সূরা আল-মায়েদা
আয়াত সংখ্যা: ১২০, রুকু সংখ্যা: ১৬
সূরা আল-মায়িদা অর্থ “খাবারের টেবিল” বা “সাজানো খানা”। এটি কুরআনের ৫ম সূরা এবং এতে মোট ১২০টি আয়াত রয়েছে। এটি একটি মাদানী সূরা — অর্থাৎ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এতে ইসলামী শরীয়তের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিধান বর্ণিত হয়েছে, বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিকনির্দেশনা।
সূরার নাম এসেছে আয়াত ১১২–১১৫ থেকে, যেখানে বনী ইসরাঈলের অনুরোধে আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আঃ)-এর জন্য আসমান থেকে খাবার ভর্তি টেবিল (আল-মায়িদা) অবতীর্ণ করেন। এই ঘটনা থেকে সূরাটির নাম রাখা হয়েছে “আল-মায়িদা”।
সূরা আল-মায়িদা ইসলামি সমাজের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রূপে বিবেচিত। এতে হালাল-হারাম, চুক্তি রক্ষা, ন্যায়বিচার, হত্যার শাস্তি, খাদ্যবিধি, ইহুদি-খ্রিস্টানদের সঙ্গে সম্পর্ক, এবং নেতৃত্বের নীতি সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
🌿 সূরা আল-মায়িদা’র মূল বিষয়সমূহ:
- চুক্তি রক্ষা, প্রতিশ্রুতি পালন এবং আনুগত্যের গুরুত্ব।
- হালাল ও হারাম খাদ্য এবং কোরবানির বিধান।
- নবী ﷺ এর প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহর বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা।
- ইহুদি-খ্রিস্টানদের সাথে আচরণ ও ধর্মীয় সীমারেখা নির্ধারণ।
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও পক্ষপাতহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশ।
- মুসা (আঃ)-এর জাতির অবাধ্যতা এবং তার পরিণতি।
- হযরত ঈসা (আঃ)-এর সত্য অবস্থান ও আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণা।
🌸 সূরা আল-মায়িদা’র বৈশিষ্ট্য:
- এটি নবী ﷺ-কে অবতীর্ণ হওয়া শেষ দিকের সূরাগুলোর একটি। অর্থাৎ এতে ইসলামী শরীয়তের অনেক চূড়ান্ত আদেশ এসেছে।
- আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম সম্পূর্ণ করেছি, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে পছন্দ করেছি।” (📖 সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩)
- এ সূরায় কেবল বিশ্বাস নয়, বরং কর্মের মাধ্যমেই ঈমানের পূর্ণতা বোঝানো হয়েছে।
- মানব সমাজে চুক্তি ভঙ্গ, প্রতারণা ও অবিচারের পরিণতি সম্পর্কে সতর্কতা প্রদান করা হয়েছে।
💫 সূরা আল-মায়িদা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা:
- আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূল ﷺ-এর আদেশ সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব।
- চুক্তি রক্ষা ও ন্যায়বিচার ইসলামী সমাজের মূল ভিত্তি।
- হারাম ও হালাল স্পষ্ট — মুমিনের কর্তব্য এই সীমারেখা রক্ষা করা।
- অবিশ্বাসীদের অনুকরণ ও ধর্মীয় আপস ইসলাম স্বীকার করে না।
- আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও তাঁর হুকুম মানাই মুক্তির পথ।
🌿 শিক্ষণীয় বিষয়:
- আল্লাহর প্রতি আনুগত্যই প্রকৃত সফলতা।
- চুক্তি রক্ষা করা ইসলামী চরিত্রের পরিচায়ক।
- অন্যায়, পক্ষপাত ও বেঈমানি সমাজ ধ্বংস করে দেয়।
- আল্লাহর বিধান মানলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, না মানলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
- সূরা আল-মায়িদা আমাদের শেখায় — “আল্লাহর দেওয়া সীমা লঙ্ঘন করো না, তবেই তোমরা সফল হবে।”
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিশ্বাসীদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের অঙ্গীকার ও চুক্তি সমূহ পূর্ণ করতে। ইসলামে চুক্তি পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, তা হোক আল্লাহর সাথে ইবাদতের প্রতিশ্রুতি, কিংবা মানুষের সাথে সামাজিক বা ব্যবসায়িক অঙ্গীকার।
এরপর আল্লাহ খাদ্যবিধান সম্পর্কে বলছেন— গৃহপালিত পশুসমূহ (যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া) সাধারণত হালাল, তবে যেগুলো সম্পর্কে কোরআনে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে (যেমন মৃত প্রাণী, রক্ত ইত্যাদি) সেগুলো হারাম। আর যখন হজ বা উমরার জন্য ইহরাম অবস্থায় থাকবে, তখন শিকার করা নিষিদ্ধ।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে— আল্লাহ যা চান তাই বিধান করেন; মানুষকে উচিত বিনয় ও আনুগত্যের সাথে তাঁর হুকুম মেনে চলা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার অঙ্গীকার পূরণ করে এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৭৩৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করা ঈমানের অংশ।
- কেউ হজ বা উমরার ইহরাম অবস্থায় শিকার করলে তা শরীয়তসম্মত অপরাধ।
- আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করা কারো ক্ষমতায় নেই—মানুষের কর্তব্য তা মান্য করা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১):
- চুক্তি ও অঙ্গীকার পূর্ণ করা ঈমানের শর্ত।
- হালাল-হারামের সীমা আল্লাহ নির্ধারণ করেন, মানুষ নয়।
- ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম।
- আল্লাহর বিধান চূড়ান্ত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন— যেন তারা আল্লাহর নিদর্শন, ধর্মীয় প্রতীক এবং পবিত্র বিধানসমূহকে অসম্মান না করে। এর মধ্যে রয়েছে—
- পবিত্র মাসসমূহের (রজব, যুল-ক্বা‘দা, যুল-হিজ্জা ও মুহাররম) মর্যাদা রক্ষা,
- হজের পশু (হাদী) ও তার চিহ্ন (গলায় দড়ি বা মালা) অবমাননা না করা,
- এবং যারা কাবার দিকে যাচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা একে অপরকে সাহায্য করো কল্যাণ ও তাকওয়ায়, কিন্তু অন্যায় ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না।” (📖 তাফসিরে ইবনে কাসির, সূরা আল-মায়েদা: ২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মুসলমান ধর্মীয় প্রতীক যেমন কুরআন, মসজিদ, আজান ইত্যাদি অবমাননা সহ্য করতে পারে না — এটি ঈমানের দাবি।
- অন্যায় বা দুর্নীতির কাজে কাউকে সহায়তা করা ইসলামী নীতির পরিপন্থী।
- মানুষের প্রতি ঘৃণা বা প্রতিশোধের কারণে যেন আমরা ন্যায়নীতি হারিয়ে না ফেলি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২):
- আল্লাহর নিদর্শন ও ধর্মীয় প্রতীকসমূহকে সম্মান করা ঈমানের অংশ।
- পবিত্র মাসসমূহ ও হজের পশুর মর্যাদা রক্ষা করা উচিত।
- ন্যায় ও তাকওয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতা করা ইসলামের নির্দেশ।
- পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ।
- আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা—তাঁর ভয় সর্বদা মনে রাখা দরকার।
এই আয়াতে ইসলামী খাদ্যবিধান এবং দ্বীন সম্পূর্ণ হওয়ার ঘোষণা এসেছে। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কোন খাবারগুলো মুসলমানদের জন্য হারাম — যেমন: মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের মাংস, এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করা জন্তু। একই সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া পশু (যেমন গলায় আটকে বা পড়ে মারা যাওয়া) খাওয়াও নিষিদ্ধ।
**"আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম..."** — এই বাক্যাংশটি ইসলামের ইতিহাসে এক বিশাল মাইলফলক। এটি নাযিল হয়েছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হজ্জাতুল বিদা (বিদায় হজ)-এর সময়, আর এটি ছিল ইসলামী শরীয়তের পূর্ণতা ঘোষণা। অর্থাৎ, এখন ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা মানুষকে ঈমান, ইবাদত, ন্যায়নীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারে সম্পূর্ণভাবে দিকনির্দেশনা দেয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
এক ইহুদি সাহাবি উমর (রাঃ)-কে বলেছিল— “তোমাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যদি সেই আয়াত আমাদের উপর অবতীর্ণ হতো, আমরা সেটিকে ঈদ দিবস হিসেবে পালন করতাম।” উমর (রাঃ) বললেন— “আমরা তো জানি কোন দিনে এবং কোথায় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে — এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিদায় হজের দিনে আরাফার ময়দানে নাযিল হয়েছে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩০১৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলমানকে অবশ্যই হালাল-হারামের সীমা রক্ষা করতে হবে।
- জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম পরিপূর্ণ নির্দেশনা দেয় — তাই অন্য কোনো জীবনব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।
- চরম প্রয়োজনে (যেমন প্রাণরক্ষার ক্ষেত্রে) হারাম বস্তু সীমিতভাবে গ্রহণ করা যায় — এটি আল্লাহর দয়া।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩):
- মৃত প্রাণী, রক্ত ও শূকরের মাংস হারাম।
- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করা খাবার হারাম।
- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা।
- চরম প্রয়োজনে কিছু হারাম বস্তু গ্রহণযোগ্য — কিন্তু তা অপব্যবহার করা যাবে না।
- আল্লাহর বিধানই চূড়ান্ত; তাঁরই ভয় করা উচিত।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা শিকার ও হালাল খাদ্যবিধানের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন — কোন খাবার ও শিকার তাদের জন্য বৈধ? উত্তরে আল্লাহ বলেন, সমস্ত “ত্বয়্যিবাত” (পবিত্র ও উপকারী বস্তু) হালাল।
এরপর বলা হয়েছে — প্রশিক্ষিত শিকারি জন্তু (যেমন শিকারি কুকুর, বাজ ইত্যাদি) যদি কোনো প্রাণী ধরে ফেলে এবং প্রশিক্ষিতভাবে মালিকের জন্য সেটি ধরে রাখে, তবে তার মাংস হালাল, শর্ত হলো — শিকার পাঠানোর সময় আল্লাহর নাম নিতে হবে (বিসমিল্লাহ বলা)। যদি শিকারি প্রাণী নিজেই মেরে ফেলে এবং না খায়, তবুও তা বৈধ, কারণ উদ্দেশ্য ছিল শিকার করা, নিজে ভক্ষণ নয়।
আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন — “আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।” অর্থাৎ, মানুষ যেন হালাল-হারামের সীমা লঙ্ঘন না করে; কারণ আল্লাহর বিচার অতি ন্যায়নিষ্ঠ ও দ্রুত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন তুমি তোমার প্রশিক্ষিত কুকুর বা শিকারি প্রাণী পাঠাও, এবং তুমি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো, তখন সে যা ধরে আনে, তা খাও, আর যদি কুকুর কিছুটা খেয়ে ফেলে, তাহলে খাবে না।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫৪৮৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৩০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মুসলমানদের জন্য খাদ্যে ‘হালাল’ ও ‘তায়্যিব’ (পবিত্র) হওয়া জরুরি — অর্থাৎ শুধু ধর্মীয়ভাবে বৈধ নয়, বরং পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর ও উপকারীও হতে হবে।
- শিকার বা খাদ্য উৎপাদনে আল্লাহর নাম স্মরণ করা এখনো ইসলামী বিধান।
- হালাল সার্টিফিকেটবিহীন বা সন্দেহজনক খাবার থেকে দূরে থাকা তাকওয়ার অংশ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪):
- আল্লাহ পবিত্র ও উপকারী বস্তুসমূহ হালাল করেছেন।
- শিকারি প্রাণী দ্বারা ধরা শিকার বৈধ, যদি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়।
- খাবারের ক্ষেত্রে হালাল ও হারাম পার্থক্য জানা জরুরি।
- আল্লাহকে সর্বদা ভয় করা উচিত; কারণ তিনিই দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।
এই আয়াতে মুসলমানদের জন্য খাদ্য ও বিবাহ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিধান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন— আজ তোমাদের জন্য সমস্ত **“ত্বয়্যিবাত”** (পবিত্র, পরিষ্কার ও উপকারী বস্তু) হালাল।
এরপর উল্লেখ করা হয়েছে— আহলে কিতাব (ইহুদি ও খ্রিস্টান) যারা কিতাব প্রাপ্ত জাতি, তাদের বৈধভাবে জবাই করা খাদ্য মুসলমানদের জন্য হালাল, এবং মুসলমানদের খাদ্যও তাদের জন্য বৈধ। তবে অবশ্যই শর্ত হলো— তারা আল্লাহর নামে জবাই করেছে এবং হারাম কিছু অন্তর্ভুক্ত নয়।
একইভাবে, মুসলমান পুরুষরা আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে সতী-সাধ্বী ও চরিত্রবান নারীদের সাথে বৈধভাবে বিবাহ করতে পারে, তবে শর্ত হলো এটি **বৈধ বিবাহের মাধ্যমে**, ব্যভিচার বা গোপন সম্পর্ক নয়। বিবাহের সময় মোহর (মহরানা) প্রদান বাধ্যতামূলক।
আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ সতর্ক করেছেন— যে ব্যক্তি ঈমান অস্বীকার করে, তার সকল সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে, এবং পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “মুমিনের জন্য বৈধ নারীরা তারা, যারা ঈমানদার বা কিতাবপ্রাপ্ত জাতির সতী নারী।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫৪৫৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪১২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মুসলমানদের উচিত খাদ্যে ও বিবাহে ধর্মীয় সীমা রক্ষা করা।
- বিবাহ বৈধ হলে তবেই সম্পর্ক হালাল — ব্যভিচার বা অবৈধ সম্পর্ক কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- ঈমানের অস্বীকার সব আমল ধ্বংস করে দেয় — তাই ঈমানই হলো জীবনের মূল ভিত্তি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫):
- পবিত্র ও উপকারী খাদ্য হালাল।
- আহলে কিতাবদের বৈধভাবে প্রস্তুত করা খাদ্য মুসলমানদের জন্য বৈধ।
- আহলে কিতাবদের সতী নারীদের সঙ্গে বৈধ বিবাহ অনুমোদিত।
- ব্যভিচার ও অবৈধ সম্পর্ক ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- ঈমান হারালে সব আমল বাতিল হয়ে যায়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে **ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম** সম্পর্কিত স্পষ্ট বিধান দিয়েছেন।
নামাজের জন্য শারীরিক পবিত্রতা অপরিহার্য। এজন্য ওযুর মাধ্যমে মুখ, হাত, মাথা ও পা ধোয়ার নির্দেশ এসেছে। ওযুর এই চারটি অঙ্গ ধোয়া ফরজ।
যদি কেউ অপবিত্র অবস্থায় থাকে (যেমন—জুনুব, স্বপ্নদোষ, মিলন ইত্যাদি), তবে সম্পূর্ণ শরীর ধোয়া (গোসল) বাধ্যতামূলক।
আর যদি কেউ অসুস্থ থাকে বা সফরে পানি না পায়, তাহলে আল্লাহ তায়াম্মুমের অনুমতি দিয়েছেন— যা ইসলামের সহজতা ও দয়ার প্রতীক। তায়াম্মুম করতে হবে পরিষ্কার মাটির উপর হাত রেখে, মুখ ও হাত মাসেহ করে।
শেষে আল্লাহ বলেন— “আমি তোমাদের উপর কোনো কষ্ট চাপাতে চাই না, বরং তোমাদেরকে পবিত্র করতে ও অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চাই।” এটি ইসলামের দয়া, সহজতা ও ভারসাম্যের শিক্ষা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “পৃথিবী আমার জন্য পবিত্র ও মসজিদস্বরূপ করা হয়েছে। সুতরাং যে-ই হোক না কেন, যেখানে নামাজের সময় পাবে, সে সেখানেই নামাজ আদায় করতে পারবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫২১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- পানির অভাবে নামাজ ছেড়ে দেওয়া নয় — বরং তায়াম্মুম করে নামাজ আদায় করতে হবে।
- পবিত্রতা ইসলামী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ — শরীর, পোশাক ও স্থান পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি।
- ইসলাম সবসময় সহজতা ও বাস্তবতার ধর্ম — কষ্ট নয়, বরং সুবিধা দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬):
- নামাজের আগে ওযু করা ফরজ।
- অপবিত্র অবস্থায় গোসল করা বাধ্যতামূলক।
- পানি না পেলে তায়াম্মুম করা বৈধ।
- ইসলাম কষ্ট নয়, সহজতা চায়।
- পবিত্রতা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার প্রতীক।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাঁর অনুগ্রহ ও অঙ্গীকার স্মরণ করতে বলেছেন। ইসলামে বিশ্বাসী হওয়ার পর প্রতিটি মুমিন আল্লাহর সঙ্গে এক প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ — “আমরা শুনেছি এবং মান্য করেছি।” এটি সেই প্রতিশ্রুতির স্মারক, যা ইসলামী জীবনের মূল ভিত্তি।
আল্লাহ আমাদের innumerable (অসংখ্য) নেয়ামত দান করেছেন — জীবন, স্বাস্থ্য, ইমান, জ্ঞান, রিজিক, কুরআন, রাসূল ﷺ — সবই তাঁর অশেষ দয়া ও অনুগ্রহ। তাই বান্দার কর্তব্য হলো সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকা এবং আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা।
আয়াতের শেষে বলা হয়েছে — “আল্লাহ অন্তরের গোপন বিষয় জানেন।” অর্থাৎ, কেবল মুখে নয়, অন্তর থেকেও আল্লাহর আদেশ মেনে চলা উচিত। কারণ আল্লাহ মানুষ যা গোপন করে, সেটাও জানেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ তোমাদের দেহ বা তোমাদের চেহারার দিকে তাকান না, বরং তোমাদের অন্তরের দিকে তাকান।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের মুসলমানদের উচিত আল্লাহর সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি স্মরণ রাখা — অর্থাৎ, শুধুমাত্র নামাজ, রোজা নয়, বরং পূর্ণ জীবন আল্লাহর নির্দেশে পরিচালিত করা।
- অনেক সময় মানুষ মুখে ধর্মের কথা বলে, কিন্তু অন্তরে সেই বিশ্বাস থাকে না — এটি মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য।
- আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশই সত্যিকারের ঈমান।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭):
- আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত।
- আল্লাহর সঙ্গে করা অঙ্গীকার পূর্ণ করা ঈমানের দাবি।
- কেবল মুখে নয়, অন্তর থেকেও আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে।
- আল্লাহ অন্তরের সবকিছু জানেন, তাই আন্তরিক হতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে ন্যায়বিচার এমন এক মূলনীতি যা শত্রু বা বন্ধুর ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।
“কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়বিচার থেকে বিরত না রাখে।” — অর্থাৎ, যদি কেউ তোমার শত্রু হয়, তবুও তার সঙ্গে অন্যায় করো না। ন্যায়বিচার করাই আল্লাহর কাছে প্রকৃত তাকওয়া বা পরহেজগারির প্রতীক।
ইসলাম ন্যায় ও সততার এমন এক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে আবেগ, জাতীয়তা বা ব্যক্তিগত ক্ষোভ স্থান পায় না। ন্যায়বিচার আল্লাহর একটি নামের প্রতিফলন — তিনি নিজেও ন্যায়বিচারক (العَدْل), তাই তাঁর বান্দাদেরও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সাত শ্রেণির মানুষ আছে, যাদেরকে আল্লাহ সেই দিনে (কিয়ামতের দিনে) তাঁর আরশের ছায়া দিবেন, যখন অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হলো — ন্যায়পরায়ণ শাসক।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৬০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০৩১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- ন্যায়বিচার শুধুমাত্র আদালতে নয়, পরিবার, ব্যবসা, সমাজ — প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
- শত্রুতা বা রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না।
- যে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শান্তি ও তাকওয়া স্বাভাবিকভাবে প্রস্ফুটিত হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮):
- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ঈমানের অংশ।
- শত্রুর প্রতিও ন্যায়বিচার করা তাকওয়ার পরিচায়ক।
- ন্যায়পরায়ণতা সমাজে শান্তি ও স্থিতি আনে।
- আল্লাহ সবকিছু জানেন, তাই ভণ্ডামি বা পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত থাকতে হবে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদের জন্য এক মহিমান্বিত প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। যারা ঈমান আনবে, আল্লাহর আদেশ পালন করবে, এবং সৎকাজে আত্মনিয়োগ করবে — তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দুইটি বিশাল পুরস্কার রয়েছেঃ
১️ মাগফিরাত (ক্ষমা) — তাদের পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ২️ আজরুন আযীম (মহাপুরস্কার) — জান্নাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি।
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন এক অঙ্গীকার, যা কখনো ভঙ্গ হয় না, যদি বান্দা আন্তরিকভাবে ঈমান ও আমল অবলম্বন করে। এই আয়াত মুমিনদের জন্য এক বিশাল আশা ও প্রেরণার উৎস।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তার জন্য জান্নাত নিশ্চিত।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৪৮৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি নামাজ, রোজা, দান ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে — সে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত।
- মুমিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৎকর্ম করার মাধ্যমে ক্ষমা ও জান্নাত লাভের আশা রাখতে পারে।
- এই আয়াত আল্লাহর রহমত ও প্রতিশ্রুতির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জাগায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯):
- ঈমান ও সৎকর্ম আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কারের একমাত্র পথ।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনো মিথ্যা নয়।
- যে ঈমান ও সৎকাজে অবিচল থাকে, তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত।
- মুমিন সর্বদা আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশায় কাজ করবে।
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের বিপরীতে একটি সতর্কবাণী। যেখানে আয়াত ৯-এ আল্লাহ ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য **ক্ষমা ও মহান পুরস্কারের** প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এখানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন — যারা ঈমান অস্বীকার করে ও তাঁর নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে, তাদের শেষ পরিণতি হলো **জাহান্নাম (আগুনের বাসস্থান)**।
অর্থাৎ, ঈমান ও সৎকর্মের বিপরীতে অবিশ্বাস ও অবাধ্যতার ফল হলো শাস্তি। “আয়াত” বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে — কুরআনের নির্দেশ, আল্লাহর প্রেরিত নবীগণ, এবং সৃষ্টিজগতের নিদর্শনসমূহ — যেগুলোর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহকে চিনতে পারে।
যারা এগুলোকে মিথ্যা বলে অস্বীকার করে, তাদের অন্তর অন্ধ হয়ে যায়, আর তাদের জন্য জান্নাতের বদলে জাহান্নাম নির্ধারিত হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “অবিশ্বাসই হলো সেই পথ, যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়; আর ঈমান ও সৎকাজই জান্নাতের পথ।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ আল্লাহর কিতাব ও নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে — এ আয়াত তাদের জন্য এক কঠিন সতর্কতা।
- আল্লাহর প্রেরিত বার্তাগুলো অবজ্ঞা করা বা তুচ্ছজ্ঞান করা অবিশ্বাসেরই একটি রূপ।
- যে ব্যক্তি কুরআনের দিকনির্দেশনা থেকে দূরে থাকে, সে ধীরে ধীরে জাহান্নামের পথে চলে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০):
- অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা জাহান্নামের কারণ।
- আল্লাহর আয়াত মানা ও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ঈমানের শর্ত।
- জাহান্নাম হলো সেই সকল মানুষের আবাসস্থল, যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে ও তাঁর দয়া প্রত্যাখ্যান করে।
- আল্লাহর সতর্কবাণী সর্বদা মনে রেখে ঈমান রক্ষা করা জরুরি।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন অতীতের সেই ঘটনাগুলো, যেখানে তাঁর অনুগ্রহের ফলে শত্রুরা তাদের ক্ষতি করতে পারেনি।
অনেক তাফসীরবিদের মতে, এই আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিল — যখন একদল ইহুদি (বা মুশরিক) নবী করিম ﷺ এবং তাঁর সাহাবিদের ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন এবং তাদের হাত মুমিনদের দিকে বাড়াতে দেননি।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ বিশ্বাসীদের শিক্ষা দিচ্ছেন — তাঁর অনুগ্রহ ও সুরক্ষা সর্বদা তোমাদের সঙ্গে আছে, তাই তাঁর প্রতি তাকওয়া রাখো এবং কেবল তাঁর উপরই ভরসা করো।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।” (📖 সহিহ তিরমিজি, হাদিস: ২৫১১; সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৪৭২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যখন মানুষ বিপদের মুখে পড়ে, তখন আল্লাহর সাহায্যই প্রকৃত রক্ষা দেয়।
- বিশ্বাসীকে সর্বদা মনে রাখতে হবে, শত্রুদের ষড়যন্ত্র যত বড়ই হোক, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিছুই ঘটতে পারে না।
- তাকওয়া ও আল্লাহর উপর ভরসা জীবনকে নিরাপদ ও শান্ত রাখে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১):
- আল্লাহর অনুগ্রহ ও সুরক্ষা সর্বদা মুমিনদের সঙ্গে থাকে।
- শত্রুর ষড়যন্ত্রও আল্লাহ ব্যর্থ করে দিতে পারেন।
- তাকওয়া ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখা ঈমানের অপরিহার্য অংশ।
- স্মরণশক্তি ও কৃতজ্ঞতা ঈমানকে শক্তিশালী করে।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইল (ইহুদি জাতি)-এর সাথে করা তাঁর চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ তাদের কাছে দায়িত্ব দিয়েছিলেন — নামাজ কায়েম করা, যাকাত প্রদান, নবীদের প্রতি ঈমান আনা ও সাহায্য করা, এবং আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করা।
বিনিময়ে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন — তাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল। তারা নবীদের অবাধ্যতা করেছিল, কিছুকে হত্যা করেছিল, এবং আল্লাহর পথ থেকে সরে গিয়েছিল।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে — যারা এই অঙ্গীকারের পরেও অবিশ্বাস করলো, তারা সরল পথ থেকে দূরে সরে গেল। এটি মুসলমানদের জন্যও একটি সতর্কবার্তা — যেন আমরা পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মতো আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ না করি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেন।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৮৪১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০২৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মুসলমানদেরও আল্লাহর সাথে একটি অঙ্গীকার রয়েছে — নামাজ কায়েম, যাকাত প্রদান, নবীর আদেশ পালন, এবং আল্লাহর পথে দান।
- যারা এই অঙ্গীকার রক্ষা করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেন।
- কিন্তু যারা অবহেলা ও অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়, তারা পথভ্রষ্ট জাতিগুলোর মতো ধ্বংসের দিকে যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২):
- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সাথে অঙ্গীকার করেছেন নামাজ, যাকাত ও ঈমানের।
- আল্লাহর পথে দান করা উত্তম ঋণ, যা জান্নাতের কারণ।
- আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেন, কিন্তু মানুষ প্রায়ই ভঙ্গ করে।
- অঙ্গীকার ভঙ্গ মানুষকে সরল পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের অঙ্গীকারভঙ্গের ফলাফল বর্ণনা করেছেন। তারা বারবার আল্লাহর সাথে করা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল, এজন্য আল্লাহ তাদের উপর **লানত (অভিশাপ)** আরোপ করেন এবং তাদের অন্তরকে কঠিন করে দেন, যাতে তারা সত্য গ্রহণ করতে না পারে।
তারা আল্লাহর বাণী বিকৃত করত — কুরআনের ভাষায় “يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ” অর্থাৎ, আল্লাহর কিতাবের শব্দ ও অর্থ পরিবর্তন করত নিজেদের স্বার্থে।
তারা আল্লাহর নির্দেশনা ভুলে গিয়েছিল এবং প্রতারণা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আল্লাহ নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে নির্দেশ দেন — “তুমি তাদের ক্ষমা করো ও উপেক্ষা করো”, কারণ ইসলামের শিক্ষা প্রতিশোধ নয়, বরং ক্ষমা ও দয়া।
আয়াতের শেষে আল্লাহ ঘোষণা করেন — “আল্লাহ মুহসিন (সৎকর্মশীল) মানুষদের ভালোবাসেন।” অর্থাৎ, যারা অন্যের অন্যায়ের প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন; আর যে নম্রতা প্রদর্শন করে, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কেউ কেউ ধর্মের আদেশ বিকৃত করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে — এটি বনি ইসরাইলের ভুলের পুনরাবৃত্তি।
- ক্ষমা ও সহনশীলতা আল্লাহর প্রিয় গুণ — প্রতিশোধের বদলে ধৈর্য ও দয়া অবলম্বন করা উচিত।
- আল্লাহর দয়া পেতে হলে মুহসিন হতে হবে — অর্থাৎ অন্যদের প্রতি দয়া, ন্যায় ও ক্ষমা প্রদর্শনকারী।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৩):
- অঙ্গীকার ভঙ্গ আল্লাহর অভিশাপ ও হৃদয়ের কঠোরতার কারণ।
- আল্লাহর বাণী বিকৃত করা গুরুতর অপরাধ।
- ক্ষমা ও উপেক্ষা আল্লাহপ্রিয় গুণ।
- সৎকর্মশীলদের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা চিরন্তন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা খ্রিস্টানদের (নাছারাদের) সম্পর্কেও সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। আল্লাহ তাদের সাথেও একটি **অঙ্গীকার (মীসাক)** করেছিলেন — যেন তারা তাঁর বার্তা, কিতাব ও রাসূলদের অনুসরণ করবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিল এবং আল্লাহর বাণীর একাংশ ভুলে গিয়েছিল বা বিকৃত করেছিল।
এর ফলস্বরূপ আল্লাহ তাদের মধ্যে পারস্পরিক **শত্রুতা ও বিদ্বেষ** সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষী যে, খ্রিস্টান সমাজ বিভক্ত হয়েছে নানা সম্প্রদায়ে — যেমন ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্স ইত্যাদি, এবং একে অপরের বিরুদ্ধে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুদ্ধ করেছে।
এটি ছিল তাদের ভুলে যাওয়া ও অবাধ্যতার পার্থিব শাস্তি, আর আখেরাতে আল্লাহ তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তারা যা করেছিল — বিশ্বাসে, কাজে ও আচরণে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “বনি ইসরাইল তেহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মতও তেমনি বিভক্ত হবে; কিন্তু যারা আমার পথ ও সাহাবিদের পথ অনুসরণ করবে, তারাই মুক্তি পাবে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৬৪১)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যখন মানুষ আল্লাহর কিতাব ও শিক্ষা ভুলে যায়, তখন সমাজে বিভেদ, শত্রুতা ও ঘৃণা জন্ম নেয়।
- ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে দূরে গেলে ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়।
- মুমিনদের উচিত এই শিক্ষা থেকে সাবধান হওয়া, যেন তারাও কোরআনের শিক্ষা ভুলে বিভক্ত না হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৪):
- খ্রিস্টানদের মতো মুসলমানদেরও উচিত আল্লাহর অঙ্গীকার স্মরণ রাখা।
- আল্লাহর শিক্ষা ভুলে গেলে সমাজে বিভেদ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়।
- ঐক্য, শিক্ষা ও তাকওয়াই মুমিন সমাজের শক্তি।
- কিয়ামতের দিনে আল্লাহ প্রত্যেককে তার কাজ অনুযায়ী জবাবদিহি করাবেন।
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিস্টানদের) উদ্দেশ্যে বলছেন — আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ রাসূল, মুহাম্মদ ﷺ-কে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি তাদের কাছে কিতাবের সেই সত্যগুলো প্রকাশ করেন যা তারা গোপন করে রেখেছিল।
আহলে কিতাবরা তাদের ধর্মগ্রন্থ (তাওরাত ও ইঞ্জিল)-এর বহু বিধান বিকৃত করেছিল বা গোপন করেছিল নিজেদের স্বার্থে। নবী করিম ﷺ-এর আগমন সেই গোপন সত্যকে উদ্ঘাটন করেছে।
“নূর” বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ, কারণ তিনি মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও আলোকবর্তিকা। আর “কিতাবুম মুবীন” বলতে বোঝানো হয়েছে কুরআন মাজীদ, যা স্পষ্ট নির্দেশনা, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী (ফুরকান)।
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সব নবুয়তের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আগমন ছিল পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার ও পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো এক ব্যক্তির মতো, যিনি একটি সুন্দর ভবন নির্মাণ করেন কিন্তু এক কোণে একটি ইট ফাঁকা রাখেন; মানুষ আসে ও বলে — যদি এই ইটটি বসানো হতো, ভবনটি পূর্ণ হতো। আমিই সেই শেষ ইট, এবং আমি নবুওয়াতের সীল।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৫৩৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কুরআন সেই স্পষ্ট আলোকবর্তিকা যা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ মানবজাতির জন্য আল্লাহর পাঠানো নূর ও রহমত।
- যারা সত্যকে গোপন করে, তাদের জন্য এই আয়াত এক কঠিন সতর্কতা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৫):
- নবী মুহাম্মদ ﷺ আহলে কিতাবদের প্রতি আল্লাহর শেষ সতর্কবার্তা।
- কুরআন হলো স্পষ্ট কিতাব — সত্য ও আলোকের উৎস।
- সত্য গোপন করা আল্লাহর নিকট মারাত্মক অপরাধ।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো “নূর”।
“نُورٌ” (নূর) শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা:
“নূর” শব্দটি আরবি نُورٌ থেকে এসেছে, যার অর্থ — আলো, দিশা, আলোকিত করা ও পথপ্রদর্শন। এখানে এটি বোঝায় আল্লাহর সেই আলো, যার মাধ্যমে অন্ধকার দূর হয়। এই আয়াতে “নূর” দ্বারা বোঝানো হয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ।
কেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে “নূর” বলা হয়েছে:
- ১️ মানবজাতির অন্ধকার দূর করেছেন:
নবী মুহাম্মদ ﷺ এমন এক যুগে আগমন করেছিলেন, যখন মানুষ ছিল অজ্ঞতা ও অন্যায়ে নিমজ্জিত। তিনি আল্লাহর নির্দেশনা এনে মানবজাতিকে আলোকিত করেছেন। 📖 “আর তিনি তোমাদের আহ্বান করেন আলোর দিকে।” (সূরা আল-আহযাব ৩৩:৪৬) - ২️ হিদায়াতের প্রদীপ:
নবী ﷺ ছিলেন আল্লাহর প্রদত্ত জীবন্ত হিদায়াতের বাতি। 📖 “হে নবী! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি ... এবং আলোকিত প্রদীপ হিসেবে।” (সূরা আল-আহযাব ৩৩:৪৫–৪৬) - ৩️ অন্তরের আলো জাগিয়েছেন:
তিনি মানুষের হৃদয়ে ঈমানের আলো প্রজ্বলিত করেছেন। 📖 “আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর।” (সূরা আন-নূর ২৪:৩৫) - ৪️ কিয়ামত পর্যন্ত রহমতের প্রতীক:
নবী ﷺ আল্লাহর রহমতের প্রতিফলন — 📖 “আমি তোমাকে পাঠাইনি, কিন্তু বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবে।” (সূরা আল-আম্বিয়া ২১:১০৭)
সংক্ষেপে “নূর” শব্দের তিন স্তর:
| স্তর | অর্থ | ব্যাখ্যা |
|---|---|---|
| ১️ | রাসূলুল্লাহ ﷺ | মানবজাতির আলোকবর্তিকা, যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় এনেছেন। |
| ২️ | কুরআনুল কারিম | আল্লাহর স্পষ্ট কিতাব, যা হিদায়াত ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। |
| ৩️ | হিদায়াত (দিশা) | ঈমান, তাকওয়া ও সঠিক পথের আলো। |
উপসংহার:
“নূর” (نُورٌ) শব্দটি ইসলামের গভীরতম আধ্যাত্মিক প্রতীক।
রাসূলুল্লাহ ﷺ সেই জীবন্ত আলো, যার মাধ্যমে আল্লাহ মানবজাতিকে দিশা দিয়েছেন।
📖 “قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ”
“নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এক নূর (নবী মুহাম্মদ ﷺ)
এবং এক স্পষ্ট কিতাব (কুরআন)।” — (সূরা আল-মায়েদা ৫:১৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন — কুরআন ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আগমন মানবজাতির জন্য কেমন বরকতময়। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে কুরআনের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাঁদের তিনটি মহান অনুগ্রহ দান করেন —
১️ হিদায়াত — “يَهْدِي بِهِ ٱللَّهُ...”
আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে তাদেরকে পথ দেখান, যাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। অর্থাৎ, কুরআন শুধুমাত্র পাঠের জন্য নয় — এটি সঠিক জীবনের দিকনির্দেশিকা।
২️ শান্তি ও নিরাপত্তার পথ — “سُبُلَ ٱلسَّلَـٰمِ”
“সুবুলাস্ সালাম” অর্থ শান্তির পথসমূহ — আল্লাহর পথে চলা মানেই মানসিক, আধ্যাত্মিক ও চিরস্থায়ী শান্তি লাভ করা। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানুষকে শান্তি ও ভারসাম্যের দিকে আহ্বান করে।
৩️ আলোকিত জীবন — “يُخْرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ”
কুরআনের আলো মানুষের অন্তরের অন্ধকার দূর করে। এখানে “অন্ধকার” বলতে বোঝানো হয়েছে অবিশ্বাস, অজ্ঞতা, অন্যায় ও পাপাচার। আর “নূর” অর্থ জ্ঞান, ঈমান, সত্য ও আল্লাহর দিকনির্দেশনা।
এরপর আল্লাহ বলেন — “وَيَهْدِيهِمْ إِلَىٰ صِرَٰطٍ مُّسْتَقِيمٍ” অর্থাৎ, আল্লাহ তাদেরকে একমাত্র সোজা পথে পরিচালিত করেন, যা জান্নাতের পথ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “কুরআন এমন এক আলো, যা অন্ধকারে পথ দেখায়; এটি আল্লাহর দড়ি, যা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলে কখনো পথ হারাবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮০৪; তিরমিজি, হাদিস: ২৯১০)
“অন্ধকার থেকে আলোতে” (মিনাজ-জুলুমাত ইলান-নূর) — এর ব্যাখ্যা:
- “অন্ধকার” = অবিশ্বাস, পাপ, ভয়, অন্যায়, বিভ্রান্তি।
- “আলো” = ঈমান, জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও আল্লাহর সন্তুষ্টি।
- কুরআনই সেই আলো, যা মানুষকে ভুল জীবন থেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি কুরআনের শিক্ষায় জীবন পরিচালনা করে, সে হৃদয়ের শান্তি ও আলো লাভ করে।
- কুরআন থেকে দূরে থাকা মানে অন্ধকারে থাকা — বিভ্রান্তি ও অসন্তুষ্টির জীবন।
- আজকের দুনিয়ায় আল্লাহর আলো ছাড়া কোনো প্রকৃত শান্তি নেই।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৬):
- কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য সর্বোত্তম দিকনির্দেশনা।
- যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, কুরআন তাদের হিদায়াত দেয়।
- কুরআনের আলো অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করে।
- সত্যিকারের শান্তি কেবল আল্লাহর পথে অনুসরণেই পাওয়া যায়।
উপসংহার:
এই আয়াতের মূল শিক্ষা হলো —
কুরআনই মানবতার নূর ও হিদায়াত।
যারা এর আলো গ্রহণ করে, আল্লাহ তাদেরকে অন্ধকার জীবন থেকে বের করে
শান্তি ও সোজা পথে পরিচালিত করেন।
📖 “يُخْرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ”
“তিনি তাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা খ্রিস্টানদের ভুল বিশ্বাসের স্পষ্ট প্রতিবাদ করেছেন — যারা বলেন, “ঈসা (আঃ) নিজেই আল্লাহ”। কুরআন স্পষ্ট ঘোষণা করে — এটি **অবিশ্বাস (কুফর)**। কারণ আল্লাহ কখনোই কোনো সৃষ্টি, নবী বা মানুষ নন। তিনি একক, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান।
আল্লাহ বলেন — “বলো, যদি আল্লাহ চান ঈসা ইবনে মরিয়ম, তাঁর মাকে ও পৃথিবীর সবাইকে ধ্বংস করে দেন, তবে কে আল্লাহকে বাধা দিতে পারবে?” অর্থাৎ, ঈসা (আঃ) ও মরিয়ম দুজনই আল্লাহর সৃষ্টি; তারা আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছুই করতে পারেন না। তাদের কোনো ঈশ্বরত্ব নেই।
এরপর আল্লাহ বলেন — “ওয়া লিল্লাহি মুলকুস্ সামা-ওয়াতি ওয়াল্ আরদ্ব” অর্থাৎ, আসমান ও জমিনের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন ও যা ইচ্ছা করেন তা করেন। এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহর উপর কারো কোনো ক্ষমতা নেই — তিনিই একমাত্র অধিপতি ও সৃষ্টিকর্তা।
“يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ” — আল্লাহ যেভাবে চান, যাকে চান, যেমনভাবে চান সৃষ্টি করেন। যেমন তিনি আদম (আঃ)-কে কোনো পিতা-মাতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন, হাওয়া (আঃ)-কে পুরুষ থেকে, এবং ঈসা (আঃ)-কে পিতা ছাড়া — সবই আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন, ঈশ্বরত্বের নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি বলে ‘আল্লাহ তিনজনের একজন’, সে অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক মানুষ নবী ঈসা (আঃ)-কে ঈশ্বর মনে করে, অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহর একজন শ্রেষ্ঠ রাসূল।
- এই আয়াত মুসলমানদের শেখায় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউই ক্ষমতাবান নয় — এমনকি নবী-রাসূলও আল্লাহর ইচ্ছার অধীন।
- যে বিশ্বাসে মানুষ আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করে, তা সর্ববৃহৎ অপরাধ — শিরক।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৭):
- ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ বলা কুফরি বিশ্বাস।
- আল্লাহ সবকিছুর মালিক, তিনিই সৃষ্টি ও ধ্বংসের ক্ষমতার অধিকারী।
- মানুষ বা নবীর কোনো ঐশ্বরিক শক্তি নেই — সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাধীন।
- আল্লাহ একক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো অংশীদার নেই।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে,
যারা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ বলে বিশ্বাস করে তারা প্রকৃতপক্ষে সত্য থেকে দূরে।
আল্লাহ এক, সর্বশক্তিমান, এবং আসমান-জমিনের সমস্ত রাজত্ব তাঁর।
📖 “وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ قَدِيرٞ”
“আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মিথ্যা গর্বের প্রতিবাদ করেছেন। তারা দাবি করত — “আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয় মানুষ।” অর্থাৎ, তারা মনে করত আল্লাহ তাদের কখনো শাস্তি দেবেন না, কারণ তারা তাঁর বিশেষ জাতি বা প্রিয়জন।
আল্লাহ তাদের এই দাবির জবাবে নবী ﷺ-কে নির্দেশ দেন বলতে — “যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহর প্রিয়জন হও, তবে তোমরা কেন তোমাদের পাপের কারণে শাস্তি পেয়ে থাকো?” অর্থাৎ, তোমাদের কষ্ট, বিপদ ও লাঞ্ছনা প্রমাণ করে যে তোমরাও অন্যান্য মানুষের মতোই — আল্লাহর ন্যায়বিচারের অধীনে সমান।
তারপর আল্লাহ বলেন — “বরং তোমরা তাঁরই সৃষ্টি।” মানুষ হিসেবে সবাই সমান; জাতি বা ধর্মের গর্বে আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায় না। বরং আল্লাহর প্রিয় তারা, যারা **তাকওয়াবান ও সৎকর্মশীল**।
এরপর আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন — “ইয়াগফিরু লিমান ইয়াশা-উ ওা ইউ‘ায্জিবু মান ইয়াশা-উ।” অর্থাৎ, আল্লাহ যাকে চান ক্ষমা করেন, যাকে চান শাস্তি দেন। এখানে বোঝানো হয়েছে — ক্ষমা বা শাস্তি কারো জাতি, বংশ বা ধর্মের নামে নয়; বরং কারো কাজ ও ঈমানের ভিত্তিতে।
শেষে আল্লাহ বলেন — “ওা লিল্লাহি মুলকুস্ সামা-ওয়াতি ওয়াল্ আরদ্বি ওা মা বাইনাহুমা।” অর্থাৎ, আসমান ও জমিনের মালিক আল্লাহ — তিনিই সবকিছুর অধিপতি, এবং একদিন সবাই তাঁর কাছেই ফিরে যাবে বিচারের জন্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ তোমাদের বংশ বা জাতি দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক মানুষ ধর্ম বা বংশের অহংকারে ভাবে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আল্লাহর প্রিয় — অথচ প্রকৃত প্রিয়জন তারা, যারা তাকওয়া ও সৎকর্মে অগ্রগামী।
- আল্লাহর ভালোবাসা জাতি বা পরিচয়ে নয়, কর্ম ও ঈমানের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
- মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো — পাপ থেকে বিরত থাকা ও তওবা করা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৮):
- আল্লাহর প্রিয়জন হওয়ার দাবি কেবল কথায় নয়, আমলে প্রমাণিত হয়।
- আল্লাহর শাস্তি ও ক্ষমা তাঁর ইচ্ছাধীন, কারও জাতি বা মর্যাদায় নির্ভরশীল নয়।
- সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, তাই কেউই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত নয়।
- অবশেষে সবাই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে, সেদিন শুধু আমলই মূল্যবান হবে।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের একমাত্র পথ হলো ঈমান, তাকওয়া ও সৎকর্ম।
জাতি, বংশ বা পরিচয়ের অহংকার আল্লাহর কাছে মূল্যহীন।
📖 “يَغْفِرُ لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُ”
“তিনি যাকে চান ক্ষমা করেন এবং যাকে চান শাস্তি দেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিস্টানদের) উদ্দেশ্যে আবার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন — নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে আমি পাঠিয়েছি এমন এক সময়ে, যখন পূর্ববর্তী নবীদের আগমন বন্ধ ছিল (প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি সময়)।
এই “নবুয়তের বিরতি”কে বলা হয় “فَتْرَةٌ مِّنَ ٱلرُّسُلِ” (ফাত্রাতুন মিনার্ রুসুল), অর্থাৎ এমন এক সময় যখন কোনো নবী বা ওহি ছিল না। মানুষ তখন বিভ্রান্ত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পথভ্রষ্ট ছিল।
আল্লাহ বলেন — আমি নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে পাঠিয়েছি যেন তোমরা পরে অজুহাত না দিতে পারো — “আমাদের কাছে কেউ আসেনি, যে আমাদেরকে আল্লাহর বার্তা শুনিয়েছে।” এখন তোমাদের কাছে এসেছেন “বাশীর” (সুসংবাদদাতা) ও “নযীর” (সতর্ককারী) — অর্থাৎ নবী ﷺ তোমাদের জানাচ্ছেন, যারা ঈমান আনে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ, আর যারা অবিশ্বাস করে তাদের জন্য জাহান্নামের সতর্কতা।
আয়াতের শেষাংশ: “ওয়াল্লাহু ‘আলা কুল্লি শাই-ইন কদীর” — আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান; তিনি নবুওয়াত প্রেরণ করেন, যাকে চান মনোনীত করেন, আর যাকে চান তাঁর মাধ্যমে পথপ্রদর্শন করেন।
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, নবী মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বশেষ রাসূল, এবং তাঁর আগমনের পর আর কোনো নবী আসবে না। তিনি সেই আলোকিত বার্তাবাহক, যিনি অন্ধকার যুগে মানবজাতিকে আলোর পথে এনেছেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার ও পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো এক রাজপ্রাসাদের মতো, যা সুন্দরভাবে নির্মিত, কিন্তু এক কোণে একটি ইটের জায়গা খালি। আমি সেই শেষ ইট — আমার আগমনেই নবুওয়াত সম্পূর্ণ হয়েছে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৫৩৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৮৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- নবী মুহাম্মদ ﷺ-ই সেই শেষ নবী, যাঁর আগমন নবুওয়াতের ধারাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
- তাঁর আগমনের পূর্বে মানবসভ্যতা বিভ্রান্তি ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
- আজও এই পৃথিবীতে কুরআনই সেই আলোর উৎস, যা মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১৯):
- রাসূলুল্লাহ ﷺ নবুওয়াতের বিরতি-পর্বে প্রেরিত আল্লাহর সর্বশেষ নবী।
- আল্লাহর দয়া এই যে, তিনি মানুষকে একা ফেলে দেননি, বরং পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছেন।
- নবী ﷺ হচ্ছেন সুসংবাদদাতা (বাশীর) ও সতর্ককারী (নযীর)।
- নবুওয়াতের ধারার পূর্ণতা আল্লাহর সর্বশক্তিমান সত্তার নিদর্শন।
উপসংহার:
এই আয়াত প্রমাণ করে —
নবী মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর প্রেরিত শেষ নবী,
যিনি দীর্ঘ নীরবতার পর মানবজাতিকে আবার আল্লাহর পথে আহ্বান করেছেন।
কুরআন তাঁর হাতে আল্লাহর সর্বশেষ দিশার আলো।
📖 “فَقَدْ جَآءَكُم بَشِيرٞ وَنَذِيرٞ”
“তোমাদের কাছে এসেছেন এক সুসংবাদদাতা ও এক সতর্ককারী।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের প্রতি নবী মূসা (আঃ)-এর উপদেশ বর্ণনা করেছেন। মূসা (আঃ) তাদের স্মরণ করিয়ে দেন আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহ ও দয়া, যা তিনি বিশেষভাবে তাদের জাতির উপর বর্ষণ করেছিলেন।
“يَـٰقَوْمِ ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَةَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ” অর্থাৎ, “হে আমার জাতি! আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করো।” আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার বহু বরকত দিয়েছিলেন — নবুওয়াত, রাজত্ব, মুক্তি, মান্না ও সালওয়া ইত্যাদি।
১️ আল্লাহ তাদের মধ্যে নবী প্রেরণ করেছিলেন: বনি ইসরাইলের মধ্যে অসংখ্য নবী প্রেরিত হয়েছেন — যেমন ইয়াকুব (আঃ), ইউসুফ (আঃ), মূসা (আঃ), হারুন (আঃ), দাউদ (আঃ), সুলাইমান (আঃ), ইয়াহইয়া (আঃ), ও ঈসা (আঃ)। এটি ছিল এক মহান সম্মান।
২️ “ওয়া জা‘আলাকুম মুলূকান্” — তোমাদের রাজা বানিয়েছিলেন: অর্থাৎ, তোমাদের স্বশাসন ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। মিসর থেকে মুক্তির পর তোমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে শাসন করেছিলে। কেউ কেউ বলেন, এখানে “মুলূকান” অর্থ “মর্যাদাশালী, স্বাধীন ও সমৃদ্ধ মানুষ।”
৩️ “ওয়া আতা-আকুম মা লাম ইউ’তিহি আহাদান মিনাল ‘আলামীন” — আল্লাহ তোমাদের এমন নিয়ামত দিয়েছেন, যা অন্য কাউকে দেননি — যেমন মান্না-সালওয়া খাদ্য, সমুদ্র বিভাজন, মেঘের ছায়া, ও তাওরাতের মতো ঐশী গ্রন্থ।
আয়াতের মূল বার্তা: নবী মূসা (আঃ) বনি ইসরাইলকে বলেছিলেন — আল্লাহর নিয়ামত ভুলে যাওয়া অকৃতজ্ঞতার লক্ষণ। আল্লাহ তোমাদের যেভাবে সম্মানিত করেছেন, তেমনি তোমাদের উচিত কৃতজ্ঞ হওয়া ও তাঁর আদেশ মেনে চলা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে মানুষ আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ডেকে আনে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে জাতি আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করে, সে জাতি বরকতময় হয়।
- যে জাতি অকৃতজ্ঞ হয়, তাদের থেকে আল্লাহ নিয়ামত ছিনিয়ে নেন।
- আজও মুসলমানদের উচিত আল্লাহর দেওয়া স্বাধীনতা, ঈমান ও দিকনির্দেশনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২০):
- আল্লাহর নিয়ামত সবসময় স্মরণ রাখা ঈমানের অংশ।
- কৃতজ্ঞ জাতি সর্বদা আল্লাহর বরকত লাভ করে।
- নবী ও আল্লাহর দান স্মরণ করা মানুষকে বিনয়ী ও অনুগত রাখে।
- অকৃতজ্ঞতা আল্লাহর নিয়ামত হ্রাসের কারণ।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করো, কৃতজ্ঞ হও, এবং তা তাঁর পথে ব্যবহার করো।
যেমন আল্লাহ বনি ইসরাইলকে নবুওয়াত, রাজত্ব ও বরকত দিয়েছিলেন,
তেমনি আল্লাহ আমাদেরকেও দিয়েছেন ঈমান, কুরআন ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নেতৃত্ব।
📖 “ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَةَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ”
“তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২০)
এই আয়াতে নবী মূসা (আঃ) তাঁর জাতি — বনি ইসরাইলকে — “পবিত্র ভূমি” (আরদ্বুল মুকাদ্দাসা)-তে প্রবেশের নির্দেশ দিচ্ছেন। এই ভূমি বলতে বোঝানো হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস বা ফিলিস্তিনের এলাকা, যা আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন।
তারা তখন মিসর থেকে মুক্ত হয়ে মরুভূমিতে অবস্থান করছিল। আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন — যদি তারা ঈমান ও সাহস রাখে, তাহলে তারা ঐ ভূমিতে প্রবেশ করে শান্তি পাবে।
কিন্তু মূসা (আঃ)-এর এই আহ্বান ছিল শুধুমাত্র ভূমিতে প্রবেশ নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশ মানা, জিহাদে দৃঢ় থাকা এবং কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। কারণ “আরদ্বুল মুকাদ্দাসা” শুধু ভূমি নয় — এটি ছিল আল্লাহর পরীক্ষা ও বরকতের ক্ষেত্র।
“ٱدْخُلُوا۟ ٱلْأَرْضَ ٱلْمُقَدَّسَةَ” — এখানে “পবিত্র ভূমি” বলতে বোঝানো হয়েছে এমন এক ভূমি, যা নবীদের আগমন, ওহি ও বরকতের মাধ্যমে আল্লাহ পবিত্র করেছেন। (সূরা আল-আনবিয়া ২১:৭১; সূরা আল-ইসরা ১৭:১)
“وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَىٰٓ أَدْبَارِكُمْ” — অর্থাৎ, “পেছনে ফিরো না”, মানে কাপুরুষতার কারণে ভয় পেয়ো না, আল্লাহর আদেশ থেকে পিছু হটিও না। যদি তোমরা তা করো, তবে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আয়াতের মূল শিক্ষা: আল্লাহর নির্দেশ সবসময় বিশ্বাস ও সাহসের সাথে গ্রহণ করতে হবে। ভয়, দুনিয়ার মোহ বা অলসতা মানুষকে আল্লাহর বরকত থেকে বঞ্চিত করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আর যে আল্লাহর পথে অটল থাকে, আল্লাহ তার জন্য পথ খুলে দেন।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যখন আল্লাহ কোনো সুযোগ বা দায়িত্ব দেন, তখন ভয় না পেয়ে তা গ্রহণ করা উচিত — কারণ আল্লাহ সাহায্য করেন দৃঢ় ঈমানদারদের।
- যারা পেছনে সরে যায়, তারা বরকত ও সফলতা হারায়।
- আল্লাহর পথের বাধা কেবল সাহস ও তাওয়াক্কুল দিয়ে অতিক্রম করা যায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২১):
- আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে ক্ষতি অনিবার্য।
- আল্লাহর পথে ভয় ও দ্বিধা পরিত্যাগ করা উচিত।
- পবিত্র ভূমি আল্লাহর এক বিশেষ বরকতের প্রতীক।
- সাহস, ঈমান ও তাওয়াক্কুল আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার মূল চাবিকাঠি।
উপসংহার:
নবী মূসা (আঃ) তাঁর জাতিকে আহ্বান করেছিলেন —
আল্লাহর প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করো,
পিছু হটো না, দুর্বল হয়ো না।
কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই ভয় পেয়েছিল ও অবাধ্য হয়েছিল।
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
আল্লাহর নির্দেশ মানা, সাহসী থাকা ও তাওয়াক্কুল করা
মুমিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।
📖 “فَتَنقَلِبُوا۟ خَـٰسِرِينَ”
“তা না হলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২১)
নবী মূসা (আঃ) যখন তাঁর জাতি বনি ইসরাইলকে বলেছিলেন আল্লাহর নির্ধারিত পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে, তখন তারা ভয় ও দুর্বলতায় পূর্ণ হয়ে এই উত্তর দিয়েছিল।
তারা বলল — “হে মূসা! সেই ভূমিতে তো এক অত্যন্ত শক্তিশালী জাতি বাস করে। আমরা সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তারা সেখান থেকে চলে যায়।”
এরা ছিল **“আমালিকা” (عَمَالِقَة)** নামের এক শক্তিশালী জাতি — বিশাল দেহ, যুদ্ধকুশল ও বলবান যোদ্ধা। বনি ইসরাইল তাদের দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিল।
তাদের এই জবাবের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল — আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি অবিশ্বাস, কাপুরুষতা ও দুনিয়ার ভয়। অথচ আল্লাহ তাঁদের সাথে ছিলেন, তাঁদের পক্ষে সমুদ্র বিভাজন করেছেন, ফেরাউনকে ধ্বংস করেছেন, কিন্তু তবুও তাঁরা আল্লাহর সাহায্যের উপর বিশ্বাস রাখেনি।
“إِنَّ فِيهَا قَوْمٗا جَبَّارِينَ” অর্থাৎ, “সেখানে এক বলবান জাতি আছে” — এটা ছিল তাঁদের অজুহাত, যা আল্লাহর প্রতি দুর্বল ঈমানের প্রতিফলন।
আয়াতের মূল শিক্ষা: মুমিনের শক্তি আসে আল্লাহর উপর নির্ভরতা (তাওয়াক্কুল) থেকে, শত্রুর শক্তি দেখে ভীত হওয়া থেকে নয়। যে জাতি আল্লাহর সাহায্যে বিশ্বাস রাখে, তারা অল্প শক্তিতেও বিজয়ী হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যদি তোমরা আল্লাহর উপর প্রকৃত ভরসা করতে, তবে আল্লাহ তোমাদের এমনভাবে রিযিক দিতেন, যেমন তিনি পাখিদের রিযিক দেন — তারা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় ভরপেটে ফিরে আসে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৩৪৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- অনেক মুসলমান আল্লাহর সাহায্যের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ভয় পায় দুনিয়ার চ্যালেঞ্জের মুখে — এটি বনি ইসরাইলের সেই মনোভাবের পুনরাবৃত্তি।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ় বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়।
- যে জাতি ভয় ও দুর্বলতা ছেড়ে ঈমানের শক্তিতে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তাদেরকে সফলতা দেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২২):
- ভয় ও দুর্বলতা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি থেকে বঞ্চিত করে।
- আল্লাহর সাহায্যে বিশ্বাস রাখা মুমিনের মূল শক্তি।
- অজুহাত তৈরি করা ঈমানের দুর্বলতার লক্ষণ।
- সাহসী ও তাওয়াক্কুল সম্পন্ন জাতিই আল্লাহর বরকত লাভ করে।
উপসংহার:
বনি ইসরাইলের এই উত্তর ছিল তাদের ভয়, অবিশ্বাস ও দুর্বলতার প্রতিফলন।
আল্লাহর নির্দেশে তারা অগ্রসর না হয়ে পিছু হটেছিল,
আর এর ফলেই তারা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, সে কখনো পরাজিত হয় না।
📖 “فَإِن يَخْرُجُوا۟ مِنْهَا فَإِنَّا دَٰخِلُونَ”
“যদি তারা বেরিয়ে যায়, তাহলে আমরা প্রবেশ করব।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সেই দুই সাহসী মুমিন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, যারা বনি ইসরাইলের ভীরু জনগোষ্ঠীর বিপরীতে সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলেছিল। ঐ দুই ব্যক্তি ছিলেন — ইউশা (আঃ) (যিনি পরে নবী হন) এবং কালিব (আঃ)।
তারা আল্লাহর সাহায্যে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন এবং বললেন — “তোমরা শহরে প্রবেশ করো, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন, আমরা বিজয়ী হবো।”
এখানে “مِنَ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ” অর্থাৎ — যারা আল্লাহকে ভয় করত, শত্রুকে নয়। তারা জানত, আল্লাহর আদেশে অগ্রসর হলে কোনো শক্তিশালী জাতিও বাধা দিতে পারবে না।
“ٱدۡخُلُواْ عَلَيۡهِمُ ٱلۡبَابَ” — অর্থাৎ, “শহরের প্রবেশদ্বারে ঢুকে পড়ো।” আল্লাহর সাহায্য তখনই আসে, যখন মানুষ সাহস নিয়ে প্রথম পদক্ষেপ নেয়। যতক্ষণ না মুমিন এগিয়ে আসে, আল্লাহর সাহায্য প্রকাশ পায় না।
“وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ” — এই অংশে আল্লাহর উপর নির্ভরতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সত্যিকার মুমিন সে-ই, যে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখে এবং ফলাফলের চিন্তা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়।
এই দুই ব্যক্তি মূসা (আঃ)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কিন্তু বাকি জাতি ভয় ও দুর্বলতার কারণে পিছু হটেছিল। আল্লাহ তাঁদের সাহসের প্রশংসা করেছেন, কারণ তাঁরা ছিলেন ঈমান, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহভীতির প্রতীক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যদি তোমরা আল্লাহর উপর প্রকৃত ভরসা করতে, তবে তিনি তোমাদেরকে এমনভাবে রিযিক দিতেন, যেমন তিনি পাখিদের রিযিক দেন — তারা সকালে খালি পেটে বের হয়, এবং সন্ধ্যায় ভরপেটে ফিরে আসে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৩৪৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মুমিনদের উচিত ভয় নয়, বরং তাওয়াক্কুল ও সাহসের সাথে এগিয়ে চলা।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে, তার জন্য আল্লাহ সাহায্যের দরজা খুলে দেন।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ় বিশ্বাসই বিজয়ের মূল চাবিকাঠি।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৩):
- আল্লাহর উপর নির্ভরতা (তাওয়াক্কুল) ঈমানের চূড়ান্ত প্রকাশ।
- যে জাতি সাহসী ও আল্লাহভীরু, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন।
- ভয় নয়, কর্ম ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়।
- প্রথম পদক্ষেপে আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হয়।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ সেই দুই ঈমানদার মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন,
যারা ভীত জনগণের মধ্যে একমাত্র দৃঢ়ভাবে বলেছিল —
“চলো, আল্লাহর উপর ভরসা করো, আমরা বিজয়ী হবো।”
এটি প্রমাণ করে —
তাওয়াক্কুল ও সাহসই মুমিনের বিজয়ের মূল ভিত্তি।
📖 “وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ”
“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, যদি তোমরা সত্যিই মুমিন হও।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৩)
এই আয়াতে বনি ইসরাইলের চরম অবাধ্যতা ও কাপুরুষতার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। নবী মূসা (আঃ) তাঁদের আল্লাহর আদেশে সাহসিকতার সাথে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু তারা কেবল অমান্য করল না, বরং অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে নবীকে বলল — “তুমি ও তোমার রব্ব যুদ্ধ করো, আমরা এখানে বসে থাকব।”
এটি ছিল আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের চূড়ান্ত প্রকাশ। তারা বলল, “আমরা কখনোই সেখানে যাব না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ শক্তিশালী জাতি (আমালিকা) সেখানে আছে।” অর্থাৎ, তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, সাহায্য ও মুজিজাত সব ভুলে গিয়েছিল।
“فَٱذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَـٰتِلَآ” — এই বাক্যটি ছিল তাদের ঘোর অবাধ্যতা ও ঈমানের দুর্বলতার নিদর্শন। তারা নিজেদের নবীর সাথে এক কাতারে দাঁড়ানোর পরিবর্তে তাঁকেই আল্লাহর সাথে “যুদ্ধ করতে যাও” বলে অপমান করেছে।
এ কথার মাধ্যমে বনি ইসরাইল দেখিয়েছিল, তারা কেবল মুক্তি চায়, কিন্তু সংগ্রাম বা ত্যাগ করতে চায় না। অথচ আল্লাহর বরকত ও প্রতিশ্রুতি অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন ছিল — ঈমান, সাহস, তাওয়াক্কুল ও আনুগত্য।
আয়াতের শিক্ষা: এই ঘটনা শুধু ইতিহাস নয়, বরং আজও প্রযোজ্য। অনেক মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহ চায়, কিন্তু তাঁর পথে পরিশ্রম ও সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে যায়। আল্লাহর বরকত পেতে হলে কষ্ট, ত্যাগ ও সাহসের প্রয়োজন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “জান্নাত কঠিন ও কষ্টের জিনিসে ঘেরা, আর জাহান্নাম ভোগ-বিলাস ও সহজ জিনিসে ঘেরা।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮২২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে জাতি সংগ্রাম ও ত্যাগ ছেড়ে দেয়, তারা বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।
- মুমিনদের উচিত আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকা, কারণ আল্লাহর সাহায্য সবসময় মুজাহিদ ও সৎকর্মশীলদের জন্য।
- কষ্টের ভয় করে বসে থাকা মানুষ বরকতের সুযোগ হারায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৪):
- আল্লাহর আদেশ মানা ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা ঈমানের নিদর্শন।
- অলসতা ও ভয় মানুষকে আল্লাহর দয়া থেকে বঞ্চিত করে।
- আল্লাহর নবীকে অসম্মান করা বড় গুনাহ ও কুফরি প্রবণতা।
- আল্লাহর সাহায্য শুধু কর্মঠ, দৃঢ় ঈমানদারদের জন্য।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
যারা আল্লাহর পথে কাজ করতে দ্বিধা করে,
তারা আল্লাহর বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।
বনি ইসরাইলের এই অহংকার ও অবাধ্যতা
তাঁদের উপর আল্লাহর রোষ ও শাস্তি ডেকে এনেছিল।
আর মুমিনদের শিক্ষা হলো —
ভয় ও অলসতা ত্যাগ করে আল্লাহর আদেশে দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হও।
📖 “فَٱذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَـٰتِلَآ إِنَّا هَـٰهُنَا قَـٰعِدُونَ”
“তুমি ও তোমার রব্ব যুদ্ধ করো, আমরা তো এখানেই বসে থাকব।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৪)
যখন বনি ইসরাইল নবী মূসা (আঃ)-এর নির্দেশ অমান্য করল, এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ভয়ে পিছিয়ে গেল — তখন মূসা (আঃ) অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করেন।
তিনি বললেন — “হে আমার প্রতিপালক! আমি শুধু নিজের ও আমার ভাই হারূনের উপরই নিয়ন্ত্রণ রাখি।” অর্থাৎ, তিনি বুঝিয়ে দেন — তাঁর জাতি এতটাই অবাধ্য হয়ে গেছে যে, তাদেরকে আর পথ দেখানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। তিনি কেবল নিজের ও তাঁর সহোদর হারূন (আঃ)-এর জন্যই দায়িত্ব নিতে পারছেন।
“فَٱفْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ ٱلْقَوْمِ ٱلْفَـٰسِقِينَ” — “হে আল্লাহ! আমাদের ও এই ফাসেক (অবাধ্য) জাতির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাও।” অর্থাৎ, আল্লাহ যেন এই অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতি থেকে মূসা ও হারূন (আঃ)-কে আলাদা করে দেন, যাতে তাঁদের উপর তাদের অপরাধের প্রভাব না পড়ে।
এই দোয়া ছিল একপ্রকার **বিচার চাওয়া ও আত্মসমর্পণের দোয়া**। মূসা (আঃ) এই কথা বলেছিলেন তাঁর জাতির প্রতি চরম হতাশা ও দুঃখ থেকে। কারণ তাঁরা আল্লাহর এমন মহান অনুগ্রহ দেখেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি, বরং অমান্যতা ও অলসতার পথ বেছে নিয়েছিল।
আল্লাহ এই দোয়ার পরে (পরবর্তী আয়াতে) ঘোষণা করেন — এই অবাধ্য জাতি চল্লিশ বছর মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াবে (আয়াত ২৬), যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে এবং নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা আল্লাহর আদেশ মানবে।
আয়াতের মূল বার্তা:
একজন নবীও যদি তাঁর জাতিকে আল্লাহর পথে আনতে ব্যর্থ হন, তা প্রমাণ করে যে **হিদায়াত কেবল আল্লাহর হাতে**। নবী নির্দেশ দিতে পারেন, কিন্তু ঈমান দেওয়া কেবল আল্লাহর কাজ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি সত্যিকারের আল্লাহভীরু হয়, আল্লাহ তাকে এমন জায়গা থেকে পথ দেখান, যা সে কখনো কল্পনাও করতে পারে না।” (📖 সূরা আত-তালাক ৬৫:২–৩ এর তাফসীর অনুসারে সহিহ হাদিসের মর্মার্থ)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যখন সমাজ আল্লাহর আদেশ থেকে দূরে সরে যায়, তখন সত্যবাদী মানুষদের জন্য আল্লাহ আলাদা পথ খুলে দেন।
- একজন ঈমানদার কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের ভুল অনুসরণ করে না।
- মুমিনের কর্তব্য হলো, নিজের ঈমান ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৫):
- হিদায়াত কেবল আল্লাহর হাতে; নবী কেবল আহ্বান করেন।
- অবাধ্য জাতির সাথে আপোষ করা ঈমানদারের কাজ নয়।
- নিজেকে সৎ পথে রাখার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা জরুরি।
- যখন মানুষ অবাধ্যতায় নিমজ্জিত হয়, আল্লাহ তাদের থেকে তাঁর বন্ধুদের আলাদা করেন।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
আল্লাহর পথে আহ্বান করতে গিয়ে কখনো কখনো নবীরাও গভীর কষ্ট পান,
কিন্তু তাঁরা হাল ছেড়ে দেন না; বরং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন।
মূসা (আঃ)-এর এই দোয়া সত্যিকারের মুমিনের দোয়া,
যিনি আল্লাহর বিচারের উপর ভরসা রাখেন।
📖 “فَٱفْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ ٱلْقَوْمِ ٱلْفَـٰسِقِينَ”
“তাই তুমি আমাদের ও এই অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দাও।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের অবাধ্যতার চূড়ান্ত শাস্তি ঘোষণা করেছেন। তারা যখন নবী মূসা (আঃ)-এর নির্দেশ অমান্য করে বলেছিল — “তুমি ও তোমার রব্ব যুদ্ধ করো, আমরা তো এখানেই বসে থাকব।” তখন আল্লাহ ঘোষণা করেন — এখন তারা “পবিত্র ভূমি” (বায়তুল মুকাদ্দাস)-এ প্রবেশ করতে পারবে না।
আল্লাহ বলেন — “فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِينَ سَنَةٗ” — অর্থাৎ, চল্লিশ বছর পর্যন্ত ঐ ভূমি তাদের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) করা হলো। এই চল্লিশ বছর তাঁরা মরুভূমিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াবে। ইতিহাসে এই সময়কালকে বলা হয় **“তীহ” (تِيه)** — অর্থাৎ, বনি ইসরাইলের মরুভূমিতে পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়ানোর যুগ।
“يَتِيهُونَ فِي ٱلْأَرْضِ” — তাঁরা মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াবে, কোথাও স্থায়ী হতে পারবে না। এভাবেই তাঁরা প্রায় চার দশক মরুভূমিতে কষ্টে জীবনযাপন করে। এই সময়ে তাঁদের পুরোনো প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যায়, এবং নতুন প্রজন্ম আল্লাহর আদেশ মানার যোগ্য হয়ে ওঠে।
আল্লাহ নবী মূসা (আঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন — “فَلَا تَأْسَ عَلَى ٱلْقَوْمِ ٱلْفَـٰسِقِينَ” — অর্থাৎ, “এই ফাসেক (অবাধ্য) জাতির জন্য তুমি দুঃখ করো না।” কারণ আল্লাহর শাস্তি তাদের নিজেদের কর্মফলের ফলাফল।
এই চল্লিশ বছরের শিক্ষা:
এটি ছিল আল্লাহর এক বিশেষ শাস্তি ও শিক্ষা, যাতে তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য ও সাহস শিখে নিতে পারে। মরুভূমিতে তাঁদের খাদ্য হতো **মান্না ও সালওয়া**, যা আল্লাহ তাঁদের জন্য আসমান থেকে দান করতেন।
এভাবে, অবাধ্য প্রজন্ম চলে গেল, আর নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে (ইউশা ইবন নুন আঃ-এর অধীনে) বনি ইসরাইল অবশেষে সেই ভূমিতে প্রবেশ করে, যা আগে তাঁদের জন্য নির্ধারিত ছিল।
সম্পর্কিত হাদিস ও শিক্ষা:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তাঁকে কষ্টে ফেলেন, যেন তাঁর পাপ মাফ হয় এবং আত্মা পরিশুদ্ধ হয়।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৩৯৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে জাতি অবাধ্য হয়, আল্লাহ তাদের বরকত থেকে বঞ্চিত করেন।
- আল্লাহর শাস্তি কেবল ধ্বংস নয় — কখনো তা শিক্ষা ও সংশোধনের জন্যও হয়।
- অসহায়তা, বিপদ ও কষ্ট মুমিনদের জন্য শিক্ষা ও তওবার সুযোগ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৬):
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে তাঁর বরকত হারাতে হয়।
- কোনো জাতি যদি কৃতজ্ঞ না হয়, আল্লাহ তাদের নিয়ামত বদলে দেন।
- আল্লাহর শাস্তি একইসাথে ন্যায় ও দয়া — এতে শিক্ষা লুকানো থাকে।
- মুমিনদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা এবং অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা।
উপসংহার:
বনি ইসরাইলের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাদের চল্লিশ বছরের জন্য মরুভূমিতে ঘুরিয়ে রাখলেন,
যাতে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে।
নবী মূসা (আঃ)-এর ধৈর্য, দোয়া ও ঈমান এই ঘটনার মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
এটি আমাদের শেখায় —
আল্লাহর আদেশ মানা ও ধৈর্য ধারণ করাই মুক্তির পথ।
📖 “فَلَا تَأْسَ عَلَى ٱلْقَوْمِ ٱلْفَـٰسِقِينَ”
“অতএব, তুমি এই অবাধ্য জাতির জন্য দুঃখ করো না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র — **হাবীল ও কাবীল** — এর ঘটনার মাধ্যমে মানবজাতিকে ঈর্ষা, অহংকার ও তাকওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন।
“ٱتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ٱبْنَىْٓ ءَادَمَ بِٱلْحَقِّ” — অর্থাৎ, “তাদের কাছে আদমের দুই পুত্রের সত্য ঘটনা পাঠ করে শোনাও।” এটি কেবল ইতিহাস নয়, বরং একটি নৈতিক শিক্ষা — কীভাবে ঈর্ষা ও অহংকার মানুষকে হত্যা ও অন্যায়ের পথে নিয়ে যায়।
হাবীল ও কাবীল উভয়েই আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি (নৈবেদ্য) পেশ করেছিল। হাবীল ছিল মেষপালক — সে তার সেরা মেষটি উৎসর্গ করেছিল। আর কাবীল ছিল কৃষক — সে তার নিম্নমানের ফসল উৎসর্গ করেছিল।
আল্লাহ তাকওয়াবান হাবীলের কুরবানি কবুল করলেন, আর কাবীলের কুরবানি প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ তার অন্তরে ছিল অহংকার ও ঈর্ষা।
“قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ” — কাবীল ক্রোধান্বিত হয়ে তার ভাইকে বলল, “আমি তোমাকে হত্যা করব!” এটি ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যার ঘোষণা।
হাবীলের উত্তর: “إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلْمُتَّقِينَ” — অর্থাৎ, “আল্লাহ কেবল তাকওয়াবানদের থেকেই গ্রহণ করেন।” এটি অত্যন্ত গভীর উত্তর, যা আমাদের শেখায় যে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে **নিয়ত, সততা ও পরহেযগারির উপর**, বাহ্যিক প্রদর্শনের উপর নয়।
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহর কাছে কাজের মান নয়, বরং মনোভাবই প্রধান। ছোট আমলও মহান হতে পারে, যদি তা খাঁটি নিয়ত ও তাকওয়াসহ করা হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদ দেখে বিচার করেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও কর্ম দেখে বিচার করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
আয়াতের শিক্ষা:
- আল্লাহর কাছে কোনো আমল তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা তাকওয়া ও খাঁটি নিয়তের সাথে করা হয়।
- ঈর্ষা, অহংকার ও অন্যের প্রতি বিদ্বেষ — পাপের মূল শিকড়।
- যে ব্যক্তি আল্লাহভীরু, তার সামান্য দানও আল্লাহ কবুল করেন।
- হাবীলের ধৈর্য ও নরম আচরণ মুমিন চরিত্রের উদাহরণ।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ অন্যের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয় — এটি কাবীলের মনোভাবের পুনরাবৃত্তি।
- আল্লাহ আমাদের তাকওয়াবান হতে বলেছেন, যাতে আমাদের দোয়া, সালাত, দান ও আমল গ্রহণযোগ্য হয়।
- সত্যিকারের কুরবানি হলো আত্মত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিয়ত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৭):
- আল্লাহ কেবল পরহেযগারদের আমল কবুল করেন।
- ঈর্ষা ও অহংকার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
- কাজের মূল মূল্য নির্ধারিত হয় নিয়ত ও তাকওয়ার দ্বারা।
- ধৈর্য, নম্রতা ও আল্লাহভীতি একজন সত্য মুমিনের গুণ।
উপসংহার:
এই আয়াত মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানি ও প্রথম হত্যার শিক্ষা বহন করে।
আল্লাহ আমাদেরকে সততা, তাকওয়া ও ঈর্ষা থেকে মুক্ত রাখুন।
কারণ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে একমাত্র হৃদয়ের বিশুদ্ধতার উপর।
📖 “إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلْمُتَّقِينَ”
“আল্লাহ কেবল পরহেযগারদের কাছ থেকেই গ্রহণ করেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৭)
এই আয়াতে হাবীল-এর উচ্চ নৈতিকতা, ঈমান ও আল্লাহভীতি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ভাই কাবীল ঈর্ষার কারণে যখন হত্যার হুমকি দিল, তখন হাবীল শান্তভাবে উত্তর দিলেন — “তুমি যদি আমাকে হত্যা করতেও চাও, আমি কখনো তোমাকে হত্যা করব না।”
এটি কোনো দুর্বলতার কথা নয়, বরং আল্লাহভীতি (তাকওয়া)র প্রতীক। হাবীল জানতেন, হত্যার মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না; বরং এটি আল্লাহর বড় গুনাহ।
“لَئِنۢ بَسَطتَّ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي” — অর্থাৎ, “তুমি যদি আমার দিকে হাত বাড়াও, আমাকে হত্যা করতে,” এটি কাবীলের অন্যায় উদ্যোগের প্রতি হাবীলের শান্ত জবাব।
“مَآ أَنَا۠ بِبَاسِطٖ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ” — অর্থাৎ, “আমি তোমার দিকে হাত বাড়াব না তোমাকে হত্যা করতে।” হাবীল তাঁর আত্মরক্ষার অধিকার থাকা সত্ত্বেও, ন্যায় ও আল্লাহভীতির কারণে নিজে থেকে অন্যায় পথে পা বাড়ালেন না।
“إِنِّيٓ أَخَافُ ٱللَّهَ رَبَّ ٱلْعَـٰلَمِينَ” — এই অংশই তাঁর উত্তরের মূল হৃদয়। তিনি বলেন — আমি আল্লাহকে ভয় করি, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। এই ভয়ই তাঁকে অন্যায়ের প্রতিশোধ থেকে বিরত রেখেছিল।
এভাবে হাবীল মানব ইতিহাসে ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা ও তাকওয়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি দেখিয়েছেন, প্রকৃত মুমিন কখনো অন্যায়ভাবে প্রতিশোধ নেয় না, বরং আল্লাহর বিচারের উপর ভরসা করে।
আয়াতের মূল শিক্ষা:
আল্লাহর প্রতি ভয় ও তাকওয়া মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। রাগ, প্রতিশোধ ও অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে; কিন্তু আল্লাহভীতি মানুষকে শান্ত, ন্যায়পরায়ণ ও নম্র করে তোলে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “একজন মুমিনের জন্য তার ভাইকে হত্যা করা তো দূরের কথা, এমনকি তার প্রতি অস্ত্র তুলাও হারাম।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৮৭৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬১৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি আল্লাহভীরু, সে কখনো প্রতিশোধ বা ঘৃণার পথে যায় না।
- আল্লাহভীতি মানুষকে রাগ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে।
- আত্মসংযম ও ধৈর্য আল্লাহর নিকট সর্বোচ্চ মর্যাদার কারণ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৮):
- আল্লাহভীতি মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে রক্ষা করে।
- প্রতিশোধ নয় — ধৈর্য ও ন্যায়ের পথে থাকা মুমিনের গুণ।
- রাগ ও অহংকার হত্যার মূল শিকড়।
- আল্লাহর উপর ভরসা করে শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা উচিত।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
প্রকৃত মুমিন কখনো রাগ বা প্রতিশোধের বশে অন্যায় করে না।
আল্লাহভীতিই মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে।
হাবীলের এই ধৈর্য ও নম্রতা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনন্ত শিক্ষা।
📖 “إِنِّيٓ أَخَافُ ٱللَّهَ رَبَّ ٱلْعَـٰلَمِينَ”
“আমি আল্লাহকে ভয় করি, যিনি সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৮)
এই আয়াতটি হাবীল (عليه السلام)-এর ধৈর্য, ঈমান ও আল্লাহভীতির এক গভীর প্রতিফলন। যখন তাঁর ভাই কাবীল ঈর্ষা ও ক্রোধে তাঁকে হত্যার হুমকি দিল, তখন হাবীল বলেন — “আমি তোমার সাথে যুদ্ধ করতে চাই না। বরং আমি চাই না, আমার হাত অন্যায়ভাবে তোমার রক্তে রঞ্জিত হোক।”
“إِنِّيٓ أُرِيدُ أَن تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ” — অর্থাৎ, “আমি চাই তুমি আমার পাপ ও তোমার পাপ উভয়ই বহন করো।” এটি বোঝায় — যদি তুমি আমাকে হত্যা করো, তবে তোমার ওপর দুটি পাপ আসবে:
- নিজের হত্যার গুনাহ
- অন্যায়ভাবে একজন নিরপরাধকে হত্যা করার পাপ
“فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَـٰبِ ٱلنَّارِ” — “তাহলে তুমি জাহান্নামের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” অর্থাৎ, এই অন্যায় হত্যার পরিণতি হবে জাহান্নাম। এটি আল্লাহর ন্যায়বিচারের ঘোষণা — অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা কখনোই ক্ষমাযোগ্য নয়, যদি না খুনী তওবা করে এবং আল্লাহ ক্ষমা করেন।
“وَذَٰلِكَ جَزَٰٓؤُا۟ ٱلظَّـٰلِمِينَ” — “আর এটাই যালিমদের শাস্তি।” এখানে “যালিম” বলতে বোঝানো হয়েছে — যারা অন্যায়ভাবে জীবন নেয়, ঈর্ষা করে, অথবা আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে। আল্লাহ তাদের পরিণতি স্পষ্ট করে দিয়েছেন — জাহান্নামই তাদের ঠিকানা।
এই আয়াত মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যার পূর্বভূমিকা। হাবীলের এই কথায় স্পষ্টভাবে দেখা যায় — তিনি প্রতিশোধের পরিবর্তে আল্লাহর বিচারের উপর ভরসা করেছিলেন। এটি ইসলামী চরিত্রের মূল ভিত্তি: অন্যায়ের জবাব অন্যায় দিয়ে নয়, বরং ন্যায় ও ধৈর্যের মাধ্যমে দিতে হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যদি দুই মুসলিম তলোয়ার নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়, তবে হত্যাকারী ও নিহত উভয়েই জাহান্নামে যাবে।” সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন: “হে আল্লাহর রাসূল! নিহত কেন?” তিনি বললেন: “কারণ সেও চেয়েছিল তার ভাইকে হত্যা করতে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও মানুষ ক্ষমার পরিবর্তে প্রতিশোধ বেছে নেয় — এটি কাবীলের মনোভাবের প্রতিফলন।
- যে ব্যক্তি অন্যায়ের প্রতিক্রিয়ায় ন্যায় অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মর্যাদা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেন।
- আল্লাহর বিচারে বিশ্বাস ও ধৈর্য হলো প্রকৃত বিজয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ২৯):
- অন্যায় হত্যার শাস্তি জাহান্নাম — আল্লাহর কাছে এটি মারাত্মক অপরাধ।
- প্রতিশোধের বদলে ধৈর্য ও তাকওয়া অবলম্বন করা মুমিনের গুণ।
- অন্যের প্রতি অন্যায় করলে তার পাপ নিজের ওপর এসে পড়ে।
- যালিমদের জন্য পরিণতি সবসময়ই ধ্বংস ও জাহান্নাম।
উপসংহার:
এই আয়াতে হাবীলের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে এক প্রকৃত মুমিনের চিত্র —
যিনি অন্যায়, রাগ ও প্রতিশোধ থেকে দূরে থেকেও দৃঢ় ঈমানের উপর স্থির ছিলেন।
আল্লাহ আমাদের এমন ধৈর্য, তাকওয়া ও আল্লাহভীতি দান করুন,
যেন আমরা কখনো অন্যায়ের পথে পা না বাড়াই।
📖 “وَذَٰلِكَ جَزَٰٓؤُا۟ ٱلظَّـٰلِمِينَ”
“এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:২৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যার বাস্তব চিত্র বর্ণনা করেছেন। কাবীল (আদমের পুত্র) তার ভাই **হাবীল**-এর প্রতি ঈর্ষা, অহংকার ও ক্রোধে অন্ধ হয়ে যায়, এবং অবশেষে নিজের নফস (আত্মা) বা শয়তানের প্ররোচনায় প্রথমবারের মতো হত্যার জঘন্য কাজটি সংঘটিত করে।
“فَطَوَّعَتْ لَهُۥ نَفْسُهُۥ قَتْلَ أَخِيهِ” — অর্থাৎ, “তার নফস (প্রবৃত্তি) তাকে ভাইকে হত্যা করতে প্ররোচিত করল।” এটি বোঝায় যে, মানুষ যখন ঈর্ষা, রাগ ও লোভের বশবর্তী হয়, তখন তার অন্তরের নফস (অহংকার ও শয়তানের প্রভাব) তাকে অন্যায় ও পাপের পথে ঠেলে দেয়।
নফস (نَفْسُهُ) এখানে সেই প্রবৃত্তিকে বোঝায়, যা মানুষকে ন্যায় থেকে অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়, যেমন আল্লাহ বলেন — “নিশ্চয়ই নফস মানুষকে মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়, তবে যার প্রতি আমার রব দয়া করেছেন, সে ব্যতীত।” — (সূরা ইউসুফ ১২:৫৩)
“فَقَتَلَهُۥ” — অর্থাৎ, “সে তাকে হত্যা করল।” এটি ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম রক্তপাত। এক ভাই ঈর্ষার কারণে আরেক ভাইকে হত্যা করে, এবং পৃথিবীতে পাপের সূচনা ঘটে।
“فَأَصْبَحَ مِنَ ٱلْخَـٰسِرِينَ” — “অতঃপর সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।” এখানে “খাসিরীন” মানে — সেইসব লোক যারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কাবীল শুধু ভাইকে হত্যা করেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং কিয়ামত পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড হবে, প্রতিটি হত্যার অংশ পাপও তার উপর বর্তাবে, কারণ তিনিই পৃথিবীতে প্রথম হত্যার পথ চালু করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখনই পৃথিবীতে কোনো হত্যা সংঘটিত হয়, আদমের প্রথম পুত্র (কাবীল)-এর ওপর তার একটি অংশ পাপ লিখে দেওয়া হয়, কারণ সে-ই প্রথম হত্যাকারী।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩৩৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৭৭)
আয়াতের শিক্ষা:
- নফস ও শয়তানের প্ররোচনাই মানুষকে অন্যায় কাজে প্ররোচিত করে।
- অন্যের প্রতি ঈর্ষা ও রাগ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
- অন্যায় হত্যার পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে চরম ক্ষতি।
- প্রথম হত্যাকারী কাবীল ইতিহাসে ধ্বংসপ্রাপ্তদের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজকের সমাজেও হিংসা, লোভ ও রাগের কারণে মানুষ অপরাধ করে — এটি কাবীলের মানসিকতারই ধারাবাহিকতা।
- যে ব্যক্তি তার নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে-ই প্রকৃত বিজয়ী (সূরা আশ-শামস ৯১:৯–১০)।
- অন্যের সাফল্যে ঈর্ষা নয়, বরং সন্তুষ্টি ও আল্লাহভীতি রাখা উচিত।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩০):
- নফসকে নিয়ন্ত্রণ না করলে মানুষ পাপের পথে পড়ে যায়।
- হত্যা মানবতার সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ।
- ঈর্ষা ও রাগই অনেক বড় গুনাহের উৎস।
- আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া মানুষকে অন্যায় থেকে রক্ষা করে।
উপসংহার:
এই আয়াত মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যার ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় —
যখন একজন মানুষ তার ভাইকে হত্যা করে চিরস্থায়ী ক্ষতির মুখোমুখি হয়।
আল্লাহ আমাদের নফস ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করুন,
এবং আমাদের অন্তরকে ঈর্ষা, রাগ ও অহংকার থেকে পরিশুদ্ধ করুন।
📖 “فَأَصْبَحَ مِنَ ٱلْخَـٰسِرِينَ”
“ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩০)
কাবীল তার ভাই হাবীলকে হত্যা করার পর হতবাক হয়ে গেল। সে জানত না, এখন ভাইয়ের দেহ কীভাবে আড়াল বা দাফন করবে। তখন আল্লাহ তাঁর রহমতে একটি কাক (غُرَاب) পাঠালেন — কাকটি মাটিতে ঠোঁট দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করতে লাগল, যেন কাবীল দেখে শিক্ষা নিতে পারে।
আল্লাহর এই কাক ছিল এক প্রাকৃতিক শিক্ষক। কাকের এই কাজ দেখে কাবীল বুঝতে পারল, লাশকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে দাফন করতে হয়। এভাবেই মানব ইতিহাসে প্রথমবার “দাফনের রীতি” শুরু হয়।
“لِيُرِيَهُۥ كَيْفَ يُوَٰرِي سَوْءَةَ أَخِيهِ” — অর্থাৎ, “যাতে সে শিখে নিতে পারে কীভাবে ভাইয়ের দেহ আড়াল করতে হয়।” এখানে “سَوْءَةَ” (সাও’আত) শব্দের অর্থ — “লজ্জাজনক দেহ” বা “লাশ”। এটি দেখায়, আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দেন এমন জায়গা থেকেও, যা সে কখনো কল্পনাও করতে পারে না।
কাকের এই দৃষ্টান্ত মানবতার এক বড় শিক্ষা — প্রকৃতির মধ্যেও আল্লাহর নির্দেশ ও শিক্ষা নিহিত আছে।
“يَـٰوَيْلَتَىٰٓ أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَـٰذَا ٱلْغُرَابِ” — কাবীল বলল, “হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি কি এতটাই অক্ষম যে এই কাকের মতোও হতে পারলাম না?” এটি ছিল গভীর অনুতাপ ও আত্ম-গ্লানির প্রকাশ।
“فَأَصْبَحَ مِنَ ٱلنَّـٰدِمِينَ” — “অতঃপর সে অনুতপ্ত হয়ে গেল।” তবে এই অনুতাপ তওবা নয়; এটি ছিল কেবল কাজের ফলাফলের জন্য অনুশোচনা, কিন্তু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া বা তওবা করার আন্তরিকতা এতে ছিল না। তাই কাবীলের এই অনুতাপ তাকে মুক্তি দেয়নি।
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, পাপের পর সত্যিকারের তওবা ও সংশোধনই মুক্তির পথ; কেবল দুঃখ বা লজ্জা যথেষ্ট নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, সে এমন এক গুনাহ বহন করবে, যেন সে গোটা মানবজাতিকে হত্যা করেছে।” (📖 সূরা আল-মায়েদা ৫:৩২; সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিমে বর্ণিত)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ প্রযুক্তিতে উন্নত হলেও, অনেক সময় প্রকৃতির কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হয়।
- অপরাধের পর শুধু অনুশোচনা নয়, বরং সত্যিকারের তওবা করতে হবে।
- আল্লাহ প্রকৃতির মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষা দেন, যদি সে চিন্তা করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩১):
- আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দেন বিভিন্ন উপায়ে — এমনকি একটি কাকের মাধ্যমেও।
- পাপের পর অনুতাপ যথেষ্ট নয়, তওবা অপরিহার্য।
- অন্যায় কাজ মানুষকে লজ্জা ও অনুশোচনায় নিমজ্জিত করে।
- প্রকৃতি আল্লাহর এক মহান শিক্ষাগ্রন্থ, যদি আমরা চিন্তা করি।
উপসংহার:
এই আয়াতে কাকের শিক্ষা মানুষের জন্য এক গভীর ইঙ্গিত —
আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দেন নানা পথে,
কিন্তু মানুষ তখনই উপকৃত হয়, যখন সে বিনয় ও তওবার মনোভাব রাখে।
কাবীলের অনুতাপ শিক্ষা দিলেও মুক্তি দেয়নি,
কারণ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া পাপ মোচন হয় না।
📖 “فَأَصْبَحَ مِنَ ٱلنَّـٰدِمِينَ”
“অতঃপর সে অনুতপ্ত হয়ে গেল।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩১)
এই আয়াত মানব জীবনের পবিত্রতা ও মূল্য সম্পর্কে কুরআনের অন্যতম গভীর ঘোষণাগুলোর একটি। এখানে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের (ইহুদিদের) জন্য যে বিধান দিয়েছিলেন, তা সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি মৌলিক নৈতিক নীতি হিসেবে প্রযোজ্য।
“مَن قَتَلَ نَفْسَۢا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٖ فِي ٱلْأَرْضِ” — অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, এমন নয় যে সে খুনের প্রতিশোধ নিচ্ছে বা অন্যায় দমন করছে, বরং নিছক বিদ্বেষ, রাগ বা স্বার্থের কারণে হত্যা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।
কেননা, **একজন মানুষের জীবন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত আমানত**, তার অবৈধ অপসারণ সমগ্র মানব সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ।
“وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَآ أَحْيَا ٱلنَّاسَ جَمِيعٗا” — অর্থাৎ, যে ব্যক্তি একজনের জীবন রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষা করল। এটি বোঝায় যে, জীবন রক্ষা করা, মানবিক সাহায্য, দয়া ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ইসলামে সর্বোচ্চ সওয়াবের কাজ।
এই আয়াত প্রমাণ করে, **ইসলাম মানব জীবনকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছে**। অন্যায় হত্যা শুধু এক ব্যক্তির নয় — পুরো সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং আল্লাহর হুকুম অমান্য।
“وَلَقَدْ جَآءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِٱلْبَيِّنَـٰتِ” — অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁদের কাছে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছিলেন স্পষ্ট প্রমাণ ও সত্য বার্তাসহ। তবুও অধিকাংশ মানুষ সীমালঙ্ঘন করেছে। অর্থাৎ, তারা নবীদের শিক্ষার প্রতি অহংকার ও অবাধ্যতা দেখিয়েছে।
আয়াতের শিক্ষা: মানব জীবনের মর্যাদা আল্লাহর দৃষ্টিতে অপরিসীম। অন্যায় হত্যা শুধু দুনিয়ার আইন নয়, বরং আখিরাতেও চরম শাস্তির কারণ। আর যে জীবন রক্ষা করে — চিকিৎসা, দয়া, খাদ্য, আশ্রয় বা নিরাপত্তা দিয়ে — সে আল্লাহর নিকট অসাধারণ মর্যাদা অর্জন করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “দুনিয়ার ধ্বংস আল্লাহর নিকট ততটা গুরুতর নয়, যতটা গুরুতর একজন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৯৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি একজন মানুষকে বাঁচায় — চিকিৎসা, খাদ্য বা নিরাপত্তা দিয়ে — সে ইসলামের দৃষ্টিতে সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচানোর সমান সওয়াব পায়।
- অন্যায় হত্যা ও সন্ত্রাস ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে।
- আধুনিক মানবাধিকারের মূল ভিত্তিও এই কুরআনিক নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩২):
- একজন মানুষের জীবন পুরো মানবজাতির সমান মূল্যবান।
- অন্যায় হত্যা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহগুলোর একটি।
- জীবন রক্ষা করা ইসলামে সর্বোচ্চ মানবিক দায়িত্ব।
- নবীদের শিক্ষা অমান্য করা ধ্বংস ও সীমালঙ্ঘনের পথ।
উপসংহার:
এই আয়াত ইসলামের মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক দর্শনের প্রতীক।
আল্লাহ মানুষকে শিখিয়েছেন —
একটি প্রাণের মূল্য গোটা মানবতার সমান।
যারা অন্যায় হত্যা করে, তারা মানবতার শত্রু;
আর যারা জীবন রক্ষা করে, তারা আল্লাহর বন্ধু।
📖 “فَكَأَنَّمَا قَتَلَ ٱلنَّاسَ جَمِيعٗا … فَكَأَنَّمَآ أَحْيَا ٱلنَّاسَ جَمِيعٗا”
“সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল... আর যে জীবন রক্ষা করল,
সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে রক্ষা করল।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা “মুহারিব” (যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে) এবং “মুফসিদ ফিল আরদ্ব” (যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা ছড়ায়) — তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান ঘোষণা করেছেন।
এটি ইসলামী রাষ্ট্রে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা “হিরাবা” (حِرَابَة) নামে পরিচিত। অর্থাৎ, যারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নষ্ট করে, ডাকাতি, খুন, সন্ত্রাস, বিদ্রোহ বা জিহাদের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
“إِنَّمَا جَزَٰٓؤُا۟ ٱلَّذِينَ يُحَارِبُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ” — অর্থাৎ, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।” এখানে যুদ্ধ বলতে কেবল অস্ত্রের লড়াই নয়, বরং ইসলাম ও ন্যায়বিচারের বিরোধিতা করা, মুসলমানদের নিরাপত্তা নষ্ট করা, এবং সমাজে অশান্তি ছড়ানোও বোঝানো হয়েছে।
“أَن يُقَتَّلُوٓا۟ أَوْ يُصَلَّبُوٓا۟ ...” — আল্লাহ এখানে চার প্রকার দণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন:
- তাদের হত্যা করা হবে (যদি তারা হত্যা করে থাকে)।
- ক্রুশবিদ্ধ করা হবে (জনসম্মুখে অপমানের জন্য)।
- বিপরীত দিক থেকে হাত ও পা কেটে ফেলা হবে (যদি তারা ডাকাতি করে)।
- নির্বাসিত করা হবে (দেশ থেকে বহিষ্কার বা কারাবন্দি করা)।
এই শাস্তিগুলো বিচারকের বিবেচনায় নির্ধারিত হয়, অপরাধের মাত্রা ও সমাজের নিরাপত্তার প্রয়োজনে।
“ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْيٞ فِي ٱلدُّنْيَا” — এটি তাদের জন্য দুনিয়ার লাঞ্ছনা। তারা জনসমক্ষে অপমানিত হবে, সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে, এবং মানুষ তাদের থেকে ঘৃণা করবে।
“وَلَهُمْ فِي ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ” — এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। দুনিয়ার আইনগত শাস্তি থেকে রেহাই পেলেও, যদি তারা তওবা না করে, আখিরাতে তাদের জন্য আল্লাহর কঠিন শাস্তি নির্ধারিত।
এই আয়াত সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা। আল্লাহ দেখিয়ে দিলেন — ইসলাম করুণা ও ন্যায়বিচারের ধর্ম হলেও, যারা বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসে জড়িত, তাদের জন্য কোনো ছাড় নেই।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৮৭৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৭৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা সন্ত্রাস, ডাকাতি বা সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করে, তারা এই আয়াতের আওতায় পড়ে।
- ইসলামী আইনে শাস্তি কেবল প্রতিশোধ নয় — এটি ন্যায়, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উপায়।
- দুনিয়ার আইন থেকে রেহাই পেলেও, আল্লাহর বিচারে কেউ বাঁচতে পারবে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৩):
- ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম — বিশৃঙ্খলা এর শত্রু।
- যারা সমাজে ফাসাদ (অরাজকতা) ছড়ায়, তাদের কঠোর শাস্তি প্রাপ্য।
- দুনিয়ার শাস্তি থেকে বাঁচলেও, আখিরাতে পাপের শাস্তি অনিবার্য।
- আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানে ন্যায় ও মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
উপসংহার:
এই আয়াত ইসলামী আইন (শরীয়াহ)-এর কঠোর ন্যায়বিচারের প্রতীক।
আল্লাহ মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।
যারা সেই সুরক্ষা ভঙ্গ করে, তাদের জন্য আছে দুনিয়ার লাঞ্ছনা
এবং আখিরাতের ভয়াবহ শাস্তি।
📖 “ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْيٞ فِي ٱلدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ”
“এটি তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা,
আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৩)
পূর্ববর্তী আয়াতে (আয়াত ৩৩) আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান।
কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর রহমত ও করুণা প্রকাশ করে একটি ব্যতিক্রম ঘোষণা করেছেন — যদি অপরাধীরা ধরা পড়ার আগে আন্তরিক তওবা করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।
“إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُوا۟ مِن قَبْلِ أَن تَقْدِرُوا۟ عَلَيْهِمْ” — অর্থাৎ, “তবে যারা তোমরা তাদের গ্রেফতার বা দণ্ড দিতে সক্ষম হওয়ার পূর্বেই তওবা করে,” তারা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে পারে। এটি ইসলামের ন্যায়বিচার ও দয়ার এক অনন্য ভারসাম্য।
ইসলামী শরীয়াতে, যদি কেউ অপরাধ করে এবং **নিজে থেকে তওবা করে**, সমাজের ক্ষতি পূরণ করে ও সত্যিকার অনুশোচনা দেখায়, তবে রাষ্ট্র তার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারে।
এটি ইসলামী আইন (শরীয়াহ)-এর একটি মৌলিক নীতি — **“তওবার দরজা সর্বদা খোলা থাকে।”** আল্লাহর রহমত কখনো সীমাবদ্ধ নয়।
“فَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ” — অর্থাৎ, “জেনে রাখো, আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” আল্লাহর এই ঘোষণা অপরাধী ও পথভ্রষ্টদের জন্য আশা ও মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে। এমনকি যারা সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছে, তারাও আল্লাহর ক্ষমা পেতে পারে যদি তারা আন্তরিকভাবে তওবা করে।
এই আয়াত সমাজে দুটি বার্তা দেয়:
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা — অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা।
- আল্লাহর রহমত প্রকাশ — তওবার মাধ্যমে মুক্তির সুযোগ দেওয়া।
এই ভারসাম্যই ইসলামের মহান বৈশিষ্ট্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি তওবা করে, আল্লাহ তার অতীত পাপ এমনভাবে মুছে দেন, যেন সে কখনো কোনো পাপই করেনি।” (📖 সহিহ ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪২৫০; তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৪০)
আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন — “যে ব্যক্তি তওবা করে, আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হন যেমন এক পথহারা ব্যক্তি তার উট ফিরে পেয়ে আনন্দিত হয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৪৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে অপরাধী তার ভুল বুঝে নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করে ও তওবা করে, ইসলামী দৃষ্টিতে তার প্রতি করুণা ও পুনর্বাসনের সুযোগ রয়েছে।
- যারা আল্লাহর পথে ফিরে আসে, তাদের অতীত পাপ ক্ষমা হয়ে যায়।
- মানব সমাজেও যদি দয়া ও ন্যায়ের ভারসাম্য থাকে, তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৪):
- তওবার দরজা সর্বদা খোলা — আল্লাহর রহমত অসীম।
- অপরাধের পর তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন, যদি তওবা আন্তরিক হয়।
- ইসলাম ন্যায় ও দয়ার সুন্দর সমন্বয় করেছে।
- আল্লাহ গফুর (ক্ষমাশীল) ও রহীম (দয়ালু)।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর ন্যায় ও রহমতের পরিপূর্ণ ভারসাম্য প্রকাশ করে।
যারা সমাজে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তি;
আর যারা তওবা করে, তাদের জন্য খোলা ক্ষমার দরজা।
আল্লাহর এই করুণা আমাদের শেখায় —
যত বড়ই পাপ হোক না কেন, **তওবার মাধ্যমে আল্লাহ ক্ষমা করেন।**
📖 “إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُوا۟ مِن قَبْلِ أَن تَقْدِرُوا۟ عَلَيْهِمْ فَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ”
“তবে যারা ধরা পড়ার পূর্বে তওবা করে,
নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৪)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদেরকে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন:
- আল্লাহভীতি অবলম্বন করা — “اتَّقُوا۟ ٱللَّهَ”
- আল্লাহর নিকটে যাওয়ার উপায় (ওসিলা) অনুসন্ধান করা — “وَٱبْتَغُوٓا۟ إِلَيْهِ ٱلْوَسِيلَةَ”
- আল্লাহর পথে জিহাদ করা — “وَجَـٰهِدُوا۟ فِي سَبِيلِهِۦ”
এই তিনটি উপদেশই আল্লাহর নৈকট্য ও সফলতার মূল চাবিকাঠি।
“ওসিলা (وَسِيلَة)” — এর অর্থ ও ব্যাখ্যা:
ওসিলা শব্দের মূল অর্থ হলো — “কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য মাধ্যম বা উপায়।” ইসলামী দৃষ্টিতে, ওসিলা বলতে বোঝায় — এমন সব উপায়, যা দ্বারা বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করতে পারে।
🕋 **ওসিলা তিন প্রকার হতে পারে:**
-
১️ আমল দ্বারা ওসিলা:
যেমন — নামাজ, রোযা, দান, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ইত্যাদি।
অর্থাৎ, সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।
📖 আল্লাহ বলেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালো কাজ করে, আল্লাহ তার নিকটে তাকে আরো ঘনিষ্ঠ করে দেন।” — (সূরা আল-ইনশিকাক ৮৯:৬) - ২️ দোয়া দ্বারা ওসিলা: আল্লাহর কাছে চাওয়া, তাঁর নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে। যেমন — “হে আল্লাহ, তুমি গফুর, রহীম — তোমার রহমতের দ্বারা আমাকে ক্ষমা করো।” (এটি আল্লাহর নাম দ্বারা ওসিলা।)
- ৩️ নেক ব্যক্তিদের দোয়া দ্বারা ওসিলা (জীবিত অবস্থায়): যেমন, কোনো সৎ ব্যক্তি বা আলেমের কাছে দোয়া চাওয়া, যেন আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর যুগে সাহাবীরা করতেন। (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ১০১০ — “দোয়া আল-ক্বুনুত”)
“وَجَـٰهِدُوا۟ فِي سَبِيلِهِۦ” — অর্থাৎ, “আল্লাহর পথে সংগ্রাম করো।” এখানে “জিহাদ” বলতে কেবল যুদ্ধ নয়, বরং নিজের নফস, খারাপ অভ্যাস, শয়তানের প্ররোচনা ও অন্যায় সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।
“لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ” — অর্থাৎ, “যাতে তোমরা সফল হও।” প্রকৃত সফলতা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখনই তোমরা আল্লাহর কাছে কিছু চাও, তাঁর কাছে তাঁর সুন্দর নামসমূহের মাধ্যমে প্রার্থনা করো।” (📖 সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৮০) আরেক হাদিসে তিনি বলেন — “আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি সে, যে বেশি পরিমাণে তাকওয়াবান।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- নামাজ, দোয়া, দান, কুরআন তিলাওয়াত — সবই আল্লাহর নিকটে যাওয়ার ওসিলা।
- কোনো সমস্যায় পড়লে আল্লাহর নাম ধরে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হলো সর্বোত্তম ওসিলা।
- সৎকর্ম ও নেক মানুষদের সঙ্গ — আল্লাহর নৈকট্যের পথে সাহায্য করে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৫):
- তাকওয়া হলো আল্লাহর নিকটে যাওয়ার প্রথম ধাপ।
- ওসিলা মানে বৈধ উপায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
- জিহাদ কেবল যুদ্ধ নয়, বরং নফস ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
- আল্লাহর নৈকট্যই প্রকৃত সফলতা।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে শেখায় —
আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর পথ তাকওয়া, সৎকর্ম ও জিহাদের মাধ্যমে।
ওসিলা মানে কোনো সৃষ্টিকে আহ্বান নয়,
বরং এমন আমল করা, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।
তাই প্রকৃত ওসিলা হলো ইমান, তাকওয়া, সৎকর্ম ও দোয়া।
📖 “وَٱبْتَغُوٓا۟ إِلَيْهِ ٱلْوَسِيلَةَ”
“আর তাঁর নিকটে পৌঁছার উপায় অনুসন্ধান করো।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা কুফরি (অবিশ্বাস) এবং আল্লাহর নির্দেশ অস্বীকারকারীদের পরিণতি বর্ণনা করেছেন।
“إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟” — অর্থাৎ, যারা ঈমানের পর কুফরি বেছে নিয়েছে, আল্লাহর হুকুমকে অগ্রাহ্য করেছে, নবী-রাসূলদের অস্বীকার করেছে, তাদের পরিণতি কিয়ামতের দিন চরম ধ্বংস ও আফসোসের।
“لَوْ أَنَّ لَهُم مَّا فِي ٱلْأَرْضِ جَمِيعٗا وَمِثْلَهُۥ مَعَهُۥ” — অর্থাৎ, যদি তাদের কাছে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, ধন-সম্পদ, সোনা, রূপা, রাজত্ব এবং তার দ্বিগুণ পরিমাণও থাকত — তবুও তারা তা মুক্তিপণ হিসেবে আল্লাহর কাছে দিতে পারবে না।
কিয়ামতের দিন কেউই নিজের মুক্তির বিনিময়ে কোনো সম্পদ, সোনা, ক্ষমতা বা মর্যাদা দিতে পারবে না। কারণ সেদিন একমাত্র গ্রহণযোগ্য জিনিস হলো — ঈমান ও সৎকর্ম।
“مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ” — অর্থাৎ, তাদের মুক্তিপণ বা আপস কোনোভাবেই গ্রহণ করা হবে না। কারণ দুনিয়ায় তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে জীবন কাটিয়েছিল, এখন তাদের সামনে আল্লাহর ন্যায়বিচার ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
“وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٞ” — “আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” এখানে “আলীম” শব্দটি গভীর যন্ত্রণার ইঙ্গিত দেয় — এটি কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিক, আত্মিক ও চিরস্থায়ী কষ্টের শাস্তি।
এই আয়াত কুফর ও গাফলতের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে একটি জাগরণমূলক সতর্কতা। মানুষকে মনে করিয়ে দেয় — দুনিয়ার সম্পদ, রাজত্ব বা সম্মান কোনো কিছুই আখিরাতে কাজে আসবে না, যদি ঈমান ও তাকওয়া না থাকে।
📖 আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন — “সেদিন সম্পদ বা সন্তান কিছুই উপকারে আসবে না, শুধুমাত্র সে ব্যতীত, যে পরিশুদ্ধ হৃদয় নিয়ে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে।” — (সূরা আশ-শু‘আরা ২৬:৮৮–৮৯)
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “কিয়ামতের দিন কাফের বলা হবে, যদি তোমার কাছে পৃথিবীর সবকিছু থাকত, তুমি কি তা মুক্তির বিনিময়ে দিতে চাইতে না?” সে বলবে, ‘অবশ্যই চাইতাম।’ তখন বলা হবে, ‘দুনিয়ায় তুমি যা চাওনি, আজ তা তোমার কোনো কাজে আসবে না।’” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৫৩৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮০৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ মানুষ অর্থ, ক্ষমতা ও প্রযুক্তিতে গর্ব করে, কিন্তু ঈমান ছাড়া এগুলোর কোনো মূল্য নেই।
- মৃত্যুর পর সবকিছু পিছনে ফেলে মানুষ একা আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া কোনো সম্পদ বা প্রভাব মুক্তির কারণ হতে পারে না।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৬):
- দুনিয়ার সম্পদ আখিরাতে কোনো কাজ দেবে না।
- আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো ঈমান ও তওবা।
- কুফরি ও গাফেলত মানুষকে চিরস্থায়ী ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।
- আল্লাহর ন্যায়বিচার কঠোর এবং নিখুঁত।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় —
দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ, ক্ষমতা বা কৌশল কিয়ামতের দিনে কোনো উপকারে আসবে না।
সেই দিনের মুক্তির একমাত্র মূলধন হলো ঈমান, তাকওয়া ও সৎকর্ম।
আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া ও ন্যায়ের পথে চলাই প্রকৃত সফলতা।
📖 “مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٞ”
“তাদের থেকে কিছুই গ্রহণ করা হবে না,
আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা অবিশ্বাসীদের (কাফেরদের) আখিরাতের পরিণতি ও তাদের হতাশার চিত্র তুলে ধরেছেন।
“يُرِيدُونَ أَن يَخْرُجُوا۟ مِنَ ٱلنَّارِ” — অর্থাৎ, তারা জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে বের হতে চাইবে। কিন্তু সেই চাওয়া হবে নিষ্ফল ও অসম্ভব। কারণ তারা দুনিয়ায় আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিল, কুফরি ও গুনাহে জীবন কাটিয়েছিল, অথচ আল্লাহর প্রতি বিনয় প্রকাশ করেনি।
কিয়ামতের দিনে তারা আফসোস করে বলবে — “হে আমাদের প্রভু! আমাদের এখান থেকে বের করে দাও, আমরা এবার ভালো কাজ করব।” কিন্তু তখন তাদের বলা হবে — “তোমাদের কি পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি?” — (সূরা ফাতির ৩৫:৩৭)
আল্লাহর শাস্তি কেবল ন্যায়বিচারের ফল, কোনো অযথা প্রতিশোধ নয়। তিনি দুনিয়ায় মানুষকে তওবার অসংখ্য সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু যারা সেগুলো উপেক্ষা করেছে, তাদের জন্য আখিরাতে কোনো মুক্তি থাকবে না।
“وَمَا هُم بِخَـٰرِجِينَ مِنْهَا” — অর্থাৎ, তারা জাহান্নাম থেকে কখনোই বের হতে পারবে না। এটি নির্দেশ করে যে, **কাফের ও মুনাফিকদের শাস্তি চিরস্থায়ী।** তাদের উপর আল্লাহর রোষ ও শাস্তি স্থায়ীভাবে অব্যাহত থাকবে।
“وَلَهُمْ عَذَابٞ مُّقِيمٞ” — অর্থাৎ, “তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী (অবিরাম) শাস্তি।” “مُقِيم” শব্দটি বোঝায় এমন এক শাস্তি যা কখনো হ্রাস পাবে না, শেষ হবে না, এবং কোনো বিরতি থাকবে না।
এই আয়াত কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দেয় — যে আগুন থেকে বের হওয়ার আশা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। আল্লাহর সেই শাস্তি কেবল তাদের জন্য যারা অবিশ্বাস, বিদ্রোহ ও পাপাচারে অনুতাপহীন জীবন কাটায়।
📖 আল্লাহ বলেন — “তাদের মুখ আগুনে পোড়ানো হবে, এবং বলা হবে — তোমরা যা অর্জন করেছিলে তার প্রতিফলই পাচ্ছো।” — (সূরা আল-মুমিনুন ২৩:১০৪)
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “জাহান্নামবাসীরা আগুনে এমনভাবে থাকবে, যেন তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করছে; তারা বের হতে চাইবে, কিন্তু বের হতে পারবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮৫৯)
তবে অন্যদিকে, যারা ঈমানদার কিন্তু পাপী — তাদের শাস্তি সাময়িক, যতক্ষণ না তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়। এরপর আল্লাহর রহমতে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- মানুষ দুনিয়ায় গাফেল হয়ে ভাবে, “সময় আছে, পরে তওবা করব।” কিন্তু মৃত্যুর পর আর কোনো “পরে” থাকে না।
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করে জীবন কাটানো মানুষ শেষ পর্যন্ত আফসোস ছাড়া কিছুই পাবে না।
- আখিরাতের মুক্তি চায় যারা, তাদের জন্য দুনিয়াই পরীক্ষা ক্ষেত্র।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৭):
- জাহান্নামের শাস্তি চিরস্থায়ী এবং ভয়াবহ।
- দুনিয়ার জীবনে তওবা ও সংশোধনের সুযোগই মুক্তির পথ।
- আল্লাহর আদেশ উপেক্ষা করলে আখিরাতে অনুতাপ কোনো কাজে আসবে না।
- আল্লাহর দয়া ও ন্যায় একসাথে কাজ করে — অবিশ্বাসীদের জন্য দয়া নয়, ন্যায়।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে কিয়ামতের দিনের বাস্তবতা ও ন্যায়বিচার স্মরণ করিয়ে দেয়।
জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয় —
মুক্তি কেবল ঈমান, তাকওয়া ও তওবার মাধ্যমে সম্ভব।
যারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে,
তাদের জন্য আখিরাতে চিরস্থায়ী শাস্তি ও হতাশা অপেক্ষা করছে।
📖 “وَمَا هُم بِخَـٰرِجِينَ مِنْهَا وَلَهُمْ عَذَابٞ مُّقِيمٞ”
“তারা কখনোই তা থেকে বের হতে পারবে না;
আর তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইসলামী সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য **চুরির (সারিक़াহ)** শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। এটি ইসলামী ফৌজদারি আইনের (হদ্দ) অন্যতম বিধান, যা সমাজে অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।
“وَٱلسَّارِقُ وَٱلسَّارِقَةُ” — অর্থাৎ, “চোর পুরুষ ও চোর নারী।” এখানে উভয় লিঙ্গকে উল্লেখ করে আল্লাহ দেখিয়েছেন যে **আইনের সামনে নারী-পুরুষ সমান** — কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
“فَٱقْطَعُوا۟ أَيْدِيَهُمَا” — অর্থাৎ, “তাদের হাত কেটে দাও।” এটি শরীয়াহ অনুযায়ী **ডান হাতের কবজি পর্যন্ত কাটা** বোঝায়, তবে এটি প্রয়োগের জন্য কিছু কঠোর শর্ত রয়েছে।
⚖️ **ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী হাত কাটা শাস্তি প্রযোজ্য হওয়ার শর্তসমূহ:**
- চুরি অবশ্যই এমন সম্পদ হতে হবে যা হেফাজতে রাখা হয়েছে (secured property)।
- চুরি প্রমাণিত হতে হবে (সাক্ষী, স্বীকারোক্তি বা নিশ্চিত প্রমাণ দ্বারা)।
- চুরি করা বস্তু নির্দিষ্ট মূল্যের উপরে হতে হবে (এক “নিসাব” বা প্রায় ১/৪ দিরহাম সমমূল্য)।
- চোর দারিদ্র্য, অনাহার বা অনিচ্ছাকৃত কারণে না করে থাকতে হবে।
ইসলামী আইনে এই শাস্তি **অত্যন্ত কড়া শর্তে** প্রয়োগ করা হয়, যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি কখনো শাস্তি না পায়।
“جَزَآءَۢ بِمَا كَسَبَا نَكَالٗا مِّنَ ٱللَّهِ” — অর্থাৎ, “তারা যা করেছে তার প্রতিফলস্বরূপ আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।” অর্থাৎ, এই শাস্তি কেবল প্রতিশোধ নয় — বরং সমাজে **অন্যদের জন্য শিক্ষা ও সতর্কতা** হিসেবে নির্ধারিত।
ইসলাম মানুষকে চুরি থেকে দূরে রাখে দুটি উপায়ে — ১️ আগে থেকে প্রয়োজনীয়তার ব্যবস্থা করে (যাকাত, সাদকা, ন্যায় অর্থনীতি), ২️ এরপরও যদি কেউ চুরি করে, তখন কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করা হয়।
“وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ” — অর্থাৎ, “আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” আল্লাহর আইন কঠোর হলেও তা সর্বদা প্রজ্ঞা ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি সমাজে অপরাধ রোধের জন্য চূড়ান্ত ভারসাম্যপূর্ণ বিধান।
📖 আল্লাহ বলেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে, সে নিজেই নিজের উপর জুলুম করে।” — (সূরা আত-তালাক ৬৫:১)
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর আইন অনুযায়ী হাত কাটা একটি ন্যায়বিচার, যা যদি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এক বছরের বৃষ্টির চেয়েও বেশি কল্যাণ নিয়ে আসে।” (📖 সহিহ ইবন মাজাহ, হাদিস: ২৫৮১)
অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন — “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণ ছিল — তারা সম্মানিত ব্যক্তিদের অপরাধে শাস্তি দিত না, কিন্তু দুর্বলদের শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম! যদি আমার মেয়ে ফাতিমাও চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৭৮৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- ইসলাম কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে, কিন্তু তা মূলত অপরাধ রোধের জন্য, নিষ্ঠুরতার জন্য নয়।
- যে সমাজে ন্যায়বিচার, খাদ্য ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এই আইন প্রয়োগের প্রয়োজন খুব কম হয়।
- আল্লাহর আইন মানব রচিত আইনের চেয়ে সর্বোচ্চ ও পূর্ণাঙ্গ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৮):
- ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কেই আইনের আওতায় এনেছে।
- চুরি একটি গুরুতর অপরাধ — এর জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি নির্ধারিত।
- ইসলামী শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক, যাতে অন্যরা শিক্ষা গ্রহণ করে।
- আল্লাহর আইন সর্বোচ্চ ন্যায় ও প্রজ্ঞায় পূর্ণ।
উপসংহার:
এই আয়াত সমাজে ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে।
ইসলাম শুধু শাস্তির কথা বলে না,
বরং এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায় যেখানে কেউ অভাবে চুরি করতে বাধ্য না হয়।
তবে কেউ যদি সচেতনভাবে অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে,
আল্লাহর ন্যায়বিচার তাকে কখনো ছেড়ে দেয় না।
📖 “فَٱقْطَعُوا۟ أَيْدِيَهُمَا جَزَآءَۢ بِمَا كَسَبَا نَكَالٗا مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ”
“তাদের হাত কেটে দাও, যা তারা অর্জন করেছে তার প্রতিফলস্বরূপ,
আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে।
নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৮)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াত (আয়াত ৩৮)-এর পরিপূরক। সেখানে চুরির শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে, আর এখানে আল্লাহ তাআলা অপরাধীর জন্য **তওবা ও সংশোধনের দরজা** খুলে দিয়েছেন। 🌸
“فَمَن تَابَ مِنۢ بَعْدِ ظُلْمِهِۦ” — অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার অপরাধ ও অন্যায় করার পর তওবা করে। এখানে “ظُلْمِهِۦ” (জুলমিহি) দ্বারা বোঝানো হয়েছে — নিজের প্রতি ও অন্যের প্রতি অন্যায় করা, যেমন — চুরি, প্রতারণা, জুলুম, অন্যের অধিকার নষ্ট করা ইত্যাদি।
তওবা মানে শুধুমাত্র “ক্ষমা চাই” বলা নয়, বরং —
- অপরাধের জন্য গভীর অনুশোচনা করা,
- তাৎক্ষণিকভাবে পাপ কাজ ত্যাগ করা,
- ভবিষ্যতে আর না করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা,
- এবং কারও অধিকার নষ্ট করলে তা ফেরত দেওয়া বা সংশোধন করা।
“وَأَصْلَحَ” — অর্থাৎ, “এবং সে যদি নিজের অবস্থা সংশোধন করে।” অর্থাৎ, তওবা কেবল মুখের কথা নয়, কাজের মাধ্যমে তার প্রমাণ দিতে হবে — সৎ পথে ফিরে আসা, অন্যায় কাজ ছেড়ে দেওয়া এবং সৎকর্মে মনোযোগী হওয়া।
“فَإِنَّ ٱللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِۗ” — “তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।” আল্লাহর এই ঘোষণা হলো এক বিশাল আশার বার্তা ❤️ এমনকি চোর, জালেম, প্রতারক — যেই হোক না কেন, যদি আন্তরিকভাবে তওবা করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।
“إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ” — “নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” এই আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের চেয়েও বড়। আল্লাহ সবসময় চান মানুষ তাঁর দিকে ফিরে আসুক, নিজেকে সংশোধন করুক এবং জান্নাতের যোগ্য হয়ে উঠুক।
📖 অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন — “বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন।” — (সূরা আজ-যুমার ৩৯:৫৩)
এই আয়াত সমাজে ন্যায়বিচারের সাথে সাথে দয়ার ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম শুধু শাস্তির ধর্ম নয় — বরং পুনর্বাসন ও সংশোধনের ধর্ম।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা গ্রহণ করেন, এমনকি যদি তার পাপ আকাশ পর্যন্ত পৌঁছায়।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪২৫১) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ এমনভাবে তওবাকারীর প্রতি খুশি হন, যেমন একজন পথহারা ব্যক্তি তার উট ফিরে পেয়ে খুশি হয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৪৭)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি জীবনের ভুল বুঝে আল্লাহর পথে ফিরে আসে, আল্লাহ তার সব পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেন।
- একজন অপরাধী যদি আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়, সমাজের উচিত তাকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া।
- তওবা কেবল মুখের কথা নয় — কাজ ও আচরণে পরিবর্তন আনতে হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৩৯):
- আল্লাহর দয়া সীমাহীন — আন্তরিক তওবায় সব পাপ ক্ষমা হয়।
- তওবা ও সংশোধন ঈমানের জীবন্ত নিদর্শন।
- ইসলাম শাস্তির পাশাপাশি তওবা ও পুনর্বাসনের শিক্ষা দেয়।
- তওবা করার সুযোগ মৃত্যু আগ পর্যন্ত খোলা থাকে।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষের জন্য এক বিশাল আশার দ্বার।
কেউ যত বড় পাপী হোক না কেন,
যদি সে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, তওবা করে ও জীবন সংশোধন করে,
আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর রহমতে ঢেকে দেন।
আল্লাহর দয়া সবসময় তাঁর ক্রোধের উপর প্রাধান্যশীল।
📖 “فَمَن تَابَ مِنۢ بَعْدِ ظُلْمِهِۦ وَأَصْلَحَ
فَإِنَّ ٱللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِۗ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ”
“যে ব্যক্তি অপরাধের পর তওবা করে ও সংশোধন করে,
নিশ্চয়ই আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন;
নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর **সার্বভৌম কর্তৃত্ব, ন্যায়বিচার ও ক্ষমাশক্তি** সম্পর্কে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।
“أَلَمْ تَعْلَمْ” — অর্থাৎ, “তুমি কি জানো না?” এটি এক প্রশ্নবোধক রূপ, যা আসলে **স্মরণ করিয়ে দেওয়া** ও **জোরালোভাবে বোঝানো** উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, ‘তুমি তো অবশ্যই জানো!’ — আল্লাহই একমাত্র মালিক, তিনিই ন্যায়বিচারের অধিকারী।
“أَنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ” — অর্থাৎ, “আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহরই।” এই বাক্যটি নির্দেশ করে, **আল্লাহর রাজত্ব সর্বব্যাপী — সৃষ্টি, আইন, শাস্তি, ক্ষমা, সবকিছু তাঁর হাতে।** কেউ তাঁর হুকুমের বাইরে নয়, কেউ তাঁর আদেশ অমান্য করে পার পাবে না।
“يُعَذِّبُ مَن يَشَآءُ وَيَغْفِرُ لِمَن يَشَآءُ” — অর্থাৎ, “তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” এই অংশে আল্লাহর **পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও সার্বভৌম ইচ্ছা** প্রকাশিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে — আল্লাহ কখনো অন্যায়ভাবে কাউকে শাস্তি দেন না, এবং ইচ্ছেমতো ক্ষমা করেন মানে এটি নয় যে অন্যায়ের প্রশ্রয় দেন। বরং, তিনি শাস্তি দেন **ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে**, এবং ক্ষমা করেন **রহমতের ভিত্তিতে।** 🌸
এই আয়াত মানুষকে দুটি বিষয় শেখায়:
- আল্লাহর ন্যায়বিচারের ভয় রাখা (তাকওয়া),
- আল্লাহর দয়ার উপর আশা রাখা (রহমত)।
একজন মুমিন সর্বদা এই দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রাখে — **ভয় ও আশা (خوف ও رجاء)** এর মধ্যে জীবনযাপন করে।
“وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ قَدِيرٞ” — অর্থাৎ, “আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।” এই বাক্যটি আল্লাহর **সর্বোচ্চ ক্ষমতার ঘোষণা**। আল্লাহর কোনো কাজের প্রতিবন্ধক নেই, কেউ তাঁকে প্রশ্ন করতে পারে না — “কেন?” বরং সব সৃষ্টি তাঁকে প্রশ্নের মুখোমুখি হবে — “তুমি কী করেছো?”
