সূরা আন-নিসা
আয়াত সংখ্যা: ১৭৬, রুকু সংখ্যা: ২৪
📘 সূরা আন-নিসা — ভূমিকা (Introduction)
সূরা আন-নিসা (আরবি: النِّسَاء, অর্থ “নারীগণ”) মদীনায় অবতীর্ণ একটি দীর্ঘ সূরা, যার আয়াত সংখ্যা ১৭৬। এটি কুরআনের চতুর্থ সূরা এবং মূলত মুসলিম সমাজে ন্যায়, নীতি, পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
“আন-নিসা” শব্দটি এসেছে “নিসা” (নারী) থেকে, কারণ এই সূরায় নারীদের অধিকার, বিবাহ, মেহর, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক দায়িত্বের বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তাই একে বলা হয় “নারী অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সূরা”।
📍 সূরার অবতীর্ণ প্রেক্ষাপট:
সূরা আন-নিসা নাজিল হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন মদীনায় মুসলিম সমাজ গঠন হচ্ছিল এবং যুদ্ধের পর বহু নারী, এতিম ও দুর্বল লোক সমাজে অসহায় অবস্থায় ছিল। আল্লাহ তাআলা এই সূরার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিলেন — কিভাবে সমাজে দয়া, ন্যায়বিচার ও দায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
🌿 সূরার মূল উদ্দেশ্য:
- নারীদের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
- এতিম ও দুর্বলদের সম্পদ রক্ষা করা।
- পরিবার, বিবাহ ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত শরিয়াহ নির্দেশনা প্রদান।
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যের মাধ্যমে ঐক্য প্রতিষ্ঠা।
- ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব ও সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
- মুনাফিকতা ও শিরকের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা প্রদান।
💫 সূরা আন-নিসার বৈশিষ্ট্য:
- এই সূরায় সমাজ, রাষ্ট্র ও পারিবারিক জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রের নির্দেশনা রয়েছে।
- এটি কুরআনের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তারিত উত্তরাধিকার আইন বর্ণনা করে।
- মুমিন, মুনাফিক ও কাফের — এই তিন শ্রেণির মানুষের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
- ইমান, তাওহিদ ও নবুওয়াতের প্রমাণের পাশাপাশি, বনী ইসরাঈলের ইতিহাস থেকেও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
📖 সূরা আন-নিসা সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি সূরা আন-নিসা পাঠ করবে, সে নিজের এবং অন্যদের অধিকারের ব্যাপারে উদাসীন থাকবে না।” (📚 তাফসীর ইবনু কাসীর, সূরা আন-নিসার ভূমিকা অংশ)
🌸 উপসংহার:
সূরা আন-নিসা মানবসমাজে ন্যায়, নারী-পুরুষের ভারসাম্য,
ও আল্লাহভীতির ওপর ভিত্তি করে জীবন গঠনের আহ্বান জানায়।
এটি এমন একটি সূরা যা একটি সুষ্ঠু, ন্যায়নিষ্ঠ, ভারসাম্যপূর্ণ
ইসলামী সমাজ গঠনের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান হিসেবে বিবেচিত।
“إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ”
“নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় ও উৎকৃষ্ট আচরণের আদেশ দেন।” (সূরা নাহল ১৬:৯০)
এই আয়াত মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়—তাদের সবার উৎস একই। আদম (আঃ) থেকে শুরু করে তার স্ত্রী হাওয়া (আঃ), তারপর তাদের বংশধর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষকে আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে বলা হয়েছে, বিশেষত আত্মীয়তার হক আদায়ে।
- এক উৎস: সব মানুষ আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান।
- আত্মীয়তার সম্পর্ক: আত্মীয়তার হক আদায় করা অপরিহার্য।
- আল্লাহর তত্ত্বাবধান: আল্লাহ সবসময় মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১):
- মানবজাতির উৎস এক—তাই বর্ণবাদ, জাতিবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
- আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের অংশ।
- আল্লাহ সর্বদা আমাদের উপর পর্যবেক্ষক, তাই সচেতন থাকা জরুরি।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এতিমদের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা ফরজ। কারো সম্পদ আত্মসাৎ করা বড় গুনাহ, আর এতিমের সম্পদ খাওয়া আরও গুরুতর অপরাধ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, সে কিয়ামতের দিনে নিজের পেটে আগুন নিয়ে আসবে।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩৬৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬২৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক ক্ষেত্রে এতিমের সম্পত্তি আত্মীয়রা নিজেদের করে নেয়।
- ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার সন্তানের জমি বা টাকা দখল করে নেওয়া হয়।
- অনেকে এতিমের টাকা ব্যবসায় ব্যবহার করে কিন্তু ফেরত দেয় না।
শিক্ষনীয় বিষয় :
- এতিমের সম্পদ রক্ষা করা ফরজ ইবাদত।
- এতিমের সম্পদ ভোগ করা আখিরাতে কঠিন শাস্তির কারণ।
- সমাজে এতিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ন্যায়বিচারের অংশ।
- মুমিনের দায়িত্ব—এতিমদের সাথে সদয় হওয়া এবং তাদের হক সঠিকভাবে ফিরিয়ে দেওয়া।
এই আয়াত মূলত বিবাহ ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দিচ্ছে। কেউ যদি এতিম নারীদের হক ঠিকভাবে আদায় করতে না পারে, তবে অন্য নারীদের সাথে বিবাহ করতে বলা হয়েছে। ইসলামে একাধিক স্ত্রী করার অনুমতি আছে, তবে সর্বোচ্চ চার পর্যন্ত। তবে শর্ত হলো—স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করা। যদি ন্যায়বিচারের ভয় থাকে, তবে কেবল একটির সাথেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী রয়েছে, আর সে তাদের মধ্যে কারো প্রতি অবিচার করে, কিয়ামতের দিন সে আসবে তার শরীরের এক দিক বাঁকা অবস্থায়।” (📖 সুন্নান আবু দাউদ, হাদিস: ২১৩৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে একাধিক স্ত্রী বিয়ে করে ন্যায়বিচার করে না, এক পক্ষকে প্রাধান্য দেয়।
- কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরা ন্যায়বিচার করতে না পেরে বিবাহকে দায়িত্বের পরিবর্তে কষ্টে পরিণত করে।
- আজকের সমাজে অনেক সময় “ন্যায়বিচার” না করে নিজের খেয়াল অনুযায়ী বহুবিবাহ করা হয়, যা ইসলামের বিধানের পরিপন্থী।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩):
- বিবাহে ন্যায়বিচার করা ইসলামের মূল শর্ত।
- একাধিক স্ত্রী করার অনুমতি আছে, কিন্তু শর্ত হলো ন্যায়বিচার।
- যদি ন্যায়বিচারের ভয় থাকে, তবে একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকা শ্রেয়।
- অন্যায় করা আখিরাতে কঠিন শাস্তির কারণ হবে।
এই আয়াতে স্ত্রীদের মাহর (মোহরানা) সম্পর্কিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মাহর হলো স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি একটি নির্ধারিত অধিকার। এটি আনন্দের সাথে ও পূর্ণ আন্তরিকতায় প্রদান করতে হবে। যদি স্ত্রী স্বেচ্ছায় কিছু অংশ ক্ষমা করে দেয়, তবে তা গ্রহণ করা বৈধ। কিন্তু জোর-জবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগ করে স্ত্রীকে তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হারাম।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীদের প্রতি সর্বোত্তম আচরণ করে।” (📖 সুন্নান তিরমিজি, হাদিস: ৩৮৯৫)
আরেক হাদিসে এসেছে— “মহিলাদের প্রতি তোমরা উত্তম ব্যবহার করো, কারণ তারা তোমাদের নিকট আল্লাহর আমানত।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক স্বামী স্ত্রীর মাহর দেয় না, বা খুব অল্প পরিমাণ নির্ধারণ করে।
- অনেকে বিয়ের পর স্ত্রীকে মাহরের অংশ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করে, যা অন্যায়।
- মাহরকে বোঝা না ভেবে এটি স্ত্রীকে সম্মান ও অধিকার দেওয়ার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪):
- স্ত্রীর মাহর দেওয়া ফরজ এবং এটি স্ত্রীদের প্রাপ্য অধিকার।
- মাহর আনন্দ ও আন্তরিকতার সাথে প্রদান করতে হবে।
- স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়, তবে তা বৈধ, কিন্তু জোর করা যাবে না।
- মাহরকে ছোট করে দেখা নয়, বরং এটি ইসলামের সুন্দর একটি বিধান।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন—অপরিণত, অযোগ্য, বুদ্ধিহীন কিংবা অবিবেচক লোকদের হাতে সম্পদ তুলে দিও না, যাতে তারা অপচয় বা ক্ষতি করে। বরং অভিভাবক বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেই সম্পদ দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা (খাবার, পোশাক) পূর্ণ করবে। পাশাপাশি তাদের সাথে সদয় আচরণ ও সুন্দরভাবে কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আদম সন্তান তার সম্পদ থেকে যে ব্যয় করে, তার মধ্যে সর্বোত্তম ব্যয় হলো— সে যে ব্যয় নিজের পরিবারে করে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৫)
আবার অন্য হাদিসে এসেছে— “যে ব্যক্তি এতিমকে আশ্রয় দেয় এবং তাকে সঠিকভাবে লালন করে, আমি ও সে জান্নাতে এভাবে একসাথে থাকব।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩০৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পরিবারে দেখা যায়, অল্পবয়সী বা অজ্ঞ লোকের হাতে টাকা তুলে দিলে তারা অপচয় করে ফেলে।
- এতিম শিশুদের সম্পদ দায়িত্বশীল অভিভাবকের হাতে রেখে তাদের প্রয়োজনীয় খরচ সঠিকভাবে করা জরুরি।
- কেউ যদি ব্যবসা করতে না জানে, তার হাতে সম্পদ দিলে লোকসান হবে—তাই জ্ঞানী ও যোগ্য অভিভাবক নিয়ন্ত্রণ করবে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫):
- অযোগ্য বা অবিবেচক লোকের হাতে সম্পদ দেওয়া ইসলাম অনুমোদন করে না।
- এতিম ও অযোগ্যদের হক রক্ষা করা সমাজের দায়িত্ব।
- প্রয়োজনীয় চাহিদা যেমন খাবার, পোশাক দেওয়া এবং সুন্দর কথা বলা ইসলামের শিক্ষা।
- অভিভাবকত্ব ও দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে।
আল্লাহ এতিমদের সম্পদ ফেরত দেওয়ার নিয়ম শিখিয়েছেন। তাদের পরীক্ষা করা হবে—তারা বুঝদার ও সম্পদ ব্যবহারের যোগ্য হয়েছে কি না। যদি যোগ্য হয়, তবে তাদের সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। অভিভাবক ধনী হলে তাদের সম্পদ থেকে কিছু নেবে না, আর যদি গরিব হয় তবে প্রয়োজনীয় অংশ ভদ্রভাবে নিতে পারে। সম্পদ ফেরত দেওয়ার সময় সাক্ষী রাখা জরুরি, যেন কেউ অস্বীকার না করতে পারে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি ও এতিমের অভিভাবক, যে তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করবে, জান্নাতে এভাবে একসাথে থাকব।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৩০৪)
আবার তিনি ﷺ বলেছেন— “যে এতিমকে দেখাশোনা করে এবং তার সাথে সদয় ব্যবহার করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দেবেন।” (📖 সুন্নান তিরমিজি, হাদিস: ১৯১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক সময় এতিম বয়সে পৌঁছলেও অভিভাবকরা তাদের সম্পদ ফেরত দেয় না।
- বিবাহ বা চাকরির পরও এতিমের সম্পদ নিজের দখলে রেখে ব্যবহার করা হয়, যা গুনাহ।
- আধুনিকভাবে বলতে গেলে—যেমন কোনো এতিমের ব্যাংক জমা বা জমিজমা থাকে, তা সঠিক বয়সে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬):
- এতিমদের বয়স হলে ও যোগ্যতা দেখা দিলে সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া ফরজ।
- অভিভাবক ধনী হলে এতিমের সম্পদ থেকে কিছু নেওয়া বৈধ নয়।
- গরিব অভিভাবক শুধু প্রয়োজনীয় অংশ নিতে পারে, তাও শর্ত হলো ন্যায়সঙ্গতভাবে।
- লেনদেনে সাক্ষী রাখা উচিত, যেন কোনো ঝগড়া বা অন্যায় না হয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা উত্তরাধিকার (মীরাস) সম্পর্কিত বিধান দিয়েছেন। আগে সমাজে নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। ইসলাম প্রথম নারীদের জন্যও নির্ধারিত অংশ নিশ্চিত করেছে। সম্পদ যত অল্পই হোক, তা উত্তরাধিকারের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ নির্ধারিত হক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ নিজে প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর হক নির্ধারণ করেছেন। তাই কোনো উত্তরাধিকারীর জন্য অন্যকে বঞ্চিত করে وصية (ওসিয়াত/অতিরিক্ত অংশ) করা যাবে না।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২৮৭০; তিরমিজি, হাদিস: ২১২০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক পরিবারে নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
- ভাইরা প্রায়শই বোনদের অংশ দেয় না বা জোর করে ক্ষমা করিয়ে নেয়।
- অল্প সম্পদ থাকলেও ইসলামীভাবে ভাগ করা জরুরি—হোক সেটা জমি, বাড়ি, সোনাদানা বা টাকা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭):
- উত্তরাধিকার আল্লাহর নির্ধারিত বিধান, এটি পালন করা ফরজ।
- নারী ও পুরুষ উভয়েরই উত্তরাধিকার রয়েছে।
- সম্পদ যত অল্পই হোক, ভাগ করে দেওয়া জরুরি।
- উত্তরাধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা মহাপাপ।
উত্তরাধিকার ভাগাভাগির সময় শুধু ওয়ারিশদের অধিকারই নয়, বরং এতিম, অভাবগ্রস্ত ও আত্মীয়রা যদি উপস্থিত থাকে, তবে তাদেরও কিছু দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি ফরজ অংশ নয়, বরং সদকা বা উপহার হিসেবে দেওয়া। আর যদি দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে অন্তত তাদের সাথে সুন্দর কথা বলা উচিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে এতিম ও অভাবীর উপর দয়া করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৪৬৩)
আরেকটি হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি এতিমের মাথায় হাত বুলায়, আল্লাহ তার জন্য যত চুল আছে তত সওয়াব লিখে দেন।” (📖 ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৬৭৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কারো সম্পদ ভাগাভাগির সময় গরিব আত্মীয়রা উপস্থিত হলে তাদের প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়।
- আজও অনেক সমাজে এতিমরা উত্তরাধিকার ভাগের সময় কিছুই পায় না, বরং তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
- আধুনিক প্রেক্ষাপটে—যেমন বাড়ি বা জমি বিক্রি করার পর ভাগাভাগি হয়, তখন কিছু অংশ গরিব আত্মীয় বা এতিমদের দেওয়া উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮):
- উত্তরাধিকার ভাগাভাগির সময় অভাবীদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
- এতিম ও অভাবীদের প্রতি সদয় হওয়া আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল।
- যদি কিছু দেওয়া সম্ভব না হয়, অন্তত সুন্দর ও সদয় কথা বলা জরুরি।
- ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার শুধু পরিবারের মধ্যে নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য।
এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেছেন— এতিম বা দুর্বল শিশুদের প্রতি অন্যায় করলে যেন মনে করে, যদি তারা নিজেরাও সন্তান রেখে যায় এবং অন্যরা তাদের সাথে অন্যায় করে, তবে কেমন লাগবে? তাই মানুষ যেন তাকওয়া অবলম্বন করে এবং ন্যায়সঙ্গত কথা ও আচরণ করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি এতিমদের প্রতি দয়া করে না, দুর্বলদের হক আদায় করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৪৬৩)
আবার তিনি ﷺ বলেছেন— “মুমিনদের মধ্যে ঈমানে সবচেয়ে পূর্ণ ব্যক্তি সেই, যার চরিত্র উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবার-পরিজনের প্রতি শ্রেষ্ঠ।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৬১২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক অভিভাবক মারা গেলে এতিম সন্তানদের প্রতি আত্মীয়রা অন্যায় করে, তাদের হক মেরে নেয়।
- একজন মানুষকে ভাবা উচিত—তার নিজের সন্তান যদি এতিম হয়, তবে তারা কেমন কষ্টে পড়বে।
- অনেক সময় এতিমদের সম্পদ দখল করে বিলাসিতা করা হয়—এটি গুরুতর অপরাধ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯):
- অন্যের সন্তানদের সাথে ন্যায়বিচার করতে হবে, যেমন নিজের সন্তানের জন্য চাই।
- আল্লাহভীতি (তাকওয়া) অন্যায় থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।
- সঠিক কথা বলা ও ন্যায়বিচার করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
- এতিমদের প্রতি অন্যায় করলে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
এ আয়াতে এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করার ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে খাওয়া আখিরাতে জাহান্নামের আগুন খাওয়ার সমান। এটি বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত এবং কিয়ামতের দিনে অপরাধীরা জ্বলন্ত আগুনে শাস্তি পাবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, সে কিয়ামতের দিনে তার পেটে আগুন নিয়ে আসবে।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩৬৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬২৮)
আরেক হাদিসে এসেছে— “সাতটি ধ্বংসাত্মক গুনাহ থেকে বাঁচো।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন: সেগুলো কী? তিনি ﷺ বললেন: আল্লাহর সাথে শিরক করা, যাদু করা, যার প্রাণ আল্লাহ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ খাওয়া, যুদ্ধ থেকে পালানো এবং পবিত্র নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৭৬৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক আত্মীয় এতিমের জমি, বাড়ি বা ব্যাংকের টাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
- অভিভাবকরা এতিমের সম্পদ ব্যবসায় খাটিয়ে নিজেরা ভোগ করে, অথচ ফিরিয়ে দেয় না।
- অল্প বয়সী শিশুদের সম্পদ আত্মসাৎ করে তারা অজ্ঞতার সুযোগ নেয়—এটি ভয়াবহ গুনাহ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০):
- এতিমের সম্পদ খাওয়া জাহান্নামের আগুন খাওয়ার সমান।
- এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ বড় গুনাহ ও ধ্বংসাত্মক অপরাধ।
- মুমিনের জন্য জরুরি—এতিমের সম্পদ সম্পূর্ণ রক্ষা করা।
- আল্লাহর কঠোর শাস্তি থেকে বাঁচতে ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
এই আয়াত উত্তরাধিকার বণ্টনের মৌলিক বিধান নির্ধারণ করেছে। সন্তানদের মধ্যে ছেলে দুই মেয়ের সমান অংশ পাবে। মেয়েদের সংখ্যা যদি দুই বা তার বেশি হয়, তবে তারা মোট সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। এক মেয়ে হলে অর্ধেক পাবে। মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতারও নির্দিষ্ট অংশ আছে— সন্তান থাকলে প্রত্যেক অভিভাবক ১/৬ পাবে। সন্তান না থাকলে মা ১/৩ পাবে, কিন্তু ভাই-বোন থাকলে মা ১/৬ পাবে। সবকিছু সম্পন্ন হবে ওসিয়াত ও ঋণ পরিশোধের পর। আল্লাহ স্পষ্টভাবে বললেন—এটি তাঁর পক্ষ থেকে ফরজ বিধান।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর হক নির্ধারণ করেছেন, তাই কোনো উত্তরাধিকারীর জন্য অন্যকে বঞ্চিত করে وصية (ওসিয়াত) করা বৈধ নয়।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২৮৭০; তিরমিজি, হাদিস: ২১২০)
আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “জ্ঞান অর্জন করো এবং উত্তরাধিকার বণ্টনের জ্ঞান মানুষকে শিক্ষা দাও, কেননা আমি বিদায় নেব, কিন্তু উত্তরাধিকার বণ্টনের জ্ঞান অদৃশ্য হবে।” (📖 ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৭১৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক সমাজে মেয়েদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, যা কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশের বিরোধী।
- অনেকে মনে করে জমি বা বাড়ি ভাগ করলে পরিবার দুর্বল হয়ে যায়, তাই মেয়েদের কিছুই দেয় না।
- অল্প সম্পদ হলেও সঠিকভাবে ভাগ করা ফরজ, না দিলে কিয়ামতে কঠিন শাস্তি হবে।
- আধুনিক আইনের সঙ্গে ইসলামী আইন মিলিয়ে না দেখায় অনেক মুসলিম পরিবারে অন্যায় ঘটে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১):
- উত্তরাধিকার আল্লাহর ফরজ বিধান, এটি পরিবর্তন করা যাবে না।
- ছেলে দুই মেয়ের সমান অংশ পায়—এটি আল্লাহর প্রজ্ঞা, অবিচার নয়।
- মা-বাবারও নির্ধারিত অংশ রয়েছে, কেউ তাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।
- ওসিয়াত ও ঋণ পরিশোধের পরই উত্তরাধিকার বণ্টন হবে।
- নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা মহাপাপ।
এই আয়াত স্বামী-স্ত্রীর উত্তরাধিকার বণ্টনের বিধান দিচ্ছে। - স্ত্রী মারা গেলে: স্বামীর জন্য অর্ধেক, যদি সন্তান না থাকে; সন্তান থাকলে ১/৪। - স্বামী মারা গেলে: স্ত্রীর জন্য ১/৪, যদি সন্তান না থাকে; সন্তান থাকলে ১/৮। - যদি মৃত ব্যক্তি "কলা-লাহ" অর্থাৎ সন্তান ও পিতা-মাতা না রেখে মারা যায়, তবে ভাই বা বোন প্রত্যেকে ১/৬ পাবে; একাধিক হলে সবাই মিলে ১/৩ ভাগ পাবে। এগুলো সব ওসিয়াত ও ঋণ পরিশোধের পর কার্যকর হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ প্রতিটি ওয়ারিশের হক নির্ধারণ করেছেন। তাই ওসিয়াত কেবল উত্তরাধিকারী নয় এমন ব্যক্তির জন্য বৈধ।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২৮৭০; তিরমিজি, হাদিস: ২১২০) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “তোমরা উত্তরাধিকার বণ্টনের জ্ঞান অর্জন করো এবং মানুষকে শেখাও। কেননা এটি অর্ধেক জ্ঞান এবং ভুলে যাওয়া হবে সর্বপ্রথম।” (📖 ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৭১৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পরিবারে স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে অল্প কিছু দেওয়া হয়, অথচ কুরআনে তার নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে।
- স্ত্রী মারা গেলে স্বামী প্রায়ই পুরো সম্পদ নিজের করে নেয়, সন্তানের কথা বিবেচনা করে না।
- অনেক সময় ভাই-বোনের অংশ (কলা-লাহ) উপেক্ষা করা হয়।
- আধুনিক সমাজে এই আয়াতের বাস্তবায়ন হলে পরিবারে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২):
- স্বামী-স্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন।
- ওসিয়াত ও ঋণ পরিশোধের পরেই উত্তরাধিকার বণ্টন হবে।
- “কলা-লাহ” (পিতা-মাতা ও সন্তানহীন) ব্যক্তির ভাই-বোনও নির্দিষ্ট অংশ পাবে।
- উত্তরাধিকার লঙ্ঘন করা মহাপাপ।
উত্তরাধিকার বণ্টনের বিধান আল্লাহ নিজে নির্ধারণ করেছেন। এগুলো তাঁর সীমারেখা, যা মানতে হবে। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ এর আনুগত্য করে, সে জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখ লাভ করবে। এটাই মানুষের জন্য প্রকৃত সাফল্য।
আয়াত ১৩-এর শিক্ষনীয় বিষয়:
- উত্তরাধিকার বিধান মানা আল্লাহর হুকুম মানা।
- আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের প্রতিদান জান্নাত।
- মুমিনের আসল সফলতা হলো আখিরাতের মুক্তি।
যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অমান্য করবে, বিশেষ করে উত্তরাধিকার বিধান লঙ্ঘন করবে, তার প্রতিফল হবে জাহান্নাম। সেখানে সে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন— তাঁর নির্ধারিত সীমা অমান্য করা সরাসরি চিরস্থায়ী আযাবের কারণ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি উত্তরাধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার জান্নাতের অংশ কেটে দেবেন।” (📖 ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৭০৩)
আয়াত ১৪-এর শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহর সীমারেখা অমান্য করা মানে বড় গুনাহে লিপ্ত হওয়া।
- উত্তরাধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা জাহান্নামের কারণ।
- মুমিনের জন্য আল্লাহর আনুগত্যই মুক্তির পথ।
এই আয়াত প্রাথমিকভাবে ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে নারীদেরকে গৃহবন্দী করার বিধান দিয়েছিল। তবে পরে সূরা নূর (২৪:২) এর মাধ্যমে ব্যভিচারের চূড়ান্ত শাস্তি নির্ধারণ করা হয়— **অবিবাহিত ব্যভিচারীর জন্য ১০০ বেত্রাঘাত এবং বিবাহিত হলে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড (হাদ্দ)।**
এখানে মূল শিক্ষা হলো—ব্যভিচারের জন্য চারজন ন্যায়বান সাক্ষীর প্রয়োজন, যা প্রমাণ করে ইসলাম মানুষকে অন্যায় অপবাদ ও সীমালঙ্ঘন থেকে রক্ষা করেছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমার উম্মতের জন্য আমি সবচেয়ে ভয় করি—ব্যভিচার ও সুদ।” (📖 মুসনাদ আহমদ, হাদিস: ২২৯৬২) আবার হাদিসে এসেছে— “যখন ব্যভিচার ও সুদ প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়বে, তখন জনগণের উপর আল্লাহর শাস্তি নাযিল হবে।” (📖 সহিহ হাকিম, হাদিস: ২২৫৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজে ব্যভিচার নানা নামে ছড়িয়ে পড়েছে—অবৈধ সম্পর্ক, ফ্রি-মিক্সিং, ইন্টারনেট অবাধ ব্যবহার।
- অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফি ব্যভিচারের পথকে সহজ করে দিচ্ছে।
- যুবসমাজকে বাঁচাতে ইসলামী শিক্ষা, হায়া (লজ্জাশীলতা) ও পরিবারভিত্তিক সুরক্ষা জরুরি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫):
- ব্যভিচার একটি গুরুতর অপরাধ, প্রমাণের জন্য কঠোর শর্ত (চারজন সাক্ষী) রয়েছে।
- আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত শাস্তি মানা জরুরি।
- অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে।
- পাপের প্রচলন হলে সমাজে আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে।
এই আয়াতে পুরুষদের ব্যভিচারের প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে সমাজ থেকে লজ্জা দেওয়া, ভর্ৎসনা করা বা শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ ছিল। তবে পরে সূরা নূর (২৪:২) এ স্পষ্টভাবে চূড়ান্ত শাস্তি নাজিল হয়েছে— **অবিবাহিত ব্যভিচারীর জন্য ১০০ বেত্রাঘাত এবং বিবাহিত হলে রজম (পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যু)।**
এখানে মূল শিক্ষা হলো—ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা এবং যারা ভুল করেছে তাদের তওবা করে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যখন ব্যভিচার ও সুদ প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়বে, তখন জনগণ আল্লাহর শাস্তির কবলে পড়বে।” (📖 সহিহ হাকিম, হাদিস: ২২৫৯) আরেক হাদিসে এসেছে— “যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তওবা করে, আল্লাহ তার পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৬৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের যুগে ব্যভিচারকে অনেকেই স্বাভাবিক মনে করে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ।
- অনেক যুবক-যুবতী অবাধ সম্পর্ক, অবৈধ প্রেম ও সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে জিনার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
- সমাজে ইসলামী শাস্তি কার্যকর না থাকলেও পরিবার ও সমাজকে তরুণদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নৈতিক শিক্ষা ও হায়া শেখানো জরুরি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬):
- ব্যভিচার একটি বড় গুনাহ, এর শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ।
- তওবা ও সংশোধনের দরজা আল্লাহ খোলা রেখেছেন।
- সমাজের দায়িত্ব—অশ্লীলতার প্রচলন রোধ করা এবং পাপীদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া।
- মুমিনকে সবসময় আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে এবং পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন যে তাওবা কবুল হয় তাদের জন্য— যারা গুনাহ করে কিন্তু পরে দ্রুত অনুতপ্ত হয় ও ফিরে আসে। এখানে “অজ্ঞতা” বলতে বোঝানো হয়েছে— না জেনে গুনাহ করা, অথবা আবেগে, প্রবৃত্তির চাপে বা মুহূর্তের দুর্বলতায় গুনাহ করা। কিন্তু তারা গুনাহকে স্থায়ী অভ্যাস বানায় না, বরং দ্রুত তওবা করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি তওবা করে, সে এমন যেন সে কোনো গুনাহই করেনি।” (📖 ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২৫০) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ রাতের বেলায় তওবা কবুল করেন দিনের গুনাহগারের, আর দিনের বেলায় তওবা কবুল করেন রাতের গুনাহগারের, যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে ওঠে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৫৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ ভুল করে, কিন্তু পরে লজ্জিত হয় ও ক্ষমা চায়—এটাই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য তওবা।
- যেমন—কেউ রাগের মাথায় অন্যায় করে ফেলে, পরে অনুতপ্ত হয়ে মাফ চায়।
- অশ্লীলতা, গীবত বা অন্য যে কোনো গুনাহ করে থাকলেও দ্রুত তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭):
- তাওবার দরজা খোলা থাকে, যতক্ষণ না মৃত্যু বা কিয়ামতের আলামত আসে।
- অজ্ঞতা বা প্রবৃত্তির কারণে গুনাহ হলেও দ্রুত তওবা করা জরুরি।
- আল্লাহ দয়ালু, তিনি আন্তরিক তওবা কবুল করেন।
- মুমিনকে সর্বদা গুনাহের পর অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে।
এই আয়াত তাওবার একটি সীমা নির্ধারণ করেছে। - যে ব্যক্তি গুনাহ করতে করতে মৃত্যুশয্যায় এসে তাওবা করবে, তার তাওবা কবুল হবে না। - একইভাবে, যে ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মারা যায়, তার তাওবা কবুল হয় না। আল্লাহ মানুষকে সুযোগ দেন মৃত্যুর আগে তওবা করার জন্য। কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তে গিয়ে তওবা করা আসলেই অনুতাপ নয়, বরং বাধ্যতামূলক স্বীকারোক্তি—এটি আল্লাহ গ্রহণ করেন না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবা গ্রহণ করেন, যতক্ষণ না সে মৃত্যুযন্ত্রণায় পৌঁছে (রূহ গলায় পৌঁছায়)।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৩৭; সহিহ ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২৫৩) আরেক হাদিসে এসেছে— “ফেরাউন যখন ডুবে যাচ্ছিল, তখন বলল: আমি ঈমান এনেছি! কিন্তু তখন আল্লাহ তার ঈমান কবুল করেননি।” (📖 সূরা ইউনুস: ৯০-৯১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে বলে—“বৃদ্ধ বয়সে নামাজ পড়ব, মৃত্যুর আগে তাওবা করব”—এটি ভুল ধারণা।
- যারা জীবনভর গুনাহ করে এবং মৃত্যুশয্যায় এসে আল্লাহর কথা স্মরণ করে, তাদের তাওবা গ্রহণযোগ্য নয়।
- যারা ঈমান ছাড়া মৃত্যু বরণ করে, তাদের জন্য আখিরাতে চরম শাস্তি অপেক্ষা করছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৮):
- তাওবার সুযোগ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সীমিত।
- মৃত্যুশয্যায় এসে তাওবা করা গ্রহণযোগ্য নয়।
- কাফের অবস্থায় মৃত্যু হলে আল্লাহর শাস্তি নিশ্চিত।
- মুমিনকে দেরি না করে সবসময় তওবা করতে হবে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে।
এই আয়াত স্ত্রীদের সাথে আচরণের মৌলিক শিক্ষা দেয়। - জাহিলিয়াত যুগে প্রথা ছিল—মৃত ব্যক্তির স্ত্রীকে জোর করে উত্তরাধিকার হিসেবে নেওয়া। ইসলাম তা নিষিদ্ধ করল। - স্ত্রীদের কষ্ট দিয়ে বা নির্যাতন করে তাদের থেকে মাহর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। - স্বামীকে স্ত্রীদের সাথে সুন্দর ব্যবহার ও সদাচার করতে হবে। - যদি স্ত্রীকে অপছন্দও করে, তবুও ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে, কারণ আল্লাহ সেই সম্পর্কেই কল্যাণ রেখেছেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সাথে সর্বোত্তম আচরণ করে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ৩৮৯৫) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার وصية (অসিয়ত) আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক সমাজে আজও নারীদের জোরপূর্বক বিবাহ বা উত্তরাধিকার দখল করা হয়।
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ হলে অনেক পুরুষ স্ত্রীদের নির্যাতন করে বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
- কিছু পুরুষ স্ত্রীর মাহর ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়—এটি কুরআনের স্পষ্ট বিরোধী।
- বিবাহিত জীবনে অপছন্দ থাকলেও ধৈর্য ধরলে অনেক সময় পরে তাতে কল্যাণ আসে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৯):
- নারীদের জোরপূর্বক বিবাহ বা উত্তরাধিকার করা হারাম।
- স্ত্রীর প্রতি নির্যাতন ও অধিকার হরণ ইসলাম অনুমোদন করে না।
- স্বামীকে সদাচারসহ জীবনযাপন করতে হবে।
- যা অপছন্দ মনে হয়, তাতেও আল্লাহ কল্যাণ রেখেছেন।
এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন— যদি স্বামী কোনো কারণে আগের স্ত্রীকে ছেড়ে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করে, তবে আগের স্ত্রীকে দেওয়া মাহর বা সম্পদ ফেরত নেওয়া যাবে না। যদিও তা বিপুল সম্পদ হয়, তবুও তা স্ত্রীর অধিকার। স্ত্রীকে অপবাদ দিয়ে বা জোরপূর্বক সম্পদ ফেরত নেওয়া স্পষ্ট গুনাহ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “নারীদের মাহর থেকে কিছু কেড়ে নেওয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫১৬২) তিনি ﷺ আরও বলেছেন— “তোমরা নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করো, কারণ তারা তোমাদের কাছে আমানত।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সমাজে স্বামী নতুন বিয়ে করলে পুরনো স্ত্রীকে কষ্ট দিয়ে তার অধিকার কেড়ে নিতে চায়।
- কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের পর স্ত্রীকে দেওয়া মাহর ফেরত নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
- এমনকি অনেক সময় অপবাদ দিয়ে বা আদালতের মাধ্যমে নারীর হক মেরে দেওয়া হয়, যা ইসলামের খিলাফ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২০):
- স্ত্রীর মাহর ও অধিকার কেড়ে নেওয়া হারাম।
- স্বামী যদি নতুন স্ত্রী গ্রহণ করে, তবে পুরনো স্ত্রীর হক আরও বেশি রক্ষা করা জরুরি।
- অপবাদ দিয়ে সম্পদ নেওয়া মহাপাপ।
- নারীদের সম্মান ও হক রক্ষা ইসলামের অপরিহার্য বিধান।
আল্লাহ এখানে স্বামীদের সতর্ক করেছেন— স্ত্রীদের অধিকার, বিশেষত মাহর, অন্যায়ভাবে নেওয়া যাবে না। কারণ বিবাহ একটি সাধারণ চুক্তি নয়, বরং এটি **মীসাকান গালীযা**—একটি দৃঢ় ও গুরুতর অঙ্গীকার। স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উল্লেখ করে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, এমন সম্পর্কের পর স্ত্রীর হক অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতা ও জঘন্য পাপ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “নারীদের হক আদায় করো এবং তাদের সম্মানের সাথে জীবনযাপন করো, কারণ তারা তোমাদের নিকট আমানত।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১৮) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল হলো তালাক।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২১৭৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীর মাহর ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করে, যা এই আয়াতের স্পষ্ট বিরোধী।
- বিবাহকে অনেক সময় সাধারণ সামাজিক সম্পর্ক মনে করা হয়, অথচ আল্লাহ এটিকে গুরুতর অঙ্গীকার বলেছেন।
- স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের পরে তার হক অস্বীকার করা ন্যায়বিচারবিরোধী এবং আল্লাহর কাছে বড় গুনাহ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২১):
- বিবাহ হলো মজবুত অঙ্গীকার (মীসাকান গালীযা), এটিকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।
- স্ত্রীর মাহর ফেরত নেওয়া বা অস্বীকার করা হারাম।
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পারস্পরিক আস্থা, সম্মান ও দায়িত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।
- স্ত্রীর অধিকার রক্ষা করা আল্লাহর হুকুম।
জাহিলিয়াত যুগে প্রচলিত ছিল—মানুষ তার পিতার স্ত্রীকে বিয়ে করত। ইসলাম এসে একে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। পিতার স্ত্রী মানে জন্মদাতা পিতা, দাদা কিংবা আরও উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষদের স্ত্রী। এটি সবচেয়ে জঘন্য কাজগুলোর মধ্যে একটি, কারণ এতে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং বড় ধরনের অশ্লীলতা সৃষ্টি হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি তার পিতার স্ত্রীকে বিয়ে করবে, আল্লাহ তাকে এবং তাকে বিয়ে করা নারী উভয়কেই জাহান্নামে দেবে।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২২৫৪; নাসায়ী, হাদিস: ৩২২৫) আরেক হাদিসে এসেছে— “যে ব্যক্তি তার পিতার স্ত্রীকে বিয়ে করেছে, তাকে হত্যা করো।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৮৩০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭০৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজেও আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
- এটি কেবল শারীরিক গুনাহ নয়, বরং গোটা পরিবার কাঠামো ধ্বংস করে দেয়।
- এ আয়াত মনে করিয়ে দেয় যে ইসলামে পরিবার ও আত্মীয়তার পবিত্রতা রক্ষার জন্য কঠোর বিধান রয়েছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২২):
- পিতার স্ত্রী বা পূর্বপুরুষদের স্ত্রীদের বিয়ে করা চিরতরে হারাম।
- এটি সবচেয়ে জঘন্য ও ঘৃণিত কাজ, যা সমাজকে ধ্বংস করে।
- ইসলামে পরিবার ও আত্মীয়তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- অশ্লীলতা ও সীমালঙ্ঘন থেকে বাঁচতে কুরআনের এই বিধান মেনে চলা ফরজ।
এই আয়াতে হারাম সম্পর্কের পূর্ণ তালিকা এসেছে। হারাম নারীরা দুই ভাগে— ১️ **চিরতরে হারাম**: মা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভ্রাতুষ্পুত্রী, ভগ্নী-পুত্রী, দুধ-মা, দুধ-বোন, স্ত্রীর মা, সৎ-কন্যা (যদি স্ত্রীকে সহবাস করা হয়), ছেলের স্ত্রী। ২️ **অস্থায়ীভাবে হারাম**: এক সাথে দুই বোনকে বিয়ে করা। ইসলাম পরিবার ব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষার জন্য এ সম্পর্কগুলোতে বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “দুধ সম্পর্কও বংশ সম্পর্কের মতো (হারাম করে)।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৪৪) তিনি ﷺ আরও বলেছেন— “তোমরা নারীদের সাথে বিয়েতে (হারাম ও হালাল) বিষয়ে আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রম করো না।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫১০০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কিছু সমাজে এখনো আত্মীয়তার মধ্যে অজ্ঞতাবশত হারাম সম্পর্কের প্রতি ঝুঁক দেখা যায়।
- দুধ-মা ও দুধ-বোনের সম্পর্ক অনেক সময় অবহেলা করা হয়, অথচ এটি বংশের মতোই হারাম।
- এক সাথে দুই বোনকে বিয়ে করা ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু আজও কিছু সংস্কৃতিতে দেখা যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৩):
- হারাম সম্পর্ক আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত, পরিবর্তনযোগ্য নয়।
- দুধ সম্পর্কও (রদা‘আহ) বংশ সম্পর্কের মতো বিয়েতে হারাম করে।
- পরিবার ব্যবস্থার শুদ্ধতা ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ইসলাম এই সীমারেখা দিয়েছে।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল, পূর্বের ভুল ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু পরবর্তীতে সীমা লঙ্ঘন করা মহাপাপ।
- বিবাহিত নারীকে বিয়ে করা হারাম, তবে যুদ্ধবন্দী দাসীদের ক্ষেত্রে (যাদের বৈধ মালিকানা হয়) আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন। - বৈধ সম্পর্ক হলো কেবল **নিকাহ** (বিবাহ) এর মাধ্যমে। - নিকাহর উদ্দেশ্য হলো—সচ্চরিত্র জীবনযাপন, ব্যভিচার নয়। - স্ত্রীদেরকে মাহর দেওয়া ফরজ, এটি তাদের অধিকার। - মুতআ নিকাহ (সাময়িক বিবাহ) আগে জাহিলিয়াতে প্রচলিত ছিল, পরে ইসলাম একে হারাম ঘোষণা করেছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে মুতআ (সাময়িক নিকাহ) করার অনুমতি দিয়েছিলাম। এখন আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত এটিকে হারাম করেছেন। যার কারো কাছে কেউ আছে, সে তাকে ছেড়ে দিক।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪০৬) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কারো সাথে ব্যভিচার করবে বা সাময়িক নিকাহ করবে, সে আল্লাহর অভিশপ্ত।” (📖 সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকাল অনেকেই সাময়িক সম্পর্ককে বৈধ করার চেষ্টা করে, যা মুতআ নিকাহের মতো। এটি ইসলাম সম্পূর্ণরূপে হারাম করেছে।
- কিছু সমাজে বিবাহ ছাড়া অবাধ সম্পর্ককে স্বাভাবিক মনে করা হয়—এটি স্পষ্ট ব্যভিচার।
- আধুনিক যুগে বিবাহের মাহরকে হালকা মনে করা হয়, অথচ কুরআন একে ফরজ করেছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৪):
- বিবাহিত নারী চিরতরে হারাম, কেবল বৈধ মালিকানাধীন দাসী ব্যতীত।
- শুধুমাত্র নিকাহই বৈধ সম্পর্কের পথ, ব্যভিচার নয়।
- স্ত্রীকে মাহর দেওয়া ফরজ ও তার অধিকার।
- সাময়িক নিকাহ (মুতআ) ইসলাম দ্বারা নিষিদ্ধ।
- নিকাহর উদ্দেশ্য হলো—সচ্চরিত্র জীবনযাপন ও পরিবার গঠন।
- যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই স্বাধীন নারীকে বিয়ে করার, তারা মুমিন দাসীকে বিয়ে করতে পারবে। - তবে দাসীকে বিয়ে করার জন্যও অভিভাবকের অনুমতি ও মাহর নির্ধারণ আবশ্যক। - উদ্দেশ্য হবে পবিত্র জীবনযাপন, ব্যভিচার বা গোপন সম্পর্ক নয়। - দাসীর ব্যভিচারের শাস্তি স্বাধীন নারীর তুলনায় অর্ধেক—কারণ দাসী সমাজে দুর্বল অবস্থায় থাকে। - আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন—ধৈর্য ধরে স্বাধীন নারীকে বিয়ে করাই উত্তম।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি দাসীকে শিক্ষিত করে, সুন্দর আচার-আচরণ শেখায়, তারপর তাকে মুক্তি দেয় এবং বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৭) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারে না, সে বিয়ে করুক।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৬৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪০০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যদিও আজকের যুগে দাসপ্রথা নেই, তবে এই আয়াত থেকে শিক্ষা—সমাজের দুর্বল শ্রেণীকেও সম্মানের সাথে বিবাহ করা বৈধ।
- আজ যারা আর্থিক কারণে বিয়ে বিলম্ব করে, তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়—এটি বড় গুনাহ।
- ধৈর্য ধরে বৈধ পথে বিবাহ করাই উত্তম, অবৈধ সম্পর্ক নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৫):
- বিবাহ মানুষের জন্য ব্যভিচার থেকে সুরক্ষা।
- দরিদ্র হলেও বৈধভাবে বিয়ে করা যাবে, অবৈধ সম্পর্ক নয়।
- স্ত্রীকে মাহর দেওয়া আবশ্যক।
- ধৈর্য ধরে আল্লাহর বিধান মানা সর্বোত্তম।
আল্লাহর রহমত হলো—তিনি বান্দাদের জন্য হালাল-হারাম পরিষ্কার করেছেন, যাতে তারা বিভ্রান্ত না হয়। পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের মতো পথভ্রষ্ট না হয়ে মুমিনরা সঠিক পথে থাকে। আল্লাহ চান মানুষ তওবা করুক, তিনি তাদের ক্ষমা করতে প্রস্তুত। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সীমাহীন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরো, কখনো পথভ্রষ্ট হবে না— আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” (📖 মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৫৯৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ নানা মতবাদ, দর্শন ও সংস্কৃতির অনুসরণ করছে, ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
- কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব নয়।
- আল্লাহর দেয়া স্পষ্ট নির্দেশনা মানলে সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৬):
- আল্লাহ মানুষের জন্য হালাল-হারাম স্পষ্ট করেছেন।
- কুরআন-সুন্নাহই সঠিক পথের একমাত্র উৎস।
- আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা করতে চান, তাই তওবা করা জরুরি।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়—তাঁর বিধানে কোনো ভুল নেই।
আল্লাহ তাওবার দরজা খুলে রেখেছেন, যাতে তাঁর বান্দারা ফিরে এসে ক্ষমা লাভ করতে পারে। কিন্তু যারা নিজেদের খেয়াল-খুশি ও কাম-বাসনার পেছনে ছুটে চলে, তারা চায় মুমিনরা যেন সঠিক পথ থেকে সরে যায়। এ কারণেই কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “সমস্ত আদম সন্তানই ভুল করে; আর ভুলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তারা, যারা তাওবা করে।” (📖 তিরমিযী, হাদিস: ২৪৯৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের যুগে নানারকম ভোগবাদী প্রবণতা সহজলভ্য হয়ে গেছে।
- সামাজিক মাধ্যমে নৈতিকতা-বিরোধী প্রচার মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
- কুরআন-সুন্নাহর আলোয় জীবন গড়লেই এ বিভ্রান্তি থেকে বাঁচা সম্ভব।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৭):
- আল্লাহ তাওবার আহ্বান করেন; তিনি বান্দাদের ক্ষমা করতে চান।
- ইচ্ছা-বাসনার অনুসরণ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
- কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা আঁকড়ে ধরাই মুক্তির পথ।
- আল্লাহ চান মুমিনরা পথভ্রষ্ট না হয়ে সঠিক পথে থাকুক।
- আল্লাহ বান্দাদের কষ্টে ফেলতে চান না, তাই দ্বীনের বিধান সহজ করেছেন। - নামাজ, রোযা, যাকাত, হজ—সব ইবাদতে সহজীকরণ রয়েছে। - মানুষ দুর্বল, তাই পাপ করে, কিন্তু আল্লাহ তাঁর দয়া দ্বারা তাওবার সুযোগ দিয়েছেন। - ইসলামে কঠোরতার পরিবর্তে সহজতা, দয়া ও ক্ষমার নীতি বিদ্যমান।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “এই দ্বীন সহজ, যে এটিকে কঠিন করতে চাইবে, সে পরাজিত হবে। তাই মধ্যপন্থা অবলম্বন করো।” (📖 সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৯) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন— “তোমরা সহজ করে দাও, কঠিন করো না; সুসংবাদ দাও, ঘৃণা সৃষ্টি করো না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কেউ অসুস্থ হলে বসে বা শুয়ে নামাজ পড়তে পারে।
- যাত্রী হলে রোযা ভাঙা বৈধ, পরে কাজা করতে হবে।
- অসামর্থ্যবান হলে হজ ফরজ হয় না।
- এসবই প্রমাণ করে ইসলাম মানুষের দুর্বলতা বিবেচনা করে বিধান দিয়েছে।
শিক্ষনীয় বিষয়:
- ইসলাম মানুষের জন্য সহজ ধর্ম।
- আল্লাহ বান্দাদের দুর্বলতা জানেন, তাই কষ্টে ফেলেন না।
- যে ব্যক্তি দ্বীনে বাড়াবাড়ি করে, সে টিকতে পারে না।
- মুমিনকে সহজভাবে দ্বীন পালন করতে হবে এবং সর্বদা তাওবা করতে হবে।
আল্লাহ এই আয়াতে মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ না করে। সুদ, ঘুষ, চুরি, জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা হারাম। শুধুমাত্র বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য ও উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি দ্বারা লেনদেন বৈধ। এছাড়াও এখানে আত্মহত্যা থেকে কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ বান্দার প্রতি দয়ালু এবং তিনি চান বান্দারা সুস্থ-সবল থেকে ইবাদত করুক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমাদের কেউ যেন আত্মহত্যা না করে। যে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে চিরকাল সেই যন্ত্রণা ভোগ করবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫৭৭৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই সুদ ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করছে, যা ইসলামে হারাম।
- অন্যায় উপায়ে ধনী হওয়া সমাজে অশান্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি করে।
- অর্থনৈতিক সংকট ও মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ইসলাম এ কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৯):
- অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ হারাম।
- বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহর কাছে পবিত্র।
- আত্মহত্যা একটি মহাপাপ।
- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়ালু ও রহমতশীল।
পূর্ববর্তী আয়াতে অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ ও আত্মহত্যা থেকে নিষেধ করা হয়েছিল। এখানে আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন—যে ব্যক্তি জেনে-শুনে সীমালঙ্ঘন ও জুলুম করে এসব কাজ করবে, তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহর জন্য এটা করা কোনো কঠিন কাজ নয়। এটা মানুষকে সতর্ক করে দেয় যে, বড় পাপ করে পার পাওয়া অসম্ভব।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কিয়ামতের দিনে বড় বড় অপরাধীদের মধ্যে একজনকে নিয়ে আসা হবে এবং তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৫১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অন্যায় ও জুলুম করে সম্পদ উপার্জনকারীদের পরিণতি হবে কঠিন শাস্তি।
- আত্মহত্যা, খুন, সুদ, প্রতারণা ইত্যাদি জুলুমের কাজ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
- আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচতে হলে সীমালঙ্ঘন ও জুলুম থেকে বিরত থাকতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩০):
- জুলুম ও সীমালঙ্ঘনকারী আল্লাহর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।
- জাহান্নামের আগুন আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা।
- পাপকে ছোট করে দেখা যাবে না, কারণ এর পরিণতি ভয়াবহ।
- আল্লাহর বিধান অমান্য করে নিরাপদ থাকা সম্ভব নয়।
এই আয়াতে আল্লাহর বিশেষ দয়া প্রকাশ পেয়েছে। যদি মানুষ বড় গুনাহগুলো (যেমন: শিরক, হত্যা, সুদ, ব্যভিচার ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকে, তবে ছোটখাটো গুনাহগুলো আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আর মুমিনদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এটি মুমিনদের জন্য এক বিরাট সুখবর।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমা থেকে পরবর্তী জুমা, রমজান থেকে পরবর্তী রমজান — এগুলো সব গুনাহ মাফ করে দেয়, যদি বড় গুনাহগুলো এড়িয়ে চলা হয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মুসলিম ছোট গুনাহকে হালকা ভাবে নেয়, কিন্তু বড় গুনাহে জড়িয়ে পড়ে।
- শিরক, সুদ, ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদি বড় গুনাহ থেকে বিরত থাকলে আল্লাহ ছোট পাপ ক্ষমা করবেন।
- নিয়মিত নামাজ, রোজা ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা সম্ভব।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩১):
- বড় গুনাহ থেকে বিরত থাকা আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার প্রধান শর্ত।
- ছোট গুনাহগুলো আল্লাহ ক্ষমা করে দেন যদি বান্দা বড় গুনাহে লিপ্ত না হয়।
- আল্লাহ জান্নাতকে মুমিনদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন।
- নিয়মিত ইবাদত ও তওবা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়।
এ আয়াতে আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন— অন্যের প্রাপ্ত অনুগ্রহ দেখে হিংসা করা বা অযথা আকাঙ্ক্ষা করা উচিত নয়। প্রত্যেককে তার পরিশ্রম অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া হবে। পুরুষ ও নারীর মধ্যে আল্লাহ যে ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন তা হিকমতের ভিত্তিতে। সবার উচিত আল্লাহর কাছে তাঁর ফযল ও রহমত প্রার্থনা করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “ধনী ব্যক্তি ও গরীব ব্যক্তি উভয়েই আল্লাহর কাছে সমান হতে পারে, যদি তারা নিজেদের অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে এবং আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ চায়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩১২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ আজও অন্যের সম্পদ, পদমর্যাদা বা প্রতিভা দেখে হিংসা করে।
