষ সত্য কিতাব (কুরআন) দিয়েছেন—যা মতভেদ মিটিয়ে দেয় এবং সোজা পথ দেখায়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ নবী ও কিতাব পাঠিয়েছেন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
- মতভেদ মূলত অহংকার ও হিংসার কারণে সৃষ্টি হয়।
- হেদায়াত আল্লাহর হাতে—তিনি যাকে চান সোজা পথে পরিচালিত করেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সত্যের পথ হলো কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ।
- মতভেদ এড়াতে হলে আল্লাহর কিতাবকে মাপকাঠি করতে হবে।
- হেদায়াত পাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করতে হবে।
এ আয়াতে মুমিনদের একটি চিরন্তন শিক্ষা দেয়া হয়েছে— জান্নাত শুধু মুখে দাবি করে পাওয়া যায় না, বরং তা অর্জনের জন্য ধৈর্য, পরীক্ষা ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
- পূর্ববর্তীদের অবস্থা: আগের নবী ও তাদের অনুসারীরা প্রচণ্ড কষ্ট, দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিল।
- কঠিন পরীক্ষা: এমন পরীক্ষা এসেছিল যে তারা হতাশ হয়ে বলেছিল—“আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে?”
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতি: আল্লাহ বলেন—সাহায্য নিকটবর্তী। দেরি মনে হলেও আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসে।
বর্তমান যুগের কিছু উদাহরণ:
- ফিলিস্তিনের মুমিনরা: তারা অন্যায়ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, কিন্তু ধৈর্য ধরে আল্লাহর সাহায্যের অপেক্ষায় আছে।
- চাকরি/রোজগারের কষ্ট: আজকের দিনে অনেক মুমিন হালাল রিজিকের জন্য সংগ্রাম করছে। হারাম পথে সহজ উপায় আছে, কিন্তু তারা তা বর্জন করে কষ্ট সহ্য করছে—এটাই পরীক্ষার অংশ।
- ইসলাম পালন করার কষ্ট: আধুনিক সমাজে হিজাব করা, সুন্নাহ মানা বা নামায পড়ার জন্য অনেককে উপহাস, বাধা কিংবা চাকরিতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এটি মুমিনের ধৈর্যের পরীক্ষা।
- ব্যক্তিগত কষ্ট: দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, পারিবারিক সমস্যা—এসবের মধ্যেও যদি কেউ ঈমান ধরে রাখে, তবে সে পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের মতো পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে।
মূল শিক্ষা:
- জান্নাত পেতে হলে কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
- ধৈর্য ও ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায়।
- আল্লাহর সাহায্য সবসময় কাছেই থাকে, তবে তা আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে আসে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- পরীক্ষা এলে হতাশ হওয়া যাবে না, বরং আল্লাহর সাহায্যের জন্য দু‘আ ও ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।
- যারা ধৈর্য ধরে থাকে, তারাই প্রকৃত সফল।
- আল্লাহর সাহায্য কখনো দেরি হয় না, বরং যথাসময়ে আসে।
এ আয়াতে আল্লাহ দান-সদকার অগ্রাধিকার এবং খরচের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
- প্রথম অগ্রাধিকার: নিজের পিতা-মাতা। তাদের প্রয়োজন পূরণ করা দান ও সদকার সবচেয়ে বড় কাজ।
- নিকটাত্মীয়: আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদেরকে সাহায্য করা দ্বিগুণ সওয়াব আনে—দান + আত্মীয়তার হক আদায়।
- ইয়াতীম: পিতৃহীন শিশুরা সমাজে সবচেয়ে অসহায়। তাদের খরচ বহন করা বড় সওয়াবের কাজ।
- মিসকীন: যারা অল্প আয়ের কারণে জীবিকা নির্বাহে অক্ষম।
- ইবনুস-সাবীল: মুসাফির যারা ভ্রমণে কষ্টে পড়ে, যদিও তারা স্বাভাবিকভাবে ধনী হতে পারে।
- আল্লাহর জ্ঞান: মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে—তোমরা যত সামান্য দানই করো, আল্লাহ তা জানেন ও প্রতিদান দেবেন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ যদি কারও বাবা-মা বৃদ্ধ হয়, তাদের চিকিৎসা, খাদ্য ও প্রয়োজন মেটানোই সবচেয়ে বড় দান।
- আত্মীয়দের মধ্যে দরিদ্র কেউ থাকলে তাকে সাহায্য করা গরিব অচেনা কাউকে সাহায্য করার চেয়েও উত্তম।
- ইয়াতীমখানা, এতিমদের পড়াশোনা ও খাবারের খরচ বহন করা।
- মিসকীনদের জন্য রান্নাঘর চালানো বা অভাবী পরিবারকে মাসিক খাদ্য সরবরাহ।
- রাস্তায় বিপদে পড়া ভ্রমণকারীকে সাহায্য করা—যেমন দুর্ঘটনায় আহতকে চিকিৎসা দেওয়া, পথ হারানো মুসাফিরকে সহায়তা করা।
মূল শিক্ষা:
- দান-সদকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হলো পরিবারের ভেতরে।
- প্রকৃত দান হলো যেটি প্রয়োজনীয় জায়গায় খরচ হয়।
- আল্লাহ প্রত্যেকটি দান ও কল্যাণমূলক কাজের খবর রাখেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান শুধুমাত্র নাম বা খ্যাতির জন্য নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
- পিতা-মাতার খরচ চালানো দান হিসেবে গণ্য হয়।
- দান করার আগে দেখতে হবে—কে বেশি প্রয়োজনীয়, সেখানে খরচ করতে হবে।
এ আয়াতটি মুমিনদের শেখায় যে, জীবনে এমন কিছু নির্দেশ আসবে যা তাদের কাছে কষ্টকর মনে হবে, কিন্তু আসলে তাতে কল্যাণ লুকিয়ে থাকে। যুদ্ধ (জিহাদ) সেই উদাহরণগুলোর একটি।
- যুদ্ধ ফরজ: ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা ও দ্বীন রক্ষার জন্য যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে।
- অপছন্দ হলেও কল্যাণ: মুমিনরা যুদ্ধকে কষ্টকর মনে করে—কারণ এতে জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি আছে। কিন্তু এর মাধ্যমে দ্বীন রক্ষা হয় এবং শেষ পর্যন্ত জান্নাত লাভ হয়।
- পছন্দ হলেও ক্ষতি: অনেক কিছু মানুষ ভালোবাসে (যেমন আরাম, দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, অন্যায় ক্ষমতা), অথচ এগুলো আখিরাতের ক্ষতি ডেকে আনে।
- আল্লাহর জ্ঞান: মানুষ সীমিত জ্ঞান রাখে। আল্লাহ সব জানেন—তাই তাঁর নির্দেশই সঠিক।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কেউ নামাযকে কঠিন মনে করে, কিন্তু আসলে নামাযই অন্তরের শান্তি আনে।
- হালাল ব্যবসা অনেক সময় কষ্টকর, কিন্তু তাতে বরকত আছে; হারাম পথে আয় সহজ মনে হলেও তাতে ধ্বংস আছে।
- কোনো পরীক্ষায় ব্যর্থতা মানুষকে কষ্ট দেয়, অথচ তা তাকে ভবিষ্যতে ভালো পথে নিয়ে যেতে পারে।
- অসুস্থতা অপছন্দনীয় হলেও তা মানুষের গুনাহ মোচন করে এবং ধৈর্য শিখায়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নির্দেশ মানা জরুরি, যদিও তা কঠিন মনে হয়।
- অপছন্দনীয় জিনিসেও কল্যাণ থাকতে পারে।
- মানুষ সীমিত জ্ঞান রাখে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ধৈর্য ধরলে কষ্টেও কল্যাণ পাওয়া যায়।
- আল্লাহর উপর আস্থা রাখা মুমিনের কর্তব্য।
- সত্যিকার ভালো-মন্দ আল্লাহই জানেন।
এ আয়াতে “পবিত্র মাসে যুদ্ধ” সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর এবং কাফেরদের ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে।
- পবিত্র মাস: জিলকদ, জিলহজ্জ, মহররম ও রজব—এই চার মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। তবে শত্রুরা বাধ্য করলে তখন যুদ্ধ বৈধ।
- গুরুতর অপরাধ: যুদ্ধ বড় অপরাধ হলেও, মুমিনদেরকে মক্কা থেকে বের করা, কাবার পথে বাধা দেওয়া এবং শিরক—এসব আল্লাহর কাছে আরও ভয়ংকর অপরাধ।
- ফিতনা হত্যার চেয়ে বড়: মুসলিমদেরকে নির্যাতন, দ্বীন থেকে সরিয়ে দেয়া—এগুলো হত্যার থেকেও বড় জুলুম।
- কাফেরদের কৌশল: তারা সর্বদা চেষ্টা করবে মুসলিমদের ঈমান নষ্ট করতে।
- মুরতাদদের শাস্তি: যে মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করে কুফরের অবস্থায় মারা যায়, তার দুনিয়া ও আখিরাতের সব আমল নষ্ট হবে, এবং সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও ইসলামের শত্রুরা মুসলিমদের দ্বীন পালনে বাধা দেয়—কখনো চাকরি, কখনো সমাজ, কখনো আইন প্রণয়নের মাধ্যমে।
- ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের মুসলিমরা আল্লাহর ঘর (মসজিদ) থেকে বঞ্চিত হচ্ছে—এ আয়াত তাদের বাস্তব অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে।
- যারা ইসলাম ত্যাগ করে দুনিয়ার স্বার্থে চলে যায়, তাদের ভবিষ্যৎ ক্ষতি এই আয়াত পরিষ্কার করেছে।
মূল শিক্ষা:
- যুদ্ধ নিজে বড় অপরাধ, তবে দ্বীনের পথে বাধা দেয়া ও শিরক তার থেকেও বড় অপরাধ।
- কাফেররা সবসময় মুসলিমদের দ্বীন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে।
- মুরতাদদের দুনিয়া ও আখিরাত—দুটোই ধ্বংস।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলামের বিধানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, শত্রুর চক্রান্তে প্রভাবিত হওয়া যাবে না।
- ফিতনা প্রতিরোধ করা মুমিনদের কর্তব্য।
- আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকতে হবে, কারণ সত্যের পথেই প্রকৃত সফলতা।
এ আয়াতে তিন শ্রেণির মানুষের কথা বলা হয়েছে— যারা আল্লাহর রহমতের প্রকৃত দাবিদার।
- ঈমানদার: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এ ঈমান আনা—এটাই মূল ভিত্তি।
- হিজরতকারী: যারা দ্বীনের জন্য নিজের দেশ, পরিবার ও সম্পদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে। যেমন—মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত।
- মুজাহিদ: যারা আল্লাহর দ্বীন রক্ষায় ও তাঁর বাণী প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে—জিহাদ শুধু অস্ত্রধারণ নয়, বরং দ্বীনের জন্য ত্যাগ-সংগ্রামও জিহাদ।
- আল্লাহর রহমত: এ তিন শ্রেণির মানুষ আল্লাহর রহমতের আশা করতে পারে।
- আল্লাহর গুণ: তিনি গফূর (ক্ষমাশীল) ও রাহীম (দয়ালু)—তাদের ত্রুটি ক্ষমা করবেন এবং রহমত দান করবেন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে যুবক দুনিয়ার লোভ ত্যাগ করে হালাল রাস্তায় চলে—সে হিজরতকারীর মতো।
- যে মানুষ ইসলাম প্রচারের জন্য নির্যাতন সহ্য করে—সে জিহাদের পথে।
- যারা গোনাহ থেকে বিরত থাকতে পরিবেশ ত্যাগ করে—তাদের হিজরত আজকের বাস্তব উদাহরণ।
- যারা ইন্টারনেট, মিডিয়া বা সমাজে দ্বীনের দাওয়াহ দেয়, তারাও জিহাদের একটি রূপ পালন করছে।
মূল শিক্ষা:
- ঈমান, হিজরত ও জিহাদ মুমিনের মূল ভিত্তি।
- আল্লাহর রহমতের আশা শুধু তাদের জন্য, যারা দ্বীনের জন্য ত্যাগ করে।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু—তিনি বান্দাদের ত্রুটি ঢেকে দেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ঈমান আনলেও দ্বীনের জন্য ত্যাগ ও সংগ্রাম অপরিহার্য।
- আল্লাহর রহমত পেতে চাইলে মুমিনকে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।
- ধৈর্য, হিজরত ও সংগ্রামই জান্নাতের পথ।
এ আয়াতে দু’টি প্রধান বিষয় আলোচনা হয়েছে— ১) মদ ও জুয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা। ২) খরচের সঠিক দিকনির্দেশনা।
- মদ ও জুয়া:
- মদ্যপানে কিছু উপকার আছে—যেমন সাময়িক আনন্দ, ব্যবসায়িক লাভ ইত্যাদি।
- জুয়াতেও কিছু উপকার আছে—কেউ হঠাৎ অর্থ পেতে পারে।
- কিন্তু এ দু’টির ক্ষতি ও গুনাহ এত বেশি যে, উপকার এর কাছে তুচ্ছ। (পরে কুরআনে এগুলোকে সম্পূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে: সূরা মায়িদাহ ৯০-৯১)
- দান-সদকা: দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ বললেন—“অতিরিক্ত” অর্থাৎ যে অর্থ তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত, সেটিই দান করা উচিত।
- চিন্তাশীল হওয়া: মুসলিমদের জন্য শিক্ষা হলো—প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর হুকুমের পেছনে গভীর প্রজ্ঞা রয়েছে, তাই তা নিয়ে ভাবতে হবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মদ: আজকের যুগে মদকে “এন্টারটেইনমেন্ট” ও “ব্যবসা” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এর ফলে নেশা, দুর্ঘটনা, পরিবার ভাঙন, স্বাস্থ্যহানি ও অপরাধ বাড়ছে—যা ক্ষতির বড় দিক।
- জুয়া: আধুনিক ক্যাসিনো, লটারী, ক্রিকেট বেটিং, অনলাইন গেম্বলিং—এসব সাময়িক আনন্দ বা লাভ দেয়, কিন্তু মানুষকে পথে বসিয়ে দেয়, পরিবার নষ্ট করে দেয়।
- দান: আজকের দিনে অনেকেই অতিরিক্ত অর্থ বিলাসিতায় খরচ করে; অথচ তা গরিব, এতিম, মিসকীনদের জন্য খরচ করলে সমাজে সমতা আসতে পারে।
মূল শিক্ষা:
- মদ ও জুয়া সাময়িক উপকার দিলেও আসলে বড় ক্ষতি ডেকে আনে।
- প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ দান করা উচিত।
- আল্লাহ চান আমরা চিন্তাশীল হই এবং তাঁর হুকুমের গভীরতা বুঝি।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সমাজ ধ্বংসকারী যেকোনো কাজে (মদ, জুয়া, নেশা) অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকা ফরজ।
- দান সর্বপ্রথম উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকে হওয়া উচিত।
- কুরআনের প্রতিটি বিধান চিন্তাশীল মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা বহন করে।
এ আয়াতে ইয়াতীমদের (পিতৃহীন শিশুদের) হক এবং তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- দুনিয়া ও আখিরাতের চিন্তা: মুসলিমের উচিত দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই ভারসাম্যের সাথে চিন্তা করা।
- ইয়াতীমদের হক: ইয়াতীমদের সম্পদ ও জীবনের সুরক্ষা জরুরি। তাদের কল্যাণ করা আল্লাহর নিকট সওয়াবের কাজ।
- ভ্রাতৃত্ব: যদি অভিভাবকরা ইয়াতীমদের সাথে একত্রে বসবাস বা ব্যবসা করে, তবে তা বৈধ। কিন্তু এতে কোনো প্রকার প্রতারণা বা অপকার করা যাবে না।
- মনের অবস্থা: আল্লাহ জানেন—কে ইয়াতীমের উপকার করতে চায় আর কে ক্ষতি করতে চায়।
- আল্লাহর রহমত: তিনি ইচ্ছা করলে কঠিন বিধান দিতেন, কিন্তু সহজ করেছেন—কারণ তিনি দয়ালু ও প্রজ্ঞাময়।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ এতিমখানায় থাকা শিশুদের সঠিক শিক্ষা, খাদ্য ও ভালোবাসা দেওয়া এ আয়াতের বাস্তব প্রয়োগ।
- অভিভাবক মারা যাওয়ার পর আত্মীয়রা যদি এতিমের সম্পদ নিজের জন্য ব্যবহার করে, তবে তা বড় গুনাহ।
- কেউ যদি নিজের পরিবারে এতিমকে আশ্রয় দেয়—সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর রহমত লাভ করে।
মূল শিক্ষা:
- ইয়াতীমদের সাথে সৎ আচরণ করা আল্লাহর নিকট মহৎ কাজ।
- তাদের কল্যাণে খরচ করা দান-সদকার চেয়ে উত্তম।
- আল্লাহ অন্তরের উদ্দেশ্য জানেন—তাই বাহ্যিক ভালো ব্যবহার করে প্রতারণা করলে কোনো লাভ নেই।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইয়াতীমদের হক হরন করা জাহান্নামের কঠিন শাস্তির কারণ।
- তাদেরকে ভাইয়ের মতো সম্মান করতে হবে।
- মুমিনকে দুনিয়া ও আখিরাত—দুটোর ভারসাম্য রেখে চলতে হবে।
এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদেরকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন— বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে ঈমানকে প্রধান শর্ত হিসেবে রাখতে হবে।
- মুশরিক নারীদের সাথে বিয়ে: মুসলিম পুরুষদের জন্য হারাম, যতক্ষণ না তারা ইসলাম গ্রহণ করে।
- মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে: মুসলিম নারীদের জন্য হারাম, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে।
- ঈমানের মর্যাদা: একজন মুমিন দাস বা দাসী একজন স্বাধীন মুশরিক নারী-পুরুষের চেয়েও উত্তম।
- আহ্বান: মুশরিকরা মানুষকে নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে, আর আল্লাহ আহ্বান করেন জান্নাত ও ক্ষমার দিকে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজে অনেক মুসলিম ছেলে-মেয়েরা প্রেমে পড়ে অমুসলিমদের বিয়ে করতে চায়—এ আয়াত তা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
- কেউ যদি শুধু সৌন্দর্য, ধন-সম্পদ বা সমাজের মর্যাদা দেখে মুশরিকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তবে তা ঈমানের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
- একজন সাধারণ গরিব মুমিন/মুমিনা একজন ধনী বা সুন্দর মুশরিকের চেয়ে আল্লাহর কাছে উত্তম।
মূল শিক্ষা:
- বিয়ে করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো ঈমান।
- দ্বীন ছেড়ে দুনিয়ার সৌন্দর্য বা সম্পদকে অগ্রাধিকার দিলে তা শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
- আল্লাহ মানুষকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন, শিরক মানুষকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুমিনের জন্য বিয়েতে ঈমান ও তাকওয়া প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
- দ্বীনের বাইরে প্রেম-ভালোবাসা মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
- আল্লাহর নির্দেশ মানলে সংসারে বরকত আসে এবং আখিরাতে জান্নাত লাভ হয়।
এ আয়াতে নারীর মাসিক (ঋতুমতী অবস্থা) সম্পর্কিত শরীয়তের বিধান ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- অশুচি অবস্থা: মাসিক রক্ত অশুচি এবং এতে স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে অসুবিধা রয়েছে।
- দূরে থাকা: অর্থাৎ এই সময়ে স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে খাওয়া, বসা, কথা বলা ইত্যাদি বৈধ।
- পবিত্র হওয়া: রক্ত বন্ধ হওয়ার পর পূর্ণ গোসল (গোসল-ই-হায়েজ) করার মাধ্যমে নারী পবিত্র হয়।
- আল্লাহর নির্দেশ: পবিত্র হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে বৈধ হয়ে যায়।
- আল্লাহর ভালোবাসা: আল্লাহ পছন্দ করেন—যারা গুনাহ হলে তাওবা করে এবং যারা সর্বদা পবিত্রতা অর্জনে যত্নবান থাকে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সমাজে মাসিক সময়কে অপমানজনক করে দেখা হয়, কিন্তু ইসলাম নারীর মর্যাদা রক্ষা করে শুধু যৌন সম্পর্ককে নিষিদ্ধ করেছে, অন্য সম্পর্ক নয়।
- এ সময়ে নারীর শারীরিক দুর্বলতা ও মানসিক কষ্ট থাকে—তাকে কষ্ট না দিয়ে সহানুভূতি দেখানোই প্রকৃত ইসলামী আচরণ।
- পরিচ্ছন্নতা ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—আজও মাসিকের সময়ে হাইজিন মেনে চলা নারীর স্বাস্থ্য ও পরিবারের জন্য কল্যাণকর।
মূল শিক্ষা:
- ঋতুস্রাবকালে যৌন সম্পর্ক হারাম।
- নারীর প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করতে হবে।
- আল্লাহ ভালোবাসেন—যারা পাপ থেকে ফিরে আসে এবং পরিচ্ছন্ন থাকে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- শরীয়তের বিধান মানা মানেই কল্যাণ ও স্বাস্থ্য রক্ষা।
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ইসলামের নির্ধারিত সীমার মধ্যে হতে হবে।
- তাওবা ও পরিচ্ছন্নতা একজন মুসলিমের চরিত্রের অংশ।
এই আয়াতে আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে সুন্দরভাবে বোঝাতে কৃষিক্ষেত্রের উপমা ব্যবহার করেছেন।
- স্ত্রী হলো ক্ষেত্র: যেমন ক্ষেত্র চাষ করলে ফল আসে, তেমনি স্ত্রী হলো সন্তান জন্মদানের মাধ্যম।
- যেভাবে ইচ্ছা: বৈধ সীমার মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তবে পশ্চাদ্দেশীয় সঙ্গম (anal intercourse) হারাম।
- সৎকর্ম অগ্রিম পাঠানো: দুনিয়ার কাজের মাধ্যমে আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করা।
- আল্লাহর ভয়: দাম্পত্য জীবনে যেন আল্লাহর ভয় রাখা হয়, অন্যায়-অশ্লীল কাজে না জড়ানো হয়।
- সাক্ষাতের স্মরণ: কিয়ামতের দিনে সবাই আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে—তাই সব কাজে তাকওয়া জরুরি।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- দাম্পত্য জীবনে শুধু জৈবিক চাহিদা নয়, বরং আল্লাহর ভয় এবং সন্তানকে নেক বানানোর উদ্দেশ্য রাখতে হবে।
- আধুনিক যুগে অনেকেই বৈবাহিক জীবনে হারাম কাজে লিপ্ত হয় (যেমন পর্নোগ্রাফি, হারাম সম্পর্ক), অথচ এ আয়াত শেখায়—স্ত্রীর সাথে বৈধ সীমার মধ্যে সম্পর্কই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।
- নিজেদের জন্য অগ্রিম পাঠানো মানে—নামায, দান-সদকা, নেক সন্তান গড়ে তোলা—যা আখিরাতে কাজে আসবে।
মূল শিক্ষা:
- স্ত্রী হলো দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্র, তাকে সম্মান করতে হবে।
- আল্লাহর নির্দেশিত সীমার মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক বৈধ।
- প্রত্যেক মুমিনকে মনে রাখতে হবে—আল্লাহর সাথে সাক্ষাত অবধারিত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- বিবাহিত জীবনে আল্লাহর ভয় রাখা আবশ্যক।
- দাম্পত্য জীবনে লক্ষ্য হওয়া উচিত নেক সন্তান গড়ে তোলা।
- আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের বিশ্বাস আমাদের প্রতিটি কাজের মধ্যে প্রভাব ফেলতে হবে।
এ আয়াতে আল্লাহ সতর্ক করেছেন— যেন আল্লাহর নাম নিয়ে অকারণে শপথ করা না হয়, কিংবা শপথকে অজুহাত বানিয়ে নেক কাজ বাদ দেওয়া না হয়।
- শপথের অপব্যবহার: কেউ যদি বলে—“আল্লাহর কসম, আমি আর দান করব না”, তবে এটি ভুল শপথ।
- তাকওয়া অবলম্বন: শপথ কখনও তাকওয়া বা সৎকর্মের পথে বাধা হতে পারবে না।
- মানুষের মধ্যে মিল-মহব্বত: ঝগড়া মিটিয়ে দেওয়া ইসলামের বড় কাজ। শপথ দিয়ে এটি বর্জন করা নিষিদ্ধ।
- আল্লাহর গুণ: তিনি সব শোনেন ও জানেন—অতএব বান্দা তাঁর নামে মিথ্যা বা অপব্যবহার করলে তিনি অবগত থাকেন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে শপথ করে বলে—“আমি অমুক আত্মীয়ের সাথে আর কথা বলব না”—এটি হারাম, কারণ ইসলামে সম্পর্ক রক্ষা ফরজ।
- কেউ শপথ করে বলে—“আমি আর কোনো গরিবকে সাহায্য করব না”—এ আয়াত তা নিষিদ্ধ করেছে।
- কখনও শপথকে ঢাল বানিয়ে দ্বীনের কাজ থেকে বিরত থাকা যায় না।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর নামে শপথকে অজুহাত বানিয়ে সৎকর্ম ত্যাগ করা যাবে না।
- দান, তাকওয়া ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন মুমিনের কর্তব্য।
- আল্লাহ সব কথা শোনেন ও জানেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- শপথ কখনও সৎকর্মে বাধা হওয়া উচিত নয়।
- আল্লাহর নামকে হালকাভাবে ব্যবহার করা মারাত্মক গুনাহ।
- আল্লাহর ভয়ে নেক কাজ ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হওয়া মুমিনের দায়িত্ব।
এ আয়াতে শপথের দুই ধরণের ব্যাখ্যা করা হয়েছে — ১) হালকা, অসচেতন শপথ (লাগভ)। ২) ইচ্ছাকৃত ও সচেতন শপথ।
- লাগভ শপথ: দৈনন্দিন কথাবার্তায় অসচেতনভাবে আল্লাহর নাম নিয়ে বলা— যেমন, “আল্লাহর কসম, আমি আজ ওখানে যাব” — অথচ সেটা শুধু কথার ছলে বলা, বাস্তব উদ্দেশ্য নেই। ➝ এর জন্য আল্লাহ পাকড়াও করবেন না।
- ইচ্ছাকৃত শপথ: মন থেকে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে শপথ করা— যেমন, “আল্লাহর কসম, আমি অমুক কাজ করব না” এবং তা ভঙ্গ করা। ➝ এর জন্য কাফফারা (শপথ ভঙ্গের প্রায়শ্চিত্ত) ফরজ।
- আল্লাহর গুণ: তিনি গফূর (ক্ষমাশীল) ও হালীম (সহনশীল)। তিনি অসচেতন ভুল ক্ষমা করেন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে কথার ছলে বলে—“আল্লাহর কসম, আমি এটা খাইনি”—এটা যদি শুধু অভ্যাসে বলে, তবে গুনাহ নেই।
- কিন্তু কেউ যদি বলে—“আল্লাহর কসম, আমি আজ থেকে নামায পড়ব”—তারপর না পড়ে, তবে তা ভঙ্গ হবে এবং শাস্তিযোগ্য।
- কেউ যদি শপথ করে—“আমি অমুক আত্মীয়ের সাথে আর কথা বলব না”—এটি গুনাহ, এবং শপথ ভেঙে কাফফারা দিতে হবে।
মূল শিক্ষা:
- অসচেতনভাবে বলা শপথের জন্য আল্লাহ পাকড়াও করেন না।
- ইচ্ছাকৃত শপথ ভঙ্গ করলে দায়বদ্ধ হতে হয়।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সহনশীল—তাই বান্দাদের প্রতি সহজ করেছেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর নামকে হালকাভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
- ইচ্ছাকৃত শপথ ভঙ্গ করা গুনাহ এবং এর কাফফারা আদায় করতে হবে।
- আল্লাহ বান্দার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করেন, কিন্তু ইচ্ছাকৃত গুনাহর জন্য পাকড়াও করবেন।
এ আয়াতে “ঈলা” নামে পরিচিত একটি বিশেষ পরিস্থিতি উল্লেখ করা হয়েছে।
- ঈলা: স্বামী যদি শপথ করে স্ত্রীকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত না ছোঁয়ার, সেটিকে বলে ঈলা।
- চার মাস সীমা: ইসলাম স্বামীকে সর্বোচ্চ চার মাস সময় দিয়েছে। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—স্ত্রীর কাছে ফিরবে, না বিচ্ছেদ দেবে।
- ফিরে আসা: যদি স্বামী স্ত্রীকে গ্রহণ করে, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল। শপথ ভঙ্গের কাফফারা দিতে হবে, কিন্তু সংসার টিকে যাবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কেউ রাগের বশে বলে—“আমি আর কখনো তোমার কাছে যাব না”—এটি ঈলা। তবে ইসলাম তাকে সর্বোচ্চ ৪ মাস সময় দেয়, এর পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
- আধুনিক সমাজে অনেকে মাসের পর মাস স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখে—এ আয়াত সেই আচরণ নিষিদ্ধ করেছে।
- স্বামী যদি সম্পর্ক ঠিক করে নেয়, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন এবং সংসার চলতে থাকে।
মূল শিক্ষা:
- স্ত্রীকে ঝুলিয়ে রাখা ইসলাম অনুমোদন করে না।
- চার মাস হলো সর্বোচ্চ সীমা—এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল—ভুল করে থাকলে তাওবা করে সংসার রক্ষা করা উত্তম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে রাগের বশে শপথ করা উচিত নয়।
- সংসারে ঝুলন্ত অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে—ইসলাম এভাবে অনিশ্চয়তা রাখতে দেয় না।
- আল্লাহর কাছে ফিরে আসা মানেই দয়া ও ক্ষমা লাভ।
এ আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (২:২২৬) সাথে সম্পর্কিত। সেখানে বলা হয়েছিল, যদি স্বামী চার মাস স্ত্রী থেকে দূরে থাকার শপথ করে।
- সিদ্ধান্ত: চার মাস পর স্বামীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—স্ত্রীর কাছে ফিরবে, না তালাক দেবে।
- তালাক: যদি সে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে আল্লাহ তা শুনেন এবং জানেন।
- আল্লাহর জ্ঞান: এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে—তালাক বড় দায়িত্বের কাজ, এটি খেলো বা রাগের বশে দেওয়া উচিত নয়।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক সময় স্বামী রাগের মাথায় হঠাৎ তালাক দেয়—আয়াতটি সতর্ক করছে, কারণ আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
- আধুনিক সমাজে স্বামী-স্ত্রী ঝগড়ার পর মাসের পর মাস আলাদা থাকে—ইসলাম এভাবে অনিশ্চয়তায় ঝুলিয়ে রাখতে দেয় না, সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হতে হবে।
- তালাক বৈধ হলেও এটি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল কাজ (হাদীস অনুযায়ী)। তাই খুব জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া তালাক দেওয়া উচিত নয়।
মূল শিক্ষা:
- চার মাসের বেশি স্বামী-স্ত্রীকে ঝুলিয়ে রাখা যাবে না।
- তালাক বড় দায়িত্বের কাজ, হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।
- আল্লাহ সব কথা শোনেন এবং সবকিছু জানেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- তালাক কখনও রাগের মাথায় বা মজার ছলে দেওয়া উচিত নয়।
- স্বামীকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সংসার টিকিয়ে রাখা নাকি আলাদা হওয়া।
- আল্লাহর ভয় ও সচেতনতা নিয়ে সংসার ও তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ আয়াতে তালাকের পর নারীর ইদ্দত এবং স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- ইদ্দত: তালাকপ্রাপ্তা নারীরা ৩ হায়েয (ঋতুচক্র) অপেক্ষা করবে। এ সময়ে তারা নতুন বিয়ে করতে পারবে না।
- গর্ভ গোপন করা হারাম: যদি তারা গর্ভবতী হয়, তবে তা লুকানো যাবে না। এটি সন্তানের হক এবং বংশ রক্ষার জন্য জরুরি।
- রুজু (ফিরিয়ে নেওয়া): স্বামী চাইলে ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে, তবে এর শর্ত হলো—সংসার টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে।
- অধিকার ও দায়িত্ব: নারীদেরও অধিকার রয়েছে, যেমন স্বামীর প্রতি দায়িত্ব রয়েছে। তবে পুরুষের একটি অতিরিক্ত মর্যাদা (পরিচালনা/দায়িত্ব) রয়েছে।
- আল্লাহর গুণ: তিনি ‘আযীয (পরাক্রমশালী) ও হাকীম (প্রজ্ঞাময়)। তাই তাঁর হুকুমে পূর্ণ প্রজ্ঞা রয়েছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আধুনিক যুগে কেউ কেউ তালাকের পর ইদ্দতের নিয়ম মানে না—এ আয়াত সেই ভুল ধারণা দূর করে।
- নারীরা গর্ভাবস্থা গোপন করলে ভবিষ্যতে সন্তানের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়—আজকের সমাজে এর বাস্তব উদাহরণ আছে।
- কিছু পুরুষ তালাক দিয়ে পরে আবার রুজু করে স্ত্রীকে কষ্ট দেয়—কিন্তু এ আয়াত বলছে, রুজুর উদ্দেশ্য হতে হবে সংশোধন, কষ্ট দেওয়া নয়।
মূল শিক্ষা:
- তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত মানা ফরজ।
- নারীর অধিকারও রয়েছে, তবে পুরুষের অতিরিক্ত দায়িত্ব রয়েছে।
- গর্ভ গোপন করা বড় গুনাহ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলাম নারীর অধিকার রক্ষা করে, যেমন স্বামীর অধিকার রেখেছে।
- ইদ্দত হলো বংশরক্ষা ও পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিধান।
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সংশোধন ও শান্তি, কষ্ট নয়।
এ আয়াতে তালাকের সীমা ও নিয়ম স্পষ্ট করা হয়েছে।
- তালাক দুইবার: স্বামী সর্বোচ্চ দুইবার তালাক দিয়ে রুজু (ফিরিয়ে নেওয়া) করতে পারে।
- তৃতীয়বার: তৃতীয় তালাক দিলে আর রুজু করা যাবে না—তখন স্থায়ী বিচ্ছেদ হবে।
- সদয়ভাবে আলাদা করা: যদি সংসার টিকানো না যায়, তবে ঝগড়া নয়—সদয়ভাবে আলাদা হতে হবে।
- স্বামীর অধিকার সীমিত: স্ত্রীকে দেওয়া দেনমোহর বা সম্পদ ফেরত নেওয়া বৈধ নয়, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে—যখন উভয়ের মধ্যে আল্লাহর হুকুম মানা অসম্ভব হয়।
- খুল‘ (স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ): স্ত্রী যদি স্বামীকে সহ্য করতে না পারে, তবে স্বামীকে দেনমোহর বা কিছু ফিরিয়ে দিয়ে বিচ্ছেদ চাইতে পারে।