📖 কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন — “বলুন, হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, তুমি যাকে চাও রাজত্ব দাও, যাকে চাও রাজত্ব কেড়ে নাও।” — (সূরা আলে ইমরান ৩:২৬)
মূল ভাবার্থ: এই আয়াত দেখায় যে, **আল্লাহই বিচারক, আল্লাহই দয়াময়।** মানুষ কেবল তাঁর আদেশ মানার দায়িত্বে নিযুক্ত। দুনিয়ার জীবন হলো পরীক্ষা, আখিরাতে আল্লাহই নির্ধারণ করবেন কে শাস্তির যোগ্য আর কে ক্ষমার যোগ্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যদি মানুষ জানত আল্লাহর শাস্তি কত কঠিন, কেউ জান্নাতের আশা করত না। আর যদি জানত আল্লাহর রহমত কত বিশাল, কেউ জাহান্নামের ভয় করত না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৫৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যে ব্যক্তি মনে করে আল্লাহর দয়া তাকে কখনো ত্যাগ করবে না, সে ভুল — তাকে ভয়ও রাখতে হবে।
- আর যে মনে করে আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না, সে হতাশ — তাকে আশাবাদী হতে হবে।
- আল্লাহর মালিকানার স্বীকৃতি মানেই তাঁর বিধান মানা।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪০):
- আকাশ ও পৃথিবীর মালিকানা কেবল আল্লাহর।
- শাস্তি ও ক্ষমা — উভয়ই আল্লাহর হাতে।
- আল্লাহর ন্যায়বিচার নিখুঁত এবং দয়া সীমাহীন।
- আল্লাহ সর্বশক্তিমান — তাঁর আদেশের বাইরে কিছুই ঘটে না।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় —
আল্লাহই একমাত্র মালিক, বিচারক ও ক্ষমার উৎস।
তিনি ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শাস্তি দেন,
এবং রহমতের ভিত্তিতে ক্ষমা করেন।
তাই মুমিনের উচিত — আল্লাহর ভয়ে আত্মসমর্পণ করা
এবং তাঁর দয়ার প্রতি সর্বদা আশাবাদী থাকা।
📖 “يُعَذِّبُ مَن يَشَآءُ وَيَغْفِرُ لِمَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ قَدِيرٞ”
“তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন, যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন;
আর আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪০)
এই আয়াত রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তিনি দুঃখ পেতেন যখন কিছু মানুষ ঈমানের ভান করে কুফরি করত, বা মুনাফিকরা ইসলামকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করত।
“لَا يَحْزُنكَ ٱلَّذِينَ يُسَـٰرِعُونَ فِي ٱلْكُفْرِ” — অর্থাৎ, “যারা দ্রুত কুফরির দিকে ধাবিত হয়, আপনি তাদের কারণে দুঃখিত হবেন না।” এখানে উদ্দেশ্য হলো, নবী ﷺ যেন এই ভণ্ড ও অবিশ্বাসীদের আচরণে কষ্ট না পান, কারণ তাদের কাজ আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয় — আল্লাহ তাদের পরিণতি জানেন এবং তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করেছেন।
“مِنَ ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟ ءَامَنَّا بِأَفْوَٰهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِن قُلُوبُهُمْ” — অর্থাৎ, “যারা মুখে বলে আমরা ঈমান এনেছি, অথচ তাদের হৃদয়ে ঈমান নেই।” এটি মুনাফিকদের প্রতি ইঙ্গিত — যারা মুখে ইসলাম গ্রহণের ভান করত, কিন্তু ভিতরে ছিল অবিশ্বাস, ঘৃণা ও কপটতা।
“وَمِنَ ٱلَّذِينَ هَادُوا۟ سَمَّـٰعُونَ لِلْكَذِبِ” — অর্থাৎ, “আর কিছু ইহুদি আছে যারা মিথ্যা শোনে।” তারা নবী ﷺ-এর কথা বিকৃতভাবে প্রচার করত, কুরআনের বাণীকে বিকৃত করত, এবং সত্যকে গোপন করত।
“يُحَرِّفُونَ ٱلْكَلِمَ مِنۢ بَعْدِ مَوَاضِعِهِۦ” — অর্থাৎ, “তারা আল্লাহর বাণীর স্থান পরিবর্তন করে দেয়।” এটি ইহুদিদের এক বড় গুনাহ ছিল — তারা তাওরাতের আইন ও শব্দগুলো পরিবর্তন করে নিজেদের স্বার্থে ব্যাখ্যা দিত। (যেমন — ব্যভিচারীদের পাথর নিক্ষেপের আইন তারা লুকিয়ে রাখত)।
“يَقُولُونَ إِنْ أُوتِيتُمْ هَـٰذَا فَخُذُوهُ ...” — তারা একে অপরকে বলত, “যদি নবী ﷺ এমন রায় দেন যা তোমাদের পছন্দসই, তবে গ্রহণ করো, আর না দিলে প্রত্যাখ্যান করো।” অর্থাৎ, তারা ধর্মীয় বিধানকে খেলাচ্ছলে নিয়েছিল।
“وَمَن يُرِدِ ٱللَّهُ فِتْنَتَهُۥ ...” — আল্লাহ বলেন, “যাকে আমি বিভ্রান্ত করতে চাই, তার জন্য তুমি কিছুই করতে পারবে না।” এটি বোঝায়, হেদায়েত কেবল আল্লাহর হাতে। যাদের অন্তর সত্য গ্রহণে অস্বীকার করে, আল্লাহ তাদের অন্তর সিল করে দেন।
“لَهُمْ فِي ٱلدُّنْيَا خِزْيٞ” — অর্থাৎ, “তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা।” যেমন — ইহুদিরা পরাজিত ও অপমানিত হয়েছিল, তাদের ইতিহাসে লজ্জার অধ্যায় রয়েছে।
“وَلَهُمْ فِي ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ” — “আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” কারণ তারা আল্লাহর বাণী বিকৃত করেছে এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করেছে।
মূল বার্তা:
এই আয়াত নবী ﷺ-কে সান্ত্বনা দিয়ে শিক্ষা দেয় যে, সত্যপথে যারা চলবে, তাদের সামনে মিথ্যার প্রচারকরা থাকবে, কিন্তু আল্লাহর সাহায্যই শেষ পর্যন্ত সত্যকে বিজয়ী করবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মানুষ যখন আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করে নিজেদের মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে, তখন ধ্বংস তাদের নিকটে চলে আসে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৬৫০)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও কেউ কেউ কুরআনের কথা নিজেদের স্বার্থে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে।
- সত্যকে আড়াল করে ধর্মকে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা — এই আয়াতের সতর্কতা আজও প্রযোজ্য।
- আল্লাহর বাণী পরিবর্তন নয় — অনুসরণ করতে হবে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪১):
- আল্লাহর রাসূল ﷺ দুঃখিত হলেও আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।
- মুনাফিকতা ও ধর্ম বিকৃতি আল্লাহর কাছে ঘৃণিত।
- সত্যকে বিকৃত করার পরিণাম দুনিয়ায় লাঞ্ছনা ও আখিরাতে শাস্তি।
- হেদায়েত কেবল আল্লাহর হাতে — কেউ জোর করে কাউকে সৎ করতে পারে না।
উপসংহার:
এই আয়াত নবী ﷺ-কে ও সমগ্র মুসলিম জাতিকে আশ্বস্ত করে —
অবিশ্বাসী ও কপটদের চক্রান্তে কষ্ট পেয়ো না,
কারণ আল্লাহ নিজেই সত্যকে রক্ষা করবেন এবং মিথ্যাকে পরাজিত করবেন।
যারা ধর্ম বিকৃতি করে, তাদের জন্য দুনিয়ার লজ্জা ও আখিরাতের শাস্তি নির্ধারিত।
📖 “لَهُمْ فِي ٱلدُّنْيَا خِزْيٞ وَلَهُمْ فِي ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ”
“তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে মহা শাস্তি।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪১)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **ইহুদিদের ভণ্ডামী, মিথ্যাচার ও অন্যায়ের প্রবণতা** তুলে ধরেছেন, এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন।
“سَمَّـٰعُونَ لِلْكَذِبِ” — অর্থাৎ, “তারা মিথ্যা শোনে।” তারা সত্যকে উপেক্ষা করে, মিথ্যা ও গুজব শুনতে ও প্রচার করতে পছন্দ করে। এটি তাদের নৈতিক দুর্নীতির প্রতিফলন।
“أَكَّـٰلُونَ لِلسُّحْتِ” — অর্থাৎ, “তারা হারাম (অবৈধ সম্পদ) খেতে ভালোবাসে।” “সুহ্ত” (السحت) অর্থ — এমন সম্পদ যা অন্যায় উপায়ে উপার্জিত হয়, যেমন ঘুষ, প্রতারণা, সুদ, বা অন্যের অধিকার হরণ।
ইহুদিদের মধ্যে বিচারক ও ধর্মীয় নেতারা ঘুষ নিতেন, এবং সত্যকে বিকৃত করে ঘুষদাতার পক্ষে রায় দিতেন। তাই আল্লাহ রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সতর্ক করলেন যেন এই অন্যায়কারীদের প্রভাবে বিচার না করা হয়।
“فَإِن جَآءُوكَ فَٱحْكُم بَيْنَهُمْ أَوْ أَعْرِضْ عَنْهُمْ” — “যদি তারা আপনার কাছে রায়ের জন্য আসে, আপনি চাইলে বিচার করুন অথবা মুখ ফিরিয়ে নিন।” এটি বোঝায়, নবী ﷺ-এর জন্য তাদের মধ্যে বিচার করা বাধ্যতামূলক নয়। কারণ তারা ইসলামের শাসন মেনে চলতে আগ্রহী ছিল না, বরং নিজেদের স্বার্থে নবীর রায় নিতে চাইত।
“وَإِن تُعْرِضْ عَنْهُمْ فَلَن يَضُرُّوكَ شَيْـٔٗا” — “আপনি যদি তাদের উপেক্ষা করেন, তারা আপনাকে ক্ষতি করতে পারবে না।” অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ ﷺ যেন তাদের কপট আচরণে দুঃখিত না হন, কারণ আল্লাহ তাঁর রক্ষাকারী।
“وَإِنْ حَكَمْتَ فَٱحْكُم بَيْنَهُم بِٱلْقِسْطِ” — “আর যদি বিচার করেন, তবে ন্যায়বিচারসহ বিচার করুন।” ইসলামি আইনের অন্যতম মূলনীতি এখানেই — ন্যায়বিচার (القسط) হলো ইসলামী সমাজের ভিত্তি।
“إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ” — “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।” অর্থাৎ, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তারা — যারা ঘুষ, পক্ষপাত, রাগ বা বিদ্বেষ ছাড়া ন্যায়ের সাথে রায় প্রদান করে।
📖 কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে — “আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন, তোমরা যখন বিচার করো, তখন ন্যায়বিচারসহ করো।” — (সূরা আন-নিসা ৪:৫৮)
এই আয়াত ন্যায়বিচারের মূল শিক্ষা দেয় — **ইসলামী রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত জীবনে ন্যায় ও সততা সর্বাগ্রে।** এটি শুধু বিচারকের জন্য নয়, বরং প্রত্যেক বিশ্বাসীর জন্যও প্রযোজ্য, যিনি অন্যের ব্যাপারে রায় দেন বা মতামত দেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে বিচারক জেনে শুনে অন্যায় রায় দেয়, সে জাহান্নামের আগুনের এক অংশে নিক্ষিপ্ত হবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৮২২) আরেক হাদিসে তিনি ﷺ বলেছেন — “তিন প্রকার বিচারক আছে — একজন জান্নাতি: যে ন্যায়ভাবে রায় দেয়; এবং দুজন জাহান্নামী: যে জেনে শুনে অন্যায় রায় দেয়, আর যে জ্ঞানহীন অবস্থায় রায় দেয়।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৩৫৭৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক সমাজে ঘুষ, মিথ্যা সাক্ষ্য ও অন্যায় রায় প্রচলিত — এটি এই আয়াতের বিরুদ্ধে জঘন্য কাজ।
- ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব ও বিচারই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
- আল্লাহর প্রিয় হতে চাইলে সত্যের পক্ষে থাকতে হবে, এমনকি তা নিজের ক্ষতির কারণ হলেও।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪২):
- মিথ্যা ও ঘুষ সমাজ ধ্বংসের মূল কারণ।
- ন্যায়বিচার ইসলামি সমাজের সর্বোচ্চ নীতি।
- আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।
- রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সান্ত্বনা: অন্যায়কারীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় নেই।
উপসংহার:
এই আয়াত ন্যায়বিচার ও সৎ নেতৃত্বের গুরুত্ব তুলে ধরে।
ইসলাম এমন এক সমাজ চায় যেখানে ঘুষ, মিথ্যা ও পক্ষপাতিত্বের স্থান নেই।
নবী ﷺ ও মুমিনদের বলা হয়েছে —
অন্যায়কারীদের নিয়ে চিন্তা করো না,
বরং সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকো।
কারণ আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরই ভালোবাসেন।
📖 “وَإِنْ حَكَمْتَ فَٱحْكُم بَيْنَهُم بِٱلْقِسْطِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ”
“আর যদি আপনি বিচার করেন,
তবে ন্যায়বিচারসহ বিচার করুন;
নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **ইহুদিদের ভণ্ডামি ও দ্বিমুখিতা** প্রকাশ করেছেন। তারা নিজেদের ধর্মগ্রন্থ “তাওরাত”-এর মধ্যে স্পষ্ট হুকুম থাকা সত্ত্বেও, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে রায় নিতে আসত — শুধুমাত্র তখনই, যখন মনে করত নবী ﷺ তাদের পক্ষে রায় দেবেন।
“وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ” — অর্থাৎ, “তারা কীভাবে আপনাকে বিচারক বানায়?” অর্থাৎ, তারা মুখে নবী ﷺ-এর বিচার চায়, কিন্তু অন্তরে সত্য মেনে নিতে রাজি নয়। এটি ছিল তাদের মিথ্যাচার ও কপটতার প্রকাশ।
“وَعِندَهُمُ ٱلتَّوْرَىٰةُ فِيهَا حُكْمُ ٱللَّهِ” — “অথচ তাদের কাছে তাওরাত রয়েছে, যাতে আল্লাহর হুকুম রয়েছে।” এখানে বোঝানো হয়েছে যে, তাওরাতে ব্যভিচারীর জন্য **পাথর নিক্ষেপের (রাজম)** শাস্তি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থে সেই আইন পরিবর্তন করেছিল। যখন তারা নবী ﷺ-এর কাছে এ বিষয়ে রায় চাইতে আসে, তখন আল্লাহ এই আয়াত নাজিল করেন, যেন নবী ﷺ জানেন তাদের উদ্দেশ্য শুধু স্বার্থসিদ্ধি।
ইতিহাস অনুযায়ী — এক ইহুদি নারী ও পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে, ইহুদি সমাজের নেতা এই আইন কার্যকর করতে চাইছিল না, কারণ অপরাধীরা ছিল উচ্চবংশীয়। তারা তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে রায় চায়, আশা করেছিল নবী ﷺ হালকা শাস্তি দেবেন। কিন্তু নবী ﷺ তাওরাত থেকে মূল আইন পড়ে শোনান এবং পাথর নিক্ষেপের আদেশ দেন — যা দেখে তাদের কপটতা প্রকাশ পায়।
“ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ” — অর্থাৎ, “তারপরও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।” অর্থাৎ, সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও তারা তা গ্রহণ করে না। তারা আল্লাহর হুকুম ও নবীর বিচার উভয়কেই অমান্য করে।
“وَمَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ” — “তারা মুমিন নয়।” কারণ মুমিন সে-ই, যে আল্লাহর আদেশকে বিনা শর্তে মেনে নেয়। আর যারা নিজেদের ইচ্ছেমতো আল্লাহর আইন মানে, তারা কখনো সত্যিকার মুমিন হতে পারে না।
এই আয়াত আজকের যুগেও প্রযোজ্য — যখন মানুষ আল্লাহর নির্দেশকে উপেক্ষা করে নিজের সুবিধামতো “ধর্ম” বা “আইন” বেছে নেয়, তখন সে ইহুদিদের সেই পথেই চলে।
📖 আল্লাহ বলেন — “তারা কি চায় জাহেলিয়াতের বিচার? অথচ আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিচারক আর কে আছে তাদের জন্য, যারা দৃঢ়ভাবে ঈমান এনেছে?” — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫০)
সম্পর্কিত হাদিস:
সহিহ বুখারীতে বর্ণিত — এক ইহুদি নারী ও পুরুষ ব্যভিচার করলে, নবী ﷺ বললেন: “তোমাদের তাওরাতে কী বলা আছে?” তারা বলল: “কালো মুখে মর্দন।” কিন্তু একজন আলেম বলল: “তাওরাতে রাজমের আদেশ আছে।” তখন নবী ﷺ বললেন: “তাহলে আমি তাওরাতের হুকুম অনুযায়ী রায় দেব।” — (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৮২৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- যারা আল্লাহর কিতাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের স্বার্থে মানব রচিত আইনকে অগ্রাধিকার দেয়, তারা এই আয়াতের সতর্কতার অন্তর্ভুক্ত।
- ধর্মকে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা এক ধরনের কপটতা।
- আল্লাহর হুকুমই একমাত্র চূড়ান্ত ও ন্যায়সঙ্গত আইন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৩):
- আল্লাহর আইনকে উপেক্ষা করা ঈমানহীনতার নিদর্শন।
- তাওরাতে স্পষ্ট হুকুম থাকা সত্ত্বেও ইহুদিরা তা অমান্য করেছিল।
- আল্লাহর রাসূল ﷺ ন্যায়বিচারের প্রকৃত মানদণ্ড স্থাপন করেছেন।
- মুমিন সে-ই, যে আল্লাহর আদেশকে বিনা শর্তে মেনে চলে।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর আইন ও ন্যায়বিচারের মর্যাদা তুলে ধরে।
যারা ধর্মের সত্য আইনকে উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থে বদলাতে চায়,
তারা আসলে মুমিন নয়, বরং মুনাফিক ও কপট।
নবী ﷺ-কে বলা হয়েছে —
দুশ্চিন্তা করো না, আল্লাহর হুকুমই সর্বোচ্চ ও অপরিবর্তনীয়।
📖 “وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِندَهُمُ ٱلتَّوْرَىٰةُ فِيهَا حُكْمُ ٱللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَۚ وَمَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ”
“তারা কীভাবে আপনাকে বিচারক বানায়, অথচ তাদের কাছে তাওরাত রয়েছে,
যাতে আল্লাহর বিধান আছে? তারপরও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়;
তারা মুমিন নয়।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৩)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **তাওরাতের মর্যাদা, ইহুদিদের দায়িত্ব ও তাদের ব্যর্থতা** বর্ণনা করেছেন। এটি তাওরাতের প্রতি বিশ্বাসীদের জন্য এক শিক্ষা, এবং মুসলমানদের জন্যও এক সতর্ক বার্তা — আল্লাহর আইন ত্যাগ করলে পরিণতি কী হতে পারে।
“إِنَّآ أَنزَلْنَا ٱلتَّوْرَىٰةَ فِيهَا هُدٗى وَنُورٞ” — “আমি তাওরাত নাজিল করেছি, যাতে ছিল হেদায়েত ও নূর।” তাওরাত ছিল বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক পরিপূর্ণ শরীয়াহ, যাতে সত্য, ন্যায়বিচার ও আল্লাহভীতির শিক্ষা ছিল।
“يَحْكُمُ بِهَا ٱلنَّبِيُّونَ ٱلَّذِينَ أَسْلَمُوا۟” — “যারা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেছিলেন, সেই নবীগণ তার দ্বারা বিচার করতেন।” অর্থাৎ, তাওরাতের অনুসারী নবীগণ (যেমন মূসা আঃ, হারুন আঃ ইত্যাদি) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজে বিচার করতেন।
“وَٱلرَّبَّـٰنِيُّونَ وَٱلْأَحْبَارُ” — “রাব্বানী ও আহবারগণও তত্ত্বাবধান করতেন।”
- রাব্বানী (رَبّاني): আল্লাহভীরু শিক্ষাগুরু ও ন্যায়পরায়ণ নেতা।
- আহবার (أحبار): ইহুদি আলেম বা জ্ঞানীগণ।
“فَلَا تَخْشَوُا۟ ٱلنَّاسَ وَٱخْشَوْنِ” — “মানুষকে ভয় করো না, বরং আমাকেই ভয় করো।” এটি আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ যে, **বিচারে মানুষ বা সমাজের চাপে নয়, বরং আল্লাহভীতিতে কাজ করতে হবে।**
“وَلَا تَشْتَرُوا۟ بِـَٔايَـٰتِي ثَمَنٗا قَلِيلٗا” — “আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য মূল্য লাভ করো না।” অর্থাৎ, সত্য গোপন বা বিকৃত করে পার্থিব লাভ (ঘুষ, জনপ্রিয়তা, সম্মান) অর্জন করা আল্লাহর দৃষ্টিতে এক বড় গুনাহ।
“وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ” — “আর যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই কাফের।” এখানে “কাফের” বলতে বোঝানো হয়েছে — যারা জেনে শুনে আল্লাহর আইন অমান্য করে, নিজেদের তৈরি নিয়মকে আল্লাহর বিধানের ওপরে স্থান দেয়।
📖 ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে, সে কাফের। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করে কিন্তু অনুসরণ করে না, সে জালেম বা ফাসিক।” (📚 তাফসীর ইবন কাসীর)
এই আয়াত মুসলিম সমাজকেও শিক্ষা দেয় — কুরআনই আজকের যুগের তাওরাত; আমাদের শাসন, বিচার, আইন ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআনের বিধানই সর্বোচ্চ হতে হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিচার করে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন; আর যে অন্যায়ভাবে রায় দেয়, সে জাহান্নামের দিকে ধাবিত হয়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৮২৩)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সমাজে মানব রচিত আইন কুরআনের উপরে স্থান পেয়েছে — এটি ঠিক ইহুদিদের মতো অবস্থা।
- যে জাতি আল্লাহর বিধানকে ত্যাগ করে, তারা অবশেষে অন্যায়, দুর্নীতি ও বিভ্রান্তিতে পতিত হয়।
- আল্লাহর আইন মানা মানেই প্রকৃত ন্যায় ও শান্তির পথ অনুসরণ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৪):
- আল্লাহর কিতাব সর্বদা হেদায়েত ও আলোর উৎস।
- বিচারে মানুষ নয়, আল্লাহর ভয় প্রধান হওয়া উচিত।
- সত্য বিকৃত করে দুনিয়াবি লাভ করা মহাপাপ।
- আল্লাহর বিধান ত্যাগকারীরা কাফের বা অবিশ্বাসীর অন্তর্ভুক্ত।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর বিধানের গুরুত্ব,
ন্যায়বিচারের মূল্য ও আল্লাহভীতির প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
যেসব জাতি আল্লাহর আইন ত্যাগ করে,
তারা ধ্বংস ও অন্ধকারে পতিত হয়।
আর যারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে,
তাদের জন্য রয়েছে হেদায়েত ও নূর।
📖 “وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ”
“আর যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী বিচার করে না,
তারাই কাফের।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৪)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **তাওরাতে বনী ইসরাইলের জন্য নির্ধারিত ন্যায়বিচারের আইন** বর্ণনা করেছেন — যা ন্যায়, প্রতিশোধ (কিসাস) ও ক্ষমার ভারসাম্যের শিক্ষা দেয়।
“أَنَّ ٱلنَّفْسَ بِٱلنَّفْسِ ...” — অর্থাৎ, “প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ…” এটি **কিসাস (قِصَاص)** এর আইন — যেখানে অপরাধের প্রতিদান অপরাধের সমান মাত্রায় দেওয়া হয়। এটি আল্লাহর এক মহান ন্যায়বিচারমূলক বিধান।
কিসাসের উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নয়, বরং **ন্যায় ও প্রতিরোধ** — যেন কেউ অন্যের ক্ষতি করার সাহস না পায়।
📖 আল্লাহ বলেন — “হে বুদ্ধিমানগণ! কিসাসে তোমাদের জন্য রয়েছে জীবন।” — (সূরা আল-বাকারা ২:১৭৯)
“وَٱلْجُرُوحَ قِصَاصٞ” — “ক্ষতের জন্যও প্রতিশোধ।” অর্থাৎ, শারীরিক ক্ষতিসাধনের প্রতিদানও সমানভাবে নির্ধারিত, যেমন — আঘাত, অঙ্গহানি বা ক্ষতের ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত প্রতিদান।
“فَمَن تَصَدَّقَ بِهِۦ فَهُوَ كَفَّارَةٞ لَّهُۥ” — “কিন্তু কেউ যদি ক্ষমা করে দেয়, তা তার জন্য কাফ্ফারা।” অর্থাৎ, প্রতিশোধের অধিকার থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়, তবে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করেন এবং তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। 💖 এখানে ইসলামী আইনের এক মহান দিক প্রকাশ পায় — ন্যায়বিচার ও দয়ার সমন্বয়।
কিসাস ও ক্ষমা — দুটোই ইসলামী সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টি করে। প্রতিশোধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, আর ক্ষমায় দয়া ও মানবতা প্রকাশ পায়।
“وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّـٰلِمُونَ” — “আর যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই জালেম।” পূর্ববর্তী আয়াতে (৪৪ নম্বর) বলা হয়েছিল — “তারা কাফের”, আর এখানে বলা হয়েছে — “তারা জালেম।” অর্থাৎ, যারা আল্লাহর আইন জানে কিন্তু তা প্রয়োগ করে না, তারা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত।
📚 ইমাম ইবন কাসীর বলেন — “যে আল্লাহর আইন অস্বীকার করে, সে কাফের; আর যে তা স্বীকার করেও মানে না, সে জালেম।” — (তাফসীর ইবন কাসীর)
ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে: ইসলামে **কিসাস (প্রতিশোধ)** আইন এখনো বহাল — তবে তা **ন্যায়বিচারের অধীনে** বিচারালয়ে কার্যকর করা হয়। কেউ ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে না। একই সঙ্গে **ক্ষমা করা ও দান** সর্বোচ্চ মর্যাদার আমল।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি কিসাসের পরিবর্তে ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং গুনাহ মাফ করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)
আরেক হাদিসে — “ক্ষমা করা দুর্বলতার নিদর্শন নয়, বরং শক্তিশালী ব্যক্তির আসল শক্তি তার রাগ দমন ও ক্ষমায়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬১১৪)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সমাজে প্রতিশোধই একমাত্র লক্ষ্য — কিন্তু ইসলাম শিখিয়েছে ন্যায়ের সাথে ক্ষমার সৌন্দর্য।
- আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাস্তি দিলে সমাজে ভারসাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- মানুষের রাগ, প্রতিশোধ বা স্বার্থ নয় — বরং আল্লাহভীতি ভিত্তিক ন্যায়বিচারই শ্রেষ্ঠ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৫):
- কিসাস আইন ন্যায় ও জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
- ক্ষমা আল্লাহর নিকট সর্বোচ্চ পুরস্কার বয়ে আনে।
- আল্লাহর আইন ত্যাগ করলে তা জুলুম ও অন্যায়।
- ন্যায়বিচার ও দয়া — উভয়ই ইসলামী শরীয়াহর অংশ।
উপসংহার:
এই আয়াত দেখায়, ইসলাম কোনো অন্ধ প্রতিশোধের ধর্ম নয়,
বরং এক ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা।
আল্লাহর আইনেই রয়েছে সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা ও নৈতিকতা।
যে ক্ষমা করে, সে কেবল অন্যকে নয়, নিজেকেও মুক্তি দেয়।
আর যে আল্লাহর বিধানকে ত্যাগ করে,
সে নিজেই অন্যায়ের গভীরে ডুবে যায়।
📖 “فَمَن تَصَدَّقَ بِهِۦ فَهُوَ كَفَّارَةٞ لَّهُۥۚ
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ
فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّـٰلِمُونَ”
“যে ক্ষমা করে দেয়, তা তার জন্য কাফ্ফারা;
আর যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী বিচার করে না,
তারাই জালেম।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **নবী ঈসা (আঃ)-এর আগমন ও ইনজিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য** স্পষ্ট করেছেন। এটি ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এক ঐতিহাসিক সংযোগ — তাওরাত, ইনজিল ও কুরআন — তিনটি ঐশী কিতাব এক ধারাবাহিকতার অংশ।
“وَقَفَّيْنَا عَلَىٰٓ ءَاثَـٰرِهِم” — “আর আমরা তাদের পর পাঠালাম।” অর্থাৎ, মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদের পর নবী ঈসা (আঃ)-কে প্রেরণ করা হলো। তিনি বনী ইসরাইলের নবী ছিলেন, এবং তাঁর মিশন ছিল আল্লাহর পূর্ববর্তী কিতাব (তাওরাত)-এর সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা।
“بِعِيسَى ٱبْنِ مَرْيَمَ” — এখানে “ঈসা ইবনু মারইয়াম” বলা হয়েছে, যেন পরিষ্কার হয় যে তিনি একজন মানব নবী — আল্লাহর পুত্র নন (যেমন খ্রিস্টানরা দাবি করে)।
“مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلتَّوْرَىٰةِ” — অর্থাৎ, “তাওরাতের সত্যতা নিশ্চিতকারী।” ঈসা (আঃ) তাওরাতের সত্য শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, এবং ইহুদিদের বিকৃত বিশ্বাস ও আইন সংশোধনের আহ্বান জানান।
“وَءَاتَيْنَـٰهُ ٱلْإِنجِيلَ” — “আমি তাঁকে ইনজিল প্রদান করেছি।” ইনজিল ছিল ঈসা (আঃ)-এর যুগে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব, যাতে প্রেম, দয়া, ক্ষমা ও আত্মশুদ্ধির শিক্ষা ছিল। তবে পরবর্তীতে সেই কিতাব বিকৃত ও সংমিশ্রিত হয়েছে।
“فِيهِ هُدٗى وَنُورٞ” — “যাতে ছিল হেদায়েত ও নূর।” অর্থাৎ, ইনজিলে ছিল নৈতিক দিকনির্দেশনা ও আল্লাহর আলো — যা মানুষকে অন্ধকার (অবিশ্বাস, অহংকার) থেকে মুক্তি দিত।
“وَمُصَدِّقٗا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلتَّوْرَىٰةِ” — এটি পুনরায় বলা হয়েছে, যেন বোঝানো যায়, সব ঐশী কিতাব একই আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাই তাদের বার্তাও একই — “তাওহিদ ও ন্যায়”।
“وَهُدٗى وَمَوْعِظَةٗ لِّلْمُتَّقِينَ” — “এবং মুত্তাকীদের জন্য ছিল পথনির্দেশ ও উপদেশ।” অর্থাৎ, ইনজিল শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, বরং তাকওয়াবানদের জন্য ছিল নৈতিক পথপ্রদর্শক ও হৃদয়শুদ্ধির উৎস।
ইসলাম ঈসা (আঃ)-কে একজন সম্মানিত নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তাঁকে “ঈশ্বরের পুত্র” বা “ত্রিত্বের অংশ” বলে না। তিনি ছিলেন আল্লাহর এক নির্বাচিত দাস ও নবী, যিনি আল্লাহর নির্দেশে অলৌকিক জন্ম লাভ করেন, কিন্তু আল্লাহই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন “কুন ফায়াকুন”-এর মাধ্যমে।
📖 আল্লাহ বলেন — “ঈসার দৃষ্টান্ত আল্লাহর কাছে আদমের মতো; তিনি তাঁকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর বলেছেন ‘হও’, আর তিনি হয়েছেন।” — (সূরা আলে ইমরান ৩:৫৯)
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমি পৃথিবীতে ঈসা ইবনু মারইয়ামের সর্বাধিক নিকটতম, কারণ আমাদের মধ্যে কোনো নবী নেই। আমার ও তাঁর নবুওয়াত একই ধারার।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৪২)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজও অনেক খ্রিস্টান বিশ্বাস করে ঈসা (আঃ) ঈশ্বরের পুত্র — অথচ কুরআন প্রমাণ করেছে, তিনি আল্লাহর একজন নবী ও দাস।
- ইনজিল মূলত ভালোবাসা ও তাকওয়ার কিতাব ছিল, কিন্তু মানবহাতে তা বিকৃত হয়েছে।
- ইসলাম সব নবী ও কিতাবকে সম্মান দেয়, কারণ সবই একই আল্লাহর পক্ষ থেকে।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৬):
- ঈসা (আঃ) আল্লাহর প্রেরিত নবী, আল্লাহর পুত্র নন।
- ইনজিল ছিল তাওরাতের সত্যতা নিশ্চিতকারী কিতাব।
- সব ঐশী কিতাবের মূল বার্তা এক — তাওহিদ ও ন্যায়।
- মুত্তাকীদের জন্য আল্লাহর কিতাব সর্বদা নূর ও হেদায়েত।
উপসংহার:
এই আয়াত তাওরাত, ইনজিল ও কুরআনের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দেয়।
আল্লাহর সব নবী একই দাওয়াত এনেছেন —
“এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো।”
ইনজিল ছিল তাওরাতের ধারাবাহিকতা,
আর কুরআন হলো তাদের পূর্ণতা ও সংশোধন।
📖 “وَقَفَّيْنَا عَلَىٰٓ ءَاثَـٰرِهِم بِعِيسَى ٱبْنِ مَرْيَمَ ... وَمَوْعِظَةٗ لِّلْمُتَّقِينَ”
“আর আমরা তাদের পর পাঠিয়েছি মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আঃ)-কে,
যিনি তাওরাতের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন,
এবং তাঁকে ইনজিল দান করেছি — যাতে হেদায়েত, নূর ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশ রয়েছে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৬)
এই আয়াতটি আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিক অংশ — আল্লাহ ইহুদী ও ইস্লাম-পূর্ব সমূহকে স্মরণ করাচ্ছেন যে, তাদের কাছে অবতীর্ণ পবিত্র গ্রন্থ (ইঞ্জিল) ছিল এবং তাতে থাকা বিধান অনুযায়ীই তাদের বিচার ও ব্যবহার করা উচিত ছিল।
“وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ ٱلْإِنْجِيلِ بِمَآ أَنْزَلَ ٱللَّهُ فِيهِ”
— অর্থাৎ, “ইঞ্জিলের লোকেরা হোক তাদের দায়িত্ব—তারা তাদের মধ্যকার বিষয়সমূহে আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী বিচার করুক।” এখানে নির্দেশ স্পষ্ট: কিতাবপ্রাপ্তদের কর্তব্য ছিল তাদের কিতাবের অনুশাসন মেনে চলা, কিতাবের স্পষ্ট বিধান অনুযায়ী বিচার করা এবং তা বিকৃত না করা।
“وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَآ أَنْزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَـٰسِقُونَ”
— “আর যে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারা ফাসিক।” ‘ফাসিক’ শব্দের অর্থ: আইন ভঙ্গকারী, তার নির্দেশকে উপেক্ষাকারী; অর্থাৎ ধর্মীয় কর্তব্য ও নির্দিষ্ট বিধান অমান্যকারী। এটি কেবল এক ধরনের তকমা নয়, বরং গুরুতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা।
→ এই আয়াতের উদ্দেশ্য: কিতাবপ্রাপ্ত জনগণের কাছে এক সহজ কিন্তু দৃঢ় আহ্বান— *যে ধর্মগ্রন্থ তোমাদের কাছে আছে, সেটাই তোমাদের মাপকাঠি; তাকে বিকৃত করে নিজের স্বার্থ সাধন করা স্বীকার্য নয়।*
বাস্তবিক প্রয়োগ ও শিক্ষা:
- যারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে নিজের স্বার্থে পরিবর্তন করে বা উপেক্ষা করে, তারা আল্লাহর নির্দেশ থেকে বিচ্যুত।
- পবিত্র গ্রন্থে থাকা নীতিকে সম্মান করে অনুশীলন করাই সৎ ও অধিকারসম্মত আচরণ।
- ইসলামে কুরআনই আজকের যুগে সর্বশেষ ও পূর্ণ নির্দেশ—তাই মুসলমানদের কর্তব্য কুরআন ও রাসূলের অনুসরণ করা।
নোট: এই আয়াত কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে "অন্তহীন অপরাধী" হিসেবে চিহ্নিত করার বার্তা নয়—বরং এটি আল্লাহর কাছে অংশগ্রহণকারী সকলের জন্য একটি সার্বজনীন নীতিস্মরণ: **যারা তাদের কাছে আসা আগ্রহী লেখাকে মেনে চলে না, তারা প্রকৃতভাবে পথত্যাগী।**
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৭):
- ধর্মীয় গ্রন্থের সম্মান ও আনুগত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- কিতাবপ্রাপ্তদের কর্তব্য—তাদের গ্রন্থে যা আছে তা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
- বিধান অমান্য করা নৈতিক অবক্ষয়ের লক্ষণ; এমন লোককে ‘ফাসিক’ বলা হয়েছে।
উপসংহার:
এই আয়াত স্মরণ করায়—পবিত্র কিতাব পেলে তার নির্দেশকে গ্রাহ্য করা ও তা প্রতিপালন করা প্রত্যেক সম্মানিত সম্প্রদায়ের কর্তব্য।
কিতাবের আদেশ উপেক্ষা বা বিকৃতি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করা আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা এবং তা কুফর বা ফাসিকতার দিকে ধাবিত করে।
আল্লাহ আমাদেরকে কিতাবপালনের পথ দেখান ও কিতাবের প্রতি ইমান, শ্রদ্ধা ও সৎকার্য অর্জনে সাহায্য করুন।
📖 “وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ ٱلْإِنْجِيلِ بِمَآ أَنْزَلَ ٱللَّهُ فِيهِۖ وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَآ أَنْزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَـٰسِقُونَ”
“ইঞ্জিলের লোকেরা তাদের কিতাবে যা আছে তা অনুযায়ী বিচার করুক; আর যারা তা করে না, তারা ফাসিক।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **কুরআনের মর্যাদা, এর দায়িত্ব ও মানবজাতির বৈচিত্র্যের উদ্দেশ্য** ব্যাখ্যা করেছেন। এটি সূরা আল-মায়েদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়াত — যেখানে কুরআনের তিনটি গুণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
১️ কুরআনের বৈশিষ্ট্য: “بِٱلْحَقِّ” — সত্যসহ কিতাব। কুরআন মানবজাতির জন্য এক পরিপূর্ণ ও সত্যনিষ্ঠ বিধান। এটি অন্য কোনো গ্রন্থের মতো সন্দেহজনক নয়; বরং আল্লাহর সরাসরি কালাম।
২️ পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা নিশ্চিতকারী: “مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلْكِتَـٰبِ” অর্থাৎ, কুরআন পূর্ববর্তী ঐশী কিতাবসমূহের (তাওরাত, ইনজিল, যাবুর ইত্যাদি) মূল বার্তা — তাওহিদ, ন্যায় ও তাকওয়ার সত্যতাকে নিশ্চিত করে।
৩️ “وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ” — তাদের উপর নিয়ন্ত্রক ও সংরক্ষক। অর্থাৎ, কুরআন হলো চূড়ান্ত গ্রন্থ — যা পূর্ববর্তী সব কিতাবের মানদণ্ড ও সংশোধক। যে অংশগুলো সত্য, কুরআন তা সমর্থন করেছে, আর যা বিকৃত হয়েছে, কুরআন তা বাতিল করেছে।
“فَٱحْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ” — “সুতরাং তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী বিচার কর।” নবী ﷺ ও মুসলমানদের জন্য এটি এক স্পষ্ট নির্দেশ — কোনো মানবসৃষ্ট নীতি নয়, বরং আল্লাহর বিধানই বিচারব্যবস্থার ভিত্তি হবে।
“وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَهُمْ” — “তাদের খেয়াল-খুশি অনুসরণ করো না।” ইসলাম ব্যক্তিগত ইচ্ছা, আবেগ বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতবাদকে নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশকে চূড়ান্ত বলে মানে।
“لِكُلّٖ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةٗ وَمِنْهَاجٗا” — “আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরীয়াহ ও পথনির্দেশ নির্ধারণ করেছি।” অর্থাৎ, আল্লাহ বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন যুগে উপযুক্ত বিধান দিয়েছেন — তবে সব কিতাবের মূল বার্তা একই: **আল্লাহর ইবাদত ও ন্যায়।**
“وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ” — “যদি আল্লাহ চাইতেন, তোমাদের এক জাতি বানিয়ে দিতেন।” কিন্তু তিনি এমন বৈচিত্র্য রেখেছেন যেন মানুষ একে অপরের মাধ্যমে পরীক্ষা হয় — কে সত্যে দৃঢ়, কে সৎকর্মে অগ্রগামী।
“فَٱسْتَبِقُوا۟ ٱلْخَيْرَٰتِ” — “সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করো।” ইসলামী দৃষ্টিতে প্রতিযোগিতা মানে নয় হিংসা বা লড়াই — বরং ভালো কাজ, ন্যায়, দয়া ও তাকওয়ায় এগিয়ে যাওয়া।
“إِلَى ٱللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعٗا” — “সবাই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে।” আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়াই মানবজীবনের শেষ গন্তব্য। সেখানে প্রকাশ পাবে — কে সত্যকে অনুসরণ করেছে আর কে অবহেলা করেছে।
📖 আল্লাহ বলেন — “তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী করেছেন, যাতে তিনি পরীক্ষা করেন, কে উত্তম আমল করে।” — (সূরা হূদ ১১:৭)
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করো, কারণ অচিরেই এমন ফিতনা আসবে যা অন্ধকার রাত্রির টুকরার মতো।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৮)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ পৃথিবীতে বহু জাতি, ধর্ম ও আইন রয়েছে — কিন্তু প্রকৃত সত্য একটাই — আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নির্দেশ।
- মানবতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে আল্লাহর কিতাবের অনুসরণই একমাত্র পথ।
- ইসলাম পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পরিবর্তে “সৎকর্মে প্রতিযোগিতা”র শিক্ষা দেয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৪৮):
- কুরআন সব পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা নিশ্চিত ও সংরক্ষক।
- আল্লাহর আইনই সর্বোচ্চ বিচার ও সত্যের মানদণ্ড।
- সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য।
- আল্লাহর কাছে সবাই ফিরে যাবে এবং সত্য প্রকাশ পাবে।
উপসংহার:
এই আয়াত কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও ইসলামের সর্বজনীনতাকে ঘোষণা করে।
ইসলাম সকল নবী, কিতাব ও জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও
স্পষ্ট করে দিয়েছে — **চূড়ান্ত আইন ও নির্দেশনা শুধুমাত্র কুরআনেই।**
তাই আল্লাহর নির্দেশ মেনে সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়াই মুমিন জীবনের লক্ষ্য।
📖 “فَٱسْتَبِقُوا۟ ٱلْخَيْرَٰتِۚ إِلَى ٱللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعٗا”
“সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করো,
তোমাদের সবাই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বিশেষভাবে সতর্ক করছেন — যেন তিনি বিচার ও সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে কখনো অবিশ্বাসীদের মতামত, আবেগ বা স্বার্থান্ধ প্রভাবের অনুসরণ না করেন।
“وَأَنِ ٱحْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ”
— অর্থাৎ, “তাদের মধ্যে বিচার করুন আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী।” এটি ইসলামী আইন বা শরীয়াহর মূলনীতি। আল্লাহর নির্দেশই চূড়ান্ত — কোনো ব্যক্তি, জাতি বা সংস্কৃতি নয়। নবী ﷺ-এর জন্য যেমন এটি বাধ্যতামূলক ছিল, তেমনি মুসলিম শাসক, বিচারক ও জনগণের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য।
“وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَهُمْ”
— “তাদের খেয়াল-খুশি অনুসরণ করবেন না।” অর্থাৎ, ইহুদি ও মুনাফিকরা নানা যুক্তি দিয়ে নবী ﷺ-কে প্রভাবিত করতে চাইত, যেন তিনি তাদের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সতর্ক করলেন — সত্যের বিচারে মানুষের পছন্দ বা রাজনীতি কখনো স্থান পাবে না।
“وَٱحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ”
— “সতর্ক থাকুন, তারা যেন আপনাকে বিভ্রান্ত না করে।” অর্থাৎ, এমন চেষ্টা করতে পারে যাতে আল্লাহর বাণী পরিবর্তন বা বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা হয়। ইসলাম স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে — **আল্লাহর আইনকে কখনো মানুষের স্বার্থে বিকৃত করা যাবে না।**
“فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَٱعْلَمْ ...”
— “আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, জেনে রাখুন — আল্লাহ তাদের কিছু গুনাহের কারণে শাস্তি দিতে চান।” অর্থাৎ, যারা সত্যকে অস্বীকার করে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি দিবেন। অনেক সময় মানুষের শাস্তি দুনিয়াতেই আসে — অপমান, অশান্তি ও বিভাজনের মাধ্যমে।
“وَإِنَّ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلنَّاسِ لَفَـٰسِقُونَ”
— “নিশ্চয়ই অধিকাংশ মানুষই ফাসিক।” এখানে আল্লাহ বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন — অধিকাংশ মানুষই আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করে নিজেদের ইচ্ছার অনুসরণ করে। সত্যিকার ন্যায়বিচার কেবল তারা-ই প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যারা আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে।
📖 **ইমাম কুরতুবী** বলেন — “এই আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলামী বিচারব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হওয়া হলো ফাসিকতার পরিচয়।” (তাফসীরুল কুরতুবী, ৬/২২৫)
📖 **ইবন কাসীর** বলেন — “এখানে নবী ﷺ-কে সতর্ক করা হয়েছে যাতে তিনি ইহুদিদের বা মুনাফিকদের প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী রায় দেন।” (তাফসীর ইবন কাসীর)
এই আয়াতের শিক্ষনীয় দিক:
- বিচার ও শাসনে আল্লাহর আইন সর্বোচ্চ; মানবিক মত নয়।
- অবিশ্বাসীদের প্রভাব, মিডিয়া বা সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপের কাছে নত হওয়া উচিত নয়।
- আল্লাহর আদেশ থেকে বিচ্যুতি মানুষকে বিভ্রান্তি ও শাস্তির পথে ফেলে।
- সত্যের পথে দৃঢ় থাকা নবীর আদর্শ অনুসরণ করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, আল্লাহ তাকে মানুষের কাছেও অপমানিত করবেন।” (📖 ইবন হিব্বান, হাদিস: ২৭৬)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ অনেক সমাজ আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানুষের তৈরি আইন অনুসরণ করছে।
- ন্যায়বিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন সিদ্ধান্ত হবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে।
- ফাসিক সমাজ বলতে বোঝায় — যারা আল্লাহর আদেশ জানে, কিন্তু মানে না।
উপসংহার:
এই আয়াত নবী ﷺ-এর মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে শিক্ষা দেয় —
বিচার, সিদ্ধান্ত ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে
আল্লাহর বিধানই একমাত্র মানদণ্ড।
মানুষের ইচ্ছা, স্বার্থ বা আবেগের অনুসরণ করলে সমাজে অন্যায় ছড়ায়।
আল্লাহর আইন ত্যাগকারীরা দুনিয়ায় অপমানিত ও আখিরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
📖 “وَأَنِ ٱحْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ ...
وَإِنَّ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلنَّاسِ لَفَـٰسِقُونَ”
“তুমি তাদের মধ্যে বিচার কর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী,
এবং সতর্ক থাকো যেন তারা তোমাকে বিভ্রান্ত না করে;
নিশ্চয়ই অধিকাংশ মানুষই ফাসিক।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৯)
এই আয়াত পূর্ববর্তী আয়াতের (৪৯ নম্বর) ধারাবাহিক সমাপ্তি হিসেবে নাজিল হয়েছে। এখানে আল্লাহ তাআলা এক স্পষ্ট প্রশ্নের মাধ্যমে মানবজাতিকে চিন্তা করতে আহ্বান করেছেন — **“তোমরা কোন বিচার ব্যবস্থা চাও? আল্লাহর, নাকি অজ্ঞতার যুগের?”**
“أَفَحُكْمَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَ”
— “তারা কি জাহেলিয়াতের হুকুম চায়?” এখানে **“জাহেলিয়াত”** বলতে বোঝানো হয়েছে ইসলাম-পূর্ব যুগের অজ্ঞতা, যখন মানুষ নিজের ইচ্ছা, বংশ, অর্থ ও ক্ষমতার ভিত্তিতে বিচার করত — আল্লাহর আইনকে উপেক্ষা করে। এই আয়াতের মূল বার্তা হলো: যে সমাজ আল্লাহর বিধানকে বাদ দিয়ে মানব রচিত আইন, প্রথা বা রাজনীতিকে অনুসরণ করে — সে আসলে আবার সেই অজ্ঞতার যুগে ফিরে যাচ্ছে।
📖 ইমাম ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন ত্যাগ করে অন্য আইনে বিচার চায়, সে জাহেলিয়াতের পথে চলেছে।” — *(তাফসীর ইবন কাসীর, ২/৯২)*
“وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكْمٗا”
— “আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিচারক আর কে?” এই বাক্যটি অলঙ্কারমূলক প্রশ্ন — যার উত্তর স্পষ্ট: **কেউই আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিচারক হতে পারে না।** কারণ আল্লাহই সর্বজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ ও নিরপেক্ষ। তাঁর বিধানই মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম ও ন্যায়সঙ্গত।
“لِّقَوْمٖ يُوقِنُونَ”
— “তাদের জন্য, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।” অর্থাৎ, যারা ঈমান ও ইয়াকীনে দৃঢ় — তারাই আল্লাহর বিচারব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করতে পারে। আর যারা সন্দেহে বা স্বার্থে অন্ধ, তারা মানুষের আইনকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে।
এই আয়াত কেবল ইতিহাসের নয় — আজকের আধুনিক যুগের প্রতিফলনও বটে। যখন মানুষ আল্লাহর শরীয়াহ ত্যাগ করে “মানবতাবাদ”, “গণতন্ত্র” বা “নিজস্ব আইন”-এর কথা বলে, তখন তারা আসলে সেই একই জাহেলিয়াতের ধারা পুনরুজ্জীবিত করছে।
📖 আল্লাহ বলেন — “তারা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য বিধান কামনা করছে, অথচ তাঁর চেয়ে উত্তম বিচারক আর কে হতে পারে?” — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫০)
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি কোনো সমাজের মধ্যে আল্লাহর হুকুম ব্যতীত অন্য হুকুম প্রতিষ্ঠা করে, সে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।” (📖 মুসনাদ আহমদ, হাদিস: ২৩৪৭৫)
বর্তমান যুগের উদাহরণ:
- আজ বহু মুসলিম সমাজে আল্লাহর শরীয়াহ পরিত্যক্ত — সেখানে জাহেলিয়াতের আইনই কার্যকর।
- মানব রচিত আইন কখনোই আল্লাহর হুকুমের বিকল্প হতে পারে না।
- যে জাতি আল্লাহর আইন মেনে চলে, সেই জাতিই প্রকৃত শান্তি ও ন্যায় পায়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫০):
- আল্লাহর আইনই সর্বোত্তম ও পরিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা।
- মানুষের তৈরি আইন অজ্ঞতা ও পক্ষপাতের ফসল।
- ইয়াকীন ও ঈমানের মানুষই আল্লাহর হুকুমে প্রশান্তি খুঁজে পায়।
- জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে যাওয়া মানে আল্লাহর অবাধ্যতা।
উপসংহার:
এই আয়াত মানব সভ্যতার জন্য এক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে —
আমরা কোন আইন অনুসরণ করব? আল্লাহর, না মানুষের?
ইসলাম শেখায়, **আল্লাহর হুকুমই প্রকৃত ন্যায় ও কল্যাণের নিশ্চয়তা।**
অন্য যে কোনো বিচারব্যবস্থা আল্লাহর কাছে জাহেলিয়াত হিসেবে বিবেচিত।
📖 “أَفَحُكْمَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكْمٗا لِّقَوْمٖ يُوقِنُونَ”
“তারা কি জাহেলিয়াতের হুকুম চায়?
অথচ আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিচারক আর কে হতে পারে
তাদের জন্য, যারা দৃঢ় বিশ্বাসী?”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫০)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে সতর্ক করেছেন যেন তারা বিশ্বাস ও আনুগত্যের বন্ধনে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে একীভূত না হয়। এটি কোনো ধর্মীয় বৈরিতার আহ্বান নয় — বরং **আকীদা (বিশ্বাস) ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সীমারেখা বজায় রাখার নির্দেশ।**
“لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلنَّصَـٰرَىٰٓ أَوْلِيَآءَ”
— অর্থাৎ, “ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না।” এখানে “ওলিয়া (أولياء)” শব্দটি বোঝায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রক্ষক, বা রাজনৈতিক সহযোগী — এমন সম্পর্ক, যেখানে বিশ্বাস, আনুগত্য ও সমর্থন জড়িত থাকে। ইসলাম মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, ন্যায় ও সহাবস্থানকে সমর্থন করে, কিন্তু এমন বন্ধুত্বকে নিষিদ্ধ করেছে যা মুসলমানকে ঈমানের নীতিমালা ত্যাগে প্ররোচিত করে বা শত্রুপক্ষের প্রভাবে ফেলতে পারে।
“بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٖ”
— “তারা একে অপরের বন্ধু।” অর্থাৎ, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে বিশ্বাসগত পার্থক্য থাকলেও, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতায় একত্রিত। ইতিহাসে দেখা যায় — নবী ﷺ-এর যুগে মদীনায় কিছু মুসলমান (বিশেষত মুনাফিকরা) ইহুদি ও খ্রিষ্টান নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গঠন করেছিল, যাতে তারা মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই আয়াত নাজিল হয় তাদের সতর্ক করার জন্য।
“وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُۥ مِنْهُمْ”
— “যে তাদের মধ্যে কেউকে বন্ধু বানায়, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” এটি ইসলামী সমাজব্যবস্থায় এক কঠোর সতর্কতা। কারণ, ঈমানের মৌলিক শর্ত হলো আনুগত্য কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য। এখানে ‘বন্ধু বানানো’ বলতে এমন বন্ধন বোঝানো হয়েছে, যেখানে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক আনুগত্য জড়িত — যেমন মুসলমানদের স্বার্থ ত্যাগ করে অন্য ধর্মের শত্রুদের পাশে দাঁড়ানো।
📖 আল্লাহ বলেন — “হে মুমিনগণ, তোমরা মুমিনদের বাদ দিয়ে কাফিরদেরকে বন্ধু বানিও না। যে এমন করবে, আল্লাহর কাছে তার কোনো অংশ থাকবে না।” — (সূরা আলে ইমরান ৩:২৮)
“إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ”
— “নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম জাতিকে হিদায়াত দেন না।” অর্থাৎ, যারা ঈমান ও কুফরের সীমারেখা মুছে ফেলে, তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করে। আল্লাহ তাদেরকে সত্যের পথে পরিচালিত করেন না।
এই আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা সম্পর্কে সতর্কতা:
এই আয়াতের অর্থ এই নয় যে, মুসলমানরা অমুসলিমদের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে বা বিদ্বেষ পোষণ করবে। বরং এটি বিশ্বাসের দিক থেকে আনুগত্য ও নেতৃত্বের সীমারেখা নির্ধারণ করেছে। ইসলাম শেখায় — ন্যায়, দয়া ও সহাবস্থান বজায় রেখে মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করতে হবে; কিন্তু এমন বন্ধুত্ব বা জোট করা চলবে না যা ঈমান বা ইসলামী আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আনুগত্য হতে হবে ইসলামের ভিত্তিতে।
- অমুসলিমদের সঙ্গে ন্যায়, মানবতা ও সহযোগিতা করা বৈধ, কিন্তু তাদের মতাদর্শে আত্মসাৎ হওয়া হারাম।
- আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকা মানেই প্রকৃত বন্ধুত্বের সীমা জানা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি একটি জাতির মতো হতে চায়, সে সেই জাতিরই অন্তর্ভুক্ত।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৪০৩১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫১):
- বিশ্বাস ও আনুগত্যের বন্ধন কেবল আল্লাহ ও মুমিনদের সাথে থাকা উচিত।
- ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সাথে এমন বন্ধুত্ব করা নিষিদ্ধ, যা ঈমানের সীমা অতিক্রম করে।
- অবিশ্বাসীদের নেতৃত্বে ভরসা রাখা ঈমানের ক্ষতি ডেকে আনে।
- আল্লাহর নিকট জালেম জাতি কখনো সফল হতে পারে না।
উপসংহার:
এই আয়াত মুমিনদের জন্য এক সতর্ক বার্তা —
ইসলাম ও ঈমানের সীমানা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
বন্ধুত্ব, জোট বা সহযোগিতা তখনই কল্যাণকর,
যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়,
না হলে তা ঈমানের ক্ষতি করে।
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلنَّصَـٰرَىٰٓ أَوْلِيَآءَۘ...”
“হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধু বানিও না;
তারা একে অপরের বন্ধু।
যে তাদের বন্ধু বানায়, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫১)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৫১ নম্বর) ধারাবাহিক ব্যাখ্যা। এখানে আল্লাহ তাআলা **মুনাফিকদের মানসিকতা** উন্মোচন করেছেন — যারা ঈমানের দাবিদার হলেও প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও কুফরের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে।
“فَتَرَى ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ”
— “তুমি দেখবে যাদের অন্তরে রোগ আছে।” অর্থাৎ, মুনাফিকদের হৃদয়ে ছিল ঈমানের দুর্বলতা, ভয় ও সন্দেহ। তারা বিশ্বাস করত না যে, আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দেবেন।
“يُسَـٰرِعُونَ فِيهِمْ”
— “তারা তাদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক স্থাপন করে।” অর্থাৎ, তারা মুসলমানদের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে ব্যস্ত থাকত, কারণ তারা ভয় করত মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়বে।
“يَقُولُونَ نَخْشَىٰٓ أَن تُصِيبَنَا دَآئِرَةٞ”
— “তারা বলে, আমরা আশঙ্কা করি কোনো বিপর্যয় আমাদের ওপর আসবে।” তাদের ধারণা ছিল — যদি মুসলমানরা পরাজিত হয়, তবে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা শক্তিশালী হবে, তাই তারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করেছেন, **মুনাফিকদের আনুগত্য কখনো আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর জন্য নয়, বরং স্বার্থের জন্য।** তারা প্রতিটি অবস্থায় নিরাপদ থাকতে চায় — তাই সত্য ও মিথ্যার মধ্যে দোদুল্যমান থাকে।
“فَعَسَى ٱللَّهُ أَن يَأْتِيَ بِٱلْفَتْحِ أَوْ أَمْرٖ مِّنْ عِندِهِۦ”
— “অচিরেই আল্লাহ বিজয় বা তাঁর পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ আনবেন।” এখানে “ফাতহ” বলতে বোঝানো হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের বিজয় — যেমন, বদর যুদ্ধ বা মক্কা বিজয়। আর “আমরুম মিন ‘িন্দিহি” অর্থাৎ, আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ শাস্তি, যা মুনাফিকদের কপটতাকে প্রকাশ করবে।
“فَيُصْبِحُوا۟ عَلَىٰ مَآ أَسَرُّوا۟ فِيٓ أَنفُسِهِمْ نَـٰدِمِينَ”
— “তখন তারা অনুতপ্ত হবে, যা তারা অন্তরে লুকিয়েছিল তার জন্য।” মুসলমানদের বিজয়ের পর তারা বুঝবে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং তাদের কপটতা ধ্বংস ডেকে এনেছে।
এই আয়াত শুধু ঐতিহাসিক নয় — এটি **প্রতিটি যুগের মুনাফিকদের মানসিক চিত্র** তুলে ধরে। আজও অনেক মুসলমান নামধারী ব্যক্তি ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ভাবছে এতে লাভ হবে, অথচ তারা নিজেদের ঈমান নষ্ট করছে।
📖 আল্লাহ বলেন — “তুমি কি তাদের দেখনি, যাদের অন্তরে রোগ আছে? তারা দৌড়াচ্ছে তাদের (অবিশ্বাসীদের) দিকে, বলে, আমাদের ওপর কোনো বিপদ নেমে আসতে পারে।” — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫২)
ইমাম ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, যারা দুর্বল ঈমানের কারণে ইসলাম ও কুফরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা সর্বদা উভয় দিকেই নিরাপত্তা খোঁজে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লজ্জা ও অনুতাপে পতিত হয়।”
বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপট:
- আজও এমন অনেক মুসলিম আছে, যারা ইসলামী পরিচয়ে লজ্জিত, অথচ পশ্চিমা সংস্কৃতি বা অবিশ্বাসীদের প্রভাবকে শ্রেষ্ঠ মনে করে।
- এদের মনেও একই ‘রোগ’ — আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে সন্দেহ ও ভয়।
- কিন্তু যখন ইসলাম বিজয়ী হয়, তখন তারা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫২):
- মুনাফিকদের চিহ্ন হলো — ঈমান ও কুফরের মাঝামাঝি অবস্থান।
- আল্লাহর সাহায্যে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে, না হলে ভয় ও সন্দেহ ঈমানকে দুর্বল করে দেয়।
- যারা শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিজেদের রক্ষা করতে চায়, তারা শেষ পর্যন্ত অপমানিত হয়।
- আল্লাহর বিজয় সবসময় নিশ্চিত — কেবল সময়ের ব্যাপার।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে, এবং আমানত রাখলে তা খিয়ানত করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৯)
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখাই ঈমানের আসল পরিচয়।
যারা ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে জোট গড়ে নিজেদের নিরাপদ মনে করে,
তারা নিজেদের ঈমান ধ্বংস করছে।
মুসলমানের জন্য নিরাপত্তা কেবল আল্লাহর আনুগত্যেই।
📖 “فَتَرَى ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ
يُسَـٰرِعُونَ فِيهِمْ ... فَيُصْبِحُوا۟ عَلَىٰ مَآ أَسَرُّوا۟ فِيٓ أَنفُسِهِمْ نَـٰدِمِينَ”
“যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর;
কিন্তু অচিরেই আল্লাহ বিজয় আনবেন,
তখন তারা নিজেদের লুকানো মনোভাবের জন্য অনুতপ্ত হবে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫২)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের ধারাবাহিকতা — যেখানে মুনাফিকদের মনোভাব এবং মুসলমানদের বিজয়ের পর তাদের অনুতাপ বর্ণনা করা হয়েছে।
এখানে মুসলমানদের আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ পাচ্ছে — তারা দেখবে সেইসব লোক, যারা আগে মুসলমানদের সঙ্গে মিথ্যা বন্ধুত্ব করেছিল এবং আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছিল “আমরা তোমাদেরই অংশ”, এখন তারা লজ্জিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত।
“وَيَقُولُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ ...”
— “মুমিনরা বলবে...” এই বাক্য দ্বারা বোঝানো হয়েছে মুসলমানদের বিস্ময় ও উপহাসপূর্ণ মন্তব্য। তারা দেখবে সেইসব মুনাফিক, যারা আগে গোপনে ইসলামবিরোধীদের পাশে ছিল, এখন নিজেদের অবস্থায় লজ্জিত ও অনুতপ্ত।
“أَهَـٰٓؤُلَآءِ ٱلَّذِينَ أَقْسَمُوا۟ بِٱللَّهِ جَهْدَ أَيْمَـٰنِهِمْ”
— “এরা কি তারা নয়, যারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করেছিল?” মুনাফিকরা সবসময় আল্লাহর নামে শপথ করে বলত — “আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা মুমিন।” কিন্তু বাস্তবে তারা ছিল অবিশ্বাসীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী। তাদের শপথ ছিল মিথ্যা; তারা চেয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে নিরাপদ থাকতে, আবার কাফেরদের পক্ষেও সমর্থন রাখতে। এই দ্বিমুখী নীতি ছিল মুনাফিকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
“حَبِطَتْ أَعْمَـٰلُهُمْ”
— “তাদের সব কর্ম ব্যর্থ হয়েছে।” অর্থাৎ, তাদের নামাজ, রোজা বা সাদকার মতো বাহ্যিক আমলগুলো কোনো মূল্য পাবে না, কারণ তা ঈমানবিহীন ছিল। আল্লাহ তাদের সমস্ত ভালো কাজ বাতিল করে দেবেন, কারণ তা ছিল কপটতা ও আত্মপ্রবঞ্চনার ভিত্তিতে।
📖 কুরআনের অন্য স্থানে বলা হয়েছে — “যে ব্যক্তি অবিশ্বাসে মারা যায়, তার আমল পৃথিবীতে যত ভালোই হোক, সবই ব্যর্থ হবে।” — (সূরা আল-বাকারা ২:২১৭)
“فَأَصْبَحُوا۟ خَـٰسِرِينَ”
— “তারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পরিণত হয়েছে।” অর্থাৎ, তারা দুনিয়া ও আখিরাত — উভয় জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত। দুনিয়াতে তারা লজ্জা ও অপমানে পতিত হয়েছে, আর আখিরাতে তারা পাবে কঠিন শাস্তি।
এই আয়াত আল্লাহর এক ন্যায়বিচারের ঘোষণা — যারা ঈমানকে কেবল মুখে বলে কিন্তু অন্তরে রাখে না, তারা একদিন নিজের মুখোশ খুলে ফেলতে বাধ্য হবে।
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহ মুনাফিকদের আমল কবুল করেন না, কারণ তাদের হৃদয়ে বিশ্বাস নেই।”
ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে — মুসলমানদের বিজয় হলে মুনাফিকরা নিজেদের আসল চেহারা প্রকাশ করবে, আর তখন তারা হবে অপমানিত ও পরাজিত।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- মুখের ঈমান নয়, অন্তরের ঈমানই আসল।
- যারা মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী পথে চলে, তারা শেষ পর্যন্ত লজ্জিত হবে।
- আল্লাহর কাছে আমল কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে হয়।
- মুনাফিকরা দুনিয়াতে সফল মনে হলেও, আখিরাতে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিছু করে, অথচ তাতে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, সে আল্লাহর কাছ থেকে কোনো পুরস্কার পাবে না।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪২০৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৩):
- আল্লাহ মিথ্যা ঈমান ও কপটতার আমল কবুল করেন না।
- সত্যিকারের ঈমান সবসময় পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
- মুনাফিকরা দুনিয়ার লাভ খোঁজে, কিন্তু আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- আল্লাহর হুকুম ও রাসূল ﷺ-এর আদর্শই সফলতার একমাত্র পথ।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
ঈমান মুখে নয়, হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাস ও আল্লাহর আনুগত্যে প্রকাশ পায়।
যারা দ্বিমুখী, তারা একদিন নিজেদের কপটতার ফল ভোগ করবে।
আল্লাহ মুমিনদের ঈমানকে স্থির রাখুন এবং কপটতা থেকে রক্ষা করুন।
📖 “أَهَـٰٓؤُلَآءِ ٱلَّذِينَ أَقْسَمُوا۟ بِٱللَّهِ جَهْدَ أَيْمَـٰنِهِمْ
إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْۚ حَبِطَتْ أَعْمَـٰلُهُمْ فَأَصْبَحُوا۟ خَـٰسِرِينَ”
“এরা কি তারা নয়, যারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করেছিল যে তারা তোমাদেরই সঙ্গে?