- নারী-পুরুষ উভয়েই তাদের সৎ পরিশ্রমের প্রতিদান আল্লাহর কাছ থেকে পাবে।
- অন্যের অনুগ্রহ দেখে হিংসা না করে আল্লাহর কাছে নিজেকে উন্নত করার দোয়া করা উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩২):
- হিংসা ও অযথা আকাঙ্ক্ষা পরিহার করতে হবে।
- পুরুষ-নারী উভয়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রাপ্তি নির্ধারিত।
- মানুষের উচিত আল্লাহর অনুগ্রহ চাওয়া, মানুষের প্রতি নয়।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ—তিনি জানেন কার জন্য কী উত্তম।
এই আয়াতে আল্লাহ উত্তরাধিকার সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম ঘোষণা করেছেন। পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে প্রত্যেকের জন্য আল্লাহ উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেছেন। এছাড়া প্রাচীন কালে মুসলিমরা একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব বা অঙ্গীকার করতো, তাদের প্রতিশ্রুত অংশও দিতে বলা হয়েছে। আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং সাক্ষী, তাই উত্তরাধিকার বণ্টনে কোনো ধরনের অবিচার করা যাবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ প্রত্যেক অধিকারীর অধিকার নির্ধারণ করেছেন, তাই কোনো উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো وصية (উইল) নেই।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২৮৭০; তিরমিযী, হাদিস: ২১২০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক স্থানে উত্তরাধিকার বণ্টনে অবিচার করা হয়।
- নারীদের প্রাপ্য অংশ প্রায়শই কেড়ে নেওয়া হয়, অথচ ইসলাম তাদের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
- উত্তরাধিকার বণ্টনে আল্লাহর আইন মানলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৩):
- উত্তরাধিকার বণ্টন আল্লাহর নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী করতে হবে।
- অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা আবশ্যক।
- আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা ও সাক্ষী, তাই অন্যায় করলে তিনি তা জানেন।
- নারী-পুরুষ সবার প্রাপ্য অধিকার সংরক্ষণ করা ইসলামের শিক্ষা।
এই আয়াতে পরিবার পরিচালনা ও দায়িত্বে পুরুষের কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে। কারণ পুরুষরা নারীর ভরণ-পোষণ, নিরাপত্তা ও নেতৃত্বের দায়িত্ব বহন করে। সৎ নারীরা স্বামী অনুপস্থিত থাকলেও বিশ্বস্ত থাকে। আর যদি কোনো নারী অবাধ্য হয় তবে তাকে প্রথমে উপদেশ দিতে হবে, তাতে কাজ না হলে সাময়িক শয্যা পৃথক করতে হবে, তাতেও কাজ না হলে শাসন করা যাবে, তবে হালকাভাবে। এর উদ্দেশ্য সংশোধন, নির্যাতন নয়। আর যদি তারা অনুগত হয়, তবে কোনো অজুহাতে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ঠ।” (📖 তিরমিযী, হাদিস: ৩৮৯৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পরিবার ভেঙে যাচ্ছে দায়িত্বহীনতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে।
- পুরুষের উচিত পরিবারে দায়িত্ব পালন করা, আর নারীর উচিত বিশ্বস্ত থাকা।
- পারিবারিক ঝগড়ায় মারধর ও নির্যাতন নয়, বরং ইসলামিক নির্দেশিত সীমিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৪):
- পুরুষরা পরিবারের অভিভাবক ও দায়িত্বশীল।
- নারীদের উচিত স্বামী অনুপস্থিত থাকলেও সততা ও বিশ্বস্ততা বজায় রাখা।
- বিবাহিত জীবনে সমস্যা হলে ধাপে ধাপে ইসলামী পদ্ধতিতে সমাধান করতে হবে।
- আল্লাহ মহান ও সর্বোচ্চ—তাঁর আইনকে অমান্য করা চলবে না।
এই আয়াতে বৈবাহিক জীবনের বিবাদ সমাধানের জন্য ইসলামী পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে। যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গুরুতর কলহ দেখা দেয়, তবে উভয় পক্ষ থেকে ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি বা সালিশ নিযুক্ত করতে হবে। উদ্দেশ্য হবে তাদের মধ্যে মিল-মিশ ও শান্তি স্থাপন করা। যদি তাদের ইচ্ছা সত্যিই সমাধানের হয়, তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে ঐক্য দান করবেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল জিনিস হলো তালাক।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ২১৭৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পরিবার ছোটখাটো কারণে ভেঙে যাচ্ছে।
- বিবাহিত জীবনে কলহ হলে উভয় পক্ষের অভিভাবক বা জ্ঞানী মানুষকে সালিশ করা উচিত।
- যদি উভয় পক্ষের মন পরিষ্কার থাকে তবে আল্লাহ তাদের মিলন ঘটাবেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৫):
- বিবাহিত জীবনের কলহ সমাধানে সালিশ পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত।
- উভয় পক্ষের অভিভাবক বা বিশ্বস্ত প্রতিনিধি থাকলে সমাধান সহজ হয়।
- তালাক সর্বশেষ বিকল্প, আগে সমাধানের সব পথ চেষ্টা করতে হবে।
- আল্লাহ মানুষের অন্তর সম্পর্কে সর্বজ্ঞ, তাই সৎ ইচ্ছা থাকলে মিলন ঘটবে।
আল্লাহ এই আয়াতে দ্বীনের মূল শিক্ষা একত্র করেছেন। প্রথমত, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, কারো সাথে শরীক করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়া ও সদ্ব্যবহার করতে হবে। তৃতীয়ত, এতিম, অভাবগ্রস্ত, প্রতিবেশী, সফরসঙ্গী ও অধীনস্থদের প্রতি করুণা দেখাতে হবে। ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে। অহংকার ও আত্মপ্রশংসা আল্লাহর কাছে ঘৃণিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাকে প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে এতবার وصية (উপদেশ) করেছেন যে আমি ধারণা করলাম, হয়তো প্রতিবেশীকেও উত্তরাধিকারী করা হবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬০১৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬২৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই প্রতিবেশীর অধিকার ভুলে যায়, যা সামাজিক অশান্তির কারণ।
- এতিম ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা সমাজের দায়িত্ব।
- গর্ব ও অহংকার পরিবার ও সমাজকে ভেঙে দেয়, ইসলাম এটি নিষিদ্ধ করেছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৬):
- আল্লাহর ইবাদত করা এবং শিরক থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে বড় কর্তব্য।
- পিতা-মাতা, আত্মীয়, প্রতিবেশী, এতিম ও অভাবীদের অধিকার রক্ষা করা জরুরি।
- অধীনস্থ কর্মচারী/সহযোগীদের প্রতিও সদ্ব্যবহার করতে হবে।
- অহংকার ও আত্মপ্রশংসা পরিহার করতে হবে, কারণ আল্লাহ তা অপছন্দ করেন।
আল্লাহ এ আয়াতে তিনটি নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন— (১) নিজেরা কৃপণতা করা, (২) অন্যকেও কৃপণ হতে বলা, (৩) আল্লাহর দেয়া নিয়ামত গোপন করা। এগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক অপরাধও বটে। কারণ এর ফলে সমাজে অন্যায় ও অবিচার ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের লোকদের জন্য আল্লাহ অপমানজনক শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তারা, যারা নিজেরা খায় না, অন্যকেও খেতে দেয় না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০৩৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে সম্পদ জমায় কিন্তু গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করে না।
- আজকাল ধনী লোকেরা অনেক সময় সমাজসেবাকে বাধা দেয়, যাতে দারিদ্র্য দূর না হয়।
- আল্লাহর দেয়া নিয়ামত প্রকাশ না করলে মানুষ কৃতজ্ঞ হতে শেখে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৭):
- কৃপণতা ইসলামে কঠোরভাবে নিন্দিত।
- অন্যকে কৃপণ হতে বলা আরও বড় অপরাধ।
- আল্লাহর নিয়ামত প্রকাশ করা কৃতজ্ঞতার অংশ।
- কৃপণ ও অকৃতজ্ঞদের জন্য পরকালে অপমানজনক শাস্তি রয়েছে।
এই আয়াতে আল্লাহ ভণ্ডামী ও রিয়ার (দেখানো) বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। যারা দান-খয়রাত করে শুধু মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য, অথচ আল্লাহ ও আখেরাতে তাদের বিশ্বাস নেই, তারা শয়তানের অনুসারী। আর শয়তান সবচেয়ে খারাপ সঙ্গী—যে মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করি ছোট শিরকের ব্যাপারে।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন: ছোট শিরক কী? তিনি বললেন: রিয়া (দেখানো ইবাদত)।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৮৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে দান-খয়রাত করে শুধুই ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে দেখানোর জন্য।
- ভণ্ডামির কারণে দান ও ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায়।
- যারা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস না করে, তারা সবসময় শয়তানের পথে চলে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৮):
- দান-খয়রাত কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে।
- মানুষকে দেখানোর জন্য দান করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
- আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস না থাকলে ইবাদত অর্থহীন।
- শয়তান হলো সবচেয়ে খারাপ সঙ্গী, তাই তার পথ থেকে বাঁচতে হবে।
এ আয়াতে আল্লাহ ভণ্ডদের অযৌক্তিক আচরণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তারা দান করে শুধুই মানুষকে দেখানোর জন্য। অথচ যদি তারা সত্যিই ঈমান আনতো, আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস রাখতো এবং আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে দান করতো, তবে সেটাই তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। আল্লাহ তাদের অন্তরের অবস্থা ভালোভাবেই জানেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “দান সম্পদ কমায় না; বরং আল্লাহ তা বাড়িয়ে দেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে দান-খয়রাত না করে সম্পদ জমিয়ে রাখে, যা আল্লাহর কাছে গুনাহ।
- যদি মানুষ আল্লাহ ও আখেরাতে সত্যিকার বিশ্বাস রাখতো, তবে দান-সদকা বাড়তো।
- আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে ব্যয় করলে সমাজে দারিদ্র্য দূর হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৯):
- আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস রাখলে দান করা সহজ হয়।
- দান করলে সম্পদ কমে না, বরং আল্লাহ তা বাড়িয়ে দেন।
- আল্লাহ মানুষের অন্তরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত।
- ভণ্ডামি পরিহার করে ঈমান ও ইখলাসের সাথে দান করতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহর পূর্ণ ন্যায়বিচার ও দয়া বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ কারো প্রতি সামান্যতমও জুলুম করেন না। বরং বান্দা যদি অতি ক্ষুদ্র সৎকাজও করে, আল্লাহ তার প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি করেন এবং আরও মহান পুরস্কার প্রদান করেন। এটি বান্দাদের জন্য আল্লাহর অসীম দয়ার প্রমাণ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি একটি নেক কাজের নিয়ত করে, কিন্তু তা করতে পারেনি, তার জন্যও একটি নেকি লেখা হয়। আর যে ব্যক্তি তা সম্পন্ন করে, তার জন্য দশ নেকি লেখা হয়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৪৯১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ অনেক সময় ভাবে ছোট ছোট আমল তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, অথচ আল্লাহ তার প্রতিদান বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।
- একটি সৎকাজ যেমন—একজন ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া— আখেরাতে বিশাল পুরস্কারের কারণ হতে পারে।
- আল্লাহর ন্যায়বিচার নিখুঁত, তাই কারও সামান্যতম সৎকাজও বৃথা যাবে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪০):
- আল্লাহ কারো প্রতি বিন্দুমাত্রও জুলুম করেন না।
- ছোট সৎকাজও আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।
- আল্লাহ সৎকাজের প্রতিদান বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।
- আল্লাহর প্রতিদান মহান ও সীমাহীন।
এ আয়াতে কিয়ামতের এক ভয়াবহ দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। সেদিন প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন সাক্ষী উপস্থিত করা হবে— যিনি জানাবেন উম্মতের অবস্থা, তারা তাদের নবীর প্রতি কীভাবে আচরণ করেছে। আর মহানবী ﷺ হবেন সমগ্র মানবজাতির উপর সাক্ষী। এটি প্রমাণ করে যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কোনো অজুহাত চলবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন— রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে এই আয়াত (৪১) তিলাওয়াত করতে বললেন। আমি তিলাওয়াত শুরু করলে, তিনি এত কাঁদতে লাগলেন যে তাঁর দাড়ি ভিজে গেল। (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৭৬৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮০০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ মনে করে কিয়ামতের দিন কেউ কিছু জানবে না। অথচ আল্লাহর সাক্ষী সবকিছু প্রকাশ করবে।
- নবী ﷺ-এর সাক্ষ্য প্রমাণ করবে কে তাঁর উম্মত ছিল এবং কে তাঁর আদেশ অমান্য করেছে।
- প্রত্যেক জাতির জন্য তাদের নবী সাক্ষী হবেন, তাই অজুহাত দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪১):
- কিয়ামতের দিন প্রত্যেক উম্মতের জন্য সাক্ষী থাকবে।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ সমগ্র মানবজাতির উপর সাক্ষী হবেন।
- মানুষের কর্ম লুকানো যাবে না, আল্লাহ সব প্রকাশ করবেন।
- এই আয়াত মুমিনদেরকে দুনিয়ায় আল্লাহর ভয় ও দায়িত্বশীল হতে শিক্ষা দেয়।
কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ দৃশ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যারা ঈমান আনেনি এবং রাসূল ﷺ-এর আদেশ অমান্য করেছে, তারা সেদিন আফসোস করে চাইবে—যেন মাটির সাথে মিশে যায়, যাতে শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে। কিন্তু আল্লাহর সামনে কিছুই গোপন করা যাবে না, তিনি সব প্রকাশ করবেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কিয়ামতের দিনে মানুষ আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান থাকবে। তাদের প্রত্যেকের সাথে দোভাষী থাকবে, এবং আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন: ‘তুমি এ কাজ করেছিলে কি না?’ তখন সে মিথ্যা বলতে পারবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৬৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ যারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তারা ভাবে হয়তো পার পেয়ে যাবে।
- কিন্তু কিয়ামতের দিনে তাদের কর্মই সাক্ষী দেবে।
- সেদিন অস্বীকার বা লুকানোর কোনো সুযোগ থাকবে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪২):
- কিয়ামতের দিন কাফির ও অবাধ্যরা অনুতপ্ত হবে।
- মানুষের সব কর্ম আল্লাহর সামনে প্রকাশ পাবে।
- আল্লাহর কাছ থেকে কিছুই গোপন করা সম্ভব নয়।
- এ আয়াত মুমিনদের জন্য সতর্কবার্তা—আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে শেষ পরিণতি ভয়াবহ।
এই আয়াতে নামাযের শিষ্টাচার ও পবিত্রতার গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমত, নামায আদায় করতে হলে মন সম্পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে, তাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়া নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, অপবিত্র অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয় যতক্ষণ না গোসল করা হয়। তবে যদি পানি না পাওয়া যায়, তাহলে আল্লাহ তাইয়াম্মুমের সহজ বিধান দিয়েছেন, যাতে বান্দারা নামায থেকে বঞ্চিত না হয়। এটি ইসলামের সহজ ও করুণাময় প্রকৃতিকে নির্দেশ করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “সমস্ত জমিন আমার জন্য পবিত্র করা হয়েছে ও মসজিদ করা হয়েছে। তাই আমার উম্মতের যে-ই নামাযের সময় পায়, সে যেন সেখানে নামায আদায় করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫২১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- নেশা আজও অনেক সমাজে প্রচলিত, যা নামায ও ঈমান নষ্ট করে।
- পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা ইসলামি ইবাদতের অপরিহার্য অংশ।
- যেখানে পানি পাওয়া যায় না, সেখানেও ইসলাম তাইয়াম্মুমের মাধ্যমে সহজ উপায় রেখেছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৩):
- নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায আদায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
- অপবিত্র হলে গোসল করা ফরজ, তা ছাড়া নামায বৈধ নয়।
- তাইয়াম্মুম ইসলামের সহজতার একটি দৃষ্টান্ত।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল, তাই বান্দাদের জন্য সবসময় সহজ রাস্তা রেখেছেন।
এখানে আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিস্টানদের একটি অংশ) কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাদের কিতাবের কিছু অংশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা সত্যকে বিকৃত করে ভ্রান্তি বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, তারা মুসলমানদেরও বিভ্রান্ত করতে চায়। এটি মুমিনদের জন্য সতর্কবার্তা— যেন তারা পূর্ববর্তী উম্মতের মতো বিভ্রান্তিতে না পড়ে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অনুসরণ করবে, হাতের আঙুলের সাথে আঙুল যেমন মিলে যায় তেমন করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭৩২০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৬৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ ইসলাম ছেড়ে ভ্রান্ত মতবাদকে অনুসরণ করছে।
- পাশ্চাত্যের অনেক প্রভাব মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করছে।
- শিরক, বিদআত ও কিতাব বিকৃতির পথ অনুসরণ করলে মুসলিম সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৪):
- আহলে কিতাবদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
- ভ্রান্তি অনুসরণ করলে পথভ্রষ্টতা নিশ্চিত।
- ইসলামের শিক্ষা আঁকড়ে ধরাই সঠিক পথ।
- অন্য জাতির ভ্রান্ত সংস্কৃতি ও মতবাদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
আল্লাহ মুমিনদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি তাদের শত্রুদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তাই শত্রুর ষড়যন্ত্র নিয়ে ভীত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মুমিনদের জন্য আল্লাহই অভিভাবক, রক্ষক ও সাহায্যকারী। বান্দা যদি তাঁর উপর ভরসা করে, তবে কোনো শত্রু ক্ষতি করতে পারবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে আল্লাহকে অভিভাবক বানায়, তার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৬৮৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মুসলিম উম্মাহর অনেক শত্রু রয়েছে, কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, সে সব পরিস্থিতিতে নিরাপদ থাকে।
- বিশ্বস্ত অভিভাবক কেবল আল্লাহ, মানুষ সীমিত ক্ষমতার অধিকারী।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৫):
- আল্লাহ মুমিনদের শত্রুদের সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
- আল্লাহই প্রকৃত অভিভাবক ও রক্ষক।
- আল্লাহর সাহায্যই সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্য।
- বান্দার উচিত সবসময় আল্লাহর উপর ভরসা করা।
এই আয়াতে ইহুদিদের একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে— তারা আল্লাহর কিতাব বিকৃত করেছে এবং সত্যকে গোপন করেছে। তারা নবী ﷺ-এর সাথে অসম্মানজনকভাবে কথা বলতো, যেমন “রা-ইনা” শব্দটি ব্যবহার করে ব্যঙ্গ করতো। অথচ তাদের উচিত ছিল বিনয়ীভাবে মানা ও শোনা। কুফরের কারণে আল্লাহ তাদের অভিশাপ দিয়েছেন এবং তারা অল্পই ঈমান আনে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা আহলে কিতাবদের মতো বলো না: ‘রা-ইনা’; বরং বলো: ‘উন্যুরনা’।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪১২৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩০১২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেকে কুরআনের ব্যাখ্যা বিকৃত করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে।
- ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা আধুনিক সমাজেও দেখা যায়।
- আল্লাহর বাণী বিকৃত করা বা উপহাস করা মানুষের ঈমান নষ্ট করে দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৬):
- আহলে কিতাবদের বিকৃতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
- আল্লাহর বাণী বিকৃত করা বা ব্যঙ্গ করা ভয়াবহ গুনাহ।
- বিনয় ও আনুগত্যই আল্লাহর প্রিয় আচরণ।
- কুফরের কারণে আল্লাহর লানত নেমে আসে।
এ আয়াতে আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিস্টান) উদ্দেশ্যে আল্লাহর আহ্বান করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে—কুরআনের উপর ঈমান আনতে হবে, কারণ এটি পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সত্যায়ন করে। তারা যদি ঈমান না আনে, তবে আল্লাহর কঠোর শাস্তি নেমে আসবে। যেমন: মুখ বিকৃত করে দেওয়া, বা সাবতবাসীদের মতো অভিশপ্ত হওয়া। এ আয়াত মানুষকে সতর্ক করে—আল্লাহর হুকুম অবশ্যই কার্যকর হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, এক হস্ত থেকে অন্য হস্ত, এক বাহু থেকে অন্য বাহু পর্যন্ত।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৬৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আহলে কিতাবরা কুরআনের প্রতি ঈমান না এনে নিজেদের পথভ্রষ্টতায় রয়ে গেছে।
- আজও অনেক মুসলিম কুরআনকে উপেক্ষা করে পাশ্চাত্যের প্রভাবিত সংস্কৃতি অনুসরণ করছে।
- আল্লাহর হুকুম অমান্য করলে অভিশাপ ও শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় নেই।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৭):
- কুরআনের প্রতি ঈমান আনা প্রতিটি আহলে কিতাব ও মুসলিমের জন্য আবশ্যক।
- আল্লাহর হুকুম কার্যকর হয়েই থাকে, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
- আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচতে হলে তাঁর কিতাব মানতে হবে।
- পূর্ববর্তী জাতিদের মতো পথভ্রষ্ট হলে একই পরিণতি হবে।
আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন—শিরক এমন গুনাহ যা কখনো ক্ষমাযোগ্য নয়, যদি কেউ তাতে মৃত্যু বরণ করে। তবে আল্লাহ অন্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারেন। তাই শিরক সবচেয়ে ভয়াবহ পাপ। কারণ এতে আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করা হয় এবং মাখলুককে তাঁর সমান করা হয়। এটি মানুষের ঈমান ও মুক্তি ধ্বংস করে দেয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক অবস্থায় মারা যাবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৪৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ মাজার, জ্যোতিষী, কুসংস্কার ও ভণ্ড পীরদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করে।
- শিরক হলো ইসলামের সবচেয়ে বড় অপরাধ, যা আখেরাতে মুক্তি নষ্ট করে দেয়।
- তাওবা করে আল্লাহর একত্বে ফিরে আসাই মুক্তির একমাত্র পথ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৮):
- আল্লাহ শিরক কখনো ক্ষমা করেন না, তাই এটি থেকে দূরে থাকা অপরিহার্য।
- অন্য গুনাহ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।
- শিরক হলো সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ, যা মানুষের মুক্তি ধ্বংস করে।
- আল্লাহর একত্বে দৃঢ় থাকা ও শিরক থেকে বাঁচা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য।
এই আয়াতে আল্লাহ তাদেরকে সমালোচনা করেছেন, যারা নিজেদেরকে পবিত্র দাবি করে। ইহুদিরা নিজেদেরকে নির্বাচিত ও পবিত্র জাতি মনে করতো। অথচ প্রকৃত পবিত্রতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। মানুষ যতই নিজের প্রশংসা করুক না কেন, আসল মূল্যবান হলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা। কিয়ামতের দিন আল্লাহর ন্যায়বিচার অনুযায়ী সবাইকে বিচার করা হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন; আর যে অহংকার করে, আল্লাহ তাকে অপমান করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই নিজেদের ধার্মিকতা নিয়ে গর্ব করে, অথচ অন্তরে ভণ্ডামি থাকে।
- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকেই প্রকৃত পবিত্রতা দান করেন।
- আল্লাহর কাছে বিনয়ী হওয়া ও আন্তরিক আমলই আসল মর্যাদার কারণ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৯):
- নিজেকে পবিত্র দাবি করা অহংকারের শামিল।
- আল্লাহই প্রকৃত পবিত্রতা দানকারী।
- মানুষের উপর আল্লাহ সামান্যতমও জুলুম করেন না।
- আল্লাহর কাছে বিনয়ী ও আন্তরিক হওয়াই আসল পবিত্রতা।
আল্লাহ এ আয়াতে ইহুদিদের ও ভণ্ডদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছেন। তারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করতো— যেমন নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা বলে দাবি করা, কিংবা তারা গুনাহ করলেও আল্লাহ শাস্তি দেবেন না বলে বিশ্বাস করা। অথচ আল্লাহ এসব মিথ্যাচারকে স্পষ্ট গুনাহ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে—আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলা সবচেয়ে বড় অপরাধগুলোর একটি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আমার নামে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা আরোপ করবে, সে তার স্থান জাহান্নামে করে নিক।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ১০৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর নামে মিথ্যা কথা চালু করে।
- মিথ্যা আকীদা ও ভিত্তিহীন দাবি সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
- আল্লাহর নামে মিথ্যা রটনা মানুষকে পথভ্রষ্ট করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫০):
- আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করা মারাত্মক গুনাহ।
- আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ছাড়া কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- মিথ্যা বিশ্বাস ও আকীদা সমাজকে বিভ্রান্ত করে।
- সত্য গ্রহণ করা এবং মিথ্যা প্রত্যাখ্যান করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য।
এ আয়াতে আহলে কিতাবদের এক গুরুতর বিভ্রান্তি উল্লেখ করা হয়েছে। তারা নিজেদেরকে আল্লাহর কিতাবপ্রাপ্ত দাবি করলেও, জিবত (মূর্তি, জাদু, কুসংস্কার) ও তাগুতের (অত্যাচারী নেতাদের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতো। শুধু তাই নয়, তারা কাফিরদেরকে মুমিনদের চেয়ে উত্তম বলতো। এটি ছিল তাদের ভ্রষ্টতা ও ঈমানহীনতার প্রমাণ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, সে মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরেছে, যা কখনো ভাঙবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেকে আল্লাহর কিতাব থাকার পরও কুসংস্কার, জাদু ও মূর্তিপূজায় জড়িয়ে পড়ে।
- অনেকে নাস্তিকতা ও ভ্রান্ত মতবাদকে ইসলাম ও ঈমানের চেয়ে উত্তম বলে প্রচার করে।
- আল্লাহর বাণী ত্যাগ করে মানুষ যখন অন্যকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তখন সেটি কুফরীর পথে নিয়ে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫১):
- আল্লাহর কিতাব পাওয়া সত্ত্বেও ভ্রান্ত বিশ্বাসে লিপ্ত হওয়া বড় অপরাধ।
- জিবত (মূর্তি, জাদু, কুসংস্কার) ও তাগুত থেকে বাঁচতে হবে।
- কাফিরদেরকে মুমিনদের চেয়ে উত্তম বলা মারাত্মক বিভ্রান্তি।
- প্রকৃত পথ শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর নির্দেশনাতেই রয়েছে।
এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, যারা সত্যকে অস্বীকার করে, জিবত ও তাগুতকে মান্য করে এবং কাফিরদেরকে মুমিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে— তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে এসেছে। আল্লাহ যাকে অভিশাপ দেন, তাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই। এটি আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তির কঠোর সতর্কবার্তা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে, আল্লাহ তার সমস্ত আমল বাতিল করবেন এবং তার শেষ পরিণতি জাহান্নাম।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ কুফর ও শিরকের কারণে আল্লাহর অভিশাপের যোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
- কেউ যদি আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের উপর ভরসা করে, তবে তার কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।
- আল্লাহর লানতের শিকার হলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়েই ধ্বংস অনিবার্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫২):
- আল্লাহর অভিশাপ থেকে বাঁচতে হলে ঈমান ও আনুগত্য অপরিহার্য।
- শিরক, কুফর ও তাগুতের অনুসরণ মানুষকে আল্লাহর লানতের যোগ্য করে।
- আল্লাহ যাকে লানত করেন, তাকে কেউ সাহায্য করতে পারে না।
- আল্লাহর সন্তুষ্টিই প্রকৃত নিরাপত্তা ও মুক্তির পথ।
এ আয়াতে আহলে কিতাবদের কৃপণতা ও হিংসার নিন্দা করা হয়েছে। তারা চায় না, মুসলমানরা কল্যাণ বা বরকত লাভ করুক। যদি রাজত্ব বা ক্ষমতায় তাদের অংশ থাকতো, তবে তারা কাউকেই সামান্যতম উপকার দিত না। এটি তাদের হিংসা, সংকীর্ণতা ও অন্যায় মানসিকতার প্রমাণ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মু’মিনদের দুনিয়া ও আখেরাতের উদাহরণ হলো খেজুর গাছের মতো, যার সবকিছুই কল্যাণকর।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেকে ক্ষমতার আসনে বসে জনগণকে প্রাপ্য অধিকার দেয় না।
- ক্ষমতাধরদের কৃপণতা ও হিংসা সমাজে অশান্তির কারণ।
- মুসলমানদের উচিত ক্ষমতা পেলে ন্যায়পরায়ণ হওয়া এবং মানুষের হক আদায় করা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৩):
- ক্ষমতাবান হলে মানুষের হক আদায় করা অপরিহার্য।
- আহলে কিতাবদের কৃপণতা ও হিংসা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
- ক্ষমতা থাকলেও আল্লাহর ভয়ে ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
- অন্যের কল্যাণে সামান্যতম অবদান রাখাও আল্লাহর কাছে মূল্যবান।
এ আয়াতে আহলে কিতাবদের হিংসাপরায়ণ স্বভাবের সমালোচনা করা হয়েছে। তারা হিংসা করতো কেন কুরআন ও নবুওয়াত আরবদের মাঝে এসেছে। অথচ আল্লাহ পূর্বে ইবরাহীমের পরিবারকেও কিতাব, হিকমত ও রাজত্ব দিয়েছিলেন। আল্লাহ যাকে চান তাকেই তাঁর অনুগ্রহ দান করেন। তাই হিংসা করার কোনো যুক্তি নেই।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “শুধুমাত্র দুটি ক্ষেত্রে হিংসা করা বৈধ: (১) যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, (২) যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া জ্ঞান দ্বারা বিচার করে ও তা শিক্ষা দেয়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮১৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেকেই ইসলাম ও মুসলিমদের উন্নতিতে হিংসা করে।
- অন্যের সাফল্যে হিংসা করা শয়তানি স্বভাব।
- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা যেটা দেন, সেটি তাঁর হিকমতেরই ফল।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৪):
- হিংসা করা ইসলামে নিন্দনীয় ও হারাম।
- আল্লাহ যাকে চান তাকেই তাঁর অনুগ্রহ দান করেন।
- ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবারকে আল্লাহ কিতাব, প্রজ্ঞা ও রাজত্ব দান করেছিলেন।
- মুমিনদের উচিত হিংসা নয়, বরং আল্লাহর কাছে বরকত কামনা করা।
এই আয়াতে ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর ও আহলে কিতাবদের দুই শ্রেণীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু লোক কুরআন ও নবী ﷺ-এর প্রতি ঈমান এনেছিল, আবার অনেকেই সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যারা বিরত থাকে ও সত্য অস্বীকার করে, তাদের জন্য জাহান্নামই শেষ পরিণতি। এটি প্রমাণ করে—আল্লাহর বাণী মানা বা না মানা, উভয় অবস্থারই স্পষ্ট ফলাফল রয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমার সমগ্র উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যে অস্বীকার করবে সে জান্নাতে যাবে না।” সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, কে অস্বীকার করবে? তিনি বললেন: যে আমার আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে যাবে; আর যে আমার অবাধ্য হবে, সে অস্বীকারকারী।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭২৮০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ দুই দলে বিভক্ত—কারও ঈমান আছে, কারও নেই।
- যারা ঈমান আনে, তারা মুক্তির পথে; আর যারা অস্বীকার করে, তারা ধ্বংসের পথে।
- জাহান্নাম হলো কুফর ও অবাধ্যতার শেষ পরিণতি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৫):
- মানুষ সবসময় দুই দলে বিভক্ত থাকবে—মুমিন ও কাফির।
- সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের শেষ আশ্রয় জাহান্নাম।
- নবী ﷺ-এর আনুগত্যই জান্নাতের নিশ্চয়তা।
- ঈমান গ্রহণই মুক্তির একমাত্র পথ।
এ আয়াতে কাফিরদের ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা রয়েছে। জাহান্নামের আগুনে তারা চিরস্থায়ীভাবে দগ্ধ হবে। তাদের দেহ যখনই পুড়ে যাবে, আল্লাহ নতুন চামড়া দেবেন, যাতে তারা শাস্তি অনুভব করতে থাকে। এটি প্রমাণ করে—কাফিরদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবিরাম ও অসহনীয়। আল্লাহ শক্তিশালী, তাই তাঁর শাস্তি কার্যকর হয়; আবার প্রজ্ঞাময়, তাই তা ন্যায়সংগত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি তীব্র।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩২৬৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৪৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ দুনিয়ার অগ্নিকাণ্ড বা দাহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না, অথচ জাহান্নামের আগুন অনেক গুণ বেশি ভয়াবহ।
- কুফর ও ঈমান অস্বীকারের পরিণতি হলো চিরস্থায়ী শাস্তি।
- এ আয়াত মানুষকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার জন্য ঈমান ও আমলে উদ্বুদ্ধ করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৬):
- কাফিরদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি চিরস্থায়ী।
- তাদের দেহ পুড়ে গেলে নতুন দেহ সৃষ্টি করা হবে, যাতে শাস্তি ভোগ চলতে থাকে।
- আল্লাহর শাস্তি ন্যায়সঙ্গত ও তাঁর প্রজ্ঞার ফল।
- এ আয়াত মুমিনদেরকে শিরক ও কুফর থেকে দূরে থাকতে সতর্ক করে।
এই আয়াতে মুমিনদের পুরস্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দান করবেন—যেখানে নদী প্রবাহিত হবে এবং তারা চিরকাল থাকবে। জান্নাতে তাদের জন্য থাকবে পবিত্র জীবনসঙ্গী, আর থাকবে আরামদায়ক শীতল ছায়া। এটি মুমিনদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমতের প্রতিফল।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “জান্নাতে যা কিছু আছে, তা দুনিয়ার কিছুর সাথেও তুলনীয় নয়; শুধু নামগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮২৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ দুনিয়ার অস্থায়ী ভোগ-বিলাসে মগ্ন থাকে, অথচ জান্নাতের নেয়ামত চিরস্থায়ী।
- মুমিনদের জন্য জান্নাত হলো সর্বোচ্চ পুরস্কার।
- আল্লাহর দেয়া জান্নাতের সুখ দুনিয়ার সুখের সাথে তুলনাহীন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৭):
- ঈমান ও সৎকর্ম জান্নাত লাভের মূল শর্ত।
- জান্নাতে থাকবে নদী, পবিত্র সঙ্গিনী ও শান্তিময় জীবন।
- আল্লাহ মুমিনদের জন্য স্থায়ী সুখ প্রস্তুত করেছেন।
- দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ নয়, আখেরাতের জান্নাতই প্রকৃত লক্ষ্য।
এই আয়াতে দুটি বড় দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে— (১) আমানত ফিরিয়ে দেওয়া: এটি হতে পারে সম্পদ, দায়িত্ব, পদমর্যাদা বা বিশ্বাসের দায়িত্ব। (২) বিচারকার্যে ন্যায়বিচার করা: মানুষের মধ্যে বৈষম্য না করে ন্যায্যভাবে বিচার করতে হবে। আল্লাহ এসব নির্দেশ দিয়ে বান্দাদের জন্য কল্যাণ চেয়েছেন। কারণ আল্লাহ সবই শোনেন ও দেখেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যখন আমানত নষ্ট করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন: আমানত নষ্ট হওয়া বলতে কী বোঝায়? তিনি বললেন: যখন দায়িত্ব অযোগ্য মানুষের হাতে দেওয়া হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৪৯৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই ক্ষমতার আসনে বসে আমানত রক্ষা করে না।
- ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ঘুষ ও পক্ষপাত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে।
- আমানত রক্ষা ও ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৮):
- আমানত রক্ষা করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
- মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ফরজ।
- আল্লাহর আদেশে বান্দাদের জন্য কল্যাণ নিহিত।
- আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন, তাই প্রতিটি কাজের জবাবদিহি করতে হবে।
এ আয়াতে ইসলামী সমাজে আনুগত্যের মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনটি স্তরে আনুগত্যের কথা এসেছে—
- আল্লাহর আনুগত্য: তাঁর কিতাবে যা হুকুম এসেছে তা মানা।
- রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য: কুরআনের ব্যাখ্যা ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
- উলিল আমর: মুসলিম সমাজের ন্যায়পরায়ণ শাসক, বিচারক ও আলেমদের আনুগত্য করা—তবে কেবল তখনই, যখন তাদের আদেশ কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত না হয়।
গুরুত্বপূর্ণ দিক:
- কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে সেটিকে আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। - আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এখানে স্পষ্ট ভাবে সতর্ক করে বলেছেন: “যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও, তবে আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দিকে ফিরিয়ে দাও।” আর, যদি তোমরা বিশ্বাসী না হও তবে অন্য পথ বেছে নাও—এ এক ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী । - আল্লাহ বলেছেন: এটাই উত্তম এবং ফলাফলের দিক থেকেও সর্বোত্তম। এতে মতভেদ, ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না। - উলিল আমরের আনুগত্য বাধ্যতামূলক, তবে আল্লাহর অবাধ্যতায় তাদের মানা নিষিদ্ধ
- নবী ﷺ বলেছেন: “আল্লাহর অবাধ্যতায় কোনো আনুগত্য নেই।” (📖 সহিহ বুখারী ৭২৫৭; সহিহ মুসলিম ১৮৪০)
উলিল আমর সম্পর্কে:
কিছু মানুষ এ আয়াতকে পুঁজি করে নিজ বাসনা চরিতার্থ করতে এ আয়াতের আশ্রয় গ্রহণ করে বলে যে —“আল্লাহ, রাসূল ও পীরের আনুগত্য করতে হবে।” অথচ আয়াতে কোথাও সরাসরি পীর বা দরবেশের নাম নেই। “উলিল আমর” একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যেমন ন্যায়পরায়ণ শাসক, বিচারক, আলেম ও পীর— যারা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নেতৃত্ব দেয়। পীর, শাসক বা কারও ব্যক্তিগত মত কুরআন–সুন্নাহর বিপরীতে হলে তা মানা যাবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে সে আল্লাহর আনুগত্য করলো, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে আল্লাহর অবাধ্য হলো।” (📖 সহিহ বুখারী ২৯৫৭; সহিহ মুসলিম ১৮৩৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পীর নিজেদেরকে উলিল আমর বলে দাবি করে মানুষকে অন্ধ আনুগত্যে বাধ্য করছে।
- মুমিনদের উচিত কেবল কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা।
- কোনো নেতা বা পীর যদি কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কথা বলে, তবে তার আনুগত্য করা হারাম।
- কোনো পীর যদি কুরআন ও সুন্নাহের কথা বলে এবং নিজেও সেই অনুযায়ী আমল করে তবে মানতে বা আনুগত্য করাতে দোষ নেই
শিক্ষনীয় বিষয়:
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যই সর্বপ্রথম ও চূড়ান্ত।
- ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বকে মানতে হবে, তবে কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী হলে নয়।
- বিতর্কের সমাধান কেবল কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা হবে।
- পীরদের অন্ধ আনুগত্য মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়।
এই আয়াতে এমন একদল লোকের কথা বলা হয়েছে, যারা মুখে দাবি করতো যে তারা ঈমান এনেছে, কিন্তু বাস্তবে তারা কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর হুকুম বাদ দিয়ে তাগুত (শয়তানি শক্তি, মিথ্যা বিচার ব্যবস্থা) এর কাছে বিচার চাইতো। - “তাগুত” বলতে বোঝায়—শিরক, মূর্তি, ভণ্ড নেতারা, অন্যায় শাসক, শয়তানি প্রভাব ও আল্লাহ আইন বাদ দিয়ে অন্যের আইনের কাছে বিচার চাওয়া। - আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তাগুতকে অস্বীকার করতে, কিন্তু তারা উল্টো তাগুতের দিকে ফিরে যাচ্ছিল। - তাদের এই কাজ ছিল শয়তানের প্ররোচনায়, যাতে তারা চরম ভ্রষ্টতার দিকে যায়।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও অনেক মানুষ নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে, কিন্তু তাদের বিবাদ–বিচার আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী না করে ভ্রান্ত আইন, কুসংস্কার ও ভণ্ড ধর্মীয় বা সমাজ নেতাদের কাছে নিয়ে যায়। এটি আসলে আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার করা এবং তাগুতের অনুসরণ করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর শপথ! তোমরা ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তোমাদের বিবাদে আমাকে বিচারক মানবে, আর আমি যা রায় দিব তা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৮২৪; সহিহ মুসলিম ১৭১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে কুরআন–সুন্নাহর পরিবর্তে কুফরি আইন ও ভ্রান্ত দর্শন দ্বারা বিচার করায়।
- এগুলো শয়তানের প্ররোচনা, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ঈমান থেকে দূরে নিয়ে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬০):
- তাগুতকে অস্বীকার করা ঈমানের মৌলিক শর্ত।
- কোনো সমস্যা হলে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাধান করতে হবে।
- শয়তান মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে তাগুতের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
এই আয়াতে আল্লাহ মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। মুখে তারা ঈমানের দাবি করলেও আন্তরিক ভাবে তা অস্বীকার করে , যখন বলা হয়— এসো কুরআনের দিকে, রাসূল ﷺ-এর দিকে, তখন তারা স্পষ্টভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোচনায় আসতে চায় না, বরং অন্যদিকে পালিয়ে যায়। 🔹 প্রকৃত মুমিন আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের নির্দেশ শুনে সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করে। আর মুনাফিকদের স্বভাব হলো—সত্যের সামনে মাথা নত না করে, অন্য অজুহাত খোঁজা ও দ্বীনের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও আমরা দেখি, অনেক মুসলমান নামধারী মানুষ কুরআন–হাদিসের আলোচনায় আসতে চায় না। তাদেরকে যখন বলা হয়—“এসো, ইসলামের প্রকৃত বিধানের দিকে ফিরো,” তখন তারা উদাসীনতা দেখায়, কিংবা অন্য পথ অনুসরণ করে। এটি মুনাফিকি চরিত্রেরই প্রতিফল।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি আলামত রয়েছে: (১) কথা বললে মিথ্যা বলে, (২) আমানত রাখলে খিয়ানত করে, (৩) প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে দ্বীনের আলোচনায় বসতে চায় না, বরং দুনিয়াবি কথা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
- কিছু লোক নিজেদের মুসলিম দাবি করলেও কুরআন–সুন্নাহর দিকে ফিরতে অস্বীকার করে।
- যেখানে কুরআন–হাদিসের শিক্ষা থাকে, তারা সেখান থেকে দূরে থাকে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬১):
- মুনাফিকরা কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর দিকে আসতে চায় না।
- প্রকৃত ঈমানদার সত্যের সামনে মাথা নত করে।
- কুরআন ও হাদিসের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বড় মুনাফিকির লক্ষণ।
- আল্লাহর পথে ফিরতে দেরি করা বিপজ্জনক—এতে ধ্বংস ডেকে আনে।
এই আয়াতে মুনাফিকদের দ্বিচারিতা প্রকাশ করা হয়েছে। তারা কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর নির্দেশ অমান্য করে তাগুতের দিকে ছুটে যেতো। কিন্তু যখন তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে বিপদ আসতো, তখন তারা আবার নবীর কাছে এসে অজুহাত দিতো এবং আল্লাহর নামে শপথ করতো। তারা বলতো—আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না, বরং কল্যাণ ও সমঝোতা চেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রতারণা, ভণ্ডামি ও দ্বীনের সত্যকে এড়িয়ে চলা। এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায়—মুনাফিকরা বিপদে পড়লে ধর্মীয়তার ভান ধরে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও অনেকে ইসলামকে পাশ কাটিয়ে অন্য পথ অনুসরণ করে। কিন্তু যখন বিপদ আসে, তখন তারা ধর্মের দোহাই দেয় এবং বলে—“আমাদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল।” অথচ তাদের আসল উদ্দেশ্য থাকে দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কিয়ামতের দিনে মানুষের সবচেয়ে মন্দ অবস্থায় থাকবে সেই ব্যক্তি, যে দুই চেহারার অধিকারী; একদল মানুষের কাছে একভাবে যায়, আরেকদল মানুষের কাছে অন্যভাবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬০৩১; সহিহ মুসলিম ২৫২৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে ইসলামের বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকে, কিন্তু বিপদে পড়লে ধর্মীয়তার ভান করে।
- কিছু লোক আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়।
- মুনাফিকরা সব যুগেই দ্বিচারিতা করে সমাজকে ধোঁকা দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬২):
- কৃতকর্মের কারণে মানুষ বিপদে পড়ে—এটি আল্লাহর ন্যায়বিচার।
- মিথ্যা শপথ ও অজুহাত মুনাফিকির বৈশিষ্ট্য।
- সত্যিকার মুমিন বিপদে পড়লেও আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকে।
- মুনাফিকরা সবসময় নিজেদের ভণ্ডামি ঢাকতে “কল্যাণ” শব্দ ব্যবহার করে।
এই আয়াতে আল্লাহ মুনাফিকদের অন্তরের খবর প্রকাশ করেছেন। তারা বাইরে থেকে ভালো দেখাতে চাইলেও, আল্লাহ তাদের অন্তরের কপটতা ও ভণ্ডামি সম্পর্কে অবগত। আল্লাহ তাঁর রাসূল ﷺ-কে তিনটি নির্দেশ দিলেন—
- তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও: তাদের ভণ্ডামির প্রতি কঠোর অবস্থান নাও।
- তাদের উপদেশ দাও: যাতে তারা অনুতপ্ত হয় ও তওবা করে।
- তাদের সাথে দৃঢ় ও প্রভাবশালী কথা বলো: নরম নয়, বরং এমনভাবে বলো যা তাদের অন্তরে প্রভাব ফেলবে এবং তাদেরকে সংশোধনের দিকে আনবে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের সমাজেও অনেক লোক মুসলমান দাবি করলেও দ্বীনের বিরুদ্ধে কাজ করে। আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন—তাদের অন্তরের অবস্থা তিনি জানেন, তাই আমাদের দায়িত্ব হলো তাদেরকে উপদেশ দেওয়া এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে কথা বলা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে, নতুবা আল্লাহ তোমাদের উপর এমন শাস্তি দেবেন, যা তোমরা দূর করতে পারবে না।” (📖 তিরমিযি, হাদিস: ২১৬৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ ইসলাম বিরোধী কাজ করে, কিন্তু মুসলমান দাবি করে।
- তাদেরকে উপদেশ না দিয়ে চুপ থাকলে সমাজে অন্যায় ছড়িয়ে পড়ে।
- দৃঢ়ভাবে সত্য বলা ইসলামি দাওয়াতের অন্যতম পদ্ধতি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৩):
- আল্লাহ মানুষের অন্তরের ভণ্ডামি জানেন।
- মুনাফিকদের এড়িয়ে চলা, কিন্তু প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়া জরুরি।
- সত্যকে প্রভাবশালী ভাষায় বলা দরকার।
- দ্বীনের দাওয়াত ও সংশোধনমূলক কাজ অব্যাহত রাখা ইসলামের শিক্ষা।
এ আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে, নবীদের মূল দায়িত্ব হলো আল্লাহর আদেশ পৌঁছে দেওয়া, আর তাদের আনুগত্য করা হলো ঈমানের অংশ। নবীর আনুগত্য করা মানে হলো কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য করা। এখানে বলা হয়েছে, যদি কেউ গুনাহ করে, জুলুম করে, তবে তার উচিত নবীর কাছে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আর নবী ﷺ তার জন্য দোয়া করলে আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করে দেন। 🔸 তবে খেয়াল রাখতে হবে: এ আয়াত নবীর জীবদ্দশার ঘটনা নিয়ে। নবী ﷺ দুনিয়াতে থাকাকালীন কেউ যদি ভুল করে তাঁর কাছে আসতো, তবে তিনি তাদের জন্য দোয়া করতেন। কিন্তু নবী ﷺ মৃত্যুর পর সরাসরি তাঁর কাছে আহ্বান করা ইসলামসম্মত নয়। এখন ক্ষমা চাইতে হবে শুধু আল্লাহর কাছে, নবীর রেখে যাওয়া শিক্ষা ও সুন্নাহ মেনে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আমি প্রতিদিন একশ বার তওবা করি।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭০২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ ভুল করলে আল্লাহর কাছে সরাসরি ক্ষমা চাইতে হবে।
- তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন, তিনি তাওয়াব (ক্ষমাশীল) ও রহীম (দয়ালু)।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৪):
- নবীদের পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো তাদের আনুগত্য করা।
- গুনাহ করলে সরাসরি আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে।
- নবী ﷺ জীবিত থাকাকালীন তাঁর দোয়া বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ছিল।
- আজ আমাদের কর্তব্য হলো নবীর সুন্নাহ মেনে চলা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
এ আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে— রাসূল ﷺ-এর রায় মেনে নেওয়া ছাড়া প্রকৃত ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয়। তিনটি শর্তে পূর্ণ ঈমান নিশ্চিত হয়:
- বিবাদের ক্ষেত্রে নবী ﷺ-কে (কুরআন ও সুন্নাহকে) বিচারক মানা।
- রায় মেনে নিতে অন্তরে কোনো সংকোচ বা দ্বিধা না রাখা।
- সম্পূর্ণ সমর্পণ ও সন্তুষ্টির সাথে তা গ্রহণ করা।
অপপ্রচার:
কিছু পীর ও নেতা দাবি করে—“আমাদের সিদ্ধান্ত মানা ঈমানের অংশ।” অথচ কুরআন স্পষ্ট করে দিয়েছে— চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধু কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহ অনুযায়ী হবে। মানুষের বানানো আইন বা ভণ্ড পীরদের নির্দেশ ঈমানের মানদণ্ড নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমার উম্মতের সবাই জান্নাতে যাবে, শুধু সে ব্যতীত যে অস্বীকার করবে।” সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন: কে অস্বীকার করবে? তিনি বললেন: যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে অস্বীকারকারী।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭২৮০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই নিজেদের মুসলিম দাবি করে, কিন্তু কুরআন–সুন্নাহর পরিবর্তে ভিন্ন আইন মানে।