- আল্লাহর সীমা: তালাকের নিয়ম অতিক্রম করা জালিমদের কাজ।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই রাগের মাথায় একসাথে তিন তালাক দেয়—এটি শরীয়তের সীমা অতিক্রম, তাই গুনাহ।
- কিছু স্বামী তালাক দিয়ে স্ত্রীর দেনমোহর বা সম্পদ ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করে—এ আয়াত তা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
- আজকের সমাজে খুল‘ (স্ত্রীর উদ্যোগে বিচ্ছেদ) অবহেলিত—কিন্তু ইসলাম এটিকে বৈধ করেছে, যদি স্ত্রীর কষ্ট হয়।
মূল শিক্ষা:
- তালাক সর্বোচ্চ দুইবার পর্যন্ত দেওয়া যায়, এরপর সীমা অতিক্রম করলে হারাম।
- স্বামী স্ত্রীকে দেওয়া সম্পদ ফেরত নিতে পারবে না, কেবল বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতীত।
- তালাকের নিয়ম অতিক্রম করা জুলুম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- তালাক দিতে হলে ইসলামি নিয়ম মেনে দিতে হবে।
- সংসার না টিকলে ঝগড়া নয়, বরং সুন্দরভাবে আলাদা হওয়া উচিত।
- আল্লাহর সীমা রক্ষা করাই মুমিনের কর্তব্য।
এ আয়াতে তৃতীয় তালাক সম্পর্কিত চূড়ান্ত বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
- তিন তালাকের পর: যদি স্বামী স্ত্রীকে তিনবার তালাক দেয়, তবে স্ত্রী আর তার জন্য হালাল নয়।
- হালাল হওয়ার শর্ত: স্ত্রীকে অন্য পুরুষকে সত্যিকারের বিয়ে করতে হবে, এবং যদি সে স্বামী তালাক দেয়, তখনই পূর্বের স্বামীর সাথে পুনরায় বিয়ে বৈধ হবে।
- শর্ত: পুনর্মিলনের উদ্দেশ্য হবে সংসার টিকিয়ে রাখা, আল্লাহর সীমা মানা।
- আল্লাহর সীমারেখা: তালাকের এ নিয়ম আল্লাহর হিকমতের অংশ—কেউ তা অতিক্রম করতে পারবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে রাগের মাথায় একসাথে তিন তালাক দিয়ে পরে আফসোস করে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চায়—এই আয়াত স্পষ্ট করছে, এটা তখন আর বৈধ নয়।
- “হালালাহ বিয়ে” (অর্থাৎ শুধু ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সাময়িক বিয়ে) ইসলাম কঠোরভাবে হারাম করেছে—এটি কৃত্রিম ও প্রতারণামূলক।
- আজকের সমাজে কেউ কেউ তালাককে খেলো মনে করে—এ আয়াত তা বন্ধ করে সঠিক সীমা নির্ধারণ করেছে।
মূল শিক্ষা:
- তিন তালাক হলে স্ত্রী স্বামীর জন্য স্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়, যদি না স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং সে তালাক দেয়।
- হালালাহ প্রতারণা আল্লাহর সীমা ভঙ্গ করার শামিল।
- তালাকের নিয়ম আল্লাহর নির্ধারিত সীমা—এতে বাড়াবাড়ি করা জুলুম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- তালাক দিতে হবে গভীর চিন্তাভাবনা করে, রাগের মাথায় নয়।
- তৃতীয় তালাক একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এর পর আর খেলা বা প্রতারণা বৈধ নয়।
- আল্লাহর সীমা মানা মুমিনের দায়িত্ব, সীমা ভঙ্গ করলে তা জুলুম।
এ আয়াতে তালাকের সময় স্বামী-স্ত্রীর জন্য করণীয় ও আল্লাহর সীমারেখা উল্লেখ করা হয়েছে।
- সুন্দরভাবে ফিরিয়ে নেওয়া: ইদ্দত চলাকালে স্বামী চাইলে স্ত্রীর সাথে সুন্দরভাবে সংসার পুনরায় শুরু করতে পারে।
- সুন্দরভাবে ছেড়ে দেওয়া: যদি সংসার টিকিয়ে রাখা না যায়, তবে ঝগড়া নয়—বরং সুন্দরভাবে আলাদা হতে হবে।
- কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখা: স্ত্রীকে ফিরিয়েও না নেওয়া, আবার সম্পূর্ণ মুক্তও না করা—এটি হারাম এবং জুলুম।
- আল্লাহর আয়াত নিয়ে উপহাস: তালাক ও বৈবাহিক জীবনের বিধানকে খেলা মনে করা গুনাহ।
- আল্লাহর অনুগ্রহ: আল্লাহ আমাদের উপর কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ (সুন্নাহ) নাযিল করেছেন—এগুলোই জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার পথ।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক পুরুষ তালাক দিয়ে স্ত্রীকে ঝুলিয়ে রাখে—না পুরোপুরি আলাদা করে, না সংসার করে—এটি বড় জুলুম।
- আজকের সমাজে তালাককে মজার ছলে ব্যবহার করা হয়, অথচ কুরআন বলছে—আল্লাহর আয়াত নিয়ে খেলা কোরো না।
- সংসার যদি টিকিয়ে রাখা সম্ভব না হয়, তবে শান্তিপূর্ণভাবে বিচ্ছেদই উত্তম।
মূল শিক্ষা:
- তালাক দেওয়ার পরও মুমিনের আচরণ হওয়া উচিত মর্যাদাপূর্ণ।
- স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া বা ঝুলিয়ে রাখা হারাম।
- আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহই মানবজীবনের দিকনির্দেশনা।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সংসারে ঝগড়া হলেও ইসলাম শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়।
- আল্লাহর হুকুমকে অবহেলা করা বা খেলা বানানো গুনাহ।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ—তাঁর ভয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা নারী ও স্বামীর পুনর্মিলনের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
- ইদ্দত শেষে: যদি স্ত্রী ইদ্দতের মেয়াদ পূর্ণ করে ফেলে এবং সে তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে আবার বিয়ে করতে চায়, তবে পরিবারের কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না।
- শর্ত: উভয়ের মধ্যে যদি সুস্থভাবে এবং ইসলামী নিয়মে পুনর্বিবাহ হয়, তবে সেটি বৈধ।
- শিক্ষা: এই বিধান তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর বিশ্বাস রাখে।
- পবিত্রতা: পুনর্বিবাহ বৈধ ও সম্মানজনক, এটিই শুচি এবং অধিক উত্তম।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক সময় পরিবার বা সমাজ তালাকপ্রাপ্তা নারীকে তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে পুনর্বিবাহে বাধা দেয়—এ আয়াত তা নিষিদ্ধ করছে।
- যদি দম্পতি সত্যিই সংশোধন করতে চায়, তবে তাদের পুনর্মিলনকে সম্মান করতে হবে।
- আজকের সমাজে তালাকপ্রাপ্তা নারীদের প্রতি কটূ আচরণ করা হয়—অথচ ইসলাম তাদের পূর্ণ সম্মান ও অধিকার দিয়েছে।
মূল শিক্ষা:
- তালাকপ্রাপ্তা নারী ইদ্দতের পর প্রাক্তন স্বামীকে চাইলে পুনর্বিবাহ করতে পারে।
- কোনো অভিভাবক বা সমাজ এ ক্ষেত্রে জোরপূর্বক বাধা দিতে পারবে না।
- আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমানদারদের জন্য এটি শিক্ষা।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলাম তালাকপ্রাপ্তা নারীর সম্মান রক্ষা করেছে।
- পরিবারের উচিত—সন্তানদের বৈধ ও শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনে সহায়ক হওয়া।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ—তাঁর বিধানেই প্রকৃত কল্যাণ রয়েছে।
এ আয়াতে সন্তানের দুধপান, মা-বাবার দায়িত্ব এবং পারিবারিক ভারসাম্য সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
- দুই বছর দুধপান: ইসলামে শিশুর পূর্ণ স্বাস্থ্য ও বিকাশের জন্য ২ বছর স্তন্যদান করা সুন্নাহ।
- বাবার দায়িত্ব: সন্তানের খরচ বাবার উপর ফরজ। খাদ্য, পোশাক, ওষুধের দায়িত্ব বাবাকেই নিতে হবে।
- মা-বাবার প্রতি ন্যায়বিচার: সন্তানকে অজুহাত বানিয়ে মাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, আবার মাকেও বাবাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।
- উত্তরাধিকারীর দায়িত্ব: বাবা মারা গেলে সন্তানের খরচ উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তাবে।
- পারস্পরিক সিদ্ধান্ত: উভয়েই আলোচনা করে যদি আগে দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তা বৈধ।
- বিকল্প দুধমা: প্রয়োজনে শিশুকে অন্য মহিলার দুধ খাওয়ানো যাবে, তবে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিতে হবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের দিনে অনেক মা ৬ মাস পরেই বাচ্চাকে কৃত্রিম খাবারে অভ্যস্ত করে—কিন্তু ইসলাম স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ২ বছর দুধপানের নির্দেশ দিয়েছে।
- বাবা অনেক সময় সন্তানের খরচ থেকে গাফিল থাকে—আয়াতটি তা নিষিদ্ধ করছে।
- অভিভাবক মারা গেলে অনাথ সন্তানের খরচ আত্মীয়দের দায়িত্ব।
- বিপন্ন পরিবারে বিকল্প দুধমার ব্যবহার বৈধ—যেমন “ফস্টার মাদার” সেবা।
মূল শিক্ষা:
- শিশুর হক হলো পূর্ণ দুই বছর মায়ের দুধ পান।
- সন্তানের খরচ বাবার দায়িত্ব, অন্য কারো নয়।
- পরিবারের সব সিদ্ধান্ত পারস্পরিক পরামর্শে হওয়া উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মা-বাবা উভয়ের প্রতি ন্যায়বিচার করতে হবে।
- সন্তানের লালন-পালনে অবহেলা করা হারাম।
- আল্লাহ সবকিছু দেখেন—তাই সন্তান ও অভিভাবকের হক আদায় করতে হবে।
এ আয়াতে বিধবা নারীর ইদ্দত সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
- ইদ্দতের মেয়াদ: স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর ইদ্দত হলো ৪ মাস ১০ দিন। এই সময়ে তিনি নতুন বিয়ে করতে পারবেন না।
- উদ্দেশ্য: এটি করা হয় মৃত স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এবং গর্ভাবস্থার সম্ভাবনা নিশ্চিত করার জন্য।
- ইদ্দত শেষে: ইদ্দত শেষ হলে বিধবা নারী তার জীবনের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের ভেতরে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—যেমন পুনরায় বিয়ে।
- আল্লাহর জ্ঞান: বান্দার প্রতিটি কাজ সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত—তাই ইদ্দতের বিধান অবহেলা করা যাবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকাল অনেক সমাজে বিধবাকে পুনর্বিবাহে বাঁধা দেয়—এ আয়াত স্পষ্ট করছে যে, ইদ্দত শেষে তার বিয়েতে কোনো দোষ নেই।
- আধুনিক সমাজে কেউ কেউ ইদ্দত না মেনে তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয়—এটি ইসলামের সীমা অতিক্রম করা।
- ইদ্দতের সময় নারীর ভরণপোষণ ও মানসিক সহায়তা পরিবারের দায়িত্ব।
মূল শিক্ষা:
- স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীকে ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে।
- ইদ্দত শেষে পুনরায় বিয়ে করা বৈধ।
- আল্লাহ বান্দার প্রতিটি কাজ সম্পর্কে অবহিত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- বিধবার ইদ্দত মানা ফরজ এবং এটি বংশরক্ষা ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য জরুরি।
- পরিবার বা সমাজের কারো অধিকার নেই তাকে বিয়ে থেকে বঞ্চিত করার।
- আল্লাহর হুকুমই প্রকৃত কল্যাণকর—তাই সেটি মানতে হবে।
এ আয়াতে ইদ্দত পালনরত নারীদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
- ইশারায় প্রস্তাব: বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারী ইদ্দতে থাকলে তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়া যাবে না, তবে ইশারায় বলা যাবে।
- অন্তরে রাখা: কেউ যদি মনে মনে বিয়ের ইচ্ছা রাখে, তাতেও দোষ নেই।
- গোপন প্রতিশ্রুতি নিষিদ্ধ: ইদ্দতের সময় গোপনে প্রতিশ্রুতি দেয়া বা সম্পর্ক তৈরি করা হারাম।
- নিকাহ সম্পাদন: ইদ্দতের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে বৈধ নয়।
- আল্লাহর জ্ঞান: অন্তরের কথাও আল্লাহ জানেন, তাই মুমিনকে সতর্ক থাকতে হবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সময় বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দতের সময়েই বিয়ের কথা উঠানো হয়—এ আয়াত তা নিয়ন্ত্রণ করেছে।
- গোপন সম্পর্ক বা প্রতিশ্রুতি ইদ্দতের সময় হারাম, যদিও সমাজে এগুলো ঘটে থাকে।
- ইসলাম শালীনভাবে ইশারা করতে দিয়েছে—যেমন, “আল্লাহ আপনার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ করুন।”
মূল শিক্ষা:
- ইদ্দতের সময় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব বৈধ নয়।
- অন্তরে বিয়ের ইচ্ছা রাখা বা ভদ্র ইশারায় বলা বৈধ।
- গোপন প্রতিশ্রুতি ও সম্পর্ক হারাম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলামের বিধান পরিবার ও সমাজকে অনৈতিকতা থেকে রক্ষা করে।
- আল্লাহর ভয় সব কাজে রাখতে হবে, কারণ অন্তরের কথাও তিনি জানেন।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল, তাই ভুল হলে তাওবা করতে হবে।
এ আয়াতে এমন নারীদের কথা বলা হয়েছে, যাদের সাথে বিয়ে হয়েছে কিন্তু সংসার শুরু হওয়ার আগে তালাক হয়েছে।
- মিলন বা মহর ছাড়া তালাক: যদি স্বামী-স্ত্রী মিলিত না হয় এবং মহরও নির্ধারণ না হয়, তবে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। এতে কোনো গুনাহ নেই।
- সান্ত্বনা উপহার: তবে স্ত্রীকে কিছু না দিয়ে ফেলে দেয়া যাবে না। সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু দিতে হবে—এটাই মানবিক ও ইসলামসম্মত আচরণ।
- ধনীর সামর্থ্য: ধনী ব্যক্তি বড় অংক দিতে পারবে, গরীব তার সামর্থ্য অনুযায়ী কম দিবে।
- মুহসিনীন: যারা আল্লাহভীরু ও সৎকর্মশীল, তারাই এ নিয়ম মেনে চলে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজে অনেকেই বিয়ের আগে বা সংসার শুরু হওয়ার আগেই বিচ্ছেদ ঘটায়—এ আয়াত তাদের জন্য নির্দেশনা।
- নারীকে অসম্মান করে ফেলে দেয়া ইসলাম অনুমোদন করে না—বরং তাকে উপহার দেয়া বাধ্যতামূলক।
- এটি নারীর সম্মান ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যম, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
মূল শিক্ষা:
- মিলন বা মহর ছাড়া তালাক দিলে কোনো গুনাহ নেই।
- তবে স্ত্রীকে কিছু দিয়ে বিদায় করা ফরজের মতো কর্তব্য।
- এতে নারীর সম্মান রক্ষা হয়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলাম তালাকপ্রাপ্তা নারীর সম্মান নিশ্চিত করেছে।
- ধনী-গরীব উভয়েই সামর্থ্য অনুযায়ী উপহার দিতে বাধ্য।
- মুমিনের পরিচয় হলো—সে সর্বদা সৎকর্মে আগ্রহী থাকে।
এ আয়াতে মহর নির্ধারণ করা সত্ত্বেও সংসার শুরু হওয়ার আগেই তালাকের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
- অর্ধেক মহর: যদি স্ত্রীকে স্পর্শ না করার আগে তালাক হয়, তবে স্ত্রী নির্ধারিত মহরের অর্ধেক পাবে।
- মাফ করা: স্ত্রী চাইলে তার প্রাপ্য অংশ মাফ করতে পারে।
- স্বামীও মাফ করতে পারে: স্বামী চাইলে স্ত্রীকে পূর্ণ মহরও দিতে পারে—এটি উত্তম।
- তাকওয়ার নিকটবর্তী: পরস্পরের সাথে ক্ষমাশীল ও উদার আচরণই তাকওয়ার প্রমাণ।
- অনুগ্রহ ভুলে যেও না: সংসার ভেঙে গেলেও পরস্পরের সাথে সৌজন্য ও দয়া প্রদর্শন করা উচিত।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সময় বিয়ের পূর্বেই তালাক হয়ে যায়—ইসলাম এ ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করেছে।
- নারীকে তার হক (অর্ধেক মহর) অবশ্যই দিতে হবে, এটি খেলো মনে করা যাবে না।
- আধুনিক সমাজে তালাকের পর অপমান ও ঝগড়া হয়, অথচ কুরআন বলছে—সৌজন্য, ক্ষমা ও অনুগ্রহ বজায় রাখতে হবে।
মূল শিক্ষা:
- সংসার শুরুর আগেই তালাক হলে নির্ধারিত মহরের অর্ধেক দিতে হবে।
- ক্ষমাশীলতা ও অনুগ্রহ তাকওয়ার পরিচয়।
- আল্লাহ সবকিছু দেখেন—তাই ন্যায়বিচার ও দয়া অপরিহার্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- তালাকের পরও সৌজন্য ও দয়া অব্যাহত রাখা মুমিনের গুণ।
- পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহ ভুলে গেলে সমাজে দ্বন্দ্ব ও অন্যায় বাড়বে।
- তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় রেখে উদারতা ও ন্যায় বজায় রাখা।
এ আয়াতে নামাযের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
- সব নামায: মুমিনের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায রক্ষা করা ফরজ।
- মধ্যবর্তী নামায: অধিকাংশ আলেমের মতে এটি আসরের নামায। কেউ কেউ ফজর বা যোহরের কথাও বলেছেন। তবে আসর নামায বেশি প্রসিদ্ধ।
- কানিতীন: আল্লাহর সামনে বিনয়ী, শ্রদ্ধাশীল ও একাগ্র হয়ে দাঁড়ানো।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ ব্যস্ত জীবনে অনেক মুসলিম নামায হালকা করে নেয়, বিশেষত আসরের সময় অবহেলা করে। এ আয়াত সেই গাফিলতিকে নিষিদ্ধ করছে।
- নামায কেবল শারীরিক ইবাদত নয়, বরং আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর এক মহান সম্মান।
- আজকের দুনিয়ায় সময় ব্যবস্থাপনা যতই কঠিন হোক, নামাযকে অগ্রাধিকার দেওয়াই প্রকৃত তাকওয়া।
মূল শিক্ষা:
- সব নামায নিয়মিতভাবে আদায় করতে হবে।
- আসর নামায বিশেষভাবে গুরুত্বের সাথে রক্ষা করতে হবে।
- নামাযে মনোযোগ, বিনয় ও আজ্ঞাবহতা অপরিহার্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- যে নামায রক্ষা করে, সে আল্লাহর সুরক্ষা পায়।
- আসর নামায বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, কারণ এ সময়ে কাজের ব্যস্ততা বেশি থাকে।
- নামায কেবল শরীর নয়, অন্তরের বিনয়ও দাবি করে।
এ আয়াতে বিপদকালীন অবস্থায় নামায পড়ার নিয়ম শেখানো হয়েছে।
- ভয়ের নামায: যুদ্ধ, ডাকাতি, বা যেকোনো শত্রু-আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে বা গাড়ি/অশ্বারোহী অবস্থায় নামায পড়া বৈধ।
- অবস্থার সাথে মানানসই: স্বাভাবিক নিয়মে পড়া সম্ভব না হলে ইশারা দিয়ে নামায আদায় করতে হবে।
- নিরাপদ হলে: পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পূর্ণাঙ্গভাবে নামায আদায় করতে হবে।
- আল্লাহর শিক্ষা: আল্লাহ বান্দাকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা বান্দা আগে জানত না—এটি তাঁর রহমতের নিদর্শন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যাত্রাপথে বা বিমানে, ট্রেনে, বাসে বসে নামায ইশারায় পড়া বৈধ, যদি দাঁড়ানো সম্ভব না হয়।
- ভ্রমণে বা কর্মক্ষেত্রে বিপদে থাকলেও নামায ছাড়া যাবে না—পরিস্থিতি অনুযায়ী সহজভাবে পড়তে হবে।
- যুদ্ধ বা বিপদের সময়ও নামায মওকুফ হয় না—এটাই ইসলামের বিশেষত্ব।
মূল শিক্ষা:
- ভয় ও বিপদের মধ্যেও নামায কখনও বাদ যাবে না।
- আল্লাহ বান্দাকে সব পরিস্থিতিতে তাঁর স্মরণে থাকতে শিক্ষা দিয়েছেন।
- পরিস্থিতি অনুযায়ী ইবাদত সহজ করে দেয়া ইসলামের সৌন্দর্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলাম বাস্তবধর্মী—যেকোনো অবস্থায় ইবাদত করার উপায় রাখা হয়েছে।
- বিপদের সময়ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে।
- আল্লাহর শিক্ষা ও বিধানই মানুষের জন্য সর্বোত্তম পথপ্রদর্শন।
এ আয়াতে বিধবা নারীর অধিকার ও ভরণপোষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- স্বামীর উইল (وصية): পূর্বে বিধান ছিল, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে এক বছর পর্যন্ত ভরণপোষণ ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। পরে ৪ মাস ১০ দিনের ইদ্দতের বিধান চূড়ান্ত হয়।
- নারীর অধিকার: বিধবা নারীকে অন্যায়ভাবে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হারাম।
- স্বাধীনতা: ইদ্দত শেষে যদি স্ত্রী নিজের সিদ্ধান্তে চলে যায় বা বিয়ে করে, তাতে দোষ নেই।
- আল্লাহর গুণ: তিনি ‘আযীয (পরাক্রমশালী) ও হাকীম (প্রজ্ঞাময়)—তাঁর বিধানে গভীর হিকমাহ আছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সময় বিধবা নারীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় বা অবহেলা করা হয়—ইসলাম এটিকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
- ইসলামে বিধবা নারীকে সম্মান দিয়ে তার ইদ্দতের সময় পূর্ণ ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে।
- ইদ্দত শেষে সে চাইলে পুনর্বিবাহ করতে পারে, পরিবার বাধা দিতে পারবে না।
মূল শিক্ষা:
- বিধবা নারীর জন্য ভরণপোষণ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা স্বামীর দায়িত্ব।
- ইদ্দত শেষে বিধবা নারী তার জীবনের ব্যাপারে স্বাধীন।
- আল্লাহর বিধান সর্বদা হিকমতপূর্ণ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলাম বিধবা নারীর সম্মান রক্ষা করেছে।
- পরিবার বা সমাজের কারো অধিকার নেই বিধবাকে কষ্ট দেওয়ার।
- আল্লাহর হুকুম মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক।
এ আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা নারীর সম্মানজনক বিদায় ও ভরণপোষণ এর কথা বলা হয়েছে।
- ভরণপোষণ: তালাকের পর স্ত্রীকে একেবারে খালি হাতে বিদায় করা ইসলাম অনুমোদন করেনি। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে কিছু দিতে হবে।
- সম্মানজনক বিদায়: তালাকপ্রাপ্তা নারীকে অপমানিত করা যাবে না। বরং সসম্মানে বিদায় দিতে হবে।
- তাকওয়াবানদের কর্তব্য: আল্লাহভীরু মানুষই এ নিয়ম মানে—অন্যরা অবহেলা করে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজে অনেক তালাকপ্রাপ্তা নারীকে অপমানিত করে খালি হাতে বিদায় দেওয়া হয়—এটি ইসলামের শিক্ষা বিরোধী।
- কেউ কেউ তালাক দিয়ে নারীর দেনমোহর বা প্রাপ্য জিনিস আটকে রাখে—এ আয়াত তা নিষিদ্ধ করছে।
- সম্মানজনকভাবে কিছু দিয়ে বিদায় করলে নারীও সমাজে মর্যাদা বজায় রাখতে পারে।
মূল শিক্ষা:
- তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য সম্মানজনকভাবে কিছু দেওয়া কর্তব্য।
- এটি আল্লাহভীরুদের বৈশিষ্ট্য।
- ইসলাম নারীর সম্মান রক্ষা করেছে এমনকি তালাকের সময়ও।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- তালাকের সময় নারীর প্রতি সদাচরণ করা ফরজের মতো কর্তব্য।
- তাকওয়া মানে কেবল নামায-রোজা নয়, বরং সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার করা।
- ইসলামের প্রতিটি আইনেই মানবিকতা বিদ্যমান।
এ আয়াত পূর্বের তালাক, ইদ্দত, ভরণপোষণ ও পারিবারিক নিয়মাবলী সম্পর্কিত আয়াতগুলোর সমাপ্তি টেনে একটি উপসংহার দিচ্ছে।
- আয়াত স্পষ্ট করা: আল্লাহর বিধান মানুষের কল্যাণের জন্য—তাই তিনি আয়াতগুলো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
- উদ্দেশ্য: মানুষ যেন অজ্ঞতার কারণে ভুল পথে না যায়, বরং বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে জীবন চালায়।
- আল্লাহর হিকমাহ: প্রতিটি হুকুমের পেছনে আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও রহমত রয়েছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই ইসলামের আইনকে পুরনো মনে করে, অথচ কুরআন বলছে—এগুলো বুদ্ধিদীপ্ত ও কল্যাণকর।
- তালাক, ইদ্দত ও নারীর অধিকার নিয়ে আজকের সমাজে যে বিভ্রান্তি আছে—আল্লাহর এই আয়াতগুলো মানুষকে সত্য শিক্ষা দেয়।
- যে ব্যক্তি কুরআনের শিক্ষা বুঝে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর বিধান মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে।
- কুরআনের প্রতিটি আইন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে।
- বুদ্ধিমান ব্যক্তি আল্লাহর আইন বুঝে গ্রহণ করে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- কুরআন অধ্যয়ন শুধু পড়ার জন্য নয়, বরং গভীরভাবে বোঝার জন্য।
- আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতিটি বিধান স্পষ্ট করেছেন।
- আসল প্রজ্ঞা হলো আল্লাহর বিধানকে মানা ও জীবনে প্রয়োগ করা।
এ আয়াতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
- মৃত্যুভয়: একদল মানুষ প্লেগ বা মহামারীর ভয়ে নিজেদের শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারা আল্লাহর উপর ভরসা না করে জীবন রক্ষায় নিজ উদ্যোগে সবকিছু করতে চেয়েছিল।
- আল্লাহর আদেশ: আল্লাহ তাদেরকে মৃত্যুবরণ করালেন—এটি শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর হুকুম থেকে কেউ রক্ষা পেতে পারে না।
- পুনরুজ্জীবিতকরণ: পরে আল্লাহ তাদেরকে আবার জীবিত করলেন—এটি ছিল কিয়ামতের দিনে পুনরুত্থানের নিদর্শন।
- আল্লাহর অনুগ্রহ: এ ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু মানুষ অধিকাংশ সময় অকৃতজ্ঞ থাকে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ রোগ বা বিপদে আল্লাহর উপর ভরসা না করে কেবল বস্তুগত উপায়ে রক্ষা পেতে চায়—এ আয়াত তাদের জন্য শিক্ষা।
- কোভিড মহামারীর সময়ও আমরা দেখেছি—মানুষ নানা চেষ্টা করলেও মৃত্যু থেকে কেউ বাঁচাতে পারেনি, আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত।
- এ আয়াত কিয়ামতের দিনের প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়—আল্লাহ মৃতকেও জীবিত করতে সক্ষম।
মূল শিক্ষা:
- মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না।
- আল্লাহ জীবন ও মৃত্যু উভয়ের উপর পূর্ণ ক্ষমতাশালী।
- মানুষকে আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ হতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- বিপদে কেবল দুনিয়াবি উপায়ে নয়, আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে।
- মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য—এই ঘটনা তার প্রমাণ।
- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মুমিনের অন্যতম প্রধান গুণ।
এ আয়াতে আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের নির্দেশনা রয়েছে।
- আল্লাহর পথে যুদ্ধ: উদ্দেশ্য হবে কেবল আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, দুনিয়াবি স্বার্থ বা ক্ষমতার লোভে নয়।
- আল্লাহ সর্বশ্রোতা: যোদ্ধার নীয়ত, দোয়া ও অভিপ্রায় আল্লাহ শোনেন।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ: আল্লাহ জানেন কারা আন্তরিকভাবে তাঁর পথে সংগ্রাম করছে আর কারা ভণ্ডামি করছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের দিনে আল্লাহর পথে সংগ্রাম মানে শুধু যুদ্ধ নয়—বরং দ্বীন প্রচার, জ্ঞান ছড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও এর অন্তর্ভুক্ত।
- যারা দ্বীন রক্ষার জন্য কলম, জ্ঞান ও দাওয়াহর মাধ্যমে কাজ করছে—তারা-ও আল্লাহর পথে সংগ্রামী।
- আল্লাহর পথে কাজ করলে মানুষের প্রশংসার জন্য নয়, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।
- যুদ্ধ বা সংগ্রাম কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বৈধ।
- আল্লাহ বান্দার প্রতিটি কথা ও কাজ জানেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুমিনদের জীবনে সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী।
- আল্লাহর পথে কাজ করতে হলে নীয়ত হতে হবে খাঁটি।
- আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ—এ বিশ্বাস বান্দাকে সঠিক পথে রাখে।
এখানে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে দান ও খরচে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহর পথে খরচ করাকে “ঋণ” বলে অভিহিত করা হয়েছে, যাতে বান্দা বুঝে যে এটি নষ্ট নয়, বরং আল্লাহ তা ফিরিয়ে দেবেন বহুগুণ বাড়িয়ে।
- কারদ্বান হাসানা: উত্তম ঋণ মানে খাঁটি নীয়তে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করা।
- বহুগুণ বৃদ্ধি: আল্লাহ একটি দানকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেন—কখনও দুনিয়াতে, কখনও আখিরাতে।
- আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ: আল্লাহ চান তো রিজিক সংকুচিত করেন, আবার চান তো প্রশস্ত করেন।
- চূড়ান্ত ফেরত: দুনিয়ার সবকিছুর হিসাব শেষে মানুষের গন্তব্য আল্লাহর কাছেই।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ মনে করে দান করলে সম্পদ কমে যাবে—আসলে আল্লাহ বলেন, দান করলে তিনি তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।
- যারা দারিদ্র্যের ভয়ে দান করে না, তারা আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়।
- আজকের “ইনভেস্টমেন্ট” এর চেয়েও আল্লাহর পথে দান সর্বোত্তম বিনিয়োগ—যার লাভ আখিরাতে অসীম।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর পথে দান করা মানে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেয়া।
- দান করলে আল্লাহ তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেন।
- রিজিকের মালিক কেবল আল্লাহ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান-খয়রাত কখনও সম্পদ কমায় না, বরং বরকত আনে।
- খাঁটি নীয়তে করা দান আখিরাতে বিশাল সওয়াবের কারণ হবে।
- শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকের হিসাব আল্লাহর কাছেই দিতে হবে।
এ আয়াতে বনী ইসরাঈলের ইতিহাস থেকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
- রাজা চাওয়া: বনী ইসরাঈল তাদের নবীর কাছে অনুরোধ করেছিল—একজন রাজা নিযুক্ত করুন, আমরা যুদ্ধ করব।
- নবীর সতর্কবাণী: নবী বললেন—“যদি যুদ্ধ ফরজ হয়, তোমরা হয়তো তা পালন করবে না।”
- তাদের দাবি: তারা বলল—“আমরা কিভাবে যুদ্ধ না করি, যখন আমাদের ঘরবাড়ি ও সন্তানছাড়া হতে হয়েছে?”
- বাস্তবতা: যখন যুদ্ধ বাস্তবেই ফরজ করা হলো, তারা পেছনে সরে গেল—অল্প কয়েকজন বাদে।
- আল্লাহর জ্ঞান: আল্লাহ জানেন কারা জালিম—অর্থাৎ যারা কথা বলে কিন্তু কাজে তা বাস্তবায়ন করে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ দ্বীনের জন্য বড় বড় কথা বলে, কিন্তু যখন ত্যাগের সময় আসে তখন পিছিয়ে যায়।
- দাওয়াহ, ইলম শিক্ষা, দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেকে মুখে প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজে সক্রিয় হয় না।
- এ আয়াত আমাদেরকে সতর্ক করছে—আল্লাহর পথে শুধু মুখের প্রতিশ্রুতি নয়, কাজের মাধ্যমে অংশ নিতে হবে।
মূল শিক্ষা:
- মুমিনকে আল্লাহর পথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।
- কথায় নয়, কাজে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ জরুরি।
- আল্লাহ জালিমদের সম্পর্কে অবহিত—তাদের পরিণতি ভালো হবে না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুখের কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকতে হবে।
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া সম্ভব নয়।
- যারা আল্লাহর আদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।
এ আয়াতে তালূতের রাজত্ব সম্পর্কিত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
- রাজা নির্বাচন: বনী ইসরাঈল রাজা চেয়েছিল—আল্লাহ তালূতকে তাদের জন্য মনোনীত করলেন।
- তাদের আপত্তি: তারা বলল—“তালূতের কাছে ধন-সম্পদ নেই, কিভাবে সে রাজা হবে?”