তাদের সব কর্ম ব্যর্থ হয়ে গেছে,
আর তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৩)
এই আয়াতটি ইসলাম ত্যাগকারীদের (মুরতাদদের) সম্পর্কে সতর্কবার্তা। আল্লাহ বলেন — কেউ যদি দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাতে ইসলামের কোনো ক্ষতি হবে না; বরং আল্লাহ নতুন এক সম্প্রদায় আনবেন, যারা ঈমান, প্রেম ও ত্যাগে পরিপূর্ণ হবে।
“مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِۦ”
— “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি দ্বীন থেকে ফিরে যায়।” অর্থাৎ, যারা ইসলাম ত্যাগ করে কুফরে ফিরে যায়, তারা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, বরং নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই আয়াতটি নাজিল হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন কিছু মুসলমান ইসলাম গ্রহণের পর মুনাফিকদের প্রভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিল। আল্লাহ জানিয়ে দিলেন — ইসলাম কোনো ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়; আল্লাহ সর্বদা এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যারা ঈমান ও আনুগত্যে অটল থাকবে।
“فَسَوْفَ يَأْتِي ٱللَّهُ بِقَوْمٖ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُۥٓ”
— “আল্লাহ এমন এক জাতিকে আনবেন, যাদের তিনি ভালোবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসবে।” এটি এক অনন্য বাণী 💖 — আল্লাহর প্রেম ও বান্দার প্রেমের পারস্পরিক সম্পর্কের ঘোষণা। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া মানে, তাঁর পথে আত্মনিবেদন করা এবং তাঁর আদেশে জীবন উৎসর্গ করা। 📖 ইমাম ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, আল্লাহ ইসলামের পতাকা বহন করার জন্য প্রতিটি যুগেই এক নতুন দল সৃষ্টি করবেন।” অনেকে বলেন — এই আয়াত দ্বারা **আহলে ইয়েমেন**, আবার কেউ বলেন **আহলে ফারস (ইরান)** ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা পরে ইসলামের জন্য অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করে।
“أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلْكَـٰفِرِينَ”
— “তারা মুমিনদের প্রতি বিনয়ী, কাফিরদের প্রতি দৃঢ়।” এটি প্রকৃত মুসলমানের চরিত্রের নিদর্শন। সে মুমিন ভাইদের সঙ্গে নম্র, ভালোবাসাপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল, কিন্তু সত্যের শত্রুদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও আপসহীন। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মুমিনেরা পরস্পরের প্রতি দয়া ও ভালোবাসায় এমন, যেন তারা এক দেহের অঙ্গসমূহ।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৬)
“يُجَـٰهِدُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ”
— “তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে।” অর্থাৎ, তারা আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবে — কলম, জ্ঞান, দাওয়াত, ত্যাগ ও প্রয়োজনে যুদ্ধের মাধ্যমে।
“وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَآئِمٖ”
— “তারা কোনো নিন্দাকারীর নিন্দাকে ভয় করবে না।” সত্যের পথে যারা অটল, তারা মানুষের সমালোচনা বা ভয়কে তোয়াক্কা করে না। তাদের উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি।
“ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ”
— “এটি আল্লাহর অনুগ্রহ; তিনি যাকে চান তা দান করেন।” আল্লাহর ভালোবাসা কোনো বংশ, জাতি বা সম্পদের উপর নির্ভর করে না — এটি কেবল ঈমান ও আমলের উপর নির্ভরশীল।
“وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ”
— “আল্লাহ সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ।” অর্থাৎ, আল্লাহর দয়া অসীম এবং তিনি জানেন কে সত্যিকার যোগ্য।
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- যদি কিছু মুসলমান দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাতে ইসলামের কোনো ক্ষতি নেই — আল্লাহ নতুন মানুষ সৃষ্টি করবেন।
- আল্লাহ ও বান্দার পারস্পরিক ভালোবাসাই ঈমানের প্রাণ।
- মুমিনদের প্রতি নম্রতা, আর কুফরের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা — এটি প্রকৃত মুসলমানের পরিচয়।
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও সত্যে দৃঢ় থাকা ঈমানের প্রতীক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ বলেন, আমি তাদের সঙ্গে থাকি যারা আমাকে ভালোবাসে, আমার পথে ব্যয় করে, এবং আমার সন্তুষ্টির জন্য লড়াই করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৫৩২)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৪):
- আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনই ঈমানের সর্বোচ্চ লক্ষ্য।
- যারা দ্বীন ত্যাগ করে, আল্লাহ তাদের পরিবর্তে নতুন ঈমানদার জাতি আনেন।
- মুমিনদের প্রতি দয়া ও শত্রুদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা প্রকৃত মুসলমানের গুণ।
- আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও নিন্দা উপেক্ষা করা ঈমানের চূড়ান্ত পরিচয়।
উপসংহার:
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলাম কখনো কারো ওপর নির্ভরশীল নয়।
যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, আল্লাহ তাদের স্থলে এমন মানুষ সৃষ্টি করেন
যারা তাঁকে ভালোবাসে ও তাঁর পথে ত্যাগ স্বীকার করে।
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের উপায় হলো — ঈমান, বিনয়, দৃঢ়তা ও সংগ্রাম।
📖 “يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُۥٓ
أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلْكَـٰفِرِينَ
يُجَـٰهِدُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ
وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَآئِمٖ”
“আল্লাহ এমন এক জাতিকে আনবেন যাদের তিনি ভালোবাসবেন, আর তারা তাঁকে ভালোবাসবে;
যারা মুমিনদের প্রতি বিনয়ী, কাফিরদের প্রতি দৃঢ়,
আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে এবং কোনো নিন্দাকে ভয় করবে না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৪)
এই আয়াতটি মুমিনদের প্রকৃত নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সীমা নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন — মুসলমানদের বন্ধুত্ব, নেতৃত্ব ও আনুগত্য শুধু তিন শ্রেণির জন্যই প্রযোজ্য: (১) আল্লাহ, (২) তাঁর রাসূল ﷺ, এবং (৩) সৎ মুমিনগণ।
“إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ”
— “তোমাদের ওলি (রক্ষাকারী, অভিভাবক, নেতা) কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল।” এখানে **“ওলি (وَلِيّ)”** শব্দের অর্থ কেবল বন্ধু নয় — বরং এমন ব্যক্তি যার আনুগত্য ও অনুসরণ করাটা আবশ্যক। অর্থাৎ, একজন মুসলমানের আনুগত্যের কেন্দ্র কেবল আল্লাহ ও রাসূল ﷺ। ইসলাম স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে — যে সমাজ বা ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ অমান্য করে, সে প্রকৃত নেতৃত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়।
“وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمْ رَٰكِعُونَ”
— “এবং সেই মুমিনরা, যারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয়, এবং বিনয়াবনত।” অর্থাৎ, মুমিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও নেতৃত্বের যোগ্য তারা, যারা নামাজ ও যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করে এবং বিনয় ও নম্রতায় জীবন যাপন করে।
এই আয়াতে ‘নামাজ’ ও ‘যাকাত’ একত্রে উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে, প্রকৃত ঈমান কেবল মুখের নয় — তা বাস্তব জীবনে আমল ও সমাজসেবার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
📖 ইমাম ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর পর মুসলমানদের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে ঈমান, সালাত, যাকাত ও বিনয় দ্বারা।”
এই আয়াত সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি:
কিছু তাফসীরকার বলেন, এই আয়াতটি হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছিল। একবার তিনি নামাজে রুকু অবস্থায় থাকা অবস্থায় এক গরীব ব্যক্তিকে তার আংটি সদকা করেন। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় — “যারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনয়াবনত থাকে।” (📖 তাফসীর তাবারী, ইবন কাসীর)
যদিও এই ঘটনার নির্দিষ্টতা নিয়ে মতভেদ আছে, তবে আয়াতের সাধারণ অর্থে এটি প্রযোজ্য সকল মুমিনের জন্য, যারা নামাজ ও যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর পথে থাকে।
গভীর বার্তা:
ইসলাম একটি একতাবদ্ধ সমাজের ধারণা দেয় — যেখানে বন্ধুত্ব, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের ভিত্তি হলো ঈমান, অর্থ, বংশ, জাতি বা রাজনীতি নয়।
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- বন্ধুত্ব ও নেতৃত্ব কেবল ঈমানদারদের মধ্যেই হওয়া উচিত।
- যে সমাজে নামাজ, যাকাত ও বিনয় প্রতিষ্ঠিত, সেটিই প্রকৃত ইসলামী সমাজ।
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর আনুগত্যই সকল সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
- নামাজ ও যাকাত হলো ঈমানের দুটি স্তম্ভ — এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর বন্ধু কেবল সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৫০২)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৫):
- বন্ধুত্ব ও আনুগত্য কেবল আল্লাহ, রাসূল ও প্রকৃত মুমিনদের সঙ্গে হতে পারে।
- নামাজ ও যাকাত ঈমানের প্রকাশ — তা অবহেলা করা বড় গুনাহ।
- বিনয় ও নম্রতা একজন মুমিনের চিহ্ন।
- আল্লাহর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সমাজই শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি।
উপসংহার:
এই আয়াত মুসলমানদের শেখায় —
প্রকৃত বন্ধুত্ব, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের যোগ্য তারা,
যারা আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর পথে দৃঢ় থাকে এবং নামাজ ও যাকাতের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে।
📖 “إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ
وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ
وَهُمْ رَٰكِعُونَ”
“তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই মুমিনগণ,
যারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনয়াবনত থাকে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৫)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াত (৫৫)-এর পরিপূর্ণতা — যেখানে আল্লাহ মুমিনদের জানিয়েছেন প্রকৃত বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের সম্পর্ক কার সঙ্গে হওয়া উচিত। এখন আল্লাহ এখানে ঘোষণা দিচ্ছেন — যারা আল্লাহ, রাসূল ﷺ ও ঈমানদারদেরকে নিজেদের সহায় ও অভিভাবক বানায়, তারা এক “দল” (حِزْبُ الله) — এবং এই দলই সব সময় বিজয়ী হবে।
“وَمَن يَتَوَلَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟”
— “যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে।” অর্থাৎ, যে ব্যক্তি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আল্লাহ, রাসূল ﷺ এবং মুমিন সমাজের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রকাশ করে, সে-ই আল্লাহর পক্ষের অন্তর্ভুক্ত। এই বন্ধুত্ব কেবল মুখের নয় — বরং বিশ্বাস, আনুগত্য, আদর্শ, নীতি ও জীবনধারায় প্রকাশ পেতে হবে।
“فَإِنَّ حِزْبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلْغَـٰلِبُونَ”
— “নিশ্চয়ই আল্লাহর দলই বিজয়ী।” এখানে “হিযবুল্লাহ” (حِزْبُ الله) অর্থ “আল্লাহর দল” — অর্থাৎ, তারা যারা আল্লাহর আদেশ মানে, রাসূলের অনুসরণ করে, এবং মুমিন সমাজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকে। তাদের বিজয় কখনো সংখ্যার জোরে নয়, বরং আল্লাহর সাহায্যের মাধ্যমে। 📖 আল্লাহ বলেন — “আল্লাহর সাহায্যই বিজয় এনে দেয়।” — (সূরা আল-ইমরান ৩:১২৬)
এই আয়াত এক অনন্ত সত্য ঘোষণা করে — যারা আল্লাহর পথে ঐক্যবদ্ধ, তাদের হারানোর কেউ নেই। আর যারা আল্লাহর আইন ও রাসূলের আদেশ ত্যাগ করে, তারা কখনো স্থায়ী জয় পায় না।
ইবন কাসীর বলেন — “এখানে আল্লাহর দল বলতে বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর ধর্মে দৃঢ়, রাসূল ﷺ-এর অনুসরণে অটল এবং ঈমানদারদের ভালোবাসে।” (তাফসীর ইবন কাসীর, সূরা আল-মায়েদা: ৫৬)
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হলো, আল্লাহর পথে একতাবদ্ধ মুমিন সমাজ কখনো পরাজিত হতে পারে না, যদিও দুনিয়ায় তারা সংখ্যায় কম।”
“حِزْبُ الله” — আল্লাহর দলের বৈশিষ্ট্য:
- তারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি নিঃস্বার্থ আনুগত্য প্রকাশ করে।
- তারা মুমিনদের প্রতি ভালোবাসা ও সহযোগিতায় পরিপূর্ণ।
- তারা আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও আপসহীন।
- তারা দুনিয়ার লাভের জন্য নয়, বরং আখিরাতের জন্য কাজ করে।
📖 আল্লাহ অন্যত্র বলেন — “নিশ্চয়ই আল্লাহর দলই সফলকাম।” — (সূরা আল-মুজাদিলাহ ৫৮:২২)
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- ইসলাম কখনো একা চলার ধর্ম নয়; এটি ঐক্যের ধর্ম।
- আল্লাহর দলের সদস্য হওয়া মানে — ঈমান, নীতি ও আনুগত্যে দৃঢ় থাকা।
- মুমিনদের মধ্যে ঐক্য যত বাড়বে, আল্লাহর সাহায্য তত প্রবল হবে।
- যারা আল্লাহর দলের বাইরে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর হাত (সহায়তা) সেই জামাতের উপর, আর যে জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, সে আগুনে পতিত হয়।” (📖 সহিহ তিরমিজি, হাদিস: ২১৬৭)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৬):
- আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের সঙ্গে বন্ধনই প্রকৃত আনুগত্য।
- আল্লাহর দলের সদস্যরাই প্রকৃত বিজয়ী।
- ঐক্য ও আনুগত্যের মাধ্যমেই আল্লাহর সাহায্য আসে।
- যে দল আল্লাহর আদেশ অনুসরণ করে না, তারা পরাজিত।
উপসংহার:
এই আয়াত ইসলামি সমাজের চূড়ান্ত মূলনীতি নির্ধারণ করে —
প্রকৃত শক্তি, নেতৃত্ব ও বিজয়
শুধু আল্লাহ, রাসূল ﷺ ও মুমিনদের আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত।
আল্লাহর দল কখনো পরাজিত হয় না,
কারণ তাদের সঙ্গে আছে আল্লাহর সাহায্য ও বরকত।
📖 “وَمَن يَتَوَلَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
فَإِنَّ حِزْبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلْغَـٰلِبُونَ”
“যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে —
নিশ্চয়ই আল্লাহর দলই বিজয়ী।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৬)
এই আয়াতটি মুমিনদের জন্য একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা। আল্লাহ তাআলা এখানে মুমিনদের নিষেধ করেছেন যেন তারা কখনো এমন লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন না করে, যারা ইসলামের শিক্ষাকে উপহাস করে বা মুসলমানদের ঈমানকে হাস্যরসের বিষয় বানায়।
“لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ دِينَكُمْ هُزُوٗا وَلَعِبٗا”
— “তোমরা তাদেরকে বন্ধু করো না, যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলায় পরিণত করেছে।” অর্থাৎ, এমন লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা আনুগত্যের সম্পর্ক করা নিষিদ্ধ, যারা ইসলামের বিধান, নামাজ, রোযা, হিজাব, জিহাদ ইত্যাদি নিয়ে হাসাহাসি করে। ইসলাম ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, ইসলামী চিহ্ন বা আমলকে “পুরনো প্রথা” বলা — এগুলো “হুজুওয়া ওয়া লা‘ইবা” (উপহাস ও খেলা) এর অন্তর্ভুক্ত।
“مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَـٰبَ مِن قَبْلِكُمْ وَٱلْكُفَّارَ أَوْلِيَآءَ”
— “তাদের মধ্যে যারা তোমাদের আগে কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে এবং যারা কাফির।” অর্থাৎ, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যেও এমন লোক ছিল, যারা মুসলমানদের বিশ্বাস ও ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করত। এবং সেইসাথে মক্কার মুশরিকরাও ইসলামের শত্রুতা করত। আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন — এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করা ঈমানের পরিপন্থী।
📖 আল্লাহ বলেন অন্যত্র — “যদি তোমরা এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করো, তাহলে তোমরা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫১)
“وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ”
— “আর আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা সত্যিই মুমিন হও।” এখানে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের অন্তরের ঈমানকে পরীক্ষা করছেন — যদি সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাসো ও বিশ্বাস করো, তবে তাঁর শত্রুদের ভালোবাসো না। আল্লাহভীতি (تقوى) মানে কেবল ভয় নয়; বরং আল্লাহর আদেশ মেনে চলা ও তাঁর নিষেধ থেকে বিরত থাকা।
ইমাম ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, ইসলামকে উপহাসকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করা ঈমানের শুদ্ধতাকে নষ্ট করে দেয়।”
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই নিষেধাজ্ঞা কেবল অতীত যুগের জন্য নয়, বরং সকল যুগের মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য — যারা ইসলামকে উপহাস বা অবজ্ঞা করে, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা হারাম।”
আজকের বাস্তবতা:
আজ অনেকেই ইসলামি জীবনযাপনকে “পুরনো ধারা” বা “অতিরিক্ত” বলে উপহাস করে। কেউ হিজাবকে, কেউ নামাজকে, কেউ জিহাদ বা শরিয়াহকে “বাধা” বলে হাসে। অথচ এরা নিজেদের মুসলমানও বলে দাবি করে। এই আয়াত এমন সকল মনোভাবের বিরুদ্ধেই সতর্কবার্তা।
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- ইসলামকে উপহাস করা বা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে রসিকতা করা মারাত্মক গুনাহ।
- যারা ইসলামবিদ্বেষী, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ঈমানের জন্য বিপজ্জনক।
- আল্লাহভীতি (তাকওয়া) মুমিনের আসল সুরক্ষা।
- সত্যিকারের মুমিন তার সম্পর্ক আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করে গড়ে তোলে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি কোনো জাতির মতো হতে চায়, সে সেই জাতিরই অন্তর্ভুক্ত।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৪০৩১) এবং আরও বলেছেন — “একজন মুমিন কখনো এমন কাউকে ভালোবাসে না, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ঘৃণা করে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৩৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৭):
- ইসলাম ও ধর্মীয় প্রতীক নিয়ে উপহাস করা কুফরের চিহ্ন।
- এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব বা সহমত প্রকাশ করা ঈমানের জন্য বিপদজনক।
- মুমিনদের উচিত আল্লাহভীতি ও আত্মসম্মান বজায় রাখা।
- সত্যিকারের ঈমান কখনো ইসলামবিদ্বেষীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেয় না।
উপসংহার:
এই আয়াত মুসলমানদের জানিয়ে দেয় —
ঈমান ও অবিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও উপহাস কখনো একসঙ্গে চলতে পারে না।
ইসলামকে উপহাসকারীদের সাথে সম্পর্ক রাখা মানে নিজের ঈমানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা।
তাই আল্লাহভীতি ও সততা বজায় রেখে
বন্ধুত্ব, সমাজ ও সম্পর্ক নির্ধারণ করতে হবে।
📖 “لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ دِينَكُمْ هُزُوٗا وَلَعِبٗا
مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَـٰبَ مِن قَبْلِكُمْ وَٱلْكُفَّارَ أَوْلِيَآءَۚ
وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ”
“হে মুমিনগণ! তোমরা তাদেরকে বন্ধু করো না,
যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলায় পরিণত করেছে;
আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা সত্যিই মুমিন হও।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৭)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের ধারাবাহিকতা, যেখানে ইসলামকে উপহাস ও বিদ্রূপকারীদের আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এখানে এক নির্দিষ্ট আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন — যখন মুসলমানরা আজান দেয়, তখন কিছু কাফের ও কিতাবপ্রাপ্ত লোক সেটিকে নিয়ে উপহাস করত, হাসাহাসি করত, অথবা ব্যঙ্গাত্মকভাবে পুনরাবৃত্তি করত।
“وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ”
— “যখন তোমরা নামাজের জন্য আহ্বান কর।” অর্থাৎ, যখন আজান দেওয়া হয়, যা ইসলামী সমাজে ঈমানের প্রতীক ও ঐক্যের আহ্বান।
কিন্তু সেই যুগের কিছু ইহুদি ও মুশরিকরা এই আজানকে তুচ্ছ করত, উপহাস করত, এবং “আল্লাহু আকবার” শব্দ শুনে ব্যঙ্গ করত।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতটি নাজিল হয়েছিল, যখন মদিনার কিছু আহলে কিতাব আজান শুনে ঠাট্টা করত এবং বলত: দেখো, এরা আল্লাহকে ডাকছে যেন তিনি বধির!” আল্লাহ তাআলা তাদের এই ঔদ্ধত্য ও অজ্ঞতার নিন্দা করেছেন।
“ٱتَّخَذُوهَا هُزُوٗا وَلَعِبٗا”
— “তারা এটিকে উপহাস ও খেলার বিষয় বানায়।” অর্থাৎ, নামাজ ও আজানকে তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং হাস্যরস ও ব্যঙ্গের উপাদান মনে করত। ইসলাম শত্রুরা আজও এই একই মানসিকতা বহন করে — তারা ইসলামি প্রতীক, আজান, হিজাব, নামাজ — সবকিছু নিয়ে উপহাস করে। এই আয়াত তাদের জন্যই এক চিরন্তন সতর্কবার্তা।
“ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٞ لَّا يَعْقِلُونَ”
— “এটা এই কারণে যে তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা বোঝে না।” অর্থাৎ, তারা এমন এক দল, যাদের অন্তরে ঈমান ও বোধ নেই। তারা সত্যের আলো দেখেও চিনতে পারে না। এখানে আল্লাহ জানাচ্ছেন যে — উপহাস করা কোনো যুক্তির ফল নয়, বরং অজ্ঞতার ফল। যারা সত্যকে বুঝতে চায় না, তারাই ইসলামী প্রতীকের প্রতি অসম্মান দেখায়।
📖 অন্যত্র আল্লাহ বলেন — “যখন তাদেরকে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অহংকারের কারণে।” — (সূরা আল-মুনাফিকুন ৬৩:৫)
আজানের মাহাত্ম্য:
আজান হলো ইসলামের এক অনন্য প্রতীক — এটি আল্লাহর একত্ব, নবুওয়াত, সালাত ও ঐক্যের ঘোষণা। আজানের মাধ্যমে আল্লাহর নাম ও কৃতজ্ঞতা দুনিয়ার প্রতিটি কোণে পৌঁছে যায়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন মুয়াজ্জিন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে, তখন আকাশের প্রতিটি কোণে সেই ধ্বনি পৌঁছে যায়, এবং শয়তান পালিয়ে যায়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৮৮)
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- আজান হলো ইসলামী ঐক্য ও ঈমানের প্রতীক।
- যারা আজান বা নামাজকে উপহাস করে, তারা প্রকৃত অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত।
- মুমিনদের উচিত আজানের সম্মান করা ও সাড়া দেওয়া।
- ইসলামের প্রতিটি প্রতীকের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা ঈমানের অংশ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আজান শুনে তা পুনরাবৃত্তি করে (উত্তর দেয়), তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৮৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৮):
- ইসলামী প্রতীককে উপহাস করা কুফরের লক্ষণ।
- আজান হলো ঈমান ও ইসলামী ঐক্যের ঘোষণা।
- উপহাসকারীরা বোঝার শক্তি হারিয়ে ফেলে — তারা সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত।
- মুমিনদের উচিত আল্লাহর আহ্বানে আন্তরিকভাবে সাড়া দেওয়া।
উপসংহার:
এই আয়াত ইসলামের প্রতীক ও আহ্বানের মর্যাদা তুলে ধরেছে।
যারা আজান বা নামাজকে উপহাস করে,
তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে।
আর যারা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়,
তারাই আল্লাহর নিকট সম্মানিত ও সফল।
📖 “وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ
ٱتَّخَذُوهَا هُزُوٗا وَلَعِبٗاۚ
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٞ لَّا يَعْقِلُونَ”
“যখন তোমরা নামাজের জন্য আহ্বান কর,
তখন তারা এটিকে উপহাস ও খেলার বিষয় বানায়।
এটা এই কারণে যে তারা এমন এক সম্প্রদায়,
যারা বোঝে না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী করিম ﷺ-কে নির্দেশ দিয়েছেন আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের) উদ্দেশ্যে এক যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন করতে — “তোমরা মুসলমানদের প্রতি কেন শত্রুতা করো?”
মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্বেষের কারণ ছিল না কোনো অপরাধ বা অন্যায়, বরং মুসলমানরা আল্লাহ ও সমস্ত নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস রাখে বলেই তারা ক্ষুব্ধ হতো।
“قُلْ يَـٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ هَلْ تَنقِمُونَ مِنَّآ إِلَّآ أَنْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ...”
— “বলুন, হে আহলে কিতাব! তোমরা কি কেবল এই কারণে আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছো যে আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করেছি?” এখানে একটি গভীর বার্তা আছে — সত্যিকার ঈমানদারদের প্রতি ঘৃণার মূল কারণ হলো ঈমান নিজেই। যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে, তারা সর্বদা ঈমানদারদের সহ্য করতে পারে না।
“وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلُ”
— “আমাদের প্রতি এবং আমাদের আগে যা নাজিল হয়েছে, আমরা তাতেও বিশ্বাস করি।” অর্থাৎ, মুসলমানরা শুধু কুরআনেই নয়, বরং তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুরসহ সমস্ত আল্লাহপ্রদত্ত কিতাব ও নবীদের প্রতি ঈমান রাখে। অথচ আহলে কিতাবরা নিজেদের কিতাবেই সীমাবদ্ধ ছিল, অন্য নবী ও কিতাবকে অস্বীকার করত। মুসলমানরা তাদের চেয়ে বেশি সম্পূর্ণ ঈমানদার।
📖 আল্লাহ বলেন — “আমরা কোনো নবীর মধ্যে পার্থক্য করি না।” — (সূরা আল-বাকারা ২:২৮৫)
“وَأَنَّ أَكْثَرَكُمْ فَـٰسِقُونَ”
— “অথচ তোমাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” অর্থাৎ, অধিকাংশ আহলে কিতাব সত্যকে জানে, কিন্তু অহংকার, হিংসা ও বিদ্বেষের কারণে তা অস্বীকার করে। তারা নিজেদের কিতাবে নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী জানত, তবুও তা অস্বীকার করেছে। এই বিদ্বেষই তাদের অন্তরের ফিসক (পাপাচার) ও কুফরের পরিচয়।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, যাতে তারা আহলে কিতাবদের বিদ্বেষে হতাশ না হয়। কারণ তাদের ঘৃণার কারণ অন্যায় নয়, বরং তোমাদের ঈমান।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
আজও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ইসলামবিদ্বেষের মূল কারণ — ইসলামই সত্য ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। মানুষ যখন আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে, তখন শয়তানের অনুসারীরা তাকে ঘৃণা করে। তাই মুসলমানদের উচিত ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের সাথে সত্যে অটল থাকা।
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- সত্য ও ঈমানের কারণে শত্রুতা পাওয়া নবী-রাসূলদের সুন্নাহ।
- মুমিনদের ঈমান যত দৃঢ় হবে, কুফরীদের হিংসাও তত বাড়বে।
- অন্য ধর্মের কিতাব ও নবীদের প্রতি বিশ্বাস রাখা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা।
- আল্লাহর পথে চললে ধৈর্য ও দৃঢ়তা অপরিহার্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমরা জানবে, যারা তোমাদের প্রতি সর্বাধিক শত্রুতা পোষণ করে, তারা হলো ইহুদি ও মুশরিকরা।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৬৫২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫০৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৫৯):
- আহলে কিতাবরা মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত কেবল ঈমানের কারণে।
- মুমিনদের ঈমানে দৃঢ় থাকা তাদের প্রতি শত্রুতা বাড়াতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তাদের রক্ষা করেন।
- সত্যিকারের ঈমান সব নবী ও কিতাবের প্রতি বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত করে।
- আল্লাহ পাপাচারীদের দলকে ভালোবাসেন না এবং তাদের পরিণতি ধ্বংস।
উপসংহার:
এই আয়াত মুসলমানদের শেখায় —
ঈমানের পথে বিরোধিতা আসবে, কিন্তু তা অন্যায় নয়, বরং ঈমানের পরীক্ষাই।
আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও নবী-রাসূলদের প্রতি শ্রদ্ধাই মুসলমানের পরিচয়।
বিদ্বেষ ও কটূক্তির জবাব দিতে হবে যুক্তি, নীতি ও ধৈর্যের মাধ্যমে।
📖 “قُلْ يَـٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ
هَلْ تَنقِمُونَ مِنَّآ إِلَّآ أَنْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ
وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلُ
وَأَنَّ أَكْثَرَكُمْ فَـٰسِقُونَ”
“বলুন, হে আহলে কিতাব!
তোমরা কি আমাদের প্রতি রাগ করছো কেবল এই কারণে
যে আমরা আল্লাহ ও সকল কিতাবে বিশ্বাস করেছি?
অথচ তোমাদের অধিকাংশই পাপাচারী।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৫৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (বিশেষত ইহুদিদের) প্রতি উত্তর দিচ্ছেন, যারা মুসলমানদের বিদ্রূপ ও ঘৃণা করত। আল্লাহ নবী করিম ﷺ-কে বললেন — “তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, কারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থায় আছে?”
“قُلْ هَلْ أُنَبِّئُكُم بِشَرّٖ مِّن ذَٰلِكَ مَثُوبَةً عِندَ ٱللَّهِ”
— “বলুন, আমি কি তোমাদের জানাবো কারা আল্লাহর নিকটে আরও নিকৃষ্ট অবস্থায় আছে?” অর্থাৎ, মুসলমানদের নিয়ে উপহাস করা তো একপাশে থাকুক, বরং তোমরাই তো এমন কাজ করেছো, যার জন্য আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধ তোমাদের উপর নাজিল হয়েছে।
“مَن لَّعَنَهُ ٱللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْهِ”
— “যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন এবং ক্রুদ্ধ হয়েছেন।” এখানে বোঝানো হয়েছে সেই ইহুদিদের, যারা আল্লাহর নবীদের হত্যা করেছিল, আল্লাহর বাণী বিকৃত করেছিল, এবং অহংকারে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। আল্লাহর অভিশাপ (لعنة) মানে হলো — আল্লাহর রহমত থেকে চিরবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
“وَجَعَلَ مِنْهُمُ ٱلْقِرَدَةَ وَٱلْخَنَازِيرَ”
— “যাদের মধ্যে কিছুজনকে বানর ও শূকরে পরিণত করেছেন।” এটি ঘটেছিল তাদের পাপাচার ও অবাধ্যতার ফলস্বরূপ। কুরআনে অন্যত্রও এ ঘটনা উল্লেখ রয়েছে:
📖 “তাদের মধ্যে যারা শনিবার লঙ্ঘন করেছিল, আমি তাদের বলেছিলাম — তোমরা হয়ে যাও বানর, অপমানিত।” — (সূরা আল-বাকারা ২:৬৫; সূরা আল-আ’রাফ ৭:১৬৬)
“وَعَبَدَ ٱلطَّـٰغُوتَ”
— “এবং যারা তাগুতের উপাসনা করেছে।” “তাগুত” বলতে বোঝানো হয়েছে আল্লাহ ছাড়া যাকে উপাসনা করা হয় — শয়তান, মূর্তি বা মানুষের ক্ষমতা। তারা এক আল্লাহর বদলে শয়তান ও ক্ষমতার উপাসনা শুরু করেছিল।
“أُو۟لَـٰٓئِكَ شَرّٞ مَّكَانٗا وَأَضَلُّ عَن سَوَآءِ ٱلسَّبِيلِ”
— “তারা অবস্থায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও সোজা পথ থেকে সবচেয়ে বেশি বিপথগামী।” আল্লাহ ঘোষণা দিলেন — যারা সত্য জেনে তা অস্বীকার করে, যারা নবীদের হত্যা করে, যারা আল্লাহর বানী বিকৃত করে, তারা মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশি নিকৃষ্ট।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, আহলে কিতাবদের নিজেদের অহংকারের জবাবে আল্লাহ বলছেন — তাদের পাপ ও কুফরই তাদের পতনের কারণ।”
“বানর ও শূকর” রূপান্তর — আক্ষরিক না রূপক?
তাফসীরবিদদের মধ্যে এ বিষয়ে দুই মত রয়েছে: ১️⃣ অধিকাংশ বলেন এটি **বাস্তবিক রূপান্তর (physical transformation)** — তারা সত্যিই বানর ও শূকরে পরিণত হয়েছিল, তিনদিন পর মারা যায়। ২️⃣ কিছু বলেন এটি **নৈতিক রূপান্তর (moral transformation)** — তাদের চরিত্র বানর ও শূকরের মতো লজ্জাহীন ও পাপী হয়ে গিয়েছিল। উভয় মতই ইসলামী ব্যাখ্যায় গ্রহণযোগ্য, এবং আল্লাহর ন্যায়বিচারের উদাহরণ।
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে মানুষ প্রাণীসুলভ হয়ে পড়ে — নৈতিকভাবে নিচে নেমে যায়।
- সত্য জেনেও অহংকার ও বিদ্বেষে অস্বীকার করা আল্লাহর ক্রোধকে আমন্ত্রণ জানায়।
- তাগুত বা অন্য কোনো শক্তির উপাসনা করা কুফরের বড় রূপ।
- মুমিনদের উচিত সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য ও বিনয়ে অবিচল থাকা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন কোনো জাতি প্রকাশ্যে গুনাহ করতে শুরু করে, তখন আল্লাহ তাদেরকে বিভিন্ন আকারে বিকৃত করে দেন।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪০১৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬০):
- আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধ সত্য অস্বীকারকারীদের উপর নেমে আসে।
- যারা আল্লাহর বিধানকে অবমাননা করে, তারা মানবতার নিচে নেমে যায়।
- তাগুতের উপাসনা হলো আত্মসম্মান ও ঈমান হারানোর সমান।
- সোজা পথ থেকে বিচ্যুতি মানুষকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে পতিত করে।
উপসংহার:
এই আয়াত মানব ইতিহাসের এক বড় শিক্ষা —
যারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে,
তাদের পরিণতি অপমান ও পতন।
মুসলমানদের উচিত অহংকার ত্যাগ করে বিনয়ে থাকা
এবং আল্লাহর দিশা অনুসরণ করা।
📖 “قُلْ هَلْ أُنَبِّئُكُم بِشَرّٖ مِّن ذَٰلِكَ مَثُوبَةً عِندَ ٱللَّهِۚ
مَن لَّعَنَهُ ٱللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْهِ
وَجَعَلَ مِنْهُمُ ٱلْقِرَدَةَ وَٱلْخَنَازِيرَ
وَعَبَدَ ٱلطَّـٰغُوتَۚ
أُو۟لَـٰٓئِكَ شَرّٞ مَّكَانٗا وَأَضَلُّ عَن سَوَآءِ ٱلسَّبِيلِ”
“বলুন, আমি কি তোমাদের জানাবো কারা আল্লাহর কাছে আরও নিকৃষ্ট?
তারা যাদের আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন, ক্রুদ্ধ হয়েছেন,
যাদের কিছু বানর ও শূকরে পরিণত করেছেন
এবং যারা তাগুতের উপাসনা করেছে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬০)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে মুনাফিক ও প্রতারক আহলে কিতাবদের আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তারা মুখে বলত “আমরা ঈমান এনেছি”, কিন্তু অন্তরে লুকিয়ে রাখত কুফর ও বিদ্বেষ।
“وَإِذَا جَآءُوكُمْ قَالُوٓا۟ ءَامَنَّا”
— “যখন তারা তোমাদের কাছে আসে, তারা বলে — আমরা ঈমান এনেছি।” এটি ছিল মুনাফিকদের মুখোশ। তারা নবী করিম ﷺ ও মুসলমানদের সামনে আসত, মুখে ঈমানের কথা বলত, কিন্তু অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত।
আল্লাহ তাআলা সূরা আল-বাকারা (২:৮)-এও বলেছেন — “মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’, অথচ তারা ঈমানদার নয়।”
“وَقَد دَّخَلُوا۟ بِٱلْكُفْرِ وَهُمْ قَدْ خَرَجُوا۟ بِهِۦ”
— “তারা প্রবেশ করে কুফর নিয়ে এবং একই কুফর নিয়েই বেরিয়ে যায়।” অর্থাৎ, তাদের অন্তরের অবস্থা কখনো পরিবর্তন হয় না। তারা মুসলমানদের সমাজে প্রবেশ করে ষড়যন্ত্র ও ভণ্ডামির উদ্দেশ্যে। তারা ঈমানের দাবি করে, কিন্তু অন্তরে অবিশ্বাস ও প্রতারণা বহন করে।
এই আয়াত প্রকাশ করে — ইসলামের শত্রুতা অনেক সময় লুকানো রূপে আসে। মুখে তারা মুসলমান, কিন্তু অন্তরে কুফর। এই মুনাফিকরা ইসলামী সমাজের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের বর্ণনা করেছেন যারা নবী ﷺ-এর কাছে আসত বাহ্যিকভাবে ঈমানদার রূপে, অথচ অন্তরে তারা শত্রু ছিল।”
“وَٱللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا كَانُوا۟ يَكْتُمُونَ”
— “আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন তারা যা গোপন করে।” এটি আল্লাহর এক চূড়ান্ত ঘোষণা — মানুষ বাহ্যিক আচরণ দিয়ে অন্যকে ধোঁকা দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে কিছুই গোপন নয়। তিনি অন্তরের চিন্তা, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনাও জানেন।
এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় — ইসলাম কেবল মুখের কথা নয়, বরং হৃদয়ের বিশ্বাস ও আমলের আন্তরিকতা।
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, যারা দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করে, আল্লাহ একদিন তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করবেন।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- মুখের ঈমান নয় — হৃদয়ের ঈমানই আসল।
- যারা ইসলামের নামে ভণ্ডামি করে, তারা আল্লাহর ক্রোধের যোগ্য।
- আল্লাহ সবকিছু জানেন — গোপন চিন্তাও তাঁর কাছে প্রকাশ্য।
- মুমিনদের উচিত সত্যতা, আন্তরিকতা ও সচ্চরিত্র বজায় রাখা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তুমি যদি কোনো মুনাফিককে দেখতে চাও, তবে সেই ব্যক্তিকে দেখো, যে মুখে ঈমান দাবি করে কিন্তু অন্তরে বিদ্বেষ লালন করে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৭) আরেক হাদিসে বলেছেন — “মুনাফিকের তিনটি চিহ্ন আছে: কথা বললে মিথ্যা বলে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে, এবং আমানত পেলে খিয়ানত করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬১):
- আল্লাহ অন্তরের অবস্থা জানেন — তাঁকে ধোঁকা দেওয়া যায় না।
- মুনাফিকতা ইসলাম ও সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
- সত্যিকারের ঈমান কেবল মুখের স্বীকার নয়, হৃদয়ের বিশ্বাস ও কর্মের আন্তরিকতা।
- যারা মিথ্যা ঈমান দাবি করে, তাদের আল্লাহর শাস্তি অবধারিত।
উপসংহার:
এই আয়াত মুমিনদের জন্য সতর্কবার্তা —
ঈমান কেবল মুখের কথা নয়, বরং অন্তরের বিশ্বাস ও সচ্চরিত্রের প্রকাশ।
মুনাফিকরা ইসলামের শত্রু, কারণ তারা শত্রুতাকে লুকিয়ে রাখে।
কিন্তু আল্লাহর কাছে তাদের কিছুই গোপন নয়।
📖 “وَإِذَا جَآءُوكُمْ قَالُوٓا۟ ءَامَنَّا
وَقَد دَّخَلُوا۟ بِٱلْكُفْرِ
وَهُمْ قَدْ خَرَجُوا۟ بِهِۦۚ
وَٱللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا كَانُوا۟ يَكْتُمُونَ”
“আর যখন তারা তোমাদের কাছে আসে, বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’,
অথচ তারা প্রবেশ করে কুফর নিয়ে এবং বেরিয়ে যায় কুফর নিয়েই;
আল্লাহ জানেন তারা যা গোপন করে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬১)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (বিশেষত ইহুদিদের) এক কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তারা ধর্মের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও পাপে, অবিচারে এবং অন্যায় উপার্জনে নিমগ্ন ছিল।
“وَتَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنْهُمْ”
— “তুমি তাদের অনেককে দেখবে।” অর্থাৎ, অধিকাংশ আহলে কিতাবের আচরণ এমন ছিল। তারা নামমাত্র ধর্মবিশ্বাস রাখত, কিন্তু কাজ করত সম্পূর্ণ বিপরীত।
“يُسَـٰرِعُونَ فِي ٱلْإِثْمِ وَٱلْعُدْوَٰنِ”
— “পাপ ও সীমালঙ্ঘনে দ্রুত লিপ্ত হয়।” অর্থাৎ, তারা অন্যায় ও গুনাহর কাজে তৎপর থাকত। যেমন— মিথ্যা সাক্ষ্য, চুরি, সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতি ইত্যাদি। ‘ইস্ম’ মানে পাপ এবং ‘উদওয়ান’ মানে সীমালঙ্ঘন বা অন্যের ক্ষতি করা। তারা সৎকাজে নয়, বরং অন্যায়ে প্রতিযোগিতা করত।
“وَأَكْلِهِمُ ٱلسُّحْتَ”
— “এবং হারাম উপার্জনে লিপ্ত থাকে।” “সুহ্ত” শব্দের অর্থ হচ্ছে — হারাম উপার্জন বা অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদ। ইহুদিরা ঘুষ, সুদ, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করত, এবং এটিকে বৈধ মনে করত। আল্লাহ তাআলা সূরা আল-বাকারা (২:২৭৫)-এ বলেছেন — “তারা বলে, বেচাকেনা তো সুদের মতোই।” কিন্তু আল্লাহ সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
“لَبِئْسَ مَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ”
— “তারা যা করে, তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।” আল্লাহ তাআলা কঠোরভাবে নিন্দা করছেন, কারণ তারা নিজেদের ধর্মীয় জ্ঞান ব্যবহার করত স্বার্থের জন্য, ন্যায়ের জন্য নয়। তাদের কাজ ছিল দ্বিমুখী: মুখে ধর্ম, কিন্তু কাজে অন্যায়; কথায় ঈমান, কিন্তু বাস্তবে পাপাচার।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ তাদের এমন এক সম্প্রদায়ের বর্ণনা দিয়েছেন যারা জেনে শুনে আল্লাহর অবাধ্যতা করত, এবং অন্যায়কে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করেছিল।”
ইমাম কুরতুবী বলেন — “‘সুহ্ত’ মানে কেবল হারাম সম্পদ নয়, বরং যে সম্পদে অন্যের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, সেটিও এর অন্তর্ভুক্ত।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- যে জাতি অন্যায় ও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাদের জ্ঞান ও ধর্মও তাদের উপকারে আসে না।
- ঘুষ, সুদ, জালিয়াতি ইত্যাদি আজও সমাজে “সুহ্ত” হিসেবে বিদ্যমান।
- মুমিনদের উচিত সম্পূর্ণভাবে হারাম আয় থেকে বেঁচে থাকা।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে ন্যায়বিচার ও সততার পথে থাকা জরুরি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে দেহ হারাম খাদ্যে পুষ্ট হয়, তার জন্য জান্নাত হারাম।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৫) এবং আরও বলেছেন — “যে ব্যক্তি হারাম আয় করে, তারপর তা দান করে, আল্লাহ তা কবুল করেন না।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ১৩২১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬২):
- অন্যায় ও পাপের কাজে দ্রুত লিপ্ত হওয়া ঈমানের দুর্বলতার চিহ্ন।
- হারাম উপার্জন আত্মাকে কলুষিত করে ও দোয়া কবুলে বাধা সৃষ্টি করে।
- ধর্মের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যদি মানুষ অন্যায়ে লিপ্ত হয়, তা আরও বড় গুনাহ।
- সত্যিকারের মুমিন ন্যায়, সততা ও হালাল উপার্জনে দৃঢ় থাকে।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে সতর্ক করছে —
পাপ, অন্যায় ও হারাম উপার্জনের পথে ছুটে চলা
এক জাতিকে ধ্বংস করে দেয়।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে
ন্যায়, হালাল ও তাকওয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
📖 “وَتَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنْهُمْ
يُسَـٰرِعُونَ فِي ٱلْإِثْمِ وَٱلْعُدْوَٰنِ
وَأَكْلِهِمُ ٱلسُّحْتَۚ
لَبِئْسَ مَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ”
“তুমি তাদের অনেককে দেখবে
পাপ, সীমালঙ্ঘন এবং হারাম উপার্জনে দ্রুত লিপ্ত হতে।
তারা যা করে — তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ — রাব্বানী (ধর্মপণ্ডিত) ও আহবার (আলেম) — তাদের কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেছেন।
কারণ তারা জানত তাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই পাপ করছে, অন্যায় করছে, ঘুষ ও হারাম উপার্জনে লিপ্ত, তবুও তারা তাদেরকে বাধা দিত না। বরং অনেক সময় চুপ থেকে, এমনকি কখনো সমর্থন দিত।
“لَوْلَا يَنْهَىٰهُمُ ٱلرَّبَّـٰنِيُّونَ وَٱلْأَحْبَارُ”
— “তাদের রাব্বানী ও আহবাররা কেন তাদের নিষেধ করে না?”
এখানে “রাব্বানী” বলতে বোঝানো হয়েছে — আল্লাহভীরু আলেম ও ধর্মগুরু, আর “আহবার” বলতে বোঝানো হয়েছে — বিদ্বান বা ধর্মশাস্ত্রবিদ। তারা জনগণকে সত্য শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল, কিন্তু তারা নীরব ছিল — হয়তো ভয়, স্বার্থ বা মর্যাদার কারণে।
আল্লাহর কাছে এটি ছিল বড় অপরাধ। কারণ, অন্যায় দেখে চুপ থাকা মানে অন্যায়ে অংশ নেওয়া।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমাদের মধ্যে যারা অন্যায় দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে রোধ করে; যদি না পারে, তবে জিহ্বা দিয়ে; আর যদি তাও না পারে, তবে অন্তরে ঘৃণা করুক — এটি ঈমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৯)
“عَن قَوْلِهِمُ ٱلْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ ٱلسُّحْتَ”
— “তাদের পাপাচার ও হারাম উপার্জন থেকে কেন বিরত রাখে না?” তারা মানুষকে ধর্ম শেখানোর দায়িত্বে ছিল, অথচ নিজেরাই পাপাচার ও লোভে নিমগ্ন ছিল। তারা ধর্মকে অর্থ ও ক্ষমতার হাতিয়ার বানিয়েছিল।
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে, সমাজে আলেমদের দায়িত্ব কেবল জ্ঞান বিতরণ নয়, বরং অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।
“لَبِئْسَ مَا كَانُوا۟ يَصْنَعُونَ”
— “তারা যা করে, তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।” আল্লাহ তাআলা বলছেন, নীরবতা ও উদাসীনতা পাপের মতোই নিকৃষ্ট কাজ। কারণ এর ফলে সমাজে অন্যায় ছড়িয়ে পড়ে, সত্যের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, জ্ঞানীরা যদি অন্যায় ও হারাম কর্মকাণ্ডে চুপ থাকে, তবে আল্লাহ তাদেরকেও পাপীদের সঙ্গে শাস্তি দেবেন।”
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াত সকল যুগের আলেম ও নেতাদের জন্য সতর্কবার্তা, যেন তারা সত্যকে লুকিয়ে না রাখে এবং অন্যায়ে চুপ না থাকে।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব হলো অন্যায় ও হারাম থেকে মানুষকে বিরত রাখা।
- যারা সত্য জেনে চুপ থাকে, তারা আল্লাহর নিকট দোষী।
- সমাজে দুর্নীতি ছড়ায় যখন সত্য বলা বন্ধ হয়।
- সাহসী আলেমরাই প্রকৃত আল্লাহভীরু, যারা ক্ষমতার ভয় না করে সত্য বলে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ তাঁর কিতাবের জ্ঞানীদের অভিশাপ দিয়েছেন, যারা অন্যায় দেখেও চুপ থাকে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ৩০৫৮) এবং আরও বলেছেন — “যখন মানুষ অন্যায় দেখেও তা রোধ না করে, তখন আল্লাহ তাদের সবাইকে শাস্তি দেন।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৪৩৩৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৩):
- আলেমদের দায়িত্ব সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ও অন্যায় রোধ করা।
- ধর্মীয় জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অন্যায়ে নীরব থাকা বড় পাপ।
- সত্য বলা ও পাপ থেকে বিরত রাখা ঈমানের দায়িত্ব।
- অন্যায়ে চুপ থাকা মানে অন্যায়ে অংশগ্রহণ করা।
উপসংহার:
এই আয়াত কেবল ইহুদি আলেমদের নয়,
বরং সকল যুগের ধর্মীয় নেতাদের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা।
আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন যাতে মানুষ ন্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়,
অন্যায়ে নীরব থাকে না।
আল্লাহ তাআলা সেই আলেমদের ভালোবাসেন যারা সত্য বলে,
যদিও তা তাদের জন্য কষ্টের হয়।
📖 “لَوْلَا يَنْهَىٰهُمُ ٱلرَّبَّـٰنِيُّونَ وَٱلْأَحْبَارُ
عَن قَوْلِهِمُ ٱلْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ ٱلسُّحْتَۚ
لَبِئْسَ مَا كَانُوا۟ يَصْنَعُونَ”
“তাদের আলেম ও ধর্মগুরুদের উচিত ছিল
তাদেরকে পাপাচার ও হারাম উপার্জন থেকে বিরত রাখা;
তারা যা করে, তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৩)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইহুদিদের এক গুরুতর কুফরি উক্তি ও তাদের দুষ্ট মানসিকতা প্রকাশ করেছেন।
“وَقَالَتِ ٱلْيَهُودُ يَدُ ٱللَّهِ مَغْلُولَةٌ”
— “ইহুদিরা বলেছিল — আল্লাহর হাত শৃঙ্খলাবদ্ধ।” অর্থাৎ, আল্লাহ নাকি কৃপণ, তিনি ধন-সম্পদ ব্যয় করেন না! (নাউযুবিল্লাহ) — এটি ছিল এক চরম অবমাননাকর কথা। তারা মনে করত, আল্লাহ তাদের প্রতি রিযিক সীমিত করেছেন, তাই তারা কষ্টে আছে। এটি তাদের অহংকার ও ঈমানহীনতার ফল, কারণ তারা আল্লাহর রহমত ও প্রজ্ঞাকে বুঝতে ব্যর্থ ছিল।
“غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا۟ بِمَا قَالُواۚ”
— “তাদেরই হাত শৃঙ্খলাবদ্ধ হোক এবং তারা অভিশপ্ত হোক।” আল্লাহ তাদের অভিশাপ দিলেন — অর্থাৎ, তারা নিজেরাই কৃপণতা ও সংকীর্ণতার শৃঙ্খলে বন্দি হলো। তারা হৃদয়ে সংকীর্ণ, দান ও দয়া থেকে বঞ্চিত।
“بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَآءُۚ”
— “বরং আল্লাহর দুই হাত উন্মুক্ত; তিনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করেন।” এখানে “দুই হাত” শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত — যার মানে হচ্ছে, আল্লাহ অশেষ দাতা, অসীম উদার। তাঁর রহমত, দান ও রিযিকের কোনো সীমা নেই।
📖 কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন — “যার জন্য তিনি চান রিযিক প্রশস্ত করেন, আর যাকে চান সংকুচিত করেন।” — (সূরা আল-ইসরা ১৭:৩০)
“وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرٗا مِّنْهُم مَّآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَـٰنٗا وَكُفْرٗاۚ”
— “আর তোমার প্রতি যা নাজিল হয়েছে, তা তাদের অনেকের বিদ্রোহ ও কুফর আরও বাড়িয়ে দেয়।” অর্থাৎ, কুরআনের অবতরণে তারা আরও ঈর্ষান্বিত ও বিদ্বেষপূর্ণ হয়েছিল। তারা জানত, কুরআন সত্য, কিন্তু অহংকারের কারণে তা অস্বীকার করেছিল।
“وَأَلْقَيْنَا بَيْنَهُمُ ٱلْعَدَٰوَةَ وَٱلْبَغْضَآءَ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَـٰمَةِۚ”
— “আমরা তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ নিক্ষেপ করেছি কিয়ামত পর্যন্ত।” এটি আল্লাহর এক প্রজ্ঞাপূর্ণ শাস্তি — ইহুদিরা সর্বদা নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত, দলে দলে বিভাজিত, একে অপরের শত্রু। এই অবস্থা আজও পৃথিবীতে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
“كُلَّمَآ أَوْقَدُوا۟ نَارٗا لِّلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا ٱللَّهُۚ”
— “তারা যখনই যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে, আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন।” তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু আল্লাহ তাদের প্রতিটি পরিকল্পনা ব্যর্থ করেছেন। ইসলামই টিকে গেছে, আর তাদের অহংকার ধ্বংস হয়েছে।
“وَيَسْعَوْنَ فِي ٱلْأَرْضِ فَسَادٗاۚ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلْمُفْسِدِينَ”
— “তারা পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি করতে চায়, কিন্তু আল্লাহ ফিতনাকারীদের ভালোবাসেন না।” ইহুদিদের ইতিহাস ফিতনা, প্রতারণা ও বিভেদের ইতিহাস। তারা মানবতার শত্রু হয়ে পৃথিবীতে অরাজকতা ছড়িয়েছে। কিন্তু আল্লাহ ঘোষণা করেছেন — তিনি কখনো ফাসাদ ও অন্যায়কে ভালোবাসেন না।
আল্লাহর ভালোবাসা কেবল তাকওয়াবান, সৎ, ন্যায়পরায়ণদের জন্য।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে ইহুদিদের তিনটি শাস্তি বর্ণিত হয়েছে: (১) লা’নত, (২) পারস্পরিক শত্রুতা, (৩) ফাসাদে লিপ্ততা।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহ কখনো কৃপণ নন; তিনি অশেষ দাতা ও রহমতশীল।
- যে জাতি অহংকারে আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে, তাদের পরিণতি অভিশাপ ও বিভেদ।
- ফাসাদ ও অন্যায় সৃষ্টিকারীদের আল্লাহ কখনো ভালোবাসেন না।
- আল্লাহ তাঁর প্রেরিত কিতাব ও সত্যের রক্ষক, তাই শত্রুরা যত ষড়যন্ত্র করুক, ইসলাম অম্লান থাকবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর হাত পরিপূর্ণ, তিনি দিনরাত ব্যয় করেন, কিন্তু তবুও তাঁর কোষাগার কখনো ফুরায় না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৪):
- আল্লাহ অসীম দাতা, মানুষের ধারণা সীমিত।
- অহংকার ও ঈর্ষা মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- যারা ফাসাদ সৃষ্টি করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না।
- আল্লাহর পরিকল্পনাই সর্বোত্তম — তিনি সত্যকে রক্ষা করেন।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর দানশীলতা ও ন্যায়বিচারের নিদর্শন।
যারা আল্লাহকে কৃপণ বলে অপবাদ দেয়,
তারা নিজেরাই অভিশপ্ত ও সংকীর্ণ।
আল্লাহ অশেষ রহমতশীল, দানশীল,
এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের প্রতি তাঁর ঘৃণা চিরকালীন।
📖 “وَقَالَتِ ٱلْيَهُودُ يَدُ ٱللَّهِ مَغْلُولَةٌۚ
غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا۟ بِمَا قَالُواۚ
بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ
يُنفِقُ كَيْفَ يَشَآءُۚ ... وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلْمُفْسِدِينَ”
“ইহুদিরা বলেছিল — আল্লাহর হাত শৃঙ্খলাবদ্ধ।
তাদেরই হাত শৃঙ্খলাবদ্ধ হোক ও তারা অভিশপ্ত হোক তাদের কথার জন্য!
বরং আল্লাহর দুই হাত উন্মুক্ত;
তিনি ব্যয় করেন যেভাবে ইচ্ছা করেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৪)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের) প্রতি দয়া, করুণা ও আহ্বানের কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও তারা পূর্বে আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল, তবুও আল্লাহ জানাচ্ছেন — যদি তারা ঈমান ও তাকওয়ায় ফিরে আসে, তবে তিনি তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং জান্নাত দান করবেন।
“وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ ءَامَنُوا۟ وَٱتَّقَوْا۟”
— “আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত।” এখানে “ঈমান” বলতে বোঝানো হয়েছে — নবী মুহাম্মদ ﷺ ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস। আর “তাকওয়া” মানে হলো — আল্লাহভীতি, আনুগত্য ও গুনাহ থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ, যদি তারা সত্যিকারের ঈমান ও সৎ চরিত্রে ফিরে আসত, আল্লাহ তাদের পুরনো অপরাধ ক্ষমা করে দিতেন।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর দয়ার দরজা উন্মুক্ত রেখেছেন এমনকি তাদের জন্যও যারা পূর্বে অন্যায় করেছিল।”
“لَكَفَّرْنَا عَنْهُمْ سَيِّـَٔاتِهِمْ”
— “তাহলে আমরা তাদের পাপ মোচন করতাম।” এটি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি — যে কেউ আন্তরিকভাবে ঈমান আনবে ও তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার অতীত গুনাহসমূহ মাফ করে দেন। এটি ইসলামের এক মহান নীতি — **আল্লাহর রহমত সর্বদা তওবা ও ঈমানদারদের জন্য উন্মুক্ত।**
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১)
“وَلَأَدْخَلْنَـٰهُمْ جَنَّـٰتِ ٱلنَّعِيمِ”
— “এবং আমরা তাদের প্রবেশ করাতাম অনন্দময় জান্নাতে।” অর্থাৎ, ঈমান ও তাকওয়া গ্রহণ করলে তারা শুধু দুনিয়ারই নয়, আখিরাতের সুখও লাভ করত। “জান্নাতুন নাঈম” মানে হলো — এমন জান্নাত যেখানে পরিপূর্ণ সুখ, আনন্দ ও স্থায়ী শান্তি থাকবে।
এটি আল্লাহর সর্বজনীন আহ্বান — জাতি, বংশ, ধর্ম নির্বিশেষে যে ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রহমত থেকে কোনো জাতিই বঞ্চিত নয়, যদি তারা সত্য গ্রহণ করে ও সৎ জীবনযাপন করে।”
আধুনিক শিক্ষা:
- আল্লাহর দয়া এমন যে, পূর্বের গুনাহও ঈমান দ্বারা মাফ হয়ে যায়।
- তাকওয়া হলো আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের পথ।
- জান্নাত পাওয়ার জন্য শুধু নামের বিশ্বাস নয় — বাস্তব ঈমান ও তাকওয়া প্রয়োজন।
- যে জাতি সত্য গ্রহণ করে, আল্লাহ তার জন্য রহমতের দরজা উন্মুক্ত করেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দারা! তোমরা যত গুনাহ করো না কেন, যদি আন্তরিকভাবে আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের সব গুনাহ মাফ করে দেব।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৪০)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৫):
- আল্লাহর দরজা সর্বদা খোলা থাকে তওবাকারীদের জন্য।
- ঈমান ও তাকওয়া আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের চাবি।
- অতীতের পাপ যত বড়ই হোক, আন্তরিক তওবায় মুছে যায়।
- আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সর্বদা ন্যায়বিচার ও করুণায় পূর্ণ।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর অসীম দয়ার প্রতিচ্ছবি —
তিনি এমনকি তাঁর অবাধ্য বান্দাদেরও আহ্বান জানিয়েছেন ঈমান ও তাকওয়ায় ফিরে আসার জন্য।
যারা আল্লাহভীত ও সৎ জীবন যাপন করে,
তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও পাপমোচন।
📖 “وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ
ءَامَنُوا۟ وَٱتَّقَوْا۟
لَكَفَّرْنَا عَنْهُمْ سَيِّـَٔاتِهِمْ
وَلَأَدْخَلْنَـٰهُمْ جَنَّـٰتِ ٱلنَّعِيمِ”
“যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত,
তাহলে আমরা তাদের পাপ মোচন করে দিতাম
এবং তাদের প্রবেশ করাতাম অনন্দময় জান্নাতে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের) প্রতি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যদি তারা নিজেদের কিতাব — তাওরাত, ইনজিল — এবং নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর প্রতি অবতীর্ণ কুরআনকে সত্যভাবে গ্রহণ করত, তবে আল্লাহ তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় সুখ-সমৃদ্ধি দান করতেন।
“وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ”
— “যদি তারা তাওরাত ও ইনজিল প্রতিষ্ঠা করত।” অর্থাৎ, যদি তারা তাদের কিতাবগুলিকে সঠিকভাবে মানত, তার বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করত, তাতে কোনো বিকৃতি আনত না — তাহলে তারা আল্লাহর অসীম বরকত পেত। কিন্তু তারা বরং তা বিকৃত করেছে, নিজেদের স্বার্থে আইন বদলেছে, এবং সত্যকে গোপন করেছে।
“وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ”
— “এবং যা তাদের রবের পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে।” এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কুরআনুল কারীম, যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা নিশ্চিত করে। আল্লাহ চেয়েছিলেন তারা নবী মুহাম্মদ ﷺ ও কুরআনকে গ্রহণ করুক, কিন্তু তারা অহংকার ও ঈর্ষার কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
“لَأَكَلُوا۟ مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِمۚ”
— “তাহলে তারা উপর থেকে ও পায়ের নিচ থেকে রিযিক পেত।” অর্থাৎ, আল্লাহ তাদের জন্য রিযিক, বরকত ও কল্যাণ সর্বত্র থেকে পাঠাতেন — আকাশ থেকে বৃষ্টি, পৃথিবী থেকে ফসল, জীবিকা ও শান্তি — সবকিছু আল্লাহর বরকত হিসেবে আসত।
যেমন আল্লাহ বলেন — “যদি শহরগুলোর লোকেরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমরা তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকত খুলে দিতাম।” — (সূরা আল-আ‘রাফ ৭:৯৬)
“مِّنْهُمْ أُمَّةٞ مُّقْتَصِدَةٞۖ”
— “তাদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় আছে যারা মধ্যপন্থী।” অর্থাৎ, কিছু আহলে কিতাব এমনও ছিল যারা ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী ও নৈতিকতা বজায় রাখত। তারা সম্পূর্ণ পথভ্রষ্ট হয়নি। যেমন — হযরত আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাযি.) এবং তাঁর মতো কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
“وَكَثِيرٞ مِّنْهُمْ سَآءَ مَا يَعْمَلُونَ”
— “তবে তাদের অধিকাংশই যা করে, তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।” অর্থাৎ, অধিকাংশই সত্যকে অস্বীকার করেছে, নবীদের হত্যা করেছে, কিতাব বিকৃত করেছে এবং আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেছে। তাদের দুনিয়াবী স্বার্থ, অহংকার ও জাতিগত গর্ব তাদেরকে ঈমানের আলো থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ জানিয়েছেন, যে জাতি আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করে, তারা বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।”
ইমাম কুরতুবী বলেন — “আল্লাহর বাণী প্রতিষ্ঠা করলে রিযিক আসে আকাশ থেকে ও জমিন থেকে; আর যারা বিকৃতি আনে, তাদের উপর আল্লাহর অভাব ও দুর্যোগ নাজিল হয়।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর বাণী ও বিধান প্রতিষ্ঠা করলেই সমাজে বরকত আসে।
- যারা আল্লাহর কিতাব বিকৃত করে বা অমান্য করে, তারা বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।
- সত্যিকার ন্যায়পরায়ণদের আল্লাহ কখনো ধ্বংস করেন না।
- রিযিক, শান্তি ও উন্নতির চাবিকাঠি হলো ঈমান ও তাকওয়া।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে জাতি আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী বিচার করে, তাদের মাঝে বরকত নাজিল হয়; আর যারা আল্লাহর হুকুম পরিত্যাগ করে, তাদের মাঝে ফিতনা ছড়িয়ে পড়ে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২১৬৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৬):
- আল্লাহর কিতাব ও বিধান প্রতিষ্ঠা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের কারণ।
- যে জাতি সত্য ত্যাগ করে, তাদের রিযিক ও শান্তি সঙ্কুচিত হয়।
- আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ ও মধ্যপন্থী বান্দাদের ভালোবাসেন।
- সত্যিকারের বরকত আসে আল্লাহর আনুগত্য ও সৎ আমল থেকে।
উপসংহার:
এই আয়াত এক মহা শিক্ষা দেয় —
আল্লাহর বাণী প্রতিষ্ঠা করলেই আসে বরকত, শান্তি ও উন্নতি।
কুরআনের আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপনই দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের নিশ্চয়তা।
যারা সত্যকে আঁকড়ে ধরে,
তাদের জন্য আল্লাহর রিযিক ও রহমতের দরজা চিরকাল খোলা।
📖 “وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ
وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ
لَأَكَلُوا۟ مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِمۚ
مِّنْهُمْ أُمَّةٞ مُّقْتَصِدَةٞۖ
وَكَثِيرٞ مِّنْهُمْ سَآءَ مَا يَعْمَلُونَ”
“যদি তারা তাওরাত, ইনজিল ও তাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল হয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করত,
তাহলে তারা উপর থেকে ও নিচ থেকে রিযিক পেত।
তাদের মধ্যে কিছু লোক মধ্যপন্থী,
কিন্তু অধিকাংশের কাজই নিকৃষ্ট।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৬)
এই আয়াতটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ নির্দেশ ও নিশ্চয়তা। এতে রাসূল ﷺ-কে আদেশ দেওয়া হয়েছে যেন তিনি আল্লাহর বাণী নির্ভয়ে পৌঁছে দেন, এবং আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁকে মানুষের (শত্রুদের) হাত থেকে রক্ষা করবেন।
“يَـٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ”
— “হে রাসূল! তোমার প্রতি যা নাজিল হয়েছে, তা পৌঁছে দাও।”
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক শক্তিশালী নির্দেশ: নবী ﷺ-এর দায়িত্ব কেবল বার্তা গ্রহণ নয়, বরং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া — বিনা ভয়ে, বিনা সংকোচে। নবুওয়াতের মূল দায়িত্বই হলো **“তাবলিগ”** — আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া।
“وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُۥۚ”
— “আর যদি তুমি তা না করো, তবে তুমি তাঁর বার্তা পৌঁছাওনি।”
এটি খুব কঠোর সতর্কবার্তা। অর্থাৎ, যদি রাসূল ﷺ কোনো বিষয়ে দ্বিধা করেন বা গোপন করেন (যদিও তিনি কখনোই তা করেননি), তবে বার্তাটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, নবী ﷺ কখনো আল্লাহর কোনো আদেশ গোপন করেননি; তিনি সম্পূর্ণরূপে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন।
📖 আল্লাহ বলেন — “রাসূল যা তোমাদের দিয়েছেন তা গ্রহণ করো, আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।” — (সূরা আল-হাশর ৫৯:৭)
“وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ”
— “আর আল্লাহ তোমাকে মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করবেন।”
এটি নবী ﷺ-এর জন্য এক **ঈশ্বরীয় নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি।** আল্লাহ তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন — শত্রুরা যত ষড়যন্ত্রই করুক, তাঁরা কখনো সফল হবে না। সত্যিই, নবী ﷺ-এর জীবনে অসংখ্য হত্যাচেষ্টা হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সর্বদা রক্ষা করেছেন।
📖 একবার এক ইহুদি নারী নবী ﷺ-কে বিষপ্রয়োগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৬১৭)
“إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْكَـٰفِرِينَ”
— “নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” অর্থাৎ, যারা ঈমান অস্বীকার করে, যারা সত্যের বিরোধিতা করে, তারা কখনো আল্লাহর সাহায্য ও হেদায়েত পায় না।
এই আয়াত রাসূল ﷺ-কে সাহস, দৃঢ়তা ও ঈমানের শক্তি দিয়েছে। তিনি এরপর থেকে নির্ভয়ে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন, আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখে।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত নবীর প্রতি আল্লাহর এক চূড়ান্ত নিরাপত্তা ঘোষণা; এতে নবী ﷺ-কে তাবলিগে নির্ভয়ে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে।”
ইমাম কুরতুবী বলেন — “আল্লাহ এই আয়াতের মাধ্যমে নবীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষের ভয় আল্লাহর আদেশ পালন থেকে বড় হতে পারে না।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব।
- সত্য প্রচারের পথে ভয় বা সংকোচ দেখানো উচিত নয়।
- আল্লাহ তাঁর দাওয়াতের কর্মীদের সর্বদা রক্ষা করেন।
- যারা কুফর ও অন্যায়ে লিপ্ত, তারা কখনো আল্লাহর দিকনির্দেশনা পায় না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৬১) অর্থাৎ, দাওয়াত ও প্রচার শুধু নবীদের কাজ নয় — প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব হলো সত্য বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৭):
- আল্লাহর বার্তা প্রচার করা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- আল্লাহ তাঁর রাসূল ও দাওয়াতকর্মীদের নিরাপত্তা দেন।
- ভয় ও সংকোচ সত্য প্রকাশের পথে বাধা হতে পারে না।
- কুফর ও অহংকার মানুষকে আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত করে।
উপসংহার:
এই আয়াত ইসলাম প্রচার ও দাওয়াতের ভিত্তিমূল।
এতে আল্লাহ নবী ﷺ-কে আদেশ করেছেন
তাঁর বার্তা পৌঁছে দিতে এবং আশ্বস্ত করেছেন তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে।
এটি আমাদেরও শিক্ষা দেয় যে,
সত্য কথা প্রচারে ভয় নয়, আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে।
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَۖ
وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُۥۚ
وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِۗ
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْكَـٰفِرِينَ”
“হে রাসূল! তোমার প্রতি যা নাজিল হয়েছে তা পৌঁছে দাও।
আর আল্লাহ তোমাকে মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করবেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের — অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের — সরাসরি উদ্দেশ করে বলেছেন যে, তারা সত্য ধর্মে নেই, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর কিতাব ও নির্দেশ পালন করে।
“قُلْ يَـٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ لَسْتُمْ عَلَىٰ شَيْءٍ”
— “বলো, হে আহলে কিতাব! তোমরা কোনো ভিত্তির উপর নেই।”
এটি এক কঠোর কিন্তু ন্যায়সঙ্গত ঘোষণা। অর্থাৎ, তাদের ধর্মীয় দাবি ও বাহ্যিকতা অর্থহীন, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর প্রেরিত কিতাব ও বিধান অনুসরণ করে। তারা মুখে নিজেদেরকে আল্লাহর বান্দা বলে, কিন্তু বাস্তবে তাঁর আদেশ অমান্য করত। এ কারণেই তাদের ঈমান ও আমল আল্লাহর কাছে মূল্যহীন।
“حَتَّىٰ تُقِيمُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ”
— “যতক্ষণ না তোমরা তাওরাত ও ইনজিল প্রতিষ্ঠা করো।”
অর্থাৎ, তোমরা তাওরাত ও ইনজিলের প্রকৃত শিক্ষা মানো — যেখানে স্পষ্টভাবে নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী আছে। কিন্তু তারা সেই সত্য গোপন করেছে এবং কিতাব বিকৃত করেছে। তাই আল্লাহ বললেন, যতক্ষণ না তোমরা সেই সত্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করো, তোমাদের ধর্ম কেবল নামমাত্র হবে।
“وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْۗ”
— “এবং তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল হয়েছে।”
অর্থাৎ, কুরআনুল কারীম — যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা নিশ্চিত করে এবং তাদের বিকৃতি সংশোধন করে। আল্লাহ আহলে কিতাবদের আহ্বান করেছেন যেন তারা কুরআন গ্রহণ করে, কারণ কুরআনই সত্য ও পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা।
“وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرٗا مِّنْهُم مَّآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَـٰنٗا وَكُفْرٗاۖ”
— “তোমার প্রতি তোমার রবের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা তাদের অনেকের বিদ্রোহ ও কুফর আরও বৃদ্ধি করবে।”
কুরআনের সত্য প্রমাণগুলো তাদের মনোভাব পরিবর্তন না করে, বরং আরও বিদ্বেষ ও ঈর্ষা বাড়িয়ে দেয়। তাদের হৃদয় এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহর বাণী শুনেও তারা তা অস্বীকার করত।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “যখন কুরআন আহলে কিতাবদের সম্মুখে পাঠ করা হতো, তারা ক্রোধে ও অহংকারে ফেটে পড়ত। এটাই তাদের ঈমানহীনতার প্রমাণ।”
“فَلَا تَأْسَ عَلَى ٱلْقَوْمِ ٱلْكَـٰفِرِينَ”
— “সুতরাং তুমি অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো না।”
অর্থাৎ, নবী ﷺ-কে বলা হয়েছে — তুমি তাদের জেদ ও কুফরের জন্য চিন্তিত হয়ো না। তোমার কাজ হলো বার্তা পৌঁছে দেওয়া, হেদায়েত দেওয়া নয় — তা আল্লাহর হাতে।
আল্লাহর এই বাক্য নবী ﷺ-কে সান্ত্বনা দেয়, যেন তিনি দাওয়াতের পথে শত্রুতায় হতাশ না হন।
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াত মুসলমানদেরও শিক্ষা দেয়, যে সত্য প্রচারে বাধা এলে নিরাশ হওয়া যাবে না।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- ধর্মীয় দাবির চেয়ে আল্লাহর বিধান পালনই আসল।
- যারা কুরআনের দিকনির্দেশনা মানে না, তাদের ঈমানের কোনো ভিত্তি নেই।
- দাওয়াতের পথে প্রত্যাখ্যান হবে, কিন্তু দাওয়াত থামানো যাবে না।
- আল্লাহর হেদায়েত কেবল তাদের জন্য যারা বিনয়ী ও আন্তরিক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার উদাহরণ ও তোমাদের উদাহরণ হলো সেই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালায়, আর পতঙ্গরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমিও তোমাদের আগুন থেকে দূরে টেনে আনছি, অথচ তোমরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছো।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৮৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৮):
- সত্য প্রতিষ্ঠা না করলে ধর্ম নামমাত্র হয়ে যায়।
- আল্লাহর কিতাব মানা ও অনুসরণই মুক্তির পথ।
- কুরআন প্রত্যাখ্যানকারী কখনো সঠিক পথে থাকতে পারে না।
- দাওয়াতের পথে প্রত্যাখ্যানেও নবী ﷺ ধৈর্য ও দৃঢ়তা বজায় রেখেছিলেন।
উপসংহার:
এই আয়াত আহলে কিতাবদের উদ্দেশে এক সরাসরি আহ্বান —
সত্যে ফিরে আসার ও আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী জীবন গঠনের জন্য।
এতে নবী ﷺ-কে সাহস ও দৃঢ়তা দেওয়া হয়েছে,
যেন তিনি নির্ভয়ে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান।
কুরআনই একমাত্র পথ যা মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারে।
📖 “قُلْ يَـٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ
لَسْتُمْ عَلَىٰ شَيْءٍ
حَتَّىٰ تُقِيمُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ
وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ...”
“বলো, হে আহলে কিতাব!
তোমরা কোনো সঠিক পথে নেই,
যতক্ষণ না তাওরাত, ইনজিল ও তোমাদের রবের কিতাব প্রতিষ্ঠা করো।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির প্রতি এক মহান ন্যায়বিচার ও করুণা ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে সম্মান ও মুক্তি নির্ভর করে ধর্মের নামের উপর নয় — বরং **সত্যিকারের ঈমান, পরকালীন বিশ্বাস এবং সৎকর্মের উপর।**
“إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟”
— “যারা ঈমান এনেছে” — অর্থাৎ মুসলমানরা।
“وَٱلَّذِينَ هَادُوا۟”
— “যারা ইহুদি।”
“وَٱلصَّـٰبِـُٔونَ”
— “যারা সাবীয়।” সাবীয়রা ছিলেন এমন এক সম্প্রদায় যারা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করত, কিন্তু তাদের ধর্মে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল।
“وَٱلنَّصَـٰرَىٰ”
— “যারা খ্রিষ্টান।” অর্থাৎ, যাদের মধ্যে সত্যের কিছু অবশেষ রয়ে গেছে, কিন্তু পরবর্তীতে তারা বিকৃত পথে চলে গেছে।
এরপর আল্লাহ বলেন — “مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ وَعَمِلَ صَـٰلِحٗا”
— “যে আল্লাহ ও পরকালীন দিবসে বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে।”
এই বাক্যটি বোঝায় যে, প্রকৃত মুক্তি কেবল তাদের জন্য যারা ঈমান, তাকওয়া ও আমলে সৎ। এখানে আল্লাহ মানুষের ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং **তাদের ঈমান ও কর্মের গুণমান** দিয়ে বিচার করবেন।
অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি সত্যিকারের ঈমান আনে, পরকালের জবাবদিহিতা বিশ্বাস করে এবং ন্যায় ও সৎকর্মে জীবন অতিবাহিত করে — তবে সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা, সে মুসলমান, ইহুদি, বা অন্য কিছু নামে পরিচিত হোক না কেন।
তবে এখানে শর্ত হলো — **ঈমান হতে হবে প্রকৃত ঈমান**, অর্থাৎ নবী মুহাম্মদ ﷺ-এ বিশ্বাসসহ সম্পূর্ণ তাওহীদের ভিত্তিতে।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, পূর্ববর্তী জাতিদের মধ্যেও যারা তাদের নবীর অনুসরণ করেছিল, এবং তাওহীদে দৃঢ় ছিল, তারা মুক্তি পাবে; কিন্তু নবী মুহাম্মদ ﷺ আসার পর তাঁর প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য।”
“فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ”
— “তাদের কোনো ভয় নেই, আর তারা দুঃখিতও হবে না।”
এটি আল্লাহর এক চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতি — প্রকৃত মুমিনরা নিরাপদ থাকবে, তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই শান্তি পাবে।
এই আয়াত ইসলামের সার্বজনীনতা ও মানবতার ন্যায়নীতি প্রকাশ করে। ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, এটি এক সর্বজনীন দাওয়াত — আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস এবং সৎকর্মের জীবনধারা।
ইমাম কুরতুবী বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, বরং তাদের ঈমান ও কর্মের দ্বারা মূল্যায়ন করেছেন।”
বর্তমান যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর কাছে সম্মান নির্ভর করে ঈমান, তাকওয়া ও সৎকর্মের উপর।
- যে তাওহীদের পথে ফিরে আসে, সে-ই প্রকৃত মুক্তিপ্রাপ্ত।
- ধর্মের নাম নয়, বরং আমল ও নীতিই মূল বিষয়।
- আল্লাহর রহমত সর্বজনীন, কিন্তু তা শুধুমাত্র মুমিনদের জন্য প্রযোজ্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা বংশ দেখে বিচার করবেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও কর্ম দেখবেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৬৯):
- মুক্তি পেতে হলে ঈমান, পরকালীন বিশ্বাস ও সৎকর্ম জরুরি।
- মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতা ইসলামিক চরিত্রের অংশ।
- যারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ত, তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।
- আল্লাহর বাণী জাতি, ধর্ম বা সময়ের সীমা ছাড়িয়ে সর্বজনীন।
উপসংহার:
এই আয়াত মানবজাতির প্রতি এক মহান বার্তা —
আল্লাহর নিকট প্রকৃত মর্যাদা ধর্মীয় পরিচয়ে নয়,
বরং ঈমান, সৎকর্ম ও তাকওয়ায়।
যে মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, পরকালের জন্য প্রস্তুত হয়
এবং ন্যায়নিষ্ঠ জীবন যাপন করে,
তার কোনো ভয় নেই, দুঃখও নেই।
📖 “إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
وَٱلَّذِينَ هَادُوا۟
وَٱلصَّـٰبِـُٔونَ
وَٱلنَّصَـٰرَىٰ
مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ
وَعَمِلَ صَـٰلِحٗا
فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ”
“যে আল্লাহ ও পরকালীন দিবসে বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে,
তাদের কোনো ভয় নেই, আর তারা দুঃখিতও হবে না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৬৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের (ইহুদিদের) ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তাদের প্রতি আল্লাহর অগণিত অনুগ্রহ ছিল — নবী, কিতাব ও হেদায়েত পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তারা অকৃতজ্ঞতা ও বিদ্রোহের পথে চলে গিয়েছিল।
“لَقَدْ أَخَذْنَا مِيثَـٰقَ بَنِيٓ إِسْرَٰٓءِيلَ”
— “নিশ্চয়ই আমরা বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম।”
আল্লাহ তাদের থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন — তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করবে, নবীদের অনুসরণ করবে, এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চলবে। কিন্তু তারা সেই অঙ্গীকার বারবার ভঙ্গ করেছে।
“وَأَرْسَلْنَآ إِلَيْهِمْ رُسُلٗاۖ”
— “এবং আমরা তাদের কাছে বহু নবী প্রেরণ করেছিলাম।”
আল্লাহ তাদের প্রতি একের পর এক নবী পাঠিয়েছিলেন — যেমন: হযরত মূসা (আঃ), দাউদ (আঃ), সুলাইমান (আঃ), ঈসা (আঃ) প্রমুখ। কিন্তু তারা প্রতিটি নবীর সাথে বিদ্রোহ করেছে।
“كُلَّمَا جَآءَهُمْ رَسُولُۢ بِمَا لَا تَهْوَىٰٓ أَنفُسُهُمْ”
— “যখনই তাদের কাছে এমন কোনো নবী আসতেন, যিনি তাদের মনমতো কথা বলতেন না...”
