ইসলাম এমন একটি জীবনবিধান যা নারীকে জন্মের পর থেকেই সম্মান ও অধিকার দিয়েছে— শিক্ষা, বিবাহ, সম্পত্তি, নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারীকে পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করেছে। মানুষের দৃষ্টিতে নয়, আল্লাহর দৃষ্টিতে তাকওয়া ও নেক আমলই হল আসল মানদণ্ড; নারী বা পুরুষ হওয়া নয়।
বর্তমান যুগে অনেকেই ধারণা করেন, ইসলাম নাকি নারীদের অধিকার কমিয়েছে বা তাদের পিছিয়ে রেখেছে। অথচ সত্য হলো—ইসলামই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে নারীকে স্বতন্ত্র সত্তা, আইনগত অধিকার এবং সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম নারীর জন্য এমন সব অধিকার স্বীকৃত করেছে, যা জাহেলিয়াত যুগে কল্পনাও করা যেত না।
ইসলাম আগমনের আগে আরবসহ দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে নারীরা ছিল অবহেলিত ও পদদলিত। অনেক স্থানে কন্যা সন্তান জন্মই ছিল “অপমান” মনে করা; কেউ কেউ কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিচাপা দিত। স্ত্রীকে উত্তরাধিকার সহ সম্পত্তির মতো করে ব্যবহার করা হতো, নারীর কোনো নিজস্ব মতামত বা সম্পত্তির অধিকার ছিল না।
ইসলাম এসে এই অমানবিক প্রথার মূলোৎপাটন করেছে, নারীর জীবন, সম্মান ও অধিকারকে পবিত্র ঘোষণা করেছে।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, তিনি সমগ্র মানবজাতিকেই সম্মানিত করেছেন— সেখানে নারী–পুরুষের মধ্যে কোনো হীন–মহান পার্থক্য নেই, বরং তাকওয়া ও নেক আমলই আসল মানদণ্ড।
আরেক স্থানে আল্লাহ তাআলা বলেন, নারী–পুরুষ উভয়ে যদি ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তবে উভয়কেই তিনি সুন্দর জীবন ও পরকালে পুরস্কার দান করবেন। এর মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ইবাদত, জ্ঞান ও আখিরাতের পুরস্কারে নারী–পুরুষ সমান সুযোগপ্রাপ্ত।
ইসলাম নারীকে ইবাদত ও নেক আমলের ক্ষেত্রে পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ—সব ফরজ ইবাদতেই নারী–পুরুষের উপর একসাথে বিধান এসেছে। ঈমান, আখিরাত, জান্নাত ও জাহান্নামের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে নারীর আমলও ঠিক ততটাই মূল্যবান, যতটা একজন পুরুষের আমল।
শিক্ষার অধিকার ইসলামে নারী–পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান। প্রিয় নবী ﷺ বলেছেন (অর্থ), “ইলম হাসিল করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ।” এ হাদিসের মধ্যে নারী–পুরুষ উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখি—রাসূল ﷺ–এর স্ত্রীগণ, বিশেষ করে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযি.), অসংখ্য হাদিস, ফিকহ ও ইলমের উৎস ছিলেন। অনেক সাহাবী ও তাবেঈন তাঁর কাছে জ্ঞান অর্জন করতেন। এটি প্রমাণ করে, ইসলাম নারীদেরকে শুধু পড়াশোনার অনুমতি নয়, বরং উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞান পরিবেশনের সম্মানজনক স্থান দিয়েছে।
ইসলাম নারীদেরকে স্বাধীন আর্থিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ নারী তার নিজের উপার্জন, মোহরানা, উপহার বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপর সম্পূর্ণ মালিকানা রাখে। এ সম্পত্তি ব্যবহার, সঞ্চয় বা কাউকে দেওয়ার ব্যাপারে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে; স্বামী বা অভিভাবক তার সম্পত্তির ওপর জোর করে কর্তৃত্ব করতে পারে না।