- আল্লাহর মানদণ্ড: রাজত্বের যোগ্যতা ধনসম্পদ নয়, বরং জ্ঞান, শক্তি ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনয়ন।
- আল্লাহর ইচ্ছা: আল্লাহ যাকে চান তাকেই রাজত্ব দেন—মানুষের মানদণ্ডের উপর নির্ভর করে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ নেতৃত্ব নির্ধারণ করে সম্পদ ও সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে, অথচ আল্লাহর দৃষ্টিতে যোগ্যতা হলো জ্ঞান, তাকওয়া ও সক্ষমতা।
- অনেক সময় গরীব বা সাধারণ মানুষকেই আল্লাহ নেতৃত্বে উন্নীত করেন, যেমন নবীদের অধিকাংশই ধনী ছিলেন না।
- এ আয়াত আমাদের শেখায়—আল্লাহর সিদ্ধান্তই সর্বোত্তম, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ।
মূল শিক্ষা:
- নেতৃত্ব আল্লাহর দান—এটি ধনসম্পদের উপর নির্ভর করে না।
- জ্ঞান ও শক্তি একজন নেতার মূল গুণ।
- আল্লাহ সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ—তিনিই সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে রাখেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মানুষকে তার সম্পদের কারণে বিচার করা উচিত নয়।
- আল্লাহ যাকে যোগ্য মনে করেন তাকেই দায়িত্ব দেন।
- নেতৃত্বের প্রকৃত মানদণ্ড হলো জ্ঞান, তাকওয়া ও যোগ্যতা।
এ আয়াতে তালূতের রাজত্বের নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে।
- তাবূত (সিন্দুক): এটি ছিল বনী ইসরাঈলের কাছে পবিত্র একটি সিন্দুক, যেখানে ছিল মূসা (আঃ) ও হারূন (আঃ)-এর পরিবার থেকে অবশিষ্ট কিছু বস্তু—যেমন লাঠি, পবিত্র পাথরের ফলক, কিছু জামা ইত্যাদি।
- সাকীনাহ: এই সিন্দুক তাদের জন্য প্রশান্তি ও আল্লাহর রহমতের প্রতীক ছিল।
- ফেরেশতাদের বহন: ফেরেশতারা এই সিন্দুক তাদের কাছে নিয়ে আসবে—এটাই তালূতের রাজত্বের প্রমাণ।
- নিদর্শন: এটি ছিল বনী ইসরাঈলের জন্য এক বিশেষ আল্লাহর নিদর্শন, যা তাদের ঈমান দৃঢ় করার জন্য দেয়া হয়েছিল।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ নেতৃত্ব নির্ধারণে বস্তুগত প্রমাণ চায়—এ আয়াতে শেখানো হয়েছে যে, আল্লাহর নিদর্শনই প্রকৃত প্রমাণ।
- মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক সাকীনাহ (অন্তরের শান্তি) আছে—যেমন কুরআন, নামায, দোয়া।
- যারা ঈমানদার, তারা আল্লাহর নিদর্শনগুলো চিনতে পারে; আর যারা কাফের, তারা এগুলো উপেক্ষা করে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ যাকে নেতৃত্ব দেন, তাঁর নিদর্শনও প্রদান করেন।
- আল্লাহর নিদর্শনগুলো ঈমানকে দৃঢ় করে।
- সাকীনাহ (আত্মার প্রশান্তি) কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর নিদর্শন চিনতে ও মানতে হবে।
- নেতৃত্বের প্রকৃত প্রমাণ হলো আল্লাহর মনোনয়ন ও তাঁর নিদর্শন।
- আল্লাহ মুমিনদের জন্য অন্তরের প্রশান্তি প্রদান করেন।
এখানে তালূতের সৈন্যদের পরীক্ষা ও ধৈর্যের শিক্ষা বর্ণনা করা হয়েছে।
- নদীর পরীক্ষা: সৈন্যদেরকে বলা হলো—যে পান করবে সে বাদ, যে বিরত থাকবে সে তালূতের সাথে থাকবে। অল্প পরিমাণ নেওয়া বৈধ ছিল।
- অধিকাংশ ব্যর্থ: অধিকাংশ সৈন্য পান করে ফেলল, অল্প কিছু ঈমানদারই ধৈর্য ধরে রইল।
- নদী পার হওয়ার পর: দুর্বলরা বলল—আমরা জালূতের মোকাবেলা করতে পারব না।
- সাবেক মুমিনদের বক্তব্য: তারা বলল—আল্লাহর অনুমতিতে ছোট দলও বড় দলকে হারাতে পারে।
- আল্লাহর সাহায্য: ধৈর্যশীলদের সাথেই আল্লাহ থাকেন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের যুগে দ্বীনের পথে কাজ করতে গেলে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়—কেউ টিকে থাকে, কেউ ব্যর্থ হয়।
- সংখ্যা কম হলেও যদি ঈমান দৃঢ় হয়, তবে আল্লাহর সাহায্যে বিজয় সম্ভব।
- অনেক সময় মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি হলেও দুর্বল বিশ্বাসের কারণে শত্রুর কাছে পরাজিত হয়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন।
- সংখ্যা নয়, বরং ঈমান ও ধৈর্যই বিজয়ের আসল উপাদান।
- আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দুনিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ধৈর্য অপরিহার্য।
- আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো দল বিজয়ী হতে পারে না।
- আল্লাহর পথে ছোট দলও বড় দলকে পরাজিত করতে সক্ষম।
এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে মুমিনদের দোয়া, যখন তারা জালূতের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়।
- ধৈর্যের দোয়া: তারা আল্লাহর কাছে প্রথমেই ধৈর্য প্রার্থনা করেছে। কারণ বিজয়ের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো ধৈর্য।
- দৃঢ় পদক্ষেপ: তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে যেন ভয় বা আতঙ্কে তাদের পদক্ষেপ টলে না যায়।
- বিজয়ের দোয়া: তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য চেয়েছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মুমিনরা নানা চ্যালেঞ্জ ও শত্রুর সম্মুখীন হয়—তাদের জন্য এ দোয়া একটি আদর্শ।
- জীবনের যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে প্রথমে ধৈর্য, তারপর দৃঢ়তা, শেষে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে।
- এই দোয়া আজও আমাদের নামাযে, কষ্টে ও পরীক্ষায় আদর্শ দোয়া হিসেবে পড়া উচিত।
মূল শিক্ষা:
- বিজয়ের মূল চাবিকাঠি হলো ধৈর্য ও আল্লাহর সাহায্য।
- মুমিনদের শক্তি সংখ্যায় নয়, বরং তাদের ঈমান, ধৈর্য ও দোয়ায়।
- আল্লাহ ছাড়া কোনো সাহায্য কার্যকর নয়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- কোনো বড় বিপদের সময় আল্লাহর কাছে ধৈর্য চাইতে হবে।
- দৃঢ় বিশ্বাসই মুমিনকে ভয় থেকে মুক্ত রাখে।
- আল্লাহর সাহায্য ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়।
এ আয়াতে দাউদ (আঃ)-এর বিজয় ও আল্লাহর হিকমাহ বর্ণনা করা হয়েছে।
- বিজয়: তালূতের অল্প সংখ্যক সৈন্য আল্লাহর অনুমতিতে জালূতের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করল।
- দাউদের ভূমিকা: তখন তরুণ দাউদ (আঃ) জালূতকে হত্যা করলেন—পরে তিনি নবী ও রাজা হন।
- আল্লাহর অনুগ্রহ: আল্লাহ তাঁকে রাজত্ব, হিকমাহ (প্রজ্ঞা), এবং বিশেষ জ্ঞান দান করলেন।
- আল্লাহর ব্যবস্থা: যদি আল্লাহ একদলকে আরেকদল দ্বারা প্রতিরোধ না করতেন, তবে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত।
- আল্লাহর ফজল: দুনিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করা আল্লাহর রহমতের নিদর্শন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও পৃথিবীতে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যার সংঘর্ষ হয়—আল্লাহ চান সত্য বিজয়ী হোক, এজন্য তিনি ভারসাম্য তৈরি করেন।
- দাউদ (আঃ)-এর ঘটনা শেখায়—যুবকরা ঈমান ও সাহস নিয়ে বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে।
- যদি আল্লাহর এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকত, তবে জালিমরা পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলত।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর অনুমতিই বিজয়ের মূল চাবিকাঠি।
- দাউদ (আঃ)-কে আল্লাহ রাজত্ব, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলেন।
- আল্লাহ মানুষকে একে অপরের দ্বারা প্রতিরোধ না করলে পৃথিবী নষ্ট হয়ে যেত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- বিজয়ের জন্য ঈমান ও আল্লাহর সাহায্য অপরিহার্য।
- আল্লাহই রাজত্ব ও প্রজ্ঞার দাতা।
- পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করা আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী বর্ণিত ঘটনা (তালূত, জালূত, দাউদ (আঃ)-এর বিজয় ইত্যাদি) সমাপ্ত করে নবী করিম ﷺ-এর প্রতি কুরআনের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
- আয়াতের সত্যতা: এগুলো কোনো কল্পকাহিনী নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য।
- রাসূলত্বের প্রমাণ: এসব আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর সত্যিকারের প্রেরিত নবী।
- কুরআনের উদ্দেশ্য: বান্দাদের শিক্ষা দেয়া, সঠিক পথ দেখানো ও ইতিহাস থেকে নসীহত গ্রহণ করানো।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কুরআনের প্রতিটি আয়াত সত্য—মানুষ বিজ্ঞানের মাধ্যমে, ইতিহাসের মাধ্যমে তার প্রমাণ পাচ্ছে।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর সত্যিকার রাসূল—এ বিশ্বাস মুমিনের ঈমানের অংশ।
- কুরআনের শিক্ষা উপেক্ষা করলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়।
মূল শিক্ষা:
- কুরআনের প্রতিটি আয়াত সত্য ও প্রমাণিত।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর প্রেরিত নবী।
- আল্লাহ বান্দাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা দেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- কুরআনকে গল্প মনে না করে হিদায়াতের উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুসরণ করা ঈমানের শর্ত।
- আল্লাহর বাণী সর্বদা সত্য, চিরকালীন এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর।
এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলদের মর্যাদা, তাদের বৈশিষ্ট্য ও পরবর্তী উম্মতদের অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন।
- রাসূলদের মর্যাদা: সব রাসূল সমান নন—কারো মর্যাদা অন্যের চেয়ে বেশি। যেমন: মূসা (আঃ)-এর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, মুহাম্মদ ﷺ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
- ঈসা (আঃ): তাঁকে আল্লাহ স্পষ্ট মুজিযা (অলৌকিক প্রমাণ) দিয়েছেন এবং রূহুল কুদুস (জিবরাইল আঃ)-এর মাধ্যমে সাহায্য করেছেন।
- উম্মতের ভিন্নমত: রাসূলগণের পরবর্তী মানুষরা সত্য প্রমাণ পাওয়ার পরও বিভক্ত হয়েছে—কারো ঈমান এসেছে, কেউ কুফর করেছে।
- আল্লাহর ইচ্ছা: সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে ঘটে, তিনি যা চান তাই করেন।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মুসলিম উম্মাহ মতভেদে বিভক্ত—যা রাসূলগণের পরবর্তী উম্মতের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি।
- অনেকে কুরআনের স্পষ্ট শিক্ষা জেনেও মানে না—এটি পূর্ববর্তী জাতির মতোই।
- আমাদের উচিত রাসূলদের প্রতি ঈমান রাখা এবং বিভক্তি এড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
মূল শিক্ষা:
- সব রাসূলই আল্লাহর প্রেরিত, তবে মর্যাদায় পার্থক্য আছে।
- ঈসা (আঃ) ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নিদর্শনসহ প্রেরিত নবী।
- মানুষ বিভক্ত হয় আল্লাহর ইচ্ছায়, আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আল্লাহর।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- রাসূলদের প্রতি সম্মান ও ঈমান রাখা অপরিহার্য।
- মানব ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে, সত্য প্রমাণ পাওয়ার পরও বিভক্তি এড়াতে হলে তাকওয়া দরকার।
- আল্লাহ সর্বশক্তিমান—তিনি যা চান তাই বাস্তবায়ন করেন।
এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদেরকে দান-খয়রাত ও আল্লাহর পথে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
- আল্লাহর দেয়া রিযিক: যা কিছু মানুষ উপার্জন করে, আসলে তা আল্লাহর দান। তাই তাঁর পথে ব্যয় করা অপরিহার্য।
- কিয়ামতের দিন: সেই দিন টাকা-পয়সা, লেনদেন, বন্ধুত্ব বা কোনো সুপারিশ কাজে লাগবে না—সেদিন শুধু ঈমান ও আমল সহায়ক হবে।
- কাফেরদের পরিণতি: যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে, তারা নিজেরাই জালিম।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ দানকে অপচয় মনে করে, অথচ আল্লাহ বলেন এটি আখিরাতের জন্য আসল সঞ্চয়।
- দুনিয়াতে টাকা দিয়ে অনেক কিছু কেনা যায়, কিন্তু কিয়ামতের দিন কোনো টাকা বা সম্পর্ক কাজে লাগবে না।
- আল্লাহর পথে ব্যয় না করলে, সেই ধন-সম্পদ আখিরাতে শাস্তির কারণ হতে পারে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করা ঈমানের প্রমাণ।
- কিয়ামতের দিন শুধু ঈমান ও নেক আমল কাজে লাগবে।
- যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তারা নিজেদের উপর জুলুম করে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দুনিয়ার ধন-সম্পদ আখিরাতে কোনো কাজে লাগবে না।
- মুমিনকে আল্লাহর দেয়া রিযিকের একটি অংশ অবশ্যই তাঁর পথে ব্যয় করতে হবে।
- দান ও খরচই আখিরাতের প্রকৃত পুঁজি।
এই আয়াতটি কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত হিসেবে পরিচিত। এতে আল্লাহর মহত্ত্ব, শক্তি ও একত্ববাদের ঘোষণা আছে।
- আল্লাহর একত্ব: আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই।
- চিরঞ্জীব ও সর্বপ্রতিপালক: তিনি সবকিছুর ধারক-বাহক, তাঁর অস্তিত্ব চিরন্তন।
- নিদ্রাহীন: তাঁকে ঘুম বা তন্দ্রা কখনো স্পর্শ করে না।
- মালিকানা: আসমান-জমিনের সবকিছু কেবল আল্লাহর।
- জ্ঞান: তিনি সবকিছু জানেন—মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
- কুরসী: তাঁর কুরসী আসমান-জমিনকে পরিবেষ্টন করেছে।
- পরাক্রম: সবকিছু রক্ষা করা তাঁর জন্য সহজ; তিনি মহান, পরাক্রমশালী।
হাদীস থেকে শিক্ষা:
- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “আয়াতুল কুরসী কুরআনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আয়াত।” (সহিহ মুসলিম)
- যে ব্যক্তি প্রতিদিন ফজরের পর ও ইশার পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন।
- শয্যায় যাওয়ার আগে আয়াতুল কুরসী পড়লে শয়তান নিকটবর্তী হতে পারে না। (সহিহ বুখারি)
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহই একমাত্র উপাস্য—তিনি সর্বশক্তিমান।
- আল্লাহর জ্ঞান সীমাহীন, তাঁর কুরসী আসমান-জমিনকে পরিবেষ্টন করেছে।
- আল্লাহর হেফাজতে যারা থাকে, তাদের উপর শয়তান প্রভাব ফেলতে পারে না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আয়াতুল কুরসী নিয়মিত পড়া মুমিনের ঈমানকে দৃঢ় করে।
- আল্লাহর অসীম মহত্ত্ব ও ক্ষমতা উপলব্ধি করা উচিত।
- দুনিয়া ও আখিরাতের সুরক্ষার জন্য এ আয়াত সর্বোত্তম রক্ষা কবচ।
এ আয়াতে ইসলাম একটি স্বাধীন ইচ্ছার ধর্ম হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
- কোনো জবরদস্তি নেই: ইসলাম মানুষকে জোর করে গ্রহণ করানো হয় না। সত্য-মিথ্যা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, এখন মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে।
- রুশদ ও গয়্য: সত্য পথ (ইসলাম) ও ভ্রান্তি (কুফর, শিরক) একেবারে স্পষ্ট।
- তাগূতকে অস্বীকার: তাগূত মানে আল্লাহ ছাড়া যেকোনো উপাস্য, শয়তান বা জালিম শাসক—তাকে অস্বীকার করতে হবে।
- দৃঢ় হাতল: আল্লাহতে ঈমান রাখা হলো এমন এক অটুট হাতল ধরা, যা কখনো ভাঙবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক জায়গায় মানুষ ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয় যে এটি জোর করে চাপিয়ে দেয়, অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে বলছে—“ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।”
- ইসলামের সৌন্দর্য হলো এটি যুক্তি, প্রমাণ ও হিদায়াত দিয়ে মানুষকে আহ্বান করে।
- যারা আল্লাহকে মানে এবং শিরক-তাগূত অস্বীকার করে, তারাই আসল মুক্তির পথ ধরে।
মূল শিক্ষা:
- ইসলামে কারো উপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া নেই।
- সত্য ও ভ্রান্তি স্পষ্ট—এখন মানুষের পছন্দের উপর নির্ভর করছে।
- তাগূত অস্বীকার করা এবং আল্লাহতে ঈমান আনা অপরিহার্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সত্য পথ ও ভ্রান্তি আলাদা—মানুষকে জোর করে নয়, বরং প্রমাণ দিয়ে বুঝানো উচিত।
- আল্লাহর উপর ভরসা করা মানেই দৃঢ় হাতল আঁকড়ে ধরা।
- আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ—তাঁর কাছে কিছুই গোপন নয়।
এ আয়াতে মুমিন ও কাফেরদের পরিণতির স্পষ্ট পার্থক্য বর্ণিত হয়েছে।
- মুমিনদের অবস্থা: আল্লাহ তাঁদের ওলী (অভিভাবক, রক্ষাকারী)। তিনি তাঁদের কুফর, শিরক, অজ্ঞতা ও পাপের অন্ধকার থেকে ঈমান, হিদায়াত ও নূরের পথে বের করে আনেন।
- কাফেরদের অবস্থা: তাঁদের ওলী বা অভিভাবক হলো তাগূত—শয়তান, মিথ্যা দেবতা, জালিম নেতা ইত্যাদি। তারা মানুষকে আলোর পথ (ফিতরাত ও সত্য) থেকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
- পরিণতি: মুমিনরা আলোতে আল্লাহর রহমতে বেঁচে থাকে, আর কাফেররা জাহান্নামে চিরকালীন শাস্তি ভোগ করবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ যারা ইসলামের শিক্ষা মেনে চলে, তারা আল্লাহর নূরের পথে চলছে; আর যারা শয়তানী মতবাদে চলে, তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত।
- আধুনিক যুগে মিথ্যা মতবাদ, ভোগবাদ, নাস্তিকতা ও জালিম নেতৃত্ব মানুষের জন্য তাগূতের ভূমিকা পালন করছে।
- কেবল আল্লাহর নির্দেশ মানলেই মানুষ প্রকৃত নূর ও শান্তি পেতে পারে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহই মুমিনদের অভিভাবক ও রক্ষাকারী।
- তাগূত কাফেরদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়।
- মুমিনের গন্তব্য জান্নাত, কাফেরের গন্তব্য জাহান্নাম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুমিনদের আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত, কারণ তিনিই অভিভাবক।
- কুফর ও শিরক মানুষকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।
- জীবনে সঠিক পথ বেছে নিতে হলে আল্লাহর নূরের অনুসরণ করতে হবে।
এখানে ইবরাহীম (আঃ) ও এক জালিম রাজা (নমরূদ)-এর বিতর্ক বর্ণনা করা হয়েছে।
- নমরূদের অহংকার: আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু সে তা নিয়ে অহংকার করল এবং নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ ভাবল।
- ইবরাহীম (আঃ)-এর যুক্তি: তিনি বললেন—আমার প্রতিপালক জীবন দেন ও মৃত্যু ঘটান।
- নমরূদের ধোঁকা: সে বলল—আমিও হত্যা করি ও ছেড়ে দেই, তাই আমি জীবন ও মৃত্যু দিই।
- চূড়ান্ত যুক্তি: ইবরাহীম (আঃ) বললেন—আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব থেকে উদয় করেন, তুমি পশ্চিম থেকে উদয় করো। এতে সে হতবাক হয়ে গেল।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক নেতা ও শাসক নিজেদের ক্ষমতায় গর্ব করে, আল্লাহকে ভুলে যায়।
- নাস্তিকরা আল্লাহর সৃষ্টিকে অস্বীকার করে, কিন্তু সূর্যের মতো নিদর্শনের সামনে তারা চুপ হয়ে যায়।
- এ আয়াত আমাদের শেখায়—সত্যের সামনে মিথ্যা টিকতে পারে না।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহই জীবন ও মৃত্যুর দাতা।
- মানুষ যত শক্তিশালী হোক, আল্লাহর সামনে সে অসহায়।
- আল্লাহ জালিমদের কখনও হিদায়াত দেন না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- অহংকার মানুষকে আল্লাহকে অস্বীকারে ঠেলে দেয়।
- মুমিনের যুক্তি সবসময় সত্যের উপর ভিত্তি করে।
- আল্লাহর নিদর্শন (যেমন সূর্য) মানুষকে সঠিক পথে আসার জন্য যথেষ্ট।
এ আয়াতে আল্লাহ একজন ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যাকে শত বছর মেরে আবার জীবিত করা হয়েছিল।
- ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ: একজন ব্যক্তি একটি ধ্বংসস্তূপ নগর দেখে অবাক হয়ে বলল—আল্লাহ কিভাবে একে আবার জীবিত করবেন?