- কিছু লোক শরীয়তের রায়কে অস্বীকার করে, কিন্তু নিজেদেরকে ঈমানদার বলে দাবি করে।
- প্রকৃত ঈমান হলো শরীয়তের হুকুম মানা এবং আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৫):
- কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো রায়ে চূড়ান্ত সমাধান নেই।
- শরীয়তের রায় মেনে নিতে দ্বিধা থাকলে প্রকৃত ঈমান পূর্ণ হয় না।
- মুমিনদের উচিত সম্পূর্ণ সমর্পণের সাথে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ গ্রহণ করা।
এই আয়াতে আল্লাহ বান্দাদের আনুগত্য ও পরীক্ষার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। যদি আল্লাহ খুব কঠিন কিছু হুকুম দিতেন, যেমন: - নিজেদেরকে হত্যা করতে, - বা নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করতে, তবে অধিকাংশ মানুষই তা পালন করতো না। শুধু অল্পসংখ্যক দৃঢ় ঈমানদার তা পালন করতো। কিন্তু আল্লাহ বান্দাদের উপর সহজ বিধান আরোপ করেছেন। যদি তারা সত্যিই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতো, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো এবং তাদের ঈমানকে আরও শক্তিশালী করতো।
মূল শিক্ষা: ইসলাম কঠিন নয়, বরং সহজ। তবে ঈমান পরীক্ষা করার জন্য মাঝে মাঝে কিছু কঠিন নির্দেশ আসে। প্রকৃত ঈমানদার সেই, যে কোনো পরিস্থিতিতেই আল্লাহর হুকুম মেনে নেয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যখন আমি তোমাদের কোনো কিছু করতে আদেশ দেই, তখন তোমরা তা যতটুকু পারো পালন করো। আর যখন কোনো কিছু থেকে বিরত থাকতে বলি, তখন সম্পূর্ণরূপে তা থেকে বিরত থাকো।” (📖 সহিহ বুখারী ৭২৮৮; সহিহ মুসলিম ১৩৩৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ সহজ বিধানও পালন করতে চায় না, যেমন সালাত, যাকাত, হালাল-হারাম।
- কঠিন পরীক্ষার মুখে তো তারা আরও পিছিয়ে যায়।
- অল্পসংখ্যক সত্যিকারের ঈমানদার সব অবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৬):
- আল্লাহ বান্দাদের উপর কঠিন নয়, সহজ বিধান আরোপ করেছেন।
- সত্যিকার ঈমানদাররা কঠিন পরীক্ষাতেও আল্লাহর হুকুম মানে।
- আল্লাহর আদেশ মানলে তাতে কল্যাণ রয়েছে এবং ঈমান শক্ত হয়।
- অল্পসংখ্যক দৃঢ় মুমিনই প্রকৃত আনুগত্যকারী।
পূর্ববর্তী আয়াতে (৬৬) বলা হয়েছিল— যদি মানুষ আল্লাহর আদেশ মতো কাজ করতো, তাহলে তাদের জন্য কল্যাণ ও দৃঢ়তা আসতো। আর এই আয়াতে আল্লাহ বলেন—যদি তারা তা করতো, তবে আমি নিজ পক্ষ থেকে তাদেরকে **মহান পুরস্কার** দিতাম। এই “মহান পুরস্কার” বলতে বোঝানো হয়েছে— দুনিয়ায় সম্মান, মর্যাদা ও শান্তি, আর আখিরাতে জান্নাত, চিরস্থায়ী সুখ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটি প্রমাণ করে— আল্লাহর আদেশ মেনে চলা কখনো বৃথা যায় না। মানুষ হয়তো ভাবে ইসলামের আদেশ কঠিন, কিন্তু বাস্তবে তাতে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েরই মঙ্গল রয়েছে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ অনেক মুসলমান ইসলামের বিধান এড়িয়ে চলে, অথচ আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন—যদি তোমরা আমার আদেশ মেনে চলো, আমি তোমাদের এমন পুরস্কার দিবো যা কল্পনারও অতীত। এই আয়াত আল্লাহর রহমতের প্রতিশ্রুতি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; আর যে অবাধ্য হবে, তাকে আল্লাহ জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।” (📖 সহিহ বুখারী ২৯৫৭; সহিহ মুসলিম ১৮৩৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা দ্বীনের আদেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে, তারা দুনিয়াতেও শান্তিতে থাকে।
- আল্লাহ তাদের হৃদয়ে তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি দান করেন।
- আখিরাতে তাদের জন্য প্রস্তুত আছে জান্নাতের “মহান পুরস্কার”।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৭):
- আল্লাহর আদেশ মানলে দুনিয়া ও আখিরাত দুটোতেই পুরস্কার মেলে।
- আল্লাহ তাঁর অনুগত বান্দাদের কখনো ব্যর্থ হতে দেন না।
- “মহান পুরস্কার” হলো জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি।
- আল্লাহর আনুগত্যই জীবনের প্রকৃত সফলতা।
পূর্ববর্তী আয়াতে (৬৭) আল্লাহ বলেছেন, যদি মানুষ তাঁর আদেশ পালন করতো, তবে তিনি তাদেরকে মহান পুরস্কার দিতেন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে— আল্লাহ শুধু পুরস্কারই দিতেন না, বরং তাদেরকে “সিরাতুল মুস্তাকীম” (সোজা ও সঠিক পথ) এ পরিচালিত করতেন। অর্থাৎ, যারা আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর নির্দেশ মানে, তাদের আল্লাহ নিজেই সঠিক পথের দিশা দেন, সন্দেহ, ভয়, বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করেন, এবং তাদের ঈমানকে স্থায়ী ও দৃঢ় করেন।
‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ অর্থ: - এটি সেই পথ, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। - এটি নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও নেককারদের পথ। - এটি সেই পথ, যা কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণকারীদের জন্য নির্ধারিত।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
অনেক মানুষ দুনিয়ার বিভ্রান্তিকর পথ অনুসরণ করে — অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতার পিছনে ছুটে। কিন্তু যারা আল্লাহর পথে ফিরে আসে, আল্লাহ নিজেই তাদেরকে হিদায়াত দেন এবং সঠিক পথে রাখেন। এটাই সিরাতুল মুস্তাকীমের প্রতিশ্রুতি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রতিদিন নামাজে দোয়া করতেন— “إِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ” — হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত কর।” (📖 সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত ৬) — এটি প্রতিটি মুমিনের দৈনন্দিন প্রার্থনা, যা আল্লাহর দিকনির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম মানে, আল্লাহ তাকে জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
- যারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে, তারা বিভ্রান্তির অন্ধকারে থাকে।
- আল্লাহর নির্দেশ মানলে চিন্তা, দ্বিধা ও মানসিক বিভ্রান্তি দূর হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৮):
- আল্লাহর আনুগত্য করলে তিনি নিজেই সঠিক পথে দিশা দেন।
- সিরাতুল মুস্তাকীম হলো নবী ও সৎ ব্যক্তিদের পথ।
- হিদায়াত শুধু আল্লাহর দান—মানুষের চেষ্টায় তা আসে না, বরং আল্লাহর অনুগ্রহে।
- প্রতিদিন নামাজে “إِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ” দোয়া করে হিদায়াত চাওয়া উচিত।
এই আয়াতটি আল্লাহর আনুগত্যকারীদের জন্য এক মহান সুসংবাদ। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য করবে, তাদের জন্য জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তারা এমন সম্মানিত শ্রেণির সঙ্গে থাকবে, যাদের উপর আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। এই চার শ্রেণিই আল্লাহর নিকট সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত—
- নবী (النبيّين): যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন।
- সিদ্দীক (الصّدّيقين): সত্যবাদী ও ঈমানে দৃঢ় ব্যক্তিবর্গ (যেমন আবু বকর রা.)।
- শুহাদা (الشّهداء): যারা আল্লাহর পথে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
- সালেহিন (الصّالحين): যারা সৎকর্মে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ মানুষ নামাজ, রোযা, সততা, সত্যবাদিতা থেকে দূরে সরে গেছে। অথচ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যে জীবনযাপন করে, তারা কেবল দুনিয়াতেই শান্তি পায় না, বরং আখিরাতে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে জান্নাতে অবস্থান করবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মানুষ কিয়ামতের দিনে যার সঙ্গে ভালোবাসা রাখবে, তার সঙ্গেই তাকে উঠানো হবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬১৬৯; সহিহ মুসলিম ২৬৪০) সাহাবি আনাস (রা.) বলেন— “এই হাদিস শুনে আমরা কখনো এত আনন্দিত হইনি, কারণ আমরা আশা করি নবী ﷺ-কে ভালোবাসি, তাই তাঁর সঙ্গেই জান্নাতে থাকব।”
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যই জান্নাতে উত্তম সঙ্গ লাভের একমাত্র পথ।
- যারা দুনিয়ায় নবী ও সৎ লোকদের ভালোবাসে, তারা আখিরাতে তাদের সঙ্গী হবে।
- আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে থাকা মানেই সেই মহামর্যাদাপূর্ণ সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়া।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৯):
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেয়।
- নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিরাই প্রকৃত সফল মানুষ।
- মুমিনদের জন্য জান্নাতে এই শ্রেষ্ঠ সঙ্গই সর্বোচ্চ পুরস্কার।
- দুনিয়ায় যাকে ভালোবাসো, আখিরাতে তার সঙ্গেই উঠানো হবে—তাই সঙ্গ বেছে নাও সঠিকভাবে।
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৬৯) পরিপূর্ণতা হিসেবে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছিল—যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য করবে, সে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গী হবে। আর এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করলেন— “এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ” অর্থাৎ, এমন সম্মান, এমন মর্যাদা, এমন সঙ্গ অর্জন করা মানুষের কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি মহা অনুগ্রহ। এই ফযল (অনুগ্রহ) আল্লাহ দেন শুধুমাত্র তাদেরকে, যারা আন্তরিকভাবে ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং আনুগত্যে অটল থাকে। 🔹 আল্লাহ বলেন—“আমি জানি কে প্রকৃত মুমিন, কে আন্তরিকভাবে আমার আনুগত্য করছে, তাই আমিই সর্বজ্ঞ এবং ন্যায়বিচারক।”
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
মানুষ প্রায়ই ভাবে—‘আমার কাজের ফল আমি পেয়েছি’। কিন্তু কুরআন শেখায়, প্রতিটি সাফল্য, মর্যাদা ও জান্নাতের আশীর্বাদ শুধুই আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া দ্বারা আসে। তাই অহংকার নয়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কেউ কেবল নিজের আমলের দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন: এমনকি আপনি নন, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন: এমনকি আমিও নই, যদি না আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া আমাকে দান করেন।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৪৬৩; সহিহ মুসলিম ২৮১৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষের সফলতা ও ঈমান আল্লাহর অনুগ্রহেই আসে, নিজের শক্তিতে নয়।
- আল্লাহ জানেন কার অন্তর সত্যিকারভাবে তাঁর জন্য বিনয়ী।
- কৃতজ্ঞ মুমিন সবসময় বলে — “আলহামদুলিল্লাহ! এটি আল্লাহর ফযল।”
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭০):
- জান্নাতে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়া আল্লাহর এক বিশাল অনুগ্রহ।
- মানুষের কোনো কৃতিত্ব নয়—সবই আল্লাহর দয়া ও ফযল।
- আল্লাহ সবকিছু জানেন—কারা আন্তরিকভাবে আনুগত্য করছে।
- কৃতজ্ঞতা ও বিনয়ই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে **জিহাদ ও আত্মরক্ষার প্রস্তুতি** নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিন্তু যখন শত্রুরা ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালায়, তখন আত্মরক্ষা করা ও আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা ফরজ হয়ে যায়। 🔸 “খুযূ হিযরাকুম” অর্থ — নিজেদের **সতর্কতা** অবলম্বন করো, অর্থাৎ শত্রুর ষড়যন্ত্র, আক্রমণ বা প্রতারণা থেকে সজাগ থাকো। 🔸 “ফানফিরূ সুবা-তিন আও ইনফিরূ জামী‘া” অর্থ — তোমরা **ছোট ছোট দলে** বা **একত্রে বাহিনী হিসেবে** বের হও, পরিস্থিতি অনুযায়ী সংগঠিতভাবে কাজ করো। এই আয়াত মুসলমানদেরকে অলসতা, ভয় বা দুর্বলতা থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দেয়। আল্লাহর পথে দাঁড়ানো মানে শুধু যুদ্ধ নয়, বরং দ্বীনের সুরক্ষা, দাওয়াত, ও ন্যায়ের জন্য প্রচেষ্টা।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
বর্তমান যুগে মুসলমানদের উপর নানা ধরণের আক্রমণ— সাংস্কৃতিক, মানসিক, এবং চিন্তাগত যুদ্ধ (ideological war) চলছে। “হিযরাকুম” অর্থাৎ সতর্কতা আজ মানে— দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা, কুরআন–সুন্নাহ বোঝা, মিডিয়া ও শিক্ষাক্ষেত্রে ইসলামের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাই এ আয়াত আমাদের শেখায়— মুমিনরা কখনো উদাসীন হবে না, বরং সংগঠিত, সচেতন ও দ্বীনের প্রহরী হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “বুদ্ধিমান মুমিন সেই, যে নিজের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।” (📖 তিরমিযি, হাদিস: ২৪৫৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “মুমিনকে এক গর্ত থেকে দুইবার দংশন করা উচিত নয়।” (📖 সহিহ বুখারী ৬১৩৩; সহিহ মুসলিম ২৯৯৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মুমিনদের উচিত শত্রুদের প্রতারণা ও বিভ্রান্তি থেকে সচেতন থাকা।
- ইসলামবিরোধী প্রচারণা রুখতে জ্ঞান ও ঐক্যের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়া।
- দ্বীনের রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা ফরজে কিফায়া।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭১):
- আল্লাহ মুসলমানদেরকে আত্মরক্ষা ও সতর্কতার নির্দেশ দিয়েছেন।
- ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা ইসলামী সমাজের শক্তি বৃদ্ধি করে।
- মুমিন কখনো উদাসীন নয়—সে সর্বদা দ্বীনের প্রহরী।
- সতর্কতা, জ্ঞান ও প্রস্তুতি—এই তিনটি ইসলামি জীবনের অপরিহার্য অংশ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **মুনাফিকদের স্বভাব** তুলে ধরেছেন। যখন মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথে বের হতে বলা হয় (যেমন জিহাদ, দাওয়াত বা কঠিন কাজের আহ্বান), তখন তারা নানা অজুহাতে **ঢিলেমি করে, বিলম্ব করে বা পিছিয়ে থাকে।** কিন্তু যখন মুসলমানরা কোনো বিপদে পড়ে— যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষতি হয়, কষ্ট আসে— তখন সেই মুনাফিক লোকটি অহংকারভরে বলে, “ভালোই হয়েছে আমি যাইনি! আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।” অর্থাৎ, সে মনে করে ইসলামী দায়িত্ব থেকে দূরে থাকা একপ্রকার সফলতা, অথচ প্রকৃত অর্থে সে আল্লাহর রহমত ও পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আয়াতের মূল বার্তা:
- আল্লাহর পথে কাজ করা মানে শুধুমাত্র যুদ্ধ নয়; বরং দ্বীনের দাওয়াত, কষ্ট সহ্য করা, এবং সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো। - যারা এই কাজে গাফিল, তারা সাময়িকভাবে স্বস্তি পেলেও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ অনেক মানুষ দ্বীনের কাজ থেকে দূরে থাকে— ভাবে, “আমি ঝামেলায় যাব না, অন্যরা যাক।” কিন্তু যখন দ্বীন প্রচারে কষ্ট আসে, তখন তারা খুশি হয় যে তারা বেঁচে গেছে। এটাই মুনাফিকি মানসিকতা, যা আল্লাহ এই আয়াতে নিন্দা করেছেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “দুনিয়ার জীবনে যে মানুষ মুসলমানদের দুঃখে আনন্দ পায়, সে তাদের মধ্য থেকে নয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেছেন— “মুমিন পরস্পরের প্রতি এক দেহের মতো; শরীরের এক অঙ্গ ব্যথা পেলে পুরো শরীর ব্যথা অনুভব করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬০১১; সহিহ মুসলিম ২৫৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে দ্বীনের কাজে অংশ না নিয়ে বলে—“আমার কাজ নয়” বা “আমি নিরপেক্ষ।”
- যখন ইসলামী দাওয়াতকারীরা কষ্টে পড়ে, তারা তাতে সন্তুষ্ট হয়—এটাই মুনাফিকি স্বভাব।
- দ্বীনের কাজে অংশ না নিয়ে পিছিয়ে থাকা মানে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭২):
- মুমিন সবসময় দ্বীনের কাজে অগ্রসর হয়, পিছিয়ে যায় না।
- দ্বীনের কাজের কষ্টে খুশি হওয়া আল্লাহর কাছে গোনাহ।
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম মানে জীবনের সর্বস্তরে ইসলামের প্রচেষ্টা করা।
- মুনাফিকরা সাময়িক শান্তি পেলেও আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। পূর্বের আয়াতে (৭২) তারা মুসলমানদের কষ্টে খুশি হতো, আর এই আয়াতে বলা হয়েছে— যখন মুসলমানরা আল্লাহর অনুগ্রহ, বিজয় বা সাফল্য অর্জন করে, তখন সেই একই মুনাফিক আফসোস করে এবং বলে— “আহ! আমিও যদি তাদের সঙ্গে যেতাম, তবে আমি বড় পুরস্কার পেতাম।” 🔹 তারা আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ করতে চায় না, কিন্তু পুরস্কার ও লাভ পেতে চায়। এটি প্রকৃত ঈমানের পরিপন্থী, কারণ ঈমানদার সব অবস্থায় আল্লাহর আদেশ মানে, সে বিপদে হোক বা আরামেই হোক। 🔹 “কা-আল্লাম তাকুন বাইনাকুম ওা বাইনাহু মাওাদ্দাহ” — অর্থাৎ, সে এমন আচরণ করে যেন মুসলমানদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। সে মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু স্বার্থের সময় সেই সম্পর্কের ভান ধরে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও কিছু মানুষ ইসলামের কাজ থেকে দূরে থাকে। যখন ইসলামী দাওয়াত বা কোনো সৎ উদ্যোগ সফল হয়, তখন তারা আফসোস করে—“আমিও যদি যুক্ত হতাম!” কিন্তু সফলতার আগে তারা পাশে দাঁড়াতে রাজি হয় না। এটাই মুনাফিকি মনোভাব, যা আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে নিন্দা করেছেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও কষ্ট সহ্য না করলে, কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারে না।” (📖 সহিহ বুখারী ২৬৩৭; সহিহ মুসলিম ১৮৭২) আরেক হাদিসে এসেছে— “আল্লাহর রাস্তায় এক মুহূর্ত সংগ্রাম করা দুনিয়া ও এর ভেতরের সব কিছুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৯২; সহিহ মুসলিম ১৮৮০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেকে ইসলামী প্রচারণা বা সৎকাজে অংশ নেয় না, কিন্তু সফল হলে আফসোস করে।
- কিছু লোক ইসলামী ভাইদের সাফল্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়, নিজে কাজ করে না।
- এমন মানসিকতা মুনাফিকি চিন্তারই প্রতিফলন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৩):
- মুনাফিকরা বিপদে মুসলমানদের থেকে দূরে থাকে, কিন্তু সাফল্যে তাদের মতো হতে চায়।
- আল্লাহর পথে কাজ করাই প্রকৃত সাফল্য, সুযোগ হারানো আফসোসের কারণ।
- সফলতার আকাঙ্ক্ষা থাকলে তার জন্য ত্যাগও করতে হবে।
- মুমিন সাফল্য ও বিপদ—দু’পরিস্থিতিতেই আল্লাহর আদেশ মেনে চলে।
এই আয়াতটি মুমিনদের ত্যাগ ও ঈমানের পরীক্ষা সম্পর্কে। আল্লাহ তাআলা বলছেন — যারা দুনিয়ার সাময়িক জীবনকে আখিরাতের স্থায়ী জীবনের বিনিময়ে বিক্রি করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন এবং তাদের উচিত **আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা।** 🔹 “يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ” অর্থাৎ, তারা দুনিয়ার আরাম, সম্পদ ও ভয়কে ত্যাগ করে আখিরাতের মুক্তি ও পুরস্কারকে বেছে নেয়। 🔹 “فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ” — যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, সে নিহত হোক বা বিজয় অর্জন করুক, উভয় অবস্থাতেই সে সফল, কারণ আল্লাহ তার জন্য মহান পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন। এই পুরস্কার শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয় — বরং দ্বীনের পথে ত্যাগ, দাওয়াত, কষ্ট সহ্য করা, ইসলামী আদর্শ রক্ষার জন্য কাজ করা — সবই “ফি সাবিলিল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর পথে সংগ্রাম।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ “আল্লাহর পথে সংগ্রাম” মানে শুধু যুদ্ধ নয় — বরং কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন, সত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, এবং দ্বীনের দাওয়াতের জন্য কষ্ট সহ্য করা। যারা দুনিয়ার আরাম ত্যাগ করে আল্লাহর দ্বীনের জন্য শ্রম দেয়, তারা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত “যোদ্ধা” — এবং তাদের জন্য রয়েছে “অজরান্ আজীমা” — মহান পুরস্কার।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে এক মুহূর্তের জন্য যুদ্ধ করে, জান্নাত তার জন্য নিশ্চিত।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৯৭; সহিহ মুসলিম ১৮৭৬) আবার তিনি বলেছেন— “আল্লাহর পথে এক দিনের সংগ্রাম দুনিয়া ও এর সব কিছুর চেয়ে উত্তম।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৯২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা দ্বীনের প্রচারে জীবন উৎসর্গ করে, তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছে।
- দুনিয়ার স্বার্থ ত্যাগ করে আখিরাতের সওয়াব অর্জনই প্রকৃত বিজয়।
- আল্লাহর পথে নিহত হওয়া ও বিজয় লাভ — উভয়ই সফলতা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৪):
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা মুমিনের দায়িত্ব ও গৌরব।
- দুনিয়া ত্যাগ করে আখিরাতের জন্য জীবন উৎসর্গ করা সর্বোচ্চ ত্যাগ।
- আল্লাহর পথে নিহত হোক বা বিজয়ী — উভয় অবস্থাতেই পুরস্কার নিশ্চিত।
- “ফি সাবিলিল্লাহ” মানে শুধু যুদ্ধ নয়, বরং দ্বীনের সব রকমের ত্যাগ ও পরিশ্রম।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উদ্দেশে এক শক্ত প্রশ্ন রেখেছেন— “তোমরা কেন আল্লাহর পথে লড়াই করবে না?” অর্থাৎ, যখন মুসলমানদের ভাই-বোনেরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও দুর্বল অবস্থায় আছে, তখন যারা সক্ষম তারা কি বসে থাকবে? আল্লাহ বলেন, জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য শুধু শত্রুর মোকাবেলা নয়, বরং **নির্যাতিত ও অসহায় মুসলমানদের রক্ষা করা**। 🔹 এখানে বিশেষভাবে বলা হয়েছে “পুরুষ, নারী ও শিশু” — যারা অন্যায় শাসনের কারণে স্বাধীনভাবে ঈমানের জীবন যাপন করতে পারছে না, তারা আল্লাহর কাছে কাঁদছে, সাহায্য চাইছে— “হে আমাদের রব! আমাদেরকে এই জালেমদের শহর থেকে বের করে নাও।” এই দোয়া প্রতিটি নিপীড়িত মুসলমানের দোয়া, যারা ঈমানের কারণে কষ্ট পাচ্ছে, এবং এটি আজও প্রাসঙ্গিক।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
পৃথিবীর অনেক স্থানে মুসলমানরা আজ নির্যাতিত— তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, মসজিদ ভাঙা হচ্ছে, নারী ও শিশুরা কাঁদছে। অথচ অনেক সক্ষম মুসলমান দুনিয়ার আরামে ডুবে আছে। এই আয়াত তাদের জন্য এক জাগরণবার্তা— “তোমরা কেন দাঁড়াচ্ছ না?” জিহাদ মানে শুধুই যুদ্ধ নয়; বরং সত্য প্রতিষ্ঠা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা, দ্বীনের সুরক্ষার জন্য কলম, জ্ঞান ও ঐক্যের মাধ্যমে সংগ্রাম করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো নির্যাতিত মুসলমানকে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সাহায্য করে না, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে সাহায্য করবেন না।” (📖 মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬৭২২) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি এক দেহের মতো; শরীরের এক অঙ্গ ব্যথা পেলে পুরো শরীর কষ্ট পায়।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- বিশ্বের নানা স্থানে মুসলমানরা নির্যাতিত — ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মায়ানমার, আফ্রিকা ইত্যাদিতে।
- আমাদের দায়িত্ব তাদের জন্য দোয়া, সহায়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- দ্বীনের দাওয়াত, শিক্ষা ও ঐক্যের মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করাই আজকের ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ সংগ্রাম।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৫):
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম শুধু নিজের জন্য নয়, নির্যাতিত মুসলমানদের মুক্তির জন্যও।
- অসহায় মুসলমানদের সাহায্য করা ঈমানের অংশ।
- যে জাতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকে, তাদের ঈমান দুর্বল।
- প্রত্যেক মুমিনের উচিত—দোয়া, সম্পদ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্বীনের পাশে দাঁড়ানো।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে দুটি দলের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছেন— একদল হলো **ঈমানদার**, আর অন্যদল হলো **কাফের**। 🔹 ঈমানদাররা যুদ্ধ করে “ফি সাবিলিল্লাহ” — অর্থাৎ আল্লাহর পথে, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, দ্বীনের রক্ষার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য। 🔹 আর কাফেররা যুদ্ধ করে “ফি সাবিলিত তাগুত” — অর্থাৎ অন্যায়, ক্ষমতা, মূর্তি, শয়তান ও মানবনির্মিত ব্যবস্থার পক্ষে। তাদের যুদ্ধ অন্যায়ের পক্ষে, শয়তানের আনুগত্যে পরিচালিত। তাই আল্লাহ বলেন — “তোমরা যুদ্ধ করো শয়তানের মিত্রদের (আউলিয়া-আশ্ শাইতান)” — অর্থাৎ যারা আল্লাহর দ্বীনের বিরোধিতা করে, তারা শয়তানের সেনা। এবং আল্লাহ মুমিনদের সাহস দিচ্ছেন — “নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল দুর্বল।” অর্থাৎ, যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তাদের উপর শয়তান কখনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
তাগুত শব্দের অর্থ:
“তাগুত” মানে — এমন সব কিছু, যা আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে; যেমন — শয়তান, মূর্তি, অত্যাচারী শাসক, কিংবা এমন ব্যবস্থা যা আল্লাহর বিধানের বিপরীতে চলে। ইসলামে তাগুতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগে “তাগুত” শুধু মূর্তি বা শয়তান নয়, বরং সেই সমস্ত মতবাদ, আইন ও ব্যবস্থা যা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় — যেমন: নাস্তিকতা, বস্তুবাদ, জুলুম, অন্যায় শাসন ইত্যাদি। মুমিনদের দায়িত্ব হলো এইসব তাগুত শক্তির বিরুদ্ধে জ্ঞান, দাওয়াত, কলম ও ঐক্যের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়াই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (📖 সহিহ বুখারী ২৮১০; সহিহ মুসলিম ১৮৭৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেছেন— “শয়তান তার ফাঁদ বিছায়, কিন্তু আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত মানুষকে সে পরাস্ত করতে পারে না।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৮১৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করতে আজ নানা “তাগুত” ব্যবস্থা কাজ করছে।
- মুমিনদের উচিত কলম, জ্ঞান ও ঐক্যের মাধ্যমে দ্বীন রক্ষায় এগিয়ে আসা।
- শয়তানের কৌশল দুর্বল — আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত মুমিন কখনো পরাজিত হয় না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৬):
- মুমিনরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, কাফেররা শয়তানের পথে।
- তাগুত ও অন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি।
- আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত মুমিনের উপর শয়তান প্রভাব ফেলতে পারে না।
- শয়তানের কৌশল দুর্বল — ঈমান ও আল্লাহর স্মরণই এর প্রতিষেধক।
এই আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে, যেখানে কিছু মুসলমান ছিল যারা মক্কায় নির্যাতনের সময় যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু তখন তাদেরকে বলা হয়েছিল— “এখন নয়, তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত দাও, ধৈর্য ধরো।” পরে যখন মদীনায় এসে আল্লাহ তাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করলেন, তখন তাদের মধ্যে কিছু লোক ভীত হয়ে পড়ে, তারা মানুষের ভয় করতে লাগল আল্লাহর ভয়ের চেয়েও বেশি। তাদের মধ্যে এমন মনোভাব দেখা যায় যে, তারা আখিরাতের চেয়ে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি ভালোবাসে। 🔹 “লিমা কাতাবতা ‘আলাইনাল ক্বিতাল” — তারা অভিযোগের সুরে বলে, “হে আল্লাহ! কেন যুদ্ধ ফরজ করলে?” অথচ আল্লাহ জানেন, যুদ্ধ কেবল অন্যায় প্রতিরোধ ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই ফরজ। 🔹 আল্লাহ বলেন — “দুনিয়ার জীবন সামান্য, কিন্তু আখিরাত তাকওয়াবানদের জন্য উত্তম।” অর্থাৎ, যারা আল্লাহভীরু, তারা দুনিয়ার কষ্ট সহ্য করে আখিরাতের সুখ অর্জন করে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের মনে সাহস ও ঈমান জাগিয়ে দেন, যেন তারা ভয়, অলসতা ও দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে দ্বীনের পথে দৃঢ় হয়।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও অনেক মানুষ ইসলামের জন্য সামান্য কষ্ট পেলেই প্রশ্ন তোলে— “আল্লাহ কেন এই কষ্ট দিলেন?” অথচ এই কষ্টই মুমিনদের ঈমান পরীক্ষা করে, এবং সত্যিকারের তাকওয়াবানদের আলাদা করে তুলে ধরে। আল্লাহ বলেন — দুনিয়ার জীবন অল্প, তাই আখিরাতের প্রস্তুতি নেওয়াই মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার, আর কাফেরের জন্য জান্নাত।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৯৫৬) আরেক হাদিসে তিনি বলেন— “যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে প্রতিটি বিপদ থেকে পথ বের করে দেন।” (📖 সূরা আত-তালাক ৬৫:২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কিছু মানুষ দ্বীনের কষ্ট থেকে পালাতে চায়, কিন্তু পুরস্কার চায় আখিরাতের।
- মুমিনের উচিত আল্লাহর আদেশ মেনে ধৈর্য ধরে সংগ্রাম করা।
- যে দুনিয়ার আরাম চেয়ে আখিরাত ভুলে যায়, সে প্রকৃত সফল হতে পারে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৭):
- দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আখিরাতই চিরস্থায়ী ও উত্তম।
- আল্লাহর পথে কষ্ট পাওয়া মানে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।
- মানুষের ভয় নয়, আল্লাহর ভয়ই মুমিনের জীবনের ভিত্তি।
- তাকওয়া ও ধৈর্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে এক গভীর সত্যের শিক্ষা দিয়েছেন — **মৃত্যু অনিবার্য** এবং **সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে।** 🔹 “أينما تكونوا يدرككم الموت” — অর্থাৎ, তোমরা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে থাকো, পাহাড়ের গুহায়, বাঙ্কারে বা প্রাসাদে — মৃত্যু তোমাদেরকে ধরবেই, কারণ তা আল্লাহর নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আসে। 🔹 এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে অহংকার ও ভয় থেকে মুক্ত হতে শিক্ষা দেন। যারা মৃত্যুকে ভয় পেয়ে আল্লাহর পথে কাজ করে না, তারা আসলে নিজেদের অজ্ঞতার প্রমাণ দেয়, কারণ মৃত্যু থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। 🔹 এরপর আল্লাহ বলেন — “যখন তাদের কোনো কল্যাণ হয়, তারা বলে — এটা আল্লাহর দান।” “কিন্তু যখন কোনো অকল্যাণ ঘটে, তারা বলে — এটা তোমার কারণে (হে নবী)!” এটি ছিল মুনাফিকদের বক্তব্য — তারা নবী ﷺ-কে অভিযুক্ত করতো যে, “তোমার আগমনই আমাদের দুর্ভাগ্যের কারণ!” অথচ আল্লাহ ঘোষণা করলেন — “সবকিছুই আমার কাছ থেকে — কল্যাণও, অকল্যাণও।” কারণ, উভয়ই মানুষের পরীক্ষা: কল্যাণ দ্বারা কৃতজ্ঞতা পরীক্ষা হয়, আর অকল্যাণ দ্বারা ধৈর্য পরীক্ষা হয়।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় — ভালো কিছু হলে বলে, “আমি পরিশ্রম করেছি”; আর খারাপ কিছু হলে বলে, “ভাগ্য খারাপ”, “অন্যদের দোষ”। কিন্তু কুরআন শেখায়, **সর্বকিছুই আল্লাহর হুকুমে ঘটে, আর সবকিছুতেই রয়েছে হিকমাহ (প্রজ্ঞা)।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মৃত্যু থেকে পালাতে চাওয়া অর্থহীন, কারণ মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাকে তোমার নির্ধারিত স্থানে খুঁজে নেবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৫০৭; সহিহ মুসলিম ২৬৮৩) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে মুমিন আল্লাহর আদেশে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য প্রতিটি অবস্থা কল্যাণকর।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৯৯৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ আজ মৃত্যুর ভয়ে নিরাপত্তা খোঁজে, কিন্তু মৃত্যু সর্বত্র নির্ধারিত।
- ভালো-মন্দ উভয় অবস্থাই আল্লাহর পরীক্ষা — কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্য যাচাইয়ের জন্য।
- দুনিয়ার কোনো দুর্গও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৮):
- মৃত্যু অনিবার্য — এটি আল্লাহর নির্ধারিত সময়েই আসবে।
- কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে, মানুষের পরীক্ষা হিসেবে।
- মুমিন সব অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে, অভিযোগ নয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
- মৃত্যুর ভয় নয়, বরং আল্লাহভীতি মানুষকে সফলতার পথে রাখে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবনের দুটি দিক পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন — **কল্যাণ (ভালো ফল)** ও **অকল্যাণ (কষ্ট বা বিপদ)** — উভয়ই আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে, তবে এর কারণ ভিন্ন। 🔹 “مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ” — তোমার কাছে যে কল্যাণ আসে, যেমন — স্বাস্থ্য, রিজিক, নিরাপত্তা, ঈমান, সাফল্য — এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একান্ত অনুগ্রহ ও দয়া। 🔹 “وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ” — আর তোমার যে অকল্যাণ ঘটে, যেমন — ব্যর্থতা, কষ্ট, বিপদ, অপমান — তা তোমার নিজের কৃতকর্মের ফল। কারণ, মানুষ যখন আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করে, তখন তার ফলাফল হিসেবে কষ্ট ও শাস্তি নেমে আসে। আল্লাহ কোনো অন্যায় করেন না; বরং মানুষ নিজের ভুল ও গুনাহের মাধ্যমে নিজেই বিপদ ডেকে আনে। 🔹 এরপর আল্লাহ বলেন— “আমি তোমাকে (হে নবী ﷺ) পাঠিয়েছি মানুষের প্রতি রাসূল হিসেবে।” অর্থাৎ, নবী ﷺ-এর দায়িত্ব হলো মানুষকে সতর্ক করা, যাতে তারা বুঝতে পারে—সুখ-দুঃখের সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে। এবং আল্লাহ বলেন — “আল্লাহ সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।” অর্থাৎ, মানুষ নবীর দাওয়াত গ্রহণ করুক বা না করুক, আল্লাহ নিজেই তাদের কাজের সাক্ষী এবং বিচারক।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ মানুষ ভালো কিছু পেলে গর্ব করে — “আমি করেছি”, আর খারাপ কিছু হলে বলে — “ভাগ্য খারাপ” বা “অন্যদের দোষ!” কিন্তু কুরআন শেখায়— **ভালো ও মন্দ উভয়ই আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে**, তবে মন্দের মূল কারণ মানুষের নিজের গুনাহ ও অবাধ্যতা। তাই, বিপদের সময় অভিযোগ নয়, আত্মসমালোচনা ও তওবা করা উচিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে বিপদ তোমার ওপর আসে, তা তোমার নিজের কৃতকর্মের ফল, তবে আল্লাহ অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (📖 তিরমিযি, হাদিস: ৩০৭২) আরেক হাদিসে তিনি বলেন— “মুমিনের প্রতি যে কোনো বিপদ বা কষ্ট আসে, তা তার গুনাহ মোচনের উপায়।” (📖 সহিহ বুখারী ৫৬৪১; সহিহ মুসলিম ২৫৭২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষের কষ্ট ও বিপদ প্রায়ই তার নিজের অন্যায় ও গাফিলতির ফল।
- সফলতা পেলে কৃতজ্ঞতা আর কষ্টে ধৈর্য—এই দুটিই মুমিনের গুণ।
- নবী ﷺ আমাদের জন্য এক সতর্ককারী ও দিশারী; তাঁর অনুসরণই মুক্তির পথ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৯):
- সব কল্যাণ আল্লাহর অনুগ্রহে আসে, আর অকল্যাণ আসে আমাদের নিজের গুনাহের কারণে।
- আল্লাহ কোনো অন্যায় করেন না; মানুষ নিজেই নিজের ক্ষতির কারণ।
- বিপদে ধৈর্য ও আত্মসমালোচনা, আর কল্যাণে কৃতজ্ঞতা—এটাই মুমিনের পথ।
- নবী ﷺ আল্লাহর সাক্ষী ও বার্তাবাহক—তাঁর অনুসরণেই প্রকৃত মুক্তি।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা একটি মৌলিক বিশ্বাস স্পষ্ট করেছেন — **রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য মানেই আল্লাহর আনুগত্য।** 🔹 কারণ, নবী ﷺ নিজে থেকে কিছু বলেননি; তিনি যা বলেন ও আদেশ করেন, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি (প্রকাশিত বার্তা)। আল্লাহ বলেন — “নবী তার ইচ্ছা থেকে কিছু বলেন না; এটি কেবল ওহি যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়।” (📖 সূরা আন-নজম, ৫৩:৩–৪) তাই, নবীর আদেশ অমান্য করা মানে আসলে আল্লাহর আদেশ অমান্য করা। যে ব্যক্তি নবীর আদেশ মেনে চলে, সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর আনুগত্য করছে। 🔹 এরপর আল্লাহ বলেন — “আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তোমাকে তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি।” অর্থাৎ, নবী ﷺ-এর কাজ হলো দাওয়াত ও সতর্ক করা; কারো ঈমান গ্রহণ করা বা না করা — তা আল্লাহর হাতে। নবী ﷺ মানুষের উপর জোর-জবরদস্তি করার জন্য প্রেরিত হননি, বরং তাঁর কাজ হলো মানুষকে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য দেখিয়ে দেওয়া।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ কিছু লোক বলে — “আমি আল্লাহকে মানি, কিন্তু নবীকে মানি না” বা “হাদিসের প্রয়োজন নেই।” অথচ এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন — **রাসূলের আনুগত্য ছাড়া আল্লাহর আনুগত্য অসম্পূর্ণ।** কুরআন ও হাদিস আলাদা নয়; বরং হাদিস হলো কুরআনের ব্যাখ্যা ও জীবন্ত প্রয়োগ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে আমাকে মানে, সে আল্লাহকে মানল; আর যে আমার অবাধ্য হয়, সে আল্লাহর অবাধ্য হলো।” (📖 সহিহ বুখারী ২৯৫৭; সহিহ মুসলিম ১৮৩৫) আরেক হাদিসে তিনি বলেন— “তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ইচ্ছাকে আমার আনা দ্বীনের অধীন করে।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৮৪০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা কুরআন মানে কিন্তু হাদিস অস্বীকার করে, তারা প্রকৃত মুমিন নয়।
- নবী ﷺ-এর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গঠন করাই আল্লাহর আনুগত্যের প্রকৃত রূপ।
- দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ নবী ﷺ-এর দায়িত্বের উত্তরাধিকার।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮০):
- রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যই আল্লাহর আনুগত্য।
- নবীর আদেশ মানা ঈমানের শর্ত।
- নবী ﷺ জোর করে কাউকে ঈমানদার বানাতে পাঠানো হননি; তিনি ছিলেন বার্তাবাহক।
- কুরআন ও হাদিস — উভয়ই ইসলামের পূর্ণ নির্দেশনা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **মুনাফিকদের (ভণ্ড ঈমানদারদের)** এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেছেন। 🔹 তারা নবী ﷺ-এর সামনে এসে বলে — “আমরা আনুগত্য করবো”, যেন তারা বিশ্বস্ত মুমিন। কিন্তু নবীর কাছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, তারা গোপনে এমন পরিকল্পনা করে যা নবীর আদেশের সম্পূর্ণ বিপরীত। 🔹 “بَيَّتَ طَائِفَةٌ مِّنْهُمْ” — অর্থাৎ, তারা রাতে লুকিয়ে ষড়যন্ত্র করে, মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়, নবী ﷺ-এর সিদ্ধান্তকে দুর্বল করতে চায়। আল্লাহ বলেন — “আমি তাদের সেই গোপন ষড়যন্ত্রও লিখে রাখি।” অর্থাৎ, আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে কিছুই ঘটে না। তাদের মুখের আনুগত্য ও অন্তরের কপটতা উভয়ই আল্লাহর জানা। 🔹 এরপর আল্লাহ নবী ﷺ-কে নির্দেশ দেন — “তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও” — অর্থাৎ, তাদের ধোঁকায় গুরুত্ব দিও না। “আল্লাহর উপর ভরসা রাখো” — কারণ তিনিই তোমার সাহায্যকারী ও রক্ষাকারী। এই আয়াতে আল্লাহ নবী ﷺ এবং মুসলিম সমাজকে শিক্ষা দিয়েছেন— মানুষ যা বলে তা নয়, বরং **আল্লাহর উপরই পূর্ণ আস্থা রাখো**।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও কিছু মানুষ মুখে বলে— “আমরা ইসলাম ভালোবাসি”, কিন্তু বাস্তবে ইসলামের আদেশ অমান্য করে, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। এই মুনাফিক মনোভাব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন— **মুখের আনুগত্য নয়, হৃদয়ের ঈমানই আসল।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে — সে কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে, এবং আমানত পেলে তা বেঈমানি করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আমাদের ক্ষতি করতে চায় অথচ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে, সে প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৭৭৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা ইসলামের নামে প্রতারণা করে, তারা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
- মুখে ঈমান, কিন্তু কাজে অবাধ্যতা — এটাই মুনাফিকির লক্ষণ।
- আল্লাহ সব গোপন ষড়যন্ত্র জানেন — তাই মুমিনের উচিত শুধুই আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮১):
- মুনাফিকরা মুখে আনুগত্যের ভান করে, কিন্তু অন্তরে অবাধ্য।
- আল্লাহ মানুষের অন্তরের ষড়যন্ত্রও জানেন ও লিপিবদ্ধ করেন।
- আল্লাহর উপর ভরসা করাই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়।
- মিথ্যা ও দ্বিমুখিতা সমাজ ও ঈমান উভয়কেই ধ্বংস করে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **মুনাফিকদের (ভণ্ড ঈমানদারদের)** এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেছেন। 🔹 তারা নবী ﷺ-এর সামনে এসে বলে — “আমরা আনুগত্য করবো”, যেন তারা বিশ্বস্ত মুমিন। কিন্তু নবীর কাছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, তারা গোপনে এমন পরিকল্পনা করে যা নবীর আদেশের সম্পূর্ণ বিপরীত। 🔹 “بَيَّتَ طَائِفَةٌ مِّنْهُمْ” — অর্থাৎ, তারা রাতে লুকিয়ে ষড়যন্ত্র করে, মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়, নবী ﷺ-এর সিদ্ধান্তকে দুর্বল করতে চায়। আল্লাহ বলেন — “আমি তাদের সেই গোপন ষড়যন্ত্রও লিখে রাখি।” অর্থাৎ, আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে কিছুই ঘটে না। তাদের মুখের আনুগত্য ও অন্তরের কপটতা উভয়ই আল্লাহর জানা। 🔹 এরপর আল্লাহ নবী ﷺ-কে নির্দেশ দেন — “তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও” — অর্থাৎ, তাদের ধোঁকায় গুরুত্ব দিও না। “আল্লাহর উপর ভরসা রাখো” — কারণ তিনিই তোমার সাহায্যকারী ও রক্ষাকারী। এই আয়াতে আল্লাহ নবী ﷺ এবং মুসলিম সমাজকে শিক্ষা দিয়েছেন— মানুষ যা বলে তা নয়, বরং **আল্লাহর উপরই পূর্ণ আস্থা রাখো**।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও কিছু মানুষ মুখে বলে— “আমরা ইসলাম ভালোবাসি”, কিন্তু বাস্তবে ইসলামের আদেশ অমান্য করে, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। এই মুনাফিক মনোভাব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন— **মুখের আনুগত্য নয়, হৃদয়ের ঈমানই আসল।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে — সে কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে, এবং আমানত পেলে তা বেঈমানি করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আমাদের ক্ষতি করতে চায় অথচ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে, সে প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৭৭৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা ইসলামের নামে প্রতারণা করে, তারা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
- মুখে ঈমান, কিন্তু কাজে অবাধ্যতা — এটাই মুনাফিকির লক্ষণ।
- আল্লাহ সব গোপন ষড়যন্ত্র জানেন — তাই মুমিনের উচিত শুধুই আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮১):
- মুনাফিকরা মুখে আনুগত্যের ভান করে, কিন্তু অন্তরে অবাধ্য।
- আল্লাহ মানুষের অন্তরের ষড়যন্ত্রও জানেন ও লিপিবদ্ধ করেন।
- আল্লাহর উপর ভরসা করাই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়।
- মিথ্যা ও দ্বিমুখিতা সমাজ ও ঈমান উভয়কেই ধ্বংস করে।
এই আয়াতটি কুরআনের **অলৌকিকতা, সত্যতা ও পরিপূর্ণতার প্রমাণ** বহন করে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে আহ্বান করছেন — “তোমরা কি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করো না?” 🔹 “يَتَدَبَّرُونَ” (ইয়াতাদাব্বারূন) মানে হলো — গভীরভাবে ভাবা, বিশ্লেষণ করা, বোঝা। শুধু তিলাওয়াত নয়, বরং এর অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করা। 🔹 আল্লাহ বলছেন — যদি এই কুরআন কোনো মানুষের রচনা হতো, তবে এতে হাজারো **বিরোধ, ভুল ও অসংগতি** পাওয়া যেত। কিন্তু কুরআনের প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি বাণী পরস্পরকে সম্পূর্ণ করে, কোনো দ্বন্দ্ব নেই — বরং এর প্রতিটি বাক্যে রয়েছে **জ্ঞান, সত্য ও সামঞ্জস্য।** 🔹 এই আয়াত কুরআনের ঐশ্বরিক উৎস প্রমাণ করে — কুরআন আল্লাহর বাণী, যা মানুষের চিন্তা, ইতিহাস বা জ্ঞানের ঊর্ধ্বে।
তাফসীরের মূল বক্তব্য:
- মুমিনদের উচিত কুরআন শুধু তিলাওয়াত নয়, **তাদাব্বুর (চিন্তাভাবনা)** সহকারে পড়া। - কুরআনের প্রতিটি আয়াতে এমন গভীরতা আছে যা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়। - বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভাষার প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআনের সত্যতা টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ অনেক শিক্ষিত মানুষ কুরআনকে শুধুমাত্র ধর্মীয় বই মনে করে, অথচ কুরআন হলো **মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।** এটি ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ, রাজনীতি, নীতি-নৈতিকতা — সবকিছু নিয়ে আলোচনা করে। কুরআনের কোনো বিরোধ নেই, বরং প্রতিটি আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা দেয় — এটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, কোনো মানবীয় রচনা নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কুরআন এমন এক গ্রন্থ, যার বিস্ময় কখনো শেষ হবে না, আর যার শিক্ষণ প্রতিটি যুগেই নতুনভাবে প্রকাশ পাবে।” (📖 মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২৩৪২) আবার নবী ﷺ বলেন— “তোমরা কুরআন নিয়ে চিন্তা করো, কারণ এতে আগের ও পরের সব জাতির জ্ঞান রয়েছে।” (📖 তিরমিযি, হাদিস: ২৯০৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতই অগ্রসর হোক, কুরআনের সত্য আজও অপরিবর্তিত।
- যারা কুরআন নিয়ে চিন্তা করে, তাদের হৃদয় আলোকিত হয়।
- কুরআনের প্রতিটি আয়াত মানব জীবনের জন্য পথনির্দেশ ও হিদায়াত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮২):
- কুরআন আল্লাহর বাণী — এতে কোনো বিরোধ বা ভুল নেই।
- তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা বোঝা ফরজে কিফায়া।
- যারা কুরআন নিয়ে চিন্তা করে, তাদের ঈমান ও বুদ্ধি উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
- কুরআনের সত্যতা মানুষের বুদ্ধি, বিজ্ঞান ও ইতিহাসেও প্রমাণিত।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **অবিশ্বাস্য গুজব ও অস্থিরতার সংস্কৃতির** নিন্দা করেছেন। মুনাফিক ও কিছু সরলমনা মুসলমান নবী ﷺ-এর যুগে প্রতিটি খবর শুনেই প্রচার করতে শুরু করতো — সেটা সত্য কি মিথ্যা, যাচাই না করেই! 🔹 “أَذَاعُوا بِهِ” — মানে তারা খবর ছড়িয়ে দেয়। যেমন যুদ্ধের খবর, মুসলমানদের পরাজয়, বিজয় বা নিরাপত্তা সম্পর্কিত সংবাদ— যাচাই-বাছাই না করেই তারা বলাবলি করতো। এর ফলে মুসলিম সমাজে ভয়, সন্দেহ ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ত। আল্লাহ বলেন — “যদি তারা সেই খবর নবী ﷺ বা উলিল আমর (দায়িত্বশীল নেতা ও আলেমদের) কাছে পৌঁছে দিত, তাহলে তারা বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতো।” অর্থাৎ, সব খবরই প্রচারযোগ্য নয়; কিছু সংবাদ দায়িত্বশীলভাবে যাচাই করে প্রচার করতে হয়। 🔹 “يَسْتَنْبِطُونَهُ” — অর্থাৎ যারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেয়, যেমন—নবী ﷺ, খলিফা, আলেম ও বিচারকগণ। তারা জানে কোন খবর প্রকাশ করা উচিত আর কোনটি গোপন রাখা প্রয়োজন। তারপর আল্লাহ বলেন — “যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো, তবে তোমরা সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে।” অর্থাৎ, গুজব ছড়ানো, অস্থিরতা সৃষ্টি করা — এগুলো শয়তানের পথ।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগে এই আয়াত আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এখন সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদ ও মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে মুমিনদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কুরআন শেখায় — **যে কোনো খবর শুনলে যাচাই করো, প্রচার করার আগে চিন্তা করো।** ইসলাম চায় সত্য, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীল আচরণ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “একজন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, যে সে যা শোনে তা-ই প্রচার করে।” (📖 সহিহ মুসলিম ৫) আবার বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো সংবাদ যাচাই না করে প্রচার করে, সে মিথ্যার অংশীদার।” (📖 তিরমিযি, হাদিস: ২৭৩২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মুসলমান যাচাই না করেই খবর বা ভিডিও শেয়ার করে ফেলে।
- গুজব, অপপ্রচার ও রাজনৈতিক প্ররোচনা মুসলিম ঐক্যকে দুর্বল করছে।
- ইসলাম আমাদের শেখায় — প্রচারের আগে সত্যতা নিশ্চিত করা ফরজ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৩):
- প্রত্যেক খবর প্রচারের আগে যাচাই করা জরুরি।
- আল্লাহ দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে সমাজে স্থিতি বজায় রাখতে চান।
- অস্থিরতা ও গুজব ছড়ানো শয়তানের কাজ।
- মুমিনের কাজ হলো — চিন্তা, যাচাই ও ন্যায়ভিত্তিক আচরণ।
এই আয়াতটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উদ্দেশ্য করে নাযিল হয়েছে, তবে এর শিক্ষা সমস্ত যুগের মুমিনদের জন্য প্রযোজ্য। 🔹 আল্লাহ তাআলা নবী ﷺ-কে আদেশ করছেন — “তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো।” অর্থাৎ, সত্য প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় প্রতিরোধের জন্য সংগ্রাম করো, যদিও তোমার সাথে অল্পসংখ্যক লোক থাকে। 🔹 “لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ” — অর্থাৎ, তুমি নিজের দায়িত্বে দায়বদ্ধ, অন্য কেউ সহযোগিতা না করলেও, তোমার কাজ হলো আল্লাহর আদেশ পালন করা। 🔹 এরপর আল্লাহ বলেন — “মুমিনদের উৎসাহিত করো।” অর্থাৎ, তাদের ঈমান জাগিয়ে তুলো, তাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করো যে আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে। নবী ﷺ শুধু যোদ্ধা নন, তিনি ছিলেন **উদ্দীপনাদাতা ও অনুপ্রেরণাকারী নেতা।** 🔹 তারপর আল্লাহ বলেন — “আল্লাহ কাফিরদের শক্তি রোধ করবেন।” অর্থাৎ, মুমিনদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহ শত্রুদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেবেন। 🔹 “আল্লাহর শক্তি সবচেয়ে প্রবল” — অর্থাৎ, শত্রুরা যতই শক্তিশালী হোক, আল্লাহর শক্তি ও প্রতিশোধের ক্ষমতা সর্বোচ্চ। এই আয়াতের মূল শিক্ষা হলো — **মুমিনের দায়িত্ব হলো নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করা, ফলাফল আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেওয়া।**