অর্থাৎ, যখন কোনো নবী তাদের অন্যায়, অহংকার বা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তখন তারা রেগে যেত, তাকে অস্বীকার করত। তারা শুধু সেই নবীদের গ্রহণ করত, যারা তাদের স্বার্থ অনুযায়ী কথা বলতেন।
“فَرِيقٗا كَذَّبُوا۟ وَفَرِيقٗا يَقْتُلُونَ”
— “তারা একদলকে মিথ্যাবাদী বলত এবং অন্য একদলকে হত্যা করত।”
এই বাক্যটি বনী ইসরাঈলের ভয়াবহ অপরাধ প্রকাশ করে। তারা শুধু নবীদের অস্বীকার করেনি, বরং হত্যা পর্যন্ত করেছে।
📖 যেমন— তারা **নবী ইয়াহইয়া (আঃ)** ও **নবী যাকারিয়া (আঃ)**-কে হত্যা করেছিল। আবার **ঈসা (আঃ)**-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, যদিও আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছিলেন।
ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াত প্রমাণ করে যে, বনী ইসরাঈলরা কেবল নবীদের অমান্য করেনি, বরং তাদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করেছে।”
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “তারা আল্লাহর আদেশে সন্তুষ্ট হতো না, বরং নিজেদের ইচ্ছা ও কামনা অনুযায়ী ধর্ম ব্যাখ্যা করত।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর বাণী নিজের ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যা করা মহাপাপ।
- যে জাতি নবীদের অবাধ্যতা করে, তারা বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।
- সত্য বলা অনেক সময় কষ্টকর, কিন্তু সত্যকে গোপন করা আল্লাহর শাস্তি ডেকে আনে।
- আল্লাহ সর্বদা ন্যায়বিচারক — নবীদের প্রতি অন্যায় চিরদিন অমার্জনীয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “বনী ইসরাঈল নবীদের পর নবী পেত। যখনই একজন নবী মৃত্যুবরণ করতেন, আরেকজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না; বরং থাকবে খলিফারা।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৫৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭০):
- বনী ইসরাঈল নবীদের প্রতি কৃতঘ্নতা দেখিয়েছিল।
- সত্যিকারের ঈমান মানে — আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলা।
- নবীদের অমান্য করা আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করার সমান।
- সত্য প্রচারকারীদের প্রতি অবিচার আজও এক ঐতিহাসিক শিক্ষা।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন,
পূর্ববর্তী জাতিদের পতনের কারণ ছিল নবীদের অমান্য করা।
আল্লাহর বিধান অমান্য করে নিজেদের মত ধর্ম বানানো
কেবল ধ্বংস ডেকে আনে।
মুসলমানদের জন্য এটি এক বড় সতর্কতা —
যেন তারা কখনো আল্লাহর বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।
📖 “لَقَدْ أَخَذْنَا مِيثَـٰقَ بَنِيٓ إِسْرَٰٓءِيلَ
وَأَرْسَلْنَآ إِلَيْهِمْ رُسُلٗاۖ
كُلَّمَا جَآءَهُمْ رَسُولُۢ بِمَا لَا تَهْوَىٰٓ أَنفُسُهُمْ
فَرِيقٗا كَذَّبُوا۟ وَفَرِيقٗا يَقْتُلُونَ”
“যখনই তাদের কাছে এমন নবী আসতেন, যিনি তাদের মনমতো কথা বলতেন না,
তারা একদলকে মিথ্যাবাদী বলত এবং অন্য একদলকে হত্যা করত।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭০)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের (ইহুদি জাতির) মানসিকতা ও অবাধ্যতার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তারা বারবার আল্লাহর নবীদের অস্বীকার করেছে, অন্যায়ে লিপ্ত হয়েছে, এবং ভেবেছে — তাদের উপর কোনো শাস্তি বা পরীক্ষা আসবে না। কিন্তু বাস্তবে তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
“وَحَسِبُوٓا۟ أَلَّا تَكُونَ فِتْنَةٞ”
— “তারা ধারণা করল যে, কোনো ফিতনা (পরীক্ষা) হবে না।”
অর্থাৎ, তারা মনে করেছিল যে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না, কারণ তারা নবীদের জাতি, আল্লাহর প্রিয় জাতি! কিন্তু এই অহংকারই তাদের ধ্বংস ডেকে এনেছে। তারা আল্লাহর পরীক্ষা ও গজবের ব্যাপারে অসচেতন ছিল।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “তারা ধারণা করেছিল যে, নবীদের হত্যা ও আল্লাহর অবাধ্যতার পরও আল্লাহ তাদের কিছু বলবেন না। অথচ এটি ছিল এক ভয়াবহ ভুল ধারণা।”
“فَعَمُوا۟ وَصَمُّوا۟”
— “তাই তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গেল।”
অর্থাৎ, তারা সত্য দেখা ও শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। তারা জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞের মতো আচরণ করল, আর আল্লাহর বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এটি শারীরিক অন্ধত্ব নয়, বরং **আত্মিক অন্ধত্ব ও হৃদয়ের বধিরতা।**
“ثُمَّ تَابَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمْ”
— “তারপর আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করলেন।”
আল্লাহ দয়ালু; তিনি তাদের প্রতি একাধিকবার দয়া করেছেন, যখন তারা তাওবা করেছে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো — তাদের তাওবা ছিল অস্থায়ী, আন্তরিক ছিল না।
“ثُمَّ عَمُوا۟ وَصَمُّوا۟ كَثِيرٞ مِّنْهُمْۚ”
— “কিন্তু তারা আবারও অনেকেই অন্ধ ও বধির হয়ে গেল।”
অর্থাৎ, ক্ষমা পাওয়ার পরও তারা পুনরায় পাপ ও বিদ্রোহে ফিরে যায়। এদের মন এতটাই কঠিন হয়ে যায় যে, আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে না।
“وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعْمَلُونَ”
— “আর আল্লাহ তাদের কাজকর্ম ভালোভাবেই দেখছেন।”
আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কিছুই গোপন নয়। যারা অবাধ্যতা করে, তিনি তাদের শাস্তি দেন; আর যারা তাওবা করে, তিনি তাদের দয়া করেন। এই বাক্যটি একদিকে সতর্কবার্তা, অন্যদিকে আশার প্রতিশ্রুতি।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহর দয়া ও শাস্তি দুটোই ফুটে উঠেছে। তিনি ক্ষমা করেন, কিন্তু বারবার পাপ করলে মানুষ হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- যে আল্লাহর গজবকে অবমূল্যায়ন করে, সে ধ্বংসের পথে চলে যায়।
- তাওবা কেবল মুখে নয় — আন্তরিকভাবে হৃদয়ে হতে হবে।
- অন্ধত্ব ও বধিরতা কেবল শরীরের নয়, আত্মারও হতে পারে।
- আল্লাহ সর্বদা দেখছেন — তাই পাপ গোপন নয়, বরং রেকর্ড হচ্ছে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন বান্দা বারবার গুনাহ করে এবং তাওবা না করে, তখন তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে। শেষে সে এমন হয় যে, আর কোনো হেদায়েত তার অন্তরে প্রবেশ করে না।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৩৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭১):
- আল্লাহর পরীক্ষা ও শাস্তিকে অবজ্ঞা করা মারাত্মক ভুল।
- আল্লাহ তাওবাকারীদের ক্ষমা করেন, কিন্তু পুনরাবৃত্তি করা পাপের জন্য মানুষ দায়ী।
- অহংকার ও গাফলত হৃদয়কে অন্ধ করে দেয়।
- আল্লাহ সর্বদা বান্দার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন — কেউ তাঁর দৃষ্টি থেকে লুকাতে পারে না।
উপসংহার:
এই আয়াত বনী ইসরাঈলের মতো প্রতিটি জাতির জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা।
আল্লাহর আদেশ অমান্য করা, সত্য গোপন করা এবং অহংকারে অন্ধ হওয়া —
এগুলো ধ্বংস ডেকে আনে।
তাওবা করে ফিরে আসা হলো একমাত্র মুক্তির পথ।
আল্লাহর দয়া অসীম, কিন্তু বারবার অবাধ্যতা মানুষকে সেই দয়া থেকে বঞ্চিত করে।
📖 “وَحَسِبُوٓا۟ أَلَّا تَكُونَ فِتْنَةٞ
فَعَمُوا۟ وَصَمُّوا۟
ثُمَّ تَابَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمْ
ثُمَّ عَمُوا۟ وَصَمُّوا۟ كَثِيرٞ مِّنْهُمْۚ
وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعْمَلُونَ”
“তারা ধারণা করল যে, কোনো পরীক্ষা হবে না,
তাই তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গেল,
তারপর আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করলেন,
কিন্তু তারা আবারও অনেকেই অন্ধ ও বধির হয়ে গেল।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭১)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটি গুরুতর ভ্রান্ত ধারণার সংশোধন করেছেন। তারা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বা নিজেই আল্লাহ বলে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু এটি স্পষ্ট কুফরি, যা তাওহীদের মূল শিক্ষার পরিপন্থী।
“لَّقَدْ كَفَرَ ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلْمَسِيحُ ٱبْنُ مَرْيَمَ”
— “যারা বলে, ‘আল্লাহই হলেন মসীহ ইবনু মারইয়াম,’ তারা নিশ্চিতভাবে কাফের হয়েছে।”
অর্থাৎ, যারা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর অংশ বা অবতার বলে মনে করে, তারা আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করছে। এটি খ্রিষ্টান ধর্মের মূল ত্রুটির দিক নির্দেশ করছে — **তাওহীদের বিকৃতি ও আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন।**
“وَقَالَ ٱلْمَسِيحُ يَـٰبَنِيٓ إِسْرَٰٓءِيلَ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمۚ”
— “আর মসীহ (ঈসা) বলেছিলেন, ‘হে বনী ইসরাঈল! আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমারও রব এবং তোমাদেরও রব।’”
এটি প্রমাণ করে যে, ঈসা (আঃ) নিজে কখনোই নিজেকে আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করেননি। বরং তিনি আল্লাহর প্রতি ইবাদতের আহ্বান করেছেন, যেমন অন্য সব নবীরা করেছেন — নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, মুহাম্মদ (আঃ)। ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত বার্তা ছিল **তাওহীদের দাওয়াত** — “শুধু আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি একমাত্র রব।”
“إِنَّهُۥ مَن يُشْرِكْ بِٱللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ ٱلْجَنَّةَ وَمَأْوَىٰهُ ٱلنَّارُ”
— “যে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন, আর তার আশ্রয় হবে আগুন।”
এটি এক চূড়ান্ত ঘোষণা — **শিরক (আল্লাহর সাথে অংশীদার করা)** এমন এক অপরাধ, যা ক্ষমার অযোগ্য যদি কেউ তাওবা না করে মৃত্যুবরণ করে। আল্লাহ বলেন — 📖 *“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করবেন না; তিনি যাকে ইচ্ছা অন্য গুনাহ ক্ষমা করবেন।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:৪৮)
“وَمَا لِلظَّـٰلِمِينَ مِنْ أَنصَارٖ”
— “আর জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।”
অর্থাৎ, যারা শিরক, কুফর ও অবাধ্যতার মাধ্যমে নিজেদের উপর জুলুম করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী থাকবে না — না ফেরেশতা, না নবী, না কেউই।
📖 ইবন কাসীর বলেন — “এই আয়াত তাওহীদের গুরুত্ব ও শিরকের ভয়াবহতা প্রকাশ করে। আল্লাহর সাথে কোনো কিছু অংশীদার করা মানে আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করা, যা চিরন্তন আগুনের কারণ।”
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “আল্লাহর একত্ব ও ঈসা (আঃ)-এর মানবিকতা — এই দুইটি বিশ্বাসই মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে মূল পার্থক্য।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ঈসা (আঃ) আল্লাহর নবী ও বান্দা — তিনি কোনোভাবেই আল্লাহ বা তাঁর পুত্র নন।
- তাওহীদ হচ্ছে সব নবীদের দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু।
- শিরক (আল্লাহর সাথে অংশীদার করা) জান্নাত থেকে বঞ্চিত করে।
- আল্লাহর একত্ব স্বীকার করলেই মুক্তি — অন্য সব পথ বিভ্রান্তি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭২):
- ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ বলা কুফরি ও শিরকের সমান।
- তাওহীদই জান্নাতের চাবিকাঠি; শিরক জান্নাত হারাম করে দেয়।
- নবীরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও দূত, কেউই তাঁর অংশ নন।
- আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ — তাওহীদ ও আন্তরিক ঈমান।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর একত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোষণা।
খ্রিষ্টানদের ভুল ধারণা যে ঈসা (আঃ) আল্লাহ —
তা কুরআনের ভাষায় সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
ঈসা (আঃ) নিজেই মানুষদের বলেছেন —
“আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমার ও তোমাদের রব।”
তাই তাওহীদই মুক্তির একমাত্র পথ,
আর শিরক হলো এমন অপরাধ, যার পরিণতি চিরন্তন আগুন।
📖 “إِنَّهُۥ مَن يُشْرِكْ بِٱللَّهِ
فَقَدْ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ ٱلْجَنَّةَ
وَمَأْوَىٰهُ ٱلنَّارُ”
“যে আল্লাহর সাথে শরীক করে,
আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন
আর তার আশ্রয় হবে আগুন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা খ্রিষ্টানদের আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস — “ত্রিত্ববাদ” (Trinity) — কে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, আল্লাহ তিনটি সত্তার সমন্বয়ে গঠিত: ১️⃣ আল্লাহ (পিতা), ২️⃣ ঈসা (পুত্র), ৩️⃣ পবিত্র আত্মা (রূহুল কুদুস)।
কিন্তু কুরআন স্পষ্ট ঘোষণা করছে — **আল্লাহ এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, কোনো ত্রিত্ব নেই।**
“لَّقَدْ كَفَرَ ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟ إِنَّ ٱللَّهَ ثَالِثُ ثَلَـٰثَةٖ”
— “যারা বলে, ‘আল্লাহ তিন জনের তৃতীয়,’ তারা অবশ্যই কাফের হয়েছে।”
এই বাক্যটি সরাসরি “Trinity”-এর বিশ্বাসকে অস্বীকার করছে। কারণ আল্লাহ একক, তাঁর কোনো অংশ, সঙ্গী বা সহোদর নেই। 📖 আল্লাহ বলেন — *“বল, তিনি আল্লাহ, একক; আল্লাহ অমুখাপেক্ষী; তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি; এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।”* — (সূরা আল-ইখলাস ১১২:১-৪)
“وَمَا مِنْ إِلَـٰهٍ إِلَّآ إِلَـٰهٞ وَٰحِدٞۚ”
— “এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।”
এখানে আল্লাহর একত্ব (তাওহীদ) পুনরায় ঘোষণা করা হয়েছে। ঈসা (আঃ) বা ফেরেশতা বা রূহুল কুদুস কারো মধ্যেই আল্লাহত্বের অংশ নেই। ইসলাম ঘোষণা করে — 🌿 *“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”* — “আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।”
“وَإِن لَّمْ يَنتَهُوا۟ عَمَّا يَقُولُونَ لَيَمَسَّنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ”
— “আর তারা যদি এই কথাবার্তা থেকে বিরত না হয়, তবে তাদের মধ্যকার কাফেরদের উপর কঠোর শাস্তি অবধারিত।”
এটি এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা — যদি তারা ত্রিত্ববাদে লিপ্ত থাকে, তবে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী পরিণতি — **জাহান্নামের শাস্তি।**
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, ঈমানের মূল শর্ত হলো আল্লাহর একত্ব স্বীকার করা। যেকোনো ধরনের শরীক স্থাপন বা বিভক্ত বিশ্বাস আল্লাহর দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ ত্রিত্ববাদী ধারণার মূলোৎপাটন করেছেন। ঈসা (আঃ), জিবরাঈল (আঃ) — কেউই আল্লাহর অংশ নয়। বরং তারা সবাই তাঁর সৃষ্টি।”
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “এই আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করলে কোনো ইবাদত, ত্যাগ বা সৎকর্ম গ্রহণযোগ্য নয়।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ত্রিত্ববাদ (Trinity) কুরআনের দৃষ্টিতে একটি মিথ্যা ধারণা।
- আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, চিরন্তন ও সর্বক্ষমতাশালী।
- কোনো সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর অংশ নেই; তিনি সকলের স্রষ্টা।
- যে আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করে, তার পরিণতি জাহান্নাম।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রাসূল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৩):
- আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় — তাঁর কোনো অংশ বা অংশীদার নেই।
- ত্রিত্ববাদ বা আল্লাহর সাথে অংশীদার করা শিরক ও কুফর।
- তাওহীদই ইসলামের কেন্দ্রীয় বার্তা।
- যারা তাওহীদ অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর একত্ব ও খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে
একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় ঘোষণা।
ইসলাম যে তাওহীদের বার্তা নিয়ে এসেছে,
তা নবীদের সমস্ত শিক্ষার মূল —
“আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরীক নেই।”
যে এই সত্য গ্রহণ করবে, তার জন্য জান্নাত;
আর যে অস্বীকার করবে, তার জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি।
📖 “لَّقَدْ كَفَرَ ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟
إِنَّ ٱللَّهَ ثَالِثُ ثَلَـٰثَةٖۘ
وَمَا مِنْ إِلَـٰهٍ إِلَّآ إِلَـٰهٞ وَٰحِدٞۚ”
“যারা বলে, আল্লাহ তিন জনের তৃতীয়, তারা কাফের হয়েছে;
অথচ এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৩)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় খ্রিষ্টান ও অন্যান্য মুশরিকদের প্রতি আল্লাহ তাআলার এক করুণ আহ্বান। যদিও তারা ত্রিত্ববাদ ও শিরকের ভয়াবহ পথে লিপ্ত, তবুও আল্লাহ তাদেরকে **তাওবার আহ্বান** জানাচ্ছেন।
“أَفَلَا يَتُوبُونَ إِلَى ٱللَّهِ”
— “তারা কি আল্লাহর দিকে তাওবা করে ফিরে আসবে না?”
আল্লাহ প্রশ্ন করছেন — তারা কি নিজেদের ভুল বুঝে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে না? যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, রিজিক দিচ্ছেন, পথ দেখাচ্ছেন — তারই দিকে ফিরে আসাই তো মুক্তির একমাত্র উপায়।
“وَيَسْتَغْفِرُونَهُۥۚ”
— “এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না?”
অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত, কারণ তিনি তাদের শিরক, কুফর, অবাধ্যতা — সবই ক্ষমা করতে পারেন, যদি তারা আন্তরিকভাবে তাওবা করে।
আল্লাহ কখনো কাউকে একবারের অপরাধে চিরদিনের জন্য দূরে ঠেলে দেন না; বরং তিনি বান্দার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকেন।
“وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ”
— “আল্লাহ তো অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
এটি আল্লাহর **রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা।** যদি কেউ হাজারো পাপ করে থাকে, তবুও আন্তরিক তাওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। 📖 কুরআনে অন্যত্র আল্লাহ বলেন — *“বল, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর সীমালঙ্ঘন করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন।”* — (সূরা আয্-যুমার ৩৯:৫৩)
এই আয়াত তাই শুধু খ্রিষ্টানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক **বিশাল বার্তা ও আশার প্রতীক।**
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহর অসীম দয়া ফুটে উঠেছে। মানুষ যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, যদি আন্তরিকভাবে ফিরে আসে, আল্লাহ তাকে গ্রহণ করবেন।”
📖 তাফসীরুস্ সা’দী-তে বলা হয়েছে — “এই আয়াত আল্লাহর মমতার চূড়ান্ত প্রমাণ। শিরক ও কুফর থেকেও তাওবা গ্রহণ করা সম্ভব, যদি তাওবা হয় আন্তরিক ও সত্যনিষ্ঠ।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর দয়া অসীম — কোনো পাপই ক্ষমার বাইরে নয়।
- শিরক থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব, যদি তাওবা করা হয় জীবিত অবস্থায়।
- মানুষ যত দূরেই চলে যাক, আল্লাহর কাছে ফিরে আসা সম্ভব।
- আল্লাহ চান না মানুষ ধ্বংস হোক; তিনি চান মানুষ ক্ষমা প্রার্থনা করুক।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তাওবা করে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মুছে দেন, যেন সে আজই জন্ম নিয়েছে।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪২৫০)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৪):
- আল্লাহ সবসময় বান্দার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকেন।
- তাওবা ও ইস্তেগফার আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা বাড়ায়।
- আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা সীমাহীন — তিনি সবকিছু মাফ করতে পারেন।
- যে তাওবা করে, আল্লাহ তার অতীতকে কল্যাণে পরিণত করেন।
উপসংহার:
এই আয়াত মানবজাতির জন্য আশার এক দ্বার উন্মুক্ত করেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেননি — “তোমরা ধ্বংস হও।”
বরং তিনি আহ্বান জানিয়েছেন —
“ফিরে এসো, ক্ষমা চাও, আমি গাফুরুর রহীম।”
তাই তাওবা হলো আল্লাহর রহমতের দ্বার,
যা কখনোই বন্ধ হয় না যতক্ষণ বান্দা জীবিত।
📖 “أَفَلَا يَتُوبُونَ إِلَى ٱللَّهِ
وَيَسْتَغْفِرُونَهُۥۚ
وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ”
“তারা কি আল্লাহর দিকে ফিরে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না?
আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৪)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন — ঈসা (আঃ) কোনো দেবতা নন, বরং আল্লাহর এক নবী ও বান্দা। তাঁর মা মরিয়ম (আঃ) ও একজন সম্মানিত, পবিত্র নারী — কিন্তু তারা উভয়েই মানুষ ছিলেন, আল্লাহ নন।
“مَّا ٱلْمَسِيحُ ٱبْنُ مَرْيَمَ إِلَّا رَسُولٞ”
— “মারইয়ামের পুত্র মসীহ তো এক রাসূল ব্যতীত আর কিছুই নন।”
অর্থাৎ, ঈসা (আঃ) আল্লাহর প্রেরিত নবীদের একজন, যেমন অন্য নবীগণ ছিলেন। তিনি আল্লাহর বান্দা, তাঁর সৃষ্টির অংশ, স্রষ্টা নন। 📖 অন্যত্র আল্লাহ বলেন — *“ঈসা তো কেবল আল্লাহর রূহ ও বানী, যা আল্লাহ মারইয়ামের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।”* — (সূরা আন্-নিসা ৪:১৭১)
“قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ ٱلرُّسُلُ”
— “তাঁর আগে অনেক রাসূল চলে গেছেন।”
অর্থাৎ, ঈসা (আঃ)-এর আগেও বহু নবী পৃথিবীতে আগমন করেছেন এবং তাঁরা সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই ঈসা (আঃ)-এর মানবতা ও মৃত্যুর বিষয়টিও স্বাভাবিক।
“وَأُمُّهُۥ صِدِّيقَةٞۖ”
— “আর তাঁর মা ছিলেন অত্যন্ত সত্যবাদী নারী।”
মরিয়ম (আঃ) ছিলেন ঈমানদার, সতী ও সত্যনিষ্ঠ নারী — আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন, কিন্তু দেবত্ব প্রদান করেননি। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“আল্লাহ মরিয়মকে সমস্ত নারীদের উপর বেছে নিয়েছেন।”* — (সূরা আলে ইমরান ৩:৪২)
“كَانَا يَأْكُلَانِ ٱلطَّعَامَۗ”
— “তারা উভয়েই আহার করতেন।”
এটি এক অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত যুক্তি — যারা খাওয়া-দাওয়া করে, তাদের পেটের প্রয়োজন আছে, তারা কখনোই আল্লাহ হতে পারে না।
আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, কিন্তু মানুষ (যেমন ঈসা ও মরিয়ম) মুখাপেক্ষী — এটি প্রমাণ করে যে তারা মানুষ, আল্লাহ নয়।
“ٱنظُرْ كَيْفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ ٱلْـَٔايَـٰتِ ثُمَّ ٱنظُرْ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ”
— “দেখো, আমরা কীভাবে তাদের কাছে নিদর্শনসমূহ স্পষ্ট করছি, তবুও দেখো, তারা কীভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে।”
আল্লাহ বলেন — আমি কত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছি যে ঈসা (আঃ) মানুষ, তবুও তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটি তাদের একগুঁয়েমি, অজ্ঞতা ও অহংকারের প্রতিফলন।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “আল্লাহ এই আয়াতে ঈসা (আঃ)-এর মানবিকতা প্রমাণ করেছেন যেন কেউ তাঁকে আল্লাহ মনে না করে। খাওয়া-দাওয়া করা, ক্লান্ত হওয়া, বিশ্রাম নেওয়া — এসব আল্লাহর নয়, মানুষের বৈশিষ্ট্য।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “আল্লাহর একত্ব বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে — কেউই তাঁর মতো নয়, এমনকি নবী ও মুমিনরাও নয়।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ঈসা (আঃ) আল্লাহর নবী ও বান্দা, তিনি কোনো দেবতা নন।
- মরিয়ম (আঃ) ছিলেন সম্মানিত, কিন্তু তিনিও মানুষ।
- যারা মানুষকে আল্লাহ বানায়, তারা যুক্তিহীন পথ অনুসরণ করে।
- আল্লাহ এক, অমুখাপেক্ষী ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার ও মরিয়মের পুত্র ঈসার মধ্যে কোনো নবী নেই, এবং যখন তিনি আসবেন, তিনি ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন, এবং জিযিয়া বাতিল করবেন।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৪৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৫):
- ঈসা (আঃ) আল্লাহর রাসূল — তিনি মানুষ ছিলেন, আল্লাহ নন।
- মরিয়ম (আঃ) ছিলেন সত্যবাদী নারী, আল্লাহর পবিত্র বান্দী।
- খাওয়া-দাওয়া করা মানুষিক বৈশিষ্ট্য; এটি প্রমাণ করে ঈসা ও মরিয়ম মানুষ।
- আল্লাহর নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করা হলো বিভ্রান্তির চূড়ান্ত পর্যায়।
উপসংহার:
এই আয়াত মানবজাতিকে স্পষ্টভাবে শেখায় —
নবীদের মর্যাদা স্বীকার করো, কিন্তু তাঁদের আল্লাহ বানিও না।
ঈসা (আঃ) ও মরিয়ম (আঃ) আল্লাহর সম্মানিত বান্দা,
তবে তাঁরা মানুষ, স্রষ্টা নন।
আল্লাহ একক, তিনি অমুখাপেক্ষী ও অদ্বিতীয়।
📖 “مَّا ٱلْمَسِيحُ ٱبْنُ مَرْيَمَ إِلَّا رَسُولٞ
قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ ٱلرُّسُلُۖ
وَأُمُّهُۥ صِدِّيقَةٞۖ
كَانَا يَأْكُلَانِ ٱلطَّعَامَۗ”
“মারইয়ামের পুত্র মসীহ এক রাসূল ব্যতীত আর কিছুই নন;
তাঁর মা ছিলেন সত্যবাদী নারী, তারা উভয়েই আহার করতেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সরাসরি নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি খ্রিষ্টান ও মুশরিকদের প্রশ্ন করেন — তোমরা কি এমন সত্ত্বার উপাসনা করছো, যারা নিজেরাও কিছু করতে সক্ষম নয়?
এটি এক **যুক্তিনির্ভর চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবাদ**, যা মানুষকে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
“قُلْ أَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرّٗا وَلَا نَفْعٗاۚ”
— “বলুন, তোমরা কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কিছুর ইবাদত করছো, যা তোমাদের কোনো ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না?”
অর্থাৎ, ঈসা (আঃ), মরিয়ম (আঃ), বা কোনো মূর্তি, ফেরেশতা বা মানুষ — কেউই নিজের ক্ষমতায় কারো ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। তারা সবাই আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা; তাদের ক্ষমতা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। 📖 কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন — *“যারা তোমরা আল্লাহ ছাড়া আহ্বান করো, তারা নিজেদের জন্যও কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না।”* — (সূরা ইউনুস ১০:১০৬)
অর্থাৎ, কোনো মানুষ, নবী বা ফেরেশতা কখনোই আল্লাহর মতো সার্বভৌম ক্ষমতাধর হতে পারে না।
“وَٱللَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ”
— “অথচ আল্লাহই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের ডাকে, প্রার্থনায় ও অন্তরের কথায় সর্বদা অবগত। তিনি প্রতিটি বান্দার কথা শোনেন, প্রতিটি চাহিদা জানেন। তাই অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া অযৌক্তিক — কারণ আল্লাহ একাই যথেষ্ট।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “আল্লাহ এই আয়াতে মানুষকে যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন — যে কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, তা কিভাবে উপাস্য হতে পারে?”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “আল্লাহর একত্বের অন্যতম নিদর্শন হলো — উপকার ও অনিষ্ট একমাত্র তাঁর হাতেই। সৃষ্টির কোনো শক্তিই আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কার্যকর নয়।”
এই আয়াতের মূল বার্তা: ইসলাম যুক্তির ধর্ম। কুরআন মানুষকে বলে — “চিন্তা করো, কাকে তুমি ডেকেছো? সে কি তোমাকে শুনতে বা সাহায্য করতে পারে?” এটি এক গভীর প্রশ্ন, যা মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত করে সত্যের পথে আনে।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- কোনো মানুষ, নবী বা সাধু উপাস্য নয় — আল্লাহই একমাত্র ইলাহ।
- যে কিছুর নিজেরই শক্তি নেই, তার কাছে সাহায্য চাওয়া বোকামি।
- আল্লাহই প্রকৃত শ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী; তাঁর নিকটই দোয়া কবুল হয়।
- তাওহীদ হলো মুক্তি ও মানসিক শান্তির মূল চাবিকাঠি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন তুমি কিছু চাও, আল্লাহর কাছেই চাও; আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করো, আল্লাহর কাছেই করো।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৬)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৬):
- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করা শিরক।
- আল্লাহই একমাত্র উপকারকারী ও ক্ষতিকারী ক্ষমতার অধিকারী।
- তাওহীদই মানবতার মুক্তির পথ।
- আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ — তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেই যথেষ্ট।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে যুক্তির মাধ্যমে আহ্বান করেছেন —
তোমরা কেন এমন কিছুর উপাসনা করো,
যা নিজের জন্যও কিছু করতে পারে না?
আল্লাহই একমাত্র শ্রবণকারী ও জ্ঞানবান;
তিনি সব দেখেন, সব জানেন, সব পারেন।
তাই প্রকৃত ইবাদত কেবল তাঁরই প্রাপ্য।
📖 “قُلْ أَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ
مَا لَا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرّٗا وَلَا نَفْعٗاۚ
وَٱللَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ”
“বলুন, তোমরা কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কিছুর ইবাদত করছো,
যা তোমাদের কোনো ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না?
অথচ আল্লাহই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি **আহলে কিতাব** — অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সতর্ক করেন। তারা তাদের ধর্মে এমন সীমা অতিক্রম করেছিল যা সত্য, ন্যায় ও তাওহীদের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
“لَا تَغْلُوا۟ فِي دِينِكُمْ غَيْرَ ٱلْحَقِّ”
— “তোমরা তোমাদের ধর্মে সীমা অতিক্রম করো না সত্যের বাইরে।”
এখানে “غُلُوّ” (*গুলু*) শব্দের অর্থ হলো — **অতিরিক্ততা, বাড়াবাড়ি বা চরমপন্থা।**
অর্থাৎ, তারা তাদের নবীদের সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রশংসা করতে গিয়ে তাদের দেবতার পর্যায়ে উন্নীত করেছে। বিশেষত খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে “আল্লাহর পুত্র” বা “আল্লাহ” বলে দাবি করেছে, যা তাওহীদের পরিপন্থী। 📖 আল্লাহ অন্যত্র বলেন — *“হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের ধর্মে বাড়াবাড়ি করো না, এবং আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ছাড়া কিছু বলো না।”* — (সূরা আন্-নিসা ৪:১৭১)
“وَلَا تَتَّبِعُوٓا۟ أَهْوَآءَ قَوْمٖ قَدْ ضَلُّوا۟ مِن قَبْلُ”
— “এবং এমন এক জাতির খেয়াল-খুশি অনুসরণ করো না যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে।”
অর্থাৎ, তোমরা এমন লোকদের পথ অনুসরণ করো না যারা নিজেদের কামনা, ইচ্ছা ও পক্ষপাতকে ধর্মে মিশিয়ে দিয়েছিল। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের অনেকেই ধর্মকে বিকৃত করেছে — তারা আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করেছে নিজেদের সুবিধার জন্য।
“وَأَضَلُّوا۟ كَثِيرٗا وَضَلُّوا۟ عَن سَوَآءِ ٱلسَّبِيلِ”
— “তারা অনেককেই বিপথে নিয়েছে, এবং নিজেরাও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।”
এটি এমন এক জাতির বর্ণনা যারা শুধু নিজেরাই বিপথগামী হয়নি, বরং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করেছে। তারা নবীদের হত্যা করেছে, আল্লাহর বাণী বিকৃত করেছে, এবং আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করেছে।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াত মুসলমানদেরও সতর্ক করছে — যাতে তারা ধর্মে কোনো বাড়াবাড়ি না করে, যেমন পূর্ববর্তী জাতিরা করেছিল।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “গুলু (অতিরিক্ততা) হলো এমন একটি পথ, যা সত্যকে বিকৃত করে কুসংস্কারে পরিণত করে। ধর্মে সংযমই হলো হেদায়েত।”
ধর্মে ‘গুলু’ (অতিরিক্ততা) এর উদাহরণ:
- নবীদের দেবতা বা অলৌকিক শক্তিধর বলে মনে করা।
- আল্লাহর আদেশে নতুন কিছু যোগ করা বা পরিবর্তন করা।
- অন্যদের অন্ধভাবে অনুসরণ করা, কুরআন-সুন্নাহর আলো ছাড়াই।
- ধর্মে চরমপন্থা অবলম্বন করা বা উদাসীন হয়ে পড়া।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ধর্মে সংযম ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ইসলামের নীতি।
- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর সীমা অতিক্রম করা গুনাহ।
- ধর্মে অতিরঞ্জন বা উদাসীনতা — উভয়ই বিপদজনক।
- ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো কুরআনের মূল শিক্ষা বিকৃত করা থেকে সাবধান থাকা জরুরি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সাবধান! তোমরা তোমাদের ধর্মে বাড়াবাড়ি করো না, কারণ তোমাদের আগে যারা ছিল, তারা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৩০২৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৭):
- ধর্মে সত্য ও সংযম বজায় রাখা ফরজ।
- অতিরিক্ততা বা অবহেলা — উভয়ই বিপথের কারণ।
- আহলে কিতাবদের ভুল পুনরাবৃত্তি করা থেকে বাঁচতে হবে।
- আল্লাহর নির্দেশ ও নবীর সুন্নাহই হলো মধ্যপন্থার পথ।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেছেন —
ধর্মে বাড়াবাড়ি করো না, নিজের মনগড়া পথ অনুসরণ করো না।
অতিরিক্ততা ও বিকৃতি পূর্ববর্তী জাতিদের ধ্বংস করেছে,
তাই মুসলমানদের জন্য শিক্ষা হলো —
সত্যকে মধ্যপন্থায়, সংযমে ও আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ধারণ করা।
📖 “لَا تَغْلُوا۟ فِي دِينِكُمْ غَيْرَ ٱلْحَقِّ
وَلَا تَتَّبِعُوٓا۟ أَهْوَآءَ قَوْمٖ
قَدْ ضَلُّوا۟ مِن قَبْلُ
وَأَضَلُّوا۟ كَثِيرٗا
وَضَلُّوا۟ عَن سَوَآءِ ٱلسَّبِيلِ”
“তোমরা তোমাদের ধর্মে সীমা অতিক্রম করো না সত্যের বাইরে,
এবং এমন এক জাতির খেয়াল-খুশি অনুসরণ করো না
যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে,
অনেককেই বিভ্রান্ত করেছে,
এবং সঠিক পথ থেকে নিজেদেরও দূরে সরিয়েছে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের এক কঠিন পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা আল্লাহর নবীদের অবাধ্যতা করেছিল, তাদের শিক্ষাকে বিকৃত করেছিল, এমনকি আল্লাহর রাসূলদের হত্যা পর্যন্ত করেছিল। তাই আল্লাহ তাদেরকে **দাউদ (আঃ)** ও **ঈসা (আঃ)**-এর মুখে অভিশাপ দিয়েছেন।
“لُعِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنۢ بَنِيٓ إِسْرَـٰٓءِيلَ”
— “বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরি করেছিল, তারা অভিশপ্ত হয়েছে।”
এখানে “লু‘ইনা” (لُعِنَ) অর্থ — **আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া**। অর্থাৎ, আল্লাহ তাদের দয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তাদের অবাধ্যতা ও কুফরির কারণে।
“عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُۥدَ وَعِيسَى ٱبْنِ مَرْيَمَ”
— “দাউদ ও মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আঃ)-এর জবান দ্বারা।”
অর্থাৎ, এই অভিশাপ উচ্চারণ করেছেন আল্লাহর দুই নবী — দাউদ (আঃ) ও ঈসা (আঃ)। তারা আল্লাহর নির্দেশে তাদের জাতির মন্দকর্ম, জুলুম ও বিদ্রোহের কারণে তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ ঘোষণা করেছিলেন। 📖 হাদীসে এসেছে — *দাউদ (আঃ) ও ঈসা (আঃ) উভয়েই তাদের জাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যখন তারা অন্যায় ও পাপাচারে ডুবে গিয়েছিল।* — (তাফসীর ইবন কাসীর)
“ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا۟ وَكَانُوا۟ يَعْتَدُونَ”
— “এটি এজন্য যে, তারা অবাধ্যতা করত এবং সীমালঙ্ঘন করত।”
অর্থাৎ, তাদের অভিশপ্ত হওয়ার মূল কারণ হলো — ১️ আল্লাহর আদেশ অমান্য করা, ২️ অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন করা, ৩️ ধর্মে বিকৃতি আনা, ৪️ নবীদের অবমাননা করা। তারা কেবল গুনাহ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং বারবার অনুশোচনা ছাড়াই সেই পাপ চালিয়ে গিয়েছিল।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “যখন তারা অন্যায় ও বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছিল, তখন নবীগণ আল্লাহর আদেশে তাদের উপর লা’নত করেছেন — এটি ছিল তাদের দুষ্কর্মের ন্যায্য পরিণতি।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “লা’নত মানে কেবল মুখের অভিশাপ নয়; বরং আল্লাহর দয়া থেকে চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।”
এখানে তিনটি বড় শিক্ষা:
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।
- নবীদের প্রতি অসম্মান বা বিদ্রোহ আল্লাহর লা’নতের কারণ।
- সীমালঙ্ঘন ও অবাধ্যতা কোনো জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও যদি মুসলমানরা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তবে তারাও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
- অন্যায়, জুলুম ও ধর্মে বিকৃতি থেকে বাঁচা জরুরি।
- সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া জাতিকে আল্লাহর শাস্তি স্পর্শ করে।
- আল্লাহর রহমত পেতে হলে তাঁর আনুগত্য ও নবীর অনুসরণ অপরিহার্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন কোনো জাতি প্রকাশ্যে গুনাহ করতে শুরু করে এবং কেউ তাদের থামায় না, তখন আল্লাহর অভিশাপ সবার উপর নাযিল হয়।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২১৬৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৮):
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করা অভিশাপের কারণ।
- অন্যায় ও বিদ্রোহের শাস্তি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যাওয়া।
- আল্লাহর নবীগণও অবাধ্য জাতিকে অভিশাপ দিয়েছেন আল্লাহর আদেশে।
- ধর্মে অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘন জাতিকে ধ্বংস করে।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে সতর্ক করছে —
যদি কোনো জাতি আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, অন্যায়ে লিপ্ত থাকে,
এবং নবীদের শিক্ষা উপেক্ষা করে,
তবে আল্লাহর রহমত থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আল্লাহর লা’নত মানে হলো,
আল্লাহর দয়া ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়া।
📖 “لُعِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنۢ بَنِيٓ إِسْرَـٰٓءِيلَ
عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُۥدَ وَعِيسَى ٱبْنِ مَرْيَمَۚ
ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا۟ وَكَانُوا۟ يَعْتَدُونَ”
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরি করেছিল,
তারা দাউদ ও ঈসা (আঃ)-এর জবান দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছে।
এটি এজন্য যে, তারা অবাধ্যতা করত ও সীমালঙ্ঘন করত।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের এক গুরুতর নৈতিক দুর্বলতা তুলে ধরেছেন — তারা পাপাচার ও অন্যায় দেখেও কাউকে নিষেধ করত না। বরং তারা মন্দ কাজের প্রতি নীরব থেকেছে, এমনকি অনেক সময় সমর্থনও দিয়েছে।
“كَانُوا۟ لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ”
— “তারা একে অপরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখত না, যা তারা নিজেরাই করত।”
অর্থাৎ, তারা সমাজে অন্যায়, জুলুম, সুদ, প্রতারণা ও পাপাচার ছড়িয়ে পড়লেও কাউকে বাধা দিত না, কাউকে সংশোধনের আহ্বান জানাত না। 📖 আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র বলেন — *“তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকা উচিত, যারা সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।”* — (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৪)
এই আয়াত প্রমাণ করে — **যে সমাজে মানুষ অন্যায় দেখে চুপ থাকে, সেখানে আল্লাহর গজব নেমে আসে।**
“لَبِئْسَ مَا كَانُوا۟ يَفْعَلُونَ”
— “তারা যা করত, তা কতই না নিকৃষ্ট কাজ ছিল!”
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন নিন্দা — কারণ তারা শুধু নিজেরাই পাপ করত না, বরং অন্যদেরও তা করতে দিত। তাদের নীরবতা তাদের পাপের অংশীদার বানিয়ে দেয়। 📖 হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন — “যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় কাজ দেখে এবং তা পরিবর্তন না করে, সে যেন সেই কাজের অংশীদার হয়ে যায়।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২১৬৮)
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াত মুসলমানদের সতর্ক করছে যেন তারা অন্যায়ের প্রতি নীরব না থাকে, কারণ অন্যায়ে নীরবতা এক প্রকার সম্মতি।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “যে সমাজে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ বন্ধ হয়ে যায়, সেই সমাজে আল্লাহর রহমত বন্ধ হয়ে যায়।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- অন্যায়ের প্রতি নীরব থাকা এক প্রকার গুনাহ।
- সত্য বলা, সততা বজায় রাখা ও পাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি।
- সমাজে ‘নাহি আনিল মুনকার’ (অসৎ কাজের নিষেধ) প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- যদি সবাই চুপ থাকে, তবে অন্যায় সমাজে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমাদের কেউ যদি কোনো মন্দ কাজ দেখে, সে যেন তা হাতে পরিবর্তন করে; যদি তা না পারে, তবে মুখে বলুক; আর যদি তাও না পারে, তবে অন্তরে ঘৃণা করুক — আর এটি হলো ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৭৯):
- অন্যায় ও পাপাচার দেখে নীরব থাকা গুনাহের শামিল।
- সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ইসলামী সমাজের ভিত্তি।
- আল্লাহর লা’নত থেকে রক্ষা পেতে হলে সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- নীরবতা কখনো কখনো অপরাধীদের শক্তিশালী করে তোলে।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয় —
সমাজে অন্যায়, গুনাহ বা অশ্লীলতা দেখেও যদি কেউ চুপ থাকে,
তবে সে আল্লাহর কাছে দায়ী।
আল্লাহ চান, তাঁর বান্দারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করুক এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক।
নীরবতা কখনোই সমাধান নয়, বরং এটি গুনাহের সহায়তা।
📖 “كَانُوا۟ لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ
لَبِئْسَ مَا كَانُوا۟ يَفْعَلُونَ”
“তারা একে অপরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখত না,
যা তারা নিজেরাই করত।
তারা যা করত, তা কতই না নিকৃষ্ট কাজ ছিল!”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৭৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের আরেকটি বড় দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন — তারা ঈমানদারদের পরিবর্তে **অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত** এবং তাদের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলত, যদিও তাদের কাজ আল্লাহর বিরোধী ছিল।
“تَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟”
— “তুমি তাদের অনেককে দেখবে যারা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে।”
অর্থাৎ, তাদের হৃদয় মুশরিক ও কাফেরদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। তারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, রাজনৈতিক সম্পর্ক ও সহায়তা স্থাপন করত — অথচ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর শত্রু ছিল। 📖 আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র বলেন — *“মুমিনরা মুমিনদের ছেড়ে কাফেরদের বন্ধু বানাবে না।”* — (সূরা আলে ইমরান ৩:২৮)
“لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنفُسُهُمْ”
— “তাদের প্রাণ যা আগে পাঠিয়েছে, তা কতই না মন্দ।”
অর্থাৎ, তাদের কর্মকাণ্ড তাদের পরকালীন পরিণতির জন্য ভয়াবহ প্রস্তুতি করেছে। তারা দুনিয়ার স্বার্থে আল্লাহর বিধান ত্যাগ করেছে, যার পরিণাম হলো আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও অনন্ত শাস্তি।
“أَن سَخِطَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمْ”
— “যে কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।”
আল্লাহর “সাখাত” (অসন্তুষ্টি) মানে হলো — আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকা ও তাঁর ক্রোধের আওতায় পড়া। এটি এমন এক অবস্থা যেখানে মানুষ আল্লাহর নিকট থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর শত্রুকে ভালোবাসে, সে আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিজের উপর ডেকে আনে।” (📖 তাবারানী, আল-মুজামুল কবীর)
“وَفِي ٱلْعَذَابِ هُمْ خَـٰلِدُونَ”
— “এবং তারা শাস্তির মধ্যে চিরকাল থাকবে।”
অর্থাৎ, তাদের এই কুফরি, ভ্রান্ত বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তাদের পরিণতি হলো জাহান্নামের চিরস্থায়ী জীবন। এটি আল্লাহর এক কঠোর সতর্কবার্তা — যারা ঈমানের নামে চললেও অবিশ্বাসীদের সঙ্গকে ভালোবাসে, তারা প্রকৃতপক্ষে ঈমানের মর্যাদা হারায়।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াত কেবল বনী ইসরাঈলের জন্য নয়, বরং সব যুগের জন্য শিক্ষা — মুমিন কখনো কাফেরের প্রতি হৃদয় নত করবে না।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “যারা অবিশ্বাসীদের প্রতি আনুগত্য দেখায়, তারা আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির অংশীদার হয়ে যায়।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ঈমানদারদের সম্পর্ক হওয়া উচিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ভিত্তিতে।
- অবিশ্বাসীদের প্রতি ভালোবাসা বা আনুগত্য ঈমানের ক্ষতি করে।
- রাজনৈতিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে কুফরকে সমর্থন করা আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়াই মানুষের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, সে-ই ঈমানের পূর্ণতা অর্জন করেছে।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৪৬৮১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮০):
- অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ঈমানের ক্ষতি সাধন করে।
- আল্লাহর অসন্তুষ্টি হলো মানুষের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি।
- দুনিয়ার সাময়িক লাভের জন্য ঈমান বিক্রি করা আত্মঘাতী কাজ।
- মুমিনদের হৃদয় শুধু আল্লাহ ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত।
উপসংহার:
এই আয়াত বনী ইসরাঈলের ভ্রান্ত আচরণের মাধ্যমে আমাদের সতর্ক করছে —
যেন আমরা ঈমানের পরিবর্তে কুফর ও অবিশ্বাসীদের প্রতি আনুগত্য না দেখাই।
যে ব্যক্তি আল্লাহর শত্রুকে ভালোবাসে,
সে নিজের অজান্তেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করে।
প্রকৃত ঈমান হলো — আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য বিরাগ।
📖 “تَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنْهُمْ
يَتَوَلَّوْنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ۚ
لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنفُسُهُمْ
أَن سَخِطَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمْ
وَفِي ٱلْعَذَابِ هُمْ خَـٰلِدُونَ”
“তুমি তাদের অনেককে দেখবে যারা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে।
তাদের প্রাণ যা আগে পাঠিয়েছে, তা কতই না মন্দ —
যে কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন,
এবং তারা শাস্তির মধ্যে চিরকাল থাকবে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮০)
এই আয়াতটি আগের আয়াত (৫:৮০)-এর ব্যাখ্যা ও পরিপূরক। আল্লাহ তাআলা এখানে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন — বনী ইসরাঈলের অনেকেই প্রকৃত ঈমানদার ছিল না। যদি তারা সত্যিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস রাখত, তবে তারা কখনোই অবিশ্বাসীদের বন্ধু ও সহচর বানাত না।
“وَلَوْ كَانُوا۟ يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلنَّبِيِّ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْهِ”
— “আর যদি তারা আল্লাহ, নবী ও তাঁর প্রতি নাযিলকৃত বাণীতে ঈমান আনত…”
অর্থাৎ, যদি তাদের ঈমান সত্যিকার ও অন্তর থেকে হতো, তবে তারা আল্লাহর শত্রুদের ভালোবাসত না, এবং মুমিনদের ছেড়ে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না। এখানে আল্লাহ এক সূক্ষ্ম দিক নির্দেশ করেছেন — **ঈমান শুধু মুখের কথা নয়, বরং তা আচরণে প্রতিফলিত হয়।** যার ঈমান সত্য, সে কখনো কুফর ও অন্যায়কে ভালোবাসতে পারে না।
📖 কুরআনে অন্যত্র আল্লাহ বলেন — *“তুমি এমন কোনো জাতি পাবে না, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীদের ভালোবাসে।”* — (সূরা আল-মুজাদিলা ৫৮:২২)
“مَا ٱتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَآءَ”
— “তবে তারা কখনো অবিশ্বাসীদের বন্ধু বানাত না।”
অর্থাৎ, ঈমানের বাস্তব রূপ হলো — আল্লাহর পক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও তাঁর শত্রুদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। একজন ঈমানদার কখনো এমন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না, যা ঈমানের নীতির বিরুদ্ধে যায়।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে, সে ঈমানের মিষ্টতা আস্বাদন করবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২১)
“وَلَـٰكِنَّ كَثِيرٗا مِّنْهُمْ فَـٰسِقُونَ”
— “কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসিক (অবাধ্য)।”
অর্থাৎ, তারা শুধু অবিশ্বাসীদের সঙ্গেই যুক্ত নয়, বরং তারা আল্লাহর আদেশ থেকে বেরিয়ে গেছে, সোজা পথ ত্যাগ করেছে, এবং নিজেদের মনগড়া জীবনযাপন শুরু করেছে। “ফাসিক” শব্দের অর্থ — **যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করে সীমানা অতিক্রম করে।** অর্থাৎ, তারা কেবল অবিশ্বাসে নয়, নৈতিকতায়ও পতিত হয়েছে।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “যদি ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করত, তবে তারা কাফেরদের প্রতি মৈত্রী স্থাপন করতে পারত না। এটি তাদের অন্তরের দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামির প্রমাণ।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “ঈমান ও কুফরের মধ্যে বন্ধুত্বের কোনো স্থান নেই। যে হৃদয় আল্লাহর প্রেমে পূর্ণ, সেখানে শিরক ও কুফরের স্থান নেই।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- সত্যিকার ঈমান হৃদয় ও আচরণ উভয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের মূল চিহ্ন।
- অবিশ্বাসীদের সঙ্গে আনুগত্যমূলক সম্পর্ক ঈমান দুর্বল করে।
- যে সমাজ আল্লাহর বিধান মানে না, তাকে অনুসরণ করা ফাসিকদের কাজ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে, সে ঈমানের মিষ্টতা আস্বাদন করবে — (১) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়, (২) সে কেবল আল্লাহর জন্য ভালোবাসে ও ঘৃণা করে, (৩) এবং সে কুফরিতে ফিরে যেতে যেমন ঘৃণা করে, তেমনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকেও ঘৃণা করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ১৬)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮১):
- সত্যিকারের ঈমান আল্লাহ, নবী ও ওহির প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসে নিহিত।
- যারা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তারা ঈমানের মান হারায়।
- ফাসিকরা হলো তারা, যারা আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করে নিজস্ব কামনা অনুসরণ করে।
- ঈমান মানে শুধু বিশ্বাস নয়, বরং আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রকাশ।
উপসংহার:
এই আয়াত একটি গভীর নৈতিক শিক্ষা দেয় —
ঈমান কেবল মুখের নয়, বরং কর্মের বাস্তবতা।
যে সত্যিকার অর্থে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস রাখে,
সে কখনো কুফরের সহচর হতে পারে না।
বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও আনুগত্য —
সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
📖 “وَلَوْ كَانُوا۟ يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ
وَٱلنَّبِيِّ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْهِ
مَا ٱتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَآءَ
وَلَـٰكِنَّ كَثِيرٗا مِّنْهُمْ فَـٰسِقُونَ”
“আর যদি তারা আল্লাহ, নবী এবং তাঁর প্রতি নাযিলকৃত বাণীতে ঈমান আনত,
তবে তারা কখনো অবিশ্বাসীদের বন্ধু বানাত না;
কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসিক।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮১)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির তিনটি প্রধান দলের মনোভাব বর্ণনা করেছেন — ইহুদি, মুশরিক ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি কেমন আচরণ ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে।
“لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ ٱلنَّاسِ عَدَاوَةٗ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلَّذِينَ أَشْرَكُوا۟ۖ”
— “তুমি অবশ্যই দেখবে, ঈমানদারদের প্রতি সবচেয়ে তীব্র শত্রুতা রাখে ইহুদিরা ও মুশরিকরা।”
ইহুদিরা প্রথম থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা নবী ﷺ-কে অস্বীকার করে, কুরআনের বার্তা বিকৃত করে, এবং মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য কাফেরদের সঙ্গে জোট বাঁধে। তাদের ঈর্ষা ও অহংকারই ছিল এই শত্রুতার মূল কারণ। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“তারা চায়, তোমরা যেমন কুফরি করো, তেমন তোমরাও কুফরি করো — যাতে তোমরা সমান হয়ে যাও।”* — (সূরা আন্-নিসা ৪:৮৯)
মুশরিকরাও মুসলমানদের শত্রু ছিল, কারণ ইসলাম তাদের মূর্তিপূজা ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছিল।
“وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُم مَّوَدَّةٗ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟ إِنَّا نَصَـٰرَىٰۚ”
— “আর তুমি অবশ্যই দেখবে, ঈমানদারদের প্রতি সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রাখে তারা, যারা বলে, ‘আমরা নাসারা।’”
অর্থাৎ, খ্রিষ্টানদের মধ্যে এমন এক শ্রেণি ছিল যারা সত্য অনুসন্ধানী ও বিনয়ী মনোভাবের অধিকারী ছিল। তারা ইসলাম ও নবী ﷺ-এর প্রতি ন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গি রাখত। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন **নাজরান** অঞ্চলের একদল খ্রিষ্টান ইসলাম শুনে কেঁদে ফেলেছিল, কারণ তারা বুঝেছিল এটি সত্য। 📖 আল্লাহ বলেন — *“যখন তারা যা অবতীর্ণ হয়েছে তা শোনে, তাদের চোখে অশ্রু ঝরে পড়ে, কারণ তারা সত্যকে চিনে ফেলে।”* — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৩)
“ذَٰلِكَ بِأَنَّ مِنْهُمْ قِسِّيسِينَ وَرُهْبَانٗا وَأَنَّهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ”
— “এটা এজন্য যে, তাদের মধ্যে আছে পাদ্রী ও সন্ন্যাসীরা, এবং তারা অহংকারপরায়ণ নয়।”
অর্থাৎ, তাদের মধ্যে এমন মানুষ ছিল যারা জ্ঞান, বিনয় ও সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। তারা নিজেদের মনগড়া ধর্মীয় অহংকারে ভুগত না।
এখান থেকে বোঝা যায় — **যে ব্যক্তি বিনয়ী, সত্যনিষ্ঠ ও অহংকারমুক্ত, সে সত্যকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।**
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াতে আল্লাহ খ্রিষ্টানদের সেই শ্রেণিকে প্রশংসা করেছেন, যারা আল্লাহভীরু, সন্ন্যাসী ও বিনয়ী ছিল।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “তারা সত্যের প্রতি অহংকার দেখায়নি, বরং সত্যকে চিনে তা গ্রহণ করেছে — এটি ইসলাম গ্রহণকারীদের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- অহংকার মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- বিনয় ও জ্ঞান সত্য গ্রহণের পথ খুলে দেয়।
- সব ধর্মের মধ্যে কিছু মানুষ থাকে যারা সত্যনিষ্ঠ — তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা ইসলামের শিক্ষা।
- ইহুদি ও মুশরিকদের শত্রুতা আজও সত্য, আর বিনয়ী খ্রিষ্টানদের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা আজও প্রযোজ্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮২):
- ইহুদি ও মুশরিকরা ছিল ইসলামের প্রধান শত্রু।
- খ্রিষ্টানদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠ ও বিনয়ী কিছু লোক ছিল, যারা সত্য গ্রহণ করেছিল।
- বিনয় ও অহংকারহীনতা সত্য উপলব্ধির অন্যতম উপায়।
- আল্লাহর নিকট বিনয়ী ব্যক্তিরাই প্রিয়।
উপসংহার:
এই আয়াত মানব ইতিহাসের এক বাস্তব সত্য তুলে ধরে —
যারা অহংকার ও ঈর্ষায় অন্ধ, তারা সত্যের বিরোধিতা করে;
আর যারা বিনয়ী, তারা সত্যকে চিনে নেয়।
ইহুদি ও মুশরিকদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও
কিছু খ্রিষ্টান সত্যকে গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল —
কারণ তাদের হৃদয়ে অহংকার ছিল না, ছিল জ্ঞান ও বিনয়।
📖 “لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ ٱلنَّاسِ عَدَاوَةٗ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلَّذِينَ أَشْرَكُوا۟ۖ
وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُم مَّوَدَّةٗ لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
ٱلَّذِينَ قَالُوٓا۟ إِنَّا نَصَـٰرَىٰۚ
ذَٰلِكَ بِأَنَّ مِنْهُمْ قِسِّيسِينَ وَرُهْبَانٗا
وَأَنَّهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ”
“তুমি অবশ্যই দেখবে, ঈমানদারদের প্রতি সবচেয়ে তীব্র শত্রুতা রাখে ইহুদিরা ও মুশরিকরা।
আর তুমি অবশ্যই দেখবে, ঈমানদারদের প্রতি সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রাখে তারা,
যারা বলে, ‘আমরা নাসারা’।
এটা এজন্য যে, তাদের মধ্যে আছে পাদ্রী ও সন্ন্যাসীরা,
এবং তারা অহংকারপরায়ণ নয়।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সেই খ্রিষ্টানদের হৃদয়ের অবস্থা বর্ণনা করেছেন, যারা সত্যিকার অর্থে সত্যনিষ্ঠ ও বিনয়ী ছিলেন। তারা যখন কুরআনের তেলাওয়াত শুনত, তখন সত্যের আলো তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করত — ফলস্বরূপ তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরত এবং তারা ঈমান আনত।
“وَإِذَا سَمِعُوا۟ مَآ أُنزِلَ إِلَى ٱلرَّسُولِ”
— “যখন তারা রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা শোনে।”
অর্থাৎ, যখন কুরআনের আয়াত তাদের কানে পৌঁছে, তখন তারা বুঝতে পারে যে এটি সত্য ও আল্লাহপ্রদত্ত বাণী। তাদের হৃদয় নরম হয়ে যায় এবং তারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। 📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এরা ছিল নাজরানের খ্রিষ্টানদের একটি দল, যারা কুরআন শুনে কেঁদে ফেলেছিল এবং বলেছিল: ‘এটা সেই সত্য যার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম।’”
“تَرَىٰٓ أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ ٱلدَّمْعِ”
— “তুমি দেখবে, তাদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়।”
এখানে কুরআনের সৌন্দর্য ও প্রভাবের গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। সত্যের বাণী যখন হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তখন চোখের অশ্রু হলো ঈমানের প্রথম প্রতিক্রিয়া। 📖 হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহভয়ে কেঁদেছে, তার চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ১৬৩৩)
“مِمَّا عَرَفُوا۟ مِنَ ٱلْحَقِّ”
— “কারণ তারা সত্যকে চিনে ফেলে।”
তাদের অশ্রু কোনো আবেগ নয়, বরং জ্ঞানের ও ঈমানের ফল। তারা বুঝেছিল — এই বাণী আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, এতে রয়েছে সেই সত্য যা তারা নিজেদের কিতাবে খুঁজে পায়নি।
“يَقُولُونَ رَبَّنَآ ءَامَنَّا فَٱكْتُبْنَا مَعَ ٱلشَّـٰهِدِينَ”
— “তারা বলে — হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং আমাদেরকে সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত কর।”
‘সাক্ষীরা’ বলতে বোঝানো হয়েছে — যারা সত্যের সাক্ষ্য দেয়, অর্থাৎ নবী ﷺ ও তাঁর অনুসারীগণ। তারা এই দোয়া করেছিল যেন আল্লাহ তাদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা ঈমানের সাক্ষ্য বহন করে।
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “এই দোয়া তাদের অন্তরের ঈমানের প্রমাণ, তারা শুধু কথায় নয়, সত্যিই ঈমান গ্রহণ করেছিল।”
📖 আল্লাহ বলেন — *“এরা হলো তারা, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন — নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:৬৯)
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- যখন কেউ সত্য শুনে আন্তরিকভাবে চিন্তা করে, তখন আল্লাহ তাঁর হৃদয় খুলে দেন।
- সত্যের প্রতি হৃদয়স্পর্শী প্রতিক্রিয়া ঈমানের নিদর্শন।
- আল্লাহর প্রতি বিনয় ও অশ্রু ঝরানো মুমিনের হৃদয়ের সৌন্দর্য।
- ঈমান শুধু মুখের কথা নয় — এটি আত্মার পরিবর্তন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “দুই চোখের অশ্রু কখনো আগুন স্পর্শ করবে না: (১) যে চোখ আল্লাহভয়ে কেঁদেছে, (২) যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারা দিয়েছে।” (📖 সহিহ তিরমিজি, হাদিস: ১৬৩৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৩):
- সত্য শুনে অশ্রু ঝরানো ঈমানের প্রকাশ।
- সত্যনিষ্ঠ ও বিনয়ী হৃদয়ই কুরআনের প্রভাব গ্রহণ করে।
- আল্লাহর পথে বিশ্বাসীরা ‘শাহিদ’ (সাক্ষী) হিসেবে মর্যাদা পায়।
- ঈমান হলো হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি ও আত্মসমর্পণ।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষকে শেখায় —
যখন কেউ সত্যিকারভাবে কুরআনের বাণী শুনে ও চিন্তা করে,
তখন তার হৃদয় কেঁপে ওঠে, চোখে অশ্রু ঝরে।
কারণ কুরআন মানুষের আত্মাকে ছুঁয়ে যায়।
এরা সেই সৌভাগ্যবান মানুষ,
যারা কুরআনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলে —
“হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান এনেছি,
আমাদেরকে সত্যের সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করুন।”
📖 “وَإِذَا سَمِعُوا۟ مَآ أُنزِلَ إِلَى ٱلرَّسُولِ
تَرَىٰٓ أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ ٱلدَّمْعِ
مِمَّا عَرَفُوا۟ مِنَ ٱلْحَقِّ
يَقُولُونَ رَبَّنَآ ءَامَنَّا فَٱكْتُبْنَا مَعَ ٱلشَّـٰهِدِينَ”
“আর যখন তারা রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা শোনে,
তুমি দেখবে, তাদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়,
কারণ তারা সত্যকে চিনে ফেলে।
তারা বলে — ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা ঈমান এনেছি,
সুতরাং আমাদেরকে সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত কর।’”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৩)
এই আয়াতে সেই খ্রিষ্টানদের আন্তরিক ঈমানের কথা বলা হয়েছে যারা কুরআন শুনে সত্যকে চিনে ফেলেছিল। তাদের হৃদয় নরম হয়ে গিয়েছিল এবং তারা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেছিল। তারা বলেছিল — **“আমাদের কী হয়েছে যে আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনব না, অথচ সত্য আমাদের কাছে এসেছে?”** এটি ছিল তাদের হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসা।
“وَمَا لَنَا لَا نُؤْمِنُ بِٱللَّهِ وَمَا جَآءَنَا مِنَ ٱلْحَقِّ”
— “আমাদের কী হয়েছে যে আমরা আল্লাহ ও আমাদের নিকট আগত সত্যের প্রতি ঈমান আনব না?”