- আল্লাহর পরীক্ষা: আল্লাহ তাকে ১০০ বছর মৃত্যু অবস্থায় রাখলেন, তারপর পুনরুজ্জীবিত করলেন।
- প্রমাণ: তার খাদ্য ও পানীয় অপরিবর্তিত রইল, কিন্তু তার গাধা হাড়ে পরিণত হলো—পরে আল্লাহ সেটিকে পুনর্জীবিত করলেন।
- ফলাফল: সে বুঝল যে আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান, মৃত্যুর পর জীবিত করা তাঁর জন্য সহজ।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের যুগে অনেক নাস্তিক কিয়ামত ও পুনরুত্থান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে—এই ঘটনা তাদের জন্য শিক্ষা।
- আল্লাহ যেমন শত বছর পর মৃতকে জীবিত করতে পারেন, তেমনি কিয়ামতের দিন সব মানুষকে পুনর্জীবিত করবেন।
- আধুনিক বিজ্ঞান মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে পারলেও পুনর্জীবিত করতে পারে না—এটি কেবল আল্লাহরই ক্ষমতা।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম।
- পুনরুত্থান (কিয়ামত) অবশ্যই ঘটবে।
- আল্লাহর নিদর্শন মানুষের জন্য শিক্ষা।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মানুষের জ্ঞান সীমিত, আল্লাহর ক্ষমতা সীমাহীন।
- কবর থেকে মানুষকে পুনর্জীবিত করা আল্লাহর জন্য সহজ।
- মুমিনকে আল্লাহর নিদর্শন দেখে ঈমান আরও দৃঢ় করতে হবে।
এখানে ইবরাহীম (আঃ)-এর একটি বিশেষ দোয়া ও আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে।
- ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রশ্ন: তিনি আল্লাহর কাছে জানতে চান—মৃতকে কীভাবে জীবিত করা হয়। এটি সন্দেহ নয়, বরং অন্তরকে প্রশান্ত করার জন্য।
- চারটি পাখি: আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন চারটি পাখি নিয়ে টুকরো টুকরো করতে এবং পাহাড়ে ভাগ করে রাখতে।
- অলৌকিক ঘটনা: ইবরাহীম (আঃ) ডাক দিলে সেগুলো আল্লাহর নির্দেশে জীবিত হয়ে তাঁর কাছে ফিরে এলো।
- আল্লাহর গুণাবলি: এতে প্রমাণ হলো আল্লাহ অতি পরাক্রমশালী ও হিকমতের অধিকারী।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ প্রায়ই পুনরুত্থান নিয়ে সন্দেহ করে—এই আয়াত প্রমাণ করে কিয়ামতের দিন মৃতকে জীবিত করা আল্লাহর জন্য সহজ।
- যেমন বিজ্ঞানীরা জীবনের রহস্য খুঁজে চলেছে, কিন্তু জীবন সৃষ্টির ক্ষমতা কেবল আল্লাহর।
- মুমিনের জন্য ঈমান শুধু বিশ্বাস নয়, বরং অন্তরের প্রশান্তির জন্য আল্লাহর নিদর্শনগুলো চিনে নেওয়া জরুরি।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতার একমাত্র মালিক।
- ঈমানকে দৃঢ় করতে আল্লাহ নিদর্শন দেখান।
- আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ঈমান শুধু মুখের কথা নয়, অন্তরের প্রশান্তিও দরকার।
- আল্লাহর নিদর্শন চিনলে ঈমান আরও দৃঢ় হয়।
- কিয়ামতের দিনে আল্লাহ মৃতদের পুনর্জীবিত করবেন—এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর পথে ব্যয়কারীদের পুরস্কারকে এক সুন্দর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন।
- শস্য দানা: যেমন একটি দানা থেকে সাতটি শীষ হয়, প্রতিটি শীষে থাকে ১০০ দানা—এভাবে একটি দানা ৭০০ গুণে পরিণত হয়।
- আল্লাহর গুণ বৃদ্ধি: আল্লাহ তাঁর ইচ্ছামতো আরও বেশি গুণ বৃদ্ধি করেন।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ: তিনি জানেন কার দান নিঃস্বার্থ ও খাঁটি ঈমান থেকে এসেছে, আর কারটা লোক দেখানো।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য দান করে, তার দান ছোট মনে হলেও আল্লাহর কাছে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
- যেমন একটি মসজিদ নির্মাণে অল্প টাকা দিলেও তার সওয়াব চলতে থাকবে যতদিন মানুষ নামায পড়বে।
- এভাবে দুনিয়াতে ছোট কাজ করলেও আখিরাতে তার ফল বিশাল হতে পারে।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর পথে দান করলে তার পুরস্কার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
- সওয়াব নির্ভর করে নিয়তের উপর।
- আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা আসলেই আখিরাতের সর্বোত্তম বিনিয়োগ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মুমিনকে নিয়মিত দান-সদকা করতে হবে।
- লোক দেখানো বা স্বার্থপরভাবে নয়, বরং খাঁটি নিয়তে দান করতে হবে।
- আল্লাহই সওয়াবকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।
এ আয়াতে আল্লাহ দান করার সঠিক আদব শিখিয়েছেন।
- আল্লাহর পথে দান: দান কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
- মান-গণনা নয়: দান করার পর কাউকে মনে করিয়ে দেওয়া, দান নিয়ে বড়াই করা নিষিদ্ধ।
- কষ্ট না দেওয়া: দান করার পর দুঃখ দেওয়া বা কষ্ট দেওয়া দানকে নষ্ট করে দেয়।
- পুরস্কার: যারা নিঃস্বার্থভাবে দান করে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে চিরস্থায়ী পুরস্কার রয়েছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই দান করার পর ছবি তোলে, প্রচার করে বা দানগ্রহীতাকে ছোট করে—এটি আয়াতের বিপরীত।
- যদি কেউ গরিবকে সাহায্য করে এবং পরে তাকে কষ্ট দেয়, তার সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।
- অন্যদিকে নিঃস্বার্থভাবে গোপনে দান করলে আল্লাহর কাছে বহুগুণ পুরস্কার পাওয়া যায়।
মূল শিক্ষা:
- দান করার পর উপকারের দোহাই দেওয়া যাবে না।
- দান করার পর কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
- আল্লাহর কাছে নিঃস্বার্থ দানের পুরস্কার চিরস্থায়ী।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দানকে গোপনে ও খাঁটি নিয়তে করা উচিত।
- দান করার পর কখনো তা নিয়ে অহংকার বা অপমান করা যাবে না।
- আল্লাহ নিঃস্বার্থ দাতাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে নির্ভয়তা ও শান্তি দান করবেন।
এ আয়াতে দানের আদব আরও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
- ভালো কথা: দরিদ্রকে সুন্দর ও ভদ্রভাবে কথা বলা, তার মানসম্মান রক্ষা করা।
- ক্ষমা করা: যদি কেউ চেয়ে কষ্ট দেয়, তবে তাকে ক্ষমা করা আল্লাহর প্রিয় কাজ।
- দান ও অপমান: দানের পরে যদি কষ্ট দেওয়া হয়, তবে তা নষ্ট হয়ে যায়; বরং ভালো কথা ও ক্ষমা দানের চেয়েও উত্তম।
- আল্লাহর গুণ: আল্লাহ অভাবমুক্ত, তিনি কারো দানের প্রয়োজনীয় নন; তিনি সহনশীল ও ধৈর্যশীল।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকাল অনেকেই দান করার পর ছবি তোলে, প্রচার করে বা দরিদ্রকে অপমান করে—এতে সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।
- কাউকে দান না করলেও ভালোভাবে কথা বলা ও সান্ত্বনা দেওয়া অনেক বড় ইবাদত।
- মানুষকে ক্ষমা করা ও তার মানসিক কষ্ট লাঘব করাও আল্লাহর কাছে দানের সমান সওয়াব এনে দেয়।
মূল শিক্ষা:
- দান করার পর অপমান করলে তার কোনো মূল্য নেই।
- ভালো কথা বলা ও ক্ষমা করাই উত্তম।
- আল্লাহ অভাবমুক্ত, মানুষের প্রয়োজনের জন্যই দান নির্ধারিত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- মানুষকে সদাচরণ ও ক্ষমার মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে।
- দান করলে অবশ্যই সম্মান বজায় রাখতে হবে।
- আল্লাহর কাছে দান তখনই কবুল হয়, যখন তা খাঁটি নিয়তে হয়।
এই আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের সতর্ক করছেন যে দান এমনভাবে করতে হবে, যাতে তা নষ্ট না হয়।
- মান ও আযা: দান করার পর উপকারের দোহাই দেওয়া বা কাউকে কষ্ট দেওয়া দানকে নষ্ট করে ফেলে।
- রিয়াকারের দান: যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং লোক দেখানোর জন্য দান করে, তাদের দান আল্লাহ কবুল করেন না।
- পাথরের দৃষ্টান্ত: লোক দেখানো দান এমন পাথরের মতো, যার উপর পাতলা মাটি আছে। প্রবল বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে যায়—অবশেষে কিছুই থাকে না।
- কাফেরদের পরিণতি: এরা কেবল দুনিয়ার প্রশংসা পায়, আখিরাতে কিছুই পায় না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে আজ দান করার পর সামাজিক মাধ্যমে ছবি দেয়, প্রচার করে—এতে দানের সওয়াব কমে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়।
- কেউ কাউকে সাহায্য করার পর তাকে অপমান করলে সেই দান বৃথা হয়।
- আল্লাহর পথে দান করতে হলে নিঃস্বার্থ হতে হবে, মানুষের প্রশংসার জন্য নয়।
মূল শিক্ষা:
- দান করার পর মান-গণনা বা কষ্ট দেওয়া যাবে না।
- রিয়াকারীর দান আল্লাহ কবুল করেন না।
- আল্লাহর পথে দান করলে তা শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান করার পর মানুষের উপর উপকারের দোহাই দেওয়া নিষিদ্ধ।
- দান শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য করতে হবে।
- মানুষের প্রশংসা পেতে নয়, বরং আখিরাতের সওয়াবের জন্য দান করা উচিত।
এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর পথে খাঁটি নিয়তে দানকারীদের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।
- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান: যারা শুধু আল্লাহর জন্য দান করে, লোক দেখানোর জন্য নয়।
- অন্তরের দৃঢ়তা: তারা দানের মাধ্যমে নিজেদের ঈমানকে মজবুত করে।
- বাগানের উদাহরণ: পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত উর্বর বাগান প্রচুর ফল দেয়, প্রবল বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফল হয়। এমনকি শিশির পড়লেও তা ফলবতী হয়।
- আল্লাহর দৃষ্টি: তিনি সবকিছু দেখেন—কোন দান খাঁটি, আর কোনটা লোক দেখানো।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণে বা গরিবকে সাহায্যে গোপনে দান করে, তার দান আল্লাহর কাছে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
- আজও কেউ যদি দান করে শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা পাহাড়ি বাগানের মতো ফলদায়ক হয়।
- অল্প হলেও খাঁটি দান আল্লাহর কাছে অনেক বড়।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাঁটি নিয়তে দান করতে হবে।
- খাঁটি দান অল্প হলেও আল্লাহ তার ফল বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।
- আল্লাহ আমাদের সবকিছু দেখেন ও জানেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান করার সময় নিয়তকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শুদ্ধ রাখতে হবে।
- লোক দেখানো দান বৃথা, কিন্তু খাঁটি দান সামান্য হলেও ফলপ্রসূ।
- আল্লাহর পথে দান করলে দুনিয়া ও আখিরাতে তার সুফল পাওয়া যায়।
এই আয়াতে দান ও নেক আমলের ভুল নিয়তের পরিণতি বোঝাতে একটি উপমা দেয়া হয়েছে।
- ফলবতী বাগানের দৃষ্টান্ত: একজন ব্যক্তির সুন্দর বাগান আছে—যেখানে খেজুর, আঙুর ও সব ধরনের ফল রয়েছে, নদী প্রবাহিত হচ্ছে।
- বার্ধক্য ও সন্তান: যখন সে বৃদ্ধ হয়েছে এবং দুর্বল সন্তান রয়েছে—তখন সে ওই বাগানের উপর নির্ভর করছে।
- ঝড় ও আগুন: হঠাৎ ঝড় ও আগুন এসে বাগানটিকে ধ্বংস করে দিল—তার সব আশা ভেঙে গেল।
- অর্থ: যারা দান-সদকা করে, কিন্তু পরে তা নষ্ট করে ফেলে (রিয়া, মান-গণনা, কষ্ট দেওয়ার কারণে)—আখিরাতে তাদের আমলও এমন ধ্বংস হয়ে যাবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ জীবনের শেষদিকে এসে নেক আমলের আশা করে, কিন্তু যদি সে পূর্বেই আমল নষ্ট করে ফেলে, তবে শেষ মুহূর্তে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
- যেমন আজ কেউ জীবনে প্রচুর দান করল, কিন্তু রিয়া ও গর্বের কারণে সব সওয়াব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
- আমল যেন বৃথা না যায়—তার জন্য নিয়ত ঠিক রাখা অপরিহার্য।
মূল শিক্ষা:
- আমলের মূল ভিত্তি হলো খাঁটি নিয়ত।
- রিয়া ও মান-গণনা আমলকে ধ্বংস করে দেয়।
- আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আখিরাতের সফলতার জন্য খাঁটি নিয়তে আমল করা জরুরি।
- আমল নষ্টকারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
- আল্লাহর নিদর্শন থেকে শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ মুসলমানদেরকে দানের গুণগত মান সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন।
- উত্তম থেকে দান: দান করার সময় সবচেয়ে ভালো জিনিস বেছে দিতে হবে।
- খারাপ জিনিস নয়: নষ্ট, নিম্নমানের বা এমন জিনিস যা নিজেরা নিতে চাইবে না, তা দান করা যাবে না।
- আল্লাহ অভাবমুক্ত: আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই; দান মানুষেরই কল্যাণের জন্য।
- প্রশংসাযোগ্য: খাঁটি নিয়তে করা প্রতিটি উত্তম দান আল্লাহর কাছে প্রশংসনীয়।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সময় মানুষ পুরোনো বা অকেজো জিনিস দান করে—এটি আয়াতের বিপরীত।
- যেমন: কেউ এমন কাপড় দান করল যা নিজে কখনো পরতে চাইবে না—এ ধরনের দান গ্রহণযোগ্য নয়।
- আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন আমরা ভালো জিনিস দিচ্ছি নাকি নষ্ট জিনিস দিচ্ছি।
মূল শিক্ষা:
- দান সর্বদা উৎকৃষ্ট জিনিস থেকে করতে হবে।
- খারাপ, পুরোনো বা অকেজো জিনিস আল্লাহর পথে ব্যয় করা উচিত নয়।
- আল্লাহ অভাবমুক্ত, আমাদের দান আসলে আমাদেরই কল্যাণের জন্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান করার সময় সর্বোত্তম জিনিস বেছে নেওয়া উচিত।
- যা নিজে নিতে চাইবে না, তা দান করা উচিত নয়।
- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করতে হবে, মানুষকে দেখানোর জন্য নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন কেন অনেক মানুষ দান থেকে পিছিয়ে যায়।
- শয়তানের ধোঁকা: শয়তান মানুষকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায়—যদি দান কর, গরিব হয়ে যাবে।