ইসলাম কন্যা সন্তান, স্ত্রী ও মাকে স্পষ্টভাবে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। আগে যেখানে নারীরা নিজেই সম্পত্তি ছিল, ইসলাম সেখানে নারীকেই সম্পত্তির অধিকারী বানিয়েছে।
ইসলামে বিবাহ শুধু একটি সামাজিক চুক্তি নয়; এটি ইবাদত ও মহান সুন্নাহ। এখানে নারীকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে:
ইসলাম মাকে অতুলনীয় মর্যাদা দিয়েছে। এক ব্যক্তি রাসূল ﷺ–কে জিজ্ঞাসা করলেন, কার সাথে ভালো ব্যবহার করব? তিনি তিনবারই বললেন, “তোমার মা”, তারপর বললেন “তোমার বাবা”।
এর দ্বারা বোঝা যায়, পরিবার ও সমাজে নারী—বিশেষ করে মা—একটি বিশাল সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত। সন্তান লালন–পালন, পরিবার গঠন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দ্বীন শেখানোর ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইসলামে তা সওয়াবের বিশাল ক্ষেত্র।
প্রাথমিক ইসলামী সমাজে নারীরা ইলম, দাওয়াত, চিকিৎসা, পরামর্শ ও সমাজ গঠনের বিভিন্ন সৎকর্মে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁরা মসজিদের শিক্ষা–পরিবেশে আসতেন, ফিকহ ও হাদিস শিখতেন, প্রয়োজনে প্রশ্ন করতেন, প্রয়োজনীয় পর্দা ও শালীনতা বজায় রেখে নানা সেবামূলক কাজ করতেন।
আজকের যুগেও একজন মুসলিম নারী শিক্ষিকা, ডাক্তার, লেখক, দাওয়াতি কর্মী, মাদরাসা বা স্কুলে উপদেষ্টা— নানাভাবে সমাজে ভূমিকা রাখতে পারেন—শর্ত শুধু এই যে, ইসলামী পর্দা, হালাল–হারামের সীমা ও লজ্জাশীলতা বজায় রাখতে হবে।
ইসলাম নারী–পুরুষের মধ্যে জীববৈজ্ঞানিক ও মানসিক পার্থক্যকে স্বীকার করে, তাই দায়িত্ব ও ভূমিকা পুরোপুরি একই নয়; তবে আল্লাহর কাছে মর্যাদার মানদণ্ড একটাই—তাকওয়া। কেউ নারী হওয়ার কারণে নিকৃষ্ট নয়, আবার পুরুষ হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠও নয়।
ঘরের ভেতরে ও বাইরে দু’জায়গাতেই নারী–পুরুষ একে–অপরের সহযাত্রী। কেউ কাউকে প্রতিযোগী নয়; বরং উভয়েই পরিপূরক। এভাবেই ইসলাম পরিবার, সমাজ ও সভ্যতার ভারসাম্য রক্ষা করে।
সারসংক্ষেপে বলা যায়—ইসলাম নারীকে দিয়েছে জীবনের নিরাপত্তা, ইবাদতের স্বাধীনতা, শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, বিবাহ ও বৈবাহিক জীবনে সম্মান, এবং মা, কন্যা, বোন ও স্ত্রী—প্রতিটি পরিচয়ে সম্মানজনক স্থান।
তাই “ইসলাম নারীবিদ্বেষী” এই ধারণা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছে। যে কেউ কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করবে এবং প্রাথমিক ইসলামী সমাজের বাস্তবতা দেখবে, সে অবশ্যই বুঝতে পারবে—নারীর প্রকৃত মর্যাদা ও স্বাধীনতার পথ ইসলামই দেখিয়েছে।
আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে—অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও সাংস্কৃতিক অন্যায় আচরণকে ইসলাম হিসেবে প্রচার না করে, কুরআন–সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা অনুযায়ী নারীদের হক আদায় করা এবং তাদের প্রতি ন্যায় ও দয়া প্রদর্শন করা।