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগে “আল্লাহর পথে সংগ্রাম” বলতে শুধু অস্ত্র ধারণ নয়, বরং ইসলাম রক্ষা, দাওয়াত, জ্ঞান, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ — সবই অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম চায় — প্রত্যেক মুমিন নিজের সীমার মধ্যে আল্লাহর কাজে অবদান রাখুক, সমাজে ঈমান, সাহস ও ঐক্য সৃষ্টি করুক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয় বা যোদ্ধাদের সাহায্য করে, সে যুদ্ধের সমান সওয়াব পায়।” (📖 সহিহ বুখারী ২৮৪৩; সহিহ মুসলিম ১৮৯৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে আল্লাহর পথে নিজের জান ও সম্পদ ব্যয় করে।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৯০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মুমিনের কাজ হলো চেষ্টা করা, ফলাফল আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
- আজ জ্ঞান, কলম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও ‘ফি সাবিলিল্লাহ’।
- আল্লাহর সাহায্য সেই জাতির সাথে, যারা ঐক্যবদ্ধ ও ঈমানদার।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৪):
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব।
- নিজের কাজের জন্যই মানুষ দায়বদ্ধ, অন্যের জন্য নয়।
- আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির জন্য সাহস ও ঐক্য প্রয়োজন।
- আল্লাহর শক্তি ও প্রতিশোধের ক্ষমতা সর্বোচ্চ ও অপরাজেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবসমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্ববোধের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। 🔹 “مَّن يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً” — অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোনো **ভালো কাজে সুপারিশ** করে, যেমন — কারো কল্যাণে কথা বলা, ন্যায়বিচারের জন্য সাহায্য করা, কারো প্রয়োজনে সহযোগিতা করা, অথবা অন্যের উপকারে প্রচেষ্টা করা — আল্লাহ তার জন্য সেই কাজের **সওয়াবের অংশ** নির্ধারণ করেন। 🔹 “وَمَن يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً” — আর যে ব্যক্তি **অন্যায়, গুনাহ বা ক্ষতিকর কাজে সুপারিশ** করে, যেমন — অপরাধীকে রক্ষা করা, মিথ্যা সমর্থন করা, অন্যায় সিদ্ধান্তে পক্ষ নেওয়া — তার জন্য তাতে **পাপের অংশ** নির্ধারিত হয়। 🔹 “وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ مُّقِيتًا” — অর্থাৎ, আল্লাহ প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সুপারিশ, এমনকি প্রতিটি কথাও জানেন ও তা অনুযায়ী প্রতিদান দেবেন। এই আয়াত মানুষকে শিক্ষা দেয় — সমাজে প্রতিটি কথা ও উদ্যোগের দায় আছে। ভালো কাজে অংশ নাও, কিন্তু খারাপ কাজে জড়িও না, কারণ আল্লাহ প্রত্যেকের কাজের হিসাব রাখছেন।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগে “সুপারিশ” বা “রেকমেন্ডেশন” খুব সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু ইসলাম শেখায় — তুমি যদি কোনো অন্যায় কাজ বা পাপের জন্য কাউকে সাহায্য করো, তবে তুমি সেই পাপের অংশীদার হবে। বিপরীতে, যদি কারো উপকারের জন্য সাহায্য করো, তবে তার প্রতিটি ভালো কাজের সওয়াবে তোমারও অংশ থাকবে। 📌 এই নীতিই ইসলামী সমাজের নৈতিক কাঠামো — ভালো কাজে একে অপরকে সাহায্য করো, কিন্তু গুনাহ ও অন্যায়ে সাহায্য করো না (সূরা মায়িদা ৫:২)।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজের পথে দাওয়াত দেয়, তার জন্য সেই কাজের সমান সওয়াব রয়েছে, আর যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজের পথে দাওয়াত দেয়, তার উপর সেই কাজের সমান পাপ বর্তাবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৭৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি অন্যায়ে সাহায্য করে, সে আল্লাহর ক্রোধের অধিকারী।” (📖 মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩৪৭৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অন্যায় কাজে কাউকে সহযোগিতা করা বা সমর্থন করা ইসলামে কঠিন গুনাহ।
- ভালো কাজে উৎসাহিত করলে বা সহযোগিতা করলে তার সওয়াবও ভাগ পাওয়া যায়।
- সোশ্যাল মিডিয়া বা বাস্তব জীবনে — ভালো কাজে শেয়ার করা সওয়াবের কাজ, মন্দ কাজে শেয়ার করা পাপের কাজ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৫):
- ভালো কাজে সুপারিশ করলে সওয়াব পাওয়া যায়।
- খারাপ কাজে সাহায্য বা প্রচার করলে পাপের অংশীদার হওয়া যায়।
- আল্লাহ সব কিছু জানেন ও হিসাব নেবেন।
- মুমিনের কাজ হলো — ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের **সামাজিক শিষ্টাচার ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা** দিয়েছেন। ইসলাম শুধু নামাজ, রোযা বা ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষে মানুষে আচরণ, সম্পর্ক ও সৌজন্যের ধর্ম। 🔹 “وَإِذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ” — অর্থাৎ, যখন কেউ তোমাকে সম্ভাষণ করে, যেমন “আসসালামু আলাইকুম” বলে, তখন তোমার দায়িত্ব হলো এর উত্তর দেয়া। 🔹 “فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا” — এর মানে: - হয় এর চেয়ে ভালোভাবে উত্তর দাও, যেমন “ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ”। - অথবা অন্তত সমানভাবে উত্তর দাও, যেমন “ওয়া আলাইকুমুস সালাম”। এটি শুধু মুখের কথা নয়, বরং হৃদয়ের আন্তরিকতা ও সম্মানের প্রকাশ। 🔹 এই আয়াত মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে **ভালোবাসা, সৌজন্য ও ঐক্য** দৃঢ় করার নীতি স্থাপন করে। আল্লাহ বলেন — “নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর হিসাব গ্রহণকারী।” অর্থাৎ, এমনকি ছোট একটি সালাম ফিরিয়ে দেওয়া বা না দেওয়াও আল্লাহর নিকট গণ্য হবে।
সালামের তাৎপর্য:
ইসলামে সালাম একটি মহৎ দোয়া ও পরিচয়বাহী শব্দ। “আসসালামু আলাইকুম” মানে — *তোমার প্রতি আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক।* এটি শুধু শুভেচ্ছা নয়, বরং একটি দোয়া, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার প্রতীক।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজ অনেক মুসলমান সালাম দেওয়াকে তুচ্ছ মনে করে, অথচ এটি ইসলামের মৌলিক আদব। নবী ﷺ বলেছেন, সালাম প্রচার করলে সমাজে ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বৃদ্ধি পায়। এমনকি অপরিচিত মুসলমানকেও সালাম করা সুন্নাহ। কারণ সালাম কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য নয়, বরং সকল মুসলমানের মধ্যে ভালোবাসা ছড়ানোর জন্য নির্ধারিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা একে অপরের মধ্যে সালাম প্রচার করো, তাহলে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ৫৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে আগে সালাম দেয়, সে অহংকারমুক্ত।” (📖 সহিহ বুখারী ৬২৪২) এবং বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে আগে সালাম দেয়।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৫২০৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- সালাম মুসলিমদের পরিচয়ের প্রতীক — এটি আদব ও দোয়া দুটোই।
- যে আগে সালাম দেয়, সে বিনয়ী ও আল্লাহর কাছে প্রিয়।
- সালামের উত্তর না দেওয়া অহংকারের লক্ষণ এবং গুনাহের কাজ।
- সোশ্যাল মিডিয়াতেও “আসসালামু আলাইকুম” বলা ও উত্তর দেওয়া সুন্নাহর অংশ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৬):
- সালাম দেওয়া ও উত্তর দেওয়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আদব।
- সালামের উত্তর দিতে হবে অন্তত সমান বা আরও উত্তমভাবে।
- সালাম সমাজে ভালোবাসা, ঐক্য ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে।
- আল্লাহ প্রতিটি কাজের হিসাব নেন — এমনকি ছোট একটি সালামও।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **তাওহীদ (একত্ববাদ)**, **আখিরাতের সত্যতা** এবং **কুরআনের নির্ভুলতা** — এই তিনটি মৌলিক সত্য একসাথে ঘোষণা করেছেন। 🔹 “اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ” — অর্থাৎ, একমাত্র আল্লাহই ইবাদতের যোগ্য, তাঁর ছাড়া আর কোনো মাবুদ, কোনো শক্তি, কোনো ক্ষমতা নেই। এই ঘোষণা ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি — **লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ**। 🔹 “لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ” — আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন — তিনি কিয়ামতের দিনে সমস্ত মানুষকে একত্র করবেন, কারও পক্ষে সেই দিন থেকে পালানো বা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এই বাক্যটি আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রতীক — যে দুনিয়ায় অন্যায় করে, অহংকার করে, সে সেদিন জবাবদিহি করবে। আর যারা ঈমান ও সৎকাজ করেছে, তারা পুরস্কৃত হবে। 🔹 “وَمَنۡ أَصۡدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا” — অর্থাৎ, আল্লাহর কথার চেয়ে সত্য আর কিছু হতে পারে না। কুরআনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি প্রতিশ্রুতি — পরম সত্য ও অবিনাশী। এই আয়াত মুমিনদের মনে **দৃঢ় বিশ্বাস ও আখিরাতের জবাবদিহির চেতনা** জাগিয়ে দেয়।
তাফসীরের মূল শিক্ষা:
- আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়; তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। - আখিরাত একটি নিশ্চিত বাস্তবতা; সবাই সেখানে বিচার দিবসে উপস্থিত হবে। - আল্লাহর কথা চূড়ান্ত সত্য — কোনো সন্দেহ বা পরিবর্তন নেই তাতে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগে অনেকেই আখিরাত ভুলে গেছে, দুনিয়াকে চিরস্থায়ী মনে করে চলছে। অথচ আল্লাহ ঘোষণা করেছেন — **প্রত্যেক মানুষ কিয়ামতের ময়দানে হাজির হবে,** কেউই দায় থেকে মুক্ত হবে না। এই আয়াত মানুষকে মনে করিয়ে দেয় — দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আখিরাত চিরস্থায়ী। তাই আল্লাহর কথার প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যই পরিত্রাণের পথ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দৃঢ় বিশ্বাসে উচ্চারণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৪৩৮; সহিহ মুসলিম ২৬) আরেক হাদিসে তিনি বলেন— “কিয়ামতের দিনে মানুষ তাদের রবের সামনে দাঁড়াবে, প্রত্যেকে নিজের কাজের হিসাব দিবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৯৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আখিরাতের বিশ্বাস হারালে মানুষ অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ে।
- তাওহীদের ধারণা মানুষকে স্বাধীনতা ও আল্লাহভীতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
- আল্লাহর কথা সর্বাধিক সত্য — তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনো মিথ্যা হয় না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৭):
- আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় — তাঁর ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।
- কিয়ামতের দিনে সবাই আল্লাহর সামনে হাজির হবে।
- আল্লাহর বাণীই সর্বাধিক সত্য ও নির্ভরযোগ্য।
- তাওহীদ ও আখিরাতে বিশ্বাসই ঈমানের ভিত্তি ও সফলতার চাবিকাঠি।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের একটি ভুল ধারণা সংশোধন করছেন — তারা **মুনাফিকদের (ভণ্ড ঈমানদারদের)** ব্যাপারে দ্বিধায় পড়েছিল। 🔹 **ঘটনার পটভূমি:** মদীনায় কিছু লোক ছিল যারা বাহ্যিকভাবে মুসলমান বলে দাবি করতো, কিন্তু অন্তরে তারা ইসলামকে ঘৃণা করতো। তাদের কেউ কেউ মুসলিম বাহিনী থেকে ফিরে গিয়ে শত্রুদের সাহায্য করেছিল। তখন মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় — একদল বলে, “তারা তো মুসলমান, তাদের হত্যা করা যাবে না।” অন্যদল বলে, “তারা মুনাফিক, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত।” এই বিভ্রান্তির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা বলেন — “তোমরা কেন মুনাফিকদের বিষয়ে দুই দলে বিভক্ত হচ্ছ?” 🔹 **“وَاللَّهُ أَرْكَسَهُم بِمَا كَسَبُوا”** অর্থাৎ, আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছেন। তারা নিজেরাই কপটতা ও প্রতারণার মাধ্যমে এই পরিণতি ডেকে এনেছে। 🔹 **“أَتُرِيدُونَ أَن تَهْدُوا مَن أَضَلَّ اللَّهُ”** অর্থাৎ, তোমরা কি এমন লোকদের হিদায়াত দিতে চাও, যাদেরকে আল্লাহ তাদের কর্মফলের কারণে পথভ্রষ্ট করেছেন? এটা অসম্ভব — কারণ হিদায়াত আল্লাহর হাতে, কারও প্রচেষ্টায় নয়। 🔹 **“وَمَن يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا”** অর্থাৎ, আল্লাহ যাকে তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোনো পথ নেই — না জ্ঞান, না বুদ্ধি, না যুক্তি কিছুই তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন — মুনাফিকদের কপটতা ও প্রতারণা তাদের নিজেদের আমলের ফল, এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের সামনে কেউ কিছু করতে পারে না।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও মুসলমানদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা মুখে ইসলাম, কিন্তু কাজে ইসলামবিরোধী। তারা ইসলামকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করে, দীনকে বিকৃত করে, অথচ নিজেদেরকে “আলেম” বা “পীর” বলে দাবি করে। আল্লাহ এই আয়াতে শিক্ষা দিয়েছেন — **এদের জন্য মমতা নয়, বরং সতর্কতা প্রয়োজন।** যারা বারবার সত্য অস্বীকার করে, আল্লাহ তাদের হৃদয় বন্ধ করে দেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: (১) কথা বললে মিথ্যা বলে, (২) প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে, (৩) আমানত পেলে বেঈমানি করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “মুনাফিক সে ব্যক্তি, যার অন্তর ঈমান থেকে শূন্য।” (📖 তিরমিযি, হাদিস: ২৬৩১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা ইসলামকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করে, তারা আধুনিক যুগের মুনাফিক।
- মুমিনদের উচিত মুনাফিকদের থেকে দূরে থাকা এবং সত্যের পথে দৃঢ় থাকা।
- যাদের অন্তরে ঈমান নেই, আল্লাহ তাদের হিদায়াত দেন না।
- সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে — এই আয়াত তা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৮):
- মুনাফিকদের বিষয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে সত্যের পক্ষে দৃঢ় থাকতে হবে।
- মানুষ নিজের কৃতকর্মের কারণে পথভ্রষ্ট হয়।
- হিদায়াত আল্লাহর হাতে — কেউ জোর করে কাউকে সোজা পথে আনতে পারে না।
- আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে ফেরানোর কোনো উপায় নেই।
এই আয়াতটি **মুনাফিক ও ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর অন্তরের আসল উদ্দেশ্য** প্রকাশ করে। তারা বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের সাথে ছিল, কিন্তু অন্তরে ইসলামকে ঘৃণা করত। 🔹 **“وَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا”** — অর্থাৎ, তারা চায় তোমরাও যেন তাদের মতোই ঈমান ছেড়ে দাও, যাতে তোমরা ও তারা সমান হয়ে যাও এবং পার্থক্য না থাকে। এটি মুনাফিকদের মনোভাব — তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়ে চায় অন্যকেও সেই পথে টানতে। তারা কখনো চায় না যে মুসলমানরা ঈমান ও সৎ পথে অবিচল থাকুক। 🔹 **“فَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ أَوْلِيَاءَ”** — আল্লাহ মুসলমানদের সতর্ক করে বলেছেন, এমন লোকদের কখনোই বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে (অর্থাৎ, নিজেদের ঈমানকে কার্যত প্রমাণ না করে)। 🔹 **“فَإِن تَوَلَّوْا فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ”** — অর্থাৎ, যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, ইসলামবিরোধী অবস্থানে থাকে, তাহলে তাদেরকে তোমাদের মধ্যে বন্ধু হিসেবে রেখো না, বরং তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করো। কারণ তারা মুসলিম সমাজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। 🔹 **“وَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا”** — অর্থাৎ, তাদের কাউকেই সাহায্যকারী বা রক্ষক মনে করো না। ইসলামবিরোধীদের সাথে আত্মিক, রাজনৈতিক বা বিশ্বাসভিত্তিক বন্ধন হারাম।
তাফসীরের মূল বক্তব্য:
- মুনাফিক ও ইসলামবিরোধীরা সবসময় চায় মুসলমানরা তাদের মতো হয়ে যাক। - মুসলমানদের উচিত তাদের থেকে সতর্ক থাকা এবং ইসলামী ঐক্য বজায় রাখা। - ইসলাম কাউকে অন্ধভাবে হত্যা করার নির্দেশ দেয় না, বরং যারা প্রকাশ্যে শত্রুতার অবস্থান নেয়, তাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করা বৈধ।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগে অনেকেই মুখে ইসলাম, কিন্তু কাজে ইসলামবিরোধী। তারা চায় প্রকৃত মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়ুক, ইসলামী আদর্শ থেকে সরে যাক, এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি বা নাস্তিকতার পথে চলুক। এই আয়াত সেই মানসিকতাকে নিন্দা করে — **“তোমরা কখনো এমন লোকদের অনুসরণ করো না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে বাধা সৃষ্টি করে।”**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।” (📖 আবু দাউদ ৪০৩১; সহিহ হাদিস) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “মুমিন ও মুনাফিকের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো — মুমিন আল্লাহর পথে থাকে, আর মুনাফিক আল্লাহর শত্রুদের সাথে থাকে।” (📖 তাবারানী, আল-কবির)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা ইসলামকে ভালোবাসে বলে, কিন্তু ইসলামবিরোধীদের প্রশংসা করে, তারা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
- মুমিনদের উচিত কেবল তাদেরকেই ভালোবাসা, যারা আল্লাহর পথে চলে।
- ইসলামের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করা বা তাদের পক্ষ নেওয়া ঈমানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- আল্লাহ মুমিনদের শেখান — ঈমান রক্ষা মানে সত্যের সাথে দৃঢ় থাকা, আপস না করা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৯):
- মুনাফিকরা সবসময় চায় মুসলমানরা তাদের মতো পথভ্রষ্ট হোক।
- আল্লাহর পথে হিজরত না করা পর্যন্ত এমন লোকদের বন্ধুত্ব করা হারাম।
- আল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ঈমানের জন্য হুমকি।
- মুমিনের দায়িত্ব — সত্য ও ইসলামী সমাজের নিরাপত্তা রক্ষা করা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে **ন্যায়, নীতি ও শান্তির নীতি** শিক্ষা দিয়েছেন — এমনকি শত্রু জাতির সাথেও, যদি তারা যুদ্ধ না করে, তবে মুসলমানদের তাদের সাথে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। 🔹 **“إِلَّا الَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِيثَاقٌ”** অর্থাৎ, যদি কোনো গোষ্ঠী এমন জাতির সাথে যুক্ত থাকে যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি বা সন্ধি রয়েছে, তবে তারা যুদ্ধের অংশ নয়। ইসলাম চুক্তি ভঙ্গ করে না, বরং বিশ্বস্তভাবে তা রক্ষা করে। 🔹 **“أَوْ جَاءُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ”** অর্থাৎ, এমন কিছু লোক আছে যারা যুদ্ধ চায় না — না মুসলমানদের সাথে, না নিজেদের জাতির সাথে। তাদের হৃদয় সংকুচিত, তারা শান্তি কামনা করে। ইসলাম এমন লোকদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ অনুমোদন করে না। 🔹 আল্লাহ বলেন — “যদি আমি চাইতাম, আমি তাদের তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য করতাম।” কিন্তু আল্লাহ চান না অযথা রক্তপাত হোক; তিনি চান ন্যায়, সংযম ও করুণা প্রতিষ্ঠিত হোক। 🔹 **“فَإِنِ اعْتَزَلُوكُمْ...”** অর্থাৎ, যদি তারা তোমাদের আক্রমণ না করে এবং শান্তি প্রস্তাব দেয়, তবে মুসলমানদের জন্য তাদের ওপর আক্রমণের কোনো বৈধতা নেই। ইসলাম কখনো নিরীহ বা শান্তিপ্রিয় লোকদের ক্ষতি করতে বলে না।
মূল শিক্ষা:
ইসলাম এমন এক ধর্ম যা ন্যায় ও শান্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। যুদ্ধ কেবল আত্মরক্ষা বা অত্যাচার দূর করার জন্য বৈধ। যদি শত্রুরা যুদ্ধ থেকে সরে আসে ও শান্তি চায়, তাহলে যুদ্ধ বন্ধ করা ইসলামী নীতি।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজও ইসলামের নামে অনেকেই অযথা সহিংসতা করে, অথচ কুরআন এখানে স্পষ্ট করে দিচ্ছে — **যে লড়াই চায় না, তাকে হত্যা বা ক্ষতি করা হারাম।** ইসলাম যুদ্ধ নয়, শান্তির ধর্ম; কিন্তু যখন সত্যের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হয়, তখনই প্রতিরোধের অনুমতি দেয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিমের সাথে শান্তিচুক্তি করে এবং তা ভঙ্গ করে, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।” (📖 সহিহ বুখারী ৩১৬৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যুদ্ধের সময়ও নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করো না।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৭৩১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা যুদ্ধ চায় না, তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা করা ইসলামবিরোধী।
- ইসলাম সবসময় চুক্তি, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে।
- শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল উদ্দেশ্য।
- আল্লাহ অন্যায় যুদ্ধ বা রক্তপাতকে পছন্দ করেন না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯০):
- যারা শান্তি চায়, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হারাম।
- ইসলাম চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
- যুদ্ধ কেবল আত্মরক্ষা বা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বৈধ।
- আল্লাহর দীন সর্বদা ন্যায়, ভারসাম্য ও করুণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **দ্বিমুখী চরিত্রের লোকদের** সম্পর্কে সতর্ক করছেন — যারা মুসলমানদের কাছেও নিরাপদ থাকতে চায় আবার কাফিরদের কাছেও নিরাপদ থাকতে চায়। 🔹 **“يُرِيدُونَ أَن يَأْمَنُوكُمْ وَيَأْمَنُوا قَوْمَهُمْ”** — অর্থাৎ, তারা দুই পক্ষের সাথেই ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। মুসলমানদের সামনে নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করে, আবার তাদের নিজ জাতির সামনে মুসলমানদের বিরোধিতা করে। তারা আসলে কারো বন্ধু নয় — বরং স্বার্থপর ও কপট। 🔹 **“كُلَّمَا رُدُّوا إِلَى الْفِتْنَةِ أُرْكِسُوا فِيهَا”** — অর্থাৎ, যখনই কোনো যুদ্ধ বা ফিতনার পরিস্থিতি আসে, তারা দ্বিধাহীনভাবে মন্দের দিকে ফিরে যায়, ইসলামের শত্রুদের পাশে দাঁড়ায়। 🔹 এরপর আল্লাহ বলেন — যদি তারা তোমাদের থেকে দূরে না থাকে, শান্তির বার্তা না দেয়, এবং আক্রমণ থেকে নিজেদের বিরত না রাখে, তবে তোমাদের দায়িত্ব তাদের প্রতিহত করা। এটি যুদ্ধ-নীতির অংশ — ইসলাম কখনো অযথা যুদ্ধ করতে বলে না, কিন্তু যারা প্রতারণা, কপটতা ও ষড়যন্ত্র করে, তাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া বৈধ। 🔹 **“جَعَلْنَا لَكُمْ عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا مُبِينًا”** — অর্থাৎ, আল্লাহ মুমিনদেরকে এমন লোকদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কর্তৃত্ব ও বৈধ অনুমতি দিয়েছেন। ইসলাম প্রতারণা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, কারণ এটি সমাজের ভেতরে ফিতনা ও অবিশ্বাসের বীজ বপন করে।
মূল শিক্ষা:
- ইসলাম দুইমুখী চরিত্র ও সুযোগসন্ধানীদের নিন্দা করে। - মুমিনদের উচিত সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় থাকা, মিথ্যা বা প্রতারণার সাথে আপস না করা। - আল্লাহর পথে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া ঈমানের অংশ।
আধুনিক প্রেক্ষাপট:
আজকের যুগেও আমরা এমন অনেক লোক দেখি যারা ইসলাম ও কুফরের মাঝামাঝি অবস্থান নিতে চায় — তারা মুসলমানদের মন জয় করতে চায়, আবার ইসলামবিরোধীদের সমর্থনও হারাতে চায় না। এরা প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাসঘাতক; ইসলাম এমন চরিত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি দুই মুখে কথা বলে, সে কিয়ামতের দিনে আগুনের জিহ্বা নিয়ে আসবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৭০৩২; সহিহ মুসলিম ২৫২৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “দুই মুখওয়ালা মানুষ হলেন সেই ব্যক্তি, যে একদলকে এক কথা বলে, আরেক দলকে অন্য কথা বলে, সে আল্লাহর কাছে ঘৃণিত।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫২৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা ইসলাম ও কুফর — দুই দিকেই চলতে চায়, তারা বিপজ্জনক।
- দ্বিমুখী চরিত্র সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
- মুমিনদের উচিত স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া — “আমরা আল্লাহর পথে আছি।”
- আল্লাহ এমন লোকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে ন্যায়সঙ্গত কর্তৃত্ব দিয়েছেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯১):
- ইসলাম দুইমুখী বা কপট চরিত্রকে ঘৃণা করে।
- যারা ফিতনা ও প্রতারণায় যুক্ত হয়, তাদের বিরুদ্ধে সতর্কতা জরুরি।
- যুদ্ধ কেবল আত্মরক্ষার জন্য বৈধ — আক্রমণ নয়।
- আল্লাহ মুমিনদেরকে অন্যায় ও কপটতার বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত কর্তৃত্ব দিয়েছেন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষ হত্যার ভয়াবহতা এবং ভুলবশত হত্যার কাফফারা বা ক্ষতিপূরণের বিধান স্পষ্ট করেছেন। ইসলাম মানবজীবনের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্থানে রেখেছে — এমনকি ভুলেও যদি একজন মুমিন মারা যায়, তবুও তার দায়ভার ও শাস্তি নির্ধারিত। 🔹 যদি ভুলবশত হত্যা হয়, তাহলে দুইটি কাজ আবশ্যক: ১️ একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করা (তখনকার প্রেক্ষাপটে দাসমুক্তি মানে মানবমুক্তি)। ২️ নিহত ব্যক্তির পরিবারকে “দিয়া” (রক্তপণ) প্রদান করা। যদি তারা ক্ষমা করে দেয়, তবে সেটা সদকাহ। 🔹 যদি নিহত ব্যক্তি এমন জাতির হয় যারা মুসলমানদের শত্রু, তবে শুধু দাসমুক্তি যথেষ্ট। 🔹 যদি নিহত ব্যক্তি এমন জাতির হয় যাদের সাথে মুসলমানদের চুক্তি রয়েছে, তবে দাসমুক্তি ও দিয়া দুটোই দিতে হবে। 🔹 আর যদি কেউ দাস মুক্ত করার সামর্থ্য না রাখে, তবে তাকে **টানা দুই মাস রোযা রাখতে হবে** — এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি তওবার সুযোগ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “একজন মুমিনকে হত্যা করা আল্লাহর কাছে দুনিয়ার সমস্ত কিছু ধ্বংস করার চেয়েও গুরুতর।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৮৭১; সহিহ মুসলিম ১৬৭৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেছেন— “কিয়ামতের দিন প্রথম বিচার হবে রক্তপাতের ব্যাপারে।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৬৭৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মুসলিম সমাজে হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে — অনেক সময় ধর্ম, দল বা ক্ষোভের কারণে।
- কুরআন স্পষ্ট বলছে: ‘ভুলবশত’ হত্যারও কাফফারা আছে, আর ‘ইচ্ছাকৃত’ হত্যার শাস্তি আরও কঠিন।
- একজন মানুষের প্রাণ অন্য একজনের হাতে নেওয়া মানে গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধে অপরাধ (সূরা মায়িদা ৫:৩২)।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯২):
- মানবজীবনের মূল্য আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ — কোনো মুমিনকে হত্যা করা মহাপাপ।
- ভুলবশত হত্যারও দায় আছে — ইসলাম ন্যায় ও ক্ষতিপূরণে বিশ্বাসী।
- ক্ষমা করা ও সদকা দেওয়া একটি মহৎ গুণ।
- আল্লাহ তওবার সুযোগ দেন — তবে ইচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য কঠিন হিসাব অপেক্ষা করছে।
এই আয়াতটি প্রকাশ করে — ইচ্ছাকৃতভাবে (মতদুষ্টি ছাড়াই) একজন মুমিনকে হত্যা করা কুরআনের চোখে সর্বোচ্চ অপরাধ। ১) এখানে “مُتَعَمِّدًا” শব্দটি ইচ্ছাকৃততা, পরিষ্কার উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা বোঝায় — অনিচ্ছাকৃত বা ভুলবশত হত্যার সঙ্গে এটি আলাদা। (ভুলবশত হত্যার বিধান সূরা নিসা ৪:৯২ এ আছে।) ২) ফলাফল — কোর্ট/দুনিয়াবী বিচার ছাড়াও আখিরাতে আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করেছেন: ক্রোধ, লাঞ্ছা ও চিরস্থায়ী শাস্ত্র। ৩) উদ্দেশ্য স্পষ্ট: মানবজীবন আলোচ্য নয়; জীবন রক্ষা কুরআনের অন্যতম মৌলিক আদেশ। এই আইনের মাধ্যমে সমাজে নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বারবার সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যাখ্যা করেছেন যে মুমিনের রক্ত, মাল ও ইজ্জত অপব্যবহার করা গুরুতর পাপ। তিনি বলেছেন — “মুমিনের রক্ত হালাল করা আল্লাহর কাছে বড় গোনাহ।” (হাদিসগুলো মুমিনের রক্তের মর্যাদা ও রক্তপাতের গুরুত্ব নির্দেশ করে)।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- সংখ্যালঘু-বর্হিভাগ বা রাজনৈতিক উন্মাদনায় সংগঠিত হত্যাকাণ্ড — যে হত্যাগুলো ভাবাবেগ ও ধর্মের নামে হলেও অপরাধী পরিকল্পিত হলে কুরআন এদের কড়াভাবে নিন্দা করে।
- ঘরোয়া/পারিবারিক ঝগড়ায় ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড (যেমন পরিচিত দলে ‘জিহাদি’ কারণে বা দুই পক্ষের শত্রুতায়) — এখানে মুমিন হলে কী বিধান প্রযোজ্য, তা কুরআন স্পষ্টভাবে কঠোর শাস্তির দিকে নির্দেশ করে।
- রাষ্ট্রীয় কর্তৃক অবৈধ হত্যা বা ধর্ষণ-নিষ্পত্তি—নিন্দনীয়; ইসলাম ন্যায়বিচার ও আইনের প্রতি গুরুত্ব দেয়, ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের পক্ষ নেয় না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৩):
- মানবজীবন আল্লাহর কাছে অতীব মহান — ইচ্ছাকৃত মানুষের হত্যা সর্বাপেক্ষা জঘন্য অপরাধ।
- ভুলবশত এবং ইচ্ছাকৃত হত্যার মধ্যে মূলত নীতিগত পার্থক্য আছে; কুরআন উভয় ক্ষেত্রের জন্য বিধান রেখেছে (৪:৯২–৯৩)।
- কোনো বিবাদকেই হত্যার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না; প্রতিটি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসলামের মৌলিক দায়িত্ব।
- যে কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ঈর্ষা-বিদ্বেষকে বিচার এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে — ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়।
এই আয়াতটি ইসলামি যুদ্ধনীতি ও মানবাধিকার সম্পর্কে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি ঘোষণা করে। এটি নাযিল হয়েছিল এক ঘটনার পর — এক মুসলমান ব্যক্তি যুদ্ধের সময় এক মানুষকে হত্যা করেন, যদিও সে “আসসালামু আলাইকুম” বলেছিল। মুসলিম মনে করেছিল সে ভয় পেয়ে বলছে, কিন্তু বাস্তবে সে ঈমান গ্রহণ করেছিল। তখন আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন — “যে তোমাকে সালাম দেয়, তাকে অবিশ্বাসী বলো না।” 🔹 **মূল বার্তা:** ইসলাম কারো ঈমান যাচাই করার দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দেয়নি। শুধু তার সালাম ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণই যথেষ্ট প্রমাণ। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থ বা সন্দেহের কারণে কারো প্রাণ নেওয়া মারাত্মক পাপ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে, তাকে হত্যা কোরো না; যে পর্যন্ত সে আল্লাহর পথে স্থির থাকে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪২৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন — “যে ব্যক্তি একজন মুমিনকে ‘কাফের’ বলে ডাকে, অথচ সে তেমন নয়, সে নিজেই সেই অভিযোগের অংশীদার হয়।” (📖 সহিহ বুখারী ৬১০৪; সহিহ মুসলিম ৬০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ কিছু লোক অন্যদের সহজেই ‘কাফের’, ‘মুনাফিক’, ‘বিদআতী’ বলে ফতোয়া দেয় — এই আয়াত সেই প্রবণতাকে নিন্দা করে।
- ইসলাম সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কারো ঈমান বা জীবন নিয়ে রায় দিতে দেয় না।
- আধুনিক সমাজে কারো ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করা নয়, বরং ন্যায়বিচার ও সহানুভূতি বজায় রাখাই ইসলামী নীতি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৪):
- কাউকে শুধু সন্দেহের কারণে মুমিন হিসেবে অস্বীকার করা হারাম।
- মানবজীবনের মর্যাদা ও সালামের সম্মান রক্ষা ইসলামি নীতির অংশ।
- দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য ধর্মীয় রায় বা বিচার দেওয়া গোনাহ।
- যেকোনো সিদ্ধান্তের আগে যাচাই-বাছাই (تبينوا - “তাবাইয়ানু”) জরুরি — ইসলাম তথ্যভিত্তিক বিচার চায়।
দরকারি ফতোয়া-নোট:
🔹 আধুনিক আইনি প্রেক্ষাপটে: এই আয়াত ইসলামী রাষ্ট্রে যুদ্ধ বা আইন প্রয়োগের সময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মূল নীতি। “সন্দেহ থাকলে শাস্তি বাতিল” — এটি ইসলামী ফিকহের মৌলিক নীতি, যা এই আয়াত থেকে উদ্ভূত। ইসলামী আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে “অবিশ্বাসী” বা “রাষ্ট্রদ্রোহী” ঘোষণা করার একমাত্র ক্ষমতা আদালত বা শরিয়াহ-প্রমাণিত কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে, কোনো ব্যক্তির নয়। 🔹 শরীয়তের ভূমিকা: ইসলাম নিশ্চিত করেছে — - কাউকে ঈমানহীন বলা যাবে না যতক্ষণ সে ঈমানের মৌলিক ঘোষণা অস্বীকার না করে। - যুদ্ধ বা রায়ে বিচার অবশ্যই সাক্ষ্য, প্রমাণ ও ন্যায়ভিত্তিক হতে হবে। - রাষ্ট্র বা ইসলামী প্রশাসনের দায়িত্ব হলো — মিথ্যা অভিযোগ বা অবিচার প্রতিরোধ করা, এমনকি শত্রুর প্রতিও। 🔹 সংক্ষিপ্ত সার: এই আয়াত বর্তমান যুগে একটি অসাধারণ ন্যায়বিচারের ভিত্তি তৈরি করে — “যে ভুল করতে পারে, তাকে যাচাই না করে কখনোই অভিযুক্ত করো না।” এটি ইসলামী আইন, নীতি ও মানবাধিকারের মূল ভিত্তি।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বোঝাচ্ছেন যে, **যারা আল্লাহর পথে চেষ্টা-সংগ্রাম করে (জিহাদ, দাওয়াত, সমাজসেবা, আত্মত্যাগ)** তাদের মর্যাদা নিস্ক্রিয় ও অলস মুসলমানদের চেয়ে উচ্চতর। 🔹 “الْقَاعِدُونَ” অর্থ — যারা ঘরে বসে থাকে, চেষ্টা করে না। 🔹 “غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ” — অর্থাৎ যারা অসুস্থতা বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে অংশ নিতে পারে না, তারা এর ব্যতিক্রম। 🔹 “الْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ” — আল্লাহর পথে যারা অর্থ, পরিশ্রম, জ্ঞান বা আত্মত্যাগ দিয়ে দীন প্রতিষ্ঠা করে, তাদের মর্যাদা আল্লাহ এক ধাপ, বরং বহু ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, ইসলাম শুধু নামমাত্র ঈমান নয় — বরং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা ঈমানের পূর্ণতা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর পথে এক মুহূর্তের সংগ্রাম (জিহাদ) দুনিয়া ও এর সমস্ত কিছুর চেয়ে উত্তম।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৯২; সহিহ মুসলিম ১৮৮০) আরেক হাদিসে বলা হয়েছে— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে বের হতে চায় কিন্তু কোনো অজুহাতবশত বের হতে পারে না, সে যদি আন্তরিক থাকে, তবে সে-ও মুজাহিদের সমান প্রতিদান পাবে।” (📖 সহিহ বুখারী ২৬৩১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ যারা দীন প্রচারে, শিক্ষাদানে, সত্য প্রতিষ্ঠায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখনী বা কর্মে লড়ছে, তারা ‘আল্লাহর পথে সংগ্রামী’।
- যারা অলস, কেবল নামমাত্র ঈমান রেখে কিছুই করে না, তারা ঈমানের পূর্ণতার নিচে অবস্থান করে।
- ইসলামী সমাজের অগ্রগতির জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা, দাওয়াত ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৫):
- আল্লাহর পথে পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ ঈমানের চূড়ান্ত রূপ।
- কাজে না থাকা বা নিষ্ক্রিয় থাকা ঈমানের মর্যাদা হ্রাস করে।
- অক্ষম ব্যক্তি যদি আন্তরিক হয়, আল্লাহ তার জন্য একই প্রতিদান রাখেন।
- প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব — নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ইসলামের কাজে অবদান রাখা।
দরকারি ফতোয়া-নোট (আধুনিক আইনি ও শরীয়ত প্রেক্ষাপট):
🔹 আধুনিক অর্থে “জিহাদ” বা সংগ্রাম: আজকের বিশ্বে “আল্লাহর পথে সংগ্রাম” শুধু যুদ্ধ নয় — বরং এর অন্তর্ভুক্ত হলো দাওয়াত, শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সত্য ও নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সব প্রচেষ্টা যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। 🔹 রাষ্ট্রের ভূমিকা: শরীয়ত অনুযায়ী যুদ্ধ বা সামরিক জিহাদ ঘোষণা করার ক্ষমতা শুধুমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র বা বৈধ কর্তৃপক্ষের হাতে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের ইচ্ছায় “জিহাদ” ঘোষণা করতে পারে না। (📖 ফিকহুল জিহাদ – ইমাম নববী, আল-মাওয়ার্দী, ইবনুল কাসির) 🔹 দাওয়াত ও কলমের জিহাদ: আজকের যুগে কলম, শিক্ষা, প্রযুক্তি, নৈতিকতা ও মানবিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দীন রক্ষার পথ খোলা — এটাই “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ”-এর সর্বাধিক প্রযোজ্য রূপ। 🔹 সংক্ষিপ্ত উপসংহার: এই আয়াত মুসলমানদের শেখায় — ঈমান শুধু হৃদয়ের বিশ্বাস নয়; বরং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা, মানবতার সেবা, ন্যায় ও ত্যাগই প্রকৃত ঈমানের প্রমাণ।
এই আয়াতটি আগের আয়াত (৪:৯৫)-এর পরিপূরক — সেখানে বলা হয়েছিল মুজাহিদদের মর্যাদা বসে থাকা মুসলমানদের চেয়ে বেশি, আর এখানে আল্লাহ তাঁদের পুরস্কার তিনভাবে ঘোষণা করেছেন — 🔹 **১. “দারাজাত” (মর্যাদার স্তরসমূহ):** আল্লাহ মুজাহিদদেরকে জান্নাতে বিশেষ উচ্চ মর্যাদা দান করবেন — তাঁদের জন্য থাকবে সম্মান, নিরাপত্তা ও নিকটতা আল্লাহর সান্নিধ্যে। 🔹 **২. “মাগফিরাহ” (ক্ষমা):** যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তাঁদের গুনাহ মাফ করবেন। 🔹 **৩. “রাহমাহ” (দয়া):** আল্লাহ তাঁদের প্রতি বিশেষ রহমত বর্ষণ করবেন — দুনিয়াতেও বিজয় ও পরকালেও শান্তি। এই আয়াতে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার পরিপূর্ণতা প্রকাশিত হয়েছে, যা সক্রিয়, ত্যাগী ও ন্যায়প্রাণ মুমিনদের জন্য প্রতিশ্রুত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “জান্নাতে এক মুজাহিদের মর্যাদা এমন যে, দুই স্তরের মধ্যে ফারাক পৃথিবী ও আকাশের দূরত্বের মতো।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৯০; সহিহ মুসলিম ১৮৮৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, আল্লাহ তার প্রতি বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন।” (📖 তিরমিযি ১৬৪২)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৬):
- আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও ত্যাগ মানুষকে মর্যাদা ও ক্ষমা এনে দেয়।
- নিস্ক্রিয় থাকা মুমিন ও সক্রিয় মুমিনের মধ্যে আখিরাতে পার্থক্য থাকবে।
- আল্লাহর রহমত ও মাফ সর্বদা তাঁর ত্যাগী বান্দাদের ওপর বর্ষিত হয়।
- আল্লাহর পথে কাজ করলে দুনিয়ায়ও সান্ত্বনা, পরকালে অগণিত পুরস্কার।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন মুসলমানদের সম্বন্ধে সতর্ক করেছেন, যারা অন্যায় পরিবেশে থেকেও ইসলাম রক্ষার জন্য হিজরত করেনি। 🔹 এই আয়াত নাযিল হয় মক্কার কিছু দুর্বল মুসলমানদের প্রসঙ্গে — যারা কুফর ও অত্যাচারের পরিবেশে থেকেও হিজরত করেনি, বরং নিজেদের অজুহাত দেখিয়েছিল — “আমরা দুর্বল, কিছুই করতে পারি না।” কিন্তু আল্লাহর ফেরেশতারা বলবেন — “আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না? তুমি অন্য জায়গায় গিয়ে ঈমানের চর্চা করতে পারতে না?” সুতরাং, **যারা অন্যায়, কুফর বা পাপাচারের পরিবেশে থেকে ইসলামি জীবন ত্যাগ করে, অথচ সরে যাওয়ার সুযোগ ছিল — তারা দোষী।** তাদের অজুহাত কিয়ামতের দিন গ্রহণ করা হবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত — যে স্থানে আল্লাহর বিধান মানা যায় না, সেখানে থেকে হিজরত করো।” (📖 মুসনাদ আহমাদ ১৬৩৪৭; সহিহ হাদিস) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “হিজরত চলতেই থাকবে যতক্ষণ তওবা গ্রহণ করা হবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৯১৩; সহিহ মুসলিম ১৮৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যেখানে ইসলামি জীবনযাপন অসম্ভব, সেখান থেকে নিরাপদ পরিবেশে যাওয়া হিজরতের অন্তর্ভুক্ত।
- যে মুসলমান সমাজের অন্যায়ে অংশ নেয়, অথচ সরে যাওয়ার বা প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে, সে দায়মুক্ত নয়।
- আজকের যুগে “হিজরত” মানে শুধু দেশত্যাগ নয় — বরং অন্যায়, গোনাহ ও অশুদ্ধ পরিবেশ ত্যাগ করাও হিজরত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৭):
- অন্যায় পরিবেশে নিষ্ক্রিয় থাকা ঈমানের জন্য বিপজ্জনক।
- আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত — তাই ঈমান রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা ও পরিবেশ পরিবর্তন করা আবশ্যক।
- অজুহাত নয়, কর্মই মুমিনের পরিচয়।
- হিজরত মানে সত্য ও ঈমান রক্ষার জন্য যে কোনো ত্যাগ — ভৌগলিক বা নৈতিক উভয় দিকেই।
পূর্বের আয়াতে (৪:৯৭) বলা হয়েছিল — যারা অন্যায় সমাজে থেকেও হিজরত করে না, তারা দোষী। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন — **যারা সত্যিই অসহায়, অক্ষম, বা কোনো উপায় খুঁজে পায় না, তাদের জন্য এই দায় প্রযোজ্য নয়।** 🔹 এরা হলেন — - অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম পুরুষ, - নারী যারা হিজরতের শক্তি বা সাহস রাখে না, - শিশু বা যারা পথ চিনতে অক্ষম। আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, কারণ তিনি জানেন তাদের সামর্থ্য সীমিত। ইসলাম কখনও কারো ওপর এমন দায় চাপায় না যা তার ক্ষমতার বাইরে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ বলেন: আমি আমার বান্দাকে তার সামর্থ্যের বাইরে কোনো দায় দিই না।” (📖 সহিহ বুখারী ৭৫০৫; সহিহ মুসলিম ১২৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি কোনো কাজ করতে চায় কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় পারে না, আল্লাহ তার জন্য ততটাই সওয়াব লিখে দেন, যতটা সে ইচ্ছা করেছিল।” (📖 সহিহ বুখারী ১৪৯১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা সত্যিই নিরুপায় — যেমন শারীরিকভাবে অসুস্থ, নিপীড়িত নারী বা দরিদ্র — তাদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় দয়াপূর্ণ।
- আজ অনেক মুসলিম দেশে মানুষ ইসলাম চর্চা করতে পারে না, তবু যারা চায় কিন্তু পরিবেশগত কারণে পারে না, আল্লাহ তাদের অজুহাত গ্রহণ করবেন।
- আল্লাহ কারো হৃদয়ের অবস্থা জানেন — তাই বিচার হবে ইচ্ছা, সামর্থ্য ও প্রচেষ্টার ভিত্তিতে, কেবল ফলাফলের নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৮):
- ইসলাম ন্যায় ও দয়া ভিত্তিক — কারো ওপর অন্যায় দায় চাপায় না।
- যারা সত্যিই অক্ষম, তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ দয়া রয়েছে।
- ইচ্ছা ও নিয়তও আমলের অংশ — সামর্থ্য না থাকলেও আন্তরিক ইচ্ছার পুরস্কার পাওয়া যায়।
- আল্লাহ বান্দার অবস্থা জানেন — তাই তাঁর বিচার সর্বদা ন্যায়নিষ্ঠ ও করুণাময়।
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৪:৯৮) ধারাবাহিকতা — যেখানে বলা হয়েছিল, যারা সত্যিই অক্ষম, অসহায়, বা কোনো উপায় খুঁজে পায় না, তাদের ওপর হিজরত না করার দায় নেই। এখন আল্লাহ বলেন — “তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমা প্রদর্শন করবেন।” 🔹 “عَسَى ٱللَّهُ” — এখানে “আসা” শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বোঝায়, কিন্তু যখন এটি আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ **নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি**। অর্থাৎ, আল্লাহ অবশ্যই তাঁদের ক্ষমা করবেন, কারণ তিনি জানেন তারা সত্যিই অসহায় ও নিরুপায় ছিল। 🔹 “عَفُوّٗا غَفُورٗا” — আল্লাহ একই সঙ্গে ক্ষমাশীল (যিনি অপরাধ মুছে দেন) এবং গাফুর (যিনি পুনরায় তা প্রকাশ হতে দেন না)। এই গুণের মাধ্যমে আল্লাহ দয়া ও ন্যায়ের ভারসাম্য বজায় রাখেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ বান্দার নিয়ত অনুযায়ী বিচার করবেন। যার নিয়ত ভালো কিন্তু সে তা করতে না পারে, আল্লাহ তবুও তার জন্য পূর্ণ সওয়াব লিখে দেন।” (📖 সহিহ বুখারী ১; সহিহ মুসলিম ১৯০৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি কোনো কাজ করার ইচ্ছা রাখে কিন্তু কোনো বাধার কারণে করতে পারে না, আল্লাহ তার জন্য সেই কাজের সওয়াব লিখে দেন।” (📖 মুসনাদ আহমাদ ২৩৪০১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা সত্যিই ইসলাম চর্চা করতে চায় কিন্তু পরিবেশ, দারিদ্র্য, পরিবার বা রাষ্ট্রীয় বাধার কারণে পারে না — তাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত রয়েছে।
- অনেকে ঈমান রক্ষা করতে গিয়ে নানা সামাজিক ও মানসিক বাধার মুখে পড়ে — আল্লাহ তাঁদের নিয়ত দেখেন, ফল নয়।
- আজও পৃথিবীর অনেক স্থানে নিপীড়িত মুসলিমরা আছে — তাদের জন্য এই আয়াত এক বিশাল সান্ত্বনা ও আশার বার্তা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৯):
- আল্লাহ বান্দার দুরবস্থা ও আন্তরিকতা দেখেন, বাহ্যিক ফলাফল নয়।
- যারা আন্তরিকভাবে ঈমান ধরে রাখে কিন্তু কাজ করতে পারে না, তাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া রয়েছে।
- আল্লাহর দয়া সীমাহীন — তিনি অক্ষম ও দুর্বলদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষমাশীল।
- কোনো অবস্থায় আশা হারানো যাবে না — কারণ আল্লাহ চিরক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা হিজরতের মহত্ত্ব ও তাতে আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। 🔹 **“يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ”** — অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের দেশ, ঘর, সম্পদ ও আরাম ত্যাগ করা। এই হিজরত কেবল স্থান পরিবর্তন নয়, বরং ঈমান রক্ষার প্রচেষ্টা ও ত্যাগের প্রতীক। 🔹 **“يَجِدْ فِي الْأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً”** — আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দেন: যে কেউ সত্যের পথে বের হবে, সে পৃথিবীতে নতুন সুযোগ, স্বাধীনতা ও আল্লাহর রহমত পাবে। 🔹 এমনকি যদি কেউ হিজরতের পথে মৃত্যুবরণও করে, তবুও তার পুরস্কার আল্লাহ নিজে নিশ্চিত করে রেখেছেন — কারণ আল্লাহর কাছে নিয়তই আসল।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কর্মের ফল নিয়তের ওপর নির্ভর করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করে, তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই গণ্য হবে।” (📖 সহিহ বুখারী ১; সহিহ মুসলিম ১৯০৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি হিজরত করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে, সে শহীদের মর্যাদা পায়।” (📖 তিরমিযি ১৬৪২; ইবন মাজাহ ২৭৯৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি অন্যায়, গোনাহ ও কুফরী পরিবেশ ত্যাগ করে সৎ জীবনের পথে আসে, সে হিজরতের অংশীদার।
- আজ যারা দীন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও সত্য প্রচারের জন্য দেশ, পেশা বা আরামের জায়গা ত্যাগ করে — তারাও এই আয়াতের আওতাভুক্ত।
- হিজরতের মানে কেবল স্থান নয়, বরং মন, উদ্দেশ্য ও জীবনের দিক পরিবর্তন — আল্লাহর পথে নিবেদিত হওয়া।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০০):
- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ কখনও বৃথা যায় না।
- হিজরতের প্রতিদান এমনকি মৃত্যুর পরও আল্লাহর পক্ষ থেকে নিশ্চিত।
- যে আল্লাহর পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য নতুন পথ ও সুযোগ তৈরি করে দেন।
- আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা সবসময় তাদের জন্য যারা আন্তরিকভাবে তাঁর পথে পদক্ষেপ নেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সফরের সময় নামাজ সংক্ষিপ্ত করার (قصر الصلاة — কাসরুস সালাহ) অনুমতি দিয়েছেন। 🔹 **“وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ”** — অর্থাৎ, যখন তোমরা সফরে বের হও, যাত্রায় থাকো। সফর মানে এমন ভ্রমণ যেখানে নিজের শহর থেকে দূরত্ব উল্লেখযোগ্য (প্রায় ৭৭ কিমি বা তার বেশি)। 🔹 **“فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ”** — মানে এতে কোনো গুনাহ নেই, বরং এটি আল্লাহর দয়া। 🔹 **“أَن تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ”** — নামাজ সংক্ষিপ্ত করা মানে চার রাকাআত নামাজকে দুই রাকাআত আদায় করা। উদাহরণস্বরূপ, যোহর, আসর ও এশা নামাজ সফরে দুই রাকাআত পড়া যায়। 🔹 প্রাথমিকভাবে এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধ বা ভয়ের অবস্থায়, কিন্তু পরে নবী ﷺ সাধারণ সফরেও এটি প্রয়োগ করেছেন। তাই উলামাদের মতে, **কাসর নামাজ সফরের একটি সুন্নাহ মুয়াক্কাদা (নিশ্চিত সুন্নাহ)**।
সম্পর্কিত হাদিস:
হযরত ইবনু উমর (রাঃ) বলেন— “আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ, আবু বকর, উমর ও উসমান (রাঃ)-কে দেখেছি, তারা সফরে চার রাকাআতের নামাজ দুই রাকাআত করে পড়তেন।” (📖 সহিহ বুখারী ১০৯০; সহিহ মুসলিম ৬৮৭) নবী ﷺ বলেছেন— “এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য দান (সুবিধা)। সুতরাং তোমরা আল্লাহর দান গ্রহণ করো।” (📖 সহিহ মুসলিম ৬৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের দিনে সফর বলতে বোঝানো হয়—দীর্ঘ দূরত্বে যাত্রা, যেমন ব্যবসা, দাওয়াত, বা অন্য বৈধ কাজে।
- যে ব্যক্তি সফরে বের হয় (নিজ শহর থেকে ৭৭ কিমি বা তার বেশি দূরে যায়), সে চার রাকাআতের নামাজ দুই রাকাআত আদায় করতে পারবে।
- এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল সহজতা — যা ইসলামকে বাস্তব জীবনোপযোগী করে তোলে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০১):
- ইসলাম কঠোরতা নয় — সহজতা ও বাস্তবতার ধর্ম।
- আল্লাহ তাঁর বান্দার কষ্ট চান না; তাই সফরে নামাজ সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি দিয়েছেন।
- ভয় বা বিপদের পরিস্থিতিতেও নামাজ ত্যাগ নয়, বরং সহজভাবে আদায়ের নির্দেশ।
- নামাজের গুরুত্ব এতটাই যে যুদ্ধ, সফর ও বিপদেও তা অব্যাহত রাখতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **“সালাতুল খাওফ”** (ভয়াবহ অবস্থার নামাজ) এর নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন — অর্থাৎ যুদ্ধ বা বিপদের সময় কিভাবে নামাজ আদায় করতে হবে, যাতে নামাজও কায়েম থাকে এবং নিরাপত্তাও বজায় থাকে। 🔹 নবী ﷺ যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন — তখন দুই দলে ভাগ হয়ে মুসলমানরা নামাজ আদায় করতেন। একদল নামাজে থাকত, অন্যদল পাহারায়। এরপর তারা স্থান পরিবর্তন করত। 🔹 ইসলাম কখনো যুদ্ধ বা ভয়াবহ অবস্থাতেও নামাজ ত্যাগ করার অনুমতি দেয়নি — বরং বাস্তবতার সাথে মিল রেখে **সহজতর উপায়ে নামাজ বজায় রাখতে** নির্দেশ দিয়েছে। 🔹 এটি প্রমাণ করে যে, **নামাজ কখনো বাতিল হয় না** — বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী পদ্ধতি বদলানো যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