- অশ্লীলতা: শয়তান মানুষকে অশ্লীলতা, কৃপণতা ও গোনাহের কাজে উৎসাহিত করে।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতি: আল্লাহ তাঁর পথে ব্যয়কারীদের জন্য ক্ষমা ও অশেষ অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ: তিনি জানেন কার দান খাঁটি নিয়তে এবং কারটা শয়তানের ধোঁকায় নষ্ট হয়।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ ভাবে—যদি দান করি, তাহলে টাকার ঘাটতি হবে। অথচ বাস্তবে আল্লাহ দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দেন।
- আজ শয়তান মানুষকে বিলাসিতা, ফ্যাশন, অপচয় ও হারাম কাজে অর্থ খরচ করতে প্রলুব্ধ করছে।
- যারা আল্লাহর পথে দান করে, তারা বরকত, শান্তি ও রহমতের মালিক হয়।
মূল শিক্ষা:
- শয়তান সর্বদা দান থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে।
- আল্লাহ দানকারীদেরকে ক্ষমা ও অশেষ অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতিই সত্য, শয়তানের প্রতিশ্রুতি মিথ্যা।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান করার সময় শয়তানের ভয় দেখানো কথায় কান দেওয়া উচিত নয়।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করতে হবে।
- শয়তান অশ্লীলতা ও কৃপণতার দিকে ঠেলে দেয়, তাই তাকে প্রতিরোধ করতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন প্রকৃত সম্পদ ও অনুগ্রহ কী।
- হিকমত: হিকমত বলতে বোঝায়—কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অন্তরের প্রজ্ঞা ও আল্লাহভীতি।
- সর্বোত্তম দান: হিকমত হলো এমন এক অনুগ্রহ, যা অর্থ-সম্পদের থেকেও উত্তম, কারণ এর দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ হয়।
- জ্ঞানবানরাই উপকৃত হয়: প্রকৃত হিদায়াত কেবল তারাই গ্রহণ করে, যাদের বুদ্ধি ও ঈমান আছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকের কাছে সম্পদ আছে, কিন্তু হিকমত নেই—তারা ভুল পথে তা ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- যেমন কেউ জ্ঞানী হলেও যদি আল্লাহভীতি না থাকে, তার জ্ঞান কল্যাণ বয়ে আনে না।
- কিন্তু যাকে আল্লাহ হিকমত দেন, সে সামান্য সম্পদ দিয়েও দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য লাভ করতে পারে।
মূল শিক্ষা:
- হিকমত আল্লাহর বড় অনুগ্রহ।
- যার কাছে হিকমত আছে, তার কাছে প্রকৃত সম্পদ রয়েছে।
- শুধু জ্ঞান নয়, বরং সঠিক ব্যবহারই আসল হিকমত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর কাছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দোয়া করতে হবে।
- প্রকৃত কল্যাণ সম্পদ নয়, বরং হিকমতে।
- হিকমত পেলে তা আল্লাহর পথে ব্যবহার করা জরুরি।
এই আয়াতে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিটি ব্যয় ও মানতের হিসাব তাঁর কাছে রয়েছে।
- ব্যয়: যে কোনো দান, খরচ বা সদকা আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়।
- মানত: আল্লাহর জন্য মানত করলে তা পূরণ করা ফরজ, আর আল্লাহ তা জানেন।
- জালিমদের অবস্থা: যারা দান নষ্ট করে, বা খারাপ নিয়তে দান করে, কিংবা আল্লাহর অধিকার অস্বীকার করে—তাদের জন্য আখিরাতে কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ কেউ গোপনে দান করলে মানুষ না জানলেও আল্লাহ জানেন—এটাই আসল।
- কেউ আল্লাহর নামে মানত করলে (যেমন: আমি সুস্থ হলে এত টাকার সদকা করব) তা পালন করা তার উপর ওয়াজিব।
- যারা দান না করে সম্পদ লুকিয়ে রাখে, তারা আখিরাতে সাহায্য পাবে না।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ সবকিছু জানেন—দান, মানত, নিয়ত সবই তাঁর জ্ঞানে।
- মানত পূরণ করা আবশ্যক।
- জালিমদের জন্য আখিরাতে কোনো সাহায্য থাকবে না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান ও মানত করার সময় নিয়ত খাঁটি রাখতে হবে।
- মানুষ জানুক বা না জানুক, আল্লাহর কাছে সবকিছু প্রকাশ্য।
- অন্যায়কারীদের কোনো সহায়ক আখিরাতে থাকবে না।
এই আয়াতে আল্লাহ দান করার দুই পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন।
- প্রকাশ্যে দান: প্রকাশ্যে দান করলে মানুষ উৎসাহিত হয়, তাই তা ভালো। তবে নিয়ত খাঁটি হতে হবে।
- গোপনে দান: গোপনে দান করা আরও উত্তম, কারণ এতে রিয়া বা লোক দেখানোর সম্ভাবনা কমে যায়।
- সওয়াব: খাঁটি দান গুনাহ মোচনেরও কারণ হয়।
- আল্লাহর জ্ঞান: তিনি জানেন দান প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে, নিয়তই আসল।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই প্রকাশ্যে দান করে—যাতে মানুষ শিখতে পারে। কিন্তু উদ্দেশ্য যেন শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়।
- গোপনে দান করা যেমন: কারও হাতে টাকা রেখে দেওয়া, যাতে সে বুঝতে না পারে কে দিয়েছে—এটি সবচেয়ে উত্তম।
- লোক দেখানোর জন্য দান করলে তার কোনো সওয়াব নেই।
মূল শিক্ষা:
- দান প্রকাশ্যে করা ভালো, কিন্তু গোপনে করা আরও উত্তম।
- গোপন দান গুনাহ মোচনের কারণ।
- আল্লাহ সবকিছু জানেন, নিয়তই আসল।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান করার সময় খাঁটি নিয়ত রাখতে হবে।
- লোক দেখানো থেকে বাঁচতে গোপনে দান করা উত্তম।
- দান শুধু দুনিয়ার সওয়াব নয়, গুনাহ মোচনেরও উপায়।
এ আয়াতে আল্লাহ দান-সদকা ও হিদায়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট করেছেন।
- হিদায়াতের মালিক আল্লাহ: নবী (ﷺ) দাওয়াত দেন, কিন্তু কাউকে হিদায়াত দেওয়া তাঁর হাতে নয়—এটি শুধু আল্লাহর হাতে।
- দান নিজের জন্য: যে দান করে, আসলে সে নিজেরই উপকার করে—কারণ তার সওয়াব আখিরাতে সে-ই পাবে।
- শর্ত: দান শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়।
- পুরস্কার: আল্লাহ প্রতিটি দানের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন, কোনো অবিচার করবেন না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে ভাবে—আমি কাউকে সাহায্য করলে সে ইসলাম গ্রহণ করবে বা বদলাবে; কিন্তু হিদায়াত কেবল আল্লাহর হাতে।
- দান করলে সমাজের উপকার হলেও আখিরাতে আসল উপকার দানকারীরই হয়।
- আজকের যুগে অনেক এনজিও বা সংস্থা লোক দেখানোর জন্য দান করে, অথচ সওয়াব পায় না।
মূল শিক্ষা:
- হিদায়াত আল্লাহর হাতে, মানুষের নয়।
- দান আসলে নিজের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে।
- দান কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- দান-সদকা করার সময় উদ্দেশ্য যেন খাঁটি হয়।
- মানুষের হিদায়াত আল্লাহর হাতে—তাই কাউকে দান করলে তার ঈমান পরিবর্তনের আশা করা ঠিক নয়।
- আল্লাহর কাছে প্রতিটি দানের পূর্ণ প্রতিদান পাওয়া যাবে।
এ আয়াতে আল্লাহ প্রকৃত সদকার হকদারদের বর্ণনা করেছেন।
- আল্লাহর পথে সীমাবদ্ধ: এরা আল্লাহর পথে জিহাদ, ইলম অর্জন বা দ্বীনের কাজে ব্যস্ত থাকায় জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না।
- আত্মসংযম: তারা এতটাই ধৈর্যশীল যে, অজ্ঞ লোকেরা ভাবে এরা ধনী।
- চিহ্ন: তাদের দরিদ্রতা ও কষ্ট তাদের চেহারায় বোঝা যায়, কিন্তু তারা মুখ খুলে ভিক্ষা করে না।
- সদকা প্রাপ্য: আল্লাহ নির্দেশ দিলেন—এদের সাহায্য করতে হবে, এরা প্রকৃত হকদার।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক আলেম, ছাত্র, দ্বীনের কর্মী কষ্ট করে জীবনযাপন করেন, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু চান না।
- এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সম্মানের কারণে সাহায্য চান না—তাদেরকে খুঁজে বের করে সাহায্য করা উচিত।
- গোপনে প্রকৃত হকদারকে সাহায্য করা সবচেয়ে বড় সদকা।
মূল শিক্ষা:
- সদকা সবচেয়ে বেশি প্রাপ্য সেইসব মানুষদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে ব্যস্ত।
- আত্মসংযমী দরিদ্রদের খুঁজে বের করতে হবে।
- আল্লাহ প্রতিটি দানের খবর রাখেন।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- হকদার খুঁজে বের করে দান করা উচিত।
- মুখ না খুলেও অনেক দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন রয়েছে—তাদের সাহায্য করা উত্তম।
- দান করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রকৃত হকদারদের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ খাঁটি নিয়তে দানকারীদের মর্যাদা বর্ণনা করেছেন।
- সময় ও ধরণ: মুমিনরা আল্লাহর জন্য যেকোনো সময়—রাতে বা দিনে, গোপনে বা প্রকাশ্যে দান করে।
- খাঁটি নিয়ত: তারা দান করে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, মানুষকে দেখানোর জন্য নয়।
- পুরস্কার: আল্লাহ তাদের জন্য আখিরাতে চিরস্থায়ী পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন।
- আত্মশান্তি: দুনিয়াতে ও আখিরাতে তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ রাতের অন্ধকারে গোপনে দরিদ্রকে সাহায্য করে—এটি সর্বোত্তম সদকা।
- কেউ প্রকাশ্যে দান করলে অন্যরা উৎসাহিত হয়, তবে নিয়ত খাঁটি হতে হবে।
- আল্লাহর পথে নিয়মিত দানকারীরা সবসময় বরকত ও প্রশান্তি লাভ করে।
মূল শিক্ষা:
- দান করার সময় গোপন ও প্রকাশ্য উভয়ই গ্রহণযোগ্য, তবে নিয়ত যেন খাঁটি হয়।
- দান আল্লাহর পথে করলে আখিরাতে নিরাপত্তা ও পুরস্কার নিশ্চিত।
- মুমিন দান করে নিরবচ্ছিন্নভাবে, সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- গোপনে দান করা সবচেয়ে উত্তম, কারণ এতে রিয়া থাকে না।
- প্রকাশ্যে দান করলে অন্যরা উৎসাহিত হয়, তবে নিয়ত শুধু আল্লাহর জন্য হতে হবে।
- আল্লাহর জন্য দানকারীর জীবনে শান্তি, ভয়মুক্তি ও আখিরাতের সফলতা আসে।
এই আয়াতে সুদের ভয়াবহতা এবং তার শাস্তির কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
- সুদখোরের অবস্থা: কিয়ামতের দিন সুদখোররা এমনভাবে উঠবে, যেন শয়তান দ্বারা আচ্ছন্ন এক পাগল।
- ভুল ধারণা: তারা দুনিয়াতে বলত—‘ব্যবসা তো সুদের মতোই’। কিন্তু আল্লাহ ঘোষণা করলেন—ব্যবসা হালাল, সুদ হারাম।
- পূর্ববর্তী সুদ: ইসলামের আগে কেউ সুদ খেয়ে থাকলে, উপদেশ পাওয়ার পর তা বন্ধ করলে আল্লাহ তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করবেন।
- পুনরায় সুদে ফেরা: যারা আবার সুদে ফিরে যায়, তাদের জন্য জাহান্নামে চিরস্থায়ী শাস্তি নির্ধারিত।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের ব্যাংক ব্যবস্থা, সুদী ঋণ, সুদে ব্যবসা—সবই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
- অনেকে বলে—‘সুদ তো ব্যবসার মতো’—এটি কাফেরদেরই যুক্তি।
- যারা সুদের লেনদেন থেকে বিরত হয়, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও রহমতের দরজা খুলে দেন।
মূল শিক্ষা:
- সুদ সম্পূর্ণভাবে হারাম, ব্যবসা হালাল।
- সুদখোরদের কিয়ামতের দিনে ভয়াবহ অবস্থা হবে।
- সুদের পথ ছেড়ে দিলে আল্লাহ ক্ষমা করেন।
- পুনরায় সুদে ফিরে গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নাম শাস্তি।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সুদী লেনদেন থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকতে হবে।
- সুদকে ব্যবসার সমান বলা কুফরি বক্তব্য।
- আল্লাহর পথ বেছে নিলে ক্ষমা পাওয়া যায়, কিন্তু পুনরায় পাপে ফেরত গেলে শাস্তি অবধারিত।
এ আয়াতে সুদ ও সদকার ভিন্ন পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে।
- সুদের পরিণতি: সুদ দুনিয়াতে অনেক বেশি মনে হলেও আসলে বরকতহীন। আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করে দেন, তার কোনো স্থায়িত্ব থাকে না।
- সদকার পরিণতি: সামান্য দানও আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায়, অনেক বড় পুরস্কারে পরিণত হয়।
- অকৃতজ্ঞ ও পাপী: যারা আল্লাহর বিধান অমান্য করে সুদে লিপ্ত হয়, তারা অকৃতজ্ঞ ও পাপী। আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- ব্যাংকের সুদ বা ঋণে অনেক অর্থ আসতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে বরকত থাকে না—শান্তি থাকে না, সমস্যা আসে।
- অন্যদিকে, কেউ গোপনে সামান্য দান করলে আল্লাহ তার সম্পদে বরকত দেন এবং আখিরাতে বিশাল পুরস্কার দেন।
- আজকের দুনিয়াতে দানকারীদের অন্তর শান্ত থাকে, আর সুদখোরদের অন্তরে অশান্তি থাকে।
মূল শিক্ষা:
- সুদ ধ্বংসাত্মক, আল্লাহ তা মুছে দেন।
- সদকা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায়।
- আল্লাহ অকৃতজ্ঞ ও পাপীদের ভালোবাসেন না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সুদী লেনদেন এড়াতে হবে, কারণ এতে কোনো বরকত নেই।
- সদকা ও দান নিয়মিত করতে হবে—এতে আল্লাহর রহমত ও বরকত আসে।
- মুমিনকে অকৃতজ্ঞতা ও পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ সুদখোরদের পরিণতির বিপরীতে প্রকৃত মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।
- ঈমান: আল্লাহ, তাঁর রাসূল ﷺ, কুরআন ও আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস।
- সৎকর্ম: খাঁটি নিয়তে নেক আমল করা।
- সালাত প্রতিষ্ঠা: শুধু নামায পড়া নয়, বরং সময়মতো, খুশু ও খুদু দিয়ে নামায আদায় করা।
- যাকাত প্রদান: নিজের সম্পদ থেকে আল্লাহর হক আদায় করা।
- পুরস্কার: তাদের জন্য আল্লাহর কাছে চিরস্থায়ী পুরস্কার রয়েছে।
- নিরাপত্তা: আখিরাতে তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ যারা সুদ এড়িয়ে হালাল উপার্জন করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়—তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুত নিরাপত্তা লাভ করবে।
- যারা কেবল দুনিয়ার সম্পদে মগ্ন নয়, বরং আখিরাতের জন্য কাজ করছে—তারা প্রকৃত সফল।
- আল্লাহর নিকট ভয় ও দুঃখমুক্ত জীবনের নিশ্চয়তা কেবল মুমিনদের জন্য।
মূল শিক্ষা:
- ঈমান, সালাত ও যাকাত মুমিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- সৎকর্ম ঈমানের প্রমাণ।
- মুমিনদের জন্য আখিরাতে নিরাপত্তা ও পুরস্কার নিশ্চিত।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সুদ থেকে দূরে থেকে হালাল পথে উপার্জন করতে হবে।
- সালাত ও যাকাত সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- ঈমান ও সৎকর্মই আখিরাতের মুক্তির চাবিকাঠি।