ইসলাম একজন মুসলিম পুরুষকে শুধু পরিবার নয়, সমাজ, ইবাদত, চরিত্র ও নৈতিকতার প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পরিবারকে রক্ষা, স্ত্রী-সন্তানের হক আদায়, রিজিক উপার্জন, দ্বীনি শিক্ষার প্রচার এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা—এসবই একজন মুসলিম পুরুষের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
ইসলাম পুরুষকে নেতৃত্ব, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার বিশেষ স্থান দিয়েছে। এই দায়িত্ব কোনো আধিপত্য নয়, বরং করুণা, ন্যায়, দায়িত্ববোধ ও ত্যাগের ভিত্তিতে গঠিত। একজন সত্যিকারের মুসলিম পুরুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
এখানে “কাওয়াম” অর্থ কর্তৃত্ব নয়, বরং সুরক্ষা, দায়িত্ব গ্রহণ, রিজিক উপার্জন, নেতৃত্ব ও দেখভাল করা। তাই একজন মুসলিম পুরুষের প্রথম দায়িত্ব হলো তার পরিবারকে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও ইসলামী নীতিতে গড়ে তোলা।
একজন মুসলিম পুরুষের সর্বোচ্চ দায়িত্বগুলোর একটি হলো পরিবারকে হালাল খাবার, হালাল পোশাক ও হালাল জীবিকা প্রদান করা। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—
হারাম উপার্জন শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই নিষিদ্ধ ব্যবসা, সুদ, জুলুম, প্রতারণা থেকে দূরে থাকা এবং পরিশ্রম করে হালাল আয়ের পথ অনুসন্ধান করা মুসলিম পুরুষের বড় দায়িত্ব।
একজন মুসলিম পুরুষ ইবাদতে শক্তিশালী হলে তার পরিবারও সঠিক পথে পরিচালিত হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, যাকাত ও হজ্জ—এসব ফরজ ইবাদতে সচেতন থাকা একজন পুরুষের মৌলিক দায়িত্ব।
কুরআনে বলা হয়েছে—
এর মানে হলো—নিজে নেক আমল করা এবং পরিবারকেও নেক আমল শেখানো পুরুষের স্পষ্ট দায়িত্ব।
একজন মুসলিম পুরুষ তার চরিত্র ও আচরণের মাধ্যমেই ইসলামকে উপস্থাপন করে। রসূল ﷺ বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সর্বোত্তম।” সহীহ বুখারী-৩৫৫৯
স্ত্রীকে সম্মান, ভালোবাসা, ব্যয়ভার বহন, নিরাপত্তা এবং মানসিক প্রশান্তি প্রদান করা একজন মুসলিম পুরুষের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
বাবা শুধু অভিভাবক নন; তিনি সন্তানদের প্রথম শিক্ষক। সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া, ইসলাম শেখানো, হালাল-হারাম বোঝানো এবং চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্পূর্ণ বাবার দায়িত্ব।
একজন সত্যিকারের মুসলিম পুরুষ সমাজে ন্যায়, করুণা, শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। সে কখনো জুলুম, অন্যায়, বিভেদ বা দুর্নীতিতে সহযোগিতা করে না।
একজন মুসলিম পুরুষের দায়িত্ব শুধু নিজের পরিবারই নয়, বরং পুরো সমাজকে দ্বীনের দিকে আহ্বান করা— জ্ঞান, আচরণ ও কর্মের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা।
রসূল ﷺ বলেছেন—
একজন আদর্শ মুসলিম পুরুষ এমন ব্যক্তি, যিনি আল্লাহকে ভয় করেন, পরিবারকে ভালোবাসেন, স্ত্রী ও সন্তানকে সম্মান করেন, হালাল উপার্জন করেন, উত্তম চরিত্রের অধিকারী হন এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে শক্তি, নেতৃত্ব বা মর্যাদার আসল মানদণ্ড হলো—তাকওয়া, সততা ও ন্যায়। এই গুণগুলো অর্জন করলেই একজন মুসলিম পুরুষ দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার অধিকারী হতে পারে।