হযরত জাবির (রাঃ) বলেন— “রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাতুল খাওফ নামাজে এমনভাবে নামাজ পড়েছেন, একদল তার সাথে নামাজ আদায় করল, আরেকদল পাহারায় থাকল। তারপর তারা স্থান পরিবর্তন করে একইভাবে নামাজ পড়ল।” (📖 সহিহ মুসলিম ৮৪১; সহিহ বুখারী ৯৪৩) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ তোমাদের জন্য নামাজ নির্ধারণ করেছেন — তা যুদ্ধ, ভয় কিংবা শান্তি, সব অবস্থায় কায়েম রাখো।” (📖 সহিহ মুসলিম ৮৩৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যুদ্ধক্ষেত্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বিপদের সময় মুসলমানরা এই নিয়মে নামাজ আদায় করতে পারে।
- আজও অনেক সেনাবাহিনীতে মুসলিম সৈন্যরা “সালাতুল খাওফ” অনুসারে নামাজ পড়ে থাকে।
- এটি ইসলামি শরীয়তের বাস্তবতা ও নমনীয়তার চমৎকার দৃষ্টান্ত।
- দুনিয়ার যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, নামাজ কখনও বাতিল নয় — বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী সহজভাবে পালনযোগ্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০২):
- নামাজ আল্লাহর নির্দেশ — তা কোনো অবস্থায়ও ত্যাগ করা যায় না।
- ইসলাম বাস্তবধর্মী — বিপদের সময়ও সহজতর পদ্ধতিতে আমল করার অনুমতি দেয়।
- নিরাপত্তা ও ইবাদত — উভয়ই ইসলামী জীবনের ভারসাম্যপূর্ণ অংশ।
- মুমিনদের সব অবস্থায় সতর্ক, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আল্লাহনিষ্ঠ থাকা উচিত।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের শিখিয়েছেন — নামাজ শেষ করলেও আল্লাহর স্মরণ যেন কখনও শেষ না হয়। কারণ আল্লাহর জিকির (স্মরণ) হল ঈমানের প্রাণ। 🔹 **“فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمْ”** — অর্থাৎ, দাঁড়িয়ে, বসে, বা শুয়ে — যেভাবেই সম্ভব, আল্লাহকে স্মরণ করো। কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর স্মরণ অব্যাহত রাখতে হবে। 🔹 **“فَإِذَا اطْمَأْنَنتُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ”** — যখন নিরাপদ অবস্থায় ফিরে আসবে, তখন নামাজ আবার সম্পূর্ণভাবে আদায় করো (যেমন স্বাভাবিক অবস্থায় কর)। 🔹 **“إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا”** — অর্থাৎ নামাজ নির্ধারিত সময়ে ফরজ করা হয়েছে; একে অবহেলা করা বা সময় অতিক্রম করা মারাত্মক গুনাহ। এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় — **নামাজ শুধু নির্দিষ্ট সময়েই নয়, বরং জীবনভর স্থায়ী ও অনিবার্য দায়িত্ব।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “সব আমলের মধ্যে নামাজই সর্বাধিক প্রিয় আল্লাহর কাছে, আর সময়মতো নামাজ পড়া সর্বোত্তম কাজ।” (📖 সহিহ বুখারী ৫২৭; সহিহ মুসলিম ৮৫) নবী ﷺ আরও বলেন— “যে ব্যক্তি সময়মতো নামাজ পড়ে, তার জন্য নামাজ কিয়ামতের দিনে আলো, প্রমাণ ও মুক্তি হবে।” (📖 সহিহ ইবনু হিব্বান ১৪৫৩; সহিহ আল-জামি ৩৮৭০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের ব্যস্ত জীবনে অনেকেই নামাজ বিলম্ব করে — এই আয়াত সেই অবহেলাকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে।
- ভ্রমণ, অসুস্থতা বা বিপদের সময় নামাজ সংক্ষিপ্ত করা যায়, কিন্তু বাদ দেওয়া যায় না।
- জিকির (আল্লাহর স্মরণ) নামাজের পরও অব্যাহত রাখা উচিত — যেমন: “আস্তাগফিরুল্লাহ”, “সুবহানাল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “আল্লাহু আকবার”।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৩):
- নামাজ শুধু ফরজ নয় — এটি আল্লাহর সঙ্গে সংযোগের মাধ্যম।
- আল্লাহর স্মরণ যেকোনো অবস্থায় করা যায় — দাঁড়িয়ে, বসে, বা শুয়ে।
- নামাজের সময় নির্দিষ্ট; তাই তা অবহেলা বা বিলম্ব করা গুনাহ।
- যে ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ পড়ে, তার জীবনে বরকত, প্রশান্তি ও সঠিক দিকনির্দেশনা আসে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের ধৈর্য, সাহস ও স্থিতিশীলতার আহ্বান জানিয়েছেন। যুদ্ধ বা সংগ্রামের সময় ক্লান্তি ও কষ্ট স্বাভাবিক, কিন্তু মুমিনদের আশা ও উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি — যা কাফিরদের নেই। 🔹 “وَلَا تَهِنُوا” — মানে দুর্বল হইও না, মনোবল হারিও না। ইসলাম দৃঢ়তা ও সাহসের ধর্ম। 🔹 “إِن تَكُونُوا تَأْلَمُونَ” — অর্থাৎ, যদি তোমরা আহত হও বা কষ্ট পাও, শত্রুরাও তো একইভাবে কষ্ট পায়। পার্থক্য হলো — **মুমিনদের কষ্ট আল্লাহর পথে, আর কাফিরদের কষ্ট দুনিয়ার জন্য।** 🔹 “وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لَا يَرْجُونَ” — তোমরা জান্নাত, ক্ষমা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা করো; আর তারা এই আশার কোনো অংশীদার নয়। এই আয়াত মুসলিম উম্মাহকে শেখায় — কষ্ট ও পরিশ্রমের মাঝেও ধৈর্য হারিও না, কারণ মুমিনের জীবন আল্লাহর পুরস্কারের আশায় ভরপুর।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কষ্ট সহ্য করে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেন।” (📖 সহিহ বুখারী ২৮১০; সহিহ মুসলিম ১৮৭২) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “মুমিনের অবস্থা আশ্চর্যজনক! সে যখন কষ্টে থাকে ধৈর্য ধরে, তখন সেটিও তার জন্য কল্যাণ।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৯৯৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের যুগে মুসলিমরা নানা বিপর্যয়, নির্যাতন ও চাপে রয়েছে। এই আয়াত তাদের বলে — হতাশ হয়ো না, ধৈর্য ধরো।
- কষ্ট ও পরীক্ষা ঈমানের অংশ। মুমিন কষ্ট পায় আল্লাহর জন্য, আর কাফির পায় দুনিয়ার জন্য — পার্থক্য এখানেই।
- ধৈর্য, দাওয়াত ও ইতিবাচক সংগ্রাম — এগুলোই মুমিনের বিজয়ের পথ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৪):
- মুমিন কখনও দুর্বল হয় না — কারণ তার শক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।
- কষ্ট, ত্যাগ ও সংগ্রাম ঈমানের প্রমাণ ও পুরস্কারের মাধ্যম।
- মুমিনের জীবন আশায় ভরপুর — আল্লাহর রহমত ও জান্নাতের আশায়।
- আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সর্বত্র — তাই প্রতিটি কষ্টের মধ্যেও কল্যাণ আছে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন — যেন তিনি বিচার ও রায় প্রদান করেন শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশ (কুরআন ও ওহি) অনুসারে। 🔹 **“إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ”** — আল্লাহর কিতাব (কুরআন) নাজিল হয়েছে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। 🔹 **“لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ”** — এর উদ্দেশ্য হলো, সমাজে ন্যায়বিচার কায়েম করা; পক্ষপাত, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা আবেগ নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশই হবে বিচার মানদণ্ড। 🔹 **“وَلَا تَكُن لِّلْخَائِنِينَ خَصِيمًا”** — অর্থাৎ, তুমি যেন কখনও বিশ্বাসঘাতক বা অন্যায়কারীদের পক্ষে সাফাই না গাও। ইসলামে ন্যায়বিচার এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এমনকি শত্রুর বিরুদ্ধেও অন্যায় করা নিষিদ্ধ। এই আয়াত নাযিল হয়েছিল এক মুনাফিক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, যে চুরি করে দোষ অন্য মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, আর তার পরিবার নবী ﷺ-কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। তখন আল্লাহ সরাসরি এই আয়াত নাজিল করে ন্যায়বিচারের আদেশ দেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো পক্ষে বিতর্ক করে, সে আল্লাহর ক্রোধের অধিকারী হবে যতক্ষণ না সে তা ত্যাগ করে।” (📖 সহিহ বুখারী ২৪৫২; সহিহ মুসলিম ১৭১৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “তুমি যদি কোনো বিষয়ে অন্যায়ভাবে রায় পাওও, তা আগুনের একটি অংশ যা তুমি নিজের জন্য নিচ্ছ।” (📖 সহিহ বুখারী ২৬৮০; সহিহ মুসলিম ১৭১৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের আদালত ও বিচারব্যবস্থায় অনেক সময় সত্য গোপন করা হয়, কিন্তু ইসলামে বিচার কেবল আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে হতে হবে।
- যে নেতা, বিচারক বা ব্যক্তি অন্যায়কারীর পক্ষ নেয়, সে আল্লাহর কাছে কঠোরভাবে দায়ী।
- ইসলাম শুধু ইবাদত নয়, ন্যায়বিচারক সমাজ গঠনেরও শিক্ষা দেয়।
- সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রমাণ ও নিরপেক্ষতা অপরিহার্য — আবেগ নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৫):
- বিচার ও সিদ্ধান্ত সর্বদা আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে হতে হবে।
- পক্ষপাত বা আবেগ নয়, বরং সত্য ও প্রমাণের ওপর রায় দিতে হবে।
- অন্যায়কারীর পক্ষ সমর্থন করা গুনাহ ও বিশ্বাসঘাতকতা।
- কুরআনের উদ্দেশ্য শুধু পাঠ নয়, বরং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসূল ﷺ-কে নির্দেশ দিয়েছেন — **সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে।** 🔹 আগের আয়াতে (৪:১০৫) বলা হয়েছিল, “তুমি অন্যায়কারীদের পক্ষ সমর্থন করো না।” এখন বলা হচ্ছে — **যদি কোনোভাবে ভুল বা অবচেতন ত্রুটি ঘটে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।** 🔹 যদিও নবী ﷺ নির্দোষ, তবু তাঁকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে — যাতে তাঁর উম্মত শিক্ষা নেয়: **যে-ই হোক না কেন, আল্লাহর দরবারে বিনয় ও তাওবা অব্যাহত রাখতে হবে।** 🔹 **“إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا”** — আল্লাহ চিরন্তনভাবে ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি তাওবাকারী বান্দাকে ভালোবাসেন এবং তার দোষ মাফ করেন। এই আয়াত আসলে তাওবার গুরুত্ব ও দয়া-ভিত্তিক ইসলামী নীতির প্রতিফলন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন সত্তরবারেরও বেশি বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৩০৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তার জন্য প্রতিটি দুঃখ থেকে মুক্তির পথ করে দেন এবং এমন জায়গা থেকে রিজিক দেন, যা সে কল্পনাও করেনি।” (📖 ইবনু মাজাহ ৩৮১৯; সহিহ আল-জামি ৬১৬৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের মানুষ ভুল করলে অজুহাত খোঁজে, কিন্তু মুমিন তাওবা করে — এই আয়াত সেটাই শিক্ষা দেয়।
- নবী ﷺ-এর মতো পবিত্র ব্যক্তিকেও ইস্তিগফার করতে বলা হয়েছে, তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য তো আরও জরুরি।
- নিয়মিত ইস্তিগফার করলে মন শান্ত হয়, রিজিক বৃদ্ধি পায়, আর দুঃখ-কষ্ট দূর হয় — এটি কুরআন ও হাদিসে বারবার এসেছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৬):
- তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
- ভুল করলে আত্মগর্ব নয়, বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
- আল্লাহ সর্বদা দয়ালু — যত পাপই হোক, তাওবা করলে তিনি ক্ষমা করেন।
- নিয়মিত ইস্তিগফার আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও জীবনে বরকত আনে।
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৪:১০৫–১০৬) ধারাবাহিকতায় নাযিল হয়েছে। এটি সেই ঘটনাকে ঘিরে, যেখানে এক মুনাফিক ব্যক্তি চুরি করে দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, আর তার পরিবার নবী ﷺ-এর কাছে গিয়ে তার পক্ষ সমর্থন করেছিল। তখন আল্লাহ তাআলা নবীকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেন — **“যারা অন্যায় করে নিজেদের ক্ষতি করে, তাদের পক্ষ সমর্থন করো না।”** 🔹 **“يَخْتَانُونَ أَنفُسَهُمْ”** — অর্থাৎ তারা আসলে অন্যের নয়, নিজেদেরই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। কারণ অন্যায়, প্রতারণা ও মিথ্যা দ্বারা মানুষ নিজের আত্মাকে ধ্বংস করে ফেলে। 🔹 **“إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّانًا أَثِيمًا”** — আল্লাহ এমন কাউকে ভালোবাসেন না, যে বারবার প্রতারণা করে ও পাপাচারে লিপ্ত থাকে। তাই মুমিনদের উচিত সত্যের পক্ষে থাকা, এমনকি নিজের বিরুদ্ধে হলেও। এই আয়াত ইসলামের এক মৌলিক নীতিকে প্রকাশ করে — **ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “সহায়তা করো তোমার ভাইকে — সে যদি অন্যায়কারী হয়, অথবা অন্যায়ের শিকার হয়।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “হে রাসূল, অন্যায়ের শিকার হলে সহায়তা করি বুঝলাম, কিন্তু অন্যায়কারী হলে কীভাবে?” নবী ﷺ বললেন: “তাকে অন্যায় থেকে বিরত রাখাই তার প্রকৃত সহায়তা।” (📖 সহিহ বুখারী ২৪৪৪; সহিহ মুসলিম ২৫৮৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি অন্যায়কে সমর্থন করে, সে কিয়ামতের দিনে আল্লাহর ক্রোধের অধীনে থাকবে।” (📖 মুসনাদ আহমাদ ২৩৪৪২; সহিহ আল-জামি ৬৩২০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই আত্মীয়, বন্ধু বা দলের পক্ষ নিয়ে অন্যায়কে সমর্থন করে — এটি এই আয়াতের বিরোধী কাজ।
- ইসলামে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা পারিবারিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে।
- যে ব্যক্তি বারবার অন্যায়কে ঢাকে, সে নিজের আত্মাকেই ধ্বংস করে।
- আল্লাহর প্রিয় বান্দা সেই, যে সত্যের পক্ষে থাকে — এমনকি নিজের ক্ষতি হলেও।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৭):
- অন্যায়কারীর পক্ষ সমর্থন করা হারাম, এমনকি সে আপনজন হলেও।
- যে ব্যক্তি অন্যায় ঢাকে, সে নিজেরই ক্ষতি করে।
- আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক ও পাপীদের ভালোবাসেন না।
- ন্যায়বিচার ইসলামী সমাজের মূল ভিত্তি — তা ব্যক্তিগত আবেগের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের নিন্দা করেছেন, যারা গোপনে পাপ করে বা অন্যায় পরিকল্পনা সাজায় — মনে করে কেউ দেখছে না, অথচ **আল্লাহ সবই দেখছেন**। 🔹 **“يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ”** — তারা মানুষ থেকে গোপন করে, কারণ মানুষের লজ্জা পায়; সমাজ কী বলবে, সেটাই ভাবে। 🔹 **“وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللَّهِ”** — কিন্তু আল্লাহর সামনে লজ্জাবোধ করে না, যিনি সর্বত্র উপস্থিত ও সর্বজ্ঞ। 🔹 **“إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَى مِنَ الْقَوْلِ”** — অর্থাৎ তারা রাতে বসে ষড়যন্ত্র করে, মিথ্যা সাজায়, অন্যায় পরিকল্পনা তৈরি করে, অথচ জানে না যে আল্লাহ তাদের প্রতিটি কথা শুনছেন ও দেখছেন। 🔹 এই আয়াত **মুনাফিক, প্রতারক ও গোপন ষড়যন্ত্রীদের** বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী। আল্লাহর দৃষ্টিতে কোনো কাজ গোপন নয় — মানুষকে ধোঁকা দেয়া যায়, কিন্তু আল্লাহকে নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তুমি যেখানে থাকো, আল্লাহকে স্মরণ করো (মনে রাখো); পাপের পরপরই ভালো কাজ করো, এবং মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো।” (📖 তিরমিযি ১৯৮৭ — সহিহ) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “একজন মানুষ এমন গোপন কথাও বলে ফেলে, যা আল্লাহর কাছে এত ঘৃণিত যে তা তাকে জাহান্নামে ফেলে দেয়।” (📖 সহিহ বুখারী ৬০৪৭; সহিহ মুসলিম ২৯৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকে পাপ ও প্রতারণা গোপনে করে, মনে করে কেউ জানে না — অথচ আল্লাহ জানেন।
- অনলাইনে, ব্যবসায় বা রাজনীতিতে গোপনে মিথ্যা, প্রতারণা বা ষড়যন্ত্র — সবই এই আয়াতের আওতাভুক্ত।
- মুমিনের চরিত্র হলো: গোপন ও প্রকাশ্যে সমান আল্লাহভীতি থাকা।
- যে ব্যক্তি আল্লাহকে সর্বদা উপস্থিত মনে রাখে, সে কখনো গোপনে অন্যায় করতে পারে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৮):
- আল্লাহর কাছ থেকে কিছুই গোপন নয় — তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা।
- মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাপ করা মুনাফিকির লক্ষণ।
- গোপন চিন্তা, কথা ও কাজ — সবই আল্লাহর নিকট হিসাবযোগ্য।
- মুমিন সর্বাবস্থায় আল্লাহভীত ও স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী।
এই আয়াতটি সেই লোকদের উদ্দেশ্যে নাজিল হয়েছে, যারা চোর বা অন্যায়কারীর পক্ষে নবী ﷺ-এর সামনে মিথ্যা সাক্ষ্য ও যুক্তি দেখাচ্ছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন — **“তোমরা এখন দুনিয়াতে অন্যায়কারীর পক্ষে তর্ক করছো, কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে কে তাদের রক্ষা করবে?”** 🔹 **“هَٰٓأَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ”** — এই বাক্যে তিরস্কারমূলক আহ্বান আছে, যেন বলা হচ্ছে — *তোমরা কি বুঝতে পারো না, কাদের পক্ষ নিচ্ছো?* 🔹 দুনিয়ায় কেউ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু **আল্লাহর আদালতে কোনো সুপারিশ, মিথ্যা বা কৌশল কাজে আসবে না।** 🔹 এই আয়াত স্পষ্ট করে যে — **কোনো অন্যায়কে ঢেকে দেওয়া বা অন্যায়কারীর পক্ষ সমর্থন করা কিয়ামতের দিনে চরম বিপদ ডেকে আনবে।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কিয়ামতের দিনে প্রত্যেকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, তার ও আল্লাহর মাঝে কোনো অনুবাদক থাকবে না; সে তার ডান দিকে তাকাবে — কেবল আমলই দেখবে, বাম দিকে তাকাবে — কেবল গুনাহ, আর সামনে তাকাবে — কেবল জাহান্নাম।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৫১৯; সহিহ মুসলিম ১০১৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “দুনিয়ায় মানুষ তোমার পক্ষে কথা বলতে পারে, কিন্তু আল্লাহর আদালতে কেবল সত্যই কথা বলবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৭১৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেকেই অন্যায়কারীর পক্ষে আইনজীবী, বন্ধু বা রাজনৈতিকভাবে তর্ক করে, কিন্তু কিয়ামতের দিন কোনো পক্ষসমর্থক থাকবে না।
- কোনো আদালত বা সমাজে অন্যায়কে ঢেকে দিলে, আল্লাহর আদালতে তার কোনো অজুহাত গ্রহণ করা হবে না।
- মানুষের সামনে মিথ্যা প্রমাণ দিলে দুনিয়ায় রক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু আখিরাতে সেই মিথ্যা নিজেই সাক্ষ্য হয়ে যাবে তার বিপক্ষে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৯):
- অন্যায়কারীর পক্ষে তর্ক করা নিজের ঈমানের ক্ষতি ডেকে আনে।
- দুনিয়ায় মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায়, কিন্তু আল্লাহর সামনে নয়।
- কিয়ামতের দিনে কোনো সুপারিশ বা ক্ষমতা অন্যায় ঢাকতে পারবে না।
- মুমিন সর্বদা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকবে — এমনকি নিজের বা প্রিয়জনের বিরুদ্ধেও।
এই আয়াত আল্লাহর অসীম দয়া ও ক্ষমার ঘোষণা। মানুষ যতই পাপ করুক না কেন, যদি সে আন্তরিকভাবে তাওবা ও ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তার পাপ ক্ষমা করেন। 🔹 **“وَمَن يَعْمَلْ سُوءًا”** — যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ করে, অর্থাৎ গুনাহ, অন্যায়, ব্যভিচার, মিথ্যা বা অন্য কোনো অপরাধ। 🔹 **“أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ”** — অথবা নিজের প্রতি অন্যায় করে, অর্থাৎ পাপের মাধ্যমে আত্মাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। 🔹 **“ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ”** — কিন্তু যদি সে পরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় — আন্তরিকভাবে তাওবা করে, তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। 🔹 আল্লাহর দরবারে ফিরে আসার দরজা সর্বদা খোলা — যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা পাওয়া সম্ভব। এই আয়াত মুমিনদের আশা ও আত্মবিশ্বাসের উৎস। কারণ আল্লাহ বলেন, **“يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا”** — অর্থাৎ সে আল্লাহকে সর্বদা ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তাওবা করে, আল্লাহ তার গুনাহ এমনভাবে মুছে দেন যেন সে কখনও সেই গুনাহ করেনি।” (📖 ইবনু মাজাহ ৪২৫০; সহিহ আল-জামি ৩০০৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ বলেন: হে আমার বান্দা! তুমি যতবার পাপ করো, কিন্তু আমার কাছে ফিরে আসো, আমি তোমার সব গুনাহ ক্ষমা করব।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৭৫৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ নানা গুনাহ ও অন্যায়ে জড়িত — কিন্তু আল্লাহর দরজা এখনো খোলা আছে, যতক্ষণ প্রাণ আছে।
- যে ব্যক্তি তার ভুল স্বীকার করে ও ক্ষমা চায়, সে আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়ে যায়।
- ইস্তিগফার শুধু পাপ মোচনের উপায় নয়, বরং জীবনের বরকত, রিজিক বৃদ্ধি ও মন শান্তির মাধ্যম।
- গুনাহর পর হতাশা নয়, বরং আল্লাহর দিকে ফিরে আসা — এটাই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১০):
- মানুষ ভুল করবে, কিন্তু আল্লাহর দয়া সব ভুলের চেয়ে বড়।
- তাওবা ও ইস্তিগফার পাপ মোচনের একমাত্র পথ।
- হতাশা ঈমানের বিপরীত — আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হবে না।
- আল্লাহর গুণ দুইটি সর্বদা একত্রে থাকে — গাফূর (ক্ষমাশীল) ও রাহীম (দয়ালু)।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন — **মানুষের প্রতিটি গুনাহ, প্রতিটি অন্যায় কাজ আসলে নিজের আত্মার বিরুদ্ধেই।** 🔹 **“وَمَن يَكْسِبْ إِثْمًا”** — অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ কাজ করে। পাপ কখনো অন্যের ক্ষতি করে না যতটা নিজের আত্মার ক্ষতি করে। 🔹 **“فَإِنَّمَا يَكْسِبُهُ عَلَى نَفْسِهِ”** — সে যা অর্জন করে, তা নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। কারণ গুনাহের ফল আল্লাহর কাছে নথিভুক্ত হয়, আর পরকালে সে নিজেই তার প্রতিফল ভোগ করবে। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا”** — আল্লাহ সবকিছু জানেন — গোপন, প্রকাশ্য, ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য সবই। তিনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য ফল দিবেন। এই আয়াত মানুষকে নিজের কর্মের দায়িত্ব নিতে শেখায় — অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “প্রত্যেক মানুষ তার কাজের ফল পাবে; যে ভালো কাজ করবে সে নিজেই উপকৃত হবে, আর যে মন্দ কাজ করবে, সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৯৮৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “পাপ এমন একটি ছায়ার মতো, যা অবশেষে নিজের কর্তার ওপর ফিরে আসে।” (📖 মুসনাদ আহমাদ ২৩৪২০ — সহিহ)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকে মনে করে গুনাহ শুধু সমাজের ক্ষতি করে, কিন্তু বাস্তবে তা আত্মার ক্ষয় ও আখিরাতের ধ্বংস ডেকে আনে।
- যে ব্যক্তি অন্যায়, প্রতারণা বা মিথ্যা করে, সে নিজের ঈমানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- মানুষের দৃষ্টিতে পাপ গোপন করা যায়, কিন্তু নিজের আত্মা ও আল্লাহর কাছে তা লুকানো অসম্ভব।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১১):
- প্রত্যেক গুনাহর দায় নিজেকেই বহন করতে হবে।
- অন্যের দোষ ঢেকে নিজের আত্মাকে পবিত্র করা যায় না।
- আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা পরিপূর্ণ — তিনি কাউকে অবিচার করবেন না।
- গুনাহ আত্মাকে কলুষিত করে; তাই তাওবা ও আত্মশুদ্ধি অপরিহার্য।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন তাদের সম্পর্কে, যারা নিজেদের অপরাধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। 🔹 **“وَمَن يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا”** — যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ বা পাপ করে। 🔹 **“ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا”** — তারপর তা কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, যেন দোষ সে করেনি, অন্য কেউ করেছে। 🔹 এটি একই সঙ্গে দুইটি বড় গুনাহ — (১) নিজের পাপ করা, এবং (২) নিরপরাধের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা। 🔹 **“فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا”** — অর্থাৎ সে মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট অপরাধের ভার নিজের ঘাড়ে তুলেছে। ইসলাম এই কাজকে **“বুহতান”** (অপবাদ) বলে আখ্যায়িত করেছে, যা কুরআনে অন্যতম ভয়াবহ গুনাহ হিসেবে গণ্য। এই আয়াতটি সেই মুনাফিক ব্যক্তিদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছিল যারা চুরির দোষ অন্য নির্দোষ মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, যাতে নিজেদের রক্ষা করা যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে এমন কথা বলে, যা সে করেনি, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের কাদায় বসাবেন, যতক্ষণ না সে তার বলা মিথ্যা কথার শাস্তি পেয়ে যাবে।” (📖 আবু দাউদ ৩৫৮৩; সহিহ আল-জামি ৬১৯৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি নিরপরাধের ওপর দোষ চাপায়, তার জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি নেই।” (📖 সহিহ বুখারী ২৪৪৭; সহিহ মুসলিম ২৫৮১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই নিজের দোষ লুকাতে অন্যকে অভিযুক্ত করে — এটি এই আয়াতের স্পষ্ট নিষিদ্ধ কাজ।
- সামাজিক মিডিয়া বা আইনি প্রেক্ষাপটে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো আল্লাহর দৃষ্টিতে অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ।
- ইসলাম শেখায় — অন্যায় স্বীকার করা সম্মানের, কিন্তু নিরপরাধের ওপর দোষ চাপানো দ্বিগুণ পাপ।
- আল্লাহর আদালতে প্রতিটি মিথ্যা অপবাদ সাক্ষ্য হয়ে যাবে অপরাধীর বিপক্ষে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১২):
- নিজের অপরাধ অন্যের ওপর চাপানো দ্বিগুণ গুনাহ।
- অপবাদ বা মিথ্যা অভিযোগ আল্লাহর কাছে বড় অপরাধ।
- সত্য কথা বলা ও নিজের ভুল স্বীকার করা ঈমানদারের গুণ।
- নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা বললে পরকালে কঠিন শাস্তি হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী ﷺ-কে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর উপর আল্লাহর বিশাল অনুগ্রহ ও সুরক্ষা। 🔹 **“وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُ”** — অর্থাৎ, যদি আল্লাহর দয়া ও তত্ত্বাবধান তোমার উপর না থাকত, তবে কিছু লোক তোমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইত। 🔹 তারা নবী ﷺ-এর কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিচার প্রভাবিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সত্যের পথে অটল রেখেছিলেন। 🔹 **“وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ”** — তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরই বিপথে নিচ্ছে, কারণ সত্যকে গোপন করা ও অন্যায়ে লিপ্ত থাকা আত্মবিনাশ। 🔹 **“وَأَنزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ”** — আল্লাহ নবী ﷺ-কে কুরআন ও হিকমাহ (সুন্নাহ, প্রজ্ঞা, ওহি) দান করেছেন। এটি নবুয়তের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 🔹 **“وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ”** — নবী ﷺ নিজে শিক্ষা লাভ করেননি, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা ও জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন — যা তাঁকে সর্বোত্তম শিক্ষক ও বিচারক বানিয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমার রব আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আর তিনি আমাকে সর্বোত্তমভাবে শিক্ষা দিয়েছেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: আদব, হাদিস ২৫৯৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আমি কেবল সেই কথাই বলি যা আমার রব আমাকে ওহি করেছেন।” (📖 সহিহ বুখারী ৭২৮০; সহিহ মুসলিম ২৩১০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কিছু মানুষ ইসলাম ও নবীর বাণীকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে চায়, কিন্তু আল্লাহর কিতাব ও হিকমাহ সব বিভ্রান্তিকে প্রতিহত করে।
- আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী ﷺ-কে যেভাবে রক্ষা করেছেন, তেমনি তাঁর কিতাব ও সুন্নাহকেও যুগে যুগে সংরক্ষিত রেখেছেন।
- যে কেউ কুরআন ও সুন্নাহর আলো থেকে দূরে যায়, সে আসলে নিজের আত্মাকেই বিপথে নিয়ে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৩):
- আল্লাহর অনুগ্রহই মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে।
- কুরআন ও সুন্নাহ আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যের চূড়ান্ত উৎস।
- অন্যায় পরিকল্পনা দ্বারা নবী বা ইসলামী সত্যকে কেউ ক্ষতি করতে পারে না।
- আল্লাহর শিক্ষা ও প্রজ্ঞা মানুষের সকল অজ্ঞতা দূর করার উপায়।
- মুমিনের উচিত সবসময় আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করা এবং কৃতজ্ঞ থাকা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা গোপন বৈঠক ও ফিসফিস আলোচনার নৈতিক সীমা নির্ধারণ করেছেন। 🔹 **“لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِن نَّجْوَاهُمْ”** — অধিকাংশ গোপন কথাবার্তায় কোনো ভালো নেই; কারণ মানুষ প্রায়ই ষড়যন্ত্র, গীবত, চক্রান্ত বা অন্যায় উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে। 🔹 **“إِلَّا مَن أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ”** — তবে তিনটি উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠক করা বৈধ ও বরকতময়: ১️ দান-সদকার পরিকল্পনা, ২️ কোনো সৎ কাজের পরামর্শ, ৩️ মানুষের মধ্যে মিল-মীমাংসা বা শান্তি প্রতিষ্ঠা। 🔹 **“وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ”** — যে এসব করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, না যে কোনো স্বার্থ বা প্রভাবের জন্য, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর কাছ থেকে **“আজরান আযীমা”** — মহাপুরস্কার। এই আয়াত ইসলামি সমাজে স্বচ্ছতা, সদ্ভাব ও শান্তি রক্ষার নীতিমালা নির্ধারণ করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি দু’জনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কথা বলে, সে মিথ্যা বললেও তা পাপ নয়।” (📖 সহিহ বুখারী ২৬৯২; সহিহ মুসলিম ২৬০৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি কোনো কল্যাণমূলক কাজের পরামর্শ দেয়, সে নিজে কাজ না করলেও তার সমান সওয়াব পায়।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৮৯৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সভা, মিটিং বা গোপন আলোচনা ব্যক্তিস্বার্থ বা অন্যের ক্ষতি করার জন্য হয় — এটি নিষিদ্ধ ও অপছন্দনীয়।
- কোনো দান, সমাজসেবা বা দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য নীরবে পরিকল্পনা করা — এটি বরং আল্লাহর কাছে প্রিয় কাজ।
- যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে শান্তি আনতে চেষ্টা করে, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
- কোনো কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হলে তবেই তা নেকি হিসেবে গণ্য হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৪):
- অধিকাংশ গোপন আলোচনা পাপ ও কলহ সৃষ্টি করে।
- তিনটি কাজেই গোপনতা অনুমোদিত — দান, সৎ কাজ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা।
- প্রত্যেক কাজের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি।
- শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের অন্যতম মহৎ কাজ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সত্য ঘোষণা করেছেন — **যে ব্যক্তি কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর পথ থেকে সরে যায়, সে চিরতরে ধ্বংসের পথে চলে যায়।** 🔹 **“وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ”** — যে ব্যক্তি নবী ﷺ-এর নির্দেশ ও শিক্ষা অমান্য করে, কিংবা তাঁর সুন্নাহকে উপেক্ষা করে নিজের মত অনুযায়ী চলে। 🔹 **“مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى”** — অথচ তার কাছে সত্য ও হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ, জেনে-বুঝে রাসূলের বিরোধিতা করা। 🔹 **“وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ”** — অর্থাৎ মুমিনদের ঐক্যবদ্ধ পথ (কুরআন ও সুন্নাহ) ত্যাগ করে নিজস্ব চিন্তাধারা, দল বা মতবাদ অনুসরণ করা। 🔹 **“نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى”** — আল্লাহ বলেন, আমরা তাকে সেই পথেই চালিয়ে দিই, যা সে নিজে বেছে নিয়েছে — অর্থাৎ, তার হৃদয় থেকে সত্যের আলো তুলে নেওয়া হয়। 🔹 **“وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ”** — এর পরিণাম হলো জাহান্নাম — কারণ সে জেনে-বুঝে আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ অমান্য করেছে। এই আয়াত ইসলামী শরীয়তে **রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যের বাধ্যতামূলক কর্তব্য** এবং **সুন্নাহকে অস্বীকার করার ভয়াবহ পরিণতি** নির্দেশ করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করল, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।” (📖 সহিহ বুখারী ৫০৬৩; সহিহ মুসলিম ১৪০১) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি আমার আদেশের বিপরীতে কাজ করে, তবে তা বাতিল, গ্রহণযোগ্য নয়।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৭১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই ইসলাম মানে কুরআনকে গ্রহণ করে, কিন্তু রাসূল ﷺ-এর হাদিস ও সুন্নাহকে অস্বীকার করে — এটি সরাসরি এই আয়াতের আওতাভুক্ত।
- যে ব্যক্তি ইসলামী সমাজ ও মুমিনদের পথ ছেড়ে ভিন্ন আদর্শ বা দর্শন অনুসরণ করে, সে পথভ্রষ্ট।
- আল্লাহর সত্য নির্দেশ জেনে-বুঝে অমান্য করা জাহান্নামের কারণ।
- ইসলাম শুধু বিশ্বাস নয়, আনুগত্য — আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ উভয়ের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৫):
- রাসূল ﷺ-এর বিরোধিতা করা মানে আল্লাহর বিরোধিতা করা।
- সুন্নাহ ত্যাগ করা ঈমান ও পথভ্রষ্টতার সীমারেখা।
- মুমিনদের ঐক্যবদ্ধ পথই সঠিক পথ — বিভক্তি বিপথ।
- সত্য জানা সত্ত্বেও অন্য পথ নেওয়া জাহান্নামের কারণ।
- আল্লাহর দয়া হলো — যিনি সত্য চান, তাঁকে হেদায়েত দেন; আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাঁকে তার পছন্দের পথে ছেড়ে দেন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন — **শিরক (আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার করা)** এমন এক অপরাধ, যা তাওবা ব্যতীত কখনো ক্ষমা করা হবে না। 🔹 **“إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ”** — আল্লাহর সঙ্গে কারো অংশীদার করা মানে হলো, তাঁর একত্ব অস্বীকার করা এবং অন্যকে ইলাহ হিসেবে মানা। এটি আল্লাহর সার্বভৌমত্বে চরম অবাধ্যতা। 🔹 **“وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ”** — তবে আল্লাহর দয়া এত বিশাল যে, শিরক ছাড়া অন্য সব পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। কিন্তু শিরক করলে তাওবা না করলে মুক্তি নেই। 🔹 **“وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا”** — অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শিরক করে, সে সত্য ও সঠিক পথ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। কারণ শিরক হচ্ছে ঈমান ও তাওহিদের সম্পূর্ণ বিপরীত। 💠 এই আয়াত ইসলামের মূল ভিত্তি **তাওহিদ** (একত্ববাদ) স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসই ইসলামের প্রাণ, আর শিরক তা ধ্বংস করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করে মারা যায়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে মারা যায়, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ৯৩) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “শিরক এমন সূক্ষ্ম যে, এটি কালো পিঁপড়ার পদধ্বনির মতো নিঃশব্দে ঘটে; তাই তোমরা বলো — ‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাআউযু বিকা আন নুশরিকাকা শাই’আন না’লামুহু ওা নাস্তাগফিরুকা লিমা লা না‘লাম।’” (হে আল্লাহ! আমরা তোমার আশ্রয় চাই এমন শিরক থেকে যা আমরা জানি না, এবং যা জানি না, তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাই।) (📖 আহমাদ ২৭৮৩০ — সহিহ)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ শিরকের বিভিন্ন রূপ ছড়িয়ে আছে — যেমন: কবরে সিজদা করা, মৃত পীর বা অলিয়ার কাছে সাহায্য চাওয়া, আল্লাহর বিকল্প শক্তিতে বিশ্বাস করা।
- শিরক শুধু মূর্তি পূজায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং যখন কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ভয় করে, ভালোবাসে বা তার ওপর নির্ভর করে — সেটিও শিরকের রূপ।
- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য নামাজ, কুরবানি বা মানত করা ঈমান নষ্ট করে দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৬):
- আল্লাহ শিরক ক্ষমা করেন না, যদি তাওবা না করা হয়।
- শিরক তাওহিদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং ঈমান ধ্বংসকারী।
- শিরক ছাড়া অন্য সব পাপ আল্লাহর ইচ্ছায় ক্ষমাযোগ্য।
- তাওহিদ রক্ষা করা মুমিনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
- আল্লাহর দয়া সীমাহীন, কিন্তু তাঁর একত্ব অস্বীকার করলে মুক্তি নেই।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা শিরক ও মূর্তিপূজার অযৌক্তিকতা স্পষ্ট করেছেন। 🔹 **“إِن يَدْعُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا”** — মূর্তিপূজার যুগে আরবরা তাদের উপাস্যদের “নারী” নাম দিয়েছিল, যেমন— লাত, উজ্জা, মানাত ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন, তারা আসলে এমন কিছুকে ডাকে, যারা নিজেরাও কিছু সৃষ্টি করতে পারে না — নামেই দেবতা, বাস্তবে কল্পনা ও মিথ্যা। 🔹 **“وَإِن يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَرِيدًا”** — অর্থাৎ, তারা প্রকৃতপক্ষে আহ্বান করে **বিদ্রোহী শয়তানকে**, যে মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে মিথ্যা উপাসনায় লিপ্ত করে। 💠 অর্থাৎ, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ডাকে, তারা অজান্তেই শয়তানের দাসত্ব করছে। এই আয়াত প্রকাশ করে — শিরক কেবল মূর্তিপূজা নয়, বরং শয়তানের কৌশল ও ফাঁদ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “শয়তান মানুষকে বলে, ‘আমাকে ছাড়া তোমার মুক্তি নেই।’ কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয় নেয়, শয়তানের সে ক্ষমতা তার ওপর চলে না।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৮৬৩) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে মানত করে বা কসম খায়, সে শিরক করেছে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৬৫৩; সহিহ মুসলিম ১৬৪৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ বিভিন্ন নামে মূর্তি, সাধু, পীর বা অলিয়াকে আহ্বান করে — যদিও তারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না।
- আধুনিক যুগে "নারী-রূপ" দেবতার ধারণা এখনো নানা সংস্কৃতিতে প্রচলিত — আল্লাহ বলেন, এগুলো সবই শয়তানের প্রতারণা।
- যে ব্যক্তি দোয়া, সাহায্য বা রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে ফিরে যায়, সে শয়তানের পথে পা রাখে।
- আল্লাহর একত্বই মানুষকে মুক্ত রাখে — শিরক মানুষকে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৭):
- আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আহ্বান করা শিরক ও শয়তানের আনুগত্য।
- মূর্তি ও কল্পিত দেবতা মানুষের মনগড়া প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।
- শয়তানের কৌশল হলো মানুষকে সত্য ইবাদত থেকে বিরত রাখা।
- তাওহিদের প্রতি অটল থাকা শয়তানের দাসত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, যে **ইবলিস (শয়তান)** আল্লাহর অভিশপ্ত সৃষ্টিরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মানবজাতির এক অংশকে বিভ্রান্ত করার প্রতিজ্ঞা করেছে। 🔹 **“لَعَنَهُ اللَّهُ”** — অর্থাৎ, আল্লাহ তাকে রহমত থেকে বহিষ্কার করেছেন। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে স্থায়ী লা‘নত বা অভিশাপ। 🔹 **“وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا”** — শয়তান বলেছে: “আমি তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশকে নিজের দাস বানাবো।” অর্থাৎ, আমি মানুষকে প্রতারণা করে, প্রলোভন দেখিয়ে, আল্লাহর পথে থেকে সরিয়ে নেব। 💠 “নাছীবান মাফরূদা” মানে হলো — শয়তানের জন্য নির্ধারিত সেই দল, যারা তার পথ অনুসরণ করবে। তারা আল্লাহর আনুগত্যের পরিবর্তে শয়তানের দাসত্বে আবদ্ধ হবে। এই আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয় — শয়তানের লক্ষ্য কেবল একটি: **মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে, চিরস্থায়ী ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “শয়তান মানুষের শরীরে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়; তাই তোমরা তাকে আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে প্রতিহত করো।” (📖 সহিহ বুখারী ২০৩৮; সহিহ মুসলিম ২১৭৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “শয়তান মানুষকে বলে — কেউ তোমাকে দেখছে না; কিন্তু যে আল্লাহকে স্মরণ করে, শয়তান তার কাছ থেকে পালিয়ে যায়।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬১২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ শয়তান মানুষকে আল্লাহভীতি থেকে সরিয়ে নানারূপ প্রলোভন, বিনোদন, অহংকার ও পাপাচারে লিপ্ত করছে।
- আধুনিক প্রযুক্তি, বিলাসিতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক জীবনধারা অনেককে শয়তানের “নির্ধারিত অংশে” পরিণত করছে।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির ও ইবাদত ত্যাগ করে, সে ধীরে ধীরে শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
- আল্লাহভীতি, নামাজ ও তাওবার মাধ্যমেই মানুষ শয়তানের দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৮):
- শয়তান আল্লাহর অভিশপ্ত — তার লক্ষ্য মানুষকে বিপথে নেওয়া।
- মানুষের একটি অংশ শয়তানের অনুসারী হবে, যারা তাওহিদ থেকে বিচ্যুত।
- আল্লাহর স্মরণ, নামাজ ও ইস্তেগফারই শয়তান থেকে রক্ষার ঢাল।
- মুমিনের জীবন সংগ্রাম হলো শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াই।
এই আয়াতে শয়তানের প্রতিশ্রুতির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে — কিভাবে সে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে আল্লাহর আদেশ অমান্য করতে বাধ্য করবে। 🔹 **“وَلَأُضِلَّنَّهُمۡ”** — আমি মানুষকে বিভ্রান্ত করব, যেন তারা সত্য থেকে সরে যায়। 🔹 **“وَلَأُمَنِّيَنَّهُمۡ”** — আমি তাদের মিথ্যা আশা দেখাব — দুনিয়ার সুখ, ক্ষমতা ও ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। 🔹 **“وَلَأٓمُرَنَّهُمۡ فَلَيُبَتِّكُنَّ ءَاذَانَ ٱلۡأَنۡعَٰمِ”** — সে তাদের আদেশ দেবে কুসংস্কারমূলক কাজ করতে, যেমন পশু কেটে দেবতার নামে উৎসর্গ করা, কানের ছিদ্র করা ইত্যাদি। 🔹 **“وَلَأٓمُرَنَّهُمۡ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ”** — অর্থাৎ, তারা আল্লাহর সৃষ্টির রূপ ও বিধান বিকৃত করবে — প্রকৃতির পরিবর্তন, যৌন বিকৃতি, মানুষে মানুষে সম্পর্কের নষ্টতা, এমনকি আল্লাহর দীনকে বিকৃত করা। 🔹 **“فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا”** — যে শয়তানের অনুসারী হয়, সে স্পষ্টভাবে ধ্বংসের পথে চলে যায়। 💠 শয়তানের অন্যতম কৌশল হলো — **মিথ্যা আশা ও প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মানুষকে প্রতারিত করা।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে সত্য ছেড়ে শয়তানের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত হয়, সে চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৮৮) আরেক হাদিসে রাসূল ﷺ তাঁর কন্যা ফাতিমাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহা) উদ্দেশ্য করে বলেছেন— “হে মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা! তুমি নিজেকে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাও; আমি আল্লাহর সামনে তোমার কিছুই করতে পারব না।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৫৩; সহিহ মুসলিম ২০৪) ➤ অর্থাৎ, কেউ কাউকে কিয়ামতের দিনে রক্ষা করতে পারবে না — না নবী, না পীর, না নেতা — আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ সুপারিশ করতেও পারবে না।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ কিছু **নেতা** জনগণকে শয়তানের মতো আশ্বাস দেয় — “আমাকে ভোট দাও, আমি দুনিয়া বদলে দেব,” কিন্তু ক্ষমতায় এসে ওয়াদা ভঙ্গ করে, অন্যায়ে লিপ্ত হয়। ➤ এরা শয়তানেরই অনুসারী, যারা মিথ্যা আশা দেখিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়।
- একইভাবে কিছু **ভণ্ড পীর** মানুষকে বলে — “আমাদের দরগায় আসো, আমরা কিয়ামতের দিন তোমাদের বাঁচাবো।” অথচ আল্লাহর রাসূল ﷺ পর্যন্ত তাঁর কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-কে বলেছেন — “নিজেকে বাঁচাও, আমি কিছুই করতে পারব না।”
- এইসব মিথ্যা পীর ও নেতা মানুষকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের দাসত্বে নিয়ে যায় — ঠিক যেমন শয়তান করেছিল।
- আল্লাহর পথে সত্যতা ও আত্মসমর্পণই মানুষকে এই ধরণের প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে পারে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৯):
- শয়তান মানুষকে মিথ্যা আশা দিয়ে প্রতারণা করে।
- যারা আল্লাহ ছেড়ে অন্যের প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখে, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত।
- নেতা ও পীরদের মিথ্যা আশ্বাস শয়তানের কৌশলেরই পুনরাবৃত্তি।
- কিয়ামতের দিনে কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না; একমাত্র মুক্তি আল্লাহর আনুগত্যেই।
- আল্লাহর সৃষ্টি ও বিধান পরিবর্তন করা বড় গুনাহ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রতি শয়তানের **প্রতারণামূলক কৌশল** প্রকাশ করেছেন। 🔹 **“يَعِدُهُمۡ وَيُمَنِّيهِمۡ”** — শয়তান মানুষকে নানা প্রতিশ্রুতি দেয় — “তুমি তাওবা করলে সময় আছে”, “আরও কিছু আনন্দ ভোগ করো”, “এই পাপ ছোট, আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন”, “এই কাজ করলে লাভ হবে, ক্ষতি হবে না” — এভাবে সে ধীরে ধীরে মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরায়। 🔹 **“وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا”** — কিন্তু শয়তানের সব প্রতিশ্রুতি হলো **“গুরূর”** — অর্থাৎ, মিথ্যা প্রতারণা, যা দুনিয়ায় ক্ষণিকের স্বস্তি আর আখিরাতে চিরস্থায়ী ক্ষতি বয়ে আনে। 💠 শয়তান কখনো সরাসরি মানুষকে পাপে আহ্বান করে না; বরং মিষ্টি ভাষায়, যুক্তির মোড়কে, ধীরে ধীরে ঈমান ও নৈতিকতা ক্ষয় করে দেয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “শয়তান মানুষকে বলে — ‘তুমি ধনী হলে বেশি দান করতে পারবে’, কিন্তু সে তোমাকে দান থেকে বিরত রাখে।” (📖 সহিহ মুসলিম ১০৫৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “শয়তান মানুষের হৃদয়ে বলে — ‘তাওবা করো না এখন, সময় আছে।’ অথচ মৃত্যু এসে পড়লে সে বলে — ‘তুমি আর পারবে না।’” (📖 মুসনাদ আহমাদ ২৩৪২০ — সহিহ) এবং নবী ﷺ আরও বলেছেন— “সবচেয়ে বড় প্রতারক সে, যে মানুষকে আল্লাহর রহমতের আশা দেখিয়ে গুনাহে উৎসাহ দেয়।” (📖 বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান ১০৭৬৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ শয়তানের “প্রতিশ্রুতি” আধুনিক রূপে এসেছে — “একটু উপার্জন হারাম হলেও চলবে”, “চোখের আনন্দ পাপ নয়”, “ধর্ম পরে ঠিক করব” — এভাবেই মানুষকে আত্মবিনাশের পথে নিয়ে যায়।
- রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারাও একই শয়তানি কৌশল ব্যবহার করে — ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দেয়, পরে ভঙ্গ করে, মানুষকে মিথ্যা আশায় মত্ত রাখে।
- ভণ্ড পীররাও বলে — “আমাদের অনুসরণ করলে জান্নাত নিশ্চিত,” অথচ তারা নিজেই পাপাচারে লিপ্ত।
- মুমিনের উচিত — প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তব কাজ দেখা, কারণ শয়তানও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু কখনো তা পালন করেনি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২০):
- শয়তানের প্রতিশ্রুতি কেবল প্রতারণা ও ধ্বংস ডেকে আনে।
- মিথ্যা আশা ও বিলম্বের কৌশল তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
- দুনিয়ার নেতা বা ভণ্ড পীর যারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা শয়তানেরই অনুসারী।
- মুমিনের উচিত আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রাখা — কারণ তাঁর কথা সত্য, শয়তানের কথা মিথ্যা।
- আল্লাহর স্মরণ ও কুরআনের অনুসরণই প্রতারণা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৪:১২০) পরিণতি হিসেবে নাযিল হয়েছে — যেখানে শয়তানের অনুসারীদের শেষ পরিণতি ঘোষণা করা হয়েছে। 🔹 **“أُوْلَـٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُ”** — অর্থাৎ, যারা শয়তানের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়েছে, যারা আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে অভিভাবক বানিয়েছে, তাদের শেষ গন্তব্য বা আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম। 🔹 **“وَلَا يَجِدُونَ عَنْهَا مَحِيصًا”** — তারা সেখান থেকে কোনো মুক্তি বা পালানোর উপায় পাবে না। জাহান্নামের আগুন তাদের চারদিক ঘিরে ফেলবে, আর তওবা করার সুযোগ তখন আর থাকবে না। 💠 এই আয়াত জানিয়ে দেয় — **শয়তানের আশ্রয় নেওয়া মানে জাহান্নামের আশ্রয় নেওয়া।** দুনিয়ার মিথ্যা আশ্বাস, প্রতারণা ও বিলাসিতা একদিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু শয়তানের অনুসারীদের শাস্তি হবে চিরস্থায়ী।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “জাহান্নাম সেইসব মানুষে পূর্ণ হবে যারা শয়তানের অনুসরণ করেছে এবং আল্লাহকে ভুলে গেছে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৮৪৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “জাহান্নামের আগুনের শিখা এমন হবে যে, একবার নিঃশ্বাস নিলে পাহাড় গলে যাবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩২৬৫; সহিহ মুসলিম ২৮৪৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ শয়তানের অনুসারী হয়ে দুনিয়ার মোহে অন্ধ — তারা ভাবে, “সব ঠিক আছে,” কিন্তু আখিরাতে তাদের জন্য থাকবে আগুনের শাস্তি।
- রাজনৈতিক নেতা, পীর বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও যদি আল্লাহর বিধান অমান্য করে, তারা এই আয়াতের আওতাভুক্ত।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি অনুগত নয় এবং পাপের জীবনে লিপ্ত, সে ধীরে ধীরে জাহান্নামের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
- আল্লাহর পথে ফিরে আসাই একমাত্র মুক্তির পথ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২১):
- শয়তানের অনুসারীদের পরিণতি হলো জাহান্নাম।
- জাহান্নাম থেকে মুক্তির কোনো উপায় থাকবে না, যদি তওবা ছাড়া মৃত্যু ঘটে।
- দুনিয়ার মিথ্যা প্রতারণা চিরস্থায়ী সফলতা দিতে পারে না।
- আল্লাহর আনুগত্যই চিরস্থায়ী নিরাপত্তার পথ।
- মুমিনের উচিত সর্বদা জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং শয়তানের কৌশল থেকে বাঁচা।
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী দুই আয়াতের (৪:১২০–১২১) বিপরীতে **মুমিনদের পুরস্কার ও পরিণতি** ঘোষণা করছে। 🔹 **“وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ”** — অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে। শুধু বিশ্বাস নয়, কর্মই ঈমানের বাস্তব প্রকাশ। 🔹 **“سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ”** — আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি: “আমি তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাব।” এটি কোনো কল্পনা নয়, বরং আল্লাহর নিশ্চিত ও সত্য ওয়াদা। 🔹 **“تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ”** — জান্নাতের বাগানগুলো হবে এমন, যার তলদেশে প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ নদীসমূহ — দুধ, মধু, পানি ও মদের ঝরনা (সূরা মুহাম্মদ: ১৫)। 🔹 **“خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا”** — জান্নাতের এই সুখ কখনো শেষ হবে না; চিরস্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা ও আনন্দই তাদের পুরস্কার। 🔹 **“وَعْدَ اللَّهِ حَقًّا”** — এটি আল্লাহর এমন একটি প্রতিশ্রুতি, যা কখনো মিথ্যা হবে না। 🔹 **“وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ قِيلًا”** — আল্লাহর চেয়ে সত্যবাদী কেউ নেই। মানুষ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, কিন্তু আল্লাহ কখনো করেন না। 💠 এই আয়াতে জান্নাতের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আল্লাহর সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার গুণ প্রকাশ করা হয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ বলেন: আমার বান্দা যদি আমার পথে এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক বাহু এগিয়ে যাই; আর যদি সে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।” (📖 সহিহ বুখারী ৭৪০৫; সহিহ মুসলিম ২৬৭৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “জান্নাতে এমন কিছু রয়েছে যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি মানুষের মনে কল্পনাও জাগেনি।” (📖 সহিহ বুখারী ৩২৪৪; সহিহ মুসলিম ২৮২৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ আজ দুনিয়ার অল্প সুখের জন্য পরকালের সুখ ভুলে গেছে। অথচ আল্লাহর জান্নাতের প্রতিশ্রুতি চিরস্থায়ী ও সত্য।
- ভণ্ড নেতা বা পীরদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি মিথ্যা, কিন্তু আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনো ব্যর্থ হয় না।
- যে ব্যক্তি ঈমান ও সৎকাজে দৃঢ় থাকে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত পুরস্কার।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসই মুমিনের জীবনের আসল শক্তি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২২):
- ঈমান ও সৎকর্ম জান্নাত লাভের প্রধান শর্ত।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সর্বদা সত্য; তিনি কখনো কথা ভঙ্গ করেন না।
- জান্নাতের জীবন হবে চিরস্থায়ী ও পরিপূর্ণ আনন্দময়।
- দুনিয়ার মিথ্যা সুখ ত্যাগ করে জান্নাতের জন্য পরিশ্রম করাই মুমিনের কাজ।
- আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখলে কখনো হতাশা আসবে না।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে শেখাচ্ছেন — **মুক্তি ও জান্নাত কেবল আশায় নয়, বরং ঈমান ও আমলের ওপর নির্ভর করে।** 🔹 **“لَيْسَ بِأَمَانِيِّكُمْ”** — অর্থাৎ, মুসলমানদের কেবল মুখের দাবি বা আশা দ্বারা মুক্তি হবে না। 🔹 **“وَلَا أَمَانِيِّ أَهْلِ الْكِتَابِ”** — আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান) যেমন বলত, “আমরা আল্লাহর প্রিয়, তাই শাস্তি হবে না,” — তেমন অহংকার মুসলমানদেরও করা উচিত নয়। 🔹 **“مَن يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِهِ”** — যে কেউ অন্যায় বা মন্দ কাজ করে, সে তার ফল ভোগ করবে — এখানে আল্লাহ ন্যায়বিচারের নীতি ঘোষণা করেছেন। 🔹 **“وَلَا يَجِدْ لَهُ مِن دُونِ اللَّهِ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا”** — অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কেউ তাকে রক্ষা বা সাহায্য করতে পারবে না। নবী, পীর বা অন্য কেউ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কাউকে মুক্তি দিতে পারবে না। 💠 এই আয়াত “শুধু নামের মুসলমান” ধারণার বিরোধিতা করে — প্রকৃত ঈমান হলো কর্ম ও আমলে প্রকাশিত ঈমান।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি তার কর্ম দ্বারা পিছিয়ে পড়ে, তার বংশ বা পরিচয় তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৯৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা সম্পদ দেখবেন না; বরং তিনি দেখবেন তোমাদের অন্তর ও কর্ম।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই মনে করে, “আমি মুসলমান, তাই জান্নাতে যাব”— কিন্তু কুরআন বলছে, ঈমান ও সৎকর্ম ছাড়া মুক্তি নেই।
- কেউ কেউ ভাবে, “আমার পীর বা বংশ আমাকে বাঁচাবে,” অথচ আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ ছাড়া কেউ সাহায্য করতে পারবে না।”
- রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা জাতিগত পরিচয় কাউকেই আল্লাহর আদালতে উপকারে আসবে না।
- প্রত্যেক মানুষ তার কাজের জন্যই দায়ী — ভালো করলে জান্নাত, মন্দ করলে শাস্তি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৩):
- জান্নাত কেবল আশার ওপর নয়, আমলের ওপর নির্ভর করে।
- আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ — প্রতিটি কাজের প্রতিফল দিবেন।
- কেউ অন্যের কর্মের বোঝা বহন করতে পারবে না।
- বংশ, পীর বা দলের নামে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
- আল্লাহই একমাত্র অভিভাবক ও সাহায্যকারী।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ন্যায় ও সমতার ঘোষণা দিয়েছেন — **পুরুষ ও নারী উভয়েই সমানভাবে সৎকর্মের প্রতিফল পাবে।** 🔹 **“وَمَن يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ”** — যে কেউ সৎকাজ করবে, যেমন সালাত, রোযা, দান, সত্যবাদিতা, অন্যের কল্যাণ ইত্যাদি। 🔹 **“مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ”** — আল্লাহর কাছে নারী ও পুরুষের পার্থক্য নেই — উভয়েই ঈমান ও আমলের ভিত্তিতে বিচার পাবে। 🔹 **“وَهُوَ مُؤْمِنٌ”** — তবে শর্ত হলো, সে মুমিন হতে হবে — কারণ ঈমান ছাড়া কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। 🔹 **“فَأُوْلَٰئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ”** — যারা ঈমানদার ও সৎকর্মপরায়ণ, আল্লাহ তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। 🔹 **“وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا”** — অর্থাৎ তাদের সামান্যতম অন্যায়ও করা হবে না। "নাকীর" শব্দটি খোলার মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো — অর্থাৎ কোনো অন্যায় বা বঞ্চনা হবে না। 💠 ইসলাম নারীর সম্মান ও অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে, এবং জান্নাত লাভের যোগ্যতা উভয়ের জন্যই সমান।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “নারীরা পুরুষদের সহচর; তোমরা তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, কারণ তারা তোমাদের আমানত।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৪৬৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ কারো আমল নষ্ট করেন না; পুরুষ ও নারী উভয়েরই কাজ অনুযায়ী পুরস্কার দিবেন।” (📖 সহিহ বুখারী ৬০১৫; সহিহ মুসলিম ১০০০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য প্রচলিত, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে তা নেই — ঈমান ও আমলই একমাত্র মানদণ্ড।
- যে নারী ও পুরুষ একসাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে, উভয়েই সমান জান্নাতের অধিকারী।
- দুনিয়ার সমাজে কেউ অবমূল্যায়িত হলেও, আল্লাহর কাছে তাদের কর্মের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।
- সৎকাজ, নম্রতা ও ঈমান — এগুলিই আল্লাহর নিকট মূল্যবান, লিঙ্গ বা জাত নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৪):
- পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই জান্নাতের দরজা সমানভাবে উন্মুক্ত।
- ঈমান ছাড়া কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
- আল্লাহ কারো প্রতি সামান্যতম অবিচার করেন না।
- সমাজে ন্যায়, সমতা ও মর্যাদা রক্ষা ইসলামের অন্যতম নীতি।
- আল্লাহর বিচারে একমাত্র মাপকাঠি হলো ঈমান ও সৎকর্ম।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ব্যাখ্যা করেছেন — প্রকৃত উত্তম ধর্ম বা **সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনপথ** কী এবং কারা তাতে রয়েছে। 🔹 **“أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ”** — অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার পুরো সত্তা আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করেছে; সে নিজ ইচ্ছাকে আল্লাহর আদেশের অধীন করেছে। নামাজ, রোযা, জাকাত, জীবনযাপন — সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। 🔹 **“وَهُوَ مُحْسِنٌ”** — সে কেবল আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণই করেনি, বরং সুন্দর ও সৎকাজও করে যাচ্ছে — অর্থাৎ, তার ঈমান শুধু মুখের নয়, কাজে প্রকাশিত। 🔹 **“وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا”** — সে অনুসরণ করছে ইবরাহীম (আঃ)-এর পথ — যিনি ছিলেন তাওহিদের একনিষ্ঠ দাওয়াতদাতা, শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং শুধু আল্লাহর ইবাদতে নিবেদিত। 🔹 **“وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا”** — আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-কে “খলীল” (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) বানিয়েছেন। এটি এক মহান মর্যাদা — যা বোঝায়, আল্লাহ তাঁর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠতা দান করেছেন। 💠 এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন — **ইবরাহীমের তাওহিদের পথই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ, এবং যে তা অনুসরণ করে, সে-ই সত্য ধর্মে প্রতিষ্ঠিত।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি তোমাদেরকে সেই পবিত্র ধর্মে আহ্বান করছি, যা ছিল আমার পিতা ইবরাহীমের ধর্ম।” (📖 সহিহ মুসলিম ১২১) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর আদেশের অধীন করে দেয়, সে-ই প্রকৃত মুসলমান।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৮৫৮; সহিহ মুসলিম ১৮৪৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ ইসলামকে কেবল নামমাত্র ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে, কিন্তু প্রকৃত ইসলাম হলো আত্মসমর্পণ ও আনুগত্যের ধর্ম।
- ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাওহিদের প্রতীক — তিনি মূর্তিপূজা, কুসংস্কার ও অন্যায় সমাজের বিরুদ্ধে একা লড়েছিলেন।
- বর্তমান যুগে মুসলমানদের উচিত সেই একনিষ্ঠতা ও ত্যাগের মানসিকতা ধারণ করা।
- আল্লাহ যাকে ‘খলীল’ বানিয়েছেন, তার পথই মুক্তির পথ — এ পথেই আছে ঈমান, ন্যায় ও আত্মসমর্পণের সৌন্দর্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৫):
- সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হলো আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ (ইসলাম)।
- ঈমানের পর সৎকাজই প্রকৃত ইসলামকে পরিপূর্ণ করে।
- ইবরাহীম (আঃ)-এর পথই ছিল বিশুদ্ধ তাওহিদের পথ — শিরকমুক্ত ও একনিষ্ঠ।
- আল্লাহর নিকটে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের উপায় হলো খাঁটি ঈমান ও সুন্দর চরিত্র।
- মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত “খলীলুল্লাহ”-এর মতো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর **সর্বময় মালিকানা, জ্ঞান ও ক্ষমতা** ঘোষণা করেছেন। 🔹 **“وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ”** — অর্থাৎ, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবকিছুই আল্লাহর মালিকানাধীন। মানুষ, প্রাণী, বস্তু, রাষ্ট্র, ক্ষমতা—সবই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। কেউ স্বাধীন মালিক নয়, বরং সবাই আল্লাহর সৃষ্টির অংশ। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطًا”** — আল্লাহ সবকিছুকে জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে পরিবেষ্টন করেছেন। তিনি প্রতিটি ঘটনার খবর রাখেন, প্রতিটি গোপন বিষয় জানেন, এমনকি মানুষের অন্তরের চিন্তাও তাঁর অজানা নয়। 💠 এই আয়াত মুমিনকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর মালিকানার বাইরে কেউ কিছুই নয় — তাই তাঁর প্রতি বিনয়, তাওয়াক্কুল ও আনুগত্যই প্রকৃত জ্ঞানীর কাজ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহর হাতেই সবকিছুর রাজত্ব; তিনি যাকে চান সম্মানিত করেন, যাকে চান অপমানিত করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৫৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যদি সমস্ত সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমাকে উপকার করতে চায়, তারা কেবল সেইটুকুই পারবে যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন।” (📖 জামি আত-তিরমিযী ২৫১৬ — সহিহ)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ আজ প্রযুক্তি, রাজনীতি ও অর্থনীতির শক্তিতে গর্ব করে, কিন্তু সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন — এক সেকেন্ডে তিনি চাইলেই সব কিছু উল্টে দিতে পারেন।
- প্রকৃতি, মহাবিশ্ব ও মানুষের জীবনযাত্রা— সব আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
- আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে কিছুই ঘটে না — তাই কোনো ঘটনা “দুর্ভাগ্য” নয়, বরং আল্লাহর হিকমত।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর মালিকানা স্বীকার করে, তার অন্তরে অহংকার থাকে না; বরং শান্তি ও তাওয়াক্কুল জন্ম নেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৬):
- আসমান ও জমিনের সবকিছুর মালিক আল্লাহ একমাত্র।
- আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বব্যাপী — কিছুই তাঁর দৃষ্টির বাইরে নয়।
- মানুষের মালিকানা ও কর্তৃত্ব অস্থায়ী ও সীমিত।
- মুমিনের কর্তব্য হলো তাওয়াক্কুল, বিনয় ও আল্লাহর আনুগত্য।
- সকল ঘটনার পেছনে আল্লাহর হিকমত (জ্ঞানপূর্ণ উদ্দেশ্য) রয়েছে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী ﷺ-এর মাধ্যমে মানুষকে নারীদের ও এতিমদের অধিকার সম্পর্কে **স্পষ্ট নির্দেশ ও ন্যায়বিচারের নীতি** শিখিয়েছেন। 🔹 **“وَيَسْتَفْتُونَكَ فِي النِّسَاءِ”** — সাহাবিরা নবী ﷺ-এর কাছে নারীদের হক সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। অনেক সময় পুরুষেরা এতিম নারীদের হক (মেহর, উত্তরাধিকার) না দিয়ে তাদেরকে বিয়ে করত, অথবা তাদের সম্পদের প্রতি লোভ করত। 🔹 **“قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِيهِنَّ”** — আল্লাহ নিজেই তাদের বিষয়ে ফতোয়া বা নির্দেশ দিচ্ছেন। 🔹 **“فِي يَتَامَى النِّسَاءِ”** — অর্থাৎ, এতিম নারীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে, তাদের সম্পদ, মেহর ও মর্যাদা কেড়ে নেওয়া যাবে না। 🔹 **“وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الْوِلْدَانِ”** — দুর্বল শিশুদের প্রতিও দয়া ও ন্যায়বিচার করতে হবে। সমাজে যারা নিজের অধিকার রক্ষা করতে অক্ষম, তাদের জন্যই আল্লাহ বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। 🔹 **“وَأَنْ تَقُومُوا لِلْيَتَامَى بِالْقِسْطِ”** — অর্থাৎ, এতিমদের সাথে আচরণে ন্যায়বিচার করা বাধ্যতামূলক। তাদের সম্পদ ও অধিকার রক্ষায় অবহেলা করা বড় গুনাহ। 💠 সারসংক্ষেপ: এই আয়াত নারী, এতিম ও শিশুদের **সামাজিক ন্যায়বিচার** প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো এতিমের যত্ন নেবে, আমি ও সে জান্নাতে এই দুই আঙুলের মতো পাশাপাশি থাকব।” (📖 সহিহ বুখারী ৬০০৫; সহিহ মুসলিম ২৯৮৩) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেছেন— “সবচেয়ে উত্তম ঘর হলো সে ঘর, যেখানে এতিমের প্রতি ভালো আচরণ করা হয়।” (📖 ইবনু মাজাহ ৩৬৭৯ — সহিহ)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও সমাজে নারীদের অধিকার অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত — যেমন উত্তরাধিকার, শিক্ষার সুযোগ বা সম্মান। এই আয়াত তাদের প্রতি ন্যায়বিচারের আহ্বান জানায়।
- এতিম ও অসহায় শিশুদের সম্পদ বা অধিকার দখল করা ইসলামি শরিয়তে গুরুতর অপরাধ।
- অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি এতিমদের জন্য কাজ করছে — এটি কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নেরই অংশ।
- একজন প্রকৃত মুসলিম সমাজে দুর্বল ও নিরুপায়দের পাশে দাঁড়ায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৭):
- আল্লাহ নিজেই নারীদের ও এতিমদের অধিকার সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন।
- নারীর প্রতি অন্যায় ও এতিমদের সম্পদ দখল ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
- দুর্বল শিশুদের সুরক্ষা ও কল্যাণ ইসলামের অন্যতম সামাজিক দায়িত্ব।
- ন্যায়বিচার ও সৎকাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়।
- আল্লাহ মানুষের প্রতিটি ভালো কাজ অবগত আছেন এবং তা পুরস্কৃত করবেন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা দাম্পত্য জীবনের একটি বাস্তব সমস্যার সমাধান দিচ্ছেন — **যখন স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি বিমুখ হয়ে যায় বা অবহেলা দেখায়।** 🔹 **“إِنِ ٱمْرَأَةٌ خَافَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا”** — যদি কোনো স্ত্রী আশঙ্কা করে যে স্বামী তার প্রতি অনীহা প্রকাশ করছে, সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, বা অন্য নারীর প্রতি আগ্রহী হচ্ছে — তবে সে স্বামীকে হারানোর ভয়ে কিছু অধিকার (যেমন মেহর বা ভরণপোষণ) ত্যাগ করতে রাজি হতে পারে। 🔹 **“فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا”** — উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বা আপস করলে তাতে কোনো দোষ নেই। এখানে ইসলাম **বিচ্ছেদ নয়, বরং মীমাংসা ও সম্পর্ক রক্ষার পথ** দেখিয়েছে। 🔹 **“وَالصُّلْحُ خَيْرٌ”** — আপস-মীমাংসা সর্বদা কল্যাণকর; কারণ এর মাধ্যমে পরিবার ভাঙন রোধ হয়, সন্তানরা নিরাপদ থাকে। 🔹 **“وَأُحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ”** — মানুষের মনে স্বভাবতই স্বার্থপরতা ও কৃপণতা আছে। কেউই নিজের অধিকার ত্যাগ করতে চায় না — কিন্তু পারিবারিক শান্তির জন্য তা কখনো প্রয়োজনীয় হয়। 🔹 **“وَإِن تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا”** — অর্থাৎ, যদি তোমরা ভালো আচরণ করো ও আল্লাহভীতি অবলম্বন করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের কাজ সম্পর্কে অবগত আছেন এবং পুরস্কৃত করবেন। 💠 ইসলাম পরিবার ভাঙার আগে সর্বদা **সমঝোতা ও ক্ষমার পথ** শেখায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুমিনদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।” (📖 সহিহ তিরমিযী ৩৮৯৫; সহিহ মুসলিম ১৪৬৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো, কারণ তারা তোমাদের আমানত।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৪৬৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙে অহংকার, ভুল বোঝাবুঝি ও স্বার্থপরতার কারণে। ইসলাম এই আয়াতে বলছে — “আপস করো, কারণ আপসই উত্তম।”
- কোনো নারী যদি স্বামীর বিমুখতা দেখে কিছু অধিকার ত্যাগ করে সম্পর্ক বাঁচাতে চায়, ইসলাম তা অনুমোদন করেছে।
- একইভাবে স্বামীরও উচিত স্ত্রীকে অবহেলা না করা, বরং আল্লাহভীতির সাথে ন্যায়বিচার করা।
- আজকের যুগে এই আয়াত পারিবারিক সমস্যার অন্যতম সমাধান নির্দেশ করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৮):
- দাম্পত্য জীবনে আপস-মীমাংসা ও ন্যায়বিচার সর্বোত্তম পথ।
- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহনশীলতার উপর ভিত্তি করে।
- অহংকার বা অধিকার-দাবির কারণে সম্পর্ক ভাঙা উচিত নয়।
- আল্লাহ ন্যায়, ধৈর্য ও সৎ আচরণকারীদের ভালোবাসেন।
- যে পরিবারে আল্লাহভীতি থাকে, সেখানে শান্তি ও সুখ অবশ্যম্ভাবী।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **বহুবিবাহের ন্যায়বিচার ও মানবিক সীমাবদ্ধতা** সম্পর্কে বাস্তবসম্মত নির্দেশ দিয়েছেন। 🔹 **“وَلَن تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ”** — অর্থাৎ, তোমরা যতই চাও, স্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ সমান ভালোবাসা দেখাতে পারবে না। আল্লাহ জানেন, **মানুষের হৃদয় ভালোবাসা ও অনুভূতির দিক থেকে সীমাবদ্ধ।** 🔹 **“فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ”** — অর্থাৎ, এক স্ত্রীর দিকে এমনভাবে ঝুঁকো না যাতে অন্য স্ত্রী পুরোপুরি অবহেলিত ও কষ্টে থাকে। 🔹 **“فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ”** — অর্থাৎ, তাকে এমন অবস্থায় রেখো না যেখানে সে না স্ত্রীসুলভ মর্যাদা পায়, না স্বাধীনতা পায় — যেন ঝুলন্ত জীবনের মতো কষ্ট পায়। 🔹 **“وَإِنْ تُصْلِحُوا وَتَتَّقُوا”** — অর্থাৎ, যদি তোমরা নিজের আচরণ সংশোধন করো ও আল্লাহভীতি রাখো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। 💠 ইসলাম বাস্তবতা বিবেচনা করে বলেছে — **মানুষ অনুভূতিতে সমান হতে পারে না, কিন্তু আচরণে ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি দুই স্ত্রী রাখে এবং একটির দিকে ঝুঁকে যায়, কিয়ামতের দিন সে একপাশ কাত হয়ে উঠবে।” (📖 সহিহ আবু দাউদ ২১৩৩; সহিহ তিরমিযী ১১৪১) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেছেন— “নারীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করো, কারণ এটি আল্লাহর সামনে তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দিবে।” (📖 মুসনাদ আহমাদ ২৪৫২৪ — সহিহ)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রথম স্ত্রীকে অবহেলা করে, অথচ কুরআন তা কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
- অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করে—“আমি সমানভাবে ভালোবাসতে পারি”— কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব; তাই ন্যায়বিচার ও দায়িত্বই আসল।
- যে ব্যক্তি আল্লাহভীতির সাথে ন্যায় রাখে, তার পরিবারে শান্তি ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- এই আয়াত বহুবিবাহে ভারসাম্য, সংযম ও আত্মসমালোচনার শিক্ষা দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২৯):
- মানুষ অনুভূতিতে সম্পূর্ণ সমান হতে পারে না, তবে আচরণে হতে হবে ন্যায়পরায়ণ।
- স্ত্রীর প্রতি অবহেলা ও অবিচার আল্লাহর কাছে গুরুতর অপরাধ।
- দাম্পত্য জীবনে ন্যায়বিচার ও আল্লাহভীতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
- আল্লাহভীতিসম্পন্ন ব্যক্তিই পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য রাখতে পারে।
- আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ ও ক্ষমাশীল — তওবা ও সংশোধনের সুযোগ সর্বদা উন্মুক্ত।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরও **আশা, সান্ত্বনা ও আল্লাহর করুণার বার্তা** দিয়েছেন। 🔹 **“وَإِن يَتَفَرَّقَا”** — যদি স্বামী ও স্ত্রী সকল প্রচেষ্টার পরেও মিলেমিশে চলতে না পারে, তবে আলাদা হওয়া (তালাক) তাদের জন্য অনুমোদিত। 🔹 **“يُغْنِ اللَّهُ كُلًّا مِن سَعَتِهِ”** — আল্লাহ উভয়কেই তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ থেকে অভাবমুক্ত করবেন। অর্থাৎ, তালাকের পর জীবন থেমে যায় না; আল্লাহ বিকল্প রিজিক, সান্ত্বনা ও নতুন পথ খুলে দেন। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ وَاسِعًا حَكِيمًا”** — আল্লাহর অনুগ্রহ বিস্তৃত, তাঁর সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ। তিনি জানেন কখন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কল্যাণকর, আর কখন আলাদা হওয়া ভালো। 💠 ইসলাম বিবাহকে স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ রাখতে উৎসাহিত করে, কিন্তু যখন সম্পর্ক কষ্ট, অবিচার বা ক্ষতির কারণ হয় — তখন **তালাক করাও করুণার অংশ**।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “হালাল বিষয়গুলোর মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় হলো তালাক।” (📖 আবু দাউদ ২১৭৭; সহিহ ইবনে মাজাহ ২০১৮) আবার তিনি বলেছেন— “যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরে ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তার জন্য উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা করে দেন।” (📖 সহিহ বুখারী ১৪৬৯; সহিহ মুসলিম ১০৫৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক দাম্পত্য সম্পর্ক শুধু নামমাত্র টিকে থাকে, কিন্তু ভালোবাসা ও ন্যায়বিচার হারিয়ে যায়। এই আয়াত জানাচ্ছে — **অন্যায়ে টিকে থাকার চেয়ে আলাদা হওয়া উত্তম।**
- তালাক কোনো লজ্জার বিষয় নয়; বরং এটি আল্লাহর করুণা — নতুনভাবে শুরু করার সুযোগ।
- অনেক নারী তালাকের পর নিজের জীবন ও ঈমান রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন; এটি আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতিফল।
- আল্লাহর রিজিক ও অনুগ্রহ কখনো কারো উপর নির্ভর করে না; বরং প্রত্যেকের জন্যই আল্লাহর নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩০):
- যদি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব না হয়, তবে সম্মানজনক বিচ্ছেদ অনুমোদিত।
- তালাকের পর হতাশ হওয়া উচিত নয় — আল্লাহ উভয়ের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখেন।
- আল্লাহর অনুগ্রহ সীমাহীন; তাঁর প্রজ্ঞা প্রতিটি সিদ্ধান্তে নিহিত।
- ইসলাম মানবিক বাস্তবতাকে বিবেচনা করে সম্পর্কের সমাধান দিয়েছে।
- মুমিনের কর্তব্য হলো ধৈর্য, আল্লাহভীতি ও তাঁর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল রাখা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করেছেন — **(১) মালিকানা, (২) তাকওয়া, (৩) মানুষের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব।** 🔹 **“وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ”** — আসমান ও জমিনের সবকিছু আল্লাহর। তিনি একক মালিক ও স্রষ্টা — মানুষ কেবল অস্থায়ী প্রতিনিধি (খলিফা)। 🔹 **“وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللَّهَ”** — আল্লাহ আগের নবীদের উম্মত এবং আমাদেরকেও একই উপদেশ দিয়েছেন: **“আল্লাহভীতি অবলম্বন করো”** — অর্থাৎ তাকওয়া রাখো, পাপ থেকে বেঁচে চলো। তাকওয়াই সব ধর্মীয় বিধানের কেন্দ্রবিন্দু। 🔹 **“وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ”** — তোমরা বিশ্বাস করো বা না করো, তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি নেই। কারণ আসমান ও জমিনের সবকিছু তাঁরই অধীনে। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدًا”** — আল্লাহ সম্পূর্ণ অভাবমুক্ত (غنيّ), এবং তিনি প্রশংসার যোগ্য (حميد) — অর্থাৎ, তিনি কারো উপাসনা বা আনুগত্যের মুখাপেক্ষী নন; বরং মানুষই তাঁর প্রয়োজন অনুভব করে। 💠 সারসংক্ষেপে — **আল্লাহ আমাদের তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ তাকওয়া ছাড়া মানবজীবনের ভারসাম্য থাকে না।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যেখানেই থাকো, আল্লাহকে ভয় করো (তাকওয়া অবলম্বন করো)। খারাপ কাজ করলে তার পর ভালো কাজ করো, যা তা মুছে দেবে। আর মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করো।” (📖 জামি আত-তিরমিযী ১৯৮৭ — সহিহ) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ প্রযুক্তি, অর্থ ও ক্ষমতার গর্বে মত্ত — অথচ ভুলে গেছে, সবই আল্লাহর মালিকানাধীন।
- তাকওয়া ছাড়া উন্নত সমাজ গঠন সম্ভব নয় — কারণ নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ তাকওয়া থেকেই জন্মায়।
- মানুষ যদি কৃতজ্ঞ না হয়, তাতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই; বরং সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- আল্লাহর প্রশংসা ও মহানতা মানুষের বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে না — কারণ তিনি নিজেই মহিমান্বিত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩১):
- আল্লাহই আসমান ও জমিনের একমাত্র মালিক।
- তাকওয়া সকল নবীর উম্মতের প্রতি সর্বজনীন নির্দেশ।
- মানুষের অবিশ্বাস আল্লাহর কোনো ক্ষতি করে না।
- আল্লাহ অভাবমুক্ত ও প্রশংসার যোগ্য।
- আল্লাহভীতি (তাকওয়া) ছাড়া ঈমান ও ন্যায়ের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পুনরায় তাঁর **সর্বময় মালিকানা, তত্ত্বাবধান ও সার্বভৌমত্ব** ঘোষণা করেছেন, যাতে মানুষ বুঝে যে তাদের সবকিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। 🔹 **“وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ”** — আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু, জীবিত ও জড় সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি ও মালিকানাধীন। কোনো কিছুর মালিকানা, ক্ষমতা বা অস্তিত্ব আল্লাহর অনুমতি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। 🔹 **“وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا”** — অর্থাৎ, আল্লাহই সকলের রক্ষাকারী, অভিভাবক, সহায় ও প্রতিনিধি। মানুষ যখন আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তখন সে নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিরতা পায়। 💠 এই আয়াত আমাদের শেখায় — **আল্লাহই প্রকৃত অভিভাবক ও ভরসার স্থল।** মানুষ, রাষ্ট্র, সম্পদ বা ক্ষমতা — কিছুই স্থায়ী নয়; কেবল আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা (তাওয়াক্কুল) স্থায়ী নিরাপত্তা দেয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তার জন্যই যথেষ্ট হবেন।” (📖 সুনান আত-তিরমিযী ২৫১৬ — সহিহ) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথাযথ ভরসা রাখতে, তবে তিনি তোমাদের রিজিক দিতেন যেমন তিনি পাখিদের দেন — তারা সকালে ক্ষুধার্ত বের হয়, সন্ধ্যায় পরিতৃপ্ত ফিরে আসে।” (📖 সহিহ তিরমিযী ২৩৪৪; সহিহ ইবনে মাজাহ ৪১৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ রাজনীতি, অর্থ ও প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, কিন্তু যখন বিপদ আসে, তখন বুঝতে পারে — প্রকৃত অভিভাবক একমাত্র আল্লাহ।
- মানুষ অনেক সময় অন্যের উপর ভরসা করে প্রতারিত হয়, অথচ আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কখনো ব্যর্থ হয় না।
- একজন মুমিন যখন বলে “হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নি‘মাল ওাকীল”, তখন সে তার সকল দুশ্চিন্তা আল্লাহর হাতে তুলে দেয়।
- এই আয়াত মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় — পৃথিবীর সবকিছুই অস্থায়ী, কেবল আল্লাহই স্থায়ী ও অভিভাবক।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩২):
- আসমান ও জমিনের সবকিছুই আল্লাহর মালিকানাধীন।
- আল্লাহই সকল বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক ও প্রতিনিধি।
- মুমিনের সর্বোচ্চ ভরসা ও নিরাপত্তার উৎস হলো আল্লাহ।
- মানুষের উপর নয়, বরং আল্লাহর উপর নির্ভর করাই ঈমানের চূড়ান্ত রূপ।
- তাওয়াক্কুল ও কৃতজ্ঞতা—এই দুই গুণে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে **তাঁর ক্ষমতা, সার্বভৌমত্ব ও বিকল্প ব্যবস্থার** কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। 🔹 **“إِن يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ”** — অর্থাৎ, যদি আল্লাহ চান, তিনি মুহূর্তেই তোমাদের ধ্বংস করে দিতে পারেন। মানুষ যতই শক্তিশালী বা প্রভাবশালী হোক, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সে এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। 🔹 **“وَيَأْتِ بِآخَرِينَ”** — আল্লাহ তোমাদের স্থলে এমন এক জাতি আনতে পারেন, যারা আল্লাহভীরু, ন্যায়পরায়ণ ও কৃতজ্ঞ। ইতিহাসে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে, আর তাদের স্থানে নতুন জাতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে — এটি আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَٰلِكَ قَدِيرًا”** — আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। তাঁর আদেশের জন্য কোনো কারণ বা অনুমতির প্রয়োজন নেই। 💠 সারসংক্ষেপে — **এই আয়াত মানুষকে গর্ব, অবাধ্যতা ও নির্ভরতার মিথ্যা অনুভূতি থেকে দূরে রাখে, এবং আল্লাহর প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতার শিক্ষা দেয়।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ যদি সমগ্র মানবজাতিকে ধ্বংস করতে চান, তাতেও তাঁর কোনো কষ্ট হবে না। তারপর তিনি চাইলে আরও ভালো একটি জাতি সৃষ্টি করবেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৭৪৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাওহিদে অটল থাকবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৭৫৩২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- ইতিহাসে বহু শক্তিশালী জাতি যেমন ‘আদ, সামূদ, রোমান ও পারসিক সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে — তাদের স্থলে আল্লাহ নতুন জাতি সৃষ্টি করেছেন।
- আজও আল্লাহর অবাধ্য সমাজ ধ্বংসের পথে যাচ্ছে, আর ঈমানদার ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ আল্লাহর সাহায্য পাচ্ছে।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় — কোনো জাতি আল্লাহর জন্য অপরিহার্য নয়; বরং আল্লাহর ইচ্ছায়ই জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে।
- মুমিনের উচিত আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকা, অহংকার বা অবাধ্যতায় না পড়া।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৩):
- আল্লাহ চাইলে মানুষ ও জাতিকে ধ্বংস করে অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন।
- মানুষের অস্তিত্ব ও শক্তি আল্লাহর অনুমতির উপর নির্ভরশীল।
- অহংকার, অবাধ্যতা ও কৃতঘ্নতা ধ্বংসের কারণ।
- আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা সীমাহীন — তিনি যাকে চান উঁচু করেন, যাকে চান নীচে নামান।
- কৃতজ্ঞ ও তাকওয়াবান সমাজই আল্লাহর রহমত লাভ করে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সতর্ক করেছেন **শুধুমাত্র দুনিয়ার লোভে কাজ না করতে**, বরং আখিরাতের প্রতিদানকেও লক্ষ্য রাখতে। 🔹 **“مَن كَانَ يُرِيدُ ثَوَابَ الدُّنْيَا”** — কেউ যদি কেবল দুনিয়ার স্বার্থে কাজ করে — যেমন খ্যাতি, সম্পদ, পদ বা মানুষের প্রশংসা অর্জনের জন্য, তাহলে সে কেবল দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। 🔹 **“فَعِندَ اللَّهِ ثَوَابُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ”** — অথচ আল্লাহর কাছেই রয়েছে **দুনিয়া ও আখিরাত দুই জগতের পুরস্কার।** অর্থাৎ, যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে, তাহলে সে দুনিয়াতেও বরকত ও শান্তি পাবে, আর আখিরাতেও জান্নাতের পুরস্কার লাভ করবে। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا بَصِيرًا”** — আল্লাহ শুনেন ও দেখেন — তোমার উদ্দেশ্য, তোমার কাজ, তোমার নিয়ত সবকিছুই তাঁর জানা। 💠 এই আয়াত আমাদের **নিয়ত পরিশুদ্ধ করার শিক্ষা দেয়** — কারণ দুনিয়ার কাজ আখিরাতের জন্য করলে তবেই তা সওয়াবপূর্ণ হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কাজগুলো নিয়তের উপর নির্ভর করে; আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।” (📖 সহিহ বুখারী ১; সহিহ মুসলিম ১৯০৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি দুনিয়া কামনা করে, আল্লাহ তার কাজকে ছিন্নভিন্ন করে দেন; আর যে আখিরাত কামনা করে, আল্লাহ তার দুনিয়াকেও সহজ করে দেন।” (📖 সহিহ ইবনে মাজাহ ৪১০৫; সহিহ তিরমিযী ২৪৬৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ অধিকাংশ কাজ করে দুনিয়ার লাভের জন্য — অর্থ, পদ, জনপ্রিয়তা বা ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে।
- কিন্তু আখিরাতের চিন্তা ছাড়া সব অর্জনই অস্থায়ী ও শূন্য।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে, সে দুনিয়ার জীবনেও শান্তি ও বরকত অনুভব করে।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় — সঠিক নিয়তই একটি সাধারণ কাজকে ইবাদতে পরিণত করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৪):
- মানুষের কাজের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি।
- আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাত দু’টিরই পুরস্কার রয়েছে।
- শুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
- আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা — তিনি প্রত্যেক কাজ ও নিয়ত জানেন।
- মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত দুনিয়া নয়, বরং আখিরাত অর্জন করা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ন্যায়বিচার, সত্য সাক্ষ্য এবং পক্ষপাতহীনতার একটি **মহান মানবিক ও ইসলামী নীতি** শিক্ষা দিয়েছেন। 🔹 **“كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ”** — অর্থাৎ, তোমরা ন্যায়ের জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়াও, অন্যায় ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সত্য কথা বলো। 🔹 **“شُهَدَاءَ لِلَّهِ”** — সাক্ষ্য দাও আল্লাহর জন্য, মানুষের জন্য নয়। সত্য সাক্ষ্য মানে কেবল বাস্তবতা প্রকাশ করা, তা কারো ক্ষতি বা নিজের অসুবিধা হলেও। 🔹 **“وَلَوْ عَلَى أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ”** — ন্যায়বিচার এমনকি নিজের, পিতা-মাতা বা আত্মীয়ের বিরুদ্ধেও হতে পারে। ইসলাম আত্মীয়তার চেয়ে ন্যায়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। 🔹 **“إِن يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا”** — সাক্ষ্য প্রদানে ধনী বা গরিব কারো পক্ষে পক্ষপাত নয়, কারণ উভয়ের ভাগ্য আল্লাহর হাতে। 🔹 **“فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا”** — অর্থাৎ, ন্যায়বিচারে ব্যক্তিগত আবেগ বা মতলবের অনুসরণ করো না। 💠 সারসংক্ষেপে — **ন্যায়বিচার ও সত্য সাক্ষ্য ইসলামী সমাজের ভিত্তি।** যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত, সেখানে শান্তি ও আল্লাহর রহমত নেমে আসে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সাক্ষ্য সেই, যে সত্য কথা বলে, যদিও তা তার নিজের বা প্রিয়জনের বিরুদ্ধে যায়।” (📖 সহিহ বুখারী ২৬৮৬; সহিহ মুসলিম ১৭১৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “ন্যায়বিচারকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন নূরের মঞ্চে অবস্থান করবে, কারণ তারা আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ন্যায় প্রতিষ্ঠা করত।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৮২৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ আত্মীয়তা, দলীয়তা বা স্বার্থের কারণে সত্য সাক্ষ্য গোপন করে। কিন্তু ইসলাম তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
- ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে অবিচার, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা ছড়ায়।
- একজন মুমিনের জন্য সত্য সাক্ষ্য আল্লাহর ইবাদতের অংশ।
- আজকের মুসলিম সমাজে যদি এই আয়াত বাস্তবায়িত হতো, তাহলে ন্যায়, শান্তি ও আস্থার পরিবেশ ফিরে আসত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৫):
- ন্যায়বিচারে দৃঢ় থাকা ঈমানের অঙ্গ।
- সাক্ষ্য কেবল আল্লাহর জন্য দিতে হবে, কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়।
- নিজের, পিতা-মাতা বা আত্মীয়ের বিরুদ্ধেও সত্য বলা জরুরি।
- আবেগ, লোভ বা পক্ষপাত ন্যায়বিচারের শত্রু।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা — মিথ্যা বা বিকৃত সাক্ষ্য তাঁর কাছে গোপন নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **পূর্ণাঙ্গ ঈমানের মূলনীতি** স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে — তোমরা শুধু নামমাত্র ঈমানদার নও, বরং **সত্যিকারের ঈমান আনো**। 🔹 **“آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ”** — আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস মানে হলো, আল্লাহর একত্ব ও নবীর আনুগত্যে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করা। 🔹 **“وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ”** — কুরআনের প্রতি বিশ্বাস রাখা, তার প্রতিটি হুকুম মানা ও জীবনে তা বাস্তবায়ন করা। 🔹 **“وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنزَلَ مِن قَبْلُ”** — পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ (তাওরাত, ইনজিল, যবুর ইত্যাদি)-এর প্রতি বিশ্বাস রাখা, যদিও সেগুলোর অনেক অংশ পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়েছে। 🔹 **“وَمَن يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ...”** — ঈমানের ছয়টি মূল ভিত্তির (আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রসূল, পরকাল, তাকদির) যেকোনো একটি অস্বীকার করলে সে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়। 💠 এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন — **আংশিক ঈমান নয়, বরং পূর্ণ বিশ্বাসই মুক্তির পথ।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “ঈমান হলো — তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রসূল, পরকাল ও তাকদির (ভালো-মন্দ) — সবকিছুর প্রতি বিশ্বাস রাখো।” (📖 সহিহ মুসলিম ৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি কুরআনের একটি আয়াতকেও অস্বীকার করে, সে আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী।” (📖 সহিহ বুখারী ৪৫১; সহিহ মুসলিম ৭০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করলেও নবীর আদর্শ ও কুরআনের বিধান অমান্য করে — এটি অপূর্ণ ঈমান, যা আখিরাতে কোনো উপকার আনবে না।
- কেউ কেউ শুধুমাত্র নামাজ বা রোযাকে ধর্ম মনে করে, কিন্তু ন্যায়, সততা, ও মানবিকতা ভুলে যায় — অথচ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।
- এই আয়াত মুমিনকে স্মরণ করিয়ে দেয় — আল্লাহ, ফেরেশতা, রসূল ও কিতাব — সবকিছুর প্রতি বিশ্বাস ছাড়া ঈমান সম্পূর্ণ হয় না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৬):
- পূর্ণাঙ্গ ঈমানের ছয়টি ভিত্তি মেনে চলাই প্রকৃত মুসলিম হওয়ার শর্ত।
- আল্লাহ, রসূল ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস একই সুত্রে গাঁথা।
- কেবল মুখে বিশ্বাস নয়, কর্মে ও আনুগত্যে তা প্রকাশ করতে হবে।
- যে ব্যক্তি ঈমানের কোনো অংশ অস্বীকার করে, সে ভ্রষ্টতার গভীর অন্ধকারে পড়ে।
- আল্লাহ সবকিছু দেখেন ও জানেন — তাই ঈমান কেবল মুখের নয়, অন্তরেরও।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **অস্থির ও কপট ঈমানদারদের (মুনাফিকদের)** সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তারা কখনো ঈমান আনে, কখনো অবিশ্বাস করে — তাদের ঈমান দৃঢ় নয়, বরং সুযোগসন্ধানী ও অবিশ্বাসে ভরা। 🔹 **“آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا”** — তারা ঈমানের দাবি করে, কিন্তু কিছুদিন পর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে অবিশ্বাসে ফিরে যায়। 🔹 **“ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا”** — তারা ধীরে ধীরে কুফর বা অবিশ্বাসে আরও গভীর হয়, আল্লাহর বাণী নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে এবং সত্যকে অস্বীকার করে। 🔹 **“لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ”** — এ ধরনের মানুষদের জন্য ক্ষমার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তারা নিজেদের ইচ্ছায় সত্যকে অস্বীকার করে। 🔹 **“وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا”** — আল্লাহ তাদের হিদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন, কারণ তারা বারবার ঈমান ও কুফরের মধ্যে দোদুল্যমান থেকেছে। 💠 সারসংক্ষেপে — **এই আয়াত দ্বিমুখী ঈমান, ধর্ম নিয়ে খেলা ও কপটতা থেকে সাবধান করে।** ঈমান হলো দৃঢ় বিশ্বাস ও অবিচল আনুগত্য, অস্থিরতা নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে; যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভঙ্গ করে; এবং যখন আমানত রাখা হয়, তাতে খেয়ানত করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “মানুষের দেহে একটি টুকরো আছে, যদি তা ভালো থাকে, তবে পুরো দেহ ভালো থাকে; আর তা যদি নষ্ট হয়, তবে পুরো দেহ নষ্ট হয়ে যায় — সেটি হলো হৃদয়।” (📖 সহিহ বুখারী ৫২; সহিহ মুসলিম ১৫৯৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকে ইসলামকে সাময়িকভাবে গ্রহণ করে, কিন্তু দুনিয়ার স্বার্থে বা সমাজের ভয়ে তা ত্যাগ করে।
- কেউ কেউ ঈমানের দাবিদার হলেও কুরআন-সুন্নাহর বিধান উপহাস করে — এটি মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য।
- এই আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয় — ঈমান কোনো খেলার বিষয় নয়; একবার দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করলে তা কর্মে প্রমাণ করতে হয়।
- মিথ্যা, কপটতা ও ঈমানের অস্থিরতা মানুষকে হিদায়াত থেকে বঞ্চিত করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৭):
- ঈমান ও অবিশ্বাসের মধ্যে দোদুল্যমান থাকা মারাত্মক বিপদজনক।
- যে ব্যক্তি সত্য জানার পর বারবার তা অস্বীকার করে, তার জন্য আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্য নয়।
- মুনাফিকদের ঈমান নামমাত্র, বাস্তবে নয়।
- আল্লাহ সত্যিকারের ঈমানদারদেরই হিদায়াত দেন।
- মুমিনের উচিত তার ঈমান দৃঢ় করা ও তা আমলের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এক **বিদ্রূপাত্মক ভাষায় মুনাফিকদের প্রতি সতর্কবাণী** দিয়েছেন। এখানে “সুসংবাদ” বলা হয়েছে, কিন্তু সেটি আসলে **শাস্তির সংবাদ** — অর্থাৎ তাদের জন্য সুখ নয়, বরং বেদনাদায়ক পরিণতি অপেক্ষা করছে। 🔹 **“بَشِّرِ الْمُنَافِقِينَ”** — নবী ﷺ-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তিনি মুনাফিকদের জানিয়ে দেন, তাদের মিথ্যা ঈমান, দ্বিচারিতা ও প্রতারণা কোনো ফল বয়ে আনবে না। 🔹 **“بِأَنَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا”** — অর্থাৎ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি — যা শুধু দেহ নয়, আত্মাকেও পীড়িত করবে। 💠 এখানে “মুনাফিক” বলতে বোঝানো হয়েছে — যারা মুখে ঈমানের দাবি করে কিন্তু মনে কুফর লালন করে, যারা আল্লাহ ও রসূল ﷺ-এর প্রতি আনুগত্যের ভান করে, অথচ সুযোগ পেলে সত্য ধর্মের ক্ষতি করতে চায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে; যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভঙ্গ করে; এবং যখন আমানত রাখা হয়, তাতে খেয়ানত করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯) আরেক বর্ণনায় আছে— “যে ব্যক্তি রিয়া (দেখানোর জন্য) আমল করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে লোকদের সামনে অপমানিত করবেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৯৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই মুখে ইসলাম, কিন্তু কাজে ইসলামবিরোধী আচরণ করে — এটি আধুনিক মুনাফিকতার রূপ।
- কেউ ইসলাম ব্যবহার করে রাজনীতি, ব্যবসা বা খ্যাতির জন্য; অথচ ঈমান ও আখিরাতের চিন্তা তার নেই।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় — মুনাফিকতা শুধু নবীর যুগেই ছিল না, বরং আজও আমাদের সমাজে তা প্রবলভাবে বিদ্যমান।
- সত্যিকারের মুমিন তার অন্তর ও বাহির — উভয়কেই আল্লাহর প্রতি খাঁটি রাখে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৮):
- মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন ও অপমানজনক শাস্তি নির্ধারিত।
- মিথ্যা ঈমান ও ধর্মের ভান আল্লাহর কাছে ঘৃণিত।
- ইসলামে অন্তরের ও বাহ্যিক উভয় ঈমানই জরুরি।
- মুমিনের কর্তব্য হলো নিজের ঈমানকে মুনাফিকতার ছোঁয়া থেকে রক্ষা করা।
- আল্লাহর ভয় ও আত্মসমালোচনা মুনাফিকতার প্রতিষেধক।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদারদের এক গুরুতর ভুল বিশ্বাস** উন্মোচন করেছেন — তারা মনে করে, অবিশ্বাসীদের সাথে সম্পর্ক রাখলে তারা সম্মান, শক্তি বা লাভ পাবে। 🔹 **“ٱلَّذِينَ يَتَّخِذُونَ ٱلْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ”** — অর্থাৎ যারা মুমিনদের বাদ দিয়ে অবিশ্বাসীদের সাথে বন্ধুত্ব, জোট বা আনুগত্য স্থাপন করে। এটি সেইসব লোকদের ইঙ্গিত দেয় যারা দুনিয়াবি স্বার্থে ইসলামী আদর্শ ত্যাগ করে। 🔹 **“أَيَبْتَغُونَ عِندَهُمُ الْعِزَّةَ؟”** — তারা কি অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে সম্মান চায়? সম্মান (ʿIzzah) মানে হলো মর্যাদা, প্রভাব ও নিরাপত্তা। কিন্তু অবিশ্বাসীদের থেকে পাওয়া সম্মান ক্ষণস্থায়ী, বরং তা শেষমেশ অপমানের কারণ হয়। 🔹 **“فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا”** — প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা কেবল আল্লাহরই। যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করে, আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করেন। 💠 এই আয়াত বিশ্বাসীদের শেখায় — **সত্যিকারের মর্যাদা মুমিনদের ঐক্য, ঈমান ও আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (📖 আবু দাউদ ৪০৩১; সহিহ ইবনে হিব্বান ২৭৭২) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, সে-ই ঈমানের পূর্ণতা অর্জন করেছে।” (📖 আবু দাউদ ৪৬৮১; সহিহ মুসলিম ১৭৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মুসলিম সমাজ দুনিয়াবি স্বার্থে ইসলামবিরোধী শক্তির আনুগত্য করছে, ভেবে নিচ্ছে এতে তারা সম্মান বা উন্নতি পাবে।
- কেউ কেউ পশ্চিমা সংস্কৃতিকে “আধুনিকতা” মনে করে অনুসরণ করছে, অথচ এতে আত্মিক ও নৈতিক পতন ঘটছে।
- এই আয়াত শেখায় — মুসলিমের প্রকৃত শক্তি ঈমান ও ঐক্যে, অবিশ্বাসীদের তোষণ বা অনুকরণে নয়।
- যে সমাজ আল্লাহকে ভুলে যায়, আল্লাহও তাদের কাছ থেকে সম্মান কেড়ে নেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩৯):
- মুমিনদের উচিত একে অপরের বন্ধু ও সহায়ক হওয়া।
- অবিশ্বাসীদের কাছে সম্মান খোঁজা ইসলামবিরোধী কাজ।
- সত্যিকারের মর্যাদা কেবল আল্লাহর আনুগত্যে নিহিত।
- যে আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকে, আল্লাহ তাকেই সম্মানিত করেন।
- মুমিনের আত্মসম্মান ঈমাননির্ভর, দুনিয়াবি ক্ষমতানির্ভর নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের সতর্ক করেছেন যেন তারা **আল্লাহর বাণীকে উপহাস বা অস্বীকারকারীদের সাথে মিশে না থাকে।** 🔹 **“إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا”** — যখন আল্লাহর আয়াত, ইসলাম বা শরীয়তের নিয়ম নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়, তখন একজন মুমিনের কর্তব্য হলো সেই পরিবেশ থেকে দূরে সরে যাওয়া। 🔹 **“فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ”** — তাদের সঙ্গে বসে থাকা, তাদের কথায় হাসা, বা নীরব থাকা — সবই গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, কারণ এটি **সমর্থনের শামিল।** 🔹 **“إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ”** — যদি তোমরা তাতে অংশগ্রহণ করো, তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমরাও তাদের মতো অপরাধী বিবেচিত হবে। 🔹 **“إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ”** — মুনাফিক ও কাফের — উভয় শ্রেণিই পরকালে একসাথে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে, কারণ তাদের অন্তরে ঈমানের অভাব। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত **ইসলামবিরোধী তামাশা, বিদ্রূপ, বা অবমাননা** থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো জাতির অন্যায় কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট থাকে, সে তাদের সঙ্গী বলে গণ্য হবে।” (📖 সুনান আবু দাউদ ৪৩৪৫; সহিহ ইবনে মাজাহ ৪০১১) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি মিথ্যা ও বিদ্রূপ শুনে নীরব থাকে, সে নিজেও তার অংশীদার।” (📖 তাফসিরে ইবন কাসির, সূরা আন-নিসা ৪:১৪০ ব্যাখ্যা)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ইসলাম, কুরআন ও নবী ﷺ সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়। একজন সত্যিকার মুমিনের উচিত এমন স্থান বা আলোচনায় অংশ না নেওয়া।
- কেউ যদি ইসলামের উপহাস শুনেও হাসে বা চুপ থাকে, সে বাস্তবে সেই অন্যায়ের সমর্থন করছে।
- এই আয়াত শেখায় — সত্য ও মিথ্যার মধ্যে নিরপেক্ষ থাকা মানে হলো মিথ্যার পাশে দাঁড়ানো।
- মুমিনের মর্যাদা হলো আল্লাহর দীনকে রক্ষা করা, হাস্য-বিদ্রূপে আনন্দ নেওয়া নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪০):
- আল্লাহর আয়াতকে উপহাস বা অস্বীকারকারীদের সঙ্গ ত্যাগ করা ঈমানের দাবি।
- ধর্ম নিয়ে হাসাহাসি করা বা নীরবে সমর্থন দেওয়া উভয়ই গুনাহ।
- সত্যিকারের মুমিন ইসলামবিদ্বেষী পরিবেশ থেকে দূরে থাকে।
- মুনাফিক ও কাফের উভয়ের গন্তব্য জাহান্নাম — কারণ উভয়ের মনই ঈমানশূন্য।
- আল্লাহর ভয় ও সম্মান রক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **মুনাফিকদের দ্বিচারিতা ও ভণ্ড আচরণ** উন্মোচন করেছেন। তারা কখনো মুমিনদের পক্ষে, কখনো কাফেরদের পক্ষে অবস্থান নেয় — পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। 🔹 **“يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ”** — অর্থাৎ তারা অপেক্ষা করে, দেখে কারা জয়ী হয়। যদি মুসলমানরা জয়ী হয়, তারা নিজেদের মুসলিম হিসেবে উপস্থাপন করে; আর যদি কাফেররা প্রভাবশালী হয়, তারা তাদের সাথেই চলে যায়। 🔹 **“فَإِن كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِّنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ”** — যখন মুসলমানরা বিজয় লাভ করে, মুনাফিকরা বলে — “আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম!” তারা কৃতিত্ব ভাগাভাগি করতে চায়। 🔹 **“وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ”** — কিন্তু যখন কাফেররা জয়ী হয়, তারা বলে — “আমরা তো তোমাদের পক্ষে ছিলাম এবং মুসলমানদের আক্রমণ থেকে তোমাদের রক্ষা করেছি।” 🔹 **“فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ”** — অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন আল্লাহ মুনাফিক ও মুমিনদের মধ্যে চূড়ান্ত বিচার করবেন। 🔹 **“وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا”** — যদিও দুনিয়ায় কখনো কাফেরদের সাময়িক প্রভাব থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর চূড়ান্ত বিধানে মুমিনদের উপর তাদের কোনো স্থায়ী ক্ষমতা থাকবে না। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, **দ্বিমুখী ঈমান, স্বার্থপরতা ও ধর্মে সুযোগসন্ধানিতা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “দুই মুখওয়ালা ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে দুই জিহ্বা নিয়ে আসবে — এক জিহ্বা দিয়ে মুমিনদের সাথে কথা বলত, আরেকটি দিয়ে কাফেরদের সাথে।” (📖 আবু দাউদ ৪৯৬১; সহিহ তিরমিযী ২০২৬) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “তোমরা দুই মুখওয়ালা লোকদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টদের মধ্যে গনিত হবে, যারা এক দলের কাছে এক কথা বলে, আরেক দলের কাছে অন্য কথা বলে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫২৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ ইসলাম ও অবিশ্বাসের মাঝখানে দোদুল্যমান — কখনো ইসলামকে সমর্থন করে, আবার সুযোগ এলে বিরোধিতা করে।
- রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে কিছু লোক ইসলামকে কেবল ব্যক্তিগত লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে — এরা বাস্তব জীবনের মুনাফিক।
- এই আয়াত স্পষ্টভাবে বলে — দ্বিমুখী আচরণ আল্লাহর কাছে জাহান্নামের কারণ।
- আল্লাহ মুমিনদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন — শেষ পরিণতি সবসময় সত্যিকারের ঈমানদারদের পক্ষেই হবে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪১):
- মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হলো — সুযোগ অনুযায়ী দল পরিবর্তন করা।
- আল্লাহর কাছে এ ধরনের ভণ্ডামি ঘৃণিত ও শাস্তিযোগ্য।
- মুমিনদের উপর কাফেরদের স্থায়ী কর্তৃত্ব কখনো থাকবে না।
- আল্লাহ কিয়ামতের দিন সব দ্বিমুখী লোকদের বিচার করবেন।
- একজন সত্য মুমিনের ঈমান দৃঢ়, পরিস্থিতি নির্ভর নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের অন্তরের অবস্থা ও তাদের **ভণ্ড ধর্মীয় আচরণ** প্রকাশ করেছেন। 🔹 **“يُخَادِعُونَ اللَّهَ”** — তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চায়, অর্থাৎ মুখে ঈমানের দাবি করে কিন্তু মনে কুফর লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে আল্লাহ তাদের ভেতরের অবস্থা জানেন না। 🔹 **“وَهُوَ خَادِعُهُمْ”** — কিন্তু বাস্তবে আল্লাহই তাদের ধোঁকা দেন — অর্থাৎ, দুনিয়াতে তাদেরকে সাময়িকভাবে মুক্ত রাখেন, যাতে তারা নিজের ভণ্ডামিতে আরও ডুবে যায় এবং শেষমেশ ধ্বংস হয়। 🔹 **“وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَىٰ”** — তারা নামাজে অলসভাবে দাঁড়ায়, যেন কোনো ভারী দায়িত্ব পালন করছে। তাদের নামাজে মনোযোগ বা খুশু নেই। 🔹 **“يُرَاءُونَ النَّاسَ”** — তারা নামাজ পড়ে মানুষকে দেখানোর জন্য, যেন মানুষ তাদের “ধর্মপ্রাণ” ভাবে — এটিই **রিয়া (প্রদর্শন)।** 🔹 **“وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا”** — তারা আল্লাহকে খুব সামান্যই স্মরণ করে, কেবল দুনিয়াবি স্বার্থে নামাজে যোগ দেয় বা ধর্মের কথা বলে। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত মুনাফিকদের “দেখানোর জন্য ইবাদত” করার প্রবণতা এবং অন্তরের শূন্য ঈমানের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “সবচেয়ে কঠিন নামাজ মুনাফিকদের জন্য হলো ফজর ও ইশার নামাজ; তারা জানে না যে এতে কী বরকত আছে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬৫৭; সহিহ মুসলিম ৬৫১) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে, সে আল্লাহর কাছে শিরক করছে।” (📖 সহিহ ইবনে মাজাহ ৪২০৪; সহিহ মুসলিম ২৯৮৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ নামাজ পড়ে বা ধর্মীয় কাজ করে কেবল অন্যদের প্রশংসা পাওয়ার জন্য — এটি আধুনিক রিয়ার রূপ।
- সামাজিক মাধ্যমে “ধর্মীয় ইমেজ” গড়ে তোলার প্রবণতাও এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত ভণ্ড আচরণ।
- যারা নামাজে অলসতা, তাড়াহুড়ো বা অনিচ্ছা দেখায়, তাদের ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে।
- এই আয়াত শেখায় — নামাজ কেবল শরীরের কাজ নয়, বরং অন্তরের উপস্থিতি প্রয়োজন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪২):
- আল্লাহ সবকিছু জানেন, তাই তাঁকে ধোঁকা দেওয়া অসম্ভব।
- রিয়া বা প্রদর্শন ঈমান নষ্ট করে দেয়।
- অলসভাবে নামাজ পড়া মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য।
- আল্লাহর স্মরণ ও আন্তরিক ইবাদতই ঈমানের প্রমাণ।
- মুমিনের উচিত প্রতিটি আমল কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের **অস্থির, দ্বিচারী ও অনিশ্চিত অবস্থান** স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। 🔹 **“مُّذَبْذَبِينَ بَيْنَ ذَٰلِكَ”** — অর্থাৎ তারা ঈমান ও কুফরের মাঝামাঝি ঝুলে থাকে। কখনো মুমিনদের পাশে দাঁড়ায়, আবার কখনো কাফেরদের সাথেও চলে যায়। 🔹 **“لَا إِلَى هَٰؤُلَاءِ وَلَا إِلَى هَٰؤُلَاءِ”** — তারা কোনো পক্ষেই সম্পূর্ণ নয় — মুমিনদের মতো ঈমানদার নয়, কাফেরদের মতো খোলামেলা অবিশ্বাসীও নয়। বরং তারা সুবিধাবাদী, যেদিকে লাভ দেখে, সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। 🔹 **“وَمَن يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا”** — আল্লাহ যার অন্তরকে বিভ্রান্ত করেন, তার জন্য আর কোনো পথ বা হিদায়াত থাকে না। কারণ সে নিজের ইচ্ছায় সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। 💠 এই আয়াত **দ্বিমুখী বিশ্বাস ও চরিত্রহীন ঈমানের পরিণতি** সম্পর্কে স্পষ্ট সতর্কবার্তা। আল্লাহ দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়কে পছন্দ করেন না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা দ্বিমুখী লোক হয়ো না; যারা বলে — ‘যদি মানুষ ভালো করে, আমরাও ভালো করব, আর তারা অন্যায় করলে আমরাও করব।’ বরং নিজেদের নীতিতে দৃঢ় থাকো।” (📖 তিরমিযী ২০০৭; সহিহ হাদিস) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি দুই মুখওয়ালা, সে কিয়ামতের দিনে জাহান্নামের আগুনের দুই জিহ্বা নিয়ে উপস্থিত হবে।” (📖 আবু দাউদ ৪৯৬১; সহিহ মুসলিম ২৫২৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজে অনেক মানুষ ইসলাম ও দুনিয়ার মাঝখানে ঝুলে থাকে — নামাজ পড়ে কিন্তু হারাম কাজও করে, আল্লাহকে মানে কিন্তু শরীয়তের নিয়ম অমান্য করে।
- কেউ কেউ ইসলামকে কেবল অনুষ্ঠানে মানে, কিন্তু জীবনের অন্য দিকগুলোতে পশ্চিমা ভাবধারা অনুসরণ করে।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় — “অর্ধেক ইসলাম” বলে কিছু নেই; ইসলামকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হয়।
- দ্বিধাগ্রস্ত ঈমান মানুষকে ধীরে ধীরে কুফরের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৩):
- মুনাফিকরা সবসময় দুই দিকেই নিরাপদ থাকতে চায় — কিন্তু আল্লাহর কাছে তারা উভয় দিকেই অপমানিত।
- সুবিধাবাদী ঈমান আল্লাহর দরবারে কোনো মূল্য রাখে না।
- যে আল্লাহর হিদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জন্য কোনো পথ অবশিষ্ট থাকে না।
- একজন মুমিনের উচিত ঈমানের ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া।
- অস্থিরতা ও দ্বিধা ঈমান নষ্ট করে দেয় — তাই আল্লাহর পথে স্থির থাকা অপরিহার্য।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা **অবিশ্বাসীদের প্রতি আনুগত্য বা বন্ধুত্ব স্থাপন না করে।** 🔹 **“لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ”** — অর্থাৎ অবিশ্বাসীদেরকে নেতৃত্ব, পরামর্শদাতা বা নিকট সহযোগী বানিও না। কারণ তাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়, দুনিয়াবি স্বার্থ ও প্রভাব বৃদ্ধি। 🔹 **“مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ”** — অর্থাৎ প্রকৃত বন্ধুত্ব, সমর্থন ও আনুগত্য কেবল মুমিনদের মধ্যেই থাকা উচিত। ইসলাম চায় একটি ঐক্যবদ্ধ মুমিন সমাজ, যেখানে ভালোবাসা ও সহযোগিতা ঈমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। 🔹 **“أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا”** — যদি তোমরা অবিশ্বাসীদের আনুগত্য করো, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ থাকবে — যে তোমরা নিজেরাই তাদের প্রভাব মেনে নিয়েছিলে। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত মুসলমানদের শেখায় যে, **যে জাতি ইসলামবিরোধী, তাদের প্রতি আনুগত্য বা নির্ভরতা ঈমানের পরিপন্থী।**
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (📖 আবু দাউদ ৪০৩১; সহিহ ইবনে হিব্বান ২৭৭২) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, সে-ই ঈমানের পূর্ণতা অর্জন করেছে।” (📖 আবু দাউদ ৪৬৮১; সহিহ মুসলিম ১৭৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ বহু মুসলিম সমাজ ইসলামবিরোধী শক্তির অধীনে দুনিয়াবি উন্নতির আশায় তাদের অনুকরণ করছে।
- রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে অনেক মুসলমান অবিশ্বাসীদের প্রভাব মেনে নিচ্ছে, অথচ এতে ঈমান দুর্বল হচ্ছে।
- এই আয়াত শেখায় — আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে আনুগত্যের সম্পর্ক গড়া মানে নিজেকেই আল্লাহর শত্রুর সারিতে দাঁড় করানো।
- মুমিনদের প্রকৃত সম্মান আল্লাহর আনুগত্যে, অবিশ্বাসীদের বন্ধুত্বে নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৪):
- মুমিনদের উচিত নিজেদের বন্ধুত্ব ও আনুগত্য ঈমানের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা।
- অবিশ্বাসীদের অনুকরণ ও আনুগত্য ঈমানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা এসেছে — অবিশ্বাসীদের প্রতি আনুগত্য কিয়ামতের দিন স্পষ্ট অপরাধ প্রমাণ হবে।
- সত্যিকারের মুসলমান নিজের সমাজ, ধর্ম ও ঈমানের মর্যাদা রক্ষা করে।
- যে আল্লাহকে ভালোবাসে, সে কখনো আল্লাহর শত্রুর প্রতি আনুগত্য দেখায় না।
এই আয়াতটি কুরআনের অন্যতম কঠিন সতর্কবার্তা। এখানে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, **মুনাফিকদের (ভণ্ড বিশ্বাসীদের)** শাস্তি কাফেরদের চেয়েও ভয়াবহ হবে। 🔹 **“فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ”** — ‘দরক’ মানে স্তর বা গভীর অংশ। অর্থাৎ তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে, যেখানে সবচেয়ে ভয়াবহ ও অপমানজনক শাস্তি দেওয়া হবে। 🔹 **কেন এমন শাস্তি?** কারণ মুনাফিকরা প্রকাশ্যে মুসলমানের চেহারা ধারণ করে, কিন্তু অন্তরে কুফর ও প্রতারণা লালন করে। তাদের ভণ্ডামি মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা ও ঈমানহীনতা সৃষ্টি করে। 🔹 **“وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا”** — অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কেউ সাহায্যকারী থাকবে না, না ফেরেশতা, না নবী, না বন্ধু, না কোনো অজুহাত। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহর দৃষ্টিতে মুনাফিকরা হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণি, কারণ তারা ভিতরে শত্রু অথচ বাইরে বন্ধু সাজে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে; যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভঙ্গ করে; এবং যখন আমানত রাখা হয়, তাতে খেয়ানত করে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৩; সহিহ মুসলিম ৫৯) আরও বলেছেন— “সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যক্তি সেই, যে তার জিহ্বা দ্বারা কুরআন পড়ে, অথচ তার আচরণ কুরআনের বিপরীত।” (📖 তিরমিযী ২৬২২; সহিহ হাদিস)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকে মুসলমান পরিচয়ে ধর্মের ক্ষতি করছে — ইসলামকে বিকৃত করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছে।
- মিডিয়া, রাজনীতি বা ধর্মীয় অঙ্গনে এমন ভণ্ড লোকের সংখ্যা বেড়েছে যারা ইসলামের নামে ইসলামবিরোধী কাজ করছে।
- এই আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয় — ভণ্ডামি ও দ্বিমুখিতা আল্লাহর কাছে ঘৃণিত অপরাধ।
- সত্যিকারের ঈমান হলো — অন্তর ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকেই আল্লাহর প্রতি আনুগত্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৫):
- মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচেয়ে নীচস্তরে থাকবে — এটি আল্লাহর কঠিন ঘোষণা।
- ভণ্ডামি, প্রতারণা ও দ্বিমুখী আচরণ ইসলামে বড় গুনাহ।
- কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোনো সুপারিশ বা সাহায্যকারী থাকবে না।
- একজন সত্যিকারের মুমিনের অন্তর ও বাহির এক হওয়া উচিত।
- আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ঈমান হলো — খাঁটি, দৃঢ় ও আন্তরিক ঈমান।
আগের আয়াতে (৪:১৪৫) আল্লাহ মুনাফিকদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আয়াতে তিনি রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন — অর্থাৎ যারা **সত্যিকার তওবা করে**, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেন এবং পুনরায় মুমিনদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। 🔹 **“إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا”** — অর্থাৎ যারা আন্তরিকভাবে নিজেদের কপটতা ত্যাগ করে, ঈমানের পথে ফিরে আসে। 🔹 **“وَأَصْلَحُوا”** — শুধু মুখে তওবা নয়, বরং নিজেদের আচরণ ও চরিত্র সংশোধন করে। 🔹 **“وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ”** — অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও রসূল ﷺ-এর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে। 🔹 **“وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ”** — তাদের ধর্ম ও আমলকে একান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাঁটি করে। 🔹 **“فَأُوْلَئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ”** — এই চারটি গুণ অর্জনকারীই প্রকৃত মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহর দয়া অসীম। এমনকি মুনাফিকও যদি আন্তরিকভাবে তওবা করে ও নিজেকে সংশোধন করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে তাঁর প্রিয় বান্দাদের দলে স্থান দেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তওবা করে, সে এমন যেন সে কখনো গুনাহই করেনি।” (📖 ইবনে মাজাহ ৪২৫০; সহিহ হাদিস) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবায় এত আনন্দিত হন, যতটা আনন্দিত হয় সেই ব্যক্তি যে মরুভূমিতে হারানো উট ফিরে পায়।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৭৪৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি অতীতে ইসলাম থেকে দূরে ছিল, কিন্তু এখন আন্তরিকভাবে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে — সে এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
- যারা আগে ধর্মে অবহেলা করত, কিন্তু এখন নামাজ, সততা, ও পরহেযগারিতে ফিরে এসেছে — তাদের জন্য এটি আশা ও মুক্তির বার্তা।
- এই আয়াত শেখায় — যত বড় গুনাহই হোক না কেন, তওবা ও সংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ ক্ষমা করেন।
- আল্লাহর দয়া কখনো সীমিত নয়; আন্তরিক তওবা করলে প্রতিটি দরজা খুলে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৬):
- আল্লাহর রহমত সবসময় খোলা — আন্তরিক তওবা করলে ক্ষমা নিশ্চিত।
- তওবা শুধু মুখে নয়, কাজে ও মনে পরিবর্তন আনতে হবে।
- আল্লাহর প্রতি দৃঢ় নির্ভরতা (إعتصام بالله) ঈমানের শক্ত ভিত্তি।
- খাঁটি নিয়তে করা আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।
- তওবা, সংশোধন ও ঈমানের আন্তরিকতা মানুষকে মুনাফিকতা থেকে মুক্তি দেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এক চমৎকার প্রশ্নের মাধ্যমে তাঁর রহমত ও ন্যায়বিচার প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ — **আল্লাহ কখনো এমন কাউকে শাস্তি দেন না, যে কৃতজ্ঞ ও ঈমানদার।** 🔹 **“مَّا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ”** — আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দিয়ে কী লাভ করবেন? তিনি কারো উপর জুলুম করতে চান না; বরং চান তোমরা ঈমান আনো ও কৃতজ্ঞ হও। 🔹 **“إِنْ شَكَرْتُمْ وَآمَنتُمْ”** — এখানে দু’টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে — ১️⃣ **শুকর (কৃতজ্ঞতা):** আল্লাহর নিয়ামতের স্বীকৃতি ও সঠিক ব্যবহার। ২️⃣ **ঈমান:** আল্লাহ ও তাঁর নির্দেশসমূহে দৃঢ় বিশ্বাস। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا”** — আল্লাহ “শাকির” অর্থাৎ কৃতজ্ঞদের প্রতি পুরস্কারদাতা। তিনি “আলীম” — সবকিছু জানেন, কার হৃদয়ে ঈমান আছে তাও জানেন। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহ বান্দার প্রতি দয়ালু; তাঁর শাস্তি ন্যায়সঙ্গত এবং শুধুমাত্র অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞদের জন্য নির্ধারিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ তাআলা কৃতজ্ঞ বান্দাকে ভালোবাসেন, যে অল্প নিয়ামতের জন্যও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।” (📖 তিরমিযী ১৯৫৫; সহিহ হাদিস) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে মানুষকে ধন্যবাদ দেয় না, সে আল্লাহকেও ধন্যবাদ দেয় না।” (📖 আবু দাউদ ৪৮১১; সহিহ তিরমিযী ১৯৫৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ আল্লাহর অগণিত নিয়ামত ভোগ করছে, তবুও অকৃতজ্ঞতার কারণে তাদের অন্তরে শান্তি নেই।
- কেউ সামান্য কষ্ট পেলেই অভিযোগ করে, কিন্তু আল্লাহর অগণিত অনুগ্রহ ভুলে যায়।
- এই আয়াত শেখায় — যদি আমরা সত্যিকারের ঈমান ও কৃতজ্ঞতার জীবন যাপন করি, তাহলে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকব।
- কৃতজ্ঞতা শুধু মুখে নয়, বরং আমলের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৭):
- আল্লাহ কখনো কৃতজ্ঞ ও ঈমানদার বান্দাকে শাস্তি দেন না।
- শুকর (কৃতজ্ঞতা) ও ঈমান — উভয়ই মুক্তির চাবিকাঠি।
- আল্লাহর নিয়ামত স্বীকার করে সঠিকভাবে ব্যবহার করা ইবাদতের অংশ।
- অকৃতজ্ঞতা ও অবিশ্বাস আল্লাহর শাস্তি ডেকে আনে।
- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পুরস্কারে কৃপণ নন — তিনি শাকির ও আলীম।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা শিষ্টাচার ও ন্যায়বোধের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছেন — **অন্যায়, অপবাদ, রাগ বা প্রতিহিংসার কারণে কাউকে প্রকাশ্যে অপমান করা বা গালাগালি করা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।** 🔹 **“لَا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ”** — অর্থাৎ প্রকাশ্যে কটূ, অপ্রীতিকর বা নিন্দাসূচক কথা বলা আল্লাহর পছন্দ নয়। কারণ এটি সমাজে শত্রুতা, রাগ ও অনৈতিকতা বাড়ায়। 🔹 **“إِلَّا مَن ظُلِمَ”** — তবে যে ব্যক্তি অন্যায়ের শিকার, সে নিজের অধিকার আদায় বা ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য তার অভিযোগ প্রকাশ করতে পারে — এটি নিষিদ্ধ নয়। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا”** — আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন — কে ন্যায়ের জন্য কথা বলছে আর কে অপবাদ দিচ্ছে, তা তাঁর অজানা নয়। 💠 সারসংক্ষেপে — ইসলাম মানুষকে সংযমী, ভদ্র ও ন্যায়পরায়ণ হতে শিখিয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বৈধ, কিন্তু কটূভাষায় নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬১৩৬; সহিহ মুসলিম ৪৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “গালাগালি করা ফাসিকির কাজ, আর অন্যায়ভাবে হত্যা করা কুফরি।” (📖 সহিহ বুখারী ৪৮; সহিহ মুসলিম ৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ রাগের বশে বা সামাজিক মাধ্যমে অন্যদের অপমান করে — এটি আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।
- কেউ অন্যায়ের শিকার হলে, সে আইন ও ন্যায়ের পথে প্রতিবাদ করতে পারে, কিন্তু অশালীন ভাষা ব্যবহার করা হারাম।
- এই আয়াত আমাদের শেখায় — কথা বলা একটি আমানত; তাই তা ব্যবহার করতে হবে সুবিবেচনা ও সংযমের সাথে।
- মুমিনের জিহ্বা ও চরিত্র উভয়ই শান্তি ও ন্যায়ের প্রতীক।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৮):
- অশালীন বা কটূ কথা বলা ইসলামে নিষিদ্ধ।
- অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা বৈধ, তবে সীমার মধ্যে।
- আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন, তাই প্রতিটি বাক্যের হিসাব হবে।
- ভালো কথা বলা বা নীরব থাকা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
- জিহ্বার সংযম সমাজে শান্তি ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের তিনটি শ্রেষ্ঠ গুণের প্রশংসা করেছেন — (১) ভালো কাজ করা, (২) গোপনে সৎকর্ম করা, এবং (৩) অন্যকে ক্ষমা করা। 🔹 **“إِن تُبْدُوا خَيْرًا”** — যদি তোমরা প্রকাশ্যে কোনো ভালো কাজ করো, যেমন — দান, ন্যায়পরায়ণতা, বা কাউকে সাহায্য করা, এবং তা দেখানোর জন্য নয়, বরং অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য হয়, তাহলে এটি প্রশংসনীয়। 🔹 **“أَوْ تُخْفُوهُ”** — যদি তোমরা তা গোপনে করো, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তাহলে এর প্রতিদান আরও বেশি। 🔹 **“أَوْ تَعْفُوا عَنْ سُوءٍ”** — আর যদি কেউ তোমার প্রতি অন্যায় করে, এবং তুমি প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দাও, তবে এটি আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় গুণগুলোর একটি। 🔹 **“فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا قَدِيرًا”** — কারণ আল্লাহ নিজেই ক্ষমাশীল, অথচ তাঁর ক্ষমতার অধীনে রয়েছে সবকিছু। তিনি ক্ষমা করতে পারেন, আবার চাইলে শাস্তিও দিতে পারেন — কিন্তু তিনি ক্ষমা করাকেই পছন্দ করেন। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহ মানুষকে উৎসাহিত করছেন, যেন তারা ভালো কাজ করে, প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নয়, বরং আন্তরিকতা ও ক্ষমাশীলতার সঙ্গে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “দান গোপনে করা এমন যে, ডান হাত যা দেয়, বাম হাতও তা জানে না।” (📖 সহিহ বুখারী ১৪২১; সহিহ মুসলিম ১০৩১) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকেই দান-খয়রাত বা সৎকর্ম করে শুধু প্রচারের জন্য — অথচ আল্লাহর কাছে গোপন সৎকর্মই অধিক প্রিয়।
- মানুষ ছোট ছোট অন্যায়ে একে অপরকে ক্ষমা করতে পারে না, অথচ আল্লাহ আমাদের বড় বড় গুনাহও ক্ষমা করেন।
- যে ব্যক্তি সমাজে গোপনে ভালো কাজ করে, সে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান।
- ক্ষমাশীলতা শুধু মহত্ত্বের পরিচয় নয়, এটি আল্লাহর একটি গুণ, যা মুমিনদের অর্জন করা উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪৯):
- ভালো কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে করা — উভয়ই প্রশংসনীয়।
- গোপন সৎকর্ম আল্লাহর কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।
- অন্যকে ক্ষমা করা আল্লাহর প্রিয় আমল।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সর্বশক্তিমান — আমাদেরও তাঁর মতো ক্ষমাশীল হতে হবে।
- সত্যিকারের ঈমানদার সেই, যে কৃতজ্ঞ, নীরব ও ক্ষমাশীল।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সেইসব লোকদের সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, যারা ঈমানের নাম ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ায়। তারা বলে — “আমরা আল্লাহকে মানি, কিন্তু কিছু নবীকে মানি না।” 🔹 **“يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ”** — অর্থাৎ তারা আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত সকল রসূলের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে। ইসলাম শেখায় যে, আল্লাহর পাঠানো সকল নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান আনা ফরজ। 🔹 **“يُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ”** — তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মাঝে পার্থক্য করতে চায় — যেমন, কেউ কেবল মূসা (আঃ) কে মানে, কেউ কেবল ঈসা (আঃ) কে, আবার কেউ কেবল মুহাম্মদ ﷺ-কে মানতে চায় না। 🔹 **“نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ”** — তারা বলে, “আমরা কিছু রসূলকে বিশ্বাস করি, কিন্তু কিছু রসূলকে অস্বীকার করি।” অথচ এক নবীকে অস্বীকার করা মানে সকল নবীকেই অস্বীকার করা। 🔹 **“وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا”** — তারা মধ্যপন্থা নিতে চায় — অর্থাৎ ঈমান ও কুফরের মাঝামাঝি এক অবস্থান। কিন্তু ইসলাম এমন কোনো “মধ্যপন্থা” স্বীকার করে না। 💠 সারসংক্ষেপে — ইসলাম একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস ব্যবস্থা। আল্লাহ, তাঁর কিতাব, ফেরেশতা, রসূল ও কিয়ামতের প্রতি ঈমান একসাথে থাকতে হবে; একটিকে অস্বীকার করলে সবকিছু অস্বীকার হয়ে যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি সেই নবীগণের মধ্যে যারা একই ধর্মের, আর নবীদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪৩; সহিহ মুসলিম ২৩৬৫) আরও বলেন— “যে ব্যক্তি ঈসা (আঃ)-কে অবিশ্বাস করে, অথচ আমাকে বিশ্বাস করে, সে মুমিন নয়; বরং সে কুফরি করেছে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪৪; সহিহ মুসলিম ১৫৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কিছু আধুনিক গোষ্ঠী বলে, “সব ধর্মই সত্য” — অথচ আল্লাহ বলেন, “ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম।” (আল-ইমরান ৩:১৯)
- কেউ কুরআন মানে কিন্তু হাদিস অস্বীকার করে — তার অবস্থাও এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
- আজ কিছু লোক ইসলামকে কেবল সংস্কৃতি হিসেবে মানে, কিন্তু শরীয়তের আইন অস্বীকার করে — এটি ঈমান ও কুফরের মাঝামাঝি অবস্থান, যা আল্লাহ অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করেছেন।
- আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ ঈমানই গ্রহণযোগ্য, আংশিক নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫০):
- আল্লাহ ও তাঁর সমস্ত রসূলগণের প্রতি পূর্ণ ঈমান আনাই প্রকৃত ঈমান।
- একজন নবীকে অস্বীকার করা মানে সব নবীকেই অস্বীকার করা।
- “মধ্যপন্থা” বা আংশিক ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
- ইসলাম কোনো সমঝোতার ধর্ম নয় — এটি আল্লাহর নির্ধারিত একমাত্র সত্য পথ।
- যে ইসলাম ও সুন্নাহকে একসাথে মেনে চলে, সে-ই প্রকৃত মুমিন।
পূর্ববর্তী আয়াত (৪:১৫০)-এ আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছিলেন সেইসব লোকদের, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে বিভেদ ঘটাতে চায় — অর্থাৎ কিছু নবীকে মানে, কিছু নবীকে অস্বীকার করে। এখানে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন — **তারা প্রকৃত কাফের**, তাদের ঈমানের কোনো মূল্য নেই। 🔹 **“أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا”** — অর্থাৎ তারা নিঃসন্দেহে প্রকৃত অবিশ্বাসী, কারণ তারা ঈমানের মূল ভিত্তি — আল্লাহর সব রসূলের প্রতি বিশ্বাস — তা অস্বীকার করেছে। 🔹 **“وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا”** — অর্থাৎ আল্লাহ কাফেরদের জন্য এমন এক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন, যা লাঞ্ছনাকর, অপমানজনক ও চিরস্থায়ী। এটি শুধু আগুনের কষ্ট নয়, বরং সেখানে থাকবে অপমান, নিঃসঙ্গতা ও অনুতাপের জ্বালা। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে, “আংশিক ঈমান” বা “নির্বাচিত বিশ্বাস” ঈমান নয়। আল্লাহ ও তাঁর সকল রসূলের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসই ইসলাম।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ, এবং নবীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করো না।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪২; সহিহ মুসলিম ২৩৬৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্যে কেউকে কাফের বলে ডাকে, অথচ সে কাফের নয়, তবে সেই দোষ ডেকে আনে ডাকার ওপর।” (📖 সহিহ বুখারী ৬১০৪; সহিহ মুসলিম ৬০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেকে বলে — “আমরা আল্লাহকে মানি, কিন্তু নবীদের কথা মানতে হবে না।” এই চিন্তাধারা ঠিক সেই কুফর, যার কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে।
- কেউ কুরআন মানে কিন্তু হাদিস অস্বীকার করে — সেও এই আয়াতের সতর্কতার আওতায় পড়ে।
- অনেকে ধর্মকে ব্যক্তিগত পছন্দের মতো করে নিয়েছে — কিছু অংশ মানে, কিছু অংশ ফেলে দেয় — অথচ ইসলাম সম্পূর্ণ দীন।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় — ঈমান কোনো অর্ধেক প্রতিশ্রুতি নয়; এটি পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫১):
- আল্লাহ ও তাঁর সব রসূলগণের প্রতি পূর্ণ ঈমানই প্রকৃত ঈমান।
- আংশিক বিশ্বাস বা মধ্যপন্থা আল্লাহর কাছে কুফর।
- কাফেরদের জন্য রয়েছে অপমানজনক ও স্থায়ী শাস্তি।
- হৃদয় ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই ঈমান সম্পূর্ণ হওয়া চাই।
- ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করলেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
আগের আয়াতে (৪:১৫১) বলা হয়েছিল — যারা আল্লাহ ও রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করে, তারা প্রকৃত কাফের। আর এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিপরীতে বলেছেন — **যারা আল্লাহ ও তাঁর সব রসূলের প্রতি পূর্ণ ঈমান এনেছে**, তারাই প্রকৃত মুমিন। 🔹 **“آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ”** — অর্থাৎ তারা আল্লাহ, তাঁর কিতাবসমূহ, ফেরেশতা, রসূলগণ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে। 🔹 **“وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ”** — তারা কোনো নবী বা রাসূলের মধ্যে বিভেদ করে না। সকল নবীই আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য বার্তা নিয়ে এসেছেন — এই বিশ্বাসই ইসলামের মৌলিক অংশ। 🔹 **“أُولَئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ”** — আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দেবেন — দুনিয়াতে সম্মান ও হৃদয়ের প্রশান্তি, আর পরকালে জান্নাত ও অশেষ পুরস্কার। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا”** — আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল — অতীতে যদি তারা কোনো ভুলও করে থাকে, আন্তরিক ঈমান ও তওবা দ্বারা আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত মুমিনদের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছে: তারা সম্পূর্ণ ঈমান গ্রহণ করে, আংশিক নয়; তারা আল্লাহ ও সব রসূলকে ভালোবাসে, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় জীবন পরিচালনা করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “নবীগণ একে অপরের ভাই; তাদের ধর্ম এক, কিন্তু শরীয়ত কিছুটা ভিন্ন।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪৩; সহিহ মুসলিম ২৩৬৫) আরও বলেছেন— “যে আমাকে বিশ্বাস করে এবং আমার পূর্ববর্তী নবীদের অস্বীকার করে, সে প্রকৃত মুমিন নয়।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৫৩; তিরমিযী ২৬৪৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ কেউ ইসলাম মানে কিন্তু নবী ﷺ-এর সুন্নাহ মানে না — এটি আংশিক ঈমান, যা এই আয়াতের পরিপন্থী।
- কেউ বলে সব ধর্ম সমান — অথচ আল্লাহ বলেছেন, “ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম।” (আল-ইমরান ৩:১৯)
- যারা কুরআন ও সুন্নাহ দুটিকেই আঁকড়ে ধরে, তারাই প্রকৃত অর্থে ঈমানদার।
- আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত মুমিনদের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত — শর্ত শুধু আন্তরিক বিশ্বাস ও আনুগত্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫২):
- আল্লাহ ও তাঁর সব রসূলের প্রতি পূর্ণ ঈমান আনাই প্রকৃত ঈমান।
- নবীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা কুফরীর কাজ।
- মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে চিরস্থায়ী পুরস্কার।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু — আন্তরিক তওবা সব গুনাহ মুছে দেয়।
- সম্পূর্ণ ইসলাম গ্রহণই জান্নাতের পথ খুলে দেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিস্টানদের) জেদ, অবাধ্যতা ও কুফরী মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। 🔹 **“يَسْأَلُكَ أَهْلُ الْكِتَابِ”** — আহলে কিতাবরা নবী ﷺ-এর কাছে দাবি করেছিল — “তুমি আকাশ থেকে আমাদের জন্য একটি কিতাব নামাও, যাতে আমরা সরাসরি তা দেখতে পারি।” 🔹 **“فَقَدْ سَأَلُوا مُوسَى أَكْبَرَ مِنْ ذَٰلِكَ”** — কিন্তু তারা তো মূসা (আঃ)-এর কাছেও আরও বড় দাবি করেছিল — “আমাদেরকে প্রকাশ্যে আল্লাহ দেখাও।” এটি ছিল তাদের সীমাহীন উদ্ধত আচরণ। 🔹 **“فَأَخَذَتْهُمُ الصَّاعِقَةُ”** — তাদের এই জুলুমের কারণে বজ্রাঘাত (আকাশের বিদ্যুৎ) তাদেরকে আঘাত করে ধ্বংস করেছিল। 🔹 **“ثُمَّ اتَّخَذُوا الْعِجْلَ”** — এরপরও তারা স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও বাছুরকে (একটি পশু) উপাস্য বানিয়েছিল — যা ছিল চরম কুফর ও শিরক। 🔹 **“فَعَفَوْنَا عَنْ ذَٰلِكَ”** — তবুও আল্লাহ তাদেরকে তৎক্ষণাৎ ধ্বংস করেননি, বরং ক্ষমা করেছিলেন। 🔹 **“وَآتَيْنَا مُوسَى سُلْطَانًا مُبِينًا”** — এবং মূসা (আঃ)-কে দিয়েছিলেন স্পষ্ট প্রমাণ, যেমন — লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া, সমুদ্র বিভক্ত হওয়া ইত্যাদি অলৌকিক নিদর্শন। 💠 সারসংক্ষেপে — আহলে কিতাবদের অবিশ্বাস ও জেদ কেবল ইতিহাস নয়, বরং বর্তমান যুগেও তাদের উত্তরাধিকারীরা আল্লাহর বার্তাকে অবমূল্যায়ন করছে। এই আয়াত মুসলমানদের শিক্ষা দেয় — কখনোই ঈমানের ব্যাপারে অহেতুক দাবি ও শর্ত তোলা উচিত নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমার উম্মতও বনী ইসরাঈলের মতো পথ অনুসরণ করবে, একহাত পরিমাণে একহাত, একহাতি পরিমাণে একহাতি।” (📖 সহিহ বুখারী ৭৩২০; সহিহ মুসলিম ২৬৬৯) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “তোমরা পূর্ববর্তীদের মতো অন্ধ অনুসরণ করো না; যদি তারা গর্তে প্রবেশ করে, তোমরাও করবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৬৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ কিছু লোক ইসলাম মানতে চায়, কিন্তু নিজেদের শর্তে — যেন কুরআন তাদের চিন্তার সাথে মানিয়ে চলে!
- অনেকে বলে, “আমরা বিশ্বাস করব যদি অলৌকিক কিছু দেখি।” অথচ কুরআনই সবচেয়ে বড় মুজিজা।
- যারা ইসলামী শিক্ষাকে যুক্তি বা বিজ্ঞান দিয়ে যাচাই করতে চায়, তারা বনী ইসরাঈলের মতো একই পথে হাঁটছে।
- এই আয়াত আমাদের শেখায় — ঈমান হলো আত্মসমর্পণ, শর্তারোপ নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৩):
- আল্লাহর বার্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কুফরের সূচনা।
- ঈমান মানে — দেখা বা শর্ত নয়, বরং বিশ্বাস ও গ্রহণ।
- বনী ইসরাঈলের মতো জেদ ও অবাধ্যতা আল্লাহর ক্রোধ ডেকে আনে।
- আল্লাহ দয়ালু — তিনি অপরাধীদেরও তওবার সুযোগ দেন।
- কুরআন ও রাসূল ﷺ-ই আজকের যুগে মানুষের জন্য চূড়ান্ত নিদর্শন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের সাথে করা অঙ্গীকার ও তাদের অবাধ্যতার কথা স্মরণ করিয়েছেন। তারা এমন জেদি ও অহংকারী ছিল যে, আল্লাহ তাদের উপর পর্বত তুলেও আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন। 🔹 **“وَرَفَعْنَا فَوْقَهُمُ الطُّورَ”** — মূসা (আঃ)-এর সময়ে তূর পাহাড়কে তাদের উপরে উত্তোলন করা হয়েছিল, যাতে তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য না করে এবং কিতাব মানতে বাধ্য হয়। 🔹 **“وَقُلْنَا لَهُمُ ادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا”** — আল্লাহ তাদের বলেছিলেন— “বায়তুল মাকদিসে প্রবেশ করো সিজদা অবস্থায়”, যাতে তারা বিনয় প্রকাশ করে কৃতজ্ঞতা জানায়। কিন্তু তারা আদেশ অমান্য করে বিদ্রূপ করেছিল। 🔹 **“وَقُلْنَا لَهُمْ لَا تَعْدُوا فِي السَّبْتِ”** — শনিবারের দিন কাজ করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল (সাবাথ), তবুও তারা ছলচাতুরীর মাধ্যমে তা লঙ্ঘন করে মাছ ধরত। এর ফলেই তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে (তাদের বানর বানানো হয়)। 🔹 **“وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا”** — আল্লাহ তাদের কাছ থেকে একটি কঠিন অঙ্গীকার নিয়েছিলেন — যে তারা শুধু তাঁরই উপাসনা করবে, সত্যে অটল থাকবে, এবং নবীদের অনুসরণ করবে। কিন্তু তারা সব ভঙ্গ করেছিল। 💠 সারসংক্ষেপে — বনী ইসরাঈলের ইতিহাস এক সতর্কবার্তা: চুক্তি ভঙ্গ, অবাধ্যতা ও হালাল-হারামের সাথে খেলা করার পরিণতি ভয়াবহ। মুসলমানদের জন্য এই আয়াতে শিক্ষা রয়েছে — আল্লাহর আদেশের সাথে কোনো চালাকি করা চলবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা বনী ইসরাঈলের মতো পথ অনুসরণ করবে, এক হাতের পর এক হাত, এক বুড়ো আঙুলের পর এক বুড়ো আঙুল।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৫৬; সহিহ মুসলিম ২৬৬৯) আরেক হাদিসে তিনি বলেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশকে অবজ্ঞা করে বা তা পরিবর্তন করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (📖 সহিহ মুসলিম ১১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মুসলমানও কুরআনের আদেশকে মানে না, বরং নিজের সুবিধামতো পরিবর্তন করে।
- যারা ইসলামী আইনকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিগত যুক্তি দিয়ে চলে, তারা বনী ইসরাঈলের পথ অনুসরণ করছে।
- শনিবারে সীমালঙ্ঘনের মতোই, আজ অনেকে হারামকে “চালাকিতে হালাল” বানিয়ে নিচ্ছে।
- আল্লাহর সাথে করা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ঈমানের জন্য মারাত্মক হুমকি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৪):
- আল্লাহর আদেশ মানা ছলচাতুরীর জায়গা নয়।
- অঙ্গীকার রক্ষা করা ঈমানের মৌলিক অংশ।
- আল্লাহর দয়া ও শাস্তি— দুটোই বাস্তব ও ন্যায়সঙ্গত।
- চলতি জীবনে হালাল-হারামের সীমানা সম্মান করা জরুরি।
- বনী ইসরাঈলের ইতিহাস মুসলমানদের জন্য সতর্কবার্তা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের একাধিক গুরুতর অপরাধের কথা উল্লেখ করেছেন, যার কারণে তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং তাদের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করে না। 🔹 **“فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِيثَاقَهُمْ”** — তারা বারবার আল্লাহর সাথে করা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। আল্লাহর আদেশ মানার অঙ্গীকার করেও তারা অমান্য করেছে। 🔹 **“وَكُفْرِهِمْ بِآيَاتِ اللَّهِ”** — তারা আল্লাহর নিদর্শন ও কিতাবসমূহকে অস্বীকার করেছিল, যেমন — তাওরাতের শিক্ষা ও মূসা (আঃ)-এর মুজিজাগুলো। 🔹 **“وَقَتْلِهِمُ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ”** — তারা নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে — যেমন ইয়াহইয়া (আঃ) ও জাকারিয়া (আঃ)-কে। 🔹 **“وَقَوْلِهِمْ قُلُوبُنَا غُلْفٌ”** — তারা বলত, “আমাদের হৃদয় ঢাকা (আমরা কিছুই শুনতে পাই না)।” অর্থাৎ তারা সত্য গ্রহণে অস্বীকার করত এবং নিজেদের অজ্ঞতাকে গর্ব হিসেবে উপস্থাপন করত। 🔹 **“بَلْ طَبَعَ اللَّهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ”** — আল্লাহ তাদের কুফরির কারণে তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন — অর্থাৎ তাদের অন্তর এখন আর সত্য গ্রহণ করতে সক্ষম নয়। 🔹 **“فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلَّا قَلِيلًا”** — তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক লোকই ঈমান এনেছিল — যেমন, কিছু মানুষ যারা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত আল্লাহর কঠোর ন্যায়বিচার ও সতর্কবার্তা বহন করে: যারা চুক্তি ভঙ্গ, কুফরি ও নবীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তাদের হৃদয় আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি জ্ঞান লাভের পরও অহংকার করে, আল্লাহ তার হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৫৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যখন বান্দা বারবার গুনাহ করে এবং তওবা করে না, তখন তার হৃদয়ে এক কালো দাগ পড়ে; ক্রমে সেটি পুরো হৃদয়কে ঢেকে দেয়।” (📖 তিরমিযী ৩৩৩৪; সহিহ হাদিস)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ বারবার আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে — নামাজ, সততা, বা হারাম ত্যাগের অঙ্গীকার করে আবার লঙ্ঘন করে।
- কারও কারও অন্তর এত পাথর হয়ে গেছে যে, কুরআনের কথা শুনলেও হৃদয় নরম হয় না।
- যারা আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে ঠাট্টা করে, তাদের হৃদয়ে “মোহর” পড়ে যাওয়া শুরু হয়।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় — আল্লাহর প্রতি উদাসীনতা ধীরে ধীরে ঈমান নষ্ট করে দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৫):
- আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার রক্ষা করা ঈমানের শর্ত।
- আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকার করা বড় কুফরি।
- নবীদের অবমাননা বা বিরোধিতা কঠিন গুনাহ।
- বারবার পাপ করলে হৃদয় ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যায়।
- আল্লাহর রহমত থেকে বাঁচতে চাইলে হৃদয়কে তওবা ও দীনির আলোয় নরম করতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের আরেকটি জঘন্য অপরাধের কথা উল্লেখ করেছেন — তারা মরিয়ম (আলাইহাস সালাম)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়ে চরম সীমা অতিক্রম করেছিল। 🔹 **“وَبِكُفْرِهِمْ”** — তাদের কুফর অর্থাৎ নবীদের অস্বীকার, আল্লাহর নিদর্শন অমান্য করা এবং অহংকার। 🔹 **“وَقَوْلِهِمْ عَلَىٰ مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا”** — তারা মরিয়ম (আঃ)-এর উপর এমন মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল যা ছিল ভয়ংকর অপরাধ। তারা বলেছিল যে, মরিয়ম (আঃ) নাকি অপবিত্র কাজ করেছেন — (আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন)। অথচ তিনি ছিলেন সর্বাধিক পবিত্র নারীদের একজন, যাকে আল্লাহ নিজ হাতে পবিত্র করে নির্বাচন করেছিলেন। 💠 এই অপবাদ ছিল বনী ইসরাঈলের জেদ, কুফরি ও ঈর্ষার ফল। তারা ঈসা (আঃ)-এর অলৌকিক জন্ম মেনে নিতে পারেনি, তাই মরিয়ম (আঃ)-কে দোষারোপ করেছিল। 🔹 আল্লাহ তাআলা কুরআনে অন্যত্র বলেছেন — “এবং (স্মরণ করো) যখন ফেরেশতারা বলেছিল, ‘হে মরিয়ম! আল্লাহ তোমাকে বেছে নিয়েছেন, তোমাকে পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের সকল নারীর উপর তোমাকে শ্রেষ্ঠ করেছেন।’” (📖 সূরা আলে ইমরান ৩:৪২) 🔹 ফলে মরিয়ম (আঃ)-এর বিরুদ্ধে বলা এই অপবাদ ছিল শুধু মিথ্যা নয়, বরং এটি ছিল আল্লাহর চিহ্নকে অস্বীকার করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “অনেক পুরুষ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে, কিন্তু নারীদের মধ্যে পরিপূর্ণতা অর্জন করেছেন— মরিয়ম বিনতে ইমরান এবং আসিয়্যা, ফেরাউনের স্ত্রী।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৩২; সহিহ মুসলিম ২৪৩১) আরও বলেন— “মরিয়ম ছিলেন সিদ্দীকাহ (সত্যপরায়ণা), যিনি আল্লাহর বাণীর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৪৪৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক লোক আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ওলিয়াদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয় — ঠিক যেমন বনী ইসরাঈল মরিয়ম (আঃ)-কে দোষারোপ করেছিল।
- সত্য অস্বীকারের প্রবণতা আজও সমাজে দেখা যায় — কেউ হক্ব স্বীকার না করে দোষ অন্যের ওপর চাপায়।
- এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় যে, মিথ্যা অপবাদ একটি বিশাল গুনাহ, যা সমাজ ও ঈমান উভয়কে ধ্বংস করে।
- যারা আল্লাহর নিদর্শন বা প্রিয় বান্দাদের অবমাননা করে, তারা বনী ইসরাঈলের পথ অনুসরণ করছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৬):
- মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ইসলাম অনুযায়ী মারাত্মক গুনাহ।
- মরিয়ম (আঃ) ছিলেন সর্বাধিক পবিত্র ও সম্মানিত নারী।
- ঈর্ষা, অহংকার ও কুফরি মানুষকে মিথ্যাচারের পথে ঠেলে দেয়।
- আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সম্মান করা ঈমানের অংশ।
- অন্যের সম্মানহানি করা আল্লাহর ক্রোধের কারণ হয়।
এই আয়াত ইসলামী আকীদার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন — ঈসা (আলাইহিস সালাম) নিহত হননি এবং ক্রুশবিদ্ধও হননি। 🔹 **“وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ”** — বনী ইসরাঈল অহংকারভরে দাবি করেছিল: “আমরা ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করেছি, যিনি আল্লাহর রাসূল ছিলেন।” তারা গর্ব করেছিল নবী হত্যার মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে। 🔹 **“وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ”** — আল্লাহর জবাব: “তারা তাঁকে না হত্যা করেছে, না ক্রুশে চড়িয়েছে।” খ্রিষ্টানরা মনে করে যে, ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু কুরআন এই ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। 🔹 **“وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ”** — বরং একজন অন্য ব্যক্তি (সম্ভবত ঈসার শত্রু) ঈসা (আঃ)-এর মতো করে দেখানো হয়েছিল, এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে নিরাপদে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। 🔹 **“وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ”** — অর্থাৎ যারা এই ব্যাপারে মতভেদ করেছে — ইহুদি ও খ্রিষ্টান উভয়ই, তারা নিজেরাই জানে না আসলে কী ঘটেছিল। 🔹 **“مَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ”** — তারা কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করে, কিন্তু কোনো প্রকৃত জ্ঞান তাদের নেই। 🔹 **“وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا”** — অর্থাৎ তারা নিশ্চিতভাবে ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করেনি — আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছেন, এবং তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় আকাশে তোলা হয়েছেন। 💠 সারসংক্ষেপে — ইসলাম নিশ্চিতভাবে বলে: ঈসা (আঃ) জীবিত আছেন, তাঁকে হত্যা করা হয়নি, এবং কিয়ামতের পূর্বে তিনি পৃথিবীতে পুনরায় অবতীর্ণ হবেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “ঈসা ইবনে মরিয়ম অচিরেই তোমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন, তিনি ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিজিয়া বাতিল করবেন।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪৮; সহিহ মুসলিম ১৫৫) আরও বলেন— “ঈসা (আঃ) ন্যায়বিচারের সাথে শাসন করবেন, এবং ইসলাম ব্যতীত আর কোনো ধর্ম থাকবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৫৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও খ্রিষ্টান ধর্মে এই ভুল ধারণা প্রচলিত — তারা মনে করে ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
- অন্যদিকে, ইসলাম ঈসা (আঃ)-এর মর্যাদা রক্ষা করেছে, বলেছেন— তিনি নবী, আল্লাহর দাস, এবং এখনো জীবিত আছেন।
- কিছু মুসলিম যুবক পশ্চিমা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে বাইবেলের ভুল ধারণা বিশ্বাস করতে শুরু করে — অথচ কুরআন তা পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করেছে।
- এই আয়াত বিশ্বাসীর জন্য ঈমানের পরীক্ষা — সে আল্লাহর বাণী মানবে, না মানুষের বানানো গল্প?
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৭):
- ঈসা (আঃ) নবী ছিলেন — তিনি আল্লাহর দাস, আল্লাহর পুত্র নন।
- ঈসা (আঃ)-কে না হত্যা করা হয়েছে, না ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে।
- মানুষের অনুমান নয়, আল্লাহর বাণীই সত্য ও নিশ্চিত জ্ঞান।
- কিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আঃ) পুনরায় অবতীর্ণ হবেন — এটি ইসলামী বিশ্বাস।
- সত্যের বিরোধিতা অহংকারের কারণে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে।
এই আয়াতটি আগের আয়াতের (৪:১৫৭) সত্যিকারের ব্যাখ্যা এবং পরিপূর্ণতা প্রকাশ করে। আল্লাহ তাআলা এখানে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন — ঈসা (আলাইহিস সালাম) নিহত হননি, বরং জীবিত অবস্থায় আল্লাহ তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। 🔹 **“بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ”** — অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই তাঁকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন, অর্থাৎ সম্মান ও সুরক্ষার সঙ্গে, আসমানে। এটি আল্লাহর বিশেষ করুণা ও মর্যাদা। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا”** — আল্লাহ পরাক্রমশালী — কেউ তাঁর আদেশ রোধ করতে পারে না, এবং তিনি প্রজ্ঞাময় — যা করেন তা সম্পূর্ণ ন্যায় ও হিকমতের সাথে করেন। 💠 এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলাম নিশ্চিত করে যে — ঈসা (আঃ) এখনো জীবিত, তিনি আল্লাহর আদেশে পুনরায় পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন, এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন, এবং ইসলামী শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করবেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “ঈসা ইবনে মরিয়ম অবশ্যই তোমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন; তিনি ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন, জিজিয়া (কর) বাতিল করবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪৮; সহিহ মুসলিম ১৫৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “ঈসা (আঃ) অবতীর্ণ হবেন দামেস্কের পূর্বদিকে সাদা মিনারে, দুটি হালকা হলুদ পোশাক পরিহিত অবস্থায়, তাঁর চুল থেকে পানি ঝরবে যদিও তিনি ভেজা থাকবেন না।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৫৫; ইবন মাজাহ ৪০৭৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ এই সত্য নিয়ে সন্দেহ করে, যেমন খ্রিষ্টানরা বলে ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
- কিন্তু কুরআন ও হাদিস উভয়ই স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে — ঈসা (আঃ) জীবিত, তিনি পুনরায় আসবেন।
- আধুনিক “বিজ্ঞানমনা” লোকেরা বলে, আকাশে ওঠা সম্ভব নয় — কিন্তু তারা ভুলে যায়, আল্লাহর শক্তি মানববুদ্ধির ঊর্ধ্বে।
- এই আয়াত ঈমানদারদের শেখায় — আল্লাহ যাকে ইজ্জত দিতে চান, তাঁকে কেউ হেয় করতে পারে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৮):
- ঈসা (আঃ) জীবিত, তাঁকে আল্লাহ সম্মানসহ আকাশে উঠিয়েছেন।
- আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা কেউ করতে পারে না।
- আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় — তাঁর প্রতিটি কাজ হিকমতপূর্ণ।
- এই আয়াত ঈসা (আঃ)-এর মর্যাদা ও আল্লাহর শক্তির প্রমাণ।
- বিশ্বাসীরা অদেখা বিষয়েও আল্লাহর বাণীর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা একটি ভবিষ্যদ্বাণী ঘোষণা করেছেন, যা আজও সত্য — এবং কিয়ামতের আগে তা পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে। 🔹 **“وَإِن مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ”** — অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে এমন কেউ থাকবে না, যে মৃত্যুর আগে ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করবে না। 🔹 **“إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ”** — মুফাসসিরগণ বলেন — এখানে “তার মৃত্যু” বলতে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যখন ঈসা (আঃ) কিয়ামতের আগে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, তখন আহলে কিতাবদের সবাই বুঝে যাবে যে ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও নবী, আল্লাহর পুত্র নন। কিছু তাফসীর মতে — এখানে “তার মৃত্যু” বলতে প্রত্যেক আহলে কিতাব ব্যক্তির মৃত্যুকেই বোঝানো হয়েছে; অর্থাৎ মৃত্যুর মুহূর্তে সবাই ঈসা (আঃ)-এর সত্যতা বুঝবে, কিন্তু তখন তওবার সুযোগ আর থাকবে না। 🔹 **“وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا”** — অর্থাৎ কিয়ামতের দিনে ঈসা (আঃ) সাক্ষ্য দেবেন — “হে আল্লাহ! আমি তাঁদের কাছে তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমার পরে ভ্রষ্টতা বেছে নিয়েছিল।” 💠 সারসংক্ষেপে — ইসলাম স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, ঈসা (আঃ) জীবিত আছেন, এবং কিয়ামতের আগে ফিরে আসবেন, তখন আহলে কিতাবদের সবাই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে — তবে তা তখন ঈমান হিসেবে গৃহীত হবে না, কারণ তওবার দরজা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “ঈসা ইবনে মরিয়ম অবশ্যই অবতীর্ণ হবেন, তারপর আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন কেউ থাকবে না যে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে না।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৪৮; সহিহ মুসলিম ১৫৫) আরও বলেন— “ঈসা (আঃ) ন্যায়বিচার করবেন, তিনি পৃথিবীকে শান্তি ও ন্যায়ে পূর্ণ করবেন যেমন তা একসময় অন্যায়ে পূর্ণ ছিল।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৫৫; ইবন মাজাহ ৪০৭৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও বহু খ্রিষ্টান ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করে, অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে তাঁর নবুওয়াত ও মানবত্ব ঘোষণা করেছে।
- কিয়ামতের আগে যখন ঈসা (আঃ) অবতীর্ণ হবেন, তখন এই ভুল ধারণা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে।
- আজ মুসলমানদের উচিত ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা — তিনি নবী, আল্লাহর দাস, এবং ইসলামের অংশ।
- এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যের সামনে মিথ্যা টিকতে পারে না — হয় এই দুনিয়ায়, নয়তো মৃত্যুর আগে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫৯):
- ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনাই প্রকৃত ঈমানের অংশ।
- কিয়ামতের আগে আহলে কিতাবের সবাই তাঁর সত্যতা মেনে নেবে।
- তবে মৃত্যুর সময় বা কিয়ামতের আগে আনা ঈমান তখন আর গৃহীত হবে না।
- ঈসা (আঃ) কিয়ামতের দিনে সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াবেন — কারা সত্য মেনে নিয়েছিল, আর কারা অস্বীকার করেছিল।
- আল্লাহর বার্তা অস্বীকার করে কেউ চিরকাল টিকে থাকতে পারবে না।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের (ইহুদিদের) উপর আরোপিত শাস্তির কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের জুলুম, অহংকার ও অন্যদের পথভ্রষ্ট করার কারণে তাদের জন্য কিছু হালাল জিনিসও হারাম করে দেওয়া হয়েছিল। 🔹 **“فَبِظُلْمٍ مِّنَ الَّذِينَ هَادُوا”** — ইহুদিরা ছিল অবাধ্য, তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করত, নবীদের হত্যা করত, এবং অহংকারে গোমরাহ হয়ে যেত। এই অন্যায়ই ছিল তাদের শাস্তির মূল কারণ। 🔹 **“حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ”** — আল্লাহ তাদের উপর কিছু পবিত্র (হালাল) খাদ্য নিষিদ্ধ করেন, যেমন — উটের মাংস, কিছু মাছ, চর্বি ইত্যাদি। এটি ছিল তাদের অবাধ্যতার জন্য পার্থিব শাস্তি। 🔹 **“وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا”** — তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরকেও আল্লাহর পথে আসতে বাধা দিত। তারা আল্লাহর রাসূলদের অবমাননা করত, এবং সত্য প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহর আদেশ অমান্য করার শাস্তি শুধু আখিরাতেই নয়, দুনিয়াতেও প্রকাশ পায়। যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয়, তাদের বরকত, রিজিক ও শান্তি কেড়ে নেওয়া হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যখন মানুষ অন্যায় ও পাপকে হালকা মনে করবে, তখন আল্লাহ তাদের থেকে বরকত উঠিয়ে নেবেন।” (📖 তিরমিযী ২১৫২; সহিহ হাদিস) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ফেরায়, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের পথ সহজ করে দেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৮০৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কিছু মুসলমান এমনভাবে জীবনযাপন করছে, যেন তারা নিজেরাই আল্লাহর নির্দেশ পরিবর্তন করতে পারে।
- অনেকে ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি করে, মানুষকে ইসলামের পথ থেকে দূরে রাখে — এরা ইহুদিদের পথ অনুসরণ করছে।
- অন্যায়, হারাম আয়, প্রতারণা ও অহংকারের কারণে আজ আমাদের সমাজ থেকেও বরকত উঠে যাচ্ছে।
- এই আয়াত আমাদের সতর্ক করে — আল্লাহর আইন অমান্য করলে তাঁর দেওয়া নেয়ামতও হারিয়ে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬০):
- অন্যায় ও জুলুম আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তি ডেকে আনে।
- আল্লাহর পথে বাধা দেওয়া সবচেয়ে বড় অপরাধ।
- আল্লাহ হালাল জিনিসও হারাম করে দিতে পারেন, যদি বান্দা অবাধ্য হয়।
- সমাজে ন্যায় ও দীন প্রচারে বাধা দিলে বরকত উঠে যায়।
- আল্লাহর আদেশ অমান্যকারীরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের (ইহুদিদের) আরও দুটি বড় অপরাধের কথা উল্লেখ করেছেন — (১) সুদ খাওয়া, এবং (২) অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করা। 🔹 **“وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ”** — আল্লাহর কিতাবে (তাওরাতে) তাদের সুদ খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা তাতে লিপ্ত হয়েছিল। তারা সুদকে বৈধ করার নানা ছলচাতুরী বের করেছিল, যেমন আজ অনেক মুসলিম “ইসলামিক নামে” সুদের ব্যবসা করে। 🔹 **“وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ”** — তারা অন্যদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করত, প্রতারণা, ঘুষ, মিথ্যা চুক্তি, এবং ধর্মীয় নামে ধোঁকা দিত। তারা গরীবদের হক নষ্ট করত এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করত। 🔹 **“وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا”** — যারা এইসব অপরাধে লিপ্ত হয়ে ঈমানহীন অবস্থায় মারা যাবে, আল্লাহ তাদের জন্য পরকালে কঠিন ও বেদনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করেছেন। 💠 সারসংক্ষেপে — ইসলাম ঘোষণা করেছে: “সুদ মানে অন্যের কষ্টের উপর নিজের সম্পদ বৃদ্ধি।” এটি শুধু আর্থিক অপরাধ নয়, এটি আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমান।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “সাতটি ধ্বংসাত্মক গুনাহ থেকে বাঁচো।” সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী?’ তিনি বললেন— “শিরক করা, জাদু করা, কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো, এবং পবিত্র নারীদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া।” (📖 সহিহ বুখারী ২৭৬৬; সহিহ মুসলিম ৮৯) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেন— “সুদখোর, সুদদাতা, দলিললেখক ও সাক্ষী — এদের সবাই সমান গুনাহে দোষী।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৫৯৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ বিশ্বব্যাপী সুদের অর্থনীতি চলছে, যা মানুষের পরিশ্রমের বিনিময়ে অন্যের সম্পদ টেনে নিচ্ছে।
- অনেকে “ইসলামিক ব্যাংকিং” নামে চাতুরীর মাধ্যমে সুদকে বৈধ করার চেষ্টা করছে।
- মানুষ অন্যের হক নষ্ট করছে, প্রতারণা করছে, কিন্তু ভাবে — “এটা তো বুদ্ধিমত্তা!” অথচ আল্লাহর দৃষ্টিতে এটি জুলুম।
- এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, হালাল উপার্জনই প্রকৃত বরকতের উৎস।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬১):
- সুদ খাওয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করা জুলুমের শামিল।
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি অনিবার্য।
- চালাকি বা “ইসলামি নাম” দিয়ে হারামকে হালাল করা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
- ন্যায়পরায়ণতা ও হালাল উপার্জনই প্রকৃত ঈমানদারের চিহ্ন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক শ্রেণির নেক ও আল্লাহভীরু মানুষকে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আগের আয়াতগুলোতে ইহুদিদের অপরাধের কথা বলা হলেও, এখানে বলা হয়েছে — সবাই সমান নয়; কিছু লোক সত্যিই সৎ ও ঈমানদার ছিল। 🔹 **“لَٰكِنِ الرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ”** — অর্থাৎ যারা গভীর জ্ঞানসম্পন্ন, সত্যের ওপর দৃঢ় — যারা তাওরাত ও ইনজিলের প্রকৃত শিক্ষা বুঝে ঈমান গ্রহণ করেছে। 🔹 **“يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ”** — তারা বিশ্বাস করে কুরআনের প্রতি, এবং তোমার পূর্বে নাযিলকৃত গ্রন্থসমূহের (তাওরাত, যাবুর, ইনজিল) প্রতিও। অর্থাৎ তারা নবী ও গ্রন্থের পার্থক্য না করে, সব নবীর প্রতি বিশ্বাস রাখে। 🔹 **“وَالْمُقِيمِينَ الصَّلَاةَ وَالْمُؤْتُونَ الزَّكَاةَ”** — তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে; অর্থাৎ তাদের ঈমান শুধু মুখের নয়, কর্মেও প্রকাশ পায়। 🔹 **“وَالْمُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ”** — তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। এটাই প্রকৃত ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য। 🔹 **“أُوْلَئِكَ سَنُؤْتِيهِمْ أَجْرًا عَظِيمًا”** — আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন — এদের জন্য রয়েছে মহান প্রতিদান, জান্নাতে চিরস্থায়ী সুখ ও মর্যাদা। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহ মানুষকে কখনো বংশ, জাতি বা উপাধি দিয়ে বিচার করেন না; বরং ঈমান, জ্ঞান, আমল ও ন্যায়নিষ্ঠতার ভিত্তিতেই মর্যাদা নির্ধারণ করেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালীন দিবসে ঈমান রাখে, সে যেন সত্য কথা বলে অথবা নীরব থাকে।” (📖 সহিহ বুখারী ৬১৩৬; সহিহ মুসলিম ৪৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “সবচেয়ে উত্তম মানুষ তারা, যারা জ্ঞান অর্জন করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে।” (📖 তিরমিযী ২৬৮২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মুসলমানদের মধ্যে এমন আলেম ও মুত্তাকী রয়েছেন, যারা কুরআন–সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেন।
- অন্যদিকে, অনেকেই নামমাত্র মুসলিম — নামাজ ও যাকাত থেকে দূরে সরে গিয়েছে।
- এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়: প্রকৃত জ্ঞান সেই, যা ঈমান ও আমলে প্রতিফলিত হয়।
- বংশ বা পরিচয় নয়, বরং ঈমানই মর্যাদার মানদণ্ড।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬২):
- জ্ঞানে দৃঢ় ও ঈমানদার ব্যক্তিরাই প্রকৃত সম্মানিত।
- কুরআন ও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে ঈমান আনা নবুয়াতের প্রতি বিশ্বাসের অংশ।
- নামাজ ও যাকাত ঈমানের দৃশ্যমান প্রমাণ।
- আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসই ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের ভিত্তি।
- আল্লাহ তাদের জন্য বিশাল পুরস্কার রেখেছেন যারা জ্ঞান ও ঈমানের সমন্বয় ঘটায়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মদ ﷺ–এর নবুওয়াতকে পূর্ববর্তী নবীদের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আল্লাহর বাণী ওহির মাধ্যমে যেমন পূর্ববর্তী নবীদের কাছে পৌঁছেছে, তেমনি কুরআনও ওহির মাধ্যমেই তাঁর প্রিয় রাসূল ﷺ–এর কাছে এসেছে। 🔹 **“إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ”** — অর্থাৎ, হে মুহাম্মদ ﷺ, তোমার উপর নাযিলকৃত কুরআন কোনো নতুন কথা নয়, বরং এটি পূর্ববর্তী নবুয়াতের ধারাবাহিকতার অংশ। 🔹 **“كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِن بَعْدِهِ”** — নূহ (আঃ) প্রথম রাসূল যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ ওহির মাধ্যমে দীন প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর যত নবী এসেছেন — সবাই একই তাওহিদের বার্তা প্রচার করেছেন। 🔹 **উল্লিখিত নবীগণ:** - **ইবরাহিম (আঃ)** — তাওহিদের দাওয়াতের প্রতীক। - **ইসমাইল (আঃ)** — কুরবানি ও আনুগত্যের দৃষ্টান্ত। - **ইসহাক ও ইয়াকুব (আঃ)** — বরকতময় বংশের পিতা। - **ঈসা (আঃ)** — অলৌকিক জন্মের অধিকারী ও রহমতের প্রতীক। - **আইয়ুব (আঃ)** — ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের প্রতীক। - **ইউনুস (আঃ)** — তওবা ও দোয়ার প্রতীক। - **হারুন (আঃ)** — মূসা (আঃ)-এর সহযোগী নবী। - **সুলাইমান (আঃ)** — ন্যায়পরায়ণ রাজা নবী। - **দাউদ (আঃ)** — যাঁর কাছে আল্লাহ যবূর নাযিল করেছিলেন। 💠 সারসংক্ষেপে — কুরআনের ওহি ও পূর্ববর্তী নবীদের ওহি একই উৎস থেকে এসেছে — আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই মুহাম্মদ ﷺ–এর দাওয়াত কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং আগের সব নবুয়াতের পূর্ণতা ও পরিসমাপ্তি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমার উদাহরণ ও পূর্ববর্তী নবীদের উদাহরণ হলো এমন একজন মানুষের মতো, যিনি একটি সুন্দর ঘর নির্মাণ করলেন, কিন্তু একটি কোণায় একটি ইটের স্থান ফাঁকা রইল। মানুষ ঘরটি দেখে মুগ্ধ হলো, কিন্তু বলল— ‘এই ফাঁকা ইটটি বসানো হলে ঘরটি সম্পূর্ণ হতো।’ আমি সেই ইট, এবং আমি নবীদের শেষ।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৫৩৫; সহিহ মুসলিম ২২৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ মনে করে ইসলাম নতুন কোনো ধর্ম; অথচ এটি সব নবুয়াতের ধারাবাহিকতা ও পূর্ণতা।
- ইসলামের শিক্ষা পূর্ববর্তী নবীদের বার্তারই পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
- যারা নবীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, তারা ঈমান থেকে দূরে।
- এই আয়াত আমাদের শেখায় — সব নবী একই আল্লাহর দাওয়াতদাতা ছিলেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৩):
- ওহি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের কাছে নাযিল হয় — এটি ঈমানের অংশ।
- নবী মুহাম্মদ ﷺ–এর দাওয়াত পূর্ববর্তী সব নবীর দাওয়াতেরই ধারাবাহিকতা।
- সব নবী একই তাওহিদের বার্তা প্রচার করেছেন।
- দাউদ (আঃ)-কে যবূর দেওয়া হয়েছিল — যা আল্লাহর বাণী।
- যে আল্লাহর ওহির প্রতি ঈমান রাখে, সে নবীদের উত্তরাধিকার বহন করে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবীদের সংখ্যা ও অবস্থানের ব্যাপারে একটি গভীর সত্য প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ বহু নবী পাঠিয়েছেন — কিছু কুরআনে নামসহ উল্লেখিত, আর কিছু নাম উল্লেখ না করেই প্রেরিত হয়েছেন। 🔹 **“وَرُسُلًا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ”** — অর্থাৎ কিছু নবীর ঘটনা আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি, যেমন— নূহ, ইবরাহিম, মূসা, ঈসা, ইউসুফ, ইয়াকুব প্রমুখ। 🔹 **“وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ”** — এমনও অনেক নবী আছেন যাদের নাম বা কাহিনী কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। হাদীস অনুযায়ী, নবীদের সংখ্যা ছিল প্রায় **১,২৪,০০০**, আর রাসূল ছিলেন **৩১৫ জন** (📖 মুসনাদ আহমদ ২১২৫৭)। 🔹 **“وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا”** — মূসা (আঃ) ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নবী, যিনি আল্লাহর সাথে সরাসরি (ওহি ছাড়া) কথা বলার মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তাই তাঁর উপাধি হলো — **“কালিমুল্লাহ”** (যিনি আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন)। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহর নবী ও রাসূলদের সংখ্যা অসংখ্য, তবে তাঁদের সকলের দাওয়াত ছিল এক — “আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না।” এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, ইসলাম সব নবীকে সম্মান করে, কোনো নবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “নবীদের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজার, এবং রাসূলদের সংখ্যা তিন শত পনের।” (📖 মুসনাদ আহমদ ২১২৫৭ — হাসান হাদিস) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেন— “মূসা (আঃ)-এর প্রতি আল্লাহ সরাসরি কথা বলেছেন, কিন্তু আমার প্রতি কথা বলেছেন ওহির মাধ্যমে।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৭৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ শুধুমাত্র কিছু নবীকে মানে, কিন্তু অন্য নবীদের অস্বীকার করে — অথচ এটি ঈমান ভঙ্গের কারণ।
- যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে মানে কিন্তু মুহাম্মদ ﷺ-কে মানে না।
- ইসলাম শেখায় — সব নবীই সত্য, তাঁরা সবাই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত।
- আধুনিক যুগেও কিছু মানুষ ‘নবুয়াত’ দাবি করে — অথচ নবুয়াত মুহাম্মদ ﷺ-এ সমাপ্ত হয়েছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৪):
- সব নবী ও রাসূলই আল্লাহর প্রেরিত, তাঁদের মধ্যে বিভেদ করা যাবে না।
- মূসা (আঃ) আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলার সম্মান লাভ করেছিলেন।
- সব নবীর দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল এক — তাওহিদ।
- কুরআনে উল্লিখিত নবীরা সামগ্রিক নবুয়াতের প্রতিনিধি।
- ইসলাম সর্বজনীন — এটি সব নবুয়াতের পূর্ণতা।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবীদের প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন — তারা মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করেন এবং ভ্রষ্টতা থেকে সতর্ক করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে “হুজ্জত” বা যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে কেউ কিয়ামতের দিন বলতে না পারে — “আমরা তো জানতাম না।” 🔹 **“رُسُلًا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ”** — নবীগণ ছিলেন দুই দায়িত্বের বাহক: (১) ঈমানদারদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী, (২) অবিশ্বাসীদের জন্য শাস্তির সতর্কবাণী প্রদানকারী। 🔹 **“لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ”** — আল্লাহ কাউকেই অযথা শাস্তি দেন না। প্রতিটি জাতির কাছে রাসূল পাঠানো হয়েছে, যাতে তাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছায়। এর পরে কেউ অজুহাত দেখাতে পারবে না। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا”** — আল্লাহ পরাক্রমশালী — তাঁর আদেশ অমান্য করা অসম্ভব, এবং তিনি প্রজ্ঞাময় — প্রতিটি আদেশের পেছনে হিকমত রয়েছে। 💠 সারসংক্ষেপে — নবুয়াত আল্লাহর রহমতের প্রতিফলন। নবীরা মানুষকে পথ দেখান, যাতে কেউ অজুহাত দিতে না পারে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি এসেছি সেই কাজ সম্পূর্ণ করতে, যা পূর্ববর্তী নবীরা অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিলেন।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৫৩৫; সহিহ মুসলিম ২২৮৬) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেন— “প্রত্যেক নবী তাঁর জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি।” (📖 সহিহ মুসলিম ৫২২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ নানা অজুহাত দেয় — “আমরা জানতাম না, শুনিনি।” কিন্তু কুরআন ও নবীর দাওয়াত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
- মিডিয়া, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যুগে আল্লাহর বাণী লুকানোর সুযোগ নেই।
- তবুও যারা সত্য শুনেও মানে না, তাদের জন্য কিয়ামতের দিনে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।
- নবীদের মিশন আজও অব্যাহত — দাঈ ও আলেমগণ সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৫):
- নবীদের প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সতর্ক করা ও পথ দেখানো।
- আল্লাহ কখনো কাউকে অজ্ঞতার ভিত্তিতে শাস্তি দেন না।
- সত্য জেনে অস্বীকার করাই প্রকৃত কুফরি।
- দাঈ ও আলেমদের কাজ নবীদের মিশনের ধারাবাহিকতা।
- আল্লাহর ন্যায়বিচার পরিপূর্ণ — কারো জন্য কোনো অজুহাত থাকবে না।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, কুরআন হলো তাঁরই পক্ষ থেকে অবতীর্ণ একটি নিখুঁত ও সত্য বাণী। এর সত্যতার সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ, ফেরেশতারা এবং ইতিহাসের বাস্তবতা। 🔹 **“لَّٰكِنِ اللَّهُ يَشْهَدُ بِمَا أَنزَلَ إِلَيْكَ”** — অর্থাৎ হে নবী ﷺ, মানুষের অস্বীকার বা সন্দেহ কোনো ব্যাপার নয়, আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, এই কুরআন তাঁরই বাণী, যা তিনি তোমার উপর নাযিল করেছেন। 🔹 **“أَنزَلَهُ بِعِلْمِهِ”** — কুরআন আল্লাহর সর্বজ্ঞ জ্ঞানের ভিত্তিতে নাযিল হয়েছে; এতে এমন কোনো কথা নেই যা আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে। প্রতিটি আয়াত তাঁর হিকমত, ন্যায়বিচার ও জ্ঞানের প্রতিফলন। 🔹 **“وَالْمَلَائِكَةُ يَشْهَدُونَ”** — অর্থাৎ ফেরেশতারাও সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, কুরআন সত্য — কারণ তারা ওহি নাযিলের সাক্ষী ছিল। জিবরাঈল (আঃ) কুরআন সরাসরি নবী ﷺ-এর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। 🔹 **“وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا”** — আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট প্রমাণ যে, কুরআন সত্য এবং নবী ﷺ আল্লাহর রাসূল। মানুষের সন্দেহ বা অস্বীকার কুরআনের মর্যাদা কমাতে পারে না। 💠 সারসংক্ষেপে — কুরআনের সত্যতার জন্য মানুষের প্রমাণের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর সাক্ষ্য, ফেরেশতাদের সাক্ষ্য, এবং এর অলৌকিক ভাষা ও বার্তাই যথেষ্ট প্রমাণ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “কুরআন আল্লাহর বাণী, যে তা মানুষের কথা মনে করে, সে কাফের।” (📖 সহিহ মুসলিম ৮০৪) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেন— “কুরআন আমার জন্য সাক্ষ্য দেবে বা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ৮০৪; তিরমিযী ২৯১৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ কুরআনের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করে, অথচ আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন এর সত্যতার ব্যাপারে।
- বিজ্ঞান, ইতিহাস ও মানবচেতনা — সবকিছুই কুরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করে চলেছে।
- কুরআনের ভাষা, বাণী ও ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আজও অক্ষত অবস্থায় সত্য প্রমাণ করছে।
- যারা কুরআনের দাওয়াত গ্রহণ করে, তারা আল্লাহর সাক্ষ্যকে সম্মান করছে; আর যারা অস্বীকার করে, তারা নিজেরাই আল্লাহর সাক্ষ্যের বিরোধিতা করছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৬):
- কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এবং তাঁর জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
- আল্লাহ নিজেই কুরআনের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
- ফেরেশতারাও ওহির সত্যতার সাক্ষী।
- মানুষের অস্বীকার কুরআনের মর্যাদা কমাতে পারে না।
- বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষ্যকেই যথেষ্ট মনে করে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সেইসব লোকদের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা শুধু নিজেরাই কুফরি করে না, বরং অন্যদেরও আল্লাহর পথে চলতে বাধা দেয়। তারা শুধু বিভ্রান্ত নয়, বরং এমন ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত যা থেকে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। 🔹 **“إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا”** — অর্থাৎ যারা সত্য অস্বীকার করে, নবী ﷺ ও কুরআনের বিরোধিতা করে। 🔹 **“وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ”** — তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়ে অন্যদেরও বিভ্রান্ত করে, ইসলাম প্রচারে বাধা দেয়, সত্য প্রচারকারীদের নির্যাতন করে। মক্কার কাফের নেতারা যেমন নবী ﷺ-কে বাধা দিতেন এবং মানুষকে ইসলামের দাওয়াত থেকে দূরে রাখতেন। 🔹 **“قَدْ ضَلُّوا ضَلَالًا بَعِيدًا”** — অর্থাৎ তারা এমন ভ্রষ্টতায় পড়েছে যা সাধারণ নয়, বরং অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে গেছে। তাদের অন্তর সত্য থেকে এত দূরে সরে গেছে যে, এখন আল্লাহর হেদায়েতও তাদের কাছে পৌঁছায় না। 💠 সারসংক্ষেপে — নিজের কুফরি ও অন্যকে বাধা দেওয়া আল্লাহর কাছে দ্বিগুণ অপরাধ। এমন মানুষ দুনিয়াতেও অন্ধ এবং আখিরাতেও পরাজিত হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি সৎ কাজে আহ্বান করবে, সে তার অনুসারীদের মতোই পুরস্কার পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের দাওয়াত দেবে, সে তার অনুসারীদের মতোই গুনাহ পাবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৬৭৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও এমন লোক আছে যারা ইসলামের শিক্ষাকে বিকৃত করে, মুসলমানদের কুরআন থেকে দূরে রাখে।
- কেউ নাস্তিকতা, কেউ ‘মডার্ন চিন্তা’ নামে আল্লাহর পথে বাধা দিচ্ছে।
- কিছু মিডিয়া ও নেতা মানুষকে ইসলামের বদলে জাহিল সংস্কৃতিতে নিমগ্ন করছে।
- যে আল্লাহর পথে বাধা দেয়, সে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৭):
- যারা কুফরি করে ও অন্যদের আল্লাহর পথে বাধা দেয়, তারা সবচেয়ে দূরে ভ্রষ্ট।
- নিজে বিভ্রান্ত হওয়া যেমন গুনাহ, অন্যকে বিভ্রান্ত করা তার চেয়ে বড় অপরাধ।
- ইসলামের দাওয়াত বাধাগ্রস্ত করা মানে আল্লাহর আদেশ অস্বীকার করা।
- হেদায়েতের সুযোগ থাকা অবস্থায় সত্য প্রত্যাখ্যান করলে হৃদয় কঠিন হয়ে যায়।
- একজন মুমিনের কাজ — মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা, বাধা দেওয়া নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন — যারা কুফরি করে এবং এর সাথে অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়, তাদের প্রতি আল্লাহর রহমতের দরজা বন্ধ হয়ে যায় যতক্ষণ না তারা তওবা করে। 🔹 **“إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَظَلَمُوا”** — এখানে “কুফরি” মানে হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ–এর প্রতি অবিশ্বাস, আর “জুলুম” মানে হলো অন্যের হক নষ্ট করা, এবং আল্লাহর অধিকার অস্বীকার করা। এই দুই গুনাহ একত্রে হলে তা সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে — কারণ ব্যক্তি তখন শুধু নিজেই বিভ্রান্ত নয়, সমাজেও অন্যায় ছড়ায়। 🔹 **“لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ”** — অর্থাৎ যতক্ষণ তারা তওবা না করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। কারণ ক্ষমা পাওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো — **ঈমান গ্রহণ।** 🔹 **“وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ طَرِيقًا”** — অর্থাৎ আল্লাহ তাদের হেদায়েত দেন না, কারণ তারা নিজেরাই সত্যের পথ ছেড়ে অন্যায়কে বেছে নিয়েছে। 💠 সারসংক্ষেপে — কুফরি ও জুলুম একত্রে হলে তা হেদায়েতের দরজা বন্ধ করে দেয়। আল্লাহ কাউকে জোর করে বিভ্রান্ত করেন না, বরং মানুষ নিজেই যখন অন্যায়ে লিপ্ত হয়, তখন তার হৃদয় থেকে নূর চলে যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যখন কোনো বান্দা গুনাহ করতে থাকে, তখন তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে; যদি সে তওবা করে, সেই দাগ মুছে যায়; আর যদি গুনাহ চালিয়ে যায়, দাগটি ছড়িয়ে তার পুরো হৃদয় ঢেকে ফেলে।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৪৯৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ ঈমানহীন জীবন যাপন করছে, আবার অন্যের অধিকারও নষ্ট করছে। তারা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
- অত্যাচারী শাসক, দুর্নীতিবাজ নেতা, বা অন্যায়কারী ব্যবসায়ীরা— এ আয়াত তাদের জন্য এক সতর্কবাণী।
- তারা মনে করে ক্ষমতা দিয়ে রক্ষা পাবে, অথচ আল্লাহ বলেন — “আমি তাদের কখনো হেদায়েত দেব না।”
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৮):
- কুফরি ও জুলুম একত্রে হলে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়।
- আল্লাহ কেবল সেই বান্দাকে ক্ষমা করেন, যে তওবা করে ফিরে আসে।
- হেদায়েত পেতে হলে প্রথমে ঈমান গ্রহণ জরুরি।
- অত্যাচার, দুর্নীতি ও কুফরি আল্লাহর ঘৃণিত কাজ।
- ন্যায় ও তওবা মানুষকে আবার আল্লাহর নিকটে ফিরিয়ে আনে।
এই আয়াতটি আগের (১৬৮) আয়াতের ধারাবাহিকতায় নাযিল হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছিল — যারা কুফরি করে ও জুলুম করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না, হেদায়েতও দেবেন না। এখন এখানে তাদের চূড়ান্ত পরিণতি ঘোষণা করা হয়েছে — তাদের গন্তব্য **জাহান্নাম**, এবং সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। 🔹 **“إِلَّا طَرِيقَ جَهَنَّمَ”** — অর্থাৎ তাদের জন্য আর কোনো পথ বা পরিত্রাণ নেই, কেবল জাহান্নামের পথই তাদের সামনে খোলা থাকবে। 🔹 **“خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا”** — অর্থাৎ তারা সেখানে **চিরকাল** অবস্থান করবে, কারণ তারা কুফরির উপর মৃত্যুবরণ করেছে এবং কখনো তওবা করেনি। 🔹 **“وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا”** — আল্লাহর জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া বা পুরস্কার দেওয়া কোনো কঠিন বিষয় নয়; তাঁর ন্যায়বিচার পরিপূর্ণ — তিনি কখনো অন্যায় করেন না, বরং প্রত্যেকে তার কর্ম অনুযায়ী পরিণতি লাভ করে। 💠 সারসংক্ষেপে — আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি চূড়ান্তভাবে জাহান্নামের পথে ধাবিত হয়। এটি আল্লাহর ন্যায়বিচারেরই প্রতিফলন, কোনো অত্যাচার নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি কুফরির অবস্থায় মারা যাবে, সে জাহান্নামে যাবে এবং সেখানেই চিরকাল থাকবে।” (📖 সহিহ মুসলিম ৯৩; সহিহ বুখারী ১২৮) আবার তিনি ﷺ বলেছেন— “মুমিন যত গুনাহ করুক না কেন, সে যদি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে, তাহলে একদিন জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৭৫১০; সহিহ মুসলিম ১৮৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক মানুষ জেনে শুনেও ঈমান ত্যাগ করছে, বা আল্লাহকে অস্বীকার করছে, অথচ ভাবে — “সবাই তো একদিন জান্নাতে যাবে।”
- কিন্তু কুরআন স্পষ্ট বলছে — যে কুফরির উপর মৃত্যুবরণ করে, তার জন্য মুক্তির কোনো পথ নেই।
- আল্লাহর ক্ষমা তাদের জন্য, যারা তওবা করে তাঁর দিকে ফিরে আসে।
- জাহান্নামের পথ থেকে মুক্তি পেতে হলে ঈমান ও তওবা অপরিহার্য।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬৯):
- কুফরি ও জুলুমের চূড়ান্ত পরিণতি হলো জাহান্নাম।
- যারা ঈমান ব্যতীত মৃত্যুবরণ করে, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে।
- আল্লাহর ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ — তিনি কখনো অন্যায় করেন না।
- তওবা ও ঈমান মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করতে পারে।
- আল্লাহর পক্ষে শাস্তি বা পুরস্কার প্রদান কঠিন কিছু নয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সমগ্র মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন — “হে মানুষ! আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ ﷺ তোমাদের কাছে সত্যসহ আগমন করেছেন।” এটি কুরআনের অন্যতম স্পষ্ট দাওয়াতমূলক আয়াত। 🔹 **“يَا أَيُّهَا النَّاسُ”** — এখানে “হে মানুষ” বলা হয়েছে — অর্থাৎ শুধু মুসলমান নয়, বরং সমগ্র মানবজাতিকে আহ্বান করা হয়েছে। 🔹 **“قَدْ جَاءَكُمُ الرَّسُولُ بِالْحَقِّ”** — নবী ﷺ কেবল আরবদের জন্য নন; তিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য **আল-মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ**, যিনি আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ সত্য কুরআন নিয়ে এসেছেন। 🔹 **“فَآمِنُوا خَيْرًا لَكُمْ”** — অর্থাৎ, ঈমান আনো — এটা তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্য কল্যাণকর। কারণ ঈমানই মুক্তির একমাত্র চাবিকাঠি। 🔹 **“وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ”** — যদি তোমরা ঈমান না আনো, তবুও আল্লাহর কিছুই ক্ষতি হবে না। তিনি মালিক — আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই তাঁর। 🔹 **“وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا”** — আল্লাহ সর্বজ্ঞ — তিনি জানেন কে সত্য গ্রহণ করে আর কে অস্বীকার করে। তিনি প্রজ্ঞাময় — প্রত্যেককে যথাযথ বিচার প্রদান করবেন। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াতের বার্তা সার্বজনীন। ইসলাম কোনো জাতি বা দেশের ধর্ম নয়; বরং এটি সমগ্র মানবতার জন্য চূড়ান্ত বার্তা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে — সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৪৩৮; সহিহ মুসলিম ৫২২) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেন— “আমার আগে প্রতিটি নবী তার নিজ জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিল, কিন্তু আমি প্রেরিত হয়েছি সব মানুষের জন্য।” (📖 সহিহ মুসলিম ৫২২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও ইসলাম একমাত্র ধর্ম যা মানবতার কল্যাণে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দেয়।
- বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজ—সব ক্ষেত্রে কুরআনের শিক্ষা প্রযোজ্য ও বাস্তবসম্মত।
- যারা ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তারা আসলে নিজেদেরই ক্ষতি করছে।
- রাসূল ﷺ–এর শিক্ষা মানা মানেই আল্লাহর সত্যের অনুসরণ করা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭০):
- এই আয়াত সকল মানুষের প্রতি ইসলামের সার্বজনীন দাওয়াত।
- নবী মুহাম্মদ ﷺ সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন।
- ঈমান আনাই মানুষের প্রকৃত কল্যাণের পথ।
- অবিশ্বাস আল্লাহর ক্ষতি করে না, বরং অস্বীকারকারীরই ক্ষতি করে।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় — তিনি ন্যায়বিচার করবেন।
এই আয়াতটি খ্রিষ্টানদের ভুল বিশ্বাসের প্রতি সরাসরি খণ্ডন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের তিনটি ভুল ধারণা সংশোধন করেছেন — (১) ঈসা (আঃ) আল্লাহর পুত্র, (২) আল্লাহ তিন সত্তা (ত্রিত্ববাদ), (৩) ঈসা (আঃ)-এর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা স্বতন্ত্র। 🔹 **“لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ”** — অর্থাৎ তোমরা ধর্মে সীমা অতিক্রম করো না, যেমন খ্রিষ্টানরা করেছেন — নবীকে উপাস্য বানিয়েছে। 🔹 **“إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ”** — ঈসা (আঃ) ছিলেন একজন মানব, আল্লাহর নবী ও রাসূল, যিনি আল্লাহর বাণী ও অলৌকিক নির্দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 🔹 **“وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ”** — অর্থাৎ ‘ত্রিত্ববাদ’ (Father, Son, Holy Spirit) বলা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক বা সন্তান নেই। 🔹 **“سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ”** — তিনি এতই পবিত্র যে তাঁর কোনো সন্তান হতে পারে না। সন্তান মানে নির্ভরশীলতা, আর আল্লাহ কারও উপর নির্ভরশীল নন। 💠 সারসংক্ষেপে — ইসলাম ঈসা (আঃ)-কে সম্মানিত নবী বলে স্বীকার করে, কিন্তু তাঁকে আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করা কুফরি। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়; তিনি কারও পিতা নন, কারও পুত্রও নন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রাসূল, এবং ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, আল্লাহর কালিমা ও তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ — সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ বুখারী ৩৪৩৫; সহিহ মুসলিম ২৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও বহু মানুষ ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ করে, তাঁদের ঈশ্বর বা ‘গড দ্য সন’ মনে করে।
- কিন্তু ইসলাম শেখায় — ঈসা (আঃ) নবী, যিনি মানুষকে তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছিলেন।
- অনেক তথাকথিত মুসলিমও পীর বা অলিকে ঈশ্বরীয় মর্যাদা দিতে শুরু করেছে, যা একই ধরণের গোমরাহী।
- এই আয়াত আমাদের সতর্ক করে — অতিরঞ্জন ঈমান ধ্বংস করে দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭১):
- ধর্মে সীমা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ — আল্লাহর দীনকে বিকৃত করা বড় গুনাহ।
- ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, ঈশ্বর নন।
- ত্রিত্ববাদ (তিন ইলাহ) ধারণা আল্লাহর সাথে শিরক।
- আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় — তাঁর কোনো সন্তান বা শরিক নেই।
- অতিপ্রশংসা ও বিকৃত বিশ্বাস ঈমান ধ্বংস করে দেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা খ্রিষ্টানদের একটি বড় ভুল ধারণা সংশোধন করেছেন — ঈসা (আঃ) কখনো আল্লাহর বান্দা হতে গর্ববোধ করেননি। বরং তিনি গর্বিত ছিলেন যে, তিনি আল্লাহর **আজ্ঞাবহ বান্দা ও রাসূল।** 🔹 **“لَّن يَسْتَنكِفَ الْمَسِيحُ”** — অর্থাৎ ঈসা (আঃ) কখনোই আল্লাহর ইবাদত করতে লজ্জা পাননি, বরং তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল — “আল্লাহর আনুগত্য শেখানো।” 🔹 **“وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ”** — এমনকি যারা আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতা, তারাও কখনো অহঙ্কার করেন না যে তারা ইবাদতের ঊর্ধ্বে। তারা নিরন্তর আল্লাহর প্রশংসা করে, ইবাদতে মগ্ন থাকে। 🔹 **“وَمَن يَسْتَنكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ”** — অর্থাৎ যারা আল্লাহর ইবাদতকে তুচ্ছ মনে করে, বা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে ইবাদত থেকে দূরে থাকে — তাদের জন্য কঠিন বিচার অপেক্ষা করছে। 🔹 **“فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا”** — আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সবাইকে তাঁর সামনে একত্র করবেন, আর তখন প্রতিটি আত্মা জানবে তার অবস্থান — ইবাদতের বিনম্রতা নাকি অহঙ্কারের গর্ব। 💠 সারসংক্ষেপে — নবী, ফেরেশতা কিংবা অন্য কেউ আল্লাহর ইবাদতের ঊর্ধ্বে নয়। ঈসা (আঃ)-এর মর্যাদা তাঁর নবুওয়াতে, ঈশ্বরত্বে নয়। অহঙ্কার মানুষকে ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আর ইবাদত মানুষকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে বিনম্র হয়, আল্লাহ তাকে মর্যাদা দান করেন। আর যে অহঙ্কার করে, আল্লাহ তাকে নিচে নামিয়ে দেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৮৮) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি এক বিন্দু পরিমাণ অহঙ্কারও নিজের অন্তরে রাখবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম ৯১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ মনে করে — নামাজ, রোজা, ইবাদত তার জন্য নয়। অথচ এই মানসিকতাই ছিল শয়তানের অহঙ্কারের শুরু।
- কেউ কেউ “আমি জ্ঞানী, আমি ব্যস্ত” বলে ইবাদত অবহেলা করে — এরা বাস্তবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করছে।
- এই আয়াত স্পষ্ট জানিয়ে দেয় — নবী, ফেরেশতা, বা জ্ঞানী কেউই ইবাদতের ঊর্ধ্বে নয়।
- আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠতা বিনয়ে, জ্ঞানে নয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭২):
- ঈসা (আঃ) কখনো আল্লাহর ইবাদত থেকে গর্ব করেননি।
- ফেরেশতারাও সর্বদা ইবাদতে নিমগ্ন — তারা অহঙ্কার করে না।
- যে ইবাদত থেকে বিমুখ, সে আল্লাহর সামনে লাঞ্ছিত হবে।
- অহঙ্কার ঈমান ধ্বংস করে দেয়।
- বিনয় ও আনুগত্যই আল্লাহর নিকটে মর্যাদার কারণ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আগের আয়াতের (১৭২) পরিণতি ব্যাখ্যা করেছেন — এখন বলা হয়েছে, ইবাদতে বিনয়ী ও অহঙ্কারীদের ভিন্ন পরিণতি কী হবে। 🔹 **“فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ”** — যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, অর্থাৎ ঈমান শুধু মুখে নয়, আমল দ্বারা প্রমাণিত। 🔹 **“فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدُهُم مِّن فَضْلِهِ”** — আল্লাহ তাদের শুধু প্রাপ্য প্রতিদানই দেবেন না, বরং নিজের অনুগ্রহ থেকে অতিরিক্ত দান করবেন — যেমন জান্নাতে চিরস্থায়ী সুখ, রিদওয়ান ও নূর। 🔹 **“وَأَمَّا الَّذِينَ اسْتَنْكِفُوا وَاسْتَكْبَرُوا”** — আর যারা আল্লাহর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং অহঙ্কার করেছে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত আছে। 🔹 **“وَلَا يَجِدُونَ لَهُم مِّن دُونِ اللَّهِ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا”** — অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন তারা কোনো সাহায্যকারী বা মধ্যস্থতাকারী পাবে না, যিনি তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াত আল্লাহর ন্যায়বিচার ও করুণা উভয়কেই প্রকাশ করে। ঈমান ও সৎকর্মের জন্য পুরস্কার, আর অহঙ্কার ও বিমুখতার জন্য শাস্তি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ বলেন: আমি আমার বান্দার ধারণার উপর আছি। সে যদি আমার প্রতি ভালো ধারণা রাখে, আমি তার জন্য ভালোই করব।” (📖 সহিহ বুখারী ৭৪০৫; সহিহ মুসলিম ২৬৭৫) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় প্রদর্শন করে, আল্লাহ তাকে মর্যাদা দান করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত — কেউ আল্লাহর আনুগত্যে, কেউ অবাধ্যতায়।
- যারা ঈমান ও সৎকর্মে জীবন পরিচালনা করে, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে উন্নতি দান করেন।
- আর যারা অহঙ্কার ও অবহেলায় ডুবে আছে, তারা আখিরাতে নিঃস্ব হয়ে দাঁড়াবে।
- কোনো পীর, নেতা বা ধনসম্পদ কাউকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭৩):
- ঈমান ও সৎকর্মই জান্নাত লাভের পথ।
- আল্লাহ কেবল প্রতিদানই নয়, অতিরিক্ত অনুগ্রহও দেন।
- অহঙ্কারী ও বিমুখদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত।
- আল্লাহ ছাড়া কেউ সাহায্য করতে পারবে না।
- ইবাদতের বিনয় মানুষকে আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ করে তোলে।
এই আয়াতটি তাওহিদ ও নবুওয়াতের চূড়ান্ত বার্তা। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করছেন — মানবজাতির সামনে এখন এমন প্রমাণ এসেছে যা প্রত্যাখ্যান করার আর কোনো অজুহাত নেই। 🔹 **“بُرْهَانٌ مِّن رَّبِّكُمْ”** — “বুরহান” শব্দের অর্থ হলো প্রমাণ বা অকাট্য দলিল। এখানে ‘বুরহান’ বলতে বোঝানো হয়েছে নবী মুহাম্মদ ﷺ — যিনি তাঁর চরিত্র, মুজিযা ও কুরআনের সত্যতার মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্য বার্তার জীবন্ত প্রমাণ। 🔹 **“نُورًا مُّبِينًا”** — অর্থাৎ ‘স্পষ্ট নূর’ — এখানে বোঝানো হয়েছে **আল-কুরআন**, যা মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা, অন্ধকার থেকে হেদায়েতের দিকে পরিচালনা করে। 💠 সারসংক্ষেপে — নবী ﷺ হচ্ছেন জীবন্ত প্রমাণ (বুরহান), এবং কুরআন হচ্ছে আল্লাহর নূর, যা মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। এ আয়াত প্রমাণ করে: ইসলাম কোনো অন্ধবিশ্বাস নয়, বরং যুক্তি, প্রমাণ ও আলোয় প্রতিষ্ঠিত ধর্ম।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরো তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না — আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” (📖 মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৫৯৪) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “কুরআন আল্লাহর নূর, যে এর সাথে চলবে সে আলোকিত হবে, আর যে তা ত্যাগ করবে, সে অন্ধকারে পতিত হবে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৯১০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ আল্লাহর প্রমাণের সন্ধানে, অথচ কুরআনই সেই স্পষ্ট প্রমাণ।
- নাস্তিকতা, ভ্রান্ত দর্শন ও মিথ্যা মতবাদ কুরআনের আলোতে ভেঙে যায়।
- যে ব্যক্তি কুরআনের আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে জাহিলিয়াতের অন্ধকারে বাস করে।
- যে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি লাভ করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭৪):
- আল্লাহ মানবজাতির কাছে স্পষ্ট প্রমাণ (রাসূল ﷺ) প্রেরণ করেছেন।
- কুরআন হচ্ছে আল্লাহর নূর — যা হৃদয় ও সমাজকে আলোকিত করে।
- ইসলাম প্রমাণ ও যুক্তির ধর্ম, অন্ধবিশ্বাস নয়।
- নবী ﷺ ও কুরআন — উভয়ই হেদায়েতের সর্বোচ্চ উৎস।
- যে কুরআনের আলো গ্রহণ করে, সে অন্ধকার থেকে মুক্তি পায়।
এই আয়াতটি আগের আয়াত (৪:১৭৪)-এর ধারাবাহিকতায় এসেছে, যেখানে বলা হয়েছিল — আল্লাহ মানুষকে “স্পষ্ট প্রমাণ ও নূর” দিয়েছেন। এখন আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন, সেই আলোকে গ্রহণকারীদের পুরস্কার কী হবে। 🔹 **“ٱلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ”** — অর্থাৎ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান এনেছে, তাঁর একত্বে, তাঁর রাসূলগণের বার্তায় এবং আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। 🔹 **“وَٱعْتَصَمُوا بِهِ”** — অর্থাৎ যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থেকেছে — কুরআন, সুন্নাহ ও তাওহিদের দড়ি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে, এবং কোনো অন্য পথ অনুসরণ করেনি। 🔹 **“فَسَيُدْخِلُهُمْ فِي رَحْمَةٍ مِّنْهُ وَفَضْلٍ”** — আল্লাহ তাদেরকে নিজের রহমতে (জান্নাত) এবং অনুগ্রহে (অতিরিক্ত পুরস্কার) প্রবেশ করাবেন। আল্লাহর রহমতই জান্নাতের মূল চাবিকাঠি। 🔹 **“وَيَهْدِيهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا”** — অর্থাৎ আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যাবেন, সেই সোজা পথের দিকে, যা জান্নাতের দিকে পৌঁছায়। 💠 সারসংক্ষেপে — যারা ঈমান ও তাওহিদের পথে দৃঢ় থাকে, আল্লাহ তাঁদের দুনিয়া ও আখিরাতে হেদায়েত, রহমত ও মর্যাদা দান করেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ বলেন: হে আমার বান্দারা! তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট, যদি না আমি তোমাদের হেদায়েত দিই; সুতরাং আমার নিকট হেদায়েত চাও, আমি তোমাদের হেদায়েত দেব।” (📖 সহিহ মুসলিম ২৫৭৭) আরেক হাদিসে নবী ﷺ বলেন— “যে ব্যক্তি আল্লাহর দড়ি (কুরআন ও ইসলাম) আঁকড়ে ধরে, সে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।” (📖 সহিহ বুখারী ৭২৭০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ নানা মতবাদ, দর্শন ও নেতার অনুসরণে বিভ্রান্ত।
- যারা কুরআন ও সুন্নাহর আলো আঁকড়ে ধরে, তারাই আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত লাভ করে।
- ‘আল্লাহর দড়ি’ ছেড়ে দিলে মানুষ অন্ধকারে পতিত হয়।
- যে ঈমানকে দৃঢ় রাখে, আল্লাহ তাকে দুনিয়াতেই শান্তি দেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭৫):
- ঈমান ও তাওহিদে দৃঢ়তা আল্লাহর রহমত লাভের পথ।
- আল্লাহর দড়ি (কুরআন ও ইসলাম) আঁকড়ে ধরা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
- আল্লাহ মুমিনদের জান্নাতে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহে প্রবেশ করাবেন।
- হেদায়েত আল্লাহরই দান — তা কেবল ঈমানদারদের জন্য।
- সোজা পথের দিকেই আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিচালিত করেন।
এই আয়াতটি সূরা আন-নিসার **শেষ ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধানমূলক আয়াত**। “কালালাহ” অর্থ — এমন ব্যক্তি যার **কোনো সন্তান বা পিতা-মাতা নেই**, অর্থাৎ সরাসরি উত্তরাধিকারী অনুপস্থিত। 🔹 **“يَسْتَفْتُونَكَ”** — সহাবীগণ নবী ﷺ-এর কাছে ‘কালালাহ’ বিষয়ে ফতোয়া জানতে চেয়েছিলেন। তখন এই আয়াত নাযিল হয়, যেখানে আল্লাহ নিজেই বিধান ব্যাখ্যা করেন। 🔹 **বিধানসমূহ:** - যদি কোনো পুরুষ মারা যায় এবং তার সন্তান না থাকে, কিন্তু একটি বোন থাকে — সে পাবে সম্পদের অর্ধেক। - যদি বোন মারা যায়, এবং তার কোনো সন্তান না থাকে, তবে তার ভাই পুরো সম্পদের অধিকারী হবে। - যদি দুই বোন থাকে, তারা একত্রে পাবে দুই-তৃতীয়াংশ। - যদি ভাই-বোন মিশ্র হয়, তবে **পুরুষের অংশ নারীর দ্বিগুণ**। 🔹 **“يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ أَنْ تَضِلُّوا”** — অর্থাৎ আল্লাহ এই বিধানগুলো পরিষ্কার করেছেন যাতে মানুষ উত্তরাধিকারে অবিচার বা বিভ্রান্তিতে না পড়ে। 💠 সারসংক্ষেপে — এই আয়াতে আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রতিফলন দেখা যায়। ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকার স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ নিজ হাতে ফারায়েয (উত্তরাধিকার) নির্ধারণ করেছেন, তাই উত্তরাধিকারের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিও না।” (📖 সহিহ মুসলিম ১৬১৫) আরেক হাদীসে বলা হয়েছে— “যে ব্যক্তি ফারায়েযের বিধান পরিবর্তন করে, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২১০০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক পরিবারে উত্তরাধিকার বিভাজনে জালিয়াতি ও অবিচার করা হয়।
- ইসলাম নারীদেরও সুনির্দিষ্ট অংশ দিয়েছে — এটি তাদের অধিকার, অনুগ্রহ নয়।
- আইনি উত্তরাধিকার আইন প্রায়শই কুরআনিক বিধানের বিপরীতে চলে, অথচ আল্লাহর নির্ধারিত বিধানই সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার।
- যে পরিবার ইসলামী উত্তরাধিকার অনুসরণ করে, সেখানে কলহ, অন্যায় ও শত্রুতা কমে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭৬):
- “কালালাহ” মানে যার সন্তান বা পিতা-মাতা নেই — তার উত্তরাধিকার স্পষ্ট।
- নারী ও পুরুষ উভয়েরই আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার রয়েছে।
- উত্তরাধিকারের নিয়ম মানবিক, ন্যায্য ও পূর্ণাঙ্গ।
- যে আল্লাহর বিধান অনুসারে সম্পদ বণ্টন করে, সে জুলুম থেকে নিরাপদ।
- আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করা মানে নিজের ক্ষতি ডেকে আনা।