অর্থাৎ, যখন স্পষ্টভাবে প্রমাণ পাওয়া গেল যে ইসলামই সত্য ধর্ম, নবী মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রাসূল, তখন ঈমান না আনা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তারা হৃদয়ের গভীরতা থেকে বুঝে নিয়েছিল — **সত্য গ্রহণই হলো মুক্তির একমাত্র পথ।** 📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এটি তাদের সত্যনিষ্ঠার প্রমাণ যে তারা দ্বিধা না করে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।”
“وَنَطْمَعُ أَن يُدْخِلَنَا رَبُّنَا مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلصَّـٰلِحِينَ”
— “এবং আমরা আশা করি যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করবেন।”
তারা শুধু ঈমানেই থেমে যায়নি, বরং **জান্নাতের আশাও প্রকাশ করেছে।** তারা আশা করেছে যেন আল্লাহ তাদেরকে নবী, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে রাখেন। 📖 কুরআনে আল্লাহ বলেন — *“যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:৬৯)
এই বাক্যটি ঈমানের সঙ্গে **আশার ভারসাম্য** শেখায় — শুধু বিশ্বাস নয়, বরং আল্লাহর দয়া ও সৎ সমাজে স্থান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত। 📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “ঈমান ও আমল একসঙ্গে না হলে জান্নাতের আশা অর্থহীন। এই আয়াত শেখায় যে ঈমানের পর মানুষকে সৎ হতে হবে।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- সত্যকে চিনে তা গ্রহণ করা ঈমানের প্রমাণ।
- ঈমান ও সৎকর্ম উভয়ই জান্নাতের পথে প্রয়োজনীয়।
- মুমিন সবসময় আল্লাহর দয়া ও জান্নাতের আশা রাখে।
- আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে দেরি করা বোকামি ও ক্ষতি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম করে, রোযা রাখে — আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সে যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৪):
- সত্য চিনে ঈমান আনা বুদ্ধিমান ও বিনয়ী হৃদয়ের পরিচয়।
- ঈমান আনার পর জান্নাতের আশা রাখা ঈমানের স্বাভাবিক ফল।
- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সৎকর্মই জান্নাতের যোগ্যতা অর্জনের উপায়।
- যারা সত্য শুনে আত্মসমর্পণ করে, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা।
উপসংহার:
এই আয়াত এক ঈমানদার হৃদয়ের সুন্দর প্রকাশ —
সত্য যখন পরিষ্কারভাবে সামনে আসে,
তখন সেই হৃদয় আর দ্বিধা করে না, বরং বলে —
“আমরা আল্লাহ ও সত্যের প্রতি বিশ্বাস আনলাম।”
তাদের আশা জান্নাত, এবং তাদের দৃষ্টি সৎ মানুষের সঙ্গ লাভে।
এটাই প্রকৃত ঈমানের সৌন্দর্য —
**বিশ্বাস + বিনয় + আশা = পরিপূর্ণ ঈমান।**
📖 “وَمَا لَنَا لَا نُؤْمِنُ بِٱللَّهِ
وَمَا جَآءَنَا مِنَ ٱلْحَقِّ
وَنَطْمَعُ أَن يُدْخِلَنَا رَبُّنَا مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلصَّـٰلِحِينَ”
“আর আমাদের কী হয়েছে যে আমরা আল্লাহ ও আমাদের নিকট আগত সত্যের প্রতি ঈমান আনব না,
অথচ আমরা আশা করি যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করবেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৪)
পূর্বের আয়াতে (৫:৮৩–৮৪) বলা হয়েছিল, সত্যনিষ্ঠ খ্রিষ্টানদের একদল যখন কুরআন শুনে ঈমান এনেছিল, তখন তারা বলেছিল — “আমরা ঈমান এনেছি, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত কর।”
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদের **ঈমান ও বিনয়পূর্ণ কথার প্রতিদান** ঘোষণা করেছেন — আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন **জান্নাত**, যার নিচে প্রবাহিত নদীগুলো চির শান্তির প্রতীক 🌸
“فَأَثَـٰبَهُمُ ٱللَّهُ بِمَا قَالُوا۟”
— “তারা যা বলেছিল তার প্রতিদানস্বরূপ, আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কৃত করেছেন।”
তাদের এই ‘বলা’ মানে ছিল তাদের আন্তরিক ঈমান, আত্মসমর্পণ ও দোয়া — “রাব্বানা আ-মান্না, ফাক্তুবনা মা’আশ্ শাহিদীন।” আল্লাহ তাআলা তাদের এই আন্তরিক কথাকে আমল হিসেবে কবুল করেছেন। কারণ, **আন্তরিক বিশ্বাসের কথা কখনো বৃথা যায় না।** 📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “তাদের মুখের ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই ঘোষণাই তাদের জান্নাতের যোগ্য করেছে, কারণ তারা হৃদয় থেকে তা বলেছিল।”
“جَنَّـٰتٖ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ”
— “জান্নাতসমূহ, যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত নদীসমূহ।”
এখানে ‘জান্নাত’ শব্দটি এসেছে বহুবচনে, যা বোঝায় — আল্লাহ তাদের জন্য একাধিক সুখময় আবাস প্রস্তুত করেছেন। নদীগুলো জান্নাতের আনন্দ, প্রশান্তি ও চিরস্থায়ী জীবনের প্রতীক।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “জান্নাতে চার প্রকার নদী প্রবাহিত হবে — পানি, দুধ, মধু ও খাঁটি মদ।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৩১)
“خَـٰلِدِينَ فِيهَاۚ”
— “তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।”
জান্নাতের সুখ কোনো সাময়িক পুরস্কার নয়, বরং চিরস্থায়ী। সেখানে মৃত্যু, ক্লান্তি বা বেদনা নেই — কেবল অনন্ত শান্তি, আনন্দ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি।
“وَذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلْمُحْسِنِينَ”
— “আর এটিই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার।”
“মুহসিনীন” শব্দটি এসেছে “ইহসান” থেকে, যার অর্থ — **সর্বোচ্চ সুন্দরভাবে কাজ করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করা।** তারা শুধু ঈমানই আনেনি, বরং ঈমানের সৌন্দর্যকে আমলে পরিণত করেছিল। 📖 হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “ইহসান হলো — তুমি আল্লাহর এবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো; যদিও তুমি তাঁকে দেখছো না, কিন্তু তিনি তোমাকে দেখছেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আন্তরিক ঈমান ও দোয়া আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।
- সত্যনিষ্ঠ বিশ্বাসীর পুরস্কার হলো চিরস্থায়ী জান্নাত।
- সৎকর্ম ও ইহসান জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।
- জান্নাত হলো সেই পুরস্কার, যা কেবল ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “জান্নাতে এমন কিছু আছে, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এবং কোনো মানুষের হৃদয়ে কল্পনাও করেনি।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৭৭৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮২৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৫):
- আন্তরিক ঈমান আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম আমল।
- আল্লাহ আন্তরিক ঈমান ও দোয়ার প্রতিদানে জান্নাত দান করেন।
- সৎকর্ম ও ইহসান আল্লাহর প্রিয়।
- জান্নাত চিরস্থায়ী শান্তি ও পুরস্কারের আবাস।
উপসংহার:
এই আয়াত একটি আল্লাহপ্রেমী হৃদয়ের পুরস্কারের ঘোষণা।
যারা সত্য শুনে ঈমান এনেছিল,
তাদের চোখের অশ্রু, হৃদয়ের বিনয় এবং জবানার দোয়া —
সবকিছুরই প্রতিদান দিয়েছেন আল্লাহ জান্নাত দিয়ে।
এই জান্নাত শুধু আনন্দের স্থান নয়,
বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির চিরস্থায়ী প্রতিফল।
📖 “فَأَثَـٰبَهُمُ ٱللَّهُ بِمَا قَالُوا۟
جَنَّـٰتٖ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ
خَـٰلِدِينَ فِيهَاۚ
وَذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلْمُحْسِنِينَ”
“তারা যা বলেছিল তার প্রতিদানস্বরূপ,
আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন জান্নাতসমূহ,
যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীসমূহ;
তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।
আর এটিই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৫)
পূর্বের আয়াতে (৫:৮৫) আল্লাহ তাআলা সেই ঈমানদারদের জান্নাতের পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, যারা সত্য শুনে আন্তরিকভাবে ঈমান এনেছিল। এবার এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিপরীত শ্রেণির মানুষের পরিণতি বর্ণনা করেছেন — যারা সত্য শুনেও অস্বীকার করেছে, কুরআনের নিদর্শনকে মিথ্যা বলেছে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ পরিণতি — **জাহান্নাম।**
“وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ”
— “আর যারা কুফরি করেছে এবং আমাদের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা বলেছে।”
অর্থাৎ, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য অস্বীকার করেছে, নবী ﷺ-এর বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং আল্লাহর কিতাবের স্পষ্ট প্রমাণগুলোকেও উপেক্ষা করেছে। “কাজ্যাবু” (كَذَّبُوا) অর্থ — তারা শুধু বিশ্বাস না করেই থেমে যায়নি, বরং সক্রিয়ভাবে সত্যকে **মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।** তারা আল্লাহর আয়াতকে বিদ্রুপ করেছে, রাসূলের প্রতি কটূক্তি করেছে, এবং মানুষকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছে। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকার করে, আল্লাহ তাকে পথ দেখান না, এবং তার জন্য আছে কঠোর শাস্তি।”* — (সূরা আলে ইমরান ৩:৯১)
“أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ”
— “তারাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী।”
“আসহাবুল জাহীম” মানে — যারা জাহান্নামের আগুনে চিরকাল অবস্থান করবে। এটি এমন এক ভয়াবহ অবস্থা, যেখানে তারা মুক্তি পাওয়ার আশাও হারাবে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“তারা চায় জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু তারা কখনোই বের হতে পারবে না; আর তাদের জন্য আছে অবিরাম শাস্তি।”* — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৩৭)
এখানে **দুটি পরিণতি** একসঙ্গে দেখানো হয়েছে — ১️⃣ যারা ঈমান এনেছে, তাদের জান্নাত; ২️⃣ আর যারা অস্বীকার করেছে, তাদের জাহান্নাম। এটি আল্লাহর পূর্ণ ন্যায়বিচারের নিদর্শন — যেখানে পুরস্কার ও শাস্তি উভয়ই ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত।
📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহ কারো প্রতি অন্যায় করেন না। যে কুফরি করে, সে নিজেই নিজের জন্য জাহান্নাম বেছে নেয়।”
📖 ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন — “জাহান্নাম শুধু শারীরিক শাস্তির স্থান নয়, বরং আত্মার যন্ত্রণার স্থান, যেখানে আল্লাহর দয়া থেকে বঞ্চিত থাকা সর্বোচ্চ শাস্তি।”
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- যারা সত্যকে জেনে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করে, তারা আল্লাহর ক্রোধের অধিকারী হয়।
- কুরআনের নিদর্শন মিথ্যা বলা শুধু মুখের নয়, কর্মের মাধ্যমেও হতে পারে (যেমন — আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করা)।
- আল্লাহর বিচার পূর্ণ ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে; কেউ অন্যায়ভাবে শাস্তি পায় না।
- জাহান্নাম হলো সেই পরিণতি, যা মানুষ নিজেই নিজের জন্য তৈরি করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “জাহান্নামের আগুন তোমরা যা ভাবো তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ; এটি তোমাদের আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি তপ্ত।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩২৬৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৪৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৬):
- কুফরি ও মিথ্যাচার জাহান্নামের কারণ।
- আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করা সবচেয়ে বড় অন্যায়।
- জাহান্নাম হলো আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রতিফল, কোনো অবিচার নয়।
- সত্য গ্রহণ না করা মানে নিজের জন্য শাস্তি ডেকে আনা।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা চিরস্থায়ী দুই গন্তব্য স্পষ্ট করেছেন —
যারা ঈমান এনেছে, তারা জান্নাতে;
আর যারা কুফরি করেছে ও আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকার করেছে,
তারা জাহান্নামের অধিবাসী।
এটি আল্লাহর ন্যায়বিচারের এক পরিপূর্ণ উদাহরণ।
আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন,
কিন্তু সেই ইচ্ছার জবাবদিহি অবশ্যম্ভাবী।
📖 “وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ
أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ”
“আর যারা কুফরি করেছে এবং আমাদের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা বলেছে,
তারাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ যা **হালাল (বৈধ)** করেছেন, তা উপভোগ করা তাঁর অনুগ্রহ — কিন্তু তা হারাম ঘোষণা করা বা সীমা অতিক্রম করা ইসলামসম্মত নয়।
আয়াতের প্রেক্ষাপট:
ইবন আব্বাস (রাঃ) ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেন — একদল সাহাবি (রাঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের উপর কিছু হালাল জিনিস হারাম করে নিয়েছিলেন, যেমন — স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকা, মাংস না খাওয়া, সুগন্ধি ব্যবহার না করা ইত্যাদি। তখন এই আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ বলেন — “আমি যা হালাল করেছি, তোমরা তা হারাম কোরো না।” 📖 সহিহ বুখারীতে বর্ণিত — রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আমি নামায পড়ি, আমি ঘুমাইও; আমি রোযা রাখি, আমি খাইও; আমি বিয়েও করি — যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে আমার উম্মত নয়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫০৬৩)
“لَا تُحَرِّمُوا۟ طَيِّبَـٰتِ مَآ أَحَلَّ ٱللَّهُ لَكُمْ”
— “আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হালাল করেছেন, তা হারাম করো না।”
অর্থাৎ, আল্লাহর দেওয়া হালাল নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ হও, নিজ ইচ্ছায় তা বর্জন করে কষ্টদায়ক জীবন বেছে নিও না। ইসলাম হলো ভারসাম্যের ধর্ম — যেখানে কোনো চরম ত্যাগবাদ বা ভোগবাদ নেই। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর দান করা নিয়ামত গ্রহণ করো, কারণ আল্লাহ তাঁর নিয়ামতের চিহ্ন তাঁর বান্দার মধ্যে দেখতে ভালোবাসেন।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২৮১৯)
“وَلَا تَعْتَدُوٓا۟”
— “এবং সীমালঙ্ঘন করো না।”
সীমালঙ্ঘন মানে — যা হারাম করা হয়েছে তা হালাল মনে করা, কিংবা হালাল জিনিসের অপব্যবহার করা। ইসলাম মানুষকে সংযম ও পরিমিতির শিক্ষা দেয়। 📖 আল্লাহ বলেন — *“খাও ও পান করো, কিন্তু অপচয় করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।”* — (সূরা আল-আ‘রাফ ৭:৩১)
“إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلْمُعْتَدِينَ”
— “নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।”
এখানে আল্লাহ তাআলা জোর দিয়ে বলেছেন, ইসলাম কোনো চরমপন্থা বা অতিরিক্ততা অনুমোদন করে না। আল্লাহর প্রিয় বান্দা সেই, যে তাঁর নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে জীবনযাপন করে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমরা ধর্মে অতিরিক্ততা করো না, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো অতিরিক্ততার কারণেই ধ্বংস হয়েছে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭০)
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়।
- আল্লাহর হালাল নিয়ামতকে নিজের উপর হারাম করা ভুল।
- ভোগ ও ত্যাগ — উভয়েই সীমার মধ্যে থাকা উচিত।
- চরমতা ও অতিরিক্ততা আল্লাহর অপছন্দনীয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “নিশ্চয়ই এই ধর্ম সহজ, আর যে ব্যক্তি ধর্মে অতিরিক্ততা করতে চায়, ধর্ম তার উপর ভারী হয়ে যাবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৭):
- আল্লাহর হালাল নিয়ামতকে সম্মান করো, হারাম কোরো না।
- ইসলাম চরমপন্থা নয়, ভারসাম্যের ধর্ম।
- আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।
- মুমিনের জীবন পরিমিত, বাস্তব ও আল্লাহর নির্দেশনামূলক।
উপসংহার:
এই আয়াত মুসলমানদের শিখায় —
ধর্ম মানে কঠোরতা নয়, বরং ভারসাম্য ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য।
আল্লাহর দানকৃত হালাল জিনিসকে উপভোগ করা কৃতজ্ঞতার অংশ।
আর সীমালঙ্ঘন করা হলো অকৃতজ্ঞতা ও বিদ্রোহ।
ইসলাম এমন এক জীবনধারা,
যা মানুষকে দুনিয়ার সুখ ও আখেরাতের মুক্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে শেখায়।
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
لَا تُحَرِّمُوا۟ طَيِّبَـٰتِ مَآ أَحَلَّ ٱللَّهُ لَكُمْ
وَلَا تَعْتَدُوٓا۟ۚ
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلْمُعْتَدِينَ”
“হে মুমিনগণ!
আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বৈধ করেছেন,
তোমরা তা হারাম করো না,
এবং সীমালঙ্ঘন করো না।
নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৭)
এই আয়াতটি আগের আয়াতের (৫:৮৭) পরিপূরক। যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছিলেন — “হালাল জিনিস হারাম কোরো না।” এখানে বলা হচ্ছে — “বরং সেগুলো উপভোগ করো, তবে আল্লাহভীতির সঙ্গে ও কৃতজ্ঞতার মনোভাব নিয়ে।”
“وَكُلُوا۟ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَـٰلٗا طَيِّبٗا”
— “তোমরা যা আল্লাহ তোমাদের রুযি হিসেবে দিয়েছেন, তা হালাল ও পবিত্রভাবে গ্রহণ করো।”
আল্লাহর দেওয়া রিযিক গ্রহণ করা ইবাদতের অংশ — কিন্তু শর্ত হলো, তা **হালাল (বৈধ)** হতে হবে এবং **তয়্যিব (পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন)** হতে হবে।
এখানে “হালাল” মানে — আল্লাহর অনুমোদিত উপায়ে অর্জিত, আর “তয়্যিব” মানে — বিশুদ্ধ, পবিত্র, কল্যাণকর ও ক্ষতিকর নয় এমন খাদ্য। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “হালাল স্পষ্ট, হারাম স্পষ্ট, আর এর মাঝখানে কিছু সন্দেহজনক বিষয় আছে; যে ব্যক্তি সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকে, সে নিজের দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৯৯)
ইসলাম আমাদের শেখায় — খাওয়া-পানাও শুধু দেহের চাহিদা পূরণ নয়, বরং এটি **আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।** এজন্য প্রত্যেক আহারের আগে **“বিসমিল্লাহ”** বলা ও শেষে **“আলহামদুলিল্লাহ”** বলা সুন্নাহ।
“وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِيٓ أَنتُم بِهِۦ مُؤْمِنُونَ”
— “এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো।”
অর্থাৎ, তোমরা ঈমানদার, তাই তোমাদের উচিত আল্লাহর বিধানের প্রতি সতর্ক থাকা। হালাল-হারামের সীমা লঙ্ঘন করো না, কারণ ঈমান কেবল মুখের কথা নয় — এটি এক জীবন্ত দায়িত্ব। 📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “এই আয়াতে হালাল উপার্জন, সংযম ও তাকওয়ার ভারসাম্য শেখানো হয়েছে।”
📖 কুরআনের আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন — *“হে মানবজাতি! তোমরা যা দুনিয়াতে হালাল ও পবিত্র রিযিক হিসেবে পেয়েছো, তা গ্রহণ করো; কিন্তু শয়তানের পথ অনুসরণ করো না।”* — (সূরা আল-বাকারা ২:১৬৮)
ইসলামী দৃষ্টিতে “তয়্যিব” খাবারের অর্থ:
- যা শরীরে বা মনে ক্ষতি আনে না।
- যা শরীয়তসিদ্ধ পদ্ধতিতে অর্জিত।
- যাতে হারাম মিশ্রণ নেই (যেমন: সুদ, চুরি, জুলুম ইত্যাদি)।
- যা কৃতজ্ঞতার মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করা হয়।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- রিযিক হালাল পথে উপার্জন করা ইবাদতের সমান।
- পবিত্র ও বিশুদ্ধ খাদ্য আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।
- হারাম রিযিক আত্মাকে কলুষিত করে ও দোয়া কবুলে বাধা সৃষ্টি করে।
- প্রত্যেক মুমিনের উচিত খাওয়া, উপার্জন ও ভোগে তাকওয়া অবলম্বন করা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকে, তার চুল এলোমেলো, দেহ ধুলায় ভরা, সে আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করে — ‘হে আল্লাহ!’ অথচ তার আহার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম; তাই তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে?” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৮):
- হালাল ও পবিত্র রিযিক গ্রহণ করা ইবাদতের অংশ।
- আল্লাহর রিযিকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
- খাওয়া ও উপার্জনে তাকওয়া থাকা অপরিহার্য।
- হারাম উপার্জন আত্মিক ধ্বংসের কারণ।
উপসংহার:
এই আয়াত আল্লাহর এক পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা —
তিনি মানুষকে দান করেছেন রিযিক, কিন্তু শর্ত দিয়েছেন তা হালাল ও পবিত্র হওয়া চাই।
ইসলাম কেবল নামায, রোযা নয় — বরং জীবনযাত্রার প্রতিটি দিকের নির্দেশনা।
খাদ্য, উপার্জন ও ভোগ সবকিছুতেই আল্লাহভীতি (তাকওয়া) থাকতে হবে।
যে ব্যক্তি হালাল ও তয়্যিব খাদ্য গ্রহণ করে তাকওয়ার সঙ্গে,
সে কেবল দেহ নয় — আত্মাকেও পুষ্ট করে। 🌿
📖 “وَكُلُوا۟ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَـٰلٗا طَيِّبٗاۙ
وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِيٓ أَنتُم بِهِۦ مُؤْمِنُونَ”
“আর তোমরা যা আল্লাহ তোমাদের রুযি হিসেবে দিয়েছেন,
তা হালাল ও পবিত্রভাবে গ্রহণ করো,
এবং আল্লাহকে ভয় করো,
যাঁর প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **শপথ (يمين)** সম্পর্কিত ইসলামী বিধান বর্ণনা করেছেন — কখন শপথ ভঙ্গ করলে প্রায়শ্চিত্ত (كفارة) দিতে হবে, আর কখন শপথ গণ্যই হবে না। ইসলাম প্রতিটি কথা ও প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দেয়, তবে একই সঙ্গে মানুষকে সহনশীলতা ও পরিমিতির শিক্ষা দেয়।
১️ “لَا يُؤَاخِذُكُمُ ٱللَّهُ بِٱللَّغْوِ فِىٓ أَيْمَـٰنِكُمْ”
— “আল্লাহ তোমাদের সেই শপথের জন্য দায়ী করবেন না, যা তোমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে করো।”
অর্থাৎ এমন শপথ, যা মুখে অসচেতনভাবে বলা হয়, যেমন — “আল্লাহর কসম, আমি ওখানে যাবো” — কিন্তু এটি ইচ্ছাকৃত শপথ নয়। এটি “لغو اليمين” — অর্থাৎ অর্থহীন শপথ, যা আল্লাহ ধরবেন না। 📖 সহিহ বুখারীতে এসেছে — রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “لغو اليمين হলো সেই শপথ যা কেউ অজান্তে বা অভ্যাসবশত বলে ফেলে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৬৭৪)
২️ “وَلَـٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ ٱلْأَيْمَـٰنَ”
— “কিন্তু তিনি দায়ী করবেন সেই শপথের জন্য, যা তোমরা দৃঢ়ভাবে করো।”
অর্থাৎ, যেসব শপথ সজ্ঞানে, আল্লাহর নামে, দৃঢ়ভাবে করা হয় — যেমন: “আমি আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করছি আমি এটা করবো।” এগুলো ভঙ্গ করলে কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) দিতে হবে।
৩️ “فَكَفَّـٰرَتُهُۥٓ …” — শপথ ভঙ্গের কাফফারা:
ইসলাম এখানে একটি দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ কাফফারা নির্ধারণ করেছে:
- ① দশজন মিসকিনকে খাওয়ানো, পরিবারের স্বাভাবিক মানের খাবার দিয়ে।
- ② অথবা দশজন মিসকিনকে পোশাক পরানো।
- ③ অথবা একজন দাসকে মুক্ত করা।
- ④ আর যদি এই তিনটি করতে না পারে, তাহলে তিন দিন রোযা রাখা।
এই কাফফারা শুধু একটি শাস্তি নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, দয়া ও দায়িত্ববোধের একটি শিক্ষা। 📖 ইবন কাসীর (রহঃ) বলেন — “শপথ ভঙ্গের কাফফারা মানুষের মধ্যে সহানুভূতি সৃষ্টি করে, কারণ এতে দরিদ্রের সহায়তা ও আত্মসংযম — দুই-ই শেখানো হয়েছে।”
৪️⃣ “وَٱحْفَظُوٓا۟ أَيْمَـٰنَكُمْ”
— “আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো।”
ইসলাম মানুষকে তার প্রতিশ্রুতি ও কথার প্রতি দায়িত্ববান হতে বলে। অকারণে, ঠাট্টায় বা অভ্যাসে শপথ করা উচিত নয়। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমরা আল্লাহর নামে বেশি বেশি শপথ করো না, কারণ এতে তোমাদের সত্যতাও সন্দেহজনক হয়ে যায়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৪৬)
৫️⃣ “كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ”
— “এভাবেই আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ তোমাদের জন্য স্পষ্ট করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।”
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ ও মানবিক বিধান রেখেছেন, যাতে তোমরা তাঁর দয়া উপলব্ধি করে কৃতজ্ঞ হও। ইসলাম কোনো অমানবিক ধর্ম নয় — বরং প্রতিটি বিধানের মধ্যে দয়া ও ভারসাম্য রয়েছে।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- শপথ মানে শুধু কথা নয়, এটি একটি দায়িত্ব।
- ইচ্ছাকৃত শপথ ভঙ্গ করলে এর কাফফারা আদায় করতে হয়।
- ইসলাম মানবিক — গরীবকে খাওয়ানো, পোশাক দেওয়া বা রোযা রাখা — তিনটিই ন্যায়সঙ্গত বিকল্প।
- কথা ও প্রতিশ্রুতিতে সততা রাখা ঈমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করে, সে আল্লাহর ক্রোধের অধীনে পড়বে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৬৫৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৮৯):
- শপথ ভঙ্গ করলে কাফফারা আদায় করা ফরজ।
- অকারণে শপথ করা নিষেধ।
- ইসলাম দয়া ও ভারসাম্যের ধর্ম — সব স্তরের মানুষের জন্য সহজ পথ রেখেছে।
- আল্লাহর বিধান কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করা ঈমানের অংশ।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে —
ইসলাম প্রতিটি কথা ও প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দেয়।
কিন্তু যদি মানুষ ভুল করে,
তবুও তার জন্য আল্লাহর দয়া ও প্রায়শ্চিত্তের পথ খোলা আছে।
ইসলামের নীতিতে কথা, কর্ম ও হৃদয় — তিনটিই জবাবদিহির বিষয়।
সুতরাং একজন মুমিনের উচিত সততার সঙ্গে কথা বলা
এবং শপথ রক্ষা করা। 🌿
📖 “لَا يُؤَاخِذُكُمُ ٱللَّهُ بِٱللَّغْوِ فِىٓ أَيْمَـٰنِكُمْ
وَلَـٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ ٱلْأَيْمَـٰنَۖ
فَكَفَّـٰرَتُهُۥٓ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَـٰكِينَ
أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍۢۖ
فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَـٰثَةِ أَيَّامٍۢۚ”
“আল্লাহ তোমাদের সেই শপথের জন্য দায়ী করবেন না,
যা তোমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে করো;
কিন্তু তিনি দায়ী করবেন সেই শপথের জন্য,
যা তোমরা দৃঢ়ভাবে করো;
আর এর কাফফারা হলো — দশজন মিসকিনকে খাওয়ানো, পোশাক পরানো,
অথবা একজন দাসকে মুক্ত করা;
আর যে এটি করতে না পারে, সে তিন দিন রোযা রাখবে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮৯)
এই আয়াত ইসলামি শরীয়তে **মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা ও ভাগ্য নির্ধারণের তীর** — এই চারটি কুকর্মকে একসাথে **শয়তানের কাজ (عَمَلِ الشَّيْطَانِ)** বলে ঘোষণা করেছে। এবং এখানে **চূড়ান্তভাবে হারাম** করা হয়েছে।
আয়াতের ব্যাখ্যা ধাপে ধাপে:
১️ “إِنَّمَا ٱلْخَمْرُ” — মদ:
“খামর” শব্দের অর্থ — যে কোনো বস্তু যা মস্তিষ্ক ঢেকে দেয় বা নেশাগ্রস্ত করে। এর মধ্যে মদ, গাঁজা, আফিম, মাদকজাত দ্রব্য — সবই অন্তর্ভুক্ত।
ইসলাম প্রথমে ধীরে ধীরে মদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় (সূরা আল-বাকারা ২:২১৯, সূরা আন-নিসা ৪:৪৩), আর এই আয়াতে এসে একেবারে স্পষ্টভাবে তা **হারাম** ঘোষণা করে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে জিনিস বেশি পরিমাণে নেশা আনে, তার অল্প পরিমাণও হারাম।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২০০৩)
২️ “وَٱلْمَيْسِرُ” — জুয়া:
“মাইসির” মানে এমন খেলা বা পদ্ধতি, যেখানে কারও লাভ অন্যের ক্ষতির উপর নির্ভরশীল। এটি শুধুমাত্র পাশা বা বাজি নয় — যে কোনো লেনদেন বা খেলা যেখানে অনিশ্চিত লাভের আশায় ঝুঁকি থাকে, সেটি ইসলামে জুয়া (মাইসির) বলে গণ্য।
আধুনিক যুগে এর উদাহরণ — লটারী, বেটিং, গ্যাম্বলিং, অনলাইন বেটিং গেমস ইত্যাদি। এসবের মধ্যে অন্যায়ভাবে সম্পদ হস্তান্তর হয়, যা সমাজে বিদ্বেষ, লোভ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায়।”* — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯১)
৩️ “وَٱلْأَنصَابُ” — প্রতিমা বা উৎসর্গ স্থান:
“আনসাব” অর্থ — পাথরের বেদি বা প্রতিমা, যেখানে জাহেলিয়াত যুগে আরবরা পশু কুরবানি করত মূর্তির উদ্দেশ্যে। ইসলাম এই প্রথাকে শিরকের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করেছে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন তাদের উপর, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে কোরবানি দেয়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৭৮)
৪️ “وَٱلْأزْلَـٰمُ” — ভাগ্য নির্ধারণের তীর:
“আজলাম” মানে — ভাগ্য বা সিদ্ধান্ত নির্ধারণের জন্য টানানো কাঠি বা তীর। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা এগুলোর মাধ্যমে কাজ শুরু বা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিত। ইসলাম একে কুসংস্কার ও শয়তানের প্ররোচনা বলে ঘোষণা করেছে। আধুনিক যুগে এর রূপ — রাশিফল দেখা, ভাগ্য গণনা, ট্যারো কার্ড, হাত দেখা, ইত্যাদি। সবই নিষিদ্ধ, কারণ এটি আল্লাহর তাকদীরের প্রতি অবিশ্বাসের প্রকাশ।
৫️ “رِجْسٞ مِّنْ عَمَلِ ٱلشَّيْطَـٰنِ”
— “এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ।”
অর্থাৎ, এই কাজগুলো মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে, তাকওয়া ও বিবেককে ধ্বংস করে, এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। 📖 আল্লাহ বলেন — *“শয়তান তোমাদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, এবং তোমাদের নামায ও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে।”* — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯১)
৬️ “فَٱجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ”
— “অতএব, তোমরা এগুলো থেকে দূরে থাকো, যাতে তোমরা সফল হও।”
এটি নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে শক্ত রূপ। শুধু “না করো” নয়, বরং “দূরে থাকো” — অর্থাৎ, মদ, জুয়া, শিরক ও কুসংস্কারের কাছাকাছিও যেয়ো না। ইসলাম শুধু হারাম ঘোষণা করেনি, বরং এর সব মাধ্যম, উৎস ও প্রলুব্ধকর পরিবেশ থেকেও দূরে থাকতে বলেছে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে কখনো মদ পান করবে না।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫৫৭৫)
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- মদ ও মাদক শুধু ধর্মীয় অপরাধ নয়, সামাজিক ধ্বংসের কারণ।
- জুয়া মানুষের পরিশ্রম ও ন্যায়বিচারের চেতনাকে নষ্ট করে।
- শিরক ও কুসংস্কার মানুষকে আল্লাহর উপর থেকে আস্থা হারাতে শেখায়।
- আল্লাহভীতিই সত্যিকারের সফলতার চাবিকাঠি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মদ সকল অশুভের জননী; যে মদ পান করে, সে নামায, নৈতিকতা ও ঈমান হারায়।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৩৩৭১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯০):
- মদ, জুয়া, শিরক ও কুসংস্কার ইসলামি সমাজে চরম নিষিদ্ধ।
- এগুলো শয়তানের কৌশল, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
- আল্লাহর আনুগত্য ও আত্মসংযমই সত্যিকারের সফলতার পথ।
- মুমিনের জীবনে শুদ্ধতা ও তাকওয়া থাকা অপরিহার্য।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানব সমাজের চারটি মারাত্মক রোগ —
মদ, জুয়া, শিরক ও কুসংস্কার — সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছেন।
কারণ এগুলো কেবল আত্মিক নয়, মানসিক ও সামাজিক ধ্বংসের কারণ।
একজন মুমিনের সফলতা নির্ভর করে এই অপবিত্র কাজগুলো থেকে দূরে থাকার উপর।
ইসলাম যে সমাজ চায় — তা পরিশুদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ ও আল্লাহভীতিসম্পন্ন সমাজ। 🌿
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟
إِنَّمَا ٱلْخَمْرُ وَٱلْمَيْسِرُ وَٱلْأَنصَابُ وَٱلْأزْلَـٰمُ
رِجْسٞ مِّنْ عَمَلِ ٱلشَّيْطَـٰنِ
فَٱجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ”
“হে মুমিনগণ!
মদ, জুয়া, প্রতিমার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত বস্তু
এবং ভাগ্য নির্ধারণের তীর —
এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ।
অতএব, তোমরা এগুলো থেকে দূরে থাকো,
যাতে তোমরা সফল হও।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯০)
এই আয়াতটি আগের আয়াতের (৫:৯০) পরিপূরক — সেখানে আল্লাহ তাআলা মদ ও জুয়াকে **শয়তানের কাজ** বলে ঘোষণা করেছিলেন, আর এখানে সেই শয়তানের উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
১️ “إِنَّمَا يُرِيدُ ٱلشَّيْطَـٰنُ” — শয়তানের পরিকল্পনা:
শয়তান মানুষকে কখনো সরাসরি মন্দ কাজে টেনে আনে না, বরং ধীরে ধীরে এমনভাবে ফাঁদ পাতে, যাতে মানুষ নিজেই ধ্বংসের পথে পা বাড়ায়।
সে চায় মানুষের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিভাজন ও হিংসা সৃষ্টি হোক, যাতে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও তাকওয়া নষ্ট হয়ে যায়। 📖 আল্লাহ বলেন — *“নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”* — (সূরা আল-বাকারা ২:১৬৮)
২️ “أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ ٱلْعَدَاوَةَ وَٱلْبَغْضَآءَ”
— “যাতে সে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।”
মদ ও জুয়া — উভয়ই এমন কাজ যা সমাজে ঝগড়া, বিদ্বেষ ও মারামারির কারণ হয়।
- মদের কারণে মানুষ বিবেক হারায়, ফলে অন্যকে অপমান বা আঘাত করে।
- জুয়ার কারণে বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয়, কারণ হার-জিতের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা জন্মে।
৩️ “وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ ٱللَّهِ وَعَنِ ٱلصَّلَوٰةِ”
— “এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে।”
শয়তানের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো — মানুষকে আল্লাহর স্মরণ (যিকর) ও নামায থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে, তার হৃদয়ে শয়তানের কোনো স্থান থাকে না। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মদ পানকারীর কোনো নামায ৪০ দিন পর্যন্ত কবুল হয় না।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ১৮৬২)
ইসলাম মানুষকে নেশা ও জুয়ার পরিবর্তে স্মরণ, নামায ও আত্মশুদ্ধির দিকে আহ্বান জানায়। কারণ আল্লাহর স্মরণই হৃদয়কে শান্ত করে — 📖 *“নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।”* (সূরা আর-রা’দ ১৩:২৮)
৪️ “فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ”
— “অতএব, তোমরা কি (এখনও) বিরত হবে না?”
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক কঠিন ও হৃদয়গ্রাহী প্রশ্ন — যেন তিনি প্রত্যেক মুমিনকে সরাসরি বলছেন: “তোমরা কি এখনও থামবে না?” 📖 হযরত উমর (রাঃ) বলেন — “যখন এই আয়াত নাজিল হলো, আমরা বললাম — ‘আমরা থেমে গেছি, হে আল্লাহ! আমরা থেমে গেছি।’” — (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৫৯৯) এই আয়াত নাজিল হওয়ার পরই মুসলমানরা সর্বত্র মদের পাত্র ফেলে দেয়, রাস্তা পর্যন্ত মদে ভরে যায়, কিন্তু কেউ আর ফিরে যায়নি। এটি ছিল ইসলামী ইতিহাসের এক বিশাল পরিবর্তন।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- মদ, জুয়া, নেশা ও বেটিং শুধু ধর্মীয় অপরাধ নয় — সামাজিক বিষ।
- এসব মানুষকে নামায, কুরআন ও আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- যেখানে শয়তান চায় বিভেদ, সেখানে ইসলাম চায় ঐক্য।
- একজন মুমিনের সফলতা তাকওয়া ও সংযমে নিহিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মদ হলো সমস্ত অশুভের মা; যে এটি পান করে, সে তার ঈমান হারায়।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৩৩৭১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯১):
- শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।
- নেশা ও জুয়া আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- সফলতার পথ — শয়তানের ফাঁদ থেকে দূরে থাকা।
- আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও তাকওয়াই মুক্তির একমাত্র উপায়।
উপসংহার:
এই আয়াত মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন শিক্ষা।
শয়তান মানুষকে নেশা, জুয়া, অর্থ ও বিভেদে ডুবিয়ে
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
কিন্তু মুমিনদের উচিত এই ফাঁদ থেকে বাঁচা,
নামায ও যিকরের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় রাখা।
ইসলামের এই নির্দেশ শুধুমাত্র হারাম ঘোষণা নয়,
বরং এটি মানবজাতিকে আত্মিক, মানসিক ও সামাজিক মুক্তি দান করে। 🌿
📖 “إِنَّمَا يُرِيدُ ٱلشَّيْطَـٰنُ
أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ ٱلْعَدَاوَةَ وَٱلْبَغْضَآءَ
فِى ٱلْخَمْرِ وَٱلْمَيْسِرِ
وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ ٱللَّهِ وَعَنِ ٱلصَّلَوٰةِۖ
فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ”
“শয়তান তো শুধু চায়,
মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে,
এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে।
অতএব, তোমরা কি (এখনও) বিরত হবে না?”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯১)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতগুলোর পরিণতি ও উপসংহার স্বরূপ — যেখানে আল্লাহ মদ, জুয়া ও শয়তানের কৌশল থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, এখন এখানে আল্লাহ সেই সতর্কবার্তাকে সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ় নির্দেশে সমাপ্ত করছেন।
১️ “وَأَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُوا۟ ٱلرَّسُولَ”
— “আর তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো।”
আল্লাহর আনুগত্য মানে তাঁর আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকা। আর রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য মানে — তাঁর সুন্নাহ ও নির্দেশকে জীবনে বাস্তবায়ন করা। ইসলাম কেবল বিশ্বাসের ধর্ম নয় — এটি **আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ধর্ম।** আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যই ঈমানের পরিপূর্ণতা। 📖 কুরআনে আরও বলা হয়েছে — *“যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করে।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:৮০)
২️ “وَٱحْذَرُوا۟”
— “আর সতর্ক থাকো।”
অর্থাৎ, মদ, জুয়া, শয়তানের ফাঁদ ও আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকো। কারণ শয়তান এক মুহূর্তের অবহেলাকেও ব্যবহার করে মানুষকে বিপথে নিতে পারে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “শয়তান মানুষের রক্তনালিতেও প্রবাহিত হয়; তাই তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করে তাকে দুরে রাখো।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩২৮১)
৩️ “فَإِن تَوَلَّيْتُمْ”
— “কিন্তু যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও।”
অর্থাৎ, যদি মানুষ এই স্পষ্ট নির্দেশগুলো অগ্রাহ্য করে, অবাধ্য হয় বা সত্যকে উপেক্ষা করে, তাহলে তার ক্ষতি তার নিজেরই হবে। আল্লাহর রাসূল ﷺ নিজের দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন — এখন যে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে নিজের কপাল পুড়াবে।
৪️ “فَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّمَا عَلَىٰ رَسُولِنَا ٱلْبَلَـٰغُ ٱلْمُبِينُ”
— “তবে জেনে রাখো, আমাদের রাসূলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া।”
অর্থাৎ, রাসূল ﷺ-এর দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া — কারও ঈমান বা অবাধ্যতা তাঁর দায়িত্ব নয়। আল্লাহর হিদায়াত কেবল সেই ব্যক্তিকেই দেওয়া হয়, যে হৃদয় খুলে তা গ্রহণ করতে চায়। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“তুমি (হে নবী ﷺ) কেবল সতর্ককারী; আর আল্লাহই পথ প্রদর্শন করেন যাকে তিনি চান।”* — (সূরা আল-গাশিয়াহ ৮৮:২১-২২)
৫️ এই আয়াতের গভীর তাৎপর্য:
এই আয়াতে তিনটি শিক্ষা একসাথে আছে —
- **আনুগত্য:** আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ পালন।
- **সতর্কতা:** শয়তানের ফাঁদ ও অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা।
- **দায়িত্ববোধ:** দাওয়াত ও বার্তা পৌঁছে দেওয়াই নবীর মূল কাজ।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজকের যুগে শয়তানের ফাঁদ আরও সূক্ষ্ম — মিডিয়া, ফ্যাশন, অর্থলোভ, আসক্তি — সবই বিভ্রান্তির মাধ্যম।
- আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য মানে কেবল নামায নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী নীতি মানা।
- রাসূল ﷺ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, এখন দায়িত্ব আমাদের — আমরা তা গ্রহণ করবো কি না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমরা সবাই রাখাল; এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৮৯৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯২):
- আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য ঈমানের মূলভিত্তি।
- শয়তানের ফাঁদ থেকে সবসময় সতর্ক থাকা জরুরি।
- রাসূল ﷺ-এর দায়িত্ব ছিল বার্তা পৌঁছে দেওয়া — এখন আমাদের দায়িত্ব তা অনুসরণ করা।
- ইসলাম সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও সচেতন আনুগত্যের ধর্ম।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রতি চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছেন —
তাঁর ও রাসূলের আনুগত্য করো,
শয়তানের প্রতারণা থেকে দূরে থাকো,
এবং বুঝে নাও, হিদায়াতের রাস্তা স্পষ্টভাবে তোমাদের সামনে রাখা হয়েছে।
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যে জীবন যাপন করে,
সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল।
আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়,
সে নিজেরই ক্ষতির কারণ হয়। 🌿
📖 “وَأَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُوا۟ ٱلرَّسُولَ
وَٱحْذَرُوا۟ۚ
فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّمَا عَلَىٰ رَسُولِنَا ٱلْبَلَـٰغُ ٱلْمُبِينُ”
“আর তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো,
এবং সতর্ক থাকো;
কিন্তু যদি মুখ ফিরিয়ে নাও,
তবে জেনে রাখো —
আমাদের রাসূলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯২)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৫:৯০–৯২) সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে আল্লাহ মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অনেক সাহাবি (রাঃ) এই নিষেধাজ্ঞা নাজিল হওয়ার পর উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, কারণ তারা ইসলাম আসার আগে মদ পান করতেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন — “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা পূর্বে যে মদ পান করেছি, তার কি কোনো পাপ হবে?” তখন এই আয়াত নাজিল হয় — তাদের জন্য প্রশান্তির বার্তা হিসেবে।
১️ “لَيْسَ عَلَى ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ جُنَاحٞ”
— “যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য কোনো অপরাধ নেই...”
অর্থাৎ, যারা ইসলামের আগমনের আগে অজ্ঞতার যুগে মদ পান করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ঈমান এনেছে, তওবা করেছে ও সৎকাজ শুরু করেছে — তাদের জন্য আল্লাহ কোনো পাপ রাখেননি। এটি ইসলামের এক মহা দয়া ও রহমতের নিদর্শন। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি তওবা করে, সে এমন যেন কখনো কোনো পাপই করেনি।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪২৫০)
২️ “إِذَا مَا ٱتَّقَوا۟ وَءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ”
— “যদি তারা তাকওয়া অবলম্বন করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে।”
আল্লাহ এখানে তিনটি শর্ত উল্লেখ করেছেন:
- তাকওয়া — আল্লাহভীতি ও গুনাহ থেকে বিরত থাকা।
- ঈমান — আন্তরিক বিশ্বাস ও আনুগত্য।
- সৎকাজ — আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ন্যায়নিষ্ঠ কর্ম।
৩️ “ثُمَّ ٱتَّقَوا۟ وَءَامَنُوا۟ ثُمَّ ٱتَّقَوا۟ وَأَحْسَنُوا۟”
— “তারপর তারা তাকওয়া অবলম্বন করে ও ঈমান আনে, তারপর তারা তাকওয়া অবলম্বন করে ও উৎকর্ষতা অর্জন করে।”
এই পুনরাবৃত্তি (বারবার "তাকওয়া" বলা) গভীর অর্থবহ — আল্লাহ বোঝাতে চেয়েছেন যে ঈমান ও তাকওয়া একবারের নয়, বরং **নিরবচ্ছিন্ন জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।** “আহসান” (উৎকর্ষতা) মানে হলো, এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন তুমি তাঁকে দেখছো, আর যদি তুমি তাঁকে না-ও দেখো, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন। — (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫০)
৪️ “وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلْمُحْسِنِينَ”
— “আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।”
এটি আল্লাহর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। যারা তাকওয়া, ঈমান ও সৎকর্মে অবিচল থাকে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি বিশেষ স্নেহ প্রকাশ করেন। 📖 কুরআনে আরও এসেছে — *“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।”* — (সূরা আল-মায়েদা ৫:৪২)
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
ইসলাম কেবল বর্তমান নয়, অতীত সম্পর্কেও ন্যায়বিচারপূর্ণ। কেউ যদি অজ্ঞতা বা অজানার কারণে গুনাহ করে, কিন্তু পরে তওবা করে ও সৎ পথে ফিরে আসে, আল্লাহ তাঁর অতীত মুছে দেন। কারণ আল্লাহর দয়া তাঁর রোষের চেয়ে অধিক। 📖 আল্লাহ বলেন — *“বলুন, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন।”* — (সূরা আয-যুমার ৩৯:৫৩)
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- অতীতের ভুলে নয়, বর্তমানের তাকওয়ায় আল্লাহর বিচার।
- তওবা ও সৎকাজ মানুষকে আল্লাহর প্রিয় করে তোলে।
- আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করতে চাইলে “তাকওয়া + ঈমান + সৎকাজ” — এই তিনটি অপরিহার্য।
- আল্লাহ এমন এক রব, যিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তওবাকারী ব্যক্তি সেই ব্যক্তির মতো, যে কখনো গুনাহই করেনি।” (📖 ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪২৫০)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৩):
- ইসলাম আগের গুনাহ ক্ষমা করে, যদি কেউ আন্তরিকভাবে তওবা করে।
- আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের জন্য তাকওয়া, ঈমান ও সৎকাজ জরুরি।
- ধারাবাহিক তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি ঈমানের পূর্ণতা আনে।
- আল্লাহর দয়া অসীম — তিনি মুহসিনদের ভালোবাসেন।
উপসংহার:
এই আয়াত মুমিনদের জন্য প্রশান্তি ও আশার বার্তা।
আল্লাহ তাঁর দয়া ও ক্ষমার দরজা সর্বদা খোলা রেখেছেন।
অতীতে কেউ যত বড় পাপীই হোক না কেন,
যদি সে তওবা করে, ঈমান আনে ও তাকওয়ায় জীবন সাজায় —
আল্লাহ তার অতীতকে ক্ষমা করে দেন। 🌿
ইসলাম এমন ধর্ম, যা মানুষকে হতাশ নয় — বরং আশা দেয়।
কারণ আল্লাহ ভালোবাসেন তাদেরকে,
যারা আন্তরিকভাবে নিজেদের সংশোধন করে। 🤍
📖 “لَيْسَ عَلَى ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ
جُنَاحٞ فِيمَا طَعِمُوٓا۟
إِذَا مَا ٱتَّقَوا۟ وَءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ
ثُمَّ ٱتَّقَوا۟ وَءَامَنُوا۟
ثُمَّ ٱتَّقَوا۟ وَأَحْسَنُوا۟ۗ
وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلْمُحْسِنِينَ”
“যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে,
তারা অতীতে যা খেয়েছে, তাতে কোনো অপরাধ নেই,
যদি তারা এখন তাকওয়া অবলম্বন করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে।
তারপর তারা তাকওয়া অবলম্বন করে ও উৎকর্ষতা অর্জন করে।
নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৩)
এই আয়াত মুমিনদের জন্য একটি **পরীক্ষা ও আত্মসংযমের শিক্ষা**। এখানে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে, মানুষ কেবল নামায বা রোযার মাধ্যমে নয়, বরং জীবনের ছোট ছোট প্রলোভনের মধ্য দিয়েও পরীক্ষা হয়।
১️ “لَيَبْلُوَنَّكُمُ ٱللَّهُ بِشَىْءٖ مِّنَ ٱلصَّيْدِ”
— “আল্লাহ তোমাদের কিছু শিকারের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন।”
এই আয়াত নাজিল হয়েছিল **হাজ্জ বা ইহরাম অবস্থায়**, যখন শিকার করা নিষিদ্ধ। সেই সময়ে আল্লাহ মুসলমানদের পরীক্ষা নিতে চাইলেন — এমনভাবে যে তাদের সামনে সহজলভ্য শিকার উপস্থিত করা হবে। যেমন: বন্য প্রাণী বা পাখি কাছে আসবে, যাতে ইহরামে থাকা অবস্থায় শিকার না করেও তারা ধৈর্য দেখাতে পারে কিনা, তা যাচাই হয়।
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক “তাকওয়া-পরীক্ষা” — যেখানে প্রকাশ্যে কেউ দেখছে না, কিন্তু মুমিন নিজেই নিজেকে থামিয়ে দেয়। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “প্রকৃত মুজাহিদ সেই, যে নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ১৬২১)
২️ “تَنَالُهُۥٓ أَيْدِيكُمْ وَرِمَاحُكُمْ”
— “যেগুলো তোমাদের হাত ও বর্শার নাগালে থাকবে।”
অর্থাৎ, শিকার এমন সহজলভ্য হবে যে তা হাত বা অস্ত্র দিয়েই ধরা যাবে। কিন্তু তবুও আল্লাহ দেখতে চান — মানুষ কি আল্লাহর আদেশ মানবে, নাকি নফসের প্রলোভনে পড়বে? এটাই মুমিনের সত্যিকারের পরীক্ষা — যখন সে গুনাহ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহভীতির কারণে তা পরিত্যাগ করে। 📖 হাদিসে আছে — “যে ব্যক্তি একা অবস্থায় গুনাহ করতে পারতো, কিন্তু আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তাকে নিজের ছায়ায় স্থান দেবেন।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৬০)
৩️ “لِيَعْلَمَ ٱللَّهُ مَن يَخَافُهُۥ بِٱلْغَيْبِ”
— “যাতে আল্লাহ জানতে পারেন কে তাঁকে অদৃশ্যে ভয় করে।”
এখানে “বিল্গাইব” (অদৃশ্য অবস্থায়) অর্থ — যখন কেউ দেখছে না, তবুও আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে বিরত থাকা। এটি **তাকওয়া**-এর সর্বোচ্চ স্তর।
মানুষ প্রায়ই প্রকাশ্যে ধার্মিক দেখায়, কিন্তু প্রকৃত ঈমান হলো — যখন কেউ একা অবস্থায়ও আল্লাহকে ভয় করে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“যারা অদৃশ্যে তাঁদের রবকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”* — (সূরা আল-মুলক ৬৭:১২)
৪️ “فَمَنِ ٱعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُۥ عَذَابٌ أَلِيمٞ”
— “অতএব, যে কেউ এর পরও সীমা অতিক্রম করে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
অর্থাৎ, যারা আল্লাহর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে, ইহরাম অবস্থায় শিকার করবে বা আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করবে, তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি। ইসলাম শৃঙ্খলা ও আত্মসংযম শেখায়। আল্লাহর আদেশ মানা শুধু নামাযে নয়, বরং আচরণ, প্রবৃত্তি ও লোভের দমনেও প্রযোজ্য।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- প্রতিটি মুমিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর পরীক্ষার মধ্যে আছে।
- গোপনে আল্লাহকে ভয় করাই প্রকৃত তাকওয়া।
- আল্লাহর নিষেধকে সম্মান করা মানে ঈমানের পরিপূর্ণতা।
- আত্মসংযম ও নৈতিকতা ইসলামি জীবনের মূলভিত্তি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চেহারা বা সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে তাকান।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৪):
- আল্লাহ প্রত্যেককে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন।
- তাকওয়া মানে — গোপনে আল্লাহকে ভয় করা।
- আল্লাহর আদেশ মানা আত্মসংযমের পরীক্ষা।
- সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
উপসংহার:
এই আয়াত শেখায় যে,
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ধৈর্য, আত্মসংযম ও তাকওয়া দ্বারা পরীক্ষা করেন।
কখনও তিনি সুযোগ দেন, কিন্তু নিষেধ করেন —
যেন বোঝা যায় কে সত্যিকারে আল্লাহভীরু।
একজন প্রকৃত মুমিন সেই,
যে একা থাকলেও গুনাহের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বলে —
“আমি পারি, কিন্তু করবো না; কারণ আমার রব দেখছেন।” 🌿
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
لَيَبْلُوَنَّكُمُ ٱللَّهُ بِشَىْءٖ مِّنَ ٱلصَّيْدِ
تَنَالُهُۥٓ أَيْدِيكُمْ وَرِمَاحُكُمْ
لِيَعْلَمَ ٱللَّهُ مَن يَخَافُهُۥ بِٱلْغَيْبِۚ
فَمَنِ ٱعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُۥ عَذَابٌ أَلِيمٞ”
“হে মুমিনগণ!
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে কিছু শিকারের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন —
যেগুলো তোমাদের হাত ও বর্শার নাগালের মধ্যে থাকবে —
যাতে আল্লাহ জানতে চান কে তাঁকে অদৃশ্যে ভয় করে।
অতএব, যে কেউ এর পরও সীমা অতিক্রম করে,
তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৪)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **ইহরাম অবস্থায় শিকার নিষিদ্ধ** করেছেন। হজ বা উমরাহর সময় “ইহরাম” পরা অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কিছু জিনিস নিষিদ্ধ হয়ে যায় — যেমন চুল কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার, ও প্রাণী শিকার করা। এটি মুমিনদের জন্য এক বিশেষ **তাকওয়া ও আনুগত্যের পরীক্ষা**।
১️ “لَا تَقْتُلُوا۟ ٱلصَّيْدَ وَأَنتُمْ حُرُمٞ”
— “তোমরা যখন ইহরামে থাকবে, তখন শিকার হত্যা করো না।”
এটি স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা — ইহরামে থাকা অবস্থায় কেউ কোনো বন্যপ্রাণী শিকার করতে পারবে না, এমনকি তীর বা বর্শা ছুঁড়েও না। ইসলাম শিকারকে সম্পূর্ণ হারাম বলেনি, বরং নির্দিষ্ট সময়ে (ইহরাম বা হারামের সীমানায়) তা নিষিদ্ধ করেছে, যেন মানুষ সংযম ও আনুগত্য শিখে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “ইহরামে থাকা ব্যক্তি কোনো শিকার হত্যা করবে না, এবং অন্য কাউকে শিকার করতে সাহায্যও করবে না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৯৬)
২️ “وَمَن قَتَلَهُۥ مِنكُم مُّتَعَمِّدٗا...”
— “আর তোমাদের কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে তা করে...”
অর্থাৎ, যদি কেউ জেনে-বুঝে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তবে তার ওপর নির্দিষ্ট **কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)** বাধ্যতামূলক।
৩️ “فَجَزَآءٞ مِّثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ ٱلنَّعَمِ...”
— “সে যেই প্রাণী হত্যা করেছে, তার সমপরিমাণ গৃহপালিত পশু দ্বারা কাফফারা দিতে হবে।”
যেমন — যদি কেউ হরিণ হত্যা করে, তবে তাকে একটি **ছাগল** কোরবানি করতে হবে। যদি বন্য গরু হত্যা করে, তবে একটি **গৃহপালিত গরু** দিতে হবে। এই বিচার করবে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি (ذَوَا عَدْلٍ مِّنكُمْ)।
৪️ “هَدْيَۢا بَـٰلِغَ ٱلْكَعْبَةِ”
— “এবং তা কা’বায় পৌঁছে দিতে হবে।”
অর্থাৎ, কাফফারার পশুটি মক্কার মসজিদুল হারামে পৌঁছে কোরবানি করতে হবে — এটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও তওবার প্রতীক।
৫️ “أَوْ كَفَّـٰرَةٞ طَعَامُ مَسَـٰكِينَ أَوْ عَدْلُ ذَٰلِكَ صِيَامٗا”
— “অথবা (বিকল্প হিসেবে) দরিদ্রদের খাওয়ানো বা রোযা রাখা।”
এটি ইসলামের মানবিক দিককে প্রকাশ করে — যদি কেউ কোরবানি দিতে অক্ষম হয়, তবে নির্দিষ্ট সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে খাওয়াবে, অথবা রোযা রেখে তার প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণ করবে। এটি আল্লাহর দয়া, যিনি সর্বদা বিকল্প সহজ করেছেন।
৬️ “لِّيَذُوقَ وَبَالَ أَمْرِهِۦ”
— “যাতে সে তার কাজের ফল ভোগ করে।”
এটি শাস্তির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেয় — যাতে মানুষ ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকে।
৭️ “عَفَا ٱللَّهُ عَمَّا سَلَفَ”
— “আল্লাহ পূর্বের কাজ ক্ষমা করেছেন।”
অর্থাৎ, ইসলাম আগমনের আগে যে কেউ অজ্ঞতাবশত শিকার করেছিল, আল্লাহ তা ক্ষমা করেছেন। কিন্তু জেনে-বুঝে কেউ করলে, সে আল্লাহর প্রতিশোধের অধিকারী।
৮️ “وَمَنْ عَادَ فَيَنتَقِمُ ٱللَّهُ مِنْهُۗ”
— “আর যে পুনরায় এমন করবে, আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন।”
আল্লাহর সীমা বারবার ভাঙা মানে ঈমানের দুর্বলতা ও অহংকার। এমন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর প্রতিশোধ ন্যায়সঙ্গত।
৯️ “وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٖ”
— “নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”
অর্থাৎ, আল্লাহ ন্যায়বিচার করেন, এবং যে তাঁর আদেশ উপেক্ষা করে, আল্লাহ তার উপর কঠোর প্রতিফল দেন।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ইসলাম শুধু ইবাদত নয়, নৈতিকতা ও সংযমের জীবনধারা।
- গুনাহ করার সুযোগ থাকলেও নিজেকে সংযত রাখা তাকওয়ার চূড়ান্ত রূপ।
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে তাঁর ন্যায়বিচার অবধারিত।
- আল্লাহ বিকল্প সহজ করেছেন, কারণ তাঁর ধর্ম ভারমুক্ত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “হজে বা উমরাহতে ইহরামে থাকা অবস্থায় কেউ শিকার করলে সে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চাইবে, আর কা’বায় কোরবানি দ্বারা প্রায়শ্চিত্ত দেবে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ১৮২৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৫):
- ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম।
- আল্লাহর সীমা রক্ষা করা তাকওয়ার পরীক্ষা।
- ইচ্ছাকৃত গুনাহর কাফফারা অবশ্যই আদায় করতে হয়।
- আল্লাহ পরাক্রমশালী ও ন্যায়বিচারকারী।
উপসংহার:
এই আয়াত শেখায় —
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরীক্ষা করেন।
যে মুমিন আল্লাহর আদেশকে সম্মান করে,
সে প্রকৃত মুমিন ও তাকওয়াবান।
ইসলাম শুধু নামায বা রোযার ধর্ম নয়,
এটি এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা,
যেখানে প্রতিটি কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতে হয়। 🌿
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
لَا تَقْتُلُوا۟ ٱلصَّيْدَ وَأَنتُمْ حُرُمٞۚ
وَمَن قَتَلَهُۥ مِنكُم مُّتَعَمِّدٗا
فَجَزَآءٞ مِّثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ ٱلنَّعَمِ
... وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٖ”
“হে মুমিনগণ!
তোমরা যখন ইহরামে থাকবে, তখন শিকার হত্যা করো না।
আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা করে,
তার কাফফারা গৃহপালিত পশু দ্বারা দিতে হবে...
নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **হালাল ও হারাম শিকারের সীমা** স্পষ্ট করেছেন। পূর্ববর্তী আয়াতে (৫:৯৫) ইহরাম অবস্থায় স্থল শিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আর এই আয়াতে জানানো হয়েছে — **সমুদ্রের শিকার ও সামুদ্রিক প্রাণী হালাল।**
১️ “أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ ٱلْبَحْرِ وَطَعَامُهُۥ”
— “সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে।”
এখানে “سَيْدُ ٱلْبَحْرِ” মানে — সমুদ্রের জীবিত প্রাণী ধরা বা শিকার করা, আর “طَعَامُهُ” মানে — সমুদ্র থেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া প্রাণী, যেমন মাছ। ইসলামে সামুদ্রিক প্রাণী (যেমন মাছ, চিংড়ি, সামুদ্রিক প্রাণী) সবই হালাল, কারণ এগুলো কুরআনে আল্লাহর দান বলে ঘোষিত। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সমুদ্রের পানি পবিত্র, এবং তার মৃত প্রাণী হালাল।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ৬৯)
২️ “مَتَـٰعٗا لَّكُمْ وَلِلسَّيَّارَةِ”
— “তোমাদের ও পথিকদের উপকারের জন্য।”
অর্থাৎ, সমুদ্রের শিকার কেবল খাদ্য নয়, এটি ভ্রমণকারীদের জন্যও উপকার ও জীবনধারণের মাধ্যম। মরুভূমিতে চলার পথে বা হজযাত্রার সময় মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হতো খাদ্য হিসেবে। ইসলাম বাস্তবধর্মী জীবননীতি দেয় — যেখানে কষ্টের সময় সহজ বিকল্প হালাল রাখা হয়েছে।
৩️ “وَحُرِّمَ عَلَيْكُمْ صَيْدُ ٱلْبَرِّ مَا دُمْتُمْ حُرُمٗا”
— “কিন্তু স্থলের শিকার তোমাদের জন্য হারাম, যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে।”
অর্থাৎ, ইহরাম অবস্থায় স্থল প্রাণী শিকার, হত্যা বা এমনকি অন্য কাউকে নির্দেশ দেওয়াও নিষিদ্ধ। এটি তাকওয়া ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমরা ইহরাম অবস্থায় পঙ্গপাল ও মাছ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণী শিকার করিনি।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৯৯)
৪️ “وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِيٓ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ”
— “আর আল্লাহকে ভয় করো, যার কাছে তোমরা একদিন একত্রিত হবে।”
এই শেষাংশটি একটি গভীর স্মরণ: আল্লাহর বিধান শুধু ইহরামের সময় নয় — জীবনের প্রতিটি কাজেই তাকওয়া থাকা আবশ্যক। মানুষ একদিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করবে, তাই তাঁর আদেশ অবহেলা করা উচিত নয়। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য সহজ পথ করে দেন।”* — (সূরা আত-তালাক ৬৫:৪)
৫️ এই আয়াতের মূল শিক্ষা:
- সমুদ্রের শিকার (মাছ ইত্যাদি) হালাল।
- ইহরাম অবস্থায় স্থল শিকার হারাম।
- ইসলাম বাস্তব ও মানবিক জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছে।
- আল্লাহকে ভয় করো — কারণ শেষ বিচারের দিন তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন হবে।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- ইসলামে খাদ্য ও জীবিকার সীমা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন — এটি পরীক্ষাও বটে।
- যে মানুষ সংযম ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তার জন্য হালাল জীবনই বরকতময়।
- মানুষের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহভীতি যেন হারিয়ে না যায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমরা যখন সমুদ্রে যাত্রা করতাম, মৃত মাছ আমাদের খাদ্য হিসেবে যথেষ্ট ছিল।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪২৩২)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৬):
- সমুদ্রের শিকার হালাল ও বরকতময় রিযিক।
- ইহরামে স্থল শিকার হারাম — আল্লাহর সীমা অতিক্রম করো না।
- আল্লাহকে ভয় করা প্রত্যেক মুমিনের প্রথম কর্তব্য।
- সবশেষে আমাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকেই — তাই তাকওয়াই আমাদের ঢাল।
উপসংহার:
এই আয়াতের মূল বার্তা হলো —
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য হালালকে সহজ করেছেন এবং হারামকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন,
যেন মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ, তাকওয়াবান ও আল্লাহভীরু জীবনযাপন করতে পারে।
ইসলাম এমন ধর্ম, যা ভার নয় — বরং ভারসাম্য ও সংযমের পথ।
আল্লাহর সীমারেখা মানাই হলো সত্যিকারের আনুগত্যের চিহ্ন। 🌿
📖 “أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ ٱلْبَحْرِ وَطَعَامُهُۥ
مَتَـٰعٗا لَّكُمْ وَلِلسَّيَّارَةِۖ
وَحُرِّمَ عَلَيْكُمْ صَيْدُ ٱلْبَرِّ
مَا دُمْتُمْ حُرُمٗاۗ
وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِيٓ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ”
“সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে,
তোমাদের ও পথিকদের উপকারের জন্য।
কিন্তু স্থলের শিকার তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে,
যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে।
আর আল্লাহকে ভয় করো, যার কাছে তোমরা একদিন একত্রিত হবে।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য **কা‘বার মর্যাদা, নিরাপত্তা ও প্রতীকী গুরুত্ব** ব্যাখ্যা করেছেন। কা‘বা শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং এটি ঈমান, ঐক্য ও আল্লাহর আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু।
১️ “جَعَلَ ٱللَّهُ ٱلْكَعْبَةَ ٱلْبَيْتَ ٱلْحَرَامَ قِيَـٰمٗا لِّلنَّاسِ”
— “আল্লাহ কা‘বাকে মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র বানিয়েছেন।”
এখানে “قِيَامٗا لِّلنَّاسِ” অর্থ — মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক জীবনের স্থিতিশীলতা। কা‘বা মুসলমানদের একতা ও দিকনির্দেশনার প্রতীক — পৃথিবীর যেকোনো স্থানে নামাজ পড়লে কা‘বার দিকেই মুখ ফিরিয়ে পড়া হয়। 📖 আল্লাহ বলেন — *“যেখানেই তোমরা থাকো, তোমাদের মুখ কা‘বার দিকে ফিরিয়ে দাও।”* — (সূরা আল-বাকারা ২:১৪৪)
কা‘বা কেবল ইবাদতের স্থান নয়, এটি মুসলমানদের ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু — যা পুরো উম্মাহকে এক কাতারে দাঁড় করায়।
২️ “وَٱلشَّهْرَ ٱلْحَرَامَ”
— “এবং নির্ধারিত (নিষিদ্ধ) মাসকে।”
ইসলাম চারটি “হারাম মাস” নির্ধারণ করেছে — **যুল-ক্বা‘দাহ, যুল-হিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব।** এসব মাসে যুদ্ধ ও রক্তপাত হারাম করা হয়েছে, যাতে মানুষ শান্তিতে হজ ও ইবাদত পালন করতে পারে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“হারাম মাসে যুদ্ধ করা মহাপাপ।”* — (সূরা আল-বাকারা ২:২১৭)
৩️ “وَٱلْهَدْيَ وَٱلْقَلَـٰٓئِدَ”
— “এবং কোরবানির পশু ও তাদের গলায় দড়ি পরানো পশু।”
“হাদই” (ٱلْهَدْيَ) মানে — কা‘বায় কোরবানি করার উদ্দেশ্যে পাঠানো পশু, আর “কালায়িদ” (ٱلْقَلَـٰٓئِدَ) মানে — তাদের গলায় দড়ি বা চিহ্ন পরানো, যা বোঝায় যে এই পশুগুলো কোরবানির জন্য নির্ধারিত। এই প্রথা মুসলমানদের মধ্যে নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক ছিল — কেউ ঐ পশু বা তাদের বাহককে আঘাত করতো না।
৪️ “ذَٰلِكَ لِتَعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلْأَرْضِ”
— “এটি এজন্য, যাতে তোমরা জানতে পারো — আল্লাহ জানেন আসমান ও জমিনের সব কিছু।”
আল্লাহর এসব নির্দেশ শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, বরং মানুষের অন্তর ও সমাজে শৃঙ্খলা ও তাকওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি জানেন কার উদ্দেশ্য পবিত্র, আর কার মধ্যে ভণ্ডামি আছে।
৫️ “وَأَنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ”
— “এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ।”
আল্লাহর জ্ঞান অসীম — তিনি মানুষের বাহ্যিক কাজ যেমন জানেন, তেমনি অন্তরের চিন্তাও জানেন। তাই ইবাদত বা আনুগত্যে ভণ্ডামি চলবে না।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- কা‘বা মুসলমানদের ঐক্য ও আল্লাহর দিকনির্দেশনার প্রতীক।
- আল্লাহ মানুষের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ব্যবস্থা করেছেন।
- আল্লাহর বিধান শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও নৈতিক ভারসাম্যও সৃষ্টি করে।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ — তাই প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য হতে হবে খাঁটি।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত স্থান হলো মসজিদুল হারাম (কা‘বা)। এবং মানুষের রক্ত ও সম্মানও কা‘বার মতোই পবিত্র।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৮৯১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৭):
- কা‘বা আল্লাহ নির্ধারিত পবিত্র কেন্দ্র ও মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক।
- হারাম মাসে যুদ্ধ ও সহিংসতা হারাম।
- কোরবানির পশু সম্মানিত — এটি আল্লাহর ইবাদতের অংশ।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তাই কাজ ও অভিপ্রায় উভয়ই পবিত্র হতে হবে।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা শেখাচ্ছেন যে —
ইসলাম শুধু ইবাদতের ধর্ম নয়, এটি নিরাপত্তা, ন্যায় ও শান্তির ধর্ম।
কা‘বা ও হারাম অঞ্চল মানবতার নিরাপত্তার প্রতীক।
আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন,
প্রকৃত তাকওয়া তখনই সম্ভব,
যখন আমরা তাঁর আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয় উভয়ই বজায় রাখি। 🌿
📖 “جَعَلَ ٱللَّهُ ٱلْكَعْبَةَ ٱلْبَيْتَ ٱلْحَرَامَ
قِيَـٰمٗا لِّلنَّاسِ
وَٱلشَّهْرَ ٱلْحَرَامَ
وَٱلْهَدْيَ وَٱلْقَلَـٰٓئِدَۚ
ذَٰلِكَ لِتَعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلْأَرْضِۗ
وَأَنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ”
“আল্লাহ কা‘বাকে মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র বানিয়েছেন,
এবং হারাম মাস, কোরবানির পশু ও গলায় দড়ি পরানো পশুকে সম্মানিত করেছেন,
যাতে তোমরা জানো আল্লাহ জানেন আসমান ও জমিনের সব কিছু,
এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুইটি গুণের ভারসাম্য তুলে ধরেছেন — **‘শাদীদুল ইক্বাব’ (কঠোর শাস্তিদাতা)** এবং **‘গাফূরুর রহীম’ (ক্ষমাশীল ও দয়ালু)**। এই দুই গুণ একত্রে মানুষকে **ভয় ও আশা** — উভয় দিকের শিক্ষা দেয়।
১️ “ٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ”
— “জেনে রাখো — নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।”
এই অংশে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করছেন, যাতে তারা তাঁর আদেশ অমান্য করে সীমালঙ্ঘন না করে। আল্লাহর শাস্তি তাৎক্ষণিক না হলেও, তা **অবশ্যই ন্যায়সংগত ও নিশ্চিত**। 📖 কুরআনের আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন — *“নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়ংকর।”* — (সূরা আল-বুরুজ ৮৫:১২) আল্লাহর এই গুণ মানুষকে মনে করিয়ে দেয় — গুনাহ ছোট মনে হলেও, সেটি তাঁর আদেশ অমান্য করা। তাই মুমিনের হৃদয়ে সবসময় আল্লাহভীতি থাকা আবশ্যক।
২️ “وَأَنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ”
— “এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।”
আল্লাহর দয়া অসীম। তিনি বান্দার গুনাহ যত বড়ই হোক, তওবার দরজা সর্বদা খোলা রাখেন। এই অংশ বান্দার মনে **আশা ও প্রশান্তি** জাগিয়ে তোলে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“বলুন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন।”* — (সূরা আয-যুমার ৩৯:৫৩)
এভাবে আল্লাহর এই দুই গুণ — **ভয় ও আশার ভারসাম্য** — একজন মুমিনকে ন্যায়পথে রাখে। শুধু ভয় নয়, শুধু আশা নয় — বরং এই দুই মিশ্রণই একজন মানুষকে স্থির রাখে।
৩️ ইসলামী ভারসাম্যের শিক্ষা:
এই আয়াত ইসলামের সেই চমৎকার ভারসাম্যের উদাহরণ, যেখানে আল্লাহ যেমন **ন্যায়বিচারক**, তেমনি **অসীম দয়ালু**। এই দুই গুণ ছাড়া মানবজীবন বিপথে চলে যেত — যদি শুধু শাস্তি হতো, মানুষ হতাশ হতো; আর যদি শুধু ক্ষমা হতো, মানুষ সীমা লঙ্ঘন করতো। তাই আল্লাহ বলেন — *“আমার শাস্তিও ভয়ংকর, আর আমার রহমত সবকিছুকে আচ্ছাদিত করে।”* — (সূরা আল-আ‘রাফ ৭:১৫৬)
৪️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- মুমিনের জীবনে ভয় ও আশার মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে।
- আল্লাহর আদেশ অমান্য করা কখনো ছোট বিষয় নয়।
- গুনাহর পর তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন।
- আল্লাহর দয়া যেমন সীমাহীন, তেমনি তাঁর ন্যায়বিচারও অব্যর্থ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যদি তোমরা জানত যে আল্লাহর শাস্তি কত কঠোর, তবে কেউ জান্নাতের আশা করতো না। আর যদি জানত আল্লাহর রহমত কত মহান, তবে কেউ জাহান্নামের ভয় পেত না।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৫৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৮):
- আল্লাহর শাস্তি কঠিন — তাই গুনাহ থেকে সাবধান থাকা জরুরি।
- আল্লাহর দয়া অসীম — তাই হতাশ না হয়ে তওবা করা উচিত।
- ভয় ও আশার ভারসাম্যই ঈমানের পূর্ণতা।
- আল্লাহর দুই গুণে প্রকাশ পায় তাঁর পরিপূর্ণ ন্যায় ও করুণা।
উপসংহার:
এই ছোট কিন্তু গভীর আয়াতটি মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি ও আশা সৃষ্টি করে।
এটি বলে — আল্লাহর আদেশ ভঙ্গ করলে তাঁর শাস্তি থেকে রেহাই নেই,
কিন্তু আন্তরিক তওবা করলে আল্লাহর দয়া অনন্ত।
একজন মুমিনের জীবন এই দুই ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো —
**ভয় (خوف)** ও **আশা (رجاء)**।
যেই ব্যক্তি শুধু ভয় পায়, সে হতাশ হয়;
আর যেই শুধু আশা করে, সে উদাসীন হয়।
প্রকৃত ঈমানদার সেই,
যে আল্লাহকে যেমন ভালোবাসে, তেমনি ভয়ও করে। 🌿
📖 “ٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ
وَأَنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ”
“জেনে রাখো — নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা,
এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইসলামের মৌলিক নীতি স্পষ্ট করেছেন — **নবী (ﷺ)-এর কাজ হলো শুধু আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়া, মানুষকে বাধ্য করা নয়।** এটি একটি গভীর ও ন্যায়নিষ্ঠ শিক্ষা, যা ইসলামের **দাওয়াহ ও স্বাধীন ইচ্ছার নীতি** প্রকাশ করে।
১️ “مَا عَلَى ٱلرَّسُولِ إِلَّا ٱلْبَلَـٰغُ”
— “রাসূলের দায়িত্ব কেবল বার্তা পৌঁছে দেওয়া।”
এখানে আল্লাহ তাঁর রাসূল ﷺ-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কারণ অনেকে তাঁর দাওয়াহ অস্বীকার করছিল, তবুও তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন তাদের হিদায়াতের জন্য। কিন্তু আল্লাহ জানিয়ে দিলেন — হিদায়াত দেওয়া **আল্লাহর কাজ**, আর পৌঁছে দেওয়া **রাসূলের দায়িত্ব**। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“আপনি কাউকে হিদায়াত দিতে পারবেন না, কিন্তু আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিদায়াত দেন।”* — (সূরা আল-কাসাস ২৮:৫৬)
অর্থাৎ, নবীর কাজ হলো **স্পষ্টভাবে সত্য প্রচার করা**, জোর করে কাউকে ঈমান আনা নয়। ইসলাম মানুষকে চিন্তা, প্রমাণ ও হৃদয়ের মাধ্যমে সত্য গ্রহণের আহ্বান জানায়।
২️ “وَٱللَّهُ يَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا تَكْتُمُونَ”
— “আর আল্লাহ জানেন তোমরা যা প্রকাশ করো এবং যা গোপন করো।”
এই অংশে আল্লাহ মনে করিয়ে দিচ্ছেন — মানুষ বাহ্যিকভাবে যা দেখায়, আর অন্তরে যা রাখে — উভয়ই আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য। যারা মুখে ঈমানের দাবি করে কিন্তু মনে কুফর রাখে, তাদেরও আল্লাহ জানেন; আবার যারা নিঃশব্দে সৎ থাকে, আল্লাহ তাদের আমলও জানেন। 📖 আল্লাহ বলেন — *“তিনি জানেন অন্তরের গোপন কথাও।”* — (সূরা আত-তাগাবুন ৬৪:৪)
এই আয়াত আল্লাহর পূর্ণ জ্ঞানের ও ন্যায়বিচারের প্রমাণ। মানুষকে তাঁর কাছে কিছুই গোপন করা সম্ভব নয় — না কথায়, না মনে, না অভিপ্রায়ে।
৩️ এই আয়াতের মূল বার্তা:
আল্লাহ নবী ও উম্মাহ উভয়কেই শিক্ষা দিচ্ছেন — প্রত্যেকে তার দায়িত্ব পালন করবে, ফলাফলের মালিক কেবল আল্লাহ। নবীর কাজ ছিল দাওয়াহ, আর মানুষের কাজ তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু আল্লাহ সবকিছু জানেন, তাই কারো কৃত্রিমতা বা প্রতারণা তাঁর কাছে গোপন নয়।
৪️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আমাদের দায়িত্ব শুধু সত্য প্রচার করা, ফলাফল আল্লাহর হাতে।
- দাওয়াহতে জোর নয়, যুক্তি ও হৃদয় দিয়ে মানুষকে আহ্বান করতে হবে।
- আল্লাহ অন্তরের অভিপ্রায় জানেন — তাই কাজের পিছনে নিয়ত হতে হবে খাঁটি।
- কোনো মানুষ আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে নয় — তিনি সব জানেন ও দেখেন।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার ও তোমাদের মধ্যে পার্থক্য হলো — আমি বার্তা পৌঁছে দিই, আর তোমরা তা গ্রহণ করো বা প্রত্যাখ্যান করো।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৫৬)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ৯৯):
- রাসূল ﷺ-এর দায়িত্ব ছিল বার্তা পৌঁছে দেওয়া, বাধ্য করা নয়।
- মানুষের কাজের বিচার করবে কেবল আল্লাহ।
- আল্লাহ জানেন প্রকাশ্য ও গোপন উভয় কাজ।
- তাকওয়া মানে শুধু আমল নয়, অন্তরের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা।
উপসংহার:
এই আয়াত দাওয়াহ, শিক্ষা ও আমলের মূলনীতি নির্ধারণ করে দেয়।
আল্লাহ বলেন, নবী বা দাঈর কাজ কেবল পৌঁছে দেওয়া —
মানুষকে বাধ্য করা নয়।
তাই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হলো,
জ্ঞান ও মমতাপূর্ণ ভাষায় ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়া,
এবং ফলাফল আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়া।
একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে,
আল্লাহ অন্তরের সব গোপন উদ্দেশ্য জানেন —
তাই দাওয়াহ ও ইবাদতে নিখাদ নিয়ত থাকা জরুরি। 🌿
📖 “مَا عَلَى ٱلرَّسُولِ إِلَّا ٱلْبَلَـٰغُۗ
وَٱللَّهُ يَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا تَكْتُمُونَ”
“রাসূলের দায়িত্ব কেবল বার্তা পৌঁছে দেওয়া,
আর আল্লাহ জানেন তোমরা যা প্রকাশ করো ও যা গোপন করো।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:৯৯)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এক গভীর নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন — **সত্য ও মিথ্যা, হালাল ও হারাম, ন্যায় ও অন্যায় — কখনোই সমান নয়।** বাহ্যিকভাবে হারাম বা মন্দ জিনিস আকর্ষণীয় মনে হলেও, তার পরিণতি ধ্বংসাত্মক।
১️ “قُل لَّا يَسْتَوِي ٱلْخَبِيثُ وَٱلطَّيِّبُ”
— “বলুন, অশুদ্ধ ও শুদ্ধ সমান নয়।”
“খাবীস” (الخبيث) মানে — মন্দ, অপবিত্র, নাজায়েজ বা গুনাহপূর্ণ জিনিস। আর “তয়্যিব” (الطيب) মানে — পবিত্র, হালাল ও ন্যায়সঙ্গত জিনিস। আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন যে, গুনাহ ও পাপের বাহ্যিক চাকচিক্য যতই হোক, তা কখনো সৎকাজের সমান হতে পারে না। 📖 অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন — *“মন্দ ও সৎকাজ কখনো সমান নয়।”* — (সূরা ফুসসিলাত ৪১:৩৪)
২️ “وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ ٱلْخَبِيثِ”
— “যদিও অশুদ্ধ জিনিসের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে।”
এই অংশে আল্লাহ মানুষের মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। কখনও হারাম বা পাপ কাজের বাহ্যিক সাফল্য বা সংখ্যাধিক্য মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে। যেমন — অন্যায়ে লিপ্ত লোকদের ধনসম্পদ, প্রভাব বা জনসংখ্যা দেখে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু আল্লাহ বলছেন — **সংখ্যা নয়, গুণই আসল।** যা খাঁটি, হালাল ও ন্যায়সঙ্গত — সেটিই আল্লাহর কাছে মূল্যবান। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “এক ফোঁটা হালাল রিযিক হারাম রিযিকের পাহাড়ের চেয়েও উত্তম।” (📖 ইবন হিব্বান, হাদিস: ৬৭৮)
৩️ “فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ يَـٰٓأُو۟لِي ٱلْأَلْبَـٰبِ”
— “সুতরাং হে বুদ্ধিমানগণ! আল্লাহকে ভয় করো।”
এখানে আল্লাহ “উলিল আলবাব” — অর্থাৎ **বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষদের** উদ্দেশ্য করে বলেছেন। কারণ প্রকৃত জ্ঞানী সেই, যে বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে নয়, বরং আল্লাহভীতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়। তাকওয়া (আল্লাহভীতি) মানুষকে সেই চেতনা দেয়, যা তাকে ভালো-মন্দ পার্থক্য করতে সক্ষম করে। 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দেন।”* — (সূরা আল-আনফাল ৮:২৯)
৪️ “لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ”
— “যাতে তোমরা সফল হও।”
প্রকৃত সফলতা (فلاح) হলো — দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এবং এটি কেবল তাকওয়াবান ও সৎপথে অবিচলদের জন্যই সম্ভব।
৫️ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বার্তা:
- সত্য ও মিথ্যা কখনো সমান হতে পারে না।
- হারাম বা অন্যায়ের বাহ্যিক প্রাচুর্য দেখে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
- আল্লাহভীতি (তাকওয়া) হলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আসল মাপকাঠি।
- সফলতা সংখ্যা বা সম্পদে নয়, বরং ন্যায় ও পবিত্রতায় নিহিত।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- বর্তমান সমাজে মন্দ জিনিসের প্রাচুর্য বেশি, কিন্তু তা কখনো সাফল্যের প্রতীক নয়।
- হালাল ও ন্যায়পথে চলা কষ্টকর মনে হলেও, সেটিই আখিরাতে সাফল্যের কারণ।
- জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে “তাকওয়া”কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট; আর এ দু’টির মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় রয়েছে, যেগুলো থেকে যে দূরে থাকে, সে তার ধর্ম ও সম্মান রক্ষা করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫২)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০০):
- হালাল ও হারাম কখনো এক নয়।
- সংখ্যা বা প্রাচুর্য নয়, বরং পবিত্রতাই আসল মানদণ্ড।
- আল্লাহভীতি (তাকওয়া) সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন।
- আখিরাতের সাফল্য তাকওয়া ও সৎ জীবনের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
উপসংহার:
এই আয়াত একটি **নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা** —
যেখানে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেছেন, যেন তারা বাহ্যিক চাকচিক্যে মুগ্ধ না হয়।
আল্লাহর কাছে মূল্যবান সেই ব্যক্তি,
যে সংখ্যায় নয়, ন্যায়ে ও সততায় বড়।
ইসলামী দৃষ্টিতে সাফল্য মানে —
পবিত্র আত্মা, সৎ কাজ ও আল্লাহভীতির সংমিশ্রণ।
📖 “قُل لَّا يَسْتَوِي ٱلْخَبِيثُ وَٱلطَّيِّبُ
وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ ٱلْخَبِيثِۚ
فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ يَـٰٓأُو۟لِي ٱلْأَلْبَـٰبِ
لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ”
“বলুন, অশুদ্ধ ও শুদ্ধ কখনো সমান নয়,
যদিও অশুদ্ধ জিনিসের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে।
সুতরাং হে বুদ্ধিমানগণ! আল্লাহকে ভয় করো,
যাতে তোমরা সফল হও।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০০)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের শিক্ষা দিচ্ছেন — **যে প্রশ্নের প্রয়োজন নেই, তা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।** বিশেষ করে এমন প্রশ্ন, যা অপ্রয়োজনীয়, কষ্টদায়ক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এটি ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও দাওয়াহ নীতি — **অতি অনুসন্ধান বা সন্দেহ নয়, বরং বিনয় ও আল্লাহর ওপর আস্থা।**
১️ “لَا تَسْـَٔلُوا۟ عَنْ أَشْيَآءَ إِن تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ”
— “তোমরা এমন প্রশ্ন করো না, যা তোমাদের জানানো হলে কষ্ট দেবে।”
এটি এমন প্রশ্নকে নির্দেশ করে, যা নবী ﷺ-এর সময় সাহাবাগণ মাঝে মাঝে করতেন অপ্রয়োজনীয়ভাবে। যেমন — হজের বিস্তারিত সংখ্যা, পশু কোরবানির সীমা, বা সূক্ষ্ম নিয়মাবলী নিয়ে এমনভাবে জানতে চাওয়া, যা তাদের জন্য পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক হয়ে যেত। 📖 সহিহ মুসলিমে এসেছে — রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আমাকে যতোক্ষণ না আমি কিছু নিষেধ করি, ততোক্ষণ প্রশ্ন করো না। কারণ পূর্ববর্তী জাতি অতি প্রশ্ন ও নবীদের সাথে বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩৩৭)
২️ “وَإِن تَسْـَٔلُوا۟ عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ ٱلْقُرْءَانُ تُبْدَ لَكُمْ”
— “আর যদি কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করো, তা তোমাদের জানানো হবে।”
অর্থাৎ, যদি প্রকৃত প্রয়োজন হয়, আল্লাহ তখনই এর ব্যাখ্যা প্রকাশ করবেন — কিন্তু অপ্রয়োজনীয় খোঁজার দরকার নেই। ইসলাম এমন ধর্ম নয় যা অন্ধ অনুসন্ধান নিষিদ্ধ করে, বরং এখানে “অতিরিক্ত অনুসন্ধান” যা অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা সৃষ্টি করে, সেটি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
৩️ “عَفَا ٱللَّهُ عَنْهَاۗ وَٱللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ”
— “আল্লাহ তা ক্ষমা করেছেন, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।”
এটি নির্দেশ করে, আল্লাহ তাঁর দয়া ও সহনশীলতার মাধ্যমে সেইসব প্রশ্ন ক্ষমা করেছেন, যেগুলো বান্দারা অজ্ঞানতাবশত বা অতিরিক্ত কৌতূহলবশে করেছিল। আল্লাহর এই ক্ষমা মানুষের জন্য এক বড় রহমত, যা শেখায় — অতীতে করা ভুল নিয়ে হতাশ নয়, বরং ভবিষ্যতে সাবধান হওয়া দরকার।
৪️ এই আয়াতের পটভূমি (Asbabun Nuzool):
তাফসীরবিদগণ বর্ণনা করেছেন — কিছু সাহাবি নবী ﷺ-কে প্রশ্ন করেছিলেন, যেমন — “আমার পিতা কে?”, “আমার মা কোথায়?”, ইত্যাদি। তখন নবী ﷺ অসন্তুষ্ট হন, কারণ এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিল। এর পরেই এই আয়াত নাযিল হয়। (📚 তাফসীর ইবন কাসির)
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
- যে বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূল ব্যাখ্যা দেননি, সে বিষয়ে অতিরিক্ত অনুসন্ধান করা উচিত নয়।
- ইসলাম অতিরিক্ত জটিলতা নয়, বরং সহজতার ধর্ম।
- যে প্রশ্ন মানুষকে বিভ্রান্ত বা হতাশ করে, তা পরিহার করা উচিত।
- আল্লাহ অজান্তে করা ভুল ক্ষমা করেন — তিনি গাফূর ও হালীম।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজকের যুগে ধর্মের নামে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক হয় — এগুলো আল্লাহর বাণী থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- ধর্ম বোঝার জন্য কৌতূহল দরকার, কিন্তু তা যেন সীমা না ছাড়ায়।
- মুমিনের কাজ হলো আল্লাহর প্রকাশিত নির্দেশ মেনে চলা, অতিরিক্ত প্রশ্নে জড়ানো নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমার উম্মতকে আমি যতটা ভয় করি, তার মধ্যে একটি হলো অতি প্রশ্ন ও অহেতুক বিতর্ক।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭২৮৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০১):
- অপ্রয়োজনীয় ও কষ্টদায়ক প্রশ্ন থেকে বিরত থাকা উচিত।
- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য সহজতা চান, জটিলতা নয়।
- প্রয়োজনীয় প্রশ্ন ও অনুসন্ধান অবশ্যই করা উচিত, কিন্তু বিনয়সহকারে।
- আল্লাহ ক্ষমাশীল ও ধৈর্যশীল — বান্দার ভুলে তিনি দয়া করেন।
উপসংহার:
এই আয়াত আমাদের শেখায় —
ইসলাম চিন্তা ও প্রশ্নের ধর্ম, কিন্তু তা সীমার মধ্যে হওয়া চাই।
এমন প্রশ্ন নয় যা অশান্তি বা সন্দেহ সৃষ্টি করে,
বরং এমন প্রশ্ন যা হিদায়াত ও আমলে সাহায্য করে।
আল্লাহ আমাদের এমন প্রশ্ন থেকে রক্ষা করুন যা কষ্ট বা বিভ্রান্তি আনে,
এবং আমাদের চিন্তাকে হিদায়াতময় প্রশ্নের দিকে পরিচালিত করুন। 🌿
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
لَا تَسْـَٔلُوا۟ عَنْ أَشْيَآءَ
إِن تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْۖ
وَإِن تَسْـَٔلُوا۟ عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ ٱلْقُرْءَانُ
تُبْدَ لَكُمْۚ
عَفَا ٱللَّهُ عَنْهَاۗ
وَٱللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ”
“হে মুমিনগণ! এমন বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা তোমাদের জানানো হলে কষ্ট দেবে।
আল্লাহ তা ক্ষমা করেছেন; তিনি ক্ষমাশীল ও সহনশীল।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০১)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (৫:১০১) ধারাবাহিকতা, যেখানে অপ্রয়োজনীয় ও জটিল প্রশ্ন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এখানে আল্লাহ অতীতের এক বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছেন — **পূর্ববর্তী জাতিগণ অতিরিক্ত প্রশ্ন ও জটিল অনুসন্ধানের কারণে হিদায়াত হারিয়েছিল।**
১️ “قَدْ سَأَلَهَا قَوْمٞ مِّن قَبْلِكُمْ”
— “তোমাদের পূর্ববর্তী এক সম্প্রদায়ও এই ধরনের প্রশ্ন করেছিল।”
এটি ইঙ্গিত করছে **বনু ইসরাইলের** দিকে। তারা বারবার নবী মূসা (আঃ)-এর কাছে এমন প্রশ্ন করেছিল, যেগুলো অপ্রয়োজনীয় ও জটিল ছিল। উদাহরণস্বরূপ — যখন আল্লাহ তাদেরকে একটি গরু কোরবানি করতে বলেছিলেন (সূরা আল-বাকারা: ৬৭-৭১), তারা বারবার প্রশ্ন করেছিল: “গরুটি কেমন হবে?”, “এর রং কী?”, “বয়স কত?”, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত কাজটি জটিল হয়ে পড়েছিল, যা শুরুতে সহজ ছিল। 📖 কুরআনে আল্লাহ বলেন — *“তারা বলল: তোমার প্রতিপালকের কাছে দোয়া কর, যেন তিনি আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। আমরা তো বুঝতে পারছি না কোন গরুটা।”* — (সূরা আল-বাকারা ২:৬৮) এই ধরণের অতিরিক্ত অনুসন্ধান তাদের হৃদয় কঠিন করে দেয়, ফলে তারা অবশেষে আনুগত্য হারিয়ে ফেলে।
২️ “ثُمَّ أَصْبَحُوا۟ بِهَا كَـٰفِرِينَ”
— “তারপর তারা সে কারণেই অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল।”
অর্থাৎ, তারা অতিরিক্ত প্রশ্নের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল, যা শেষে **অবিশ্বাস ও বিদ্রোহে** পরিণত হয়েছিল। তারা ভাবত যে, আল্লাহর নির্দেশের পেছনে আরও কোনো গোপন কারণ আছে — এই সন্দেহ তাদের ঈমান ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই আয়াত আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে: **সন্দেহ ও অতি কৌতূহল ঈমান নষ্ট করতে পারে।**
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “মানুষ সেই সময় পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে, যতক্ষণ না তারা অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করতে শুরু করে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭২৮৯)
৩️ ইসলামী শিক্ষা:
- পূর্ববর্তী জাতিরা অতিরিক্ত প্রশ্ন ও বিতর্কের কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে।
- অন্ধ অনুসন্ধান ও সন্দেহ ঈমানকে দুর্বল করে দেয়।
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর আদেশের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত।
- সাদাসিধে ঈমান ও আনুগত্যই প্রকৃত মুসলিমের গুণ।
৪️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও অনেকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। এতে ঈমানের স্বচ্ছতা নষ্ট হয়।
- ধর্ম বুঝতে হলে বিনয় ও আল্লাহভীতির সঙ্গে শেখা উচিত, অহংকার নিয়ে নয়।
- ইসলাম যুক্তি গ্রহণ করে, কিন্তু সীমাহীন সন্দেহ ও বিতর্ক নিরুৎসাহিত করে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন ও বিতর্ক ত্যাগ করে, আল্লাহ তার হৃদয়কে ঈমানে পরিপূর্ণ করে দেন।” (📖 তিরমিজি, হাদিস: ২০০৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০২):
- অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন ঈমানকে দুর্বল করে দেয়।
- পূর্ববর্তী জাতিগণ অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণে ধ্বংস হয়েছে।
- আল্লাহ ও রাসূলের আদেশে সন্দেহ নয়, বরং পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত।
- জটিল প্রশ্ন ও বিতর্ক থেকে দূরে থাকা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার:
এই আয়াত অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানায়।
আল্লাহ সতর্ক করছেন — পূর্ববর্তী জাতিগণ যেমন অতি অনুসন্ধান ও জটিল প্রশ্নে পতিত হয়েছিল,
তেমন যেন মুসলিম উম্মাহ না হয়।
ইসলাম জ্ঞানের ধর্ম, কিন্তু তার ভিত্তি হলো **আস্থা ও আনুগত্য।**
সত্য জানার কৌতূহল প্রশংসনীয়, কিন্তু সন্দেহের ভিত্তিতে প্রশ্ন করা বিপজ্জনক।
আল্লাহ আমাদের এমন হৃদয় দিন, যা প্রশ্ন করে জ্ঞান লাভের জন্য,
বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য নয়। 🌿
📖 “قَدْ سَأَلَهَا قَوْمٞ مِّن قَبْلِكُمْ
ثُمَّ أَصْبَحُوا۟ بِهَا كَـٰفِرِينَ”
“তোমাদের পূর্ববর্তী এক সম্প্রদায়ও এই ধরনের প্রশ্ন করেছিল,
তারপর তারা সে কারণেই অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০২)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা **জাহিলিয়াত যুগের কুসংস্কার ও মিথ্যা ধর্মীয় রীতি**-র প্রতিবাদ করেছেন। কুরআনের এই অংশে চারটি শব্দ এসেছে — “বাহীরা”, “সায়েবা”, “ওয়াসীলা”, ও “হাম” — যেগুলো ছিল আরবদের বানানো পশু-সংক্রান্ত কুসংস্কার।
১️ “مَا جَعَلَ ٱللَّهُ مِنۢ بَحِيرَةٖ وَلَا سَآئِبَةٖ وَلَا وَصِيلَةٖ وَلَا حَامٖ”
— “আল্লাহ বাহীরা, সায়েবা, ওয়াসীলা ও হাম নামে কোনো ব্যবস্থা নির্ধারণ করেননি।”
এই চারটি ছিল পশু সম্পর্কিত কুসংস্কার, যা আরবরা নিজেদের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে চালু করেছিল। তারা ভাবতো, এসব পশুকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে স্বাধীন করে দিলে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন!
🔹 বাহীরা (بحیرة): এক উটনি যে পাঁচবার বাচ্চা দিয়েছে এবং শেষ বাচ্চা মেয়ে হলে, তারা সেই উটনির কান চিরে দিয়ে বলতো — এখন এটি “বাহীরা”, এটি আর কাজ করবে না, কেউ এর দুধ পান করতে পারবে না।
🔹 সায়েবা (سائبة): যদি কেউ কোনো মানত করে বলতো — “আমার এই ইচ্ছা পূর্ণ হলে এই উট আল্লাহর নামে স্বাধীন থাকবে,” তবে সে উটকে ছেড়ে দিতো, কেউ তা ব্যবহার করতে পারতো না।
🔹 ওয়াসীলা (وصیلة): কোনো উট যদি একসঙ্গে ছেলে ও মেয়ে বাচ্চা দিত, তারা বলতো, “এটি আশীর্বাদপ্রাপ্ত,” এবং তাকে স্বাধীন করে দিতো।
🔹 হাম (حام): একটি পুরুষ উট যেটি অনেক বাচ্চার পিতা হয়েছে, তারা ভাবতো — এখন এটি ‘আল্লাহর নামে সম্মানিত,’ তাই তাকে আর কাজে লাগানো যাবে না।
এইসব প্রথা ছিল সম্পূর্ণ **আল্লাহর বিধানের বিপরীত ও মূর্খতাপূর্ণ কুসংস্কার।** মানুষ নিজেরা এসব বানিয়ে আল্লাহর নামে চালাতো — যেন এটি ধর্মীয় কাজ!
২️ “وَلَـٰكِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يَفْتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَ”
— “বরং যারা অবিশ্বাস করেছে, তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে।”
আল্লাহ বলছেন — এইসব প্রথা আমার নয়, বরং অবিশ্বাসীরা নিজেরাই এগুলো তৈরি করেছে এবং সেগুলোকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছে। তারা নিজেদের কল্পনা দিয়ে আল্লাহর নামে এমন অনেক নিয়ম বানিয়েছিল, যেমন — “এই পশু হারাম”, “ওই দুধ পবিত্র”, “এটি উৎসর্গিত”, ইত্যাদি। 📖 আল্লাহ বলেন — *“তারা বলে, এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের উপাস্যদের জন্য।”* — (সূরা আল-আন‘আম ৬:১৩৬) এটি দেখায়, **ধর্মে নতুন কিছু উদ্ভাবন (বিদআত)** কত বড় বিপদ।
৩️ “وَأَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ”
— “অথচ তাদের অধিকাংশই বুদ্ধি খাটায় না।”
অর্থাৎ তারা অন্ধভাবে প্রথা অনুসরণ করত, কোনো যুক্তি, চিন্তা বা কুরআনের নির্দেশনা ছাড়াই। এটি আজকের অনেক সমাজেও দেখা যায় — মানুষ সত্য যাচাই না করেই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে বসে। আল্লাহ এখানে মানুষকে আহ্বান করছেন — **ধর্মে বুদ্ধি, জ্ঞান ও যাচাই-বাছাই ব্যবহার করো।**
৪️ ইসলামী শিক্ষা:
- ধর্মে নিজের মনগড়া প্রথা চালু করা হারাম ও বিপজ্জনক।
- আল্লাহর নাম ব্যবহার করে মিথ্যা রীতি উদ্ভাবন করা কুফরি আচরণ।
- ইসলাম কুসংস্কার নয়, যুক্তি ও আল্লাহর নির্দেশের ধর্ম।
- সত্য জানার জন্য বুদ্ধি, কুরআন ও সুন্নাহকে অনুসরণ করা উচিত।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও অনেক সমাজে “ধর্মের নামে” মনগড়া প্রথা চলে — যেমন কবরপূজা, তাবিজ, মানত ইত্যাদি।
- ইসলাম এসব থেকে মুক্ত; এটি কেবল আল্লাহর নির্ধারিত পথে চলে।
- আল্লাহর নামে কিছু উদ্ভাবন করা মানে, আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করা।
- প্রকৃত ঈমান মানে — কুসংস্কার নয়, বরং কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর পথে থাকা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আমাদের দীন-ধর্মে এমন কিছু উদ্ভাবন করে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৬৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭১৮)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৩):
- ইসলাম কুসংস্কার ও মনগড়া প্রথার বিরোধী।
- আল্লাহর নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করা কঠিন অপরাধ।
- ধর্ম বোঝার ক্ষেত্রে চিন্তা ও জ্ঞান ব্যবহার করা জরুরি।
- বিদআত ও অন্ধ অনুকরণ ঈমানের ক্ষতি করে।
উপসংহার:
এই আয়াত মানুষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় —
**ধর্ম কখনো মানুষের বানানো নিয়ম নয়।**
আল্লাহই একমাত্র বিধানদাতা,
আর তাঁর প্রকাশিত কিতাব ও নবী ﷺ-এর শিক্ষা ব্যতীত কিছুই “ইসলামী” নয়।
তাই আল্লাহ আমাদের এমন সমাজ থেকে রক্ষা করুন,
যেখানে কুসংস্কার ও বিদআত আল্লাহর নামে প্রচারিত হয়,
এবং আমাদের কুরআনের আলোতে সত্যকে চিনতে শিখিয়ে দিন। 🌿
📖 “مَا جَعَلَ ٱللَّهُ مِنۢ بَحِيرَةٖ وَلَا سَآئِبَةٖ وَلَا وَصِيلَةٖ وَلَا حَامٖۙ
وَلَـٰكِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يَفْتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَۖ
وَأَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ”
“আল্লাহ বাহীরা, সায়েবা, ওয়াসীলা ও হাম নির্ধারণ করেননি;
বরং যারা অবিশ্বাস করেছে, তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে,
অথচ তাদের অধিকাংশই বুদ্ধি খাটায় না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৩)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে এক গুরুতর মানসিক রোগ থেকে সতর্ক করছেন — তা হলো **অন্ধ অনুসরণ (تَقْلِيدُ الأَعْمَى / Taqlīd al-a‘mā)**, অর্থাৎ — যুক্তি, প্রমাণ ও সত্য যাচাই না করে কেবল পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করা। এটি ছিল **জাহিলিয়াত যুগের মুশরিকদের প্রধান অজুহাত**, যা আজও অনেক সমাজে দেখা যায়।
১️ “وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا۟ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ”
— “যখন তাদের বলা হয় — এসো, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন ও রাসূলের দিকে।”
এখানে আহ্বান করা হয়েছে **কুরআন ও রাসূল ﷺ-এর শিক্ষা অনুসরণে।** কিন্তু মুশরিকরা বা বিভ্রান্ত সম্প্রদায়েরা সেই আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করত। এটি কেবল মুশরিকদের নয় — বরং আজকের অনেক মানুষও আল্লাহর বাণীর পরিবর্তে নিজেদের “সংস্কৃতি” বা “পুরাতন রীতি” অনুসরণ করে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“তোমরা কি পিতৃপুরুষদের অনুসরণ করবে, যদিও তারা কিছুই বুঝত না ও পথনির্দেশপ্রাপ্ত ছিল না?”* — (সূরা আল-বাকারা ২:১৭০)
২️ “قَالُوا۟ حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ ءَابَآءَنَا”
— “তারা বলে — আমাদের জন্য যথেষ্ট যা আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর পেয়েছি।”
এটি ছিল তাদের অজুহাত — তারা সত্য জানতে চায়নি, বরং পূর্বপুরুষদের রীতিকে ‘ধর্ম’ ভেবে আঁকড়ে ধরেছিল। তারা মনে করত — “আমাদের পিতৃপুরুষরা ভুল হতে পারে না।” অথচ সত্য হলো, **মানুষ ভুল করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর বাণী কখনো ভুল নয়।** 📖 কুরআনে বলা হয়েছে — *“তারা বলে, আমরা সেই পথেই আছি যা আমাদের পিতারা ছিল।”* — (সূরা যুখরুফ ৪৩:২২)
৩️ “أَوَلَوْ كَانَ ءَابَآؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْـٔٗا وَلَا يَهْتَدُونَ”
— “যদিও তাদের পূর্বপুরুষ কিছুই জানত না এবং সৎপথেও ছিল না!”
আল্লাহ এখানে যুক্তিগত প্রশ্ন করেছেন — যদি তাদের পূর্বপুরুষ অজ্ঞ ও পথভ্রষ্ট হয়, তবে কি তাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করা যুক্তিসঙ্গত? এই অংশে ইসলাম মানুষকে আহ্বান করছে — **চিন্তা করো, যাচাই করো, তারপর অনুসরণ করো।** ধর্মে বুদ্ধি, প্রমাণ ও কুরআনের আলোকেই চলতে হবে।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি অন্ধভাবে অনুসরণ করে, অথচ প্রমাণ জানে না, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যু বরণ করবে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮৫১)
৪️ ইসলামী শিক্ষা:
- সত্য যাচাই না করে অন্ধভাবে কারো অনুসরণ করা ইসলাম সমর্থন করে না।
- আল্লাহর বাণী ও রাসূল ﷺ-এর নির্দেশই একমাত্র মাপকাঠি।
- সংস্কৃতি, বংশ বা রীতিকে সত্যের উপরে স্থান দেওয়া গুনাহ।
- সত্য গ্রহণে বিনয় ও চিন্তা থাকা উচিত।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজ অনেক মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে বলে — “আমাদের বাপ-দাদারা এমন করতো, আমরাও তাই করবো।” অথচ তারা জানে না সেই প্রথা কুরআনসম্মত কি না।
- ইসলাম মানুষকে চিন্তা করতে, প্রমাণ খুঁজতে ও জ্ঞানের পথে চলতে শেখায়।
- অন্ধ অনুকরণে নয়, বরং যুক্তি ও ঈমানের আলোয় সত্য অনুসরণ করা উচিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে আমার সুন্নাহর বিপরীতে চলে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৭৩১১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৪):
- আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর শিক্ষা সর্বোচ্চ, কোনো সংস্কৃতি তার বিকল্প নয়।
- অন্ধ অনুকরণ (তাকলিদ) ঈমানের জন্য ক্ষতিকর।
- চিন্তা, প্রমাণ ও আল্লাহভীতির সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
- মানুষের কাজ নয়, বরং আল্লাহর হুকুমই চূড়ান্ত সত্য।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে শেখাচ্ছেন —
সত্য জানতে হলে **কুরআন ও রাসূল ﷺ**-এর দিকে ফিরে আসো।
পুরাতন প্রথা, বংশ বা সমাজের অন্ধ অনুকরণে নয়,
বরং জ্ঞান ও আল্লাহভীতির মাধ্যমে পথ বেছে নাও।
ইসলামী জীবনধারা মানে —
আল্লাহর প্রকাশিত বিধান অনুসারে বেঁচে থাকা,
না যে সমাজ যেমন করে, তেমনভাবে চলা।
আল্লাহ আমাদের এমন হৃদয় দিন,
যা অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং চিন্তা, জ্ঞান ও ঈমানের আলোয় পরিচালিত হয় 🌿
📖 “وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا۟ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ
قَالُوا۟ حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ ءَابَآءَنَآۚ
أَوَلَوْ كَانَ ءَابَآؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْـٔٗا
وَلَا يَهْتَدُونَ”
“আর যখন তাদের বলা হয় —
‘এসো, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন ও রাসূলের দিকে,’
তারা বলে — ‘আমাদের জন্য যথেষ্ট যা আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর পেয়েছি,’
যদিও তাদের পূর্বপুরুষ কিছুই জানত না ও সৎপথে ছিল না!”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৪)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের শিক্ষা দিচ্ছেন — **নিজেদের আমল, ঈমান ও দায়িত্বের দিকে মনোযোগ দাও।** অন্য কেউ বিভ্রান্ত বা অন্যায় পথে গেলে, তোমরা যদি সঠিক পথে থাকো, তাহলে তাদের পথভ্রষ্টতা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এটি মুমিনের জন্য **ইস্তিকামাত (অটলতা)** ও **ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা**র এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
১️ “عَلَيْكُمْ أَنفُسَكُمْ”
— “তোমরা নিজেদের দায়িত্বে মনোযোগ দাও।”
অর্থাৎ, নিজের ঈমান, আমল, নৈতিকতা ও তাকওয়া ঠিক রাখো। অন্যের ভুল বা অন্যায় দেখে হতাশ হয়ো না, বরং নিজের সংশোধন ও সৎপথে থাকার চেষ্টা করো। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন মানুষ অন্যায় দেখে তাও পরিবর্তন না করে, তখন আল্লাহ তাদের সকলের ওপর শাস্তি প্রেরণ করেন।” (📖 সহিহ তিরমিজি, হাদিস: ২১৬৮)
তবে, “নিজেদের দায়িত্বে মনোযোগ দাও” — এর মানে **অন্যকে সৎ পথে আহ্বান করা ছেড়ে দাও** — তা নয়। বরং অর্থ হলো, যখন সমাজ এতটাই দূষিত হয়ে যায় যে উপদেশেও তারা সাড়া দেয় না, তখন নিজের ঈমান রক্ষা করাই অগ্রাধিকার।
📖 সহিহ বুখারীতে এসেছে — রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “এক সময় আসবে যখন মানুষ উপদেশ গ্রহণ করবে না; তখন তুমি নিজের আমল ও ঈমান রক্ষায় মনোযোগ দাও।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৬০৫)
২️ “لَا يَضُرُّكُم مَّن ضَلَّ إِذَا ٱهْتَدَيْتُمْ”
— “তোমরা সৎপথে থাকলে, পথভ্রষ্টরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।”
অর্থাৎ, যারা সত্যকে অস্বীকার করে, ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের গোমরাহী তোমার ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না — যদি তুমি নিজে হিদায়াতের পথে দৃঢ় থাকো। এটি এক মহান আশা — যে ব্যক্তি একা হলেও সৎপথে থাকে, আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন।
৩️ “إِلَى ٱللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعٗا”
— “তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকেই।”
অর্থাৎ, এই দুনিয়ার সব অন্যায় ও ভুলের হিসাব শেষ বিচারে আল্লাহর সামনে হবে। সুতরাং তুমি নিজের আমলের জন্য প্রস্তুত হও, অন্যের আমলে নয়।
৪️ “فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ”
— “তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন তোমরা যা করতে।”
এটি কিয়ামতের হিসাবের কথা — আল্লাহ প্রতিটি ব্যক্তিকে তার নিজের কাজ অনুযায়ী বিচার করবেন। কেউ অন্যের গুনাহ বহন করবে না, যেমন আল্লাহ বলেন — *“কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না।”* — (সূরা আন‘আম ৬:১৬৪)
ইমাম ইবন কাসির (রহ.) বলেন — “এই আয়াতের অর্থ হলো, যখন মানুষ সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি অমনোযোগী হয়ে যায়, তখন তুমি নিজের ঈমান ও আমল রক্ষা করো, কারণ আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে তার নিজের কর্ম অনুযায়ী বিচার করবেন।”
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
- নিজের ঈমান ও নৈতিকতা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা মুমিনের প্রথম কর্তব্য।
- অন্যের পথভ্রষ্টতা আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না যদি আমরা হিদায়াতে দৃঢ় থাকি।
- কিয়ামতের দিন প্রত্যেকে নিজের কাজের জবাবদিহি করবে।
- সমাজ নষ্ট হলে নিজের আমল ঠিক রাখা সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজ সমাজে যখন অন্যায়, ভ্রষ্টতা ও গাফেলতায় ভরে গেছে, তখন মুমিনের কাজ হলো নিজের ঈমান অটুট রাখা।
- সৎ পথে থাকা মানুষকে হতাশ হওয়া উচিত নয়, কারণ আল্লাহ তার আমল বৃথা যেতে দেবেন না।
- আল্লাহর সামনে প্রত্যেকে একা দাঁড়াবে — তাই নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাই মূল কাজ।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যখন তুমি দেখবে মানুষ দুনিয়ার প্রতি লোভী হয়ে পড়েছে, তখন তুমি নিজের আমল ও ঈমান নিয়ে ব্যস্ত থাকো।” (📖 সহিহ ইবন হিববান, হাদিস: ৬৮৩)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৫):
- নিজের আমল ও ঈমানের প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে।
- অন্যের ভুলের কারণে হতাশ হওয়া উচিত নয়।
- হিদায়াতের পথে দৃঢ় থাকা আল্লাহর সুরক্ষার নিশ্চয়তা।
- কিয়ামতের দিন ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা অপরিহার্য।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের শিক্ষা দিচ্ছেন —
সমাজে অন্যায়, পাপ বা বিভ্রান্তি যতই বাড়ুক,
তোমার কাজ হলো নিজের ঈমান ও আমল রক্ষা করা।
ইসলাম আমাদের শেখায় —
নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করো, অন্যদের দোষে নয়,
বরং নিজের সংশোধনে ব্যস্ত থাকো।
আল্লাহ বলেন —
*“যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সে-ই সফল।”*
— (সূরা আশ-শামস ৯১:৯)
আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দিন
যেন আমরা নিজেদের আত্মাকে হিদায়াতের পথে রাখি
এবং অন্যদের জন্য কল্যাণের দৃষ্টান্ত হই 🌿
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
عَلَيْكُمْ أَنفُسَكُمْ
لَا يَضُرُّكُم مَّن ضَلَّ إِذَا ٱهْتَدَيْتُمْۚ
إِلَى ٱللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعٗا
فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ”
“হে মুমিনগণ!
তোমরা নিজেদের দায়িত্বে মনোযোগ দাও।
কেউ পথভ্রষ্ট হলে, তোমরা সৎপথে থাকলে তা তোমাদের ক্ষতি করবে না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইসলামী সমাজে **উইল (ওসিয়ত)** ও **সাক্ষ্যদানের ন্যায়নীতি** সম্পর্কে বিশদ নির্দেশ দিয়েছেন। মৃত্যুর মুহূর্তে, সম্পদ ও দায়িত্ব যেন সঠিকভাবে বণ্টিত হয়, সে জন্য ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীর উপস্থিতি অপরিহার্য করা হয়েছে।
১️ “شَهَـٰدَةُ بَيْنِكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلْمَوْتُ”
— “যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সাক্ষ্যদান তোমাদের মধ্যে।”
অর্থাৎ, যখন কেউ মৃত্যুর কাছাকাছি আসে এবং নিজের সম্পদের ব্যাপারে ওসিয়ত করতে চায়, তখন দুইজন নিরপেক্ষ ও সৎ সাক্ষী রাখা বাধ্যতামূলক। এটি সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া, প্রতারণা বা মিথ্যাচার থেকে বাঁচার ব্যবস্থা।
২️ “ٱثْنَانِ ذَوَا عَدْلٖ مِّنكُمْ”
— “তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি।”
অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্য থেকে এমন দুজন সাক্ষী, যারা সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ। তারা ওসিয়তের বিষয় সঠিকভাবে জানবে এবং পরে গোপন করবে না।
৩️ “أَوْ ءَاخَرَانِ مِنْ غَيْرِكُمْ”
— “অথবা তোমাদের ব্যতীত অন্য জাতির দুইজন।”
অর্থাৎ যদি কোনো কারণে মুসলিম সাক্ষী পাওয়া না যায় (যেমন সফরে), তবে অমুসলিমও সাক্ষী হতে পারে — তবে শর্ত হলো, তারা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। এই বিধান ইসলামের **বিচারিক নমনীয়তা ও বাস্তবতা** প্রকাশ করে — ইসলাম এমন ধর্ম নয় যা অমানবিক বা কঠোর।
৪️ “تَحْبِسُونَهُمَا مِنۢ بَعْدِ ٱلصَّلَوٰةِ فَيُقْسِمَانِ بِٱللَّهِ”
— “নামাজের পর তাদের আটক রাখবে এবং তারা আল্লাহর নামে শপথ করবে।”
এটি সাক্ষ্য গ্রহণের শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতি নির্দেশ করছে। নামাজের পর (সম্ভবত আসর বা মাগরিবের পর) শপথ নেওয়া হতো, যাতে উপস্থিত সবাই আল্লাহকে স্মরণ করে — এবং সাক্ষীরা মিথ্যা বলতে সাহস না পায়।
৫️ “لَا نَشْتَرِي بِهِۦ ثَمَنٗا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ”
— “আমরা এ সাক্ষ্য দ্বারা কোনো দাম বিক্রি করবো না, যদিও তা আত্মীয়ের পক্ষেও হয় না।”
অর্থাৎ সাক্ষী যেন কখনো ঘুষ, স্বার্থ বা আত্মীয়তার কারণে সত্য গোপন না করে। সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা বা অর্থ নয় — **আল্লাহর ভয়**ই মূল। 📖 আল্লাহ বলেন — *“তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় হও, এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দাও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যায়।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:১৩৫)
৬️ “وَلَا نَكْتُمُ شَهَـٰدَةَ ٱللَّهِ”
— “আমরা আল্লাহর সাক্ষ্য গোপন করবো না।”
অর্থাৎ সত্য সাক্ষ্য গোপন করা আল্লাহর দৃষ্টিতে পাপ। মিথ্যা সাক্ষ্য ইসলামি শরিয়তে **বড় কবীরা গুনাহ**। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমাদের কি আমি বড় গুনাহের কথা বলবো না? তা হলো — আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৬৫৪)
৭️ ইসলামী শিক্ষা:
- উইল (ওসিয়ত) করার সময় ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী থাকা জরুরি।
- সত্য সাক্ষ্য আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব — এটি গোপন করা গুনাহ।
- অমুসলিম সাক্ষীও গ্রহণযোগ্য, যদি অন্য কেউ উপস্থিত না থাকে।
- সাক্ষ্য কখনো বিক্রি করা যাবে না, ঘুষ বা আত্মীয়তার কারণে নয়।
৮️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজকের যুগে চুক্তিপত্র, সম্পত্তি বা ওসিয়ত লেখার সময় আইনি সাক্ষী রাখা জরুরি।
- সত্যনিষ্ঠ সাক্ষ্য সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।
- মিথ্যা সাক্ষ্য আদালত ও সমাজ উভয়কেই ধ্বংস করে দেয়।
- প্রত্যেকে নিজের বিবেক ও ঈমানের সামনে দায়বদ্ধ।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৬):
- উইল ও সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে আল্লাহভীতি সর্বোচ্চ প্রয়োজন।
- সাক্ষ্য বিক্রি করা বা গোপন করা ইসলামি নীতির পরিপন্থী।
- ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠায় সাক্ষীদের ভূমিকা অপরিহার্য।
- আল্লাহর নামেই সত্য বলা উচিত, তা আত্মীয়ের বিরুদ্ধেও হোক।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ এক সম্পূর্ণ **ন্যায়বিচারিক ব্যবস্থা** প্রতিষ্ঠা করেছেন —
যাতে মৃত্যুর পর সম্পদের সঠিক বণ্টন ও অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়।
সাক্ষী নির্বাচন, সত্য বলা ও শপথের বিধান —
এগুলো ইসলামী সমাজে ন্যায় ও আস্থার ভিত্তি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এমন হৃদয় দিন,
যা সত্য সাক্ষ্যে অটল থাকে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে দূরে থাকে 🌿
📖 “يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟
شَهَـٰدَةُ بَيْنِكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلْمَوْتُ
حِينَ ٱلْوَصِيَّةِ ٱثْنَانِ ذَوَا عَدْلٖ مِّنكُمْ
أَوْ ءَاخَرَانِ مِنْ غَيْرِكُمْ ...”
“হে মুমিনগণ!
যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়,
তখন তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি সাক্ষী হোক...”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৬)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের (সূরা মায়েদা: ১০৬) পরবর্তী ধাপ — অর্থাৎ যদি **সাক্ষী প্রতারণা করে** বা মিথ্যা বলে, তখন ইসলামী সমাজে তার পরিবর্তে **দ্বিতীয় সাক্ষী দল** কীভাবে দাঁড়াবে, তার বিস্তারিত নির্দেশনা এখানে দেওয়া হয়েছে। এটি ইসলামী বিচার ব্যবস্থার **ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা**র এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
১️ “فَإِنْ عُثِرَ عَلَىٰٓ أَنَّهُمَا ٱسْتَحَقَّآ إِثْمٗا”
— “যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে তারা গোনাহের যোগ্য হয়েছে।”
অর্থাৎ, যদি আগের সাক্ষীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, বা কারো ক্ষতির জন্য সত্য গোপন করে, তখন তাদের অপরাধ প্রকাশ হলে তারা আর সাক্ষী হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম কখনোই সাক্ষীকে অপরাধীর ওপরে স্থান দেয় না — বরং সত্যের ওপরে সবাইকে বিচার করা হয়।
২️ “فَـَٔاخَرَانِ يَقُومَانِ مَقَامَهُمَا”
— “তবে অন্য দুইজন সাক্ষী তাদের স্থলে দাঁড়াবে।”
এই নতুন সাক্ষীরা হবে সেই পক্ষের, যারা প্রথম সাক্ষীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা যাদের ওপর অন্যায় হয়েছে। তারা আল্লাহর নামে শপথ করবে এবং আগের সাক্ষীদের মিথ্যা প্রকাশ করবে।
৩️ “فَيُقْسِمَانِ بِٱللَّهِ لَشَهَـٰدَتُنَآ أَحَقُّ مِن شَهَـٰدَتِهِمَا”
— “তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে — আমাদের সাক্ষ্য তাদের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক সত্য।”
ইসলামী আদালতে সাক্ষ্য একটি **আমানত (trust)**। তাই যদি পূর্ববর্তী সাক্ষীরা অন্যায় করে, তাহলে সত্যনিষ্ঠ সাক্ষীরা দাঁড়িয়ে আল্লাহর নামে শপথ করে সত্য প্রকাশ করবে।
এই শপথের মধ্যে রয়েছে **আল্লাহভীতি (Taqwa)** ও **ন্যায়বিচারের চেতনা**। ইসলাম প্রত্যেক সাক্ষীকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৪️ “وَمَا ٱعْتَدَيْنَآ إِنَّآ إِذٗا لَّمِنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ”
— “আমরা অন্যায় করিনি; করলে আমরা নিশ্চয়ই অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত।”
এই অংশটি শপথের শেষ অংশ, যেখানে সাক্ষীরা নিজেদের সততার প্রমাণ দেয় — যে তারা কোনো পক্ষপাত, ঘুষ বা প্রতিহিংসা থেকে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্য বলছে। 📖 আল্লাহ বলেন — *“আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষ্য দাও, যদিও তা তোমাদের নিজের বা আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যায়।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:১৩৫)
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
- যদি কোনো সাক্ষী অসৎ প্রমাণিত হয়, তার পরিবর্তে নতুন সাক্ষী দাঁড়াতে পারে।
- সত্য প্রতিষ্ঠা সাক্ষীর সর্বোচ্চ দায়িত্ব; মিথ্যা সাক্ষ্য ইসলামি সমাজে অগ্রহণযোগ্য।
- সত্যের ওপর ভিত্তি করে ন্যায়বিচারই ইসলামের মূল লক্ষ্য।
- আল্লাহর নামে শপথ মানে — আল্লাহর সামনে জবাবদিহি স্মরণ রাখা।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজকের বিচার ব্যবস্থায়ও এই নীতি প্রযোজ্য — প্রমাণিত অসৎ সাক্ষীকে বাতিল করে নতুন সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
- ন্যায়বিচারের জন্য সাক্ষীর সততা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ।
- মিথ্যা সাক্ষী সমাজের আস্থা ও ন্যায় ধ্বংস করে দেয়।
- আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতার চেতনা থাকলে মানুষ কখনও মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যাপারে সাবধান থাকো, কারণ এটি শিরকের পরেই সবচেয়ে বড় গুনাহ।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৬৫৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৭)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৭):
- সত্য সাক্ষ্য ইসলামি সমাজে ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি।
- মিথ্যা সাক্ষী হলে নতুন সাক্ষী দাঁড়িয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
- আল্লাহর নামে শপথ মিথ্যা বলার সুযোগ নয়, বরং ভয়ের প্রতীক।
- ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের পক্ষকেও বিরোধিতা করা ঈমানের নিদর্শন।
উপসংহার:
এই আয়াত ইসলামী ন্যায়বিচারের এমন এক স্তম্ভ প্রকাশ করে,
যেখানে শুধু প্রমাণ নয়, বরং **আল্লাহভীতি ও নৈতিকতা**কেও বিচার প্রক্রিয়ার অংশ বানানো হয়েছে।
সত্য প্রতিষ্ঠা ইসলামি সমাজে শুধু আইনি নয় — এটি এক ইবাদত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এমন সাক্ষী, বিচারক ও মানুষ বানান
যারা সত্যের জন্য দৃঢ় থাকে, যদিও তা নিজের বিরুদ্ধেও যায় 🌿
📖 “فَإِنْ عُثِرَ عَلَىٰٓ أَنَّهُمَا ٱسْتَحَقَّآ إِثْمٗا
فَـَٔاخَرَانِ يَقُومَانِ مَقَامَهُمَا ...”
“যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে তারা গোনাহের যোগ্য হয়েছে,
তবে তাদের স্থলে অন্য দুইজন সাক্ষী দাঁড়াবে,
এবং তারা আল্লাহর নামে শপথ করবে যে আমাদের সাক্ষ্য তাদের চেয়ে অধিক সত্য।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৭)
এই আয়াতটি পূর্ববর্তী দুই আয়াত (সূরা মায়েদা: ১০৬-১০৭)-এর পরিপূরক ও উপসংহার। এখানে আল্লাহ তাআলা **ন্যায়বিচার ও সাক্ষ্যদানের সততা** নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নৈতিক ও আখিরাতভিত্তিক শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামী সমাজে সত্য সাক্ষ্য শুধু আইনি দায় নয়, বরং এটি এক **আখিরাতের আমানত** ও আল্লাহভীতির প্রকাশ।
১️ “ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَن يَأْتُوا۟ بِٱلشَّهَـٰدَةِ عَلَىٰ وَجْهِهَا”
— “এটি এই জন্য — যাতে তারা যথাযথভাবে সাক্ষ্য প্রদান করে।”
অর্থাৎ, সাক্ষীদের শপথ গ্রহণ ও সততার ওপর জোর দেওয়ার উদ্দেশ্য এই যে, তারা যেন আল্লাহর ভয়ে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য দেয়। ইসলামে সাক্ষ্যদান একটি ইবাদত। যখন কেউ সাক্ষ্য দেয়, তখন সে যেন ভাবে — “আমি আদালতে নয়, আল্লাহর সামনে কথা বলছি।”
📖 আল্লাহ বলেন — *“সত্য সাক্ষ্য দাও, যদিও তা তোমার নিজের বা আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যায়।”* — (সূরা আন-নিসা ৪:১৩৫)
২️ “أَوْ يَخَافُوٓا۟ أَن تُرَدَّ أَيْمَـٰنُۢ بَعْدَ أَيْمَـٰنِهِمْ”
— “অথবা তারা এই ভয়ে থাকে যে তাদের শপথের পর অন্যদের শপথ বাতিল না করে দেয়।”
অর্থাৎ, সাক্ষীরা যেন এই চিন্তা করে যে, যদি তারা মিথ্যা বলে, পরে অন্য সাক্ষীরা তাদের শপথ মিথ্যা প্রমাণ করবে। তখন সমাজে তাদের অপমান ও আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহি হবে। তাই এই আয়াত মানুষকে সতর্ক করছে — **মিথ্যা সাক্ষ্য শুধু দুনিয়ার অপরাধ নয়, বরং আখিরাতেরও লজ্জা।**
৩️ “وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَٱسْمَعُوا۟ۗ”
— “আল্লাহকে ভয় করো এবং শুনো।”
এখানে আল্লাহভীতির নির্দেশ দ্বিমুখী — ১️ সাক্ষীদের জন্য — যেন তারা আল্লাহভয়ে সত্য বলে, ২️ বিচারপ্রাপ্তদের জন্য — যেন তারা আল্লাহর বিধান মেনে নেয়। “ওয়াসমা‘উ” অর্থাৎ “শোনো” — মানে হলো, সত্যকে হৃদয়ে গ্রহণ করো, কেবল কানে নয়।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে সত্য সাক্ষ্য গোপন করে, সে যেন আল্লাহর সামনে আগুন গিলে নিচ্ছে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৬৫৩)
৪️ “وَٱللَّهُ لَا يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْفَـٰسِقِينَ”
— “নিশ্চয়ই আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।”
অর্থাৎ, যারা সত্য গোপন করে, মিথ্যা বলে, বা ন্যায়বিচারে কারচুপি করে — আল্লাহ তাদের হিদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন। ইসলাম শুধু বাহ্যিক ন্যায় নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সততা ও তাকওয়াকেও ন্যায়ের অংশ বানিয়েছে।
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
- সত্য সাক্ষ্য প্রদান ইসলামি ন্যায়বিচারের অন্যতম স্তম্ভ।
- আল্লাহভীতি ও জবাবদিহিতার অনুভূতি সাক্ষীর সততা রক্ষা করে।
- মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজে বিভ্রান্তি, শত্রুতা ও অবিচার সৃষ্টি করে।
- আল্লাহ ফাসেক ও প্রতারণাকারীদের হিদায়াত দেন না।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও বিচারব্যবস্থায় সাক্ষীর সততা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- শপথ ও সাক্ষ্য শুধু আইনগত নয়, আধ্যাত্মিক দায়ও বটে।
- ন্যায় ও সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে আস্থা ও শান্তি ফিরে আসে।
- আল্লাহভীতি ছাড়া ন্যায়বিচার কখনো পূর্ণ হতে পারে না।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সর্বোত্তম জিহাদ হলো — অন্যায় শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।” (📖 আবু দাউদ, হাদিস: ৪৩৪৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৮):
- আল্লাহভীতি সত্য বলার প্রেরণা দেয়।
- মিথ্যা সাক্ষ্য পৃথিবী ও আখিরাত উভয়েই ধ্বংস ডেকে আনে।
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর ভয়ই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
- আল্লাহ ফাসেকদের হিদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন।
উপসংহার:
এই আয়াত ন্যায়, সত্য ও আল্লাহভীতির এক মহামূল্যবান শিক্ষা দেয়।
ইসলাম চায় — সমাজে প্রতিটি সাক্ষী, বিচারক ও মুসলমান
এমনভাবে আল্লাহকে স্মরণ রাখুক যেন কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলতে না পারে।
আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহির চেতনা একজন মানুষকে সত্যনিষ্ঠ রাখে,
এবং সেই সমাজে ন্যায়বিচার টিকে থাকে 🌿
📖 “ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَن يَأْتُوا۟ بِٱلشَّهَـٰدَةِ عَلَىٰ وَجْهِهَآ
أَوْ يَخَافُوٓا۟ أَن تُرَدَّ أَيْمَـٰنُۢ بَعْدَ أَيْمَـٰنِهِمْۗ
وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَٱسْمَعُوا۟ۗ
وَٱللَّهُ لَا يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْفَـٰسِقِينَ”
“এটি এই জন্য — যাতে তারা যথাযথভাবে সাক্ষ্য প্রদান করে,
অথবা এই ভয়ে থাকে যে তাদের শপথের পর অন্যদের শপথ বাতিল না করে দেয়।
আল্লাহকে ভয় করো এবং শুনো; নিশ্চয়ই আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৮)
এই আয়াতটি কিয়ামতের এক ভয়াবহ ও মহিমাময় দৃশ্য বর্ণনা করছে — যেখানে আল্লাহ তাআলা সব নবী ও রাসূলকে একত্র করবেন এবং তাদের জিজ্ঞেস করবেন তাদের জাতির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। এটি “দিনুল হিসাব”-এর (বিচারের দিন) এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় — যেখানে এমনকি নবীগণও **আল্লাহর ভয়ে বিনীত হয়ে বলবেন:** “আমাদের কোনো জ্ঞান নেই, হে আল্লাহ! তুমিই সর্বজ্ঞ।”
১️ “يَوْمَ يَجْمَعُ ٱللَّهُ ٱلرُّسُلَ”
— “সেদিন আল্লাহ সমস্ত রাসূলদের একত্র করবেন।”
এই দিনটি হবে সেই মহান দিন — কিয়ামতের দিন, যখন আদম (আঃ) থেকে শুরু করে মুহাম্মদ ﷺ পর্যন্ত সব নবী ও রাসূল একত্র হবেন আল্লাহর সামনে। এটি হবে **জবাবদিহির দিন (يوم الحساب)** — যেখানে আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে জিজ্ঞেস করবেন, তাদের জাতি কেমন আচরণ করেছিল, তারা বার্তা কীভাবে গ্রহণ করেছিল। 📖 আল্লাহ বলেন — *“আমি অবশ্যই রাসূলদের জিজ্ঞাসা করব, এবং তাদের জাতিকেও।”* — (সূরা আল-আ‘রাফ ৭:৬)
২️ “فَيَقُولُ مَاذَآ أُجِبْتُمْۖ”
— “আল্লাহ বলবেন — তোমাদের কী উত্তর দেওয়া হয়েছিল?”
অর্থাৎ, তোমাদের জাতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? তারা কি তোমাদের প্রতি ঈমান এনেছিল, নাকি অস্বীকার করেছিল? এটি এক **দায়বদ্ধতার প্রশ্ন**, যার মাধ্যমে আল্লাহ সকল জাতির জবাবদিহি করবেন।
৩️ “قَالُوا۟ لَا عِلْمَ لَنَآۖ”
— “তারা বলবে — আমাদের কোনো জ্ঞান নেই।”
নবীগণ বিনীতভাবে উত্তর দেবেন — “হে আল্লাহ! আমরা জানি না আজ তারা কী অবস্থায় আছে। আমাদের দাওয়াত পৌঁছানোর পর তারা কী করেছিল, তুমি-ই ভালো জানো।” এটি নবীগণের বিনয়, ভয় ও আল্লাহর সর্বজ্ঞতার প্রতি স্বীকৃতি প্রকাশ করে।
📖 সহিহ হাদীসে আছে — কিয়ামতের দিন নবী ঈসা (আঃ)-কেও জিজ্ঞেস করা হবে: *“তুমি কি মানুষকে বলেছিলে — আমাকে ও আমার মাকে উপাস্য বানাও?”* তখন তিনি বলবেন — *“আমি তো শুধু তোমার আদেশই পৌঁছিয়েছি; তুমি জানো আমি কী বলেছি, আমি জানি না তুমি তাদের কী জানাও।”* — (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৬)
৪️ “إِنَّكَ أَنتَ عَلَّـٰمُ ٱلْغُيُوبِ”
— “নিশ্চয়ই তুমি-ই অদৃশ্য বিষয়ের পূর্ণজ্ঞাত।”
আল্লাহ একমাত্র “**আল্লামুল-গুইয়ূব (অদৃশ্য বিষয়ের সর্বজ্ঞাতা)**” — তিনি জানেন কে সত্য ছিল, কে প্রতারক; কে ঈমানের দাবিদার ছিল, আর কে কপট। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন — কিয়ামতের দিন **সত্য প্রকাশ পাবে, মিথ্যা ধরা পড়বে,** এবং কেউ কিছু গোপন করতে পারবে না।
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
- কিয়ামতের দিন সব নবীকে একত্র করা হবে সাক্ষ্য ও হিসাবের জন্য।
- প্রত্যেক জাতি তাদের রাসূলের কাছে জবাবদিহি করবে।
- আল্লাহই সর্বজ্ঞ, বান্দা সীমিত জ্ঞানের অধিকারী।
- নবীগণও আল্লাহর সামনে বিনীত ও ভীত।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- নবীগণ যেমন আল্লাহর সামনে বিনীত, আমরাও তেমনি আত্মসমর্পিত হওয়া উচিত।
- আল্লাহ সবকিছু জানেন — গোপন ও প্রকাশ্য উভয়ই।
- কিয়ামতের জবাবদিহির চিন্তা মানুষকে ন্যায় ও সততার পথে রাখে।
- মানুষের বিচার করতে গিয়ে আল্লাহর সর্বজ্ঞতাকে স্মরণ রাখতে হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “কিয়ামতের দিন নবীগণ সাক্ষ্য দেবেন, তারপর তাদের জাতিকেও সাক্ষ্য দিতে ডাকা হবে, তারপর আল্লাহ বিচার করবেন।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯০০)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১০৯):
- আল্লাহ সব নবীকে একত্র করবেন কিয়ামতের দিনে।
- নবীগণ আল্লাহর সামনে বিনীত ও ভীত থাকবে।
- আল্লাহ একমাত্র “অদৃশ্য বিষয়ের পূর্ণজ্ঞাত।”
- কিয়ামতের দিন কেউ সত্য গোপন করতে পারবে না।
উপসংহার:
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন —
কিয়ামতের দিন শুধু সাধারণ মানুষ নয়, নবীগণকেও জিজ্ঞাসা করা হবে।
এটি বোঝায় যে, **দায়িত্ব যত বড়, জবাবদিহিও তত বড়।**
আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সেই দিন স্মরণে রেখে
আমাদেরও উচিত নিজের আমল ও দায়িত্বের হিসাব আগে থেকেই করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দিন যেন আমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকি
এবং সেই দিনের জন্য প্রস্তুত হই 🌿
📖 “يَوْمَ يَجْمَعُ ٱللَّهُ ٱلرُّسُلَ
فَيَقُولُ مَاذَآ أُجِبْتُمْۖ
قَالُوا۟ لَا عِلْمَ لَنَآۖ
إِنَّكَ أَنتَ عَلَّـٰمُ ٱلْغُيُوبِ”
“সেদিন আল্লাহ সমস্ত রাসূলদের একত্র করবেন এবং বলবেন —
তোমাদের কী উত্তর দেওয়া হয়েছিল?
তারা বলবে — আমাদের কোনো জ্ঞান নেই;
নিশ্চয়ই তুমি-ই অদৃশ্য বিষয়ের পূর্ণজ্ঞাত।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১০৯)
এই আয়াতটি কিয়ামতের দিনের সেই মুহূর্তের বর্ণনা, যখন আল্লাহ তাআলা নবী ঈসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলবেন এবং তাঁকে তাঁর জীবনের সব নিদর্শন ও অনুগ্রহ স্মরণ করিয়ে দেবেন। এটি নবী ঈসা (আঃ)-এর **নবুওয়াতের সত্যতা**, **মুজিজার বাস্তবতা** ও **আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা**র প্রমাণ বহন করে।
১️ “إِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ”
— “যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারইয়াম!”
আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)-কে নাম ও তাঁর মাতার নামসহ ডাকছেন — এটি তাঁর সম্মান ও মিরাকেলের স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
২️ “ٱذْكُرْ نِعْمَتِي عَلَيْكَ وَعَلَىٰ وَٰلِدَتِكَ”
— “তুমি স্মরণ করো আমার অনুগ্রহ তোমার উপর এবং তোমার মাতার উপর।”
ঈসা (আঃ)-এর জন্ম কোনো পিতার মাধ্যমে নয়, বরং আল্লাহর আদেশে। আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর মা মরিয়ম (আঃ)-কে বহু আশ্চর্য মিরাকেল দান করেন। 📖 (সূরা আল-ইমরান ৩:৪৫-৪৭) — “আমি তাকে (ঈসা) সৃষ্টি করেছি মাটির দ্বারা, তারপর বলেছি ‘হও’, আর সে হয়েছে।”
৩️ “إِذْ أَيَّدتُّكَ بِرُوحِ ٱلْقُدُسِ”
— “আমি তোমাকে রূহুল কুদুস (জিবরাঈল)-এর মাধ্যমে শক্তি দিয়েছিলাম।”
অর্থাৎ, ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) ঈসা (আঃ)-এর সহযোগী ও রক্ষাকারী ছিলেন। তাঁকে মিরাকেল সম্পাদনে সাহায্য করেছিলেন — যেমন অসুস্থকে আরোগ্য দেওয়া, মৃতকে জীবিত করা ইত্যাদি।
৪️ “تُكَلِّمُ ٱلنَّاسَ فِي ٱلْمَهْدِ وَكَهْلٗا”
— “তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে শৈশবে ও প্রৌঢ় বয়সে।”
এটি ঈসা (আঃ)-এর এক বিশেষ মুজিজা — তিনি নবজাতক অবস্থায়ই মাতার পক্ষে কথা বলেন: *“আমি আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী করেছেন।”* — (সূরা মরিয়ম ১৯:৩০)
৫️ “وَإِذْ عَلَّمْتُكَ ٱلْكِتَـٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ”
— “আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনজিল।”
ঈসা (আঃ) শুধু নবী নন, তিনি ছিলেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতীক। তাঁকে তাওরাতের (মূসা আঃ-এর কিতাব) জ্ঞান ও ইনজিলের (নিজ কিতাব) শিক্ষা দান করা হয়।
৬️ “وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ ٱلطِّينِ كَهَيْـَٔةِ ٱلطَّيْرِ بِإِذْنِي”
— “তুমি মাটি থেকে পাখির আকৃতি তৈরি করেছিলে আমার অনুমতিতে।”
ঈসা (আঃ) মাটি দিয়ে পাখির আকার বানিয়ে তাতে ফুঁ দেন, আর আল্লাহর অনুমতিতে তা জীবিত হয়ে উড়ে যায়। এটি আল্লাহর সৃষ্টিশক্তির প্রমাণ, ঈসা (আঃ)-এর নয়।
৭️ “وَتُبْرِئُ ٱلْأَكْمَهَ وَٱلْأَبْرَصَ بِإِذْنِي”
— “তুমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করেছিলে আমার অনুমতিতে।”
ঈসা (আঃ)-এর চিকিৎসা কোনো চিকিৎসা-পদ্ধতি নয়, বরং আল্লাহর অনুমতিতে প্রদত্ত মুজিজা।
৮️ “وَإِذْ تُخْرِجُ ٱلْمَوْتَىٰ بِإِذْنِي”
— “তুমি মৃতদের জীবিত করেছিলে আমার অনুমতিতে।”
এটি সর্বোচ্চ মুজিজা — মৃতকে জীবিত করা — কিন্তু তা আল্লাহর অনুমতি ও ইচ্ছাতেই সম্ভব হয়েছিল, ঈসা (আঃ)-এর নিজস্ব শক্তিতে নয়।
৯️ “وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِيٓ إِسْرَٰٓءِيلَ عَنكَ”
— “আমি বনী ইসরাঈলকে তোমার হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম।”
তারা ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে উত্তোলন করেন এবং তাঁর শত্রুদের ব্যর্থ করেন। 📖 (সূরা নিসা ৪:১৫৭) — *“তারা তাঁকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে উত্তোলন করেছেন।”*
১০ “إِنْ هَـٰذَآ إِلَّا سِحْرٞ مُّبِينٞ”
— “এ তো স্পষ্ট জাদু ছাড়া আর কিছু নয়।”
কুফরকারীরা ঈসা (আঃ)-এর মুজিজাগুলোকে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে না দেখে জাদু বলে অপবাদ দিয়েছিল। এটি ছিল তাদের অহংকার ও অন্ধকার অন্তরের প্রতিফলন।
ইসলামী শিক্ষা:
- ঈসা (আঃ) আল্লাহর নবী ও বান্দা, আল্লাহর পুত্র নন।
- সব মুজিজা আল্লাহর অনুমতিতেই সংঘটিত হয়।
- মরিয়ম (আঃ)-এর পবিত্রতা ও ঈসা (আঃ)-এর জন্ম আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন।
- মানবজাতিকে হিদায়াত দেওয়া নবীদের কাজ, কিন্তু ফলাফল আল্লাহর হাতে।
আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না।
- বিজ্ঞানের অগ্রগতি যতই হোক, জীবন সৃষ্টি করা একমাত্র আল্লাহর ক্ষমতা।
- নবীদের মুজিজা ঈমান বাড়ানোর মাধ্যম, কৌতূহল মেটানোর নয়।
- ঈসা (আঃ)-এর মতো মহান নবীও ছিলেন আল্লাহর বিনীত বান্দা।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আমি পৃথিবীতে ঈসা ইবনে মারইয়ামের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি, কারণ আমরা উভয়েই এক নবুওয়াতের ধারায় এবং আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৪২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩৬৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১০):
- ঈসা (আঃ)-এর সব অলৌকিক ক্ষমতা আল্লাহর অনুমতিতেই সম্ভব হয়েছিল।
- আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করা কৃতজ্ঞতার নিদর্শন।
- নবীরা ছিলেন আল্লাহর নিখুঁত বান্দা ও হিদায়াতদাতা।
- মানুষ কখনো আল্লাহর সমকক্ষ নয় — সব শক্তি তাঁর কাছ থেকেই আসে।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী ঈসা (আঃ)-এর জীবনের অলৌকিক ঘটনাগুলোর কথা স্মরণ করিয়েছেন —
যা আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার প্রমাণ।
এটি একই সঙ্গে মুসলমানদের জন্য এক বড় শিক্ষা:
**সকল নবী আল্লাহর বান্দা, তাঁর অনুমতিতেই তাঁরা কাজ সম্পন্ন করেন।**
আল্লাহ তাআলা আমাদেরও তাঁর নেয়ামত স্মরণ করতে ও কৃতজ্ঞ থাকতে তাওফিক দিন 🌿
📖 “إِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ
ٱذْكُرْ نِعْمَتِي عَلَيْكَ وَعَلَىٰ وَٰلِدَتِكَ ...”
“যখন আল্লাহ বলবেন — হে ঈসা ইবনে মারইয়াম!
তুমি স্মরণ করো আমার অনুগ্রহ তোমার উপর এবং তোমার মাতার উপর...”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১০)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী ঈসা (আঃ)-এর সাহাবীগণ — অর্থাৎ **হাওয়ারীগণ** সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তারা ছিলেন ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত সহচর ও অনুসারী, যারা তাঁর বার্তাকে প্রচার করতেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন।
আল্লাহ তাদের হৃদয়ে **ঈমানের অনুপ্রেরণা (وَحْيٌ إِلَى الْقُلُوبِ)** দিয়েছিলেন। এটি নবুওয়াতের ওহি নয়, বরং হৃদয়ে নিক্ষিপ্ত হিদায়াত ও দৃঢ় বিশ্বাসের অনুভূতি।
১️ “وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى ٱلْحَوَارِيِّۦنَ”
— “যখন আমি হাওয়ারীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলাম।”
হাওয়ারীগণ ছিলেন নবী ঈসা (আঃ)-এর ১২ জন প্রধান অনুসারী, যাদের আল্লাহ ঈমানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তারা ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াহ প্রচারে তাঁর সঙ্গী ছিলেন। 📖 সূরা আস-সাফ (৬১:১৪) তে আল্লাহ বলেন — *“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও — যেমন ঈসা ইবনে মারইয়ামের হাওয়ারীরা বলেছিল: ‘আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী।’”*
২️ “أَنْ ءَامِنُوا۟ بِي وَبِرَسُولِي”
— “তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি ঈমান আনো।”
আল্লাহ তাদের প্রতি অন্তরে হিদায়াত দেন — যেন তারা শুধুমাত্র আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস রাখে এবং ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াতকে স্বীকার করে। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে, ঈসা (আঃ) নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলেননি, বরং তাঁর অনুসারীরা ছিলেন **আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত মুসলিম।**
৩️ “قَالُوٓا۟ ءَامَنَّا وَٱشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ”
— “তারা বলেছিল — আমরা ঈমান এনেছি; তুমি সাক্ষী থাকো যে আমরা মুসলিম।”
এটি ছিল ঈসা (আঃ)-এর হাওয়ারীদের **ঈমানের অঙ্গীকার**। তারা ঘোষণা করেছিল — “আমরা শুধু ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী নই, বরং আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আত্মসমর্পিত মুসলিম।” এই ঘোষণা প্রমাণ করে — ইসলাম কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং পূর্ববর্তী নবীদের সত্য পথের ধারাবাহিকতা।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সব নবী ও রাসূলের ধর্ম এক — ইসলাম; পার্থক্য কেবল শরিয়তের বিধানে।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৪৪৩)
৪️ ইসলামী শিক্ষা:
- হাওয়ারীগণ ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত ও বিশ্বস্ত অনুসারী ছিলেন।
- ঈমান আল্লাহর অনুপ্রেরণা ও অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে আসে।
- নবীদের সকল অনুসারীর প্রকৃত পরিচয় — “মুসলিম” (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত)।
- ইসলাম কোনো নতুন ধর্ম নয়; এটি সব নবীরই দাওয়াহর ধারাবাহিকতা।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজকের মুসলমানদেরও হাওয়ারীদের মতো আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখতে হবে।
- ঈমান শুধু মুখের কথা নয়, বরং হৃদয়ের স্বীকৃতি ও আমলের বাস্তব রূপ।
- আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্য সৎ বিশ্বাস ও আন্তরিক কর্ম অপরিহার্য।
- যারা আল্লাহর বার্তাবাহকদের সহযোগিতা করে, তারা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে মানুষকে সাহায্য করে, সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সাহায্যকারী।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯০৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১১):
- ঈমান আল্লাহর অনুপ্রেরণায় হৃদয়ে স্থাপিত হয়।
- সত্যিকারের মুমিন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল উভয়ের প্রতি ঈমান রাখে।
- হাওয়ারীগণ ইসলামের আত্মসমর্পিত দৃষ্টান্ত ছিলেন।
- আল্লাহর সাক্ষ্য চাওয়া ঈমানের গভীরতার নিদর্শন।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্মরণ করাচ্ছেন —
ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারীরা মুসলিম ছিল,
যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল ও নবীকে সমর্থন করেছিল।
এটি প্রমাণ করে — আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম **ইসলাম**,
এবং সকল নবী ও তাঁদের অনুসারীরা একই পথে আহ্বান করেছেন —
আল্লাহর একত্ব, আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরও সেই হাওয়ারীদের মতো ঈমান ও দৃঢ়তার তাওফিক দিন 🌿
📖 “وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى ٱلْحَوَارِيِّۦنَ
أَنْ ءَامِنُوا۟ بِي وَبِرَسُولِي
قَالُوٓا۟ ءَامَنَّا وَٱشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ”
“এবং যখন আমি হাওয়ারীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলাম যে —
তোমরা আমার ও আমার রাসূলের প্রতি ঈমান আনো;
তারা বলেছিল — আমরা ঈমান এনেছি,
এবং তুমি সাক্ষী থাকো যে আমরা মুসলিম।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১১)
এই আয়াতে উল্লেখ আছে **“মায়িদা” (খাবারে ভরা টেবিল)**-এর অলৌকিক ঘটনার সূচনা, যা থেকে সূরাটির নাম “আল-মায়েদা” রাখা হয়েছে। এটি ছিল নবী ঈসা (আঃ)-এর যুগের এক বিশেষ ঘটনা, যেখানে তাঁর শিষ্যগণ (হাওয়ারীরা) আকাশ থেকে এক খাদ্যপূর্ণ টেবিল নামানোর অনুরোধ করেছিল — যেন তাদের ঈমান আরও দৃঢ় হয়।
১️ “إِذْ قَالَ ٱلْحَوَارِيُّونَ يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ”
— “যখন হাওয়ারীরা বলেছিল — হে ঈসা ইবনে মারইয়াম!”
হাওয়ারীরা ছিলেন ঈসা (আঃ)-এর নিকটতম সহচরগণ, যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল এবং তাঁর দাওয়াহ প্রচার করত। তারা শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সাথে তাঁর কাছে অনুরোধ করেছিল।
২️ “هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَن يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَآئِدَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِۖ”
— “তোমার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাবারে ভরা টেবিল নামাতে পারেন?”
তারা এই প্রশ্ন করেছিল কৌতূহলবশত নয়, বরং দৃঢ় ঈমান লাভের আশায়। তারা চেয়েছিল — এমন এক মুজিজা, যা তাদের হৃদয়ে প্রশান্তি ও ঈমানের গভীরতা আনবে। কিন্তু বাক্যটির প্রকাশভঙ্গি এমন ছিল — “তোমার প্রতিপালক কি পারেন?” যা ঈসা (আঃ)-এর কাছে **আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাহীনতার মতো মনে হয়েছিল**, তাই তিনি সতর্ক করেন।
📖 ইবন কাসির (রহ.) বলেন — “তারা আসলে ‘রব্বুকা ইয়াস্তাতি‘উ’ বলেননি অবিশ্বাসে, বরং বিনীতভাবে অনুরোধ করেছিল — যেন আল্লাহ তাদের জন্য এক নিদর্শন দান করেন।”
৩️ “قَالَ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ”
— “ঈসা বললেন — আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও।”
ঈসা (আঃ) তাদের মনে করিয়ে দেন — সত্যিকার ঈমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা ও শ্রদ্ধার উপর প্রতিষ্ঠিত। অলৌকিক কিছু দেখতে চাওয়া ঈমানের শর্ত নয়। এটি শিক্ষা দেয় — **আল্লাহকে দেখা নয়, বরং তাঁর প্রতি বিশ্বাসই ঈমানের পরিচয়।**
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যারা নিদর্শন দাবি করে, তারা পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মতো। কিন্তু প্রকৃত ঈমান হলো, না দেখে বিশ্বাস করা।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫০৩২)
৪️ মায়িদার (খাবার টেবিল) পরিচয়:
“মায়িদা” শব্দের অর্থ — খাবার পরিবেশনের টেবিল, যেখানে নানা প্রকার খাবার সাজানো থাকে। হাওয়ারীরা চেয়েছিল এমন এক স্বর্গীয় টেবিল, যা আকাশ থেকে নেমে তাদের ঈমানকে দৃঢ় করবে। পরবর্তী আয়াতে (৫:১১৪) ঈসা (আঃ)-এর দোয়া উল্লেখ আছে — তিনি আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেন যেন এই নিদর্শন তাদের জন্য নাজিল করা হয়।
৫️ ইসলামী শিক্ষা:
- আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা উচিত।
- ঈমান নিদর্শনের উপর নয়, বরং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের উপর নির্ভরশীল।
- নবীগণ মানুষকে আল্লাহভীতির দিকে আহ্বান করতেন, নিদর্শন চাওয়ার দিকে নয়।
- চিন্তা ও প্রশ্ন করার আগে উচিত — আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও মানুষ প্রায়ই প্রমাণ বা অলৌকিক ঘটনা দাবি করে, অথচ ঈমানের প্রকৃত প্রমাণ হলো হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাস।
- আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম; আমাদের উচিত সন্দেহ নয়, বিশ্বাস রাখা।
- ঈসা (আঃ)-এর সতর্কবাণী আজকের যুগেও প্রযোজ্য — “আল্লাহকে ভয় করো, যদি সত্যিই মুমিন হও।”
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস রাখে, তার জন্য আসমান ও জমিনের নিদর্শন যথেষ্ট।” (📖 তাফসীর আত-তাবারী, সূরা আল-মায়েদা ৫:১১২ ব্যাখ্যা)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১২):
- আল্লাহর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়, বরং বিশ্বাস করা উচিত।
- ঈমান হলো না দেখে বিশ্বাস করা, প্রমাণ চাওয়া নয়।
- আল্লাহকে ভয় করাই সত্যিকারের ঈমানের পরিচয়।
- ঈসা (আঃ)-এর হাওয়ারীরা ছিলেন বিশ্বাসী, তবে তারা দৃঢ়তার জন্য প্রমাণ চেয়েছিল।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের শেখাচ্ছেন —
ঈমান নিদর্শনের উপর নয়, বরং হৃদয়ের বিশ্বাস ও তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত।
ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারীদের যেমন আল্লাহভীতির দিকে আহ্বান করেছিলেন,
তেমনি আজ আমাদেরও উচিত সন্দেহ নয়, বরং বিশ্বাসে অটল থাকা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন ঈমান দিন —
যা নিদর্শন নয়, বরং ভালোবাসা, ভয় ও আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত 🌿
📖 “إِذْ قَالَ ٱلْحَوَارِيُّونَ
يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ
هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ
أَن يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَآئِدَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِۖ
قَالَ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ”
“যখন হাওয়ারীরা বলল — হে ঈসা ইবনে মারইয়াম!
তোমার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আকাশ থেকে এক মায়িদা নামাতে পারেন?
ঈসা বললেন — আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১২)
এই আয়াতে হাওয়ারীদের (ঈসা আঃ-এর সাহাবীগণ) অনুরোধের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এসেছে। তারা নবী ঈসা (আঃ)-এর কাছে আসমান থেকে “মায়িদা” — অর্থাৎ খাবারে ভরা টেবিল নামানোর আবেদন করেছিল, এবং এখন তারা তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে বলছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল না কেবল খাদ্য লাভ করা, বরং ঈমানকে আরও দৃঢ় করা এবং আল্লাহর নিদর্শনের উপর সাক্ষী থাকা।
১️ “قَالُوا۟ نُرِيدُ أَن نَّأْكُلَ مِنْهَا”
— “তারা বলল: আমরা চাই, যাতে আমরা তা থেকে খেতে পারি।”
অর্থাৎ, তারা আসমান থেকে অবতীর্ণ সেই টেবিলের খাদ্য ভক্ষণ করতে চেয়েছিল। এটি কোনো লোভ নয়, বরং এক “আল্লাহর নিদর্শন” অভিজ্ঞতা করার আকাঙ্ক্ষা। তারা দেখতে চেয়েছিল — কীভাবে আল্লাহ তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন দান করেন।
২️ “وَتَطْمَئِنَّ قُلُوبُنَا”
— “এবং আমাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়।”
তারা বলল, আমরা ইতিমধ্যেই ঈমান এনেছি, কিন্তু এমন একটি নিদর্শন আমাদের ঈমানকে আরও দৃঢ় করবে, আমাদের অন্তর আরও প্রশান্ত ও স্থির হয়ে যাবে। এই কথা স্মরণ করিয়ে দেয় — **ঈমান বাড়ে আল্লাহর নিদর্শন ও কুরআনের চিন্তনের মাধ্যমে।** 📖 আল্লাহ বলেন — *“যারা ঈমান এনেছে, তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে প্রশান্ত হয়।”* — (সূরা আর-রা‘দ ১৩:২৮)
৩️ “وَنَعْلَمَ أَن قَدْ صَدَقْتَنَا”
— “এবং আমরা জেনে নিই যে তুমি আমাদের প্রতি সত্য বলেছেন।”
তারা ঈসা (আঃ)-এর প্রতি সন্দেহ পোষণ করেনি, বরং তারা চেয়েছিল আল্লাহর এক নতুন নিদর্শনের মাধ্যমে তাঁর বার্তার সত্যতা আরও প্রকাশ পায়। এটি মানুষের স্বাভাবিক মানসিক চাহিদা — দৃশ্যমান নিদর্শন দেখলে অন্তর আরও গভীরভাবে বিশ্বাস করে।
৪️ “وَنَكُونَ عَلَيْهَا مِنَ ٱلشَّـٰهِدِينَ”
— “এবং আমরা এর উপর সাক্ষ্য প্রদানকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।”
তারা আল্লাহর এই নিদর্শনের উপর সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিল — যেন তারা অন্য মানুষদের কাছে বলতে পারে, “আমরা নিজের চোখে দেখেছি, আল্লাহ আসমান থেকে খাবার নাজিল করেছেন।” এইভাবে তারা চেয়েছিল মানুষের মধ্যে ঈমান ছড়িয়ে দিতে, এবং সত্যের সাক্ষ্যদাতা হতে।
📖 আল্লাহ বলেন — *“এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর সাক্ষ্যদানকারী হও।”* — (সূরা আল-বাকারা ২:১৪৩)
৫️ শিক্ষা ও ব্যাখ্যা:
- হাওয়ারীরা ঈমানশূন্য ছিল না; তারা নিদর্শনের মাধ্যমে ঈমানকে আরও দৃঢ় করতে চেয়েছিল।
- ঈমান শুধু মুখের কথা নয় — হৃদয়ের প্রশান্তি ও দৃঢ় বিশ্বাসের বিষয়।
- আল্লাহর নিদর্শন দেখলে মুমিনের ঈমান আরও পরিপূর্ণ হয়।
- আল্লাহর নিদর্শনের সাক্ষ্য দেওয়া ঈমানের অংশ।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও অনেক মুমিন জ্ঞান, গবেষণা ও চিন্তার মাধ্যমে ঈমানকে গভীর করতে চায় — এটি কুরআনের শিক্ষা।
- আল্লাহর নিদর্শন (প্রকৃতি, মানবজীবন, আকাশ-বাতাস) আমাদের ঈমান শক্তিশালী করার মাধ্যম।
- আল্লাহর মিরাকেলকে কৌতূহল নয়, ঈমানের আলো হিসেবে দেখা উচিত।
- একজন প্রকৃত মুমিন অন্যদের ঈমানের সাক্ষ্যদাতা হতে চায়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সত্যিকার ঈমান হলো সেই ঈমান, যা হৃদয়কে প্রশান্ত করে এবং আমলকে উন্নত করে।” (📖 মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২৫০২৫)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৩):
- ঈমান বৃদ্ধি ও প্রশান্তি আল্লাহর নিদর্শন চিন্তার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সাক্ষ্য ঈমানের দুই স্তম্ভ।
- নবীদের অনুসারীরা আল্লাহর নিদর্শনের উপর সাক্ষ্যদাতা ছিলেন।
- ঈমান জ্ঞানে, উপলব্ধিতে ও অভিজ্ঞতায় আরও দৃঢ় হয়।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের শেখাচ্ছেন —
ঈমান শুধু মুখের স্বীকারোক্তি নয়, বরং হৃদয়ের প্রশান্তি ও দৃঢ় বিশ্বাসের প্রকাশ।
যেমন হাওয়ারীরা ঈসা (আঃ)-এর মুজিজা দেখে ঈমানকে আরও দৃঢ় করতে চেয়েছিল,
তেমনি আমাদেরও উচিত কুরআন, প্রকৃতি ও জীবনের ঘটনায়
আল্লাহর নিদর্শন চিনে ঈমানকে শক্তিশালী করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন ঈমান দিন,
যা জ্ঞানে, অনুভবে ও আমলে দৃঢ় ও প্রশান্ত 🌿
📖 “قَالُوا۟ نُرِيدُ أَن نَّأْكُلَ مِنْهَا
وَتَطْمَئِنَّ قُلُوبُنَا
وَنَعْلَمَ أَن قَدْ صَدَقْتَنَا
وَنَكُونَ عَلَيْهَا مِنَ ٱلشَّـٰهِدِينَ”
“তারা বলল — আমরা চাই, যাতে আমরা তা থেকে খেতে পারি,
আমাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়,
আমরা জেনে নিই যে তুমি সত্য বলেছেন,
এবং আমরা এর উপর সাক্ষ্যদানকারীদের অন্তর্ভুক্ত হই।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৩)
এই আয়াতে নবী ঈসা (আঃ)-এর সেই দোয়াটি বর্ণিত হয়েছে, যা তিনি তাঁর সাহাবীগণ — **হাওয়ারীদের অনুরোধে** আল্লাহর কাছে করেছিলেন। হাওয়ারীরা পূর্ববর্তী আয়াতে (৫:১১৩) বলেছিল — “আমরা চাই যাতে আসমান থেকে এক মায়িদা নাজিল হয়, যাতে আমাদের হৃদয় প্রশান্ত হয় ও ঈমান দৃঢ় হয়।” এই আয়াতে ঈসা (আঃ) সেই দোয়া পেশ করছেন — বিনয়, শ্রদ্ধা ও সম্পূর্ণ ঈমানের সাথে।
১️ “قَالَ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ ٱللَّهُمَّ رَبَّنَآ أَنزِلْ عَلَيْنَا مَآئِدَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ”
— “ঈসা ইবনে মারইয়াম বললেন — হে আল্লাহ, আমাদের প্রতি আসমান থেকে এক মায়িদা নাজিল করো।”
“মায়িদা” বলতে বোঝানো হয়েছে — একটি খাবারে ভরা টেবিল, যা আকাশ থেকে নাজিল হবে এক অলৌকিক মুজিজা হিসেবে। ঈসা (আঃ) তাঁর দোয়ায় আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ বিনয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন “**আল্লাহুম্মা রাব্বানা**” — অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের প্রয়োজন পূর্ণ করো। এটি দেখায় যে, নবীগণও সর্বাবস্থায় আল্লাহরই মুখাপেক্ষী ছিলেন, কখনো নিজের কোনো ক্ষমতা দাবি করেননি।
২️ “تَكُونُ لَنَا عِيدٗا لِّأَوَّلِنَا وَءَاخِرِنَا”
— “যা আমাদের প্রথম ও শেষ প্রজন্মের জন্য হবে এক উৎসব (ঈদ)।”
ঈসা (আঃ) চেয়েছিলেন, এই আকাশী খাবার নাজিলের দিনটি তাঁদের জন্য এক আনন্দ ও স্মরণীয় দিবস হয়ে থাকুক — যেমন মুসলমানদের জন্য ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক অনন্য রূপ — **আল্লাহর নেয়ামতকে স্মরণ করে আনন্দ করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।** 📖 ইবন কাসির বলেন — “ঈসা (আঃ) এর মাধ্যমে এমন এক দিন স্থির করতে চেয়েছিলেন, যা হবে আল্লাহর দান ও রহমতের স্মারক দিবস।”
৩️ “وءَايَةٗ مِّنكَ”
— “এবং তোমার পক্ষ থেকে এক নিদর্শন।”
ঈসা (আঃ)-এর এই কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, তিনি এই ঘটনার উদ্দেশ্য করেছিলেন কেবল ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি ও আল্লাহর নিদর্শন প্রকাশ। এটি তাঁর মুজিজা নয়, বরং আল্লাহর নিদর্শন (آية من الله)।
৪️ “وَٱرْزُقْنَا وَأَنتَ خَيْرُ ٱلرَّٰزِقِينَ”
— “আমাদের রিজিক দাও, কারণ তুমি সর্বোত্তম রিজিকদাতা।”
ঈসা (আঃ) এই দোয়ায় আল্লাহর এক মহান গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন — **“খাইরুর রাজিকীন”** — অর্থাৎ, তুমি সর্বোত্তম রিজিকদাতা। এর দ্বারা বোঝানো হয় — সব রিজিকের উৎস একমাত্র আল্লাহ; মানুষ কেবল মাধ্যম মাত্র।
📖 কুরআনের অন্য আয়াতেও আল্লাহ বলেন — *“আল্লাহই রিজিক দেন যাকে চান, সীমাহীনভাবে।”* — (সূরা আন-নূর ২৪:৩৮)
৫️ শিক্ষনীয় দিক:
- নবীগণ আল্লাহর প্রতি সর্বদা বিনয়ী ও নির্ভরশীল ছিলেন।
- আল্লাহর নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ঈমানের নিদর্শন।
- রিজিক আল্লাহর দান; মানুষ কেবল তার বাহক।
- বিশ্বাসীদের উচিত আল্লাহর নিদর্শন দেখেও অহংকার নয়, বরং কৃতজ্ঞ হওয়া।
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আল্লাহর দানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা একটি ঈমানি গুণ।
- আমাদের জীবনে “ঈদ” বা আনন্দের প্রকৃত কারণ হওয়া উচিত আল্লাহর অনুগ্রহ।
- রিজিকের জন্য সর্বদা আল্লাহর উপর নির্ভর করা উচিত, মানুষের উপর নয়।
- আল্লাহর নিদর্শন আমাদের ঈমানকে দৃঢ় করার উপায়, অহংকারের নয়।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি নিজের রিজিকের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তাকে যথেষ্ট রিজিক প্রদান করেন।” (📖 সহিহ তিরমিজি, হাদিস: ২৫১১)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৪):
- ঈসা (আঃ) তাঁর দোয়ায় আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ বিনয় প্রকাশ করেছিলেন।
- আল্লাহর দান ও নিদর্শন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।
- আল্লাহই সর্বোত্তম রিজিকদাতা।
- নবীগণও আল্লাহর দয়ার মুখাপেক্ষী ছিলেন।
উপসংহার:
এই আয়াতে নবী ঈসা (আঃ)-এর দোয়া আমাদের শেখায় —
কীভাবে একজন বান্দা আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে চাওয়া উচিত।
তিনি কেবল নিদর্শন চাওয়ার জন্য নয়, বরং ঈমান দৃঢ় করার জন্য দোয়া করেছিলেন।
তাঁর দোয়া ছিল আল্লাহর প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ও নির্ভরতার এক পরিপূর্ণ উদাহরণ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরও এমন দোয়ার তাওফিক দিন,
যাতে আমরা কৃতজ্ঞতা ও তাকওয়ায় পূর্ণ জীবন যাপন করতে পারি 🌿
📖 “قَالَ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ
ٱللَّهُمَّ رَبَّنَآ أَنزِلْ عَلَيْنَا مَآئِدَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ
تَكُونُ لَنَا عِيدٗا لِّأَوَّلِنَا وَءَاخِرِنَا
وَءَايَةٗ مِّنكَ
وَٱرْزُقْنَا وَأَنتَ خَيْرُ ٱلرَّٰزِقِينَ”
“ঈসা বললেন — হে আল্লাহ, হে আমাদের প্রতিপালক!
আমাদের জন্য আসমান থেকে এক মায়িদা নাজিল করো,
যা আমাদের প্রথম ও শেষ প্রজন্মের জন্য হবে এক উৎসব
এবং তোমার পক্ষ থেকে এক নিদর্শন।
আমাদের রিজিক দাও, কারণ তুমি সর্বোত্তম রিজিকদাতা।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৪)
এই আয়াতটি “আসমানী মায়িদা”-র ঘটনার পরিপূর্ণ উপসংহার। আল্লাহ তাআলা নবী ঈসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করলেন — আসমান থেকে খাবারে ভরা টেবিল নাজিল করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তবে এর সাথে একটি কঠিন শর্ত আরোপ করলেন — যদি কেউ এই মুজিজা দেখার পরও অবিশ্বাস করে, তবে সে এমন ভয়াবহ শাস্তির অধিকারী হবে যা কোনো জাতি কখনো পায়নি।
১️ “قَالَ ٱللَّهُ إِنِّي مُنَزِّلُهَا عَلَيْكُمْ”
— “আল্লাহ বললেন — নিশ্চয়ই আমি তা তোমাদের প্রতি নাজিল করব।”
আল্লাহ ঈসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করলেন, এবং ঘোষণা করলেন যে তিনি আসমান থেকে খাবারে ভরা মায়িদা পাঠাবেন। এটি ছিল ঈসা (আঃ)-এর অন্যতম বড় মুজিজা ও নিদর্শন। 📖 তাফসীর ইবন কাসির অনুযায়ী — আল্লাহ সেই টেবিল নাজিল করেছিলেন, যাতে ছিল রুটি, মাছ, ডালিম, জলপাই ও অন্যান্য ফলমূল। এটি এক অলৌকিক ঘটনা ছিল, যা ঈসা (আঃ)-এর সত্য নবুওয়াতের প্রমাণ হয়ে রইল।
২️ “فَمَن يَكْفُرْ بَعْدُ مِنكُمْ”
— “কিন্তু এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কুফরি করে...”
অর্থাৎ, এই নিদর্শন দেখার পরও কেউ যদি ঈমান না আনে, অথবা আল্লাহর উপর অবিশ্বাস করে, তবে সে আর কোনো অজুহাত দিতে পারবে না। কারণ আল্লাহর নিদর্শন স্বচক্ষে দেখার পরও অবিশ্বাস করা মানে — ইচ্ছাকৃত বিদ্রোহ ও সত্য প্রত্যাখ্যান। 📖 (সূরা আল-আন‘আম ৬:১৫৮) “যখন নিদর্শন আসবে, তখন যারা আগে ঈমান আনেনি, তাদের ঈমান কোনো কাজে আসবে না।”
৩️ “فَإِنِّيٓ أُعَذِّبُهُۥ عَذَابٗا لَّآ أُعَذِّبُهُۥٓ أَحَدٗا مِّنَ ٱلْعَـٰلَمِينَ”
— “আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যা আমি কারওকেও দেব না।”
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক কঠোর সতর্কতা। নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার পরও কুফরি করা সবচেয়ে বড় অপরাধ। আল্লাহর শাস্তি হবে এমন ভয়াবহ — যা দুনিয়া ও আখেরাতে অন্য কোনো জাতি পায়নি। 📖 তাফসীর আল-কুরতুবি বলেন — “যারা এই টেবিল থেকে খেয়েছিল, তাদের মধ্যে পরবর্তীতে কেউ অবিশ্বাস করলে, আল্লাহ তাদের রূপ পরিবর্তন করে পশু বানিয়ে দেন।” এটি বোঝায় — আল্লাহর মুজিজার প্রতি অকৃতজ্ঞতা মানবজাতির জন্য ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
৪️ শিক্ষনীয় দিক:
- আল্লাহ দোয়া কবুল করেন, তবে সাথে সতর্কতাও প্রদান করেন।
- নিদর্শন দেখার পর অবিশ্বাস করা সবচেয়ে বড় কুফরি।
- আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ মনে করা কখনোই উচিত নয়।
- নবীগণের মুজিজা দেখে যারা ঈমান এনেছিল, তাদের ঈমান দৃঢ় হয়েছে।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজকের যুগেও অনেক মানুষ প্রমাণ চায়, অথচ সত্যের নিদর্শন সর্বত্র বিদ্যমান।
- কুরআন নিজেই আল্লাহর জীবন্ত নিদর্শন; এটি দেখেও যদি কেউ অস্বীকার করে, তার অবস্থাও সেই কুফরকারীদের মতো।
- আল্লাহর দয়া সীমাহীন, কিন্তু তাঁর ন্যায়বিচারও কঠোর।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহের পর অকৃতজ্ঞ হয়, সে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শন দেখেও কৃতজ্ঞ হয় না, সে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠবে।” (📖 তাফসীর আত-তাবারী, সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৫ ব্যাখ্যা)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৫):
- আল্লাহ তাঁর বান্দার দোয়া কবুল করেন, তবে সতর্কতাসহ।
- নিদর্শন দেখে অবিশ্বাস করা আল্লাহর ক্রোধের কারণ।
- কৃতজ্ঞতা ঈমানের মূল; অকৃতজ্ঞতা কুফরির দরজা।
- আল্লাহর শাস্তি থেকে কেউ রক্ষা পাবে না, যদি সে সত্যকে অস্বীকার করে।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দয়া ও ন্যায়বিচারের একসাথে প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
একদিকে তিনি নবী ঈসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করেছেন,
অন্যদিকে তিনি মানুষকে সতর্ক করেছেন যেন তারা অকৃতজ্ঞ না হয়।
এটি শেখায় — **আল্লাহর দান যত বড়, দায়িত্বও তত বড়।**
নিদর্শন পাওয়া মানে শুধু আনন্দ নয়, বরং কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন,
যারা তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞ ও ঈমানদার থাকে 🌿
📖 “قَالَ ٱللَّهُ إِنِّي مُنَزِّلُهَا عَلَيْكُمْ
فَمَن يَكْفُرْ بَعْدُ مِنكُمْ
فَإِنِّيٓ أُعَذِّبُهُۥ عَذَابٗا لَّآ أُعَذِّبُهُۥٓ أَحَدٗا مِّنَ ٱلْعَـٰلَمِينَ”
“আল্লাহ বললেন — নিশ্চয়ই আমি তা তোমাদের প্রতি নাজিল করব;
কিন্তু এরপর কেউ যদি কুফরি করে,
তাহলে আমি তাকে এমন শাস্তি দেব,
যা আমি সমগ্র বিশ্বজগতের কারওকেও দেব না।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন — যখন তিনি নবী ঈসা (আঃ)-কে প্রশ্ন করবেন, তাঁর জাতির করা **শিরকের অপরাধ** সম্পর্কে। খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ)-কে “আল্লাহর পুত্র” এবং মরিয়ম (আঃ)-কে “ঈশ্বরমাতা” বলে উপাসনা করেছিল। আল্লাহ এই প্রশ্ন করবেন তাদের সামনে, যাতে তারা নিজেরাই তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের লজ্জাজনক পরিণতি দেখে।
১️ “وَإِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ أَأَنتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ...”
— “যখন আল্লাহ বলবেন: হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি বলেছিলে...”
এটি হবে **কিয়ামতের দিন**। আল্লাহ প্রশ্ন করবেন — তুমি কি মানুষকে বলেছিলে, আমাকে ও আমার মাকে উপাস্য বানাও? এটি হবে এক **অভিযোগমূলক প্রশ্ন**, যাতে মিথ্যা বিশ্বাসী খ্রিস্টানরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে।
📖 তাফসীর ইবন কাসিরে বলা হয়েছে — “এটি হবে সাক্ষ্য প্রদানের সময়। আল্লাহ ঈসা (আঃ)-এর মাধ্যমে খ্রিস্টানদের মিথ্যা প্রকাশ করবেন।”
২️ “قَالَ سُبْحَـٰنَكَ مَا يَكُونُ لِيٓ أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّۚ”
— “তিনি বলবেন: পবিত্র আপনি! আমি এমন কথা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়।”
ঈসা (আঃ) সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং নিজেকে মুক্ত করেন। তিনি বলেন — আমি কখনো এমন কথা বলিনি যা আমার অধিকার নয়। এটি নবী ঈসা (আঃ)-এর **তাওহীদিক অবস্থান**ের পরিপূর্ণ প্রমাণ। তিনি কখনো উপাসনা দাবি করেননি, বরং এক আল্লাহর ইবাদত শিক্ষা দিয়েছিলেন।
📖 (সূরা আস-সফ ৬১:৬) “আমি তোমাদের কাছে একজন রাসূল, আমার পরে আসবেন এক রাসূল — তাঁর নাম আহমাদ।”
৩️⃣ “إِن كُنتُ قُلْتُهُۥ فَقَدْ عَلِمْتَهُۥۚ”
— “যদি আমি এটা বলতাম, তবে নিশ্চয়ই আপনি তা জানতেন।”
ঈসা (আঃ) তাঁর সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলেন — “আমি কিছুই লুকাতে পারি না, আপনি সব জানেন।”
এটি আল্লাহর সর্বজ্ঞতার স্বীকৃতি এবং নবীর বিনয় প্রকাশ।
৪️ “تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَآ أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَۚ”
— “আপনি জানেন যা আমার অন্তরে, আর আমি জানি না যা আপনার অন্তরে।”
ঈসা (আঃ) এখানে স্পষ্ট করে বলছেন — আল্লাহ ও নবীর জ্ঞানের মধ্যে কোনো তুলনা নেই। নবীগণ কেবল আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞানেই সীমিত। এটি **খ্রিস্টানদের বিভ্রান্ত বিশ্বাসের খণ্ডন** — যে ঈসা (আঃ)-এর মধ্যে আল্লাহত্ব আছে, তা সম্পূর্ণ ভুল।
৫️ “إِنَّكَ أَنتَ عَلَّـٰمُ ٱلْغُيُوبِ”
— “নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্যের সর্বজ্ঞ।”
ঈসা (আঃ) স্বীকার করেন — অদৃশ্য ও ভবিষ্যতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই। নবীগণও সীমিত জ্ঞান রাখেন, যা আল্লাহ তাদের শেখান। 📖 (সূরা জিন ৭২:২৬–২৭) “তিনি অদৃশ্যের খবর কাউকে জানান না, তবে যাকে তিনি রাসূল হিসেবে বেছে নেন।”
৬️ এই আয়াতের তাৎপর্য:
এই সংলাপ কিয়ামতের ময়দানে ঘটবে — আল্লাহ প্রশ্ন করবেন ঈসা (আঃ)-কে, এবং তাঁর জবাব হবে আল্লাহর তাওহীদের সর্বশ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য। এটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করবে — ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, উপাস্য নন।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “কিয়ামতের দিন ঈসা ইবনে মারইয়াম আমার উম্মতের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন, যে তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করেছে।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৩৭)
৭️ শিক্ষনীয় দিক:
- আল্লাহ কিয়ামতের দিন সকল নবীকে তাদের জাতির সামনে সাক্ষ্য দিতে বলবেন।
- ঈসা (আঃ) ছিলেন আল্লাহর বান্দা, কোনোভাবেই আল্লাহর অংশ নন।
- তাওহীদের মূল শিক্ষা — সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।
- আল্লাহ সর্বজ্ঞ; নবীগণও তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছু জানেন না।
৮️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আজও অনেক মানুষ নবী, অলী বা ব্যক্তিত্বকে ঈশ্বরের স্তরে তুলতে চায় — এই আয়াত সেই বিভ্রান্তির কঠিন জবাব।
- আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসই ইসলামের প্রাণ।
- জ্ঞান, ক্ষমতা ও ইলম কেবল আল্লাহরই; মানুষ সীমিত।
- কিয়ামতের দিনে আল্লাহ প্রত্যেকের বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৬):
- আল্লাহ তাওহীদের সর্বোচ্চ সাক্ষ্য কিয়ামতের দিন প্রকাশ করবেন।
- নবী ঈসা (আঃ) আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য ও বিনয় প্রদর্শন করেছেন।
- মানবজ্ঞান সীমিত, আল্লাহর জ্ঞান সর্বব্যাপী।
- আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা সবচেয়ে বড় গুনাহ।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য তুলে ধরেছেন,
যেখানে সত্য ও মিথ্যার পরিস্কার ফয়সালা হবে।
খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের মুখে ঈসা (আঃ) ঘোষণা করবেন —
“আমি কখনো উপাস্য হইনি; আমি কেবল আল্লাহর বান্দা।”
এটি মানবজাতির জন্য এক তাওহীদের ঘোষণা।
আল্লাহই একমাত্র ইলাহ, তাঁর সাথে কারও তুলনা নেই।
🌿 আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন ঈমান দিন,
যা ঈসা (আঃ)-এর এই সাক্ষ্যের মতো দৃঢ় ও নির্মল।
📖 “وَإِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ
أَأَنتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَـٰهَيْنِ مِن دُونِ ٱللَّهِ...”
“যখন আল্লাহ বলবেন — হে ঈসা ইবনে মারইয়াম!
তুমি কি বলেছিলে — আমাকে ও আমার মাকে আল্লাহ ছাড়া দুই উপাস্য বানাও?”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৬)
এই আয়াতে নবী ঈসা (আঃ)-এর কিয়ামতের দিনের জবাবের পরবর্তী অংশ এসেছে। আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন — তুমি কি মানুষকে উপাসনা করতে বলেছিলে? এই আয়াতে ঈসা (আঃ) তাঁর উত্তর দিচ্ছেন বিনয়, সত্য ও স্পষ্ট তাওহীদের বার্তাসহ।
ঈসা (আঃ) বলবেন — “হে আল্লাহ! আমি কখনো আমার জাতিকে বিভ্রান্ত করিনি। আমি শুধু তাই বলেছি, যা আপনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন।” অর্থাৎ — তাঁর দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণ **তাওহীদভিত্তিক** — একমাত্র আল্লাহর ইবাদত, যিনি সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক।
১️ “مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَآ أَمَرْتَنِي بِهِۦٓ”
— “আমি তাদের বলিনি, শুধু তাই বলেছি যা আপনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন।”
ঈসা (আঃ) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন — তিনি কোনো কথাই নিজে থেকে বলেননি, বরং আল্লাহর ওহীর নির্দেশ অনুযায়ী বলেছেন। এটি প্রমাণ করে — নবীগণ নিজেদের ইচ্ছায় কথা বলেন না, বরং আল্লাহর নির্দেশই তাঁদের মুখে উচ্চারিত হয়। 📖 (সূরা আন-নাজম ৫৩:৩–৪) “তিনি নিজের মনগড়া কথা বলেন না; এটা ওহী ছাড়া কিছু নয়।”
২️ “أَنِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْۚ”
— “আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমারও রব এবং তোমাদেরও রব।”
ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতের মূল ছিল একেই — **তাওহীদের আহ্বান**। তিনি কখনো নিজের বা মায়ের ইবাদতের কথা বলেননি, বরং বলেছিলেন — “আমারও প্রতিপালক, তোমাদেরও প্রতিপালক একই।” 📖 (সূরা আলে ইমরান ৩:৫১) “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমারও রব এবং তোমাদেরও রব; সুতরাং তাঁরই ইবাদত করো।”
৩️ “وَكُنتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدٗا مَّا دُمْتُ فِيهِمْۖ”
— “আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম।”
ঈসা (আঃ) বলছেন — যতদিন তিনি জীবিত অবস্থায় তাদের মধ্যে ছিলেন, ততদিন তিনি তাদের ঈমান ও আমলের তত্ত্বাবধান করেছেন, তাদের ভুল পথে যেতে দেননি। কিন্তু তিনি যখন দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেওয়া হলেন, তখন তাঁর জাতি (খ্রিস্টানরা) পথভ্রষ্ট হলো।
📖 ইবন কাসির বলেন — “ঈসা (আঃ) জীবিত থাকা পর্যন্ত তাঁর জাতি তাওহীদে অটল ছিল; তাঁর পর তারা ত্রিত্ববাদ ও শিরকে লিপ্ত হয়।”
৪️ “فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنتَ أَنتَ ٱلرَّقِيبَ عَلَيْهِمْۚ”
— “কিন্তু যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন, তখন আপনি ছিলেন তাদের তত্ত্বাবধায়ক।”
এখানে “تَوَفَّيْتَنِي” (তাওয়াফ্ফাইতানী) মানে মৃত্যু নয়, বরং **উচ্চে তুলে নেওয়া (رفع)**, যেমন (সূরা আন-নিসা ৪:১৫৮)-এ বলা হয়েছে: “আল্লাহ তাঁকে (ঈসা) নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন।” ঈসা (আঃ) আল্লাহর কাছে স্বীকার করছেন যে — তাঁর অনুপস্থিতিতে আল্লাহই তাদের উপর নজর রেখেছেন, এবং তিনি সবকিছুর সাক্ষী।
৫️ “وَأَنتَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ شَهِيدٌ”
— “আপনি তো সব কিছুরই সাক্ষী।”
এটি ঈসা (আঃ)-এর বিনয়পূর্ণ ঘোষণা — যে আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টির বাইরে কিছুই ঘটে না। আল্লাহ সব জাতি, নবী, কর্ম, ও অন্তর সম্পর্কে জানেন। এটি আল্লাহর **পরম ক্ষমতা ও সর্বজ্ঞতার** ঘোষণা। 📖 (সূরা হাজ্জ ২২:১৭) “আল্লাহ বিচার করবেন সব জাতির মধ্যে; নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর সাক্ষী।”
৬️ শিক্ষা ও ব্যাখ্যা:
- ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত ছিল তাওহীদের দাওয়াত — আল্লাহর একত্বের আহ্বান।
- নবীগণ নিজ ইচ্ছায় কিছু বলেন না, কেবল আল্লাহর আদেশ অনুসরণ করেন।
- ঈসা (আঃ) জীবিত থাকা পর্যন্ত তাঁর উম্মত সঠিক পথে ছিল।
- আল্লাহ সর্বদা তাঁর বান্দাদের উপর নজর রাখেন।
- আল্লাহই সর্বজ্ঞ সাক্ষী; মানুষের আমল তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।
৭️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- নবীদের প্রকৃত শিক্ষা বুঝে তা অনুসরণ করাই ঈমানের নিদর্শন।
- মানুষকে তাওহীদ থেকে বিচ্যুত করলে সেটি সবচেয়ে বড় অন্যায়।
- আল্লাহর সব কিছু জানার ক্ষমতা আমাদের জবাবদিহিতার স্মারক।
- আজও কুরআন সেই দাওয়াত দিচ্ছে — “আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি তোমার রব।”
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “কিয়ামতের দিন প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতের উপর সাক্ষ্য দেবেন; আর আমার উম্মত হবে অন্যান্য জাতির উপর সাক্ষ্যদানকারী।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩৩৯)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৭):
- নবীগণ আল্লাহর ওহীর অনুসারী, স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তগ্রাহী নন।
- ঈসা (আঃ)-এর শিক্ষা ছিল বিশুদ্ধ তাওহীদভিত্তিক।
- আল্লাহ সর্বদা বান্দাদের তত্ত্বাবধায়ক।
- নবীদের পর তাঁদের অনুসারীদের দায়িত্ব আল্লাহর বিধান মেনে চলা।
উপসংহার:
এই আয়াতে নবী ঈসা (আঃ)-এর মুখে আল্লাহর তাওহীদের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি এসেছে।
তিনি বলেছেন — “আমি শুধু সেই কথাই বলেছি যা আপনি বলেছেন।”
অর্থাৎ, ঈমানের প্রকৃত ভিত্তি হলো **আল্লাহর ইবাদত** এবং **তাঁর একত্বে বিশ্বাস**।
এই আয়াত শেখায় —
নবীগণ আল্লাহর বার্তা প্রেরক, তাঁরা উপাস্য নন।
এবং আল্লাহ সবকিছুর উপর তত্ত্বাবধায়ক, সাক্ষী ও সর্বজ্ঞ।
🌿 আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন ঈমান দিন —
যা তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং নবীগণের পথের অনুসারী।
📖 “مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَآ أَمَرْتَنِي بِهِۦٓ
أَنِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْۚ
وَكُنتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدٗا مَّا دُمْتُ فِيهِمْۖ
فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنتَ أَنتَ ٱلرَّقِيبَ عَلَيْهِمْۚ
وَأَنتَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ شَهِيدٌ”
“আমি তাদের বলিনি, শুধু তাই বলেছি যা আপনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন —
‘আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমারও রব ও তোমাদেরও রব।’
আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন তাদের উপর নজর রাখতাম;
কিন্তু যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন, আপনি ছিলেন তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক;
আপনি তো সব কিছুরই সাক্ষী।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৭)
এই আয়াতে নবী ঈসা (আঃ) তাঁর জবাবের শেষ অংশে আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ বিনয়, মমতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। এটি আল্লাহর দরবারে একজন নবীর দোয়া, যেখানে দয়া ও ন্যায়বিচার উভয়ের ভারসাম্য ফুটে উঠেছে। ঈসা (আঃ) বলেন — “হে আল্লাহ, তারা যদি কুফরি করে থাকে, তবু তারা আপনারই বান্দা। আপনি যদি চান, শাস্তি দিন; আর যদি চান, ক্ষমা করুন — আপনি পরাক্রমশালী, আপনি প্রজ্ঞাময়।” এটি নবী ঈসা (আঃ)-এর **দয়া, বিনয় ও আল্লাহর বিচার ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা** প্রকাশ করে।
১️ “إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ”
— “আপনি যদি তাদের শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনারই বান্দা।”
ঈসা (আঃ) তাঁর জাতির শিরক ও বিভ্রান্তি সম্পর্কে বলছেন — যদি আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন, তবে তা ন্যায়সঙ্গত। কারণ, তারা আল্লাহর একত্ব অস্বীকার করেছে এবং নবীর শিক্ষা বিকৃত করেছে। কিন্তু ঈসা (আঃ)-এর বাক্যভঙ্গি লক্ষ্য করো — তিনি সরাসরি ‘তাদের শাস্তি দাও’ বলেননি, বরং বলেছেন — ‘যদি শাস্তি দেন’, যা তাঁর করুণা ও কোমল হৃদয়ের প্রতিফলন।
📖 ইবন কাসির বলেন — “এই বাক্যে ঈসা (আঃ) নিজের উম্মতের জন্য আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করছেন, যেন শাস্তির পরিবর্তে ক্ষমা প্রাধান্য পায়।”
২️ “وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ”
— “আর আপনি যদি তাদের ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”
ঈসা (আঃ) আল্লাহর অসীম দয়া ও প্রজ্ঞার উপর ভরসা করছেন। তিনি জানেন, আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন, কারণ তাঁর ক্ষমা সীমাহীন এবং তাঁর সিদ্ধান্ত সর্বদা প্রজ্ঞাপূর্ণ। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ঈসা (আঃ) বলেননি — “ফা ইন্নাকা আনতা আল-গফূরুর রহীম” (ক্ষমাশীল ও দয়ালু), বরং বলেছেন — **“আল-‘আযীযুল হাকীম”**, অর্থাৎ “পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” কেন? কারণ এটি এমন এক গুরুতর বিষয়, যেখানে আল্লাহর ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞার ঘোষণা প্রাধান্য পায়। যেন কেউ মনে না করে, আল্লাহর ক্ষমা অন্যায়ের পরিণতি বাতিল করে দেয়।
📖 ইমাম রাযি বলেন — “ঈসা (আঃ)-এর এই দোয়া আল্লাহর দয়া ও ন্যায়বিচারের পরিপূর্ণ সমন্বয়।”
৩️ এই দোয়া কী শেখায়?
এটি নবীদের নরম মনের এক উদাহরণ। ঈসা (আঃ) তাঁর উম্মতের ভুল থাকা সত্ত্বেও তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। একইসাথে এটি আল্লাহর বিচার ব্যবস্থার গভীরতাও বোঝায় — তিনি যদি শাস্তি দেন, তাতে অন্যায় নেই; আর যদি ক্ষমা করেন, তাতেও তাঁর প্রজ্ঞা প্রকাশ পায়।
📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ এই আয়াত পাঠ করে একবার কেঁদেছিলেন এবং বলেছিলেন — “হে আল্লাহ! আপনি যদি আমার উম্মতকে শাস্তি দেন, তারা আপনারই বান্দা; আর আপনি যদি ক্ষমা করেন, আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৬)
৪️ শিক্ষনীয় দিক:
- নবীগণ তাঁদের উম্মতের জন্য সর্বদা দয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
- আল্লাহর দয়া ও ন্যায়বিচার একসাথে পরিপূর্ণ।
- আল্লাহর বান্দা হওয়া মানে তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
- ক্ষমা আল্লাহর ক্ষমতার দুর্বলতা নয়, বরং তাঁর প্রজ্ঞার নিদর্শন।
৫️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- আমাদেরও উচিত ঈসা (আঃ)-এর মতো অন্যের জন্য ক্ষমা ও দয়া চাওয়া।
- আল্লাহর ন্যায়বিচারের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা ঈমানের চিহ্ন।
- আল্লাহর শাস্তি ন্যায্য, আর তাঁর ক্ষমা সীমাহীন — এই ভারসাম্যই ঈমান।
- ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে ফিরে আসা সবসময় উত্তম।
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৮):
- ঈসা (আঃ)-এর দোয়া নবীদের হৃদয়ের কোমলতার উদাহরণ।
- আল্লাহর দয়া ও প্রজ্ঞা তাঁর বিচারব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
- মানুষের অপরাধ ক্ষমা বা শাস্তি — উভয়ই আল্লাহর জ্ঞানে সঠিক সিদ্ধান্ত।
- আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সন্তুষ্টি মুমিনের গুণ।
উপসংহার:
এই আয়াতে নবী ঈসা (আঃ)-এর মুখে নবুয়তের হৃদয় ফুটে উঠেছে —
বিনয়, দয়া ও আল্লাহর প্রজ্ঞার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা।
এটি শেখায় —
আল্লাহর শাস্তি ভয়াবহ, কিন্তু তাঁর দয়া সীমাহীন;
উভয়ের ভারসাম্যই একটি মুমিন হৃদয়কে দৃঢ় রাখে।
আল্লাহ আমাদের এমন ঈমান দিন,
যা তাঁর বিচার মেনে নেয়, এবং দয়া কামনায় অবিচল থাকে 🌿
📖 “إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَۖ
وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ”
“আপনি যদি তাদের শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনারই বান্দা;
আর আপনি যদি তাদের ক্ষমা করেন,
তবে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৮)
এই আয়াতে কিয়ামতের দিনের এক গৌরবময় ঘোষণা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সেই দিনে বলবেন — “আজ হলো সত্যবাদীদের দিন”, যখন তাঁদের সত্যনিষ্ঠা ও ঈমানী সততা প্রকৃত পুরস্কার লাভ করবে।
এটি হলো সেই দিন, যখন মিথ্যা, ভণ্ডামি, কপটতা, আর কুফরি সব ব্যর্থ হয়ে যাবে, কিন্তু সত্যবাদীদের সততা হবে মুক্তির মূল চাবিকাঠি।
১️ “قَالَ ٱللَّهُ هَـٰذَا يَوْمُ يَنفَعُ ٱلصَّـٰدِقِينَ صِدْقُهُمْۚ”
— “আল্লাহ বলবেন: আজ সেই দিন, যেদিন সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে।”
এখানে “সিদক” (সত্যবাদিতা) শুধু মুখের সত্য বলা নয়, বরং ঈমান, আমল, দাওয়াহ, ও প্রতিশ্রুতিতে সত্য থাকা বোঝায়। অর্থাৎ, যারা দুনিয়ায় আল্লাহর পথে সত্যে অটল ছিল, কিয়ামতের দিন সেই সত্য তাদের রক্ষা করবে। 📖 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সত্য মানুষকে নেকির দিকে নিয়ে যায়, আর নেকি জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।” (📖 সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬০৯৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬০৭)
২️⃣ “لَهُمْ جَنَّـٰتٞ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ”
— “তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে; তারা তাতে চিরকাল অবস্থান করবে।”
আল্লাহ সত্যবাদীদের জান্নাত দান করবেন — যেখানে থাকবে অবিরাম শান্তি, সুখ ও আনন্দ। নদীর প্রবাহ এখানে প্রতীক — চিরন্তন জীবনের, পুনরুজ্জীবনের এবং আনন্দের ধারাবাহিকতার। 📖 (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৫) “তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার নিচে প্রবাহিত হবে বিশুদ্ধ জলের নদী, দুধ, মধু ও মদের নদী।”
৩️ “رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُۚ”
— “আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন, আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হবে।”
এটি জান্নাতের সর্বোচ্চ পুরস্কার — **আল্লাহর সন্তুষ্টি।** জান্নাতের সকল নেয়ামতের চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিই বড়। 📖 (সূরা আত-তাওবা ৯:৭২) “আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ — এটাই মহাসাফল্য।”
“রদিয়াল্লাহু ‘আনহুম” মানে — আল্লাহ তাদের প্রতি খুশি। আর “রাদূ ‘আনহু” মানে — তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট।
এটি এক **পারস্পরিক সন্তুষ্টির দৃশ্য**, যা মুমিন ও প্রভুর মাঝে চিরন্তন সম্পর্কের প্রতীক।
৪️ “ذَٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ”
— “এটাই হলো মহাসাফল্য।”
পৃথিবীর সাফল্য সাময়িক — কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের স্থায়িত্বই প্রকৃত **ফাওযুল আযীম** (মহাসাফল্য)। 📖 (সূরা আল-আসফ ৬১:১২) “আল্লাহ তোমাদের জান্নাত দান করবেন; এটাই মহাসাফল্য।”
৫️ এই আয়াতের তাৎপর্য:
এটি পুরো সূরা আল-মায়েদার **উপসংহারমূলক বার্তা**। সূরার শুরুতে আল্লাহ বলেছিলেন — “চুক্তি পূর্ণ করো” (৫:১), আর শেষে বলছেন — “আজ সত্যবাদীরা পুরস্কৃত হবে।” অর্থাৎ, যারা সত্যে অটল থেকেছে, তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছে।
📖 ইবন কাসির বলেন — “এই আয়াত হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের প্রতি সম্মাননামা।”
৬️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- সত্যবাদিতা কেবল একটি গুণ নয়, এটি ঈমানের প্রমাণ।
- মিথ্যা ও ভণ্ডামি অস্থায়ীভাবে লাভ দেয়, কিন্তু পরিণতি ধ্বংস।
- জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য আল্লাহর সন্তুষ্টিতে নিহিত।
- সত্যবাদীরা দুনিয়ায় পরীক্ষিত হলেও, আখিরাতে সর্বাধিক সম্মানিত হবে।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে তুমি মুক্তির পথে থাকবে, যদিও সত্যের পথে কষ্ট আছে।” (📖 সহিহ তিরমিজি, হাদিস: ১৯৮৭)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১১৯):
- কিয়ামতের দিন সত্যবাদীদের সত্যই তাদের রক্ষা করবে।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি জান্নাতের সর্বোচ্চ নেয়ামত।
- সত্যবাদিতা ঈমানের পরিচয় ও জান্নাতের নিশ্চয়তা।
- সত্যের পথে অটল থাকা পৃথিবীর সেরা সাফল্যের চেয়েও মহৎ।
উপসংহার:
এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন —
সত্যবাদীদের জন্য রয়েছে জান্নাত,
এবং তাঁদের প্রতি আল্লাহর চিরন্তন সন্তুষ্টি।
এটি পুরো সূরা আল-মায়েদার শেষ ও পরিপূর্ণ বার্তা —
তাওহীদ, সততা, চুক্তি পূরণ ও সত্যবাদিতার মাধ্যমে চিরন্তন মুক্তি।
🌿 আল্লাহ আমাদেরকেও সেই সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত করুন,
যাদের জন্য আল্লাহ বলবেন —
“আজ সত্যবাদীদের সত্যই তাদের উপকারে এলো।”
📖 “قَالَ ٱللَّهُ هَـٰذَا يَوْمُ يَنفَعُ ٱلصَّـٰدِقِينَ صِدْقُهُمْۚ
لَهُمْ جَنَّـٰتٞ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ
رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُۚ
ذَٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ”
“আল্লাহ বলবেন — আজ সেই দিন, যেদিন সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে।
তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে;
তারা তাতে চিরকাল থাকবে।
আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন, আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হবে।
এটাই হলো মহাসাফল্য।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১১৯)
এই আয়াতটি সূরা আল-মায়েদার **শেষ আয়াত** এবং সূরাটির সারাংশকে এক বাক্যে প্রকাশ করেছে — আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, শক্তি ও সর্বজ্ঞতার ঘোষণা। এটি এমন একটি সমাপ্তি, যা **তাওহীদের পূর্ণতা** ঘোষণা করে। পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ সত্যবাদীদের পুরস্কারের কথা বলেছেন (৫:১১৯), আর এই আয়াতে তিনি জানান — সমস্ত ক্ষমতা, বিচার ও পুরস্কারের মালিক একমাত্র **আল্লাহই**।
১️ “لِلَّهِ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ”
— “আসমান ও জমিনের মালিকানা আল্লাহর জন্য।”
এটি আল্লাহর সার্বভৌম রাজত্বের ঘোষণা। সমস্ত সৃষ্টি, সব কিছুর মালিক, নিয়ন্ত্রক ও শাসক একমাত্র আল্লাহ। এই বাক্যটি বোঝায় — পৃথিবীর রাজা, ধন-সম্পদ, ক্ষমতা সবই সাময়িক। কিন্তু আল্লাহর মালিকানা চিরন্তন ও সর্বব্যাপী। 📖 (সূরা বাকারাহ ২:২৫৫) “তাঁরই জন্য যা কিছু আসমান ও জমিনে আছে।”
২️ “وَمَا فِيهِنَّۚ”
— “এবং যা কিছু তন্মধ্যে রয়েছে।”
অর্থাৎ, শুধু আসমান ও জমিন নয়, বরং এর ভেতরে থাকা সমস্ত প্রাণী, ফেরেশতা, মানুষ, জিন, নক্ষত্র, এমনকি আমাদের চিন্তার বাইরের জগতও আল্লাহরই সৃষ্টি ও অধীনে। এটি আল্লাহর সৃষ্টির **সম্পূর্ণ সার্বিকতা** প্রকাশ করে — দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, পরিচিত ও অজানা, সবই তাঁর ইচ্ছার অধীন। 📖 (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৮৩) “যিনি কোনো কিছুকে অস্তিত্বে আনতে চান, বলেন ‘হও’, আর তা হয়ে যায়।”
৩️ “وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ قَدِيرُۢ”
— “আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।”
এটি আল্লাহর **কুদরতের পূর্ণ ঘোষণা।** অর্থাৎ — আল্লাহর পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি সৃষ্টি করতে পারেন, ধ্বংস করতে পারেন, পুনরুত্থিত করতে পারেন, এবং একই সাথে সবকিছু পরিচালনা করতে পারেন। এই বাক্যটি কুরআনে বহুবার এসেছে, যেন মানুষ মনে রাখে — আল্লাহর শক্তির কোনো সীমা নেই। 📖 (সূরা ইমরান ৩:২৬–২৭) “বলুন, হে আল্লাহ! রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন, যাকে ইচ্ছা তা কেড়ে নেন। আপনি যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দেন, যাকে ইচ্ছা অপমান করেন। আপনারই হাতে সমস্ত কল্যাণ; নিশ্চয়ই আপনি সর্বশক্তিমান।”
৪️ এই আয়াতের গভীর অর্থ:
এই আয়াতে আল্লাহর **তাওহীদের তিন দিক** একসাথে প্রকাশ পেয়েছে —
- তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ: আল্লাহই মালিক, সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক।
- তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ: তিনিই একমাত্র উপাস্য, তাঁরই ইবাদত প্রাপ্য।
- তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাত: তাঁরই সকল গুণ ও ক্ষমতা পূর্ণ ও নিখুঁত।
এই এক আয়াতের মাধ্যমেই সূরা আল-মায়েদা তাওহীদের আলোয় শেষ হয়েছে।
৫️ সূরা আল-মায়েদার উপসংহার:
সূরা আল-মায়েদা শুরু হয়েছিল আল্লাহর বিধান ও চুক্তি পালনের নির্দেশ দিয়ে (৫:১), আর শেষ হয়েছে আল্লাহর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও বিচার ঘোষণা দিয়ে (৫:১২০)। অর্থাৎ — সূরার শুরুতে ছিল "আমল", শেষে "আখিরাতের ফয়সালা"। এতে বোঝা যায়, যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলে, তারা তাঁর রাজত্বে সফল; আর যারা অবাধ্য হয়, তারা ক্ষতিগ্রস্ত।
📖 ইবন কাসির বলেন — “এই আয়াত কুরআনের এমন একটি মহৎ সমাপ্তি, যা আল্লাহর রাজত্ব, শক্তি ও সার্বভৌমত্বের পূর্ণ ঘোষণা।”
৬️ শিক্ষনীয় দিক:
- আল্লাহই আসমান-জমিন ও সবকিছুর প্রকৃত মালিক।
- সৃষ্টির কোনো কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।
- আল্লাহ সর্বশক্তিমান; তিনি যাকে চান সম্মান বা অপমান দান করেন।
- তাওহীদের তিন দিক — মালিকানা, উপাসনা, ও গুণাবলিতে একত্ব — এখানেই প্রতিফলিত।
৭️ আধুনিক যুগের শিক্ষা:
- দুনিয়ার রাজনীতি, ক্ষমতা বা সম্পদ সাময়িক; চিরস্থায়ী ক্ষমতা আল্লাহর।
- যে ব্যক্তি আল্লাহর রাজত্ব স্বীকার করে, তার হৃদয়ে শান্তি নেমে আসে।
- আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা আমাদের ঈমানের মূল ভিত্তি।
- সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে; তাই তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা) তাঁর উপরই থাকা উচিত।
সম্পর্কিত হাদিস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “আল্লাহর হাতে রয়েছে আসমান ও জমিনের সমস্ত ক্ষমতা; তিনি যা চান, তা বলেন ‘হও’, আর তা হয়ে যায়।” (📖 সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৫৪)
শিক্ষনীয় বিষয় (আয়াত ১২০):
- আল্লাহই সকল কিছুর মালিক, শাসক ও বিচারক।
- মানুষের রাজত্ব সাময়িক, আল্লাহর রাজত্ব চিরন্তন।
- আল্লাহর কুদরত সীমাহীন — কিছুই তাঁর বাইরে নয়।
- আল্লাহর তাওহীদই সব নবী-রাসূলের দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু।
উপসংহার:
এই শেষ আয়াতটি সূরা আল-মায়েদার সমাপ্তি ঘোষণা করছে এক মহান বাণীতে —
“সবকিছুই আল্লাহর মালিকানায়, আর তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাশালী।”
এটি কুরআনের এক গভীর স্মরণ —
মানুষ ভুলে গেলেও, আল্লাহ কখনো নিয়ন্ত্রণ হারান না।
🌿 আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন ঈমান দিন,
যাতে আমরা সর্বদা বলি —
“লিল্লাহি মালিকুল মুলক” — রাজত্ব কেবল আল্লাহরই জন্য।
📖 “لِلَّهِ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّۚ
وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٖ قَدِيرُۢ”
“আসমান ও জমিন এবং যা কিছু তন্মধ্যে রয়েছে —
সবকিছুরই মালিকানা আল্লাহর জন্য।
আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।”
— (সূরা আল-মায়েদা ৫:১২০)