এ আয়াতে আল্লাহ সুদের বিরুদ্ধে কঠোর হুকুম দিয়েছেন।
- আল্লাহভীতি: মুমিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহকে ভয় করা।
- সুদ ত্যাগ: পূর্বের সুদ মাফ হলেও, এরপর থেকে কোনো সুদ গ্রহণ করা যাবে না।
- ঈমানের শর্ত: যদি প্রকৃত মুমিন হও, তবে সুদকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতে হবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মুসলমান সুদকে স্বাভাবিক মনে করে। অথচ ঈমানের দাবিই হলো সুদ সম্পূর্ণ ত্যাগ করা।
- ব্যাংক, ঋণ, সুদী ব্যবসা—সবই এ আয়াতের আওতায় পড়ে।
- আল্লাহর ভয় থাকলে কোনো মুমিন সুদের পথে যাবে না।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহভীতি সুদ থেকে বাঁচার মূল উপায়।
- পূর্বে নেওয়া সুদ মাফ হলেও, ভবিষ্যতে সুদ গ্রহণ করা হারাম।
- সুদ ত্যাগ ঈমানের প্রমাণ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সুদ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে হবে।
- আল্লাহর ভয়কে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
- প্রকৃত মুমিন সুদকে হারাম মনে করে ত্যাগ করে।
এ আয়াতে সুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে।
- যুদ্ধের ঘোষণা: যারা সুদ ত্যাগ করবে না, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত বলে গণ্য হবে। এর চেয়ে বড় শাস্তির হুমকি আর কিছু নেই।
- তাওবা করলে: যদি কেউ সুদ থেকে ফিরে আসে, তবে তার মূলধন সে পাবে। সুদের অতিরিক্ত কোনো দাবী থাকবে না।
- ন্যায়নীতি: ইসলামী অর্থব্যবস্থা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত—কেউ কারো প্রতি জুলুম করবে না, কারো প্রতিও জুলুম করা হবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের ব্যাংকিং সিস্টেম, ঋণ ও সুদী ব্যবসা ইসলামী শরীয়তের বিরুদ্ধে।
- সুদে জড়িতরা বাস্তবে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধ করছে। এজন্য তাদের জীবনে অশান্তি, সংকট ও বরকতের অভাব দেখা দেয়।
- যদি সুদ ত্যাগ করে শুধু মূলধন ফেরত নেওয়া হয়, তবে ইসলাম তা বৈধ করেছে।
মূল শিক্ষা:
- সুদ না ছাড়লে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে যুদ্ধ বাধানো হয়।
- তাওবা করলে কেবল মূলধন বৈধভাবে পাওয়া যাবে।
- ইসলাম ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দিয়েছে—কেউ জুলুম করবে না, কারো প্রতি জুলুম করা হবে না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সুদী লেনদেনকে সবচেয়ে বড় গুনাহ মনে করতে হবে।
- সুদ ত্যাগ করে কেবল মূলধন ফেরত নিতে হবে।
- অন্যায় ও জুলুমমুক্ত অর্থনীতি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ আয়াতে আল্লাহ ঋণ প্রদানের নীতিমালা শিখিয়েছেন।
- সময় দেওয়া: ঋণগ্রহীতা যদি কষ্টে থাকে, তবে তাকে সময় দেওয়া উচিত, চাপ প্রয়োগ নয়।
- মাফ করা: যদি কেউ ঋণ মাফ করে দেয়, তবে তা তার জন্য সদকার সমান এবং আল্লাহর কাছে বড় সওয়াবের কারণ।
- মানবিকতা: ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়া উচিত নয়; বরং সহমর্মিতা দেখাতে হবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই ঋণ দিয়ে সুদ আদায় করে, যা হারাম। অথচ কোরআন শেখায়—কষ্টে থাকলে ঋণগ্রহীতাকে সময় দিতে হবে।
- কেউ ঋণগ্রহীতার অবস্থা দেখে ঋণ মাফ করে দিলে, আল্লাহ তার বদলে আখিরাতে বিশাল পুরস্কার দেবেন।
- মানুষের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ।
মূল শিক্ষা:
- ঋণগ্রহীতা কষ্টে থাকলে সময় দিতে হবে।
- ঋণ মাফ করে দেওয়া আরও উত্তম।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সদকা সর্বোত্তম মাধ্যম।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ঋণ আদায়ের সময় দয়া ও মানবিকতা দেখাতে হবে।
- ঋণ মাফ করলে তা আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম দান হিসেবে গৃহীত হয়।
- কষ্টে থাকা ঋণগ্রহীতাকে চাপ দেওয়া ইসলামসম্মত নয়।
এ আয়াতটি কুরআনের সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াতগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে আল্লাহ কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা ও জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
- আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন: দুনিয়ার প্রতিটি কাজের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে।
- পূর্ণ প্রতিদান: ভালো বা মন্দ—প্রত্যেক কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।
- অন্যায় হবে না: আল্লাহ কারো প্রতি জুলুম করবেন না; বিচার হবে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ ভাবে তার কাজ কেউ দেখছে না, কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রতিটি কাজ লিপিবদ্ধ হচ্ছে।
- আজ দুনিয়ার আদালতে অনেক সময় বিচার অন্যায় হয়, কিন্তু আখিরাতের আদালতে কোনো অন্যায় হবে না।
- এ আয়াত মানুষকে সব সময় আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মূল শিক্ষা:
- কিয়ামতের দিনের ভয় মনে রাখা মুমিনের জন্য আবশ্যক।
- প্রত্যেক কাজের প্রতিদান দেওয়া হবে—ভালো ও মন্দ উভয়ই।
- আল্লাহ সুবিচার করবেন; কারো প্রতি অন্যায় হবে না।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- সব সময় আখিরাতের হিসাবের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
- দুনিয়ার কাজে ন্যায়বিচার করতে হবে, কারণ আখিরাতে ন্যায়বিচার থেকে বাঁচা যাবে না।
- আল্লাহকে ভয় করে জীবন পরিচালনা করলে আখিরাত সফল হবে।
এ আয়াতকে বলা হয় **“আয়াতুদ্-দাইন”** (ঋণ সম্পর্কিত আয়াত), যা কুরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ আয়াত। এখানে দেনা-পাওনার নীতি, ন্যায়বিচার ও দলিল-প্রমাণের শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
- দেনা লিখে রাখা: ঋণ, বেচাকেনা বা দেনা-পাওনার লেনদেন লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা উচিত।
- ন্যায়সঙ্গত লেখক: লেখক যেন ন্যায়ের সাথে লিখে, কারো প্রতি পক্ষপাত না করে।
- সাক্ষী: দুইজন পুরুষ সাক্ষী, আর না হলে একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা সাক্ষী রাখা।
- ভুল এড়ানো: লিখিত দলিল ও সাক্ষী রাখলে সন্দেহ, ভুল বা অন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- দৈনন্দিন ব্যবসা: নগদ লেনদেন হলে লিখিত প্রয়োজন নেই, তবে সাক্ষী রাখা উত্তম।
- কোনো ক্ষতি নয়: লেখক বা সাক্ষীকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের দিনে চুক্তিপত্র, ব্যাংক লোনের কাগজ, ব্যবসার দলিল—সবই এই আয়াতের আলোকে প্রমাণিত।
- অনেক সময় পরিবার বা বন্ধুর মধ্যে ঋণ নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়, কারণ লিখিত দলিল রাখা হয় না।
- এই আয়াত মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা, বিশ্বাস ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মূলনীতি শিখিয়েছে।
মূল শিক্ষা:
- দেনা-পাওনা অবশ্যই লিখে রাখতে হবে।
- ন্যায়সঙ্গত লেখক ও সাক্ষীর প্রয়োজন রয়েছে।
- ইসলাম অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও দায়িত্বশীলতা শিক্ষা দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ঋণ বা দেনা-পাওনার ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি করা উচিত।
- সাক্ষী রাখা ঝগড়া-বিবাদ থেকে বাঁচার উপায়।
- ইসলামী অর্থনীতি ন্যায় ও নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে।
এই আয়াতে ঋণ ও দেনা-পাওনার ক্ষেত্রে সফর বা জরুরি অবস্থার জন্য আলাদা বিধান দেয়া হয়েছে।
- সফরে বন্ধক: যদি কোনো লেখক না পাওয়া যায়, তবে দেনার বিনিময়ে কিছু জিনিস বন্ধক রাখা যাবে।
- বিশ্বাস: যদি কেউ কারো প্রতি বিশ্বাস করে দেনা দেয়, তবে আমানতদারকে অবশ্যই তার দায়িত্ব পূর্ণ করতে হবে।
- আল্লাহভীতি: আমানতের হক আদায় করতে গিয়ে আল্লাহকে ভয় করতে হবে।
- সাক্ষ্য গোপন নয়: সাক্ষ্য গোপন করা বড় গুনাহ। এটি অন্তরকে পাপী বানায়।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও ঋণের ক্ষেত্রে অনেক সময় কাগজপত্র হয় না—তখন জামিন বা বন্ধক রাখা হয়।
- ব্যাংক লোন বা ব্যবসায়িক লেনদেনেও জামানত রাখা এই আয়াতের আলোকে বৈধ।
- মানুষের সাথে চুক্তি বা দেনা-পাওনায় সততা ও আল্লাহভীতি অপরিহার্য।
- সাক্ষী লুকিয়ে রাখা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আজও বড় গুনাহ।
মূল শিক্ষা:
- সফরে লেখক না পেলে বন্ধক রাখা বৈধ।
- আমানত ফেরত দেওয়া আল্লাহভীতির অংশ।
- সাক্ষ্য গোপন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- অর্থনৈতিক লেনদেনে সর্বদা স্বচ্ছতা রাখা উচিত।
- বিশ্বাসঘাতকতা বড় গুনাহ, তাই আমানত রক্ষা করা জরুরি।
- সাক্ষ্য গোপন করলে অন্তর পাপী হয়ে যায়।
এ আয়াতে আল্লাহর মালিকানা, মানুষের অন্তরের জবাবদিহিতা এবং আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
- আল্লাহর মালিকানা: আসমান ও জমিনে যা আছে, সব আল্লাহর। তিনি একক মালিক।
- অন্তরের হিসাব: মানুষের অন্তরের চিন্তা, ইচ্ছা, গোপন বা প্রকাশ্য—সবই আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে।
- ক্ষমা ও শাস্তি: আল্লাহ যাকে চান ক্ষমা করবেন, যাকে চান শাস্তি দেবেন।
- ক্ষমতাবান: আল্লাহ সর্বশক্তিমান; তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে কিছু নেই।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ মনে ভাবে—যা অন্তরে আছে, তা কেউ জানে না। কিন্তু আল্লাহ সবই জানেন।
- আজ মানুষ গোপনে অন্যায় বা খারাপ চিন্তা করে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তা প্রকাশ্য।
- আল্লাহর ভয় মানুষকে অন্তরেরও শুদ্ধতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে।
মূল শিক্ষা:
- আসমান ও জমিনে সব কিছুর মালিক আল্লাহ।
- অন্তরের গোপন চিন্তাও আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে।
- ক্ষমা ও শাস্তি আল্লাহর হাতে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- অন্তরের চিন্তা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত।
- আল্লাহর কাছে সব কিছুই প্রকাশ্য—এ বিশ্বাসে জীবন যাপন করতে হবে।
- মুমিন আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় অন্তরকে শুদ্ধ রাখবে।
এই আয়াতে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে এবং মুমিনদের আনুগত্য প্রকাশ করা হয়েছে।
- রাসূল ﷺ এর ঈমান: নবী করিম ﷺ আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছেন।
- মুমিনদের ঈমান: সত্যিকার মুমিনরা আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনে।
- রাসূলদের মধ্যে পার্থক্য নয়: সব রাসূলই আল্লাহর প্রেরিত; তাদের মধ্যে কারো প্রতি অবিশ্বাস করা কুফরি।
- আনুগত্য: মুমিনরা বলে—“আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম।”
- ক্ষমা প্রার্থনা: তারা সর্বদা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
- চূড়ান্ত গন্তব্য: প্রত্যেকের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকেই।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মুসলমানদেরও ঈমান রাখতে হবে আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব (কুরআনসহ সব কিতাব), এবং সব নবী-রাসূলের উপর।
- কেউ কেবল কিছু রাসূল বা কিতাব মানলে সে প্রকৃত মুমিন নয়।
- আল্লাহর নির্দেশ শুনে মান্য করা ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়া—এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
মূল শিক্ষা:
- ঈমানের মৌলিক ভিত্তি হলো আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব ও রাসূলগণের উপর বিশ্বাস।
- সব রাসূলকে সমভাবে সম্মান করতে হবে।
- মুমিন সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করে এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর কিতাব ও রাসূলগণের প্রতি পূর্ণ ঈমান আনা আবশ্যক।
- আনুগত্য ও ক্ষমা প্রার্থনা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- প্রত্যাবর্তনের জায়গা কেবল আল্লাহর কাছেই—এ বিশ্বাস নিয়ে জীবন কাটাতে হবে।
এই আয়াত সূরা আল-বাকারাহর সমাপ্তি, যা দোয়া ও দয়া প্রার্থনায় পূর্ণ। এখানে আল্লাহর রহমত, ন্যায়বিচার এবং বান্দার দুর্বলতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
- সামর্থ্যের বাইরে নয়: আল্লাহ কোনো বান্দাকে তার ক্ষমতার বাইরে দায়িত্ব দেন না।
- কাজের ফল: প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তার কাজের ফলাফল—ভালো হলে ভালো, মন্দ হলে মন্দ।
- ভুল ও ভ্রান্তি: ভুল ও অনিচ্ছাকৃত কাজে আল্লাহ ক্ষমা করেন, মুমিন তাঁর কাছে দোয়া করে।
- দোয়া: আল্লাহর কাছে দোয়া—অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিও না, আমাদেরকে ক্ষমা করো, দয়া করো।
- সহায়তা: কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ অনেক দায়িত্ব ও পরীক্ষায় পড়ে—আল্লাহ সেই অনুযায়ী সামর্থ্য দেন।
- মানুষ ভুল করতে পারে, তবে অনুতাপ করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করেন।
- মুমিনদের দোয়া হলো—দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য চাওয়া।
মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।
- প্রত্যেকেই তার কাজের জন্য দায়বদ্ধ।
- আল্লাহর কাছে ক্ষমা, মাফ ও দয়া প্রার্থনা করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া ও ক্ষমা চাইতে হবে।
- দায়িত্ব পালন সহজ করতে আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন।
- মুমিনদের শক্তি আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